আকাশনিম গাছের ঘন সবুজ পাতায় নরম রোদের আয়েশি সময় এখন। বাতাসের গা জুড়ে হিমের উঁকিঝুকি। বড়ঘর লাগোয়া চিলতে ফাঁকা জায়গায় লতিয়ে ওঠা আশ্বিনা শিমে মাচা পড়েছে।
সেই মাচায় জড়িয়ে থাকা শিম লতায় আমার যত না আগ্রহ, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ সে তলায় ছড়িয়ে থাকা আকাশনিম ফুলে।
আমাদের বাড়ির আকাশনিম গাছটা বহু পুরোনো। উঠোনের পেয়ারা গাছের থেকেও পুরোনো। কলতলার টিনের চাল ছুঁইয়ে থাকা কাঁচামিঠে আমগাছের থেকেও পুরোনো।
বড়ঘরের কোনায় আকাশনিম গাছটা বুনে দিয়েছিলেন মধু দাদু, কোনো এক ষষ্ঠীতে।
মধু দাদু, ঠাকুমার মেজো ভাই। পিঠেপিঠি হাওয়ার জন্য কিনা জানি না ঠাকুমার মুখে এই মধু দাদুর গল্প বেশী শোনা যায়।
‘রাঙাদা এত এত দুধ মাখন খেতো বলেই তো গায়ের রঙ অমন টকটকে ছিলো।’
অথবা,
‘রাঙাদা স্বদেশি করতো। অনেক সাহসী ছিলো এর জন্য। কানাই ডাকাতের দলকে ধাওয়া করে একবার তো এক ডাকাতকেও ধরে ফেলেছিলো।’
কিংবা
‘রাঙা দা কখনই ওপারে যেতে চায়নি। বাড়ির বাসন্তী মন্দির লুট করে নেওয়া প্রতিবেশীর সঙ্গে ওভাবে তর্কে না জড়ালে আজ রাঙা দা এপারেই থাকতো।’
মধু দাদুর টকটকে রঙ আর সাহসী চরিত্রের ছবি অবশ্য কল্পনায় একটা বড়সড় আঁচড় ফেলার আগেই আমি মানুষটাকে দেখে ফেলেছিলাম । দেখে ফেলেছিলাম কোনো এক নিস্তব্ধ ভর দুপুরে।
দুপুরের ভাতঘুমে ঠাকুমার কোলের ওম আমার সঙ্গে সবসময় লেপ্টে থাকে। তা একটু আলগা হয়ে এলেই আমার ঘুম ছুটে যায়। সেদিনও তেমন হলো। ওপাশ ফেরা ঠাকুমা। তাঁর শরীরটা একটু পরপর কেঁপে উঠছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। কী হলো আমার ঠাকুমার?
‘ও ঠাকুমা, ঠাকুমা...’
আমি হুড়মুড় করে উঠে বসি।
ঠাকুমার কাঁপুনি থেমে যায়। এপাশ ফেরে। আমার দিকে তাকায়। আঁচলের কোনা হাতে ধরা। চোখের কোলে জল।
‘ও ঠাকুমা...’
আমি ঠাকুমার গা ঘেঁষে বসি।
ঠাকুমা ফিক করে হেসে ফেলে।
‘ভয় পেয়েছো দিদি? কিছু হয়নি তো আমার।’
শীতলপাটির ওপর পড়ে থাকা একটা ছবি তুলে আমার সামনে ধরে ঠাকুমা। ঠাকুমার মুখের হাসিটা তখনও চোখের জলের কাছে ম্লান।
আমি ছবির দিকে তাকাই।হলদে হয়ে আসা সাদাকালো একটা ছবি। ছবির মানুষগুলোও কেমন আবছা আবছা। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। মানুষগুলোর পেছনে একটা ঘরের অস্পষ্ট অবয়ব।
এটা মা, এটা বাবা, এটা বড়দি, এটা মিনতি পিসিমা, এটা খুড়িমা, এটা জ্যাঠামশায়, এটা বুড়ি পিসিমা... ঠাকুমার আঙুলটা হঠাৎ থেমে যায়। থেমে যায় এক কোনায় দাঁড়ানো একটা লাজুক কিশোরী আর তার পাশে দাঁড়ানো ঢ্যাঙা এক যুবকের পাশে।
ঠাকুমা বিড়বিড় করে ওঠে, আমার ঠিক বিয়ের আগে বাসন্তী পূজার ছবি। রাঙা দা’র এই জামায় সুতো দিয়ে ফুল তুলে দিয়েছিলাম আমি।
মধু মামার অস্পষ্ট চেহারাটা খুব ভালো করে দেখার চেষ্টা করি। না, আমার কল্পনার সেই টকটকে আর সাহসী মধু মামা খুঁজে পাই না।
আমার আগ্রহ এবার কিশোরী লাজুক মেয়েটি। এটা কে?
ঠাকুমার হেঁয়ালী সুর, আমিও তো চিনতে পারছি না দিদি।
আমি একবার সেই ছবির কিশোরী মেয়ের দিকে তাকাই, আরেকবার ঠাকুমার মুখের দিকে। চওড়া কপাল আর একঢাল চুল দু’জনেরই একইরকম।
মধু দাদুর জন্য কীনা জানি না, আকাশনিম গাছটির প্রতি ঠাকুমার দরদ একটু অন্যরকম। অগ্রহায়ণ না আসতেই সে গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দেয়। গাছের গায়ে কোনো পরগাছা দেখলে ছেঁটে দেয়।
আর তারার মতো সাদা ফুলগুলো আসতে না আসতেই ঠাকুমার স্বগোতক্তি যথারীতি,
‘এবার গাছ ঝেঁপে ফুল আসবে দেখো।’
আর তাই আমিও শিমের মাচায় নিচে ছড়িয়ে থাকা আকাশনিম ফুল একটা একটা করে তুলে ঠাকুমার ফুলের সাজিতে জমাই।
আকাশনিম ফুল সাজিতে দেখলেই ঠাকুমার প্রসন্ন মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে,
‘রাঙা দা ওপাড়ের বাড়িতেও আকাশনিম গাছ লাগিয়েছে। চিঠিতে লিখেছিলো। ও গাছেও এখন ফুল এসেছে, তাই না দিদি?’
ঠাকুমার এই প্রশ্নে অদেখা একটি বাড়ি আমার কল্পনায় হামাগুড়ি দিতে শুরু করে।
ওদিকে দাদুর হাঁকডাক শুরু হয়ে গেছে। দাদুর গলা চড়া মানেই ঘড়ির কাঁটায় সময় দৌড়চ্ছে।উনুনে আঁচ পড়ে গেলো। গুড়ের চা আর সর্ষের তেল মাখা মুড়ি এ বাড়ির সকালের আলগা আয়েশ। বড়ঘরের মেঝেয় সারাদিনে এই একটি সময়েই সবাই পাটি পেতে বসে। আর দাদু কাঠের চেয়ারে গা এলিয়ে রেডিওর নব ঘুরায়।
কখনো সকাল সাতটার সংবাদ তো কখনো লালনগীতি। একইসঙ্গে চলে বাজারের ফর্দ তৈরি আর হাটের হিসাব। আবার কখনো কখনো রাশিয়া থেকে আসা সাহেব কাকুর সদ্য চিঠিখানার পুনর্পাঠ।
চায়ের আয়োজন ফুরিয়ে এলেই কেউ কলেজ, কেউ স্কুল আর কেউ তাঁতঘরের জন্য তৈরি হতে বড়ঘরের মেঝে শূন্য করে বেরিয়ে যায়।
আজও মেঝে শূন্য হবার আগে বাজারের ফর্দ লেখা হলো।বাজারের ফর্দে মাছ, আলুর সঙ্গে ঠাকুমা কিশমিশের নামও লিখে দিলো। গতকাল দাদু বাজার থেকে নতুন ওঠা বাঁধাকপি নিয়ে এসেছে।
আজ ঠাকুমা চাল বাঁধাকপি রান্না করবে।
উঠোনের রোদ লাল বারান্দায় উঠে আসার আগেই বাইরবাড়িতে রিক্সাওয়ালার হাঁক,
‘বাবু বাজার পাঠাইছে।’
আর এই একটি হাঁকে প্রতিবার এ বাড়িতে একইরকম প্রাণচাঞ্চল্য খেলে যায়।
সকালের পাত উঠে যাবার পরে কিছু সময়ের জন্য বাড়িটা থিতিয়ে আসে। মা বড়ঘরের বারান্দায় সুঁই-সুতা নিয়ে বসে। ঠাকুমা নরম হয়ে আসা কাঁথায় কম পুরাতন শক্ত কাপড়ের আবরণ বসায়। আর মনিপিসি কলেজ না থাকলে হয় পড়তে বসে, নয়তো কোহিনূর ফুপুর বাড়ি গল্প করতে যায়।
এ সময়টায় নি:স্তব্ধ বাড়ির আনাচকানাচ দখল করে নেয় তাঁত মাকুর শব্দ আর অচেনা পাখির একঘেঁয়ে ডাক।
তবে বাজারের ব্যাগ উঠোনে পড়তেই এ বাড়ির সুর বদলে যায়।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
বাজারের ব্যাগ উপুড় করতেই বেরিয়ে এলো পালং শাক, নতুন সাদা আলু, সবুজ বেগুন, লাল মূলা আর কাগজের ঠোঙায় ভরা কিসমিস। আজ মাছের ব্যাগে নওলা মাছ।
উনুনে নতুন আঁচ পড়ে। পালং শাকের সুক্তো, তিলবাটার পুরে মূলার বড়া, রাঁধুনি ফোড়নে বেগুন দিয়ে নওলা মাছ আর চাল বাঁধাকপির ঘন্ট।
তবে সবার আগে উনুনে উঠলো জলভরা লোহার কড়াই। এতে বাঁধাকপি ভাপানো হবে। ঠাকুমা খুব ঝুরি করে বাঁধাকপি কাটছে, বাঁধাকপি যত ঝুরি করে কাটা হবে স্বাদ তত খেলবে এর। তবে আমার মনোযোগ বাঁধাকপিতে নেই। সব মনোযোগ ঠাকুমার হাতের শাঁখা-পলা এক অদ্ভুত ছন্দ তুলছে তাতে। ক্রমাগত সে ছন্দ আমার লোভ বাড়িয়ে দিচ্ছে, ও ঠাকুমা, এবার রথের মেলা থেকে আমাকে ঠিক এমন চুড়ি কিনে দিবা?
ঠাকুমার হাত থেমে যায়। মুখের হাসিটা ম্লান, আমার দিদির তো শুধু আমাকে ছেড়ে যাবার শখ।
এমন চুড়ি পড়লে ঠাকুমাকে ছেড়ে যেতে হয়? আমি হাত দু’টো জামার কোঁচড়ে লুকিয়ে ফেলি।
বাঁধাকপি কাটা শেষ করে ঠাকুমা দু’টো বাটিতে আতপ চাল আর কিসমিস ভিজিয়ে রাখলো।
উনুনের জলে বলক আসতেই তাতে খানিক লবণ পড়লো। এরপরেই সেই বাঁধাকপির ঝুরি। হালকা সবুজ বাঁধাকপি লবণ জলে পড়তেই গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে। দুই বলক দিয়ে ঠাকুমা বাঁধাকপি জলসহ ঢেলে দেয় বাঁশের চালুনিতে। জল ঝরার জন্য।
এরমধ্যে নতুন আলু চেঁছে ডুমো করে কেটে নিয়েছে ঠাকুমা। তাতে এবার লবণ, হলুদ মাখিয়ে নেয়।
উনুনের কড়াইয়ে তেল পড়েছে। সেই তেল তেতে উঠতেই তাতে ডুমো আলু পড়ে। নেড়েচেড়ে সেগুলোর লাল করে নামিয়ে নিলো ঠাকুমা। এবার বেঁচে যাওয়া তেলে আতপ চালগুলো ভাজা হলে উনুন থেকে কড়াই নামে।
পেতলের খাবড়ি ওঠে উনুনে। তাতে পড়ে অনেকটা ঘি। তেজপাতা, শুকনো মরিচ আর জিরা ফোড়ন পড়ে। কড়াই থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ওঠতে শুরু করেছে। তাতে ঘি আর ফোড়নের ঘ্রাণ।
ফোড়ন কড়া হবার আগেই খাবড়িতে পড়ে ভাপানো বাঁধাকপি। হলুদ আর আদাবাটা পড়ে এরপর পরেই। আলতো নেড়ে মশলা মেশায় বাঁধাকপিতে। বেশ কয়েকটা কাঁচামরিচ আর ভাজা ডুমো আলু দিয়ে খাবড়িতে ঢাকনা পড়ে।
তবে খুব বেশি সময় নয়। উনুনের গনগনে খড়িটা বের করে ঠাকুমা আঁচ কমায়।
এরপর ভাজা আতপচাল মিশিয়ে দেয় ঠাকুমা ঘণ্টে। সঙ্গে হাতে ছেটানো জল। আবার ঢাকনা পড়ে। এবার বেশ খানিকটা সময়।
ও ঠাকুমা, ঘন্ট রান্না হয়ে গেছে? উনুনে আঁচ কি নিভে গেলো?
ঠাকুমা হাতের অন্যপিঠ দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে বলে, চাল দিয়ে বেশি নাড়তে হয় না দিদি। অল্প আঁচে ঢেকে রাখলে চাল সেদ্ধ হয়ে যায়।
এবার ঢাকনা তুলে গরম মশলা বাটা আর চিনি ছিটিয়ে আরেকবার আলতো হাতে ঘন্ট নেড়ে নেয় ঠাকুমা।
রান্নাঘরের জানালায় গুমোট বেঁধেছে ধোঁয়া। জানালা গলে উঠোনে ছড়িয়ে পড়ছে তা একটু একটু করে। বারবেলার মিহি রোদে মিশে সে ধোঁয়া আকাশনিম গাছের গোড়া ছুঁয়েছে।
বড়ঘরের লাল বারান্দায় আজ সবার পাত পড়েছে। ঠাকুমা সবার পাতে একে একে যোগান দেয় শাকের সুক্তো, মুলার বড়া, মাছের ঝোল, চাল বাঁধাকপি।
শনশনে একটা হাওয়া দেবদারুর মাথা নুইয়ে আকাশনিম গাছের পাতায় গিয়ে ঠেকে। ঠাকুমা মাছের ঝোলের বাটি দাদুর পাতের দিকে এগিয়ে দিয়েই একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। পায়ে পায়ে আকাশনিম গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়।
ও ঠাকুমা, আরও ফুল পড়েছে? দাঁড়াও আমি হাত ধুয়ে আসছি।
কলতলা থেকে দৌড়ে ঠাকুমার পাশে গিয়ে দাঁড়াই আমি।
ফুলগুলো একটা একটা করে মাচার তলার মাটি থেকে কুড়িয়ে কোঁচড়ে ফেলছে ঠাকুমা। পিঠ ছাপানো একঢাল চুলে মানুষটাকে অবিকল সাদাকালো ছবির সেই কিশোরীর মতো লাগছে এখন।
কি অপূর্ব লেখা! যেন পেন্সিলে লেখা আরেক জীবন!
এমন মায়াময় শৈশব আর হবে না।
“এবার গাছ ঝেঁপে ফুল আসবে দেখো।’”
গাছ ঝেঁপে ফুল? অনেকদিন পর এমন কথা শুনলাম। যেন খানিকটা নিমফুলের ঘ্রানও পেলাম।
আজকের ভোর এই লেখায় আরো সুন্দর হলো।
রোয়াকবাজী চলুক
অসাধারণ একটা লেখা। কোন অচিনপুরে চলে গেল মনটা। সাথে সাথে জিভে জল ও এসে গেল
সুন্দৰ লেখা
বড্ড মন কেমন করা লেখা। অজানা একটা কষ্ট মনের মধ্যে পাক খায়।
এ লেখার প্রতিটা পর্ব পড়ি আর কেমন যেন মনকেমনের দেশে হারিয়ে যাই। ছেলেবেলার কত কথা মনে পরে যায়.
খুব সুন্দর লেখা। ভঙ্গীটিও অসাধারণ।
অসাধারণ। তৃপ্তিকর। এ লেখার মধ্যে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যায়।