ইসলাম ধর্মমতে কেয়ামতের আগে দাজ্জাল নামে একজনের আগমন হবে। এই লোক ভয়ংকর চেহারার হবে, এক চোখ থাকবে, কপালে কাফের লেখা থাকবে। ঈসা আবার আসবে এই ধারনাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, ধর্মের কথা বলে অধর্মের পথে নিয়ে যাবে। খ্রিস্টান ধর্মে আছে অ্যান্টিক্রাইস্ট ধারনা। মানুষ যিশু আবার ফিরে আসছে ভেবে বিভ্রান্ত হবে। ইহুদি ধর্মেও এই ধারণা আছে। আব্রাহামিক সব ধর্মেই মূলত এই ধারণা রয়েছে। আমি যেটা বুঝতাম না তা হচ্ছে এমন সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার পরেও কেন মানুষ বিভ্রান্ত হবে? এমন চেহারা জানার পরেও কেউ দাজ্জালের ফাঁদে পড়বে? কেন পড়বে?
গত পাঁচ তারিখ আমার এই বিভ্রান্তি দূর হইছে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী, মূল কারিগরদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মেজর ডালিম। এই লোক এতদিন কই লুকিয়ে ছিল কে জানে। কেউ বলে পাকিস্তানে ছিল, কেউ বলে আমেরিকায় ট্যাক্সি চালাত! এই লোক হুট করেই ইউটিউব লাইভে এক সাংবাদিককে লম্বা সাক্ষাৎকার দিল। এখন ডালিম কী বলতে পারে? আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না ওর কথা শোনার। লাইভ চলাকালীনই জানার সুযোগ হয়েছে যে এমন একটা লাইভ চলছে। আমি একবার দেখলাম যে হ্যাঁ, কাহিনী সত্য। এরপরে আমি বাদ দিয়েছি দেখা। এরপরে শুরু হল বিলো এভারেজ আইকিউ সমৃদ্ধ মানুষের আস্ফালন! অনলাইনেই একেকজনের অর্গাজম হয়ে যাচ্ছে! আহ! এতদিনে মাসিহা পাওয়া গেল! এতদিনে প্রকৃত সত্য জানতে পারল! এতদিনে প্রকৃত বীরের দেখা পেল জাতি! অবিশ্বাস্য! এই রেতঃপাত দেখার পরে আমি বিশ্বাস করছি যে হ্যাঁ, সম্ভব, দাজ্জাল তার প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে, এক চোখ আর কপালে কাফের লেখা নিয়ে হাজির হলেও মানুষ পয়গাম্বর ভেবে তাকে মেনে নিবে! সারা দুনিয়ার মানুষ কী করবে জানি না, আমাদের এই বাংলাদেশের মানুষ সেজদায় লুটিয়ে পড়বে এইটা নিশ্চিত। এই দেশে এখন সবই সম্ভব, খুব সম্ভব।
ডালিমের বক্তব্য আমি না দেখলেও অনেকেই দেখেছে। লাইভ ভিডিওর রেকর্ড করে ফেলছে শুনলাম। অনেকেই নানা বিষয়ে লিখছে। একজন একটা ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ পাঠাল আমাকে। আমি দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধে কতজন নারী ধর্ষিত হয়েছে প্রশ্ন করা হল ডালিমকে। ডালিম কুৎসিত ভাবে খকখক করে হাসতে হাসতে বলল কী জানি, আমি দুইজনকে পাইছিলাম! পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাবে না এগুলা শুনলে? কিন্তু এইটাই স্বাভাবিক না? কী আশা করে মানুষ? ঠাণ্ডা মাথায় শিশু রাসেলকে যারা হত্যা করেছে, মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে রাসেলকে যারা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিতে পারে, যারা শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গুলে করে মেরে ফেলেছিল, যারা সেরনিয়াবাতকে গুলি করে মেরে ফেলে তাঁর দশ-পনেরো বছরের দুই কন্যা, এগারো বছর বয়সী এক পুত্র এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সী এক নাতির সঙ্গে, তাদের কাছে জাতি কী উত্তর আশা করেছিল আমি জানি না।
ডালিমের সব প্রলাপ ভেবে এড়িয়ে যাওয়া যেত। যাওয়াই উচিত। কিন্তু কিছু কথা বলছে যা একটু থেমে চিন্তা করাও উচিত। যেমন সে দাবি করেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই তারা ঠিক করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে! কেন? কারণ মুক্তিযুদ্ধ একটা স্ক্যাম, দেশকে ভারতের প্রদেশ বানানোর একটা চক্রান্ত! তার অর্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী মুজিবের নানা অপশাসনের জন্য মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হইছে এইটা এই যুক্তিতে টিকে না। যদিও তার নিজের পছন্দ কথা গুলোকে সত্য ধরব আর বাকি গুলোকে প্রলাপ বলে ফেলে দিব এইটা আমি এখনও মানছি না, পুরোটাই প্রলাপ হিসেবেই ধরছি।
‘আমি ধরে নিলাম— শেখ মুজিব খুব খারাপ লোক। খুউউব খারাপ লোক। আপনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে ফেললেন, কারণ খারাপ লোক। তার পরিবারের চৌদ্দগুষ্টিকে মারার দরকার হলো কেন? আপনি ব্যক্তি শেখ মুজিবকে মারতেন, তাইলে আমি একভাবে বুঝতাম। কিন্তু আপনি যখন তাকে নির্বংশ করতে চাচ্ছেন, সেখানে একটা সিগনেচার আছে। আর আজকে এতদিন পরে আদালত এসে যখন বলছে আপনি সেটার সাথে যুক্ত, তখন আমাকে তিনবার চিন্তা করতে হবে। আপনি কোনো ব্যক্তি শেখ মুজিবকে মারেননি। শেখ মুজিব ওয়াজ দ্য ফিজিক্যাল এমবোডিমেন্ট অব ইন্ডিপেন্ডেন্স। আপনি স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীককে হত্যা করেছেন। তো, আপনার সাথে আমার কিন্তু আর হবে না। ইউ আর ডিনাউন্সিং মাই ইন্ডিপেন্ডেন্স। পৃথিবীতে ধর্ষণকারী আর ধর্ষিতা এক রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারে না। ওরে দেখার সাথে-সাথে মাথায় আগুন ধরে। হত্যাকারী আর হত্যার শিকার এক রাস্তায় হাঁটে না। পৃথিবীর কোন্ গণতান্ত্রিক দেশ— তাদের স্বাধীনতা নিয়ে আপনি যদি অঙ্গুলিহেলন করেন, আপনাকে সহ্য করবে?’ বেশ কিছুদিন আগে মুক্তিযোদ্ধা মইনউদ্দিন খান বাদল এক টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে এই কথা গুলো বলেছিলেন। ভাগ্য ভালো মইনউদ্দিন খান বাদল মারা গেছেন। আজকের এই দিন তাঁকে দেখতে হয়নি। এই দেশে এখন স্বাধীনতা শব্দটা একটা খেলনার মত হয়ে গেছে। যে কেউ যেমন ইচ্ছা তেমন মন্তব্য করছে। ইতিহাসের ক্লাস নিচ্ছে। মানুষ, অন্তত দেখতে মানুষের মতই কিছু প্রাণী যে যা বলছে তাকেই জি হুজুর বলে মেনে নিচ্ছে। মইনউদ্দিন খান বাদলের ভাগ্য ভাল লিখলাম, এইটাও একটু আইরনি হয়ে গেল। ৫ আগস্টের পরে ভদ্রলোকের কবরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাগলের পাল!
এই অদ্ভুত সরকার গঠনের পর থেকেই বা বলা চলে ৫ আগস্টে আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর থেকেই নানা ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ওপরে নানা ভাবে আক্রমণ চলে আসছে। সরাসরি অস্বীকার করা হচ্ছে। গত ৩১ ডিসেম্বর আরেকবার চেষ্টা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার। নানা কৌশলে এরা চেষ্টা করে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে বাতিল করে দেওয়ার। ৩১ তারিখের চেষ্টাটা মাঠে মারা গেছে। প্রচুর হাঁকডাক করে সারাদেশ থেকে ছাত্রদের ঢাকায় শহীদ মিনারে এনে বিপ্লবের পরে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণার ডাক দেওয়া হয়েছিল। আর তাদের চাওয়া ছিল এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান রচিত হবে! আগেরদিনই দান উল্টে যায়। নোবেলম্যান সরকার পলটি মেরে বলে না, এগুলা করা যাবে না। ছাত্রদের এই ঘোষণাপত্র তারাই কোন এক সময়ে প্রকাশ করবে! ব্যাস, এক ঘোষণায়ই সব শেষ।
স্টার সমন্বয়কদের দুইজন এরপরে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে কেন বর্তমান সংবিধান তাদের পছন্দ না। এই সংবিধান হচ্ছে মুজিববাদ, মুজিববাদকে কবর দিতে হবে! এইটা হচ্ছে যুক্তি! সংবিধানের কোন অংশটাকে নিয়ে আপত্তি? আমাদের সংবিধান যে চার মূলনীতির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এই চারটা মূলনীতি মুক্তিযুদ্ধেরও মূলনীতি ছিল। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এই হচ্ছে চার মূলনীতি। শেখ মুজিব এই চার নীতির কথা বলায় একেই মুজিববাদ বলে প্রচার করেছে তখনকার পত্রপত্রিকা। তো এই চার মূলনীতিতে ঠিক কোথায় আপত্তি? এক স্টার ছাগল বলেছে জাতীয়তাবাদে সমস্যা! বাঙালি জাতীয়তাবাদ চলবে না। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হতে হবে। যুদ্ধ শুধু বাঙালি করে নাই, পাহাড়ি আদিবাসীরাও করেছে! এই হচ্ছে যুক্তি।
কেউ অস্বীকার করছে আদিবাসীরা মুক্তিযুদ্ধ করে নাই? কিন্তু মূল আন্দোলন, সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে গেছে কারা? একাত্তরের স্লোগান ছিল কী? তুমি কে আমি কে? বাঙালি বাঙালি! কেন? কারণ আন্দোলন শুরুই হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে। ভাষা আন্দোলন হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ধাপ। ভাষা সংস্কৃতি হচ্ছে মূল সূতিকাগার। তাই আপনি চাইলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাদ দিতে পারবেন না।
আর বাঙালি আর বাংলাদেশি এই দুইটা যে দুই জিনিস, এইটা যে কোন ক্রমেই এক হবে না এইটা এদেরকে এখন কে বুঝাবে? একজন দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে থাকলে সে হয়ত ইংল্যান্ডের নাগরিক হতে পারবে কিন্তু কোনদিনই সে ইংলিশ হতে পারবে না। একই রকম অন্য জাতি রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রেও সত্য। আমি নাগরিক হতে পারবেন কিন্তু কখনই ওই জাতির অংশ হতে পারবেন না। বাঙালি হয়ে জন্ম নিয়ে আর কোনমতেই এই জাতিসত্তাকে মুছে ফেলতে পারবেন না। আপনি নাগরিক হতে পারবেন বাংলাদেশি কিন্তু যখন জাতি প্রশ্ন আসবে তখন আপনি বাঙালি, এ থেকে নিস্তার নাই! জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামের এই উদ্ভট জিনিসের আবিষ্কারক। এইটা যে সম্ভব না এইটা তিনি বুঝেন নাই তার সমর্থকেরাও বুঝে না। এই ভুল আমরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি আমাদের পাসপোর্টে, সেখানে জাতীয়তা লেখা বাংলাদেশি, শব্দটা নাগরিক করে দিলেই শুদ্ধ হয় কিংবা বাঙালি লিখলে হয়। কিন্তু সে আর হওয়ার নয়...!
বাঙালি জাতীয়তাবাদে সমস্যা কী? সমস্যা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ! ওইপাশের বাঙালিদের সাথে মিল হয়ে যায়। এহেন অপকর্ম হতে দেওয়া যাবে? এই অন্যায় তো মেনে নেওয়া যায় না। তাই জগাখিচুড়ি করে নতুন জাতীয়তাবাদের আগমন, জোর করেই প্রমাণের চেষ্টা, ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
মূল গল্প আসলে অন্য জায়গায়। এদের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ বিরাগ লক্ষ করা গেছে। এখন পর্যন্ত তা বিরাজমান। তবে ডালিম কুমারের সাক্ষাৎকারের পরে নতুন একটা বিষয় অনলাইনে দেখা যাচ্ছে। বামাতিরা খুব গোস্বা করেছে ডালিমের সাক্ষাৎকারে। তারা ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম নিয়ে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। খুব লেখালেখি করছে এগুলার পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুট করেই আবেগ দেখাচ্ছে। আমার এতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই। আমিও তো তাই চেয়েছি। আওয়ামীলীগের ভুলে আপনি মুক্তিযুদ্ধকে কেন ছুঁড়ে ফেলে দিবেন? আরও বেশি করে লিখুন। আপত্তিটা অন্য জায়গায় আমার। আপত্তিটা হচ্ছে এইটা কেমন মুক্তিযুদ্ধ প্রেম আপনাদের যেখানে প্রতি পদে পদে মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করে চলছে এই সরকার তার বিরুদ্ধে কিচ্ছু বলছেন না আপনারা? এইটা কেমন দেশপ্রেম আপনাদের যখন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রটার নাভিমূল যাকে বলা হয় সেই বত্রিশ নাম্বার ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে, আপনি টু শব্দ করছেন না? আপনাদের এই আচারনের অর্থ তো বুঝি না। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ঘাড়ের ওপরে নিঃশ্বাস ফেলছে প্রতি নিয়ত অথচ আপনাদের মুখ দিয়া শব্দ বের হয় না। আজকে হুট করেই ডালিম কুমারকে জবাব দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগার অর্থ কী? ডালিমের পুরো বক্তব্যই যে ভুয়া এইটা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানের দরকার হয় না। যদিও বাংলাদেশের মানুষের ওইটুকু জ্ঞানও নাই।
তবে এইটা ভাবাও ঠিক হবে না যে ডালিম কুমারের হুট করেই আবির্ভাব হওয়া স্বাভাবিক কোন ঘটনা না। এইটাও দেশের রাজনীতির কোন একটা মারপ্যাঁচের অংশ। নানা প্রলাপের মধ্যে দিয়ে শুধু যে আওয়ামীলীগ বা শেখ মুজিবকে যে হেয় করেছে তা না, জিয়াউর রহমানকেও ইচ্ছামত ডুবিয়েছে। জিয়া কোরান শরীফে হাত রেখে শপথ করেছেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য। এইটা খুব সম্ভব যে ডালিমের আগমন জামাতের চালেই হয়েছে। সামনে ডালিম জামাতের সাথে দেখা গেলে আমি অবাক হব না।
জামাতের সুরেই কথা বলেছে ডালিম কুমার। জামাত বা জামাত মতাদর্শইরা মুক্তিযুদ্ধের পরেই শুরু করে ভারত বিরোধী প্রোপাগান্ডা। বলা হল তাজউদ্দীন গোপন চুক্তি করে দেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিছে! এর জন্য শেষ পর্যন্ত তাজউদ্দীনকে বিবৃতি দিতে হয় পত্রিকায় যে সে এমন কোন গোপন চুক্তি করে নাই। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করলে তো? স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কত সরকার গেল আসল, কেউ আজ পর্যন্ত তাজউদ্দীনের সেই গোপন চুক্তি মানুষের সামনে আনতে পারল না অথচ এখনও বলা সময় এই ছাগলেরা বলে যুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগ দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এই সুরেই ডালিম মিয়া আবার গীত ধরেছে, এইটা নতুন কিছু না, পুরান গীতই!
ভিন্ন দিকে যাই। সংস্কার সংস্কার বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে সরকার আর সমন্বয়কেরা। কেউ কেন বুঝতেছে না নির্বাচিত সরকার না হলে এই সংস্কারের কোন মূল নাই? সংসদে এই সংস্কার প্রস্তাব যদি পাস না করে পরবর্তী সরকার তাহলে এত কষ্ট করে সংস্কার করবে এই বিশিষ্ট বুদ্ধিমানেরা তার ফল কী হবে? নির্বাচিত সরকার মনে করল যে না, এই কয়টা জিনিস তাদের পছন্দ অনুযায়ী হচ্ছে না, তাই ওগুলা বাদ, নতুন কিছু ঢুকিয়ে সংসদে সব পাস করিয়ে নিলো! বাংলাদেশে তো এমনই হয়ে আসছে, তাই না? তাহলে এখন সংস্কার নিয়ে এত আগ্রহী হয়ে লাভ কী? যা করার তো নির্বাচিত সরকারকেই করতে হবে!
আর এই সংস্কার করার এক্তিয়ার কে দিয়েছে তাদেরকে? ফরহাদ মজহার থেকে শুরু করে ছাত্ররা পাঁচ আগস্টের পরে বলা শুরু করল যে যেহেতু তারা বিপ্লব করে ফেলেছে, বিপ্লবী জনতার মাধ্যমেই সরকার গঠন হবে! বিপ্লবী তাদের ম্যান্ডেট এনে দিয়েছে সব কিছু সংস্কার বা আগের সব বাতিল করার। এইখানেই আমার আর মাথায় ধরে না। জনগণ কবে তাদেরকে এই দায়িত্ব দিল? কোটা নিয়ে আন্দোলন, আন্দোলনে সরকারের বাড়াবাড়িতে লাশ পড়া, মৃত্যুর মিছিল, মানুষের এই রক্তপাত পছন্দ হয় নাই, আমাদেরও মনে হয়েছে পরেরটা পরে আগে এই মৃত্যুর খেলা বন্ধ হোক। এবং তাই হয়েছে, সরকার পতন হয়েছে। এইখানে কোন দিক দিয়ে, কোন এঙ্গেলে মনে হচ্ছে জনগণ তাদেরকে সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে? কী দেখে ধারনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদেরকে জনগণ দিয়েছে? কেন মনে হচ্ছে জনগণ তাদেরকে ইতিহাস নিয়ে ফুটবল খেলার এক্তিয়ার দিয়েছে? আমি জানি না। কিন্তু অনেকেই মনে করে যেহেতু তারা আন্দোলন, তথাকথিত বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে তাই তাদের সকল কিছু করার এক্তিয়ার রয়েছে!
নোবেলম্যান নিউ এজের সম্পাদক নরুল কবিরকে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। নুরুল কবির বেশ কিছু চৌকস প্রশ্ন করেছে ইউনুস সাহেবকে। মহান উপদেষ্টা প্রধান বেশ লেজেগোবরে করে ফেলেছেন এইসবের উত্তর দিতে গিয়ে। একজন সরকার প্রধান বলছেন তিনি জানেন না কী করছেন! আন্দাজে করে চলছেন, ভালো হলে ভালো না হলে কপাল খারাপ বলে মেনে নিতে হবে! শুধু তাই না, তিনি নিশ্চিত করেছেন তার উপদেষ্টাদের সকলেরই একই অবস্থা! এই যখন সরকারের অবস্থা তখন আপনি সব মাখাইতেছেন কেন? আপনি জানেন এইটা আপনার কাজ না, আপনি একটা আপদকালিন সময়ের জন্য আসছেন। তো ওইটাই করেন। আপদকালিন সময়টুকু পার করেন কোনমতে। নির্বাচন দিয়ে সরে জান। আপনি নিজেই স্বীকার করছেন সরকার চালানোর কোন যোগ্যতা আপনার নাই, আল্লার ওপরে ভরসা করে চলছেন, তো সেখানে আপনি আরও জটিল কাজে যাচ্ছেন কেন?
এর উত্তর একটা হচ্ছে এগুলা বলার জন্য বলা। আপনি ভালো করেই জানেন আপনি কী করছেন। মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্য এমন বলছেন। আর না হয় আপনি আসলেই জানেন না কী করছেন! যতখানি খাইতে পারবেন ততখানি না মাখায়া সব নষ্ট করছেন না বুঝেই।
বিপ্লবের দ্বারা তৈরি সরকার এখন পর্যন্ত একটাও বৈপ্লবিক কাজ করতে পারে নাই। সামনে বোরো ধানের আবাদের সময় আসতেছে। এখন পর্যন্ত দেশের সার কারখানা চালু করতে পারেনি। জামালপুরের ইউরিয়া সার কারখানা বন্ধ গ্যাসের অভাবে! এই শীতেই বিদ্যুৎ দিতে পারছে না, সামনে গরমে কী করবে? বোরোর আবাদ পুরো দমে শুরু হলে কী করবে? সার না দিতে পারলে কৃষক কী করবে? বোরোর আবাদ মার খেলে জনগণ কী খেয়ে থাকবে? উত্তর দেওয়ার কেউ নাই। আমাদের অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে তবে এতে জনগণের ওপরে কোন চাপ পড়বে না! রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে এতদিন সরকার ৭% ট্যাক্স নিত, এখন ১৫% নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, পোশাক কিনতে গেলে আগে দিতে হত সাড়ে সাত শতাংশ এখন দেওয়া লাগবে পনেরো! এমন সব কিছুতেই দিগুণ করে দেওয়া হয়েছে ভ্যাটের পরিমাণ। অথচ অর্থ উপদেষ্টা আশা করছেন এতে জনগণের ওপরে কোন চাপ পড়বে না! এগুলা বলতেও পারবেন না, কারণ মোবাইলে এখন ১০০ টাকা রিচার্জে ৫৬ টাকা দিতে হবে ভ্যাট!
অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে চুরি চামারি। আমাদের গলিতে ছোট থেকে বড় হয়েছি আমরা, বড় রকমের চুরির ঘটনা দেখিনি। টুকটাক যে কয়টা হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত আমাদের গল্পের বিষয় হয়ে রয়েছে। কিন্তু ওইদিন শেষ! এখানে এক বাড়িতে দুইবার পানির মোটর চুরি হয়েছে, তৃতীয় বারও চুরির চেষ্টা হয়েছিল, ভাগ্যগুণে বেচে গেছে মোটর! আমাদের বাড়ির দেউরির যে গেট ওইটা বাহির থেকে লাগানোর জন্য একতা শেকলের মতো আছে, শেকলটা টেনে লাগিয়ে দেওয়া যায়। এই সামান্য শেকলটা চুরি করে নিয়ে গেছে! ঢাকায় আমার বন্ধুর মোবাইল ওর বাসার সামনে গলায় দা ধরে নিয়ে নিয়েছে! ওদের গলিতে তিন চারটা করে মোবাইল ছিনতাই হচ্ছে! ঢাকায় আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এখন বাধ্য না হলে রাতে আর বাসা থেকে বের হয় না! শীতের মৌসুমে বেশ কিছু জিনিসের দাম কমেছে বলে অনেকেই দেখিছি তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। আমি খুশিই হয়েছিলাম শুনে। পরে দেখি অন্য কাহিনী! কৃষক মারা যাচ্ছে এই দাম কমাতে! সাধারণত শীতের শেষের দিকে সবজির দাম কমে যায়। তখন আমরা দেখছি কৃষক বাঁধাকপি, ফুলকপি দাম না পেয়ে গরুকে খাওয়াচ্ছে। বাজারে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু এবার এখনই এই দৃশ্য শুরু হয়েছে! এইটা তো তাহলে সঠিক কাজ হচ্ছে না। আমি সস্তায় পাচ্ছি ঠিক আছে। কিন্তু যে উৎপাদন করল সে যদি মরে এই দামে তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও গড়বড় রয়েছে, তাই না? কৃষক কান্নাকাটি করছে। নুরুল কবির প্রধান উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেছে যে খেত থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে দাম বাড়ছে মূলত রাস্তায় চাঁদাবাজির কারণে, আপনার প্রশাসন কেন এর ব্যবস্থা নিচ্ছে না এই ব্যাপারে? উত্তরে নোবেলম্যান বলেছেন তারা চেষ্টা করছেন! তাদের দৃষ্টি অতদূর যেতে পারছে না ব্লা ব্লা ব্লা!
গতকাল মানে ৭ তারিখ রাতে বেগম খালেদা জিয়া অবশেষে দেশ ছেড়ে লন্ডনে গিয়েছেন। উনি কেন এতদিন জান নাই, এখন কেন গেলেন এইটা নিয়ে অনেকের অনেক জল্পনা কল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে এতদিন না গেলেও, সেনাপ্রধান দেখা করার পরেই কেন গেলেন এইটা আসলেই একটা বড় প্রশ্ন। এইটা সামনেই বুঝা যাবে, এর আগে না।
শেষ করি। হুট করেই আবার এক চক্কর কলকাতা গিয়েছিলাম। কলকাতায় আসার পরে অনেকেই জিজ্ঞেস করছে বাংলাদেশের অবস্থা কী? এই প্রশ্নটা শুনলেই আমার মান্টোর উত্তরের কথা মনে হয়। তাঁকেও একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মান্টো, আপনার দেশের খবর কি? মান্টো বলেছিল 'কারাগারে জুমার নামাজ যেমন হয়, অবস্থা ঠিক তেমনি।' এইটা আবার কেমন? আবার প্রশ্ন! মান্টোর উত্তর- 'আজান দেয় বাটপার, ইমামতি করে খুনি, পেছনে নামাজ পড়ে সব চোরের দল। ফেরার সময় বিমানে ফিরেছি। আমাকে যেমন অনেকেই বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করে, বিমানে উঠার আগে যখন বসে আছি তখন আমার সামনে একজন বয়স্ক মহিলাকে বিমান বন্দরের একজন কর্মী জিজ্ঞাস করলেন বাংলাদেশের অবস্থা কী? ভদ্রমহিলার উত্তর - নোবেলের ওপর থেকে বিশ্বাসই উঠে গেছে গো!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।