বেলা এখন অনেক বড়। বারবেলা তো ফুরোতেই চায় না। বিকেলের রোদ নিভে যাবার আগ পর্যন্ত তাপ ছড়ায় ইচ্ছেমতো। আর সূর্য তলিয়ে যাবার পরের সময়টুকু হাঁসফাঁস করা গুমোট।
কলঘরে বালতি ভরা থাকে কলের ঠান্ডা জল। তাতে সুযোগ পেলেই ডুব দেয় সবুজ তরমুজ।
ঈদের আগে শেষ হাটবার আজ। আজ স্কুলশেষে দাদুও হাটে যাবে।
হাটবারের আগের সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়ে যায় কাপড়ের গাঁট বাঁধা। বড় বড় কয়েকটি সাদা গাঁট তিনচাকার ভ্যানে করে পৌঁছে যায় হাটে, সকালের বেলা মাটিতে পড়তে না পড়তেই।
এজন্যই হাটবারে আমাদের বাড়িতে দিন শুরু হয়ে যায় সূর্য ওঠার অনেক আগেই। ভোরে ছরাজল উঠোনে পড়তেই ঠাকুমা পূজার ফুল তুলতে বেরিয়ে যায়।পূর্ণির মা উঠোন লেপে, বাসি বাসন ধুয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় উপুড় করে। আকাশের নিরিবিলি অন্ধকারে তখনও আলো সেভাবে খাবা বসায়নি। ঠাকুমা ফিরে আসে। হাতে ফুল ভরা সাজি। সেটা বারান্দায় নামিয়েই কলঘরে ছোটে ঠাকুমা।
স্নান করে, নিত্য পূজা সেরে ঠাকুমা উনুনে আঁচ দেয়, তখনও দেবদারু বাগানের মাথায় আলো ফোটেনি। শুধু তো বাড়ির এতগুলো মানুষের সকালের পাতই পড়বে না, তাঁতঘরের অতগুলো লোকেরও তো পাত পড়বে হাটবারে। এসব দিনে ঠাকুমা সকালে মৌরি ফোড়ন আর আদাবাটা দিয়ে মাসকলাই ডালের খিচুড়ি রান্না করে। সকালের পাত উঠতেই তেতে ওঠে দুপুরের উনুন। হাটের ভাত কুলোতে না হলেও তিন তিনবার ভাতের হাঁড়ি উনুনে চাপে।
হাটবারে সারাদিনের ঝক্কি শেষে ঠাকুমা যখন থানাঘাটে ডুব দিতে যায়, তখন খান তিনেক ঝোলা গুড়ের হাঁড়ি আর গুড়ের কদমা-বাতাসা নিয়ে দাদু সেই তিনচাকার ফাঁকা ভ্যানরিক্সায় বাড়ি ফিরে আসে।
কিন্তু গেলো বছর থেকে এমন হয় না। বড় বড় পেটফোলা সাদা গাঁটগুলো ভ্যানরিক্সায় চড়ে এখনো হাটে যায় ঠিকই, কিন্তু ফেরার পথে সে ভ্যানরিক্সা ফাঁকা হয় না। কয়েক জোড়া কাপড় কমে সাদা গাঁটের পেটফোলা হয়তো একটু কমে কিন্তু গাঁটের সংখ্যা কমে কই?
ঠাকুমা বলে, সব হাট কি একরকম হয়?
কিন্তু প্রতিবার হাটবেলা শেষ হলে ঠাকুমার এই একই কথা দাদুর মুখে হাসি যোগায় না। শূন্য চোখে দাদু তাঁতঘরের দিকে তাকিয়ে বলে, পাওয়ার লুম শাড়ির দাম কম, শাড়িও চকচকা। হাটুরেরা কেন দাম দিয়ে তাঁতের শাড়ি কিনবে?
যতই গাঁট ফিরুক হাটবেলা শেষে, পরের হাটবারে কিন্তু দাদুই গাঁট বাঁধতে তাড়া দিতে শুরু করে সক্কলকে সবার আগে। আর হাটবার মানেই বাড়ির উনুনে আঁচ পড়বে অন্ধকার থাকতেই। তা তো অবধারিত। আজও তার ব্যতিক্রম নেই। ঠাকুমা উঠে গেছে সেই কোন ভোরে। পূর্ণির মারও বাসি সব কাজ সারা হয়ে গেছে। ঠাকুমা ফুলের সাজি এনে বারান্দায় রেখে মনিপিসিকে ডাক দিতেই আমার ঘুম ভেঙে গেলো।
মনিপিসি ওপরতলা থেকে আধাভাঙা মাসকলাইয়ের ডাল ছোট্ট ধামায় ভরে নামিয়ে আনবে। সেই ডাল কুলোয় দু’একটা টোকা দিয়ে জলে ভিজিয়ে দেবে ঠাকুমা। আর যদি মাসকলাই গোটা হয় তাহলে পূর্ণির মা যাতায় দু’তিনবার ঘুরিয়ে দেবে।
কিন্তু এখন মাসকলাই ডাল নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি গাল ফুলিয়ে বসে আছি লাল বারান্দায় ফুলের সাজি দেখে।
ঠাকুমার ফুলের সাজিতে আজ হিমচাঁপা ফুল। আর এই ফুলের গাছ শুধু পিসিঠাকুমার বাড়িতে আছে। তাহলে আমাকে না নিয়ে ঠাকুমা গিয়েছিলো পিসিঠাকুমার বাড়ি। আমার এবার কান্না আসে।
ও দিদি, ওভাবে পৈঠায় পা ছড়িয়ে বসে থাকতে নেই; শ্বশুরঘর অনেক দূরে হলে আমি কীভাবে দিদির মুখটা দেখতে পাবো প্রতিদিন?
সত্যিই তো! ঠাকুমাকে একবেলা না দেখলেই তো আমার কষ্ট হয়। আমি তাড়াহুড়ো করে পা দুটো গুছিয়ে নিই।
ঠাকুমা কলতলা চলে গেলে মনিপিসি লাল বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভ নিয়ে বসে। এসব ঝামেলার দিনে মনিপিসি স্টোভে দাদুর জন্য চা বানাতে বসে যায়। সকালের আহ্নিক শেষ করেই দাদুর চা চাই। তাতে একটু দেরি হলেই একে তাকে ডেকে এক অদ্ভুত হুল্লোড় তুলে ফেলে বাড়িতে দাদু।
পেয়ারা গাছের পাতায় দিনের প্রথম রোদ পড়েছে। ঠাকুমার নিত্যপূজা শেষ। উনুনে আধভাঙা মাসকলাই ডালের খিচুড়িতে বলক উঠেছে।
তাঁতঘরে মাকু টানার শব্দে সারা পাড়া জেগে উঠেছে।মনিপিসি আবার ওপরতলা যাচ্ছে।
ও মনিপিসি, বারবার ওপরে যাচ্ছো কেন? উত্তর দেবার সময় নেই মনিপিসির। তাই উত্তর খুঁজতে আমিও কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মনিপিসির পেছন পেছন উঠতে থাকি।
আমাদের ওপরতলা দিনের বেলাতেও বেশ অন্ধকার। ছোট ছোট কাঠের জানালাগুলোয় বরইগাছের একচ্ছত্র অধিকার। বরইপাতার প্রাচীর পেরিয়ে খুব যে একটা আলো ঘরে আসে তা না। এজন্য টিমটিমে হলুদ আলোর বাতিটা মনিপিসি দিনের বেলাতেও সেখানে জ্বালিয়ে দেয়।
সে আলো অবশ্য মাটির ডোলা, কাঠের বাক্স, গুড়ের হাঁড়ির আনাচেকানাচে জমে থাকা আবছা অন্ধকারে হাত বাড়ায় না।
মনিপিসি সেরকমই এক অন্ধকার থেকে টেনে বের করে একটা কাঁসার কলস। সেই কলসের ভেতরেও অন্ধকার। দেরি না করে মনিপিসি সে অন্ধকারে হাত ডুবিয়ে তুলে আনে কতগুলো সাদা কড়ি।
ও মনিপিসি, কড়ি দিয়ে কী হবে? আজ তোমার ব্রত আছে? মাথা নেড়ে উত্তর দেয় মনিপিসি।
সকালের সব অভিমান আমার এতক্ষণে ফুরিয়ে গেছে। ফুলের সাজির হিমচাঁপা ফুলের উপস্থিতি এখন আমাকে আনন্দ দিচ্ছে।
বাড়িতে ব্রত হওয়া মানেই আমার কাছে উৎসব। বিকেল হতে না হতেই ফল, ধূপ আর বেলপাতার ঘ্রাণ। ব্রত শেষে উপোসী মানুষটির জন্য বিশেষ পদের আয়োজন। আর সন্ধ্যায় সবকিছু মিটে যাবার পর ঠাকুমার মুখে ব্রতের পাঁচালী আরও একবার নতুন করে শোনা। সব ব্রতের পাঁচালী ঠাকুমা মুখস্থ বলতে পারে গল্পের মত।
নিচে উঠোনে কলাপাতার পাত পড়েছে। ড্রাম মাস্টারসহ কয়েকজন তাঁতির পাতে মাসকলাইয়ের খিচুড়ি পড়ে গেছে। সাথে বেগুন আর কাঁচাবাদাম ভাজা।
সবারই খুব তাড়াহুড়ো আজ। লাল বারান্দার এককোনে সাদা পেটফোলা গাঁট। বাইরবাড়িতে তিনচাকার ভ্যানরিক্সা এসে দাঁড়িয়েছে।
দাদু বাইরবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কাপড়ের গাঁটগুলোর পেছন পেছন দাদু কালীবাড় বটতলা পর্যন্ত যাবে। এরপর ভ্যানরিক্সা হাটের পথ ধরলেই দাদু স্কুলের রাস্তা ধরবে।
দাদু বাড়ি ছাড়লেই বাড়ির হুল্লোড় একটু থিতিয়ে আসে। মা চটের আসনে নকশা তুলতে বসে যায়। মনিপিসি কলেজের জন্য বেরিয়ে যায়। ঠাকুমা নরম হয়ে আসা কাঁথায় নতুন কাপড়ে ফোঁড় তোলে।
কিন্তু আজ তা হল না।
মনিপিসি কলেজের জন্য আজ বের হলো না। আর ঠাকুমার কাঁথাগুলোও কাঠের বাক্সে থেকে গেলো। একে তো হাটবার তার উপর মনিপিসির ব্রতের দিন। উনুনের আঁচ নিভলো না আজ। তবে উনুনে আমিষ ওঠার আগেই ঠাকুমা নিরামিষ পদ করে নিতে চায়। ব্রতশেষে লাল আটার রুটি দিয়ে মনিপিসি ঝিঙে বাসন্তী খাবে।
ঝিঙের খোসা ছাড়িয়ে ডুমো করে কেটে নেয় ঠাকুমা। এরসাথে মিষ্টি কুমড়োরও ডুমো হয়। মা এর ফাঁকে মটরের ডাল আর সাদা তিল জলে ভিজিয়ে দিয়েছে। তবে খুব বেশী সময় ভিজিয়ে রাখার সুযোগ নেই। তাই ঠাকুমার সবজি কাটা শেষ হতেই মা শিলবাটায় বেটে নেয় ডাল আর তিল আলাদা করে।
উনুনে কড়াই ওঠে। তাতে সর্ষের তেল।
তেল তেতে উঠতেই ঠাকুমা ভেজে নেয় মটর ডাল আর তিলবাটা মিশিয়ে বড়া। এরপর বেঁচে যাওয়া সেই তেলে কালোজিরা ফোড়ন পরে। ফোড়ন খুব একটা কড়া করে না ঠাকুমা। তাতে আগে পড়ে ডুমো মিষ্টি কুমড়ো। লাল করে ভাজা হতেই ঝিঙে ডুমো দিয়ে দেয় ঠাকুমা। ঝিঙে কড়াইয়ে পড়তেই জল ছেড়ে মজে আসে। ঠাকুমা হলুদ, লবণ আর চিনি দিয়ে কষাতে থাকে। অল্প কষিয়ে তিল আর সর্ষেবাটা দিয়ে দেয় ঠাকুমা। তিল আর সর্ষে খুব বেশী সময় কষাতে নেই। তেতো হয়ে যায়। তাই ঠাকুমা একটু পরেই সেই ডাল আর তিলের বড়াগুলো দিয়ে অল্প নেড়ে ঠাকুমা নামিয়ে নেয় ঝিঙে বাসন্তী।
আজ সারাদিনে এতটুকু ফুরসত নেই ঠাকুমার। হাটের ভাত চলে গেছে বারবেলা গড়িয়ে যাবার আগেই। এরপর উঠোনে চলছে ব্রতের আয়োজন।
পূর্ণির মা তুলসীতলা লেপে দিয়েছে। মনিপিসি সাদা ফুল, চন্দন, আতপচাল, বেলপাতার ডাল সাজিয়ে নিয়েছে। সবার আগে একটা ছোট্ট পুকুর কেটে নেয় মনিপিসি। সেই পুকুরের চারপাশে আতপচালের পিটুলির আল্পনা। সেই আল্পনার ওপরে বসে সাদা কড়ি। আর পুকুরের ভেতর বেলপাতার ডাল।
এরপর সাদা হিমচাঁপা ফুলে চন্দনবাটা ছিটিয়ে ঠাকুমা ছড়া ধরে...
পুণ্যিপুকুর ব্রতমালা/কে করে গো বারবেলা
আমি সতী, লীলাবতী/সাতভায়ের বোন,ভাগ্যবতী
হবে পুত্র, মরবে না/ধান সে গোলায় ধরবে না
পুত্র তুলে স্বামীর কোলে/আমার মরণ হয় যেন এক গলা গঙ্গাজলে…
বাড়ির উঠোনে নতুন পুকুরে জলের গায়ে আবার জল পড়ে। আর তাতে ভাসতে থাকে আতপচাল, বেলপাতা আর হিমচাঁপা ফুল।
বেলা পড়ে আসে।
বাইরবাড়িতে এসে দাঁড়ায় পেটফোলা সাদা গাঁটের ভ্যানরিক্সা। ঈদের হাটেও পেটফোলা গাঁট ফাঁকা হয়নি। দাদু মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢোকে। বিড়বিড় করে বলে, পাওয়ার লুম নদীর এপারেও চলে এসেছে গিন্নি।
মাসকলাইয়ের খিচুড়ি আর ঝিঙে বাসন্তীর জন্যে মনটা হু হু করছে .
মাসকলাইয়ের খিচুড়ি আর ঝিঙে বাসন্তীর জন্যে মনটা হু হু করছে .
পুরোটা পড়লাম। পুরনো গ্রাম বাংলায় হারিয়ে গেলাম।
এটা থেমে গেলে চলবে না
অপূর্ব, মায়াময় লেখা। পড়ার সময় মনে হল নিজের ঠাকুমার কাছে বসে গল্প শুনছি। অনেকটা এমন করেই গল্প বলতেন তিনি। ঢাকা বিক্রমপুরের টঙ্গীবাড়ি গ্রামের অন্য পাঁচটা দিনের মত একটা দিনের গল্প। কিন্তু সেই অপূর্ব কথকতায় আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই বাড়ি, সেই উঠোন, সেই উনুন, সেই খাল, সেই নদী।
এনার লেখায় সেই সিনেম্যাটিক এফেক্ট পূর্ণমাত্রায় বর্তমান। তার সাথে "স্মেলোমেটিক" আর "টেস্টোমেটিক" এফেক্ট। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি দাদুর উদাস হয়ে তাঁতঘরের দিকে তাকিয়ে থাকা, নাকে আসছে ফুল চন্দন, তিলবাটার গন্ধ, জিভের ওপর অনুভব করছি মাসকলাইয়ের খিচুড়ি ও ঝিঙে বাসন্তীর স্বাদ।
দেখলাম আরও অনেকগুলো পর্ব আছে। সবগুলোই পড়ে ফেলব। অসামান্য লেখা। পড়া শেষ হয়ে যাবার পরও পাশবালিশের মত জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে, আরামে চোখ ঢুলুঢুলু।
অসাধারণ ভালো লেখা।