জানালাটা খুলে বাইরের পাহাড়ের খাড়া দেয়ালটা একবারই দেখানো হয়েছিল তাকে। মাঝে গভীর গিরিখাত। জানালায় ছিল কড়িবর্গা, সেটা ধরে গিরিখাতের তল সে দেখতে পায়নি। জানালাটা খোলা হয়েছিল, তাকে জানতে দেওয়া হয়েছিল জানালার ওই পাড়ে আছে শৈলশিরা, কারণ তারা জানত সে পাহাড় ভালোবাসে। এতো কাছে পাহাড় থাকা সত্ত্বেও সেটি সে দেখতে পাবে না – এটাও এক ধরণের নিপীড়ন। জানালাটা আর এক বার খোলা হয়েছিল পরে, তার জন্যই।
তার স্ত্রী তাকে ফিরে আসতে না করেছিল, অনেক অনুনয় করেছিল, কিন্তু সে শোনেনি। বিমানবন্দরে নামামাত্রই তাকে আটক করা হয়েছিল। নিয়ে আসা হয়েছিল রাজধানী থেকে বহু দূরে এই বন্দিশিবিরে। সে জানত এরকমই হবে।
সকালে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো অন্য একটি ঘরে, পার হতে হতো একটি করিডর, এক পাশে দেয়াল, অন্য পাশে পর পর আটটি কামরা, এর মধ্যে একটি ছিল তার। কিন্তু সেটা সে বুঝতে পারত না, কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকত চোখ। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগলে বুঝতে পারত বাড়িটি থেকে সে বের হয়েছে। এর পরে ত্রিশটি পদক্ষেপ, অন্য একটি বাড়িতে ঢোকা। সেখানে একটি ঘরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে চোখের বাধন সরিয়ে নেওয়া হতো। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর আসত কমিসার।
প্রথম দিন সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি কে আপনি জানেন?’ কমিসার বলেছিল, ‘আমি জানি আপনি জনগণের শত্রু, এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।’ বেশি জানা কমিসারের জন্য ভালো নয়।
বহুদূরে রাজধানী, সেখান থেকে একটা গাড়ির প্রায় পুরোটা দিন লেগে যায় এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছাতে। তবু দু দিন অন্তর একটি করে গাড়ি আসে। দুদিন অন্তর কমিসারের কাছে আটটি সাদা খাম পৌঁছে দেওয়া হয়। নির্দেশনামা। সেই নির্দেশ পালন করে কমিসার আবার আটটি খামে প্রমাণসহ উত্তর পাঠিয়ে দেয় দু দিন পরে।
কমিসার তার কাছে থেকে কোনো উত্তর জানতে চাইত না, কোনো জবানবন্দী নয়। বেশিরভাগ দিনই তাকে বসিয়ে রাখা হতো, আর কোনো কোনো দিন আসত একটা শারীরিক আঘাত। আঘাতটা আসতো কোনোরকম অগ্রিম জানান না দিয়ে। কমিসার নিজ হাতেই সেটা করত। এমনই সব শর্ত – সাদা খামের শর্ত।
আর এক দিন তার জানালাটা খোলা হয়েছিল। সার্জেন্ট এসে জানালাটা খোলে, একটা ভারি তালা দিয়ে বদ্ধ থাকে জানালা। সার্জেন্ট জানালা খুলে দিয়ে তাকে বলেছিল, আধ ঘন্টার মধ্যে আবার জানালা বন্ধ হয়ে যাবে, তাই লোভীর মতো সে বাইরের পাহাড়টা শুষে নিতে চাইছিল তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে। এরপর সে দেখতে পায় বাইরের শূন্যে উড়ন্ত এক মানুষকে, সমস্ত ভার থেকে মুক্ত হয়ে সে পড়ে যাচ্ছিল গিরিখাতে, তার দেহ আঁকছিল এক প্রাসের গতিপথ। সেদিন বাড়ির ছাদ থেকে আটজন বন্দীর একজনকে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলা হয়, যাতে সবক’টা কক্ষ থেকেই সেই গতিপথ দেখা যায়। সাদা খামে শুধু লেখা ছিল এই নির্দেশ, ‘সাত নম্বর বন্দীকে গিরিখাতে ফেলে দেবেন ছাদ থেকে। এর আধ ঘন্টা আগে সব কক্ষের বাইরের জানালা খুলে দেবেন। বন্দীকে এমনভাবে ফেলবেন যেন সবক’টা জানালা থেকে তা দেখা যায়। প্রমাণ পাঠাবেন।’
একটি ক্যামেরা বরাদ্দ ছিল সেই শিবিরে। ছাদে সাত নম্বর কক্ষের বন্দীকে উঠিয়ে, দুজন সার্জেন্ট দু দিক থাকে তার হাত ও পা ধরে, চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে দিয়েছিল গিরিখাতে। কমিসার ছবি তুলেছিল। ছবির ক্যাসেটটি পরে গাড়িতে রাজধানী যাবে।
যাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তার নাম ছিল আলাজিয়া। শূন্য উড়ে যাবার সময় তাকে চিনতে পেরেছিল সে। আলাজিয়া যে এই শিবিরেই ছিল সেটা সে তখনই জানল। পাঁচ বছর আগে দেশের সীমানার বাইরে চলে যাবার আগে তাদের শেষ দেখা, আলাজিয়াকে তার অল্প সময় পরেই আটক করা হয়।
শূন্যে উড়ে যাওয়া আলাজিয়ার হৃদস্পন্দনকে ধারন করতে চাইল সে, যদিও সেই চিন্তার বেশ কয়েক মিনিট আগে, গভীর গিরিখাতের নিচে, আলাজিয়ার শরীর অভিকর্ষজ ত্বরণে ভূপাতিত হয়েছিল চরম বেগে। ‘আমি এখনো বেঁচে আছি, হয়তো আর একটা দিন, কিংবা সপ্তাহ, মাস, একটা বছরও হতে পারে, কিন্তু একদিন আলাজিয়ার মতো আমিও উড়ব,’ এরকম একটা চিন্তা তার মস্তিষ্কের কোনো এক কোনায় জেগে উঠে মিলিয়ে যায়, কিন্তু মিলিয়ে যাবার আগে সেটা তার অনুভবকে, অস্তিত্বকে স্বচ্ছতা দেয়।
দুদিন পরে তাকে আবার কমিসারের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে চেয়ারে বসিয়ে সার্জেন্টরা চলে যায়। সামনে একটা টেবিল। দশ মিনিট পরে কমিসার ঘরে ঢোকে, কিন্তু সামনের চেয়ারটায় বসে না, বরং পেছনে থাকে। পেছনে থাকে, পায়চারি করে। মিনিটখানেক পরে বলে, ‘আমি যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম এমনভাবে যাতে কেউ সেটা খেয়াল করবে না।’ এরপরে সে পেছনের জানালাটা খোলে, এই প্রথম সেই জানালাটা খোলা হলো তার উপস্থিতে। রোদ একটা চতুষ্কোণ স্তম্ভ বেয়ে তার চেয়ারের পাশে একটা উজ্জ্বল আয়াতক্ষেত্র হয়ে থাকে। এরপরে খুব দ্রুত, এত দ্রুত যে চোখের দুটো পলকের মধ্যে যে সময়টা থাকে, সেই সময়টুকুর মধ্যে, কমিসার তার বাঁ হাতটিকে ধরে টেবিলের ওপর মেলে দিয়ে, একটা চাপাতি দিয়ে কনে আঙুলটাকে হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ঘটনাটির চকিত বিহ্বলতা এমনই ছিল যে, সে প্রথমে কোনো ব্যথাই অনুভব করল না। আঙুলটা টেবিল থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ল। অনেক সময় নিয়ে যেন পড়ল। একজন সার্জেন্ট সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে আঙুলটা মেঝে থেকে তুলে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে টেবিলের ওপরই রাখল, তারপর দ্রুত কোথা থেকে ব্যান্ডেজের কাপড় বের করে তার বাঁ হাতটা মুড়িয়ে দিল।
ব্যথাটা শুরু হতে কয়েক মিনিট লাগল, তার আগে সে টেবিলেই মাথা নিচু করে বসে ছিল। এক অদ্ভুত উদাসীনতায় সে কনিষ্ঠাকে জীবন থেকে ত্যাজ্য করে দিতে চাইল, মনে করল তাতে ব্যথার উপশম হবে। ব্যান্ডেজটা লাল হয়ে যেতে থাকে। দুই সার্জেন্ট তাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়, তার চোখ খোলা ছিল। এই প্রথম সে দেখত পেল তাদের শিবিরটি কেমন দেখতে। এখানে বিলাসিতার কোনো স্থান নেই, ন্যূনতম সরঞ্জামে বানানো হয়েছে তাদের একতলার কারাগারটি। চারদিকে মরু রুক্ষতা, কিছু পাথর, দু একটি অতি উষ্ণ আবহাওয়ার গাছ। না, রাজধানী থেকে এতদূরে তার কখনই আসা হয়নি। তাকে ছয় নম্বর কক্ষে ঢুকিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় সার্জেন্টরা। একটু পরে কমিসার ঢোকে, তার হাতে একটা বাক্স। বাক্স থেকে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ বার করে সে, একটা শিশি থেকে সিরিঞ্জে তরল ঢোকায়, তারপর তার বাহুর ওপরে সিরিঞ্জের সুঁইটা প্রবেশ করায়।
এরপরে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম ভাঙে বাইরের করিডরে তুমুল চেচামেচিতে। একটা ভোঁতা ব্যথা মনে করিয়ে দেয় সে একটা আঙুল হারিয়েছে। দরজা খুলে যায়, দুই তরুণ, তাদের সে চেনে না। তারা উত্তেজিত উচ্ছ্বসিত। ‘আমাদের বরেণ্য নেতা, নেতা!’ তারা চিৎকার করে, তাদের আনন্দকে ধরে রাখা যাচ্ছিল না। বিছানা থেকে তারা তাকে উঠতে সাহায্য করে। বাইরে রোদে নিয়ে যায়, সেখানে অপেক্ষা করছিল আর এক নেতা – তাকে তরুণেরা ‘কাপিতান’ বলে সম্বোধন করে। চত্বরের এক কোনায় দুটি দেহ পড়ে আছে।
‘বিপ্লব সফল হয়েছে,’ কাপিতানের মুখমণ্ডল গর্বে স্ফীত, ‘আপনাকে আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি।’ কাপিতানের পেছনে ছজন প্রাক্তন বন্দী, তাদের কাউকেই সে চিনতে পারল না। আলাজিয়ার মতো এরা কেউই উড়তে পারেনি। ‘আপনাকে আমরা রাজধানীতে নিয়ে যাব।’
এই সময়ে কমিসারের ঘর থেকে একটি ফোনের আওয়াজ ভেসে আসে। আর একজন তরুণ সেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে, ‘কাপিতান, আপনাকে চাইছে, রাজধানী থেকে।’ ফোন ধরে কাপিতান আবার ফিরে আসে, তার মুখমণ্ডল গম্ভীর। ‘স্যার, নতুন পরিচালনা পর্ষদ আপনাকে এই শিবিরের কমিসার নিয়োগ করেছে। অভিনন্দন, স্যার।’
উত্তর দিতে দেরি করে না সে। ‘আমি এই পদ প্রত্যাখান করছি, আমাকে রাজধানী নিয়ে চলুন।’
‘আমার এতে কোনো হাত নেই, স্যার। আমি বিপ্লবের ছোটো এক যোদ্ধা মাত্র।’ কাপিতান তার তরুণ সহকর্মীদের মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করে। তারা কমিসারের ঘরে গিয়ে পুরাতন কমিসারকে বের করে নিয়ে আসে, তার হাতে হাতকড়ি, মুখাবয়বে আঘাতের চিহ্ন।
‘এই লোকটি আপনার ওপর অত্যাচার করেছে, এখন থেকে সে আপনার অধীনে,’ বলে কাপিতান। তরুণদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘একে এক নম্বর কক্ষে নিয়ে যাও।’
মাথার ওপরে প্রায় সূর্য, তার তাপ বাড়তে থাকে, হাতের ভোঁতা ব্যাথাটা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। ‘আমার চিকিৎসা লাগবে,’ সে বলে। তার কন্ঠস্বর শুষ্ক।
তার হাতের দিকে তাকায় কাপিতান। ‘নিশ্চয়, আমি রাজধানী গিয়েই আপনার জন্য চিকিৎসক পাঠাবো। আর আপনার জন্য একজন নতুন সার্জেন্ট রেখে গেলাম, খুব করিৎকর্মা, ও আপনাকে দেখে রাখবে।’
তাকে ফিরে যেতে না করেছিল তার স্ত্রী। স্ত্রীর অনেক অনুনয় – ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া কাপিতানের গাড়িটা দেখতে দেখতে - তার এখন মনে পড়ে।
পরদিন সন্ধ্যায় রাজধানী থেকে একটা বড় গাড়ি আসে, তাতে সাতজন নতুন বন্দী। তাদের জন্য বরাদ্দ হলো সাতটি কক্ষ। গাড়ির সঙ্গে আসে আটটি সাদা খাম, আটজন কয়েদীর জন্য নির্দেশনামা। গাড়িতে কোনো চিকিৎসক ছিল না।
তার পরদিন সকালে পুরাতন কমিসারের সঙ্গে দেখা করতে যায় সে, কারাগারের প্রথম কক্ষে। পুরাতন কমিসার বলে, ‘চাকার পাখি কী জিনিস জানেন? সেটা হল চাকার কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত যে শলাকা, চাকার গোলাকৃতি আকার এই পাখিগুলো ধরে থাকে। তবে এই পাখিগুলোর সেরকম দাম নেই।’
চাবি দিয়ে বাইরের জানালার তালাটা সে খুলে দেয়। কারাগারের ছোটো চৌখুপি জানালার বাইরে গিরিখাতের মসৃণ দেয়াল। সকালের সূর্য মসৃণ পাথরের ওপর ঝলকায়। সেই ঝলকানিতে সে জীবন খোঁজে।
পুরাতন কমিসার বলে, ‘আমার ঘরে টেবিলের সর্বনিম্ন ড্রয়ার খুললে নিচে যে পাটাতন, সেটা উঠিয়ে কিছু কাগজপত্র পাবেন। আমি চলে গেলে ওইগুলো যদি একটু পৌঁছে দেন …।’
কারাগারের জানালাটি সে বন্ধ করে না। কমিসারের ঘরে ফিরে এসে সে কাগজগুলো খুঁজে পায়। সেগুলোর একটিতে লেখা, ‘আমার সুপ্রিয়া, এখানে সূর্য কিছুই ক্ষমা করে না। সেই অগ্নিগোলক তোমরা কেমন আছ, কোথায় আছ, কীভাবে আছ – এসব কোনোকিছুই আমাকে ভাবতে দেয় না। রাজধানী থেকে নির্দেশনামা পাই, সেই নিদারুণ আদেশগুলো আমাকে এমন এক অস্তিত্বে রূপান্তর করে যাকে তুমি চিনবে না। তুমি জানো এই অপরিচিত হবার মূল্য হলো আমাদের ছোটো মেয়েটির আর তোমার জীবনের নিশ্চয়তা। ওরা তোমাকে কীভাবে রেখেছে জানিনা, শুধু আশা করতে পারি এই অন্ধকার একদিন দূর হবে।…’
আর একটি চিঠির কিছু অংশ – ‘এই চিঠি হয়তো কোনোদিন তুমি হাতে পাবে। ততদিনে আমাদের মেয়ে বড় হয়ে গেছে। তুমি বুঝতে পারছ এই দূর মরুবাস থেকে আমার আর ফেরা হবে না …’
চাকার পাখি, এই মরুবাস থেকে তার কি আর ফেরা হবে? গতকাল সন্ধ্যায় পাওয়া নির্দেশনামাগুলো টেবিলে পড়ে আছে। এক নম্বর কক্ষের সাদা খামটা সে আবার খোলে। ভেতরে আরো শুভ্র, আরো সাদা একটি কাগজ, তাতে লাল কালিতে টাইপ করা – ‘এক নম্বর বন্দীর বাঁ হাতের ছোটো আঙুল কেটে, প্রমাণ হিসেবে সেটি একটি ব্যাগে করে পরের গাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।’
নতুন কর্তৃপক্ষ কি তার স্ত্রীর খোঁজ পেয়েছে?
টেবিল থেকে উঠে সে ঘরের কোনায় রাখা হিমায়কটি খোলে। একটি প্লাস্টিক ব্যাগে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখে আছে তার কনিষ্ঠা আঙুলটি। পরের গাড়িতে প্রমাণ হিসেবে সে এটা পাঠিয়ে দিতে পারে, তার আরো কয়েকটা দিন লাগবে প্রস্তুত হতে, এই মরু কারাগার থেকে পালাতে। এর মধ্যে সূর্য থেকে দূরে থাকতে হবে। সূর্য তার স্ত্রী কোথায় আছে, কীভাবে আছে তা ভাবতে দেবে না।