সকালে যখন সেন্দাই শহর থেকে ট্রেনে চেপেছিলাম তখন আকাশ ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। অতি দ্রুত গতির ট্রেন, যাকে জাপানী ভাষায় বলে সিনকানসেন, সমুদ্রের তল দিয়ে যখন জাপানের সবচেয়ে উত্তরের দ্বীপ হোক্কাইদোর হাকোদাতে শহরে পৌঁছাল তখন মেঘে ঢেকে গেছে কাছের পাহাড়, দূরের সমুদ্র। এর পরে যে ট্রেনে চাপলাম তা চলল ধীর গতিতে। ট্রেন যত উত্তরে যেতে থাকল, কামরা তত ফাঁকা হয়ে এল। জাপানীরা বিদেশী দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে না, তবু সুদূর উত্তরে একা এই বিদেশী দেখে যে তারা আশ্চর্য হয়েছিল তা বুঝতে পারছিলাম। আমার গন্তব্য সিবেৎসু পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। রেন ইগারি আমাকে সিবেৎসু থেকে কেমন করে বাস ধরে আশাহিচো গ্রামে পৌঁছাতে হবে সেটা একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলেন। বাসে উঠে চালককে ‘শুভ সন্ধ্যা’ জানিয়ে কাগজটা ধরিয়ে দিলাম, সে বিস্মিত হয়ে আমার দিকে চাইল, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে আমাকে অভিবাদন করে পেছনে যেয়ে বসতে বলল। বাসে খুব বেশি লোক ছিল না, তারাও ধীরে ধীরে নেমে গেল।
পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আসার আগে বৃষ্টি নামল, বর্ষা নয়, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। সেই সময় পাহাড়ের ঢালের পাইন গাছের রেখা আঁধারে বিলীন হয়ে যাবার আগে মনে হল বাসে আমি একা নই। চালক ছাড়াও আমার সামনে বা পেছনের সিটে যেন অনেকে বসে আছে, তাদের আমি দেখতে পাচ্ছি না। এই ভাবতে ভাবতেই চালক একটা স্টপে বাস থামাল, তারপর বাসের দরজা খুলে দিয়ে কাকে যেন সম্ভাষণ জানাল। তার ভাবভঙ্গী দেখে মনে হল বাসে কেউ উঠছে। চালক দরজা বন্ধ করে দিল, বাস চলল। কাউকে দেখতে পেলাম না, কিন্তু মনে হল সামনের একটা সিট নড়ে উঠল, কেউ বসলে যেমন হয়। বাইরে ততক্ষণে পুরো অন্ধকার, বাসের ভেতরের আলোয়, বৃষ্টির ফোঁটা লেগে থাকা জানালার কাচে আমার প্রতিফলন দেখলাম, কিন্তু সেই কাচে আর কারুর প্রতিফলন ছিল না। শুধু যে গা শির শির করে উঠল তা নয়, আতঙ্কে হৃৎপিণ্ড থেমে গিয়ে দ্রুত চলতে শুরু করল। ভাবলাম ইগারি সানের কথায় এই অজানা বিঁভূয়ে কেন এলাম।
এক মাসের একটা কাজ নিয়ে জাপানের সেন্দাই শহরে একটি কলেজে এসেছিলাম। সেখানেই রসায়নের শিক্ষক রেন ইগারির সঙ্গে পরিচয়। আমার কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরে কয়েক দিনের ছুটি ছিল, ইগারি সানকে বলেছিলাম উত্তরের দ্বীপ হোক্কাইদো যেতে চাই, হোক্কাইদো আমার কাছে ছিল রহস্যময়। উনি আমাকে একটা গ্রামের ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি একদিকে অ্যাডভেঞ্চার আবার অন্যদিকে নিরিবিলি জায়গা পছন্দ করেন, তাই এই গ্রামে যেয়ে দু দিন থাকুন, আশেপাশের পাহাড়ে হাঁটুন। ওই অঞ্চলের জনমানবহীন, নষ্ট না হয়ে যাওয়া, আদিম প্রকৃতি আপনার ভাল লাগবে।’ ইগারি সান আমাকে আশাহিচো গ্রামের একমাত্র থাকার জায়গা বা হোটেল, জাপানীতে যাকে বলে রিয়োকান, সেখানে দু রাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
লক্ষ করলাম সামনের সিটের পাশ থেকে জলের ধারা এসে বাসের মাঝখানে জমছে, এমন যেন কারুর বর্ষাতি থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কেউ সেই সিটে বসে আছে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না, অথচ বাসের চালক তার সম্বন্ধে অবগত। কিছুক্ষণ পরে বাসটা যখন এক জায়গায় থামল, চালক দরজা খুলে দিল, কাউকে ‘ধন্যবাদ’ বলল – যেমন জাপানের সমস্ত বাস চালক যাত্রীরা নেমে যাবার সময় বলে – তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। এর পরের স্টপে চালক পেছন ফিরে আমাকে কী যেন বলল, বুঝলাম এটাই আমার গন্তব্যস্থল। নেমে যাবার সময় সে আমাকে ‘ধন্যবাদ’ বলল, তারপর অন্ধকারে আমাকে রেখে চলে গেল।
বৃষ্টি থেমেছে। রাস্তার পাশে দু তিনটে বাড়ি, সেগুলোর সামনে ম্রিয়মান বাতি জ্বলছে, ভেতরেও মৃদু আলো আছে। বাড়িগুলোর পেছনেই বন আচ্ছাদিত পাহাড়। মনে হল বাড়িগুলোর জানালা থেকে লোকজন আমাকে দেখছে যদিও আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না। ইগারি সানের দেওয়া মানচিত্র ধরে সেই বাড়িগুলোর পেছনে আমার রিয়োকান খুঁজে পেলাম। দরজায় কলিং বেল টিপলাম, টুং টাং শব্দ হল, কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। বেপরোয়া হয়ে দরজায় ঠেলা দিতেই খুলে গেল। রিসেপশনে কেউ নেই, সেখানে যেয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতেই চোখে পড়ল ইংরেজীতে লেখা একটা কাগজ, আমাকে উদ্দেশ্য করেই। দোতলার একটা ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সেটার নম্বর লেখা, রাতের খাবারও রিসেপশনের পাশের ঘরে ইতিমধ্যেই দেয়া হয়েছে। কাগজটার পাশে আমার ঘরের চাবি। ইগারি সান অন্তত এই ব্যবস্থাটা করে রেখেছিলেন, একটু আশ্বস্ত হলাম। ওপরের তলায় উঠে চাবি দিয়ে দরজা খোলার সময় মনে হল পাশের ঘরটা থেকে চাপা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, আমি ঘরে ঢোকা মাত্রা সেটা বন্ধ হয়ে গেল। জিনিসপত্র রেখে নিচে খেতে গেলাম, ততক্ষণে আমি আর কোনো মানুষ দেখার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। মোবাইল ফোনের কোনো সংযোগ ছিল না, সেটা যে থাকবে না ইগারি সান আগেই বলে দিয়েছিলেন।
জাপানী লোককাহিনীতে অশরীরী অস্তিত্বের কথা প্রচুর। কিন্তু সেই রাতে আশাহিচো গ্রামে মানুষজনের অনুপস্থিতি বা অশরীরীদের উপস্থিতির বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা যে আছে সেটা ভেবে নিলেও তাতে কোন সান্ত্বনা পেলাম না। খাবার খেতে খেতে মন ও শরীর দিয়ে পরখ করছিলাম ঘরে কোনো অশরীরী উপস্থিত আছে কিনা। মনে হল কেউ নেই। রাত আটটার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ, এখন ঘুমানো ছাড়া আর কী উপায়! কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই মনে হল আমার ঘরের উল্টো দিকের দরজাটা খুব আলতো করে কেউ ভেজিয়ে দিল, গায়ে কাঁটা দিল। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা আটকে দিলাম। মেঝেতে জাজিমের ওপর তোষকের বিছানা যাকে তাতামি বলা হয়। বেশ আরামের বিছানা, ভয়ে ভয়ে শুয়ে পড়লেও কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলাম।
টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, বেশ জোরালো শব্দ, বেজেই চলেছে, কেউ ধরছে না। একবার থেমে আবার বাজা শুরু করল, কোথা থেকে শব্দটা আসছে বুঝতে পারছিলাম না। পাঁচ মিনিট এভাবে চলার পরে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে দরজা খুললে বুঝতে পারলাম ফোনটা নিচে বাজছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই রিসেপশন ঘরের এক কোনায় বেশ বড় পুরনো দিনের একটা পে-ফোন চোখে পড়ল। ফোনটা ধরব কিনা বুঝতে পারছিলাম না, আমার জাপানী ‘সুপ্রভাত’, ‘ধন্যবাদ’ ও ‘কেমন আছেন’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু ফোনটা ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ইগারি সানের গলা ভেসে এল - ‘অমল সান! আমি যে কী খুশি হয়েছি আপনাকে পেয়ে, আপনি ভাল আছেন তো?’ বললাম, ‘ভাল আছি, কিন্তু আশাহিচো গ্রামে এসে একটা মানুষও এ পর্যন্ত দেখি নি।’ ইগারি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে, তারপর বলে, ‘অমল সান, আমি খুব দুঃখিত, আপনাকে আমি ভুল খবর দিয়েছি।’ ইগারির ইংরেজী উচ্চারণে, সে কী বলল, ‘ভুল খবর দিয়েছি’ না ‘ভুল জায়গায় পাঠিয়েছি’ বুঝতে পারলাম না। এরপর সে বলল, ‘অমল সান, আপনি সকালের বাস ধরেই ফিরে আসুন, সকাল সাতটায় বাস আছে একটা।’ এর উত্তরে কিছু বলার আগেই লাইনটা কেটে গেল।
ঘড়িতে দেখলাম রাত ১২টা। ফোনটা রেখে চারদিকে তাকালাম, মনে হল ঘরে অন্য লোক আছে, এই অদৃশ্য লোকেরা যেন আমার টেলিফোন ধরার অপেক্ষায় ছিল। প্রসাধনী সেন্টের খুব ক্ষীণ একটা গন্ধ আর পরিধেয় বস্ত্রের ঘষার মৃদু শব্দ। তারপর দেখলাম ঘরের একটা কোনা যেন নড়ে উঠল। নড়ে উঠল বলব না, একটা ঢেউ খেলে গেল দেয়াল ও আসবাবপত্রের ওপর দিয়ে। ঘরটাও ঠাণ্ডা হয়ে এল। এখান থেকে পালাতে হবে, কিন্তু পালানোর রাস্তা কোথায়? সকালের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আতঙ্কের মধ্যেও প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে সিঁড়িতে উঠতে যাব, তখন মনে হল ওপরের ল্যান্ডিংএ জটলা পাকিয়ে অদৃশ্য অনেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ‘মনোনকে’ কথাটা মাথায় এল, মনোনকে জাপানী লোককাহিনীর এক অশুভ অশরীরী আত্মা যা কিনা মানুষের ওপর ভর করে, এরকম অন্ধকার পাহাড়ী বনে তাদের নাকি বাস। মনোনকেরা ওপরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, ওরা জানে আমি পালাতে চাইছি, এতক্ষণ তারা আমাকে কিছু করে নি, কিন্তু ইগারি সান ফোনে কী বলেছে সেটা তারা শুনে ফেলেছে, আমার কি আর সকালে বাস ধরা হবে?
মনোনকে হোক বা যাই হোক ওপরে যেতেই হবে, ব্যাগ নিতে হবে, আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করত হবে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। ওপরের ল্যান্ডিংএ পৌঁছনোর আগেই মনে হল সবাই সরে গেল, সামনের ঘরের দরজাটা আলতো করে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে তাতামির ওপর শুয়ে পড়লাম, ঘড়িতে সকাল ছটার এলার্ম দিয়ে রাখলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার এত আতঙ্কের মধ্যেও ঘুমিয়েও পড়লাম। সকাল হল, বাইরে বের হয়ে গ্রামের একটি লোককেও দেখলাম না। বাস ঠিক সাতটায় এল। গতকালেরই চালক, সে যেন আমাকে দেখে আশ্চর্য হল না, হেসে বলল, ‘সুপ্রভাত’।
সিবিৎসু ও হাকোদাতে হয়ে সেন্দাই শহরে ফিরতে অনেক রাত হল। পরদিন কলেজে গিয়ে ইগারি সানের খোঁজ করলাম। কলেজের অধ্যক্ষ মিউকি সিরাতোরি জানালেন, ইগারি সান ছুটিতে চলে গেছেন। আমাকে কিছু না বলে আজই ছুটিতে চলে গেছেন শুনে আশ্চর্য হলাম, সৌজন্যবশত এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। মিউকি সান আমার বিভ্রান্তি বুঝতে পারছিলেন, উনি নিশ্চয় জানেন কেন ইগারি সান তাড়াহুড়ো করে ছুটিতে চলে গেলেন। মধ্যবয়সী এই নারী খুবই দায়িত্বশীল, বললেন, ‘অমল সান, আপনি হোক্কাইদো যেয়ে একদিনের মধ্যে ফিরে এলেন। বুঝতে পারছি কোনো একটা বিশেষ ঘটনা ঘটেছে। আমি এই ব্যাপারে কিছু জানি না, কিন্তু জাপান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে নির্দেশনা এসেছে এই নিয়ে যেন আপনাকে আমরা কলেজ থেকে কোনো প্রশ্ন না করি। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সেন্দাই শহরের তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুজন প্রতিনিধি আপনার সঙ্গে আজ দেখা করতে চায়, আপনি যখন সময় দিতে পারবেন তখনই তাঁরা আসবেন।’ আমার আশ্চর্য হবার শেষ নেই, বললাম, ‘আজ আমি কিছু করছি না, আমার তো হোক্কাইদো থাকারই কথা ছিল। ওনারা যে কোনো সময়ে আসতে পারেন।’ মিউকি সান বললেন, ‘তাহলে ওনাদের আসতে বলি, আধ ঘন্টার মধ্যে তাঁরা এসে যাবেন।’
আধ ঘন্টা পর যে দুজন এলেন তারা তরুণ, দুজনেরই বয়স ত্রিশ মত হবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি পুরুষ, তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষটি নারী। ঘরে ঢুকেই নত হয়ে ‘শুভ দিন’ জানিয়ে তাঁদের বিজনেস কার্ড দিলেন। পাঠকের সময়ের স্বল্পতাহেতু তাঁদের দুজনের ভাষ্যের সারমর্মটুকু এখানে তুলে ধরছি। তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ব বিভাগ ২০১২ সনে ‘মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট’ নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়। মানুষ যদি মনে করে তার চারপাশে অশরীরী অস্তিত্ব আছে তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। সে কি ভয় পাবে? ভয় পেলে ভয়ের মাত্রার পরিমাণ কতটুকু? এর মাধ্যমে তাঁরা অশরীরী বিভিন্ন অস্তিত্বের কথা লোককাহিনীতে কেমন করে প্রবেশ করেছে সেই সম্বন্ধে একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রজেক্টের বাস্তবায়নের জন্য তারা আশাহিচো গ্রামটি বেছে নেন। ঐ গ্রামে কয়েক ঘর মানুষ মাত্র থাকে, তারা এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করতে রাজী হয়, তাদেরকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেয়া হয়। বাইরে থেকে কোন পর্যটক এলে তারা লুকিয়ে থাকবে বা কিছু প্রকৌশলগত কর্মধারা প্রয়োগ করবে। যেমন বাসের মধ্যে বসার সিট নড়ে ওঠা, কি জলের ধারা, অথবা রিওকানে সেন্টের গন্ধ, অদৃশ্য কাপড়ের ঘষার শব্দ, পাশের ঘরের কথোপকথন। আগন্তুক যে একটি এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণকারী সেটা আগে থেকে জানবেন না, কিন্তু তাঁর মানসিক ও শারীরীক অবস্থা যেন ভাল থাকে, অতিরিক্ত ভয় পেয়ে যেন শক না পান সেজন্য তাঁর ওপর সব্সময় নজর রাখা হয়, আমার ওপরও রাখা হয়েছিল। যদি অবস্থার অবনতি হয় তবে আগন্তুককে সাথে সাথেই সাহায্য করা হবে, অর্থাৎ পরীক্ষকেরা ঘটনাস্থলে আবির্ভূত হবেন। পরবর্তীকালে সফল অংশগ্রহণকারী পুরো ব্যাপারটা জানবেন ও এর জন্য তাঁকে ক্ষতিপূরণ বা পারিশ্রমিক দেয়া হবে। আমার আশাহিচো যাওয়া সম্বন্ধে তাঁরা অবগত ছিলেন না, কারণ বিদেশীদের এই এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণ করানোর কোনো আইনগত অধিকার তাঁদের নেই। আমার কাছে তাঁরা ক্ষমাপ্রার্থী, আমি যদি এতে ক্রুদ্ধ হই সেটা তাঁরা বুঝতে পারবেন, কিন্তু তাঁদের আশা আমি কোনো আইনী ব্যবস্থা নেব না। এই বলে, নত হয়ে, তাঁরা একটি খাম আমার দিকে এগিয়ে দেন, খামের ওপর ২,০০০ ডলার লেখা, আমার ক্ষতিপূরণ।
আমি ক্রুদ্ধ একেবারেই হই নি, কারণ আশাহিচোর ঘটনা জীবনের একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার যে এরকম একটি সাধারণ ব্যাখ্যা হবে তাতে আশাহত হলাম, বুঝলাম নিজের অজান্তেই ভূতজাতীয় কিছুর অস্তিত্বের রোমাঞ্চ চাইছিলাম। ঘোরগ্রস্থ হয়েই দুদিন পরে জাপান ত্যাগ করে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে এলাম। এরপর মাসখানেক কেটে গেল, এক দিন ইগারি সানের ইমেইল এল। উনি লিখেছেন,
‘শ্রদ্ধেও অমল সান, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আপনাকে কোনো খোঁজখবর না নিয়ে আশাহিচোয় পাঠানো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় হঠকারিতা। বলা যেতে পারে আমি আপনাকে একটা জীবন সংশয়কারী অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলাম। ওখান থেকে আপনার সেন্দাই ফিরে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাকে আপনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ না রাখতে নিষেধ করে ও ছুটিতে যেতে বাধ্য করে, আসল ঘটনাটি আপনাকে না বলার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু আমার মনে হয় সত্য ঘটনাটি জানা আপনার প্রাপ্য। আপনাকে কর্তৃপক্ষ যা বলেছে তার মধ্যে একটি কথাই সত্য, এই প্রজেক্টের নাম ‘মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট’, কিন্তু বাকিটুকু সত্য নয়। এই এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবার উৎস দুটি। একটি হল ২০১১ সনে ভূমিকম্পের পরে ৎসুনামি-জনিত কারণে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লীর দুর্ঘটনা ও আর একটি হল তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের এক আশ্চর্য উদ্ভাবন। এই উদ্ভাবনটি হল এমন একটি বস্তু বা বস্ত্র, যার প্রতিসরণ স্থানাঙ্ক এমন যা কিনা আপতিত আলোর পথকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। একে অনেকে মেটামেট্যারিয়াল বলেন। এই বস্ত্র পড়লে পরিধানকারীকে পর্যবেক্ষক দেখতে পাবে না, কারণ পেছনের আলো শোষিত না হয়ে বস্ত্রের সঙ্গে প্রায় সমান্তরালভাবে ভ্রমণ করবে এবং অবশেষে পর্যবেক্ষকের চোখে আপতিত হবে। এর ফলে পর্যবেক্ষক বস্ত্র পরিধানকারীর পেছনের প্রেক্ষাপটটিই দেখবেন। তোহোকু প্রকৌশল বিভাগ উদ্ভাবিত বস্তুটিকে ছোট পিগমেন্ট আকারেও তৈরি করতে সক্ষম হয়, এই পিগমেন্ট যে কোনো ছোট ব্স্তুর পৃষ্ঠে প্রয়োগ করলে তাকে অদৃশ্য করে দেয়া যায়। এই ধরণের অনেক গবেষণা সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর লোকদের অদৃশ্য করে দেবার জন্য, কিন্তু তোহোকুর মেটামেট্যারিয়াল অনেক উন্নত।
‘এবার বলি এই এক্সপেরিমেন্টের আর একটি অনুপ্রেরণার কথা। ২০১১ সনে ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লীর দুর্ঘটনার তেজষ্ক্রিয়তা থামাতে বেশ কিছু কর্মী মারাত্মকভাবে আহত হন, প্রাণে বাঁচলেও তাদের মুখাবয়ব ভয়াবহভাবে পাল্টে যায়। মানসিকভাবে এই মানুষগুলি খুবই বিপর্যস্ত হয়ে যায়, সমাজে আর বাস করতে চায় না, তাদের মনে হচ্ছিল সমাজের কাছে অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারলে তারা ভাল থাকবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তোহোকুর মনস্তত্ব ও প্রকৌশল বিভাগ তখন তাঁদের এই অদৃশ্য হবার প্রকৌশলের কথা জানায়। কিন্তু যারা অদৃশ্য হবে তারা সবাইকে দেখতে পাবে, অথচ অন্যরা তাদের দেখতে পাবে না, একটি স্বাভাবিক সমাজ সেভাবে চলতে পারে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আশাহিচো গ্রামটিকে নির্দিষ্ট করা হয় যেখানে সব মানুষই অদৃশ্য থাকবে, কেউই কাউকে দেখতে পাবে না। আশাহিচোতে বসবাসকারী মানুষদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হল। প্রকল্পের নাম দেয়া হল ‘মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট’। জাপানী লৌকিক কাহিনীতে মনোনকের অদৃশ্য আত্মা যে সব্সময় অশুভ তা নয়, এটি প্রকৃতিরই একটি অংশ যার মধ্যে শুভ ও অশুভ দুই-ই বর্তমান। আমি ২০১০ সনে আশাহিচো গিয়েছিলাম, ভাল লেগেছিল। পরবর্তীকালে এই গ্রামটি যে অদৃশ্য মানুষদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে তা জানতাম না। এক্সপেরিমেন্টটি সম্বন্ধে বাইরের কেউই জানে না, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন রাখতে আপনাকে এটা মনস্তত্বের ওপর এক্সপেরিমেন্ট বলা হয়েছিল। আশা করছি আপনিও এর গোপনীয়তা রক্ষা করবেন। আশাহিচোতে আপনাকে পাঠানোর জন্য আবারো ক্ষমাপ্রার্থী। ভাল থাকবেন। আপনারই - রেন ইগারি।’
ভাবলাম, তাহলে আশাহিচোর পথে বৃষ্টিভেজা একটি মানুষ ঠিকই বাসে উঠেছিল, তার পরা অদৃশ্য কাপড় থেকে জল গড়িয়ে বাসের মেঝেতে জমছিল। মনে পড়ল আশাহিচোর রিয়োকানের খাবার ঘরের একটা কোনার আসবাবপত্রের উপরভাগে যেন ঢেউ খেলে গিয়েছিল। যে মানুষটি ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল তার পরিধেয় বস্ত্রের ওপর দিয়ে পেছনের আলো যে পথ বেছে নিয়েছিল তা হয়তো পুরোপুরি সমান্তরাল হয় নি, সেই আলোর পথের ত্রুটিই আমি দেখেছিলাম। কিন্তু মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট যদি এতই গোপনীয় হয় তবে আশাহিচোতে রিয়োকান কেন খোলা থাকবে? এমন কি হতে পারে একই সাথে এটা দুর্ঘটনায় আহত মানুষদের পুনর্বাসন ও একটি মনস্তাত্বিক এক্সপেরিমেন্ট? এরকম ভাবছি তখনই যে টেবিলে বসে এই গল্পটি লিখছি সেটা নড়ে উঠল, বসার চেয়ারটাও, সেকেন্ড দুয়েক মাত্র। চমকে উঠলাম, ক্যালিফোর্নিয়াতেও কি মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে? কিন্তু তার পরের মুহূর্তে বুঝলাম অদূরে কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে। মনে মনে হাসলাম, একটি ঘটনার কত ধরণের ব্যাখ্যা হতে পারে।