

অশোক স্তম্ভের সিংহরা ধর্মচক্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। ধর্মই তাদের শক্তির উৎস। কিন্তু মোদির সেন্ট্রাল ভিস্তার সিংহরা ধর্মচক্রের মাথায় পদাঘাত করছে। তারা স্বশক্তিধর।
যেহেতু আজ আমাদের প্রজাতন্ত্রকে তার ভিত্তিমূল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেহেতু তার প্রতীকগুলোকেও বদলে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিবর্তন অঘোষিত, তাই প্রতীক-বদলের কুকর্ম – বিকৃতি, বিস্তৃতি ও অঙ্গচ্ছেদের মত অযৌক্তিক উপায়ে পিছনের দরজা দিয়ে করা হচ্ছে। এই চৌর্যবৃত্তির রূপরেখাটা পরিস্কার – স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে উত্থিত জাতীয়তাবাদের ধারণা মুছে, সংবিধানের মূল্যবোধ বিনাশ করে ও বিংশ শতাব্দীর সংগ্রামের ঐতিহাসিক-স্মৃতি লোপ করে বিকৃতির আসন পাতার জায়গা বানানো হচ্ছে। বর্তমান শাসক দলের মূল্যবোধ ও ঘটানো ঘটনাগুলোকে বড় করে দেখিয়ে এই শূন্যতা ভরাট করা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আসন্ন অমৃত মহোৎসব পালনের উদ্দেশ্য, আসলে যতটা না আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধকে স্মরণ করা, তার চেয়ে বেশি তাকে ভুলিয়ে দিয়ে, স্বাধীনতার স্বপ্নের ভারতের থেকে শাসকের “নতুন ভারতের” ফারাক কতখানি – তা তুলে ধরা।
প্রতীকের মানে বদল
নতুন সংসদ ভবনের ওপরে স্থাপিত নতুন অশোক স্তম্ভটা প্রতীক-পরিবর্তনের একটা অংশবিশেষ মাত্র। শুধুমাত্র ক্যামেরার কৌণিক দৃষ্টিতে নয়, সারনাথের আসলটা এবং এর সর্বশেষ সংস্করণের মধ্যে নিঃসন্দেহে পার্থক্য রয়েছে। অশোকের মূল অশোক স্তম্ভ “ন্যায়িক প্রজাতন্ত্র”-র প্রতীক; ন্যায়ের প্রতীক ধর্মচক্রের দ্বারা নির্দেশিত সৌম্য ও শান্তদর্শন এক রাজকীয় শক্তি। প্রফেসর ভিখু পারেখ তার ‘ভারতের জাতীয় প্রতীক নির্বাচন’ প্রবন্ধে জাতীয় প্রতীকের ব্যাখ্যা করে বলেছেন: “পিঠে পিঠ লাগিয়ে চারদিকে মুখ করে থাকা সিংহগুলো বেছে নেওয়া হয়েছিল শক্তির গুরুত্ব বোঝাতে, যা ন্যায়পরায়ণতার ওপর আস্থা রাখা স্থিতিশীল এক শক্তি। প্রতীকের চক্রটার মাধ্যমে ন্যায়কেই চিহ্নিত করা হয়েছে।”
নতুন সংস্করণের সিংহগুলো ভয়ঙ্কর, হিংস্র এবং উগ্র। দৃশ্যত তারা আরও পেশীবহুল এবং চওড়া ছাতির। এবং নতুন সংস্করণটি সত্যিই বৃহৎ - আসলটির ১.৬ মিটারের তুলনায় এর আয়তন ৬.৫ মিটার! রাজ্যসভার সদস্য এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ জহর সরকার দু’টি প্রতীকের ছবি পাশাপাশি পোস্ট করে টুইট করেছেন: “বামদিকের আসলটি শোভন এবং স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাসী। আর ডানদিকেরটা নতুন সংসদ ভবনের উপরে রাখা মোদি সংস্করণ – পাশবিক, অপ্রয়োজনীয়ভাবে উগ্র এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ।”
নতুন সংস্করণটি জাতীয় প্রতীকের অবমাননা করছে কিনা, তা নিয়ে আমি মোটেই উদ্বিগ্ন নই। আমার উদ্বেগের বিষয় হল প্রতীকের বার্তা বা পরিভাষাটার বদল। অশোক স্তম্ভের সিংহগুলোর ভিত্তি ধর্মচক্রের, যাদের শক্তির উৎস ন্যায়। আর আজ মোদির সেন্ট্রাল ভিস্তার সিংহ ধর্মচক্রের মাথায় পা রাখছে। মনে হচ্ছে তারা স্বশক্তিধর। নতুন রুদ্র হনুমান মূর্তির মতই এরাও নতুন সিংহ, যারা হিংস্র। অথবা আমাদের নতুন বুলডোজার নীতির আইনের শাসনের মত।
পতাকা বিধির পরিবর্তন
অশোক স্তম্ভের পরিবর্তনের সাথে আমাদের আরো একটা জাতীয় প্রতীকে বদল আনা হয়েছে, যা অনেকটা দৃষ্টির আড়ালে থেকে গিয়েছে। সম্প্রতি, মোদি-সরকার ভারতের পতাকা বিধি, ২০০২ পরিবর্তন করে যন্ত্রে উৎপাদিত পলিয়েস্টার কাপড় দিয়ে তেরঙ্গা তৈরি করার অনুমোদন দিয়েছে। এই পরিবর্তন জাতীয় পতাকার সাথে মহাত্মা গান্ধীর শেষ যোগসূত্রটাও ছিন্ন করে দিয়েছে। জাতীয় পতাকায় গান্ধীজির ভূমিকার ইতিহাস সবারই জানা আছে। এই পতাকায় তাঁর বিশেষ অবদান ছিল মাঝখানের চরকাটি। পরে গণপরিষদ চরখার বদলে চক্র রাখার সিধান্ত নেয়, যা ধর্মচক্র থেকে নেওয়া। তবু পতাকাবিধি একটা গান্ধীবাদী উপাদানকে ধরে রেখেছিল: “ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে-কাটা এবং হাতে বোনা উল/সিল্ক/খাদি দিয়ে তৈরি করা হতে হবে।”
বেশিরভাগ বিধির মতই এই বিধিও নিয়মিতভাবে ভাঙা হয়। আজ চিনে উৎপাদিত প্লাস্টিকের বা বিটি তুলো দিয়ে মিলে তৈরি জাতীয় পতাকায় দেশ ছেয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এই বিধি, জাতীয় পতাকা বানানো এবং সরবরাহের জন্য স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান, কর্ণাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘের থেকে সংগ্রহ করা পতাকা ব্যবহার করতে সরকার বা সরকারী সংস্থাগুলোকে বাধ্য করত। প্রতীকী এবং আবেগের মূল্য ছাড়াও, এটা হাজার হাজার পরিবারের জন্য জীবিকা নির্বাহের উৎস ছিল। ইন্ডিয়া হ্যান্ডমেড কালেকটিভ সিন্থেটিক পতাকা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
আচ্ছা চলুন, বৈধতা, অর্থনীতি এবং ব্যবহারিকতার বিষয়গুলোকে ছেড়ে দিয়ে, প্রতীক পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। গত কয়েক বছর ধরে মোদি সরকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বৃহদাকার জাতীয় পতাকা স্থাপনে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। দিল্লির আম আদমি পার্টি (আপ) সরকার এই পদক্ষেপকে অনুসরণ করছে। এটা জানা নয় যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) কখনোই জাতীয় পতাকাকে মেনে নেয়নি – ঠিক যেমন তারা ‘জনগণমন’-কে জাতীয় সঙ্গীত বলে গ্রহণ করেনি – এবং অর্ধ শতাব্দী ধরে তারা তাদের নাগপুর সদর-দফতরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেনি।
এখন যেহেতু তারা জাতীয় পতাকার রূপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে, তাই আক্ষরিক অর্থে এর ভিত্তি ও অর্থ পরিবর্তন করাটা নতুন শাসকদের কাছে আবশ্যক হয়ে পড়েছে। খাদির পতাকার অনুভূতি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত: অমসৃণ, অসমতল এবং বাস্তব। ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দেয় সেই পতাকা। দর্শনগতভাবে তা শ্রমের মর্যাদার পক্ষে। কিন্তু ঝাঁ চকচকে, মসৃণ এবং বড় সিন্থেটিক পতাকাগুলো মানুষের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নতুন জাতীয়তাবাদের প্রতীক।
ক্ষমতার প্রতীকীকরণের প্রক্রিয়া
প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহালয় সম্পর্কে সাম্প্রতিক পর্যালোচনায়, দ্য প্রিন্টের ওপিনিয়ন এডিটর রমা লক্ষ্মী এই পদ্ধতিকে “বৃহৎ-ই-সেরা, প্রযুক্তি-সজ্জিত, চমকপ্রদ” হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এটাই মোদি-র সযত্নে তৈরি করা এই ক্ষমতাবান ভাবমূর্তিকে বিকশিত করার তন্ত্র। যদি ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয় থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধগুলির দিকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়, তাহলে ঠিক একইভাবে গ্র্যান্ড স্ট্যাচু অফ ইউনিটি এবং আম্বেদকর মেমোরিয়াল হচ্ছে প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের থেকে বর্তমান শাসকরা যা কৌশলে চুরি করে নিজেদের অনুকুলে ব্যবহার করতে পারে, তারই প্রচেষ্টা। সেন্ট্রাল ভিস্তা এখনও উদ্বোধন করা হয়নি, তবে আমরা অনুমান করতে পারি, যে এটা একটা মহিমা প্রচার এবং বিস্ময়ে তাক লাগানোর প্রচেষ্টা হবে। সম্ভবত ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ‘দেখনদারির রাজনীতি’ বলতে এইটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। যা জনসাধারণকে ফাঁকা বুলি দিয়ে প্রভাবিত করে, যা চারুকলা, বিনোদন এবং চমকের ভেল্কিতে মানুষকে বাস্তব পরিস্থিতি ভুলিয়ে মাতিয়ে রাখে।
মোদি বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাদের থেকে প্রতীকবাদ জিনিসটা বেশি বোঝেন। তিনি জানেন কীভাবে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং ভাষণ ব্যবহার করে জনসাধারণকে জাতীয়তাবাদের ছাঁচে ঢালাই করে ভুলিয়ে রাখা যায়। বিশালাকৃতি সৃষ্টি দিয়ে কীভাবে মানুষকে বিস্ময়াবিস্ট করে রাখা যায়। যাতে তার পাশে জীবনের সমস্যাগুলোকে ছোট লাগে। মানুষের অবস্থা যেরকমই থাকুক না কেন, প্রযুক্তির কৌশল দিয়ে তাকে প্রগতির কথা বুঝিয়ে দেওয়া যায়। বাস্তব জীবনের বলিরেখা সিন্থেটিক উপস্থিতি দিয়ে ঢেকে ফেলা যায়। উগ্রবাদ গভীর হীনম্মন্যতাবোধকে ঢেকে দিয়ে এক সমষ্টিগত আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। এই শান্তরস থেকে রুদ্ররসে রূপান্তর, আত্মিকবোধ থেকে বাহ্যিকবোধে যাওয়া – এক নতুন রাজনীতিকরণ। এটাই তাদের ‘নতুন ভারত’।
সেকুলার ঢ্যামনা | 91.24.***.*** | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:৪৭511676
রিলিজিয়াস ঢ্যামনা | 2405:8100:8000:5ca1::1cc:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:৫১511718
tp | 2405:8100:8000:5ca1::49:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:৫৭511719
dc | 2401:4900:1cd1:558:c848:ec19:96b9:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:০৮511720
dc | 2401:4900:1cd1:558:c848:ec19:96b9:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:১৫511721
শুভদৃষ্টি | 2405:8100:8000:5ca1::217:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:৪৪511729
dc | 2401:4900:1cd1:558:c848:ec19:96b9:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:৫১511731
ভাষাপন্ডিত | 2405:8100:8000:5ca1::1ce:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:৫১511732
dc | 2401:4900:1cd1:558:c848:ec19:96b9:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:০৮511734

S | 2a0b:f4c2:1::***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:২৭511739
S | 2a06:e80:3000:1:bad:babe:ca11:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:৩২511740
দ | 2402:3a80:c85:e917:ecdb:fd79:af8e:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:০০511741
@দীপ্তাংশু চক্রবর্তী | 223.29.***.*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:০৯511742
সিএস | 2401:4900:3eea:6e0b:61ba:cb6e:a29c:***:*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:২৭511743
@Falguni Mazumder | 109.7.***.*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:৪৬511770