গত ৩রা জুন নাকি বিশ্ব সাইকেল দিবস ছিল! আমার জানা ছিল না তারিখটা আর আগে থেকে ভাবাও ছিল না, তা না হলে আমষ্টারডামের তথা সমগ্র হল্যান্ডের সাইকেলের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে একটা বড় সড় জিনিস ফাঁদা যেত। তবে মনে যখন এসেই গেল, ভাবলাম এই নিয়ে কিছু অল্প করে হলেও লিখে ফেলা যাক আজকের কলামে –
সাইকেলের সাথে যে কোন গ্রামের ছেলের মতই আমার সম্পর্ক সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে। একদম ছোটবেলায় যখন গ্রামের রাস্তার অবস্থা একদম ভালো ছিল না আর বর্ষাকালে যা অতিরিক্ত রকম খারাপ হয়ে যেত কাদায়, তখন সাইকেল কাঁধে করে সেই রাস্তা পেরোনো খুবই সাধারণ এবং নিয়মিত ঘটনা ছিল। তবে আমাদের কাছে সাইকেল ছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে একমাত্র যাতাযাতের উপায় – সকালে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া দূরে, জোরে সাইকেল চালিয়ে ফিরে বেলা এগারোটার স্কুল ধরা সাইকেলে চেপে গিয়ে, বিকেলে সাইকেল চালিয়ে ফেরা – আবার কোন কোন সময় সন্ধ্যাবেলা সাইকেল চালিয়ে আবার পড়তে যাওয়া! তো এই সব মিলিয়ে সারাদিনের অনেকটা সময় সাইকেলেই কেটে যেত। এতটা করে সময় সাইকেলে কাটানোর ফলে আমাদের তীব্র নজর রাখতে হত নিজেদের বীচির দিকে – যেন একশিরা রোগ না হয়ে দাঁড়ায়! কৈশোর বা যৌবন কালে একশিরা রোগ কোন কাজের কথা নয়!
বুঝতেই পারছেন যে সেই সময় সাইকেল কেবলই আমাদের কাছে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল। শরীরচর্চার জন্য সাইকেল চাপছি – এমন কনসেপ্ট তখনো নিমোতে ছিল না আর এখনো নেই। সাইকেল চেপে পৃথিবী উদ্ধার করে দিচ্ছি এমন সব ভাবনা চিন্তা তো বহুদূরের ব্যাপার!
হল্যান্ডের লোকেরা সাইকেল খুব ভালোবাসে এবং যতটা সম্ভব ব্যবহার করে এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে একটা ব্যাপার বলে নিই – পরিবেশ বাঁচাতে হবে এই সব কনসেপ্ট চালু হবার বহু আগে থেকেই ডাচে-রা সাইকেল ব্যবহার করত। এবং তার মূলে আছে নিজেদের সুবিধা, সাইকেল চেপে পৃথিবী উদ্ধার করে দিচ্ছি এমন ভাবনা নয়। যাঁরা ভাবেন পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসার জন্যই এই সাইকেলের জনপ্রিয়তা – তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি ওটা রোমান্টিক ধারণা। হ্ল্যান্ডের অনেক বড় শহরে এই সাইকেল ব্যবহার করার অনেক কারণ আছে – তার মধ্যে একটা হল সেটা ব্যবহার করেই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এবং কম পয়সায় একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যায়।
আমষ্টারডাম এমন একটা শহর যেখানে মানুষের থেকে সাইকেল বেশী – মোটামুটি আট লক্ষ লোক বাস করে এই শহরে, আর সেখানে সাইকেলের সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ আশি হাজার মত (২০১৪ সালের হিসেব)। আর এই শহরের সবচেয়ে বেশী রিপোর্টেড ক্রাইম কি জানেন? সাইকেল চুরি। নানা বছরের গড় হিসেব বলছে আমষ্টারডামে বছরে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মত সাইকেল চুরি হয়! এবার এই সংখ্যাটা জানার পর আপনার সাইকেল চুরি হলে কি আপনি আর পুলিশের কাছে যাবেন? কি মনে হয়? এত পুলিশ গোটা হল্যান্ডে নেই যে বছরে ৮০ হাজার সাইকেল চুরির কিনারা করবে!
কিন্তু আমরা এত সব জানতাম না প্রথম যখন আমষ্টারডাম শহরে চাকুরী করতে যাই। আর সাইকেল ছাড়া আমষ্টারডাম ভাবাই যায় না। যাঁরা এখানে গেছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে শহর জুড়ে স্পেশাল সাইকেল চালাবার রাস্তা কেমন আছে। যেটা হয়ত জানেন না সেটা বলে দিই – আমষ্টারডাম শহরে সাইকেল চালাচ্ছে এমন লোকের সাথে পাঙ্গা নেবেন না – কারণ সব কিছুতেই ওদের অগ্রাধিকার। সে যদি ওরা ভুল দিকে ভুল ভাবে চালায় তাতেও! কিছু কিছু সাইকেল চালক তো এত অভদ্র এবং রুড হয় কি বলব। কিন্তু ওদের সাথে তর্ক করা বৃথা। পুলিশে রিপোর্ট করে কিছু হবে এমন হতে পারে যদি আপনি সাইকেল চালাতে চালাতে অন্য কারো সাইকেলে ঠোক্কর খান, মানে সাইকেলে-সাইকেলে আমনা-সামনা আর কি! সাইকেল বনাম মোটর কারের লড়াইতেও সাইকেলের জিত!
সেদিন অফিস শেষে জিম করে বেরিয়ে প্রচুর খিদে পেয়ে গেছে – কুমার বলল, চল তা হলে একেবারে খেয়েই বাড়ি ফিরি যে যার। কুমার সাইকেল নিয়ে আসে অফিস – আমার বাড়ি খুব কাছে বলে আমি আসি হেঁটে। তখন গল্প করতে করতে নদী পেরিয়ে আমরা খেতে চললাম। কুমার নিরামিষ খাবার খায় তার উপর ভারতীয় খাবার ছাড়া ওর কিছু পোষায় না। তাই ওর সাথে চললাম ওর প্রিয় ইন্ডিয়ান রেষ্টুরান্টে – যদি আপনারা আমষ্টারডাম শহরের আনা ফ্রাঙ্ক মিউজিয়াম গিয়ে থাকেন, তাহলে সেখান থেকে মাত্র ৫ মিনিটের হাঁটা পথে এই মুরুগান রেষ্টুরান্ট একদম রোজেনগ্রাগট রাস্তার উপরে। সেখানে গিয়ে কুমারের সাইকেলটাকে রেষ্টুরান্টের পাশে লক করে আমরা খেতে ঢুকলাম।
খেয়ে বেরিয়ে দেখি সেই সাইকেল হাওয়া - বুঝতেই পারলাম চুরি হয়ে গেছে! মাত্র দু-দিন আগে কুমার কিনেছিল সাইকেলটা, সাইকেল সুরক্ষার জন্য এক্সর্টা চেন-টা আর কেনা হয় নি, পরের দিন কেনার কথা। এর মধ্যেই সাইকেল চুরি! কুমারের বিশাল মন খারাপ – আমরা সেই রাতের বেলায় গেলাম কাছের পুলিশ স্টেশনে। গিয়ে কুমার বলল, “আমার সাইকেলটা কে নিয়ে চলে গেছে”। পুলিশ জবার দিল, “তা তুমিও অন্য কারো একটা নিয়ে চলে যাও”! আমরা গেলাম ঘাবড়ে, বুঝতে পারছি না পুলিশ ইয়ার্কি করছে কিনা। এতো ভালো ভাষায় চুরি করতে পরামর্শ দিচ্ছে। আমরা কি করব বুঝতে না পেরে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে রইলাম – আমাদের অবস্থা দেখে একজন মহিলা পুলিশের দয়া হল। ডেকে বলল, “দ্যাখো, রিপোর্ট করতে চাইছো কর। কিন্তু আমষ্টারডামে বছরে প্রায় ৮০ হাজার সাইকেল চুরি হয়। তোমার কি মনে হয় আমাদের সময় বা লোকবল আছে এত সাইকেল খুঁজতে বেরোনোর!” যা বোঝার বুঝে গেলাম – বাড়তি পরামর্শ দিলেন উনি যে পরের বার সাইকেল কিনলে খুব ভালো একটা তালা কিনতে।
এই দামী তালা কেনার পরামর্শ পরে সবাই দিয়েছিল – খুবই কমন ব্যাপার এটা। আপনি মাঝে মাঝে লক্ষ্য করলে দেখবেন পুরানো সাইকেল যার দাম হয় ৭৫ ইউরো হবে তাতে একটা ৫০ ইউরোর তালা ঝুলছে! সাইকেল চোরেরা সাধারণ তালা লাগানো সাইকেল বেশী চটপট চুরি করে। তারপর এটাও খেয়াল রাখতে হবে আপনাকে যে এমন ভাবে তালা লাগাবেন যাতে করে সাইকেলের পার্টস আলাদা করে খুলে নিয়ে চলে যেতে পারবে না কেউ! অনেক সময় দেখেছি শুধু তালা লাগানো সাইলেকের চাকাটা পরে রয়েছে, আর বাকি ফ্রেম শুদ্ধু সব কিছু হাওয়া। এছাড়াও অনেক ট্রিকস আছে – রঙচঙে সাইকেল বা নানা কিছু দিয়ে সাজানো সাইকেল কম চুরি হয়, কারণ এগুলো চট করে চোখে পরে যাবার সম্ভাবনা। কিন্তু কিছু পাবলিক আবার ক্রিয়েটিভ আইডিয়া বের করেও সাইকেল পার্কিং করে!
কুমারের সাথে মাঝে মাঝেই সাইকেল ঘটনা ঘটত। বেচারী সারাজীবন পড়াশুনা করে গেছে মুখ গুঁজে – ভারতে থাকাকালীন তেমন ভাবে সাইকেল চাপার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই নানা সময়েই কেলোর কীর্তি করে ফেলত আর দিত ফাইন! একদিন অবশ্য সে নিজে ভুক্তভুগী হল – অফিস থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যাবেলা (সেদিন হেঁটে ফিরছিল) কুমার-কে ধাক্কা মেরে দিল সাইকেলে। ছিটকে পড়ল – ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ, পকেটের মোবাইল আছাড় খেয়ে পড়ল। পুলিশের কাছে যাওয়া হল – ল্যাপটপ না হয় কোম্পানীর, তারা ঠিক করে দেবে। কিন্তু মোবাইল যে আছড়ে ভেঙে গেল, তার জন্য কিছু যদি কমপেনশেশন পাওয়া যায়! কিন্তু ওই যে আগেই লিখেছি, হল্যান্ডে সাইকেল-ওলার জিত সর্বত্র। পুলিশ বলে দিল কুমারকে তোমারই ভুল – সেটেলমেন্ট কিছু হবে না! তবে সেই মহিলার মনে হয় পরে খারাপ লেগেছিল সমগ্র ব্যাপারটা - পুলিশ স্টেশন থেকে বেরুবার সময় কুমারকে ৫০ ইউরো দিল নিজে থেকেই। এক ডাচের পকেট থেকে ৫০ ইউরো স্বেচ্ছায় বের করা মানুষের চাঁদে পদার্পণের থেকেও বেশী বিষ্ময়ের!
আর তা ছাড়া আমার অ্যাপার্টমেন্ট ছিল একেবারে আমষ্টারডামের প্রাইম জায়গায়। স্টুডেন্ট লাইফে ওই জায়গায় হোটেল ভাড়া করে থাকা সম্ভব ছিল না – জানেন হয়ত যে আমষ্টারডাম খুব কষ্টলি জায়গা। অবশ্যই বেশ কিছু হোষ্টেল আছে – আমার বাড়ি না থাকলে পাবলিক ওই হোষ্টেলেই থাকত। কিন্তু আমষ্টারডামের হোষ্টেলেও বেশ খুঁজে পেতে যাওয়াই ভালো, যদি গাঁজা খান তাহলে অসুবিধা নেই – কিন্তু যদি গাঁজা না খান তাহলে অ্যাডজাষ্ট করতে আসুবিধা হতে পারে।
আমষ্টারডাম শহরে একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় টুরিষ্টিক জিনিস হচ্ছে সাইকেলে করে শহরটা ঘোরা – তাই সেবার ইংল্যান্ড থেকে বন্ধুরা আমষ্টারডামে ঘুরতে এলে ঠিক হল সাইকেল ট্যুর তো করা যাক একদিন অন্তত! গ্রীষ্মকালে তো খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এমন – টলমল করতে করতে প্রচুর টুরিষ্ট সাইকেল চালাচ্ছে, আর পাশ দিয়ে প্রবল স্পিডে সাইকেল চালিয়ে ডাচ পাবলিক যাবার সময় রাগ করে গালাগালি করে ফলছে মাঝে মাঝে, কারণ এই টুরিষ্টরা ঠিক ঠাক নিয়ম মেনে সাইকেল চালাচ্ছে না!
এই সব আমি খুলে বললাম বন্ধুদের – ওলা, আইরীণ, জেন বলল কোন প্রবলেম নেই, এই সাইকেল চালানোর এক্সপিরিয়েন্স না থাকলে হয় নাকি! কিন্তু যোসেফ একটু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল – তবে তার মূল কারণ অন্য। যোসেফের মত আনফিট পাবলিক এবং তার থেকে বড় আনাড়ী সাইকেল চালক আমি জীবনে খুব একটা বেশী দিন দেখি নি। আমাকে গর্বের সাথে জানালো যে ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত কোনদিনই নাকি হেঁট হয়ে নিজের পায়ের পাতা ছুঁতে পারে নি সে! আমার সেই বার্মিংহামের ঘটনা মনে পরে গেল। যোসেফকে মাঝে মাঝে আমি ভারতীয় জিনিস শেখাতাম – একদিন শেখাচ্ছিলাম হাতে করে চটকে কি ভাবে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে হয়। ভাত মাখল আমার দেখে দেখে, মন্ড পাকিয়ে হাতের তালুতে নিয়ে মুখের কাছে আনল – এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু এর পরে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেলে যে মুখে খাবারটা ঢোকাতে হবে সেটা আর পারল না! মানে এত আনফিট! শেষ পর্যন্ত বাঁহাতে চামচ নিয়ে সেটা দিয়ে ঠেলে খাবার মুখে ঢোকালো। আর একদিন টি ভি রুমে কার্পেটে বসে ওকে ভারতীয় স্টাইলে মাটিতে বসে ভাত খাওয়া শেখাচ্ছিলাম। কিন্তু সে এবার কিছুতেই ‘বাবু’ হয়ে বসতে পারে না, পা ভাঁজ করতেই পারছে না! জোর করে বাঁ হাত দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে আছে বাবু হয়ে বসে। এবার পিছলে গেছে সেই আঙুল – পা গেছে স্প্রীং এত মত ছিটকে, সামনের থালা-টালা ছড়িয়ে যা তা ব্যাপার। অনেক ক্ষণ ধরে আমি আর যোসেফ কার্পেট ক্লীন করলাম।
তার থেকেও বড় কথা যোসেফের সাথে সাইকেল নিয়ে ইংল্যান্ডে নানা ফালতু ঘটনায় জড়িয়ে যেতাম এককালে – বারে বারেই – এবং কয়েকবার তো তা পুলিশের কাছ পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল! একটা ছোট্ট সাইকেল সংক্রান্ত ঘটনা এখানে বলে নিই –
যোসেফ এখন তার দেশে প্রোফেসর হয়ে গ্যাছে ইউনির্ভাসিটিতে। মেয়েদের প্রতি জো-র দূর্বলতা ছিল অসীম এবং আমাদের থাকার বাড়িতে তা ছিল সর্বজনবিদিত। তবে সেই দূর্বলতা মাতৃ বা ভগিনী ভাবের নয় – পুরোটাই প্রেম মূলক। যোসেফ এর আন্ডারে এখন ছেলে পুলে মাষ্টার্স এবং পি এইচ ডি করে। মাঝে মাঝে আমাকে যোসেফ এক্সটারন্যাল এক্সজামিনার হবার জন্য অনুরোধ জানায়। ইউনিভার্সিটি গিয়েও যোসেফ তার ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছে, আমাকে যে কটা থিসিস এক্সামিন করতে বলেছে এখনো পর্যন্ত তার সব কটাই মেয়ে!
একদিন ইউনিভার্সিটি ল্যাবে কাজ করছি, হন্তদন্ত হয়ে হয়ে সাদা ল্যাব কোট পরে যোসেফ আমাদের ল্যাবে ঢুকলো। সে কাজ করত আমাদের পাশের ল্যাবে। হন্তদন্ত ব্যাপারটা আপেক্ষিক – যোসেফ হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছে মানে সে খুব ব্যাস্ত এমন কিছু নয়। ওই যেমন মেমারী স্টেশন বাজারের পানের দোকানের মধু-দা। জীবনে কেউ কোনদিন ওকে শান্ত অবস্থায় দ্যাখে নি দোকানে – খদ্দের থাকলে ঠিক আছে, ফাঁকা দোকানেও সে নিদারুন ব্যস্ত থাকত। মধু-দা আর যোসেফ এই ব্যাপারে সমগোত্রীয়। তো যাই হোক ল্যাবে ঢুকেই আমাকে যোসেফ বলল,
“সুকি, এখন তোর সব ফালতু এক্সপেরিমেন্ট থামা। কারমেন বিশাল সমস্যায় পরে গ্যাছে, আমাদের যেতে হবে”।
আগেই বলেই কারমেন হল আমাদের বাড়িতে থাকা স্প্যানিশ মেয়ে যে আমাকে ভারতীয় রান্না নিয়ে প্রশ্ন করে পাগল করে দিত! কারমেন কি সমস্যায় পড়েছে যার জন্য আমাদের ছুটতে হবে এক্সপেরিমেন্ট ফেলে সেটা যোসেফ-এর কাছ থেকে বুঝে নিতে বেশ সমস্যা হল। যা বুঝতে পারলাম, কারমেন গ্যাছে সাইকেল নিয়ে হারবোর্ণ মার্কেটে সেন্সবেরী-সুপারমার্কেটে বাজার করতে। সে মেয়ে দোকানের সামনে একটা লাইট পোষ্টে সাইকেলটা চেন দিয়ে বেঁধে তালা লাগিয়ে বাজার করতে গ্যাছে। বাজার করে বড় ব্যাগ নিয়ে সাইকেলের কাছে ফিরে এসে দ্যাখে তার পকেটে চাবি নেই! কোথায় হারিয়ে ফেলেছে – একটু খানি এদিক ওদিক খুঁজে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় যোসেফ-কে ফোন করে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য। যোসেফ-কেই কেন কারমেন ফোন করে তার কারণ আমি শুরুতেই ব্যাখা করে দিয়েছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার হলে আমাদের কর্তব্য কি? বাসে করে তাকে চলে আসতে বল – পরে আমরা গিয়ে কিছু একটা করব সাইকেলটা নিয়ে। যোসেফ জানালো, ওটা কারমেনের সাইকেল নয়, তার ডিপারমেন্টে থেকে কার কাছে ধার করে বাজার গিয়েছিল। মোট কথা কারমেনের বিশাল প্রেস্টিজ ইস্যু হয়েছে। আমি যোসেফ-কে বললাম , যাব না এখন, এক্সপেরিমেন্ট করছি। সেই শুনে যোসেফ বিশাল এক ডায়লগ দিল ভৈরব গাঙ্গুলির যাত্রার মত। আমি নাকি প্রকৃত বন্ধু নয় – দুঃসময়ে তার পাশে নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। কি আর করা, অগত্যা বললাম চল। এবার আলোচনা শুরু হল, কিভাবে সেই চেন কেটে সাইকেল উদ্ধার করব আমরা। পাশেই রব উইন্সলি এক্সপেরিমেন্ট করছিল, আমাদের কথা শুনে বলল এমত অবস্থায় আমাদের উদ্ধার করতে পারবে একমাত্র নীচের মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপের ডেরেক। রবের মিনি কুপারের চাকায় কদিন আগে নাকি ডিপারমেন্টের সামনে ভুল জায়গায় পার্কিং-এর জন্য ক্ল্যাম্প লাগিয়ে দিয়েছিল। ডেরেকের কাছ থেকে কাটার নিয়ে সেই ক্ল্যাম্প কাটতে সক্ষম হয় সে! আমরা দেখলাম চাকার ক্ল্যাম্প যখন কাটা গ্যাছে তখন চেন তো কোন ছাড়।
আমারা দুজনে দুরদার করে ডেরেক এর কাছে হাজির হলাম। ডেরেক সব ডিটেলসে শুনল, কেমন ধরণের চেন ইত্যাদি (আমরা কারমেন কে ফোন করে কনফার্ম করলাম)। সব শুনে ডেরেক বলল, “আমি লিগ্যালি তোমাদের সাহায্য করতে পারি না”। যোসেফ রেগে গিয়ে মলটিজ ভাষায় জাতীয় খিস্তি করল, “তাহলে বাঁড়া আমাদের সময় নষ্ট করলে কেন?” ডেরেক বলল, “আমি নিজে হাতে তোমাদের সাহায্য করতে পারি না, তবে ওই ড্রয়ারের নীচের তাকে যে কাটার-টা আছে সেটা দিয়েই সাইকেলের চেন কাটা যাবে। তোমরা নিজে হাতে নিয়ে যাবে এবং পরে ওখানেই জমা করে যাবে”। আমরা কাটার নিয়ে ছুটলাম। যোসেফ-এর সেই ভাঙা মারুতি ৮০০ এর মত দেখতে ভক্সোয়াগেন গাড়িটায়। টেনশনের চোটে আমাদের সেই সাদা ল্যাব কোট গুলোও খোলা হয় নি।
পরের দৃশ্যে আমি আর যোসেফ সেই হারবর্ণ মার্কেটে মেন রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোষ্টে বাঁধা সাইকেলের চেন কাটার চেষ্টা করছি, পরণে সাদা ল্যাব কোট। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম কোথা থেকে পুলিশের গাড়ি চলে এল – মনে হয় আশে পাশে টহল দিচ্ছিল। এসেই আমাকে আর যোসেফ-কে পাওড়াও। ওদিকে পুলিশের গাড়ি আসতে দেখেই কারমেন হাওয়া – মেয়ে চালাক। যোসেফ পুলিশ-কে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করছে কারমেনের ডাকেই আমরা হাজির হয়েছি। পুলিশ বলল কারমেনকে ডাকা হোক – কোথায় তখন কারমেন! অনেকক্ষণ হ্যাজানো চলল – আমরা ড্রাগ অ্যাডিক্ট কিনা, মানে সাইকেল চুরী করে ড্রাগ কিনি কিনা সেই নিয়ে তল্লাশী হল। সাদা পোষাক পরে আছি কিনা সেই নিয়েও বাওয়াল – শেষ পর্যন্ত ইউনিভারসিটির পরিচয়পত্র দেখিয়ে মুক্তি পেলাম।
ফেরার সময় যোসেফ কে বললাম, “কি রে তোর কারমেন তো হাওয়া হয়ে গেল!” যোসেফ উলটে আমাকে চার্জ করল, “পুলিশ দেখে ভয় খাবে না! নাজুক মেয়ে কারমেন – সুকি, তোর এই সব ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই।। তুই চুপ থাক”।
তো যাই হোক, আমষ্টারডামের গল্পে ফিরে আসা যাক। এই সব ইতিহাসের সাথে জড়িত থাকার জন্য আমি যোসেফের সাথে সাইকেল নিয়ে আমষ্টারডাম ট্যুর দিতে রাজী হচ্ছিলাম না। যোসেফ নিজেও যেতে রাজী নয় – কিন্তু বাকিরা যাবেই সাইকেল ট্যুরে। ভোট হল - যোসেফ ভোটে হেরে গেল – মানে ওকে বলা হল তোকে সাইকেল চালাতেই হবে। শেষে রাজী হয়ে যোসেফ আমাকে বলল যে দিনের শেষে আমি যদি ক্লান্ত হয় যাই, তুই আমাকে বহন করে নিয়ে আসবি, আর তা না হলে আমি সাইকেল ফেলে ট্রাম ধরে বাড়ি চলে আসব।
তাতেই রাজী - আমার বাড়ির সামনেই একটা সাইকেল ভাড়া পাবার দোকান ছিল। সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে আমরা বের হলাম ঘুরতে – আমষ্টারডাম শহর হাতের তালুর মত আমার চেনা থাকায় ম্যাপের সাহায্য নিতে হল না। আর ভাবলাম ওদের মূল শহরের ভীড় ভাট্টা থেকে বার করে নিয়ে গিয়ে একটু অপ্রচলিত জায়গায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। সেন্ট্রাল স্টেশনের পিছন দিকে ফেরী করে নদী পেরিয়ে একটু গ্রামের দিকে গেলাম, ওখানে একটা ভাঙা উইন্ড মিল ছিল। আর পার্কটাও খুব সুন্দর – হালকা কান্ট্রি-সাইডের ছোঁয়া। সাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে আমাদের অফিসের সবার প্রিয় পাব, সেই ‘টোলহাউস’ (যা একদম ফেরীর কাছেই নদীর ধারে) এ বসে বসে বিয়ার পান করা হল। এদের এখানে কিছু স্পেশাল বেলজিয়ান বিয়ার পাওয়া যায় (লা ফে বা আমষ্টেল ও খুব জনপ্রিয় এখানে) – সেই সব ট্রাই করা হল।
আবার মূল শহরে ফিরে কিছু চেনা জায়গাও ওদের দেখিয়ে দিলাম – রাইজমিউজিয়ামের পাশ দিয়ে, হাইনিকেন ব্রুয়ারী, এবং সেই বিখ্যাত ভুন্ডল-পার্কে চক্কর কেটে বেশ বিকেল হয়ে গেল। যোসেফ ক্লান্ত, এদিকে বেশ খিদেও পেয়ে গেছে সবার। আমরা কিছু স্যান্ডউইচ এবং স্ন্যাকস কিনে নিয়ে চলে এলাম ওয়েষ্টার পার্কে – সেখানে শয়ে শয়ে পাবলিক পিকনিকের মত করছে – আমরা ঘাসের উপর বসে পড়লাম – খেতে খেতে ভাঁট হল অনেক। ওদিকে যোসেফ ঘুমিয়ে পরেছে গাছের তলায়।
আরো বিকেল হয়ে এলে পড়ন্ত বিকেলে পার্ক থেকে উঠলাম – সারাদিন সাইকেল চালিয়ে ওদের সবারই পা ক্লান্ত হয়ে গেছে। সাইকেল জমা দিয়ে ধীর পায়ে বাড়ি ফিরলাম সবাই – মনের গভীরে গেঁথে গেল একটা স্মরণীয় দিন। স্মরণীয় দিন শুধু আমষ্টারডামের সৌন্দর্য্য সাইকেলে চেপে দেখার জন্য নয়, আমার কাছে স্মরণীয় কারণ সেই প্রথম বার যোসেফের সাথে সাইকেলে বেরিয়ে কোন রকম ঝামেলায় না জড়িয়ে ঘরে ফিরলাম!
বাহ, দারুন লাগল। এক চক্কর লাগিয়ে বেশ আমস্টারডাম মানস ভ্রমন করে নিলাম
একদম।
ধন্যবাদ রমিতবাবু, রঞ্জনদা - আমষ্টারডামে সাইকেল বড়ই দেখার জিনিস এবং একই সাথে জটিল তাদের ব্যবহারও :)