(১.১) মহাপুরুষদের জীবনী
আমাদের ছোটবেলায় একজাতের বই বাড়িতে এবং স্কুলে অবশ্য পাঠ্য ছিল – মহাপুরুষদের জীবনী। তাতে ক্ষুদিরাম, নেতাজি ও সূর্য সেনের মত স্বাধীনতা সংগ্রামী, রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও আম্বেদকরের মত সমাজসংস্কারক, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের মত সাহিত্যিক এবং চৈতন্য, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মত ধর্ম সংস্কারক সকলেই একসারিতে জায়গা পেতেন।
এঁদের জীবনীর একটি ছাঁচ আছে। এঁরা কোন বিশেষ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে প্রেরিত। এঁদের জন্মসূত্রেই প্রতিভার স্ফুরণ দেখা যায়। এঁরা কখনও ভুল করেন না। কাজেই ভুল স্বীকার করার প্রশ্ন ওঠে না।
এঁরা মহাপুরুষ কেন? দুটো কারণে।
এক, এঁদের রাস্তা কখনোই মসৃণ নয়, বরং কাঁটায় ভরা। কিন্তু সব প্রতিকূলতা সব বাধা দু’হাতে সরিয়ে এঁরা এগিয়ে চলেন।
দুই, এঁরা কখনও ক্ষুদ্র স্বার্থে আদর্শের সঙ্গে আপস করেন না। তাই আর্থিক কষ্ট এঁদের নিত্যসঙ্গী আর পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সবাই এঁদের ভুল বোঝে। ফলে অধিকাংশ সময় এঁরা বড় নিঃসঙ্গ।
আমরা এঁদের আদর্শ জীবনী পড়তে পড়তে বড় হই। এবং বড় হতে হতে বুঝে যাই ওই আদর্শ চরিত্র ঠিক আমাদের মত অকিঞ্চনের মডেল নয়। ওঁরা অনেক উঁচুতে বসে আছেন। হাত বাড়িয়ে নাগাল পাওয়া দুষ্কর। তাঁদের আমরা পুজো করি, কিন্তু তাঁদের মত হওয়া? সে বড় কঠিন। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরও অমন আদর্শ মানব বা মহামানব হতে বলি না। জানি, ওঁরা ক্ষণজন্মা, সবাই চাইলেও অমন হতে পারবে না। আমরা পদে পদে আপস করি। আমাদের জীবন বৈপরীত্যে ভরা। ওঁদের জীবন সোজা সপাট, কোন ধূসর এলাকা নেই।
আজও অধিকাংশ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তীতে তাঁদের প্রণাম জানিয়ে ইতিকর্তব্য সারে। তাঁদের কর্মজীবন বা লেখাপত্রকে অনুধাবন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না। তাই ওঁদের মাথার পাশের জ্যোতির্মণ্ডল অপরিবর্তিত থাকে। তাঁরা পূজনীয়, তাই তাঁদের যাপিত জীবন বা তাঁদের উত্তরসূরীদের জন্যে বাতলে দেয়া পথ নিয়ে ঠিক বা ভুল কোন প্রশ্ন তুললেই ভক্তকুল রে রে করে ওঠেন। কার সম্বন্ধে কথা বলছে, জান? সাহস তো কম নয়! এ তো মহাপুরুষদের স্ট্যাচুতে কালি লেপে দেয়া!
সে গান্ধীজির নোয়াখালি যাত্রায় যৌনশক্তি নিয়ে অসংবেদনশীল পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হোক, বা নেতাজির প্রেমপত্র। খেয়াল করি না প্রথমটির উৎস যাত্রাসঙ্গী নির্মল কুমার বসুর দিনলিপি যা তিনি লিখেছিলেন গান্ধীজিকে জানিয়েই। দ্বিতীয়টির সমর্থন মেলে সুভাষের জার্মান স্ত্রীর কন্যা অনীতা বসুর থেকে।
এতসব সাতকাহনের একটাই কারণ। সদ্য পড়ে শেষ করেছি একটি বই যা আমাকে বিচলিত করেছে। বইটির নাম “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”। লেখক দেবোত্তম চক্রবর্তী, এটি সম্ভবত তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত বই। চারশ ছত্রিশ পাতার রুচিসম্মত অলংকরণ করা হার্ডকভার বইটির দাম ৬২০/- টাকা, প্রকাশক - কলাবতী মুদ্রা।
(১.২) আমি কেন বিচলিত?
আমি বড় হয়েছি বিদ্যাসাগরকে প্রায় বীরপুজো করে। উনি বীরসিংহের সিংহশিশু; মার সঙ্গে দেখা করতে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দামোদর সাঁতরে পার হয়েছেন।স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পড়েছি তিনি নারীজাতির প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করেন। তাই বহুবিবাহ বন্ধ করানো, বিধবার বিয়ে দেয়ার জন্যে গোঁড়াদের সঙ্গে লড়ে আইন পাশ করানো -সব করেছেন। এঁর জন্যে তাঁর উপর শারীরিক হামলাও হয়েছে। তারপর জেনেছি বাংলাভাষাকে দাঁড় করানোর জন্যে উনি প্রাইমার লিখেছেন। তাতে ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’র সহজ চিত্রময়তা ও সংগীতে রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ। শুধু এটুকুই নয়, কলেজ স্তরে বাংলা শেখানোর যে পাঠ্যবই লিখেছেন তাতে ইতিহাস, মহাপুরুষদের লাইফ স্কেচ, সীতার বনবাস বা অভিজ্ঞান শকুন্তলম থেকে অনুবাদ সবই আছে। এবং তাঁর হাত ধরে বাংলা ভাষাও ক্রমশ ‘এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। ইহার শিখরদেশ সততসঞ্চরমাণ জলধরপটলসংযোগে’ থেকে সরল এবং প্রসাদগুণ সম্পন্ন হয়েছে, বিশেষ করে ‘প্রভাবতী সম্ভাষণে’।
তারপর জেনেছি উনি ব্যালান্টাইন সায়েবকে চিঠি লিখে সাংখ্য ও বেদান্তকে ভুল দর্শন বলে তার অ্যান্টিডোট হিসেবে মিলের লজিক পড়াতে রেকমেন্ড করেছেন। আমার যৌবনের বামপন্থী মন উড়ুনি গায়ে দেয়া তালতলার চটি পরা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মধ্যে এক ব্যতিক্রমী প্রায় অজ্ঞেয়বাদী বা সংশয়বাদী আধুনিক মানসকে দেখতে পেল।
এখানেই শেষ নয়। অবধারিত ভাবে আসবে তাঁর চরিত্রের দার্ঢ্য ও ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গ। সেই ঔপনিবেশিক সমাজে ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত মানুষজন যখন শাসক ইংরেজের সায়েবদের মোসায়েবি করতে ব্যস্ত, তখন এই ইংরেজি জানা মানুষটি কখনই বুট-হ্যাট-কোটে সায়েব হওয়ার চেষ্টা করেননি। বরং এক সায়েবের বুটজুতো ট্রেনের জানলা গলিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন! দরকার পড়লে সদর্পে দেশের রাজন্যদের নাকে চটিজুতো পরে টক করে লাথি মারতে পারেন!
ফলে আমার কৈশোরপরবর্তী মানসে উনি একাধারে কলোনিয়াল প্রভু এবং দেশি সামন্তপ্রভুদের বিরুদ্ধে এক আপসহীন প্রতিবাদী চরিত্র। আর প্রথম বিধবা বিবাহ দিলেন ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে। একেবারে আপনি আচরি ধর্ম!
তারপরে শেষ জীবনে পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ। ‘আপনজনে ছাড়বে তোরে তা বলে ভাবনা করা চলবে না’। কলকাতা ছেড় কার্মাটারে সাঁওতালদের মধ্যে জীবন কাটানো! একাকী বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ ট্র্যাজিক নায়ক। আমার পছন্দের মহাপুরুষ। যাঁর কথায় কাজে ফাঁক নেই, ফাঁকি নেই। কিন্তু উপরের বইটি আমার সযত্নে লালিত এতদিনের বিশ্বাসের গোড়া ধরে টান দিয়েছে। বিভিন্ন তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে দেখাতে চাইছে যে উপরের অনেকগুলো আখ্যান ভক্তজনের তৈরি মিথ, অতিকথন বা প্রেক্ষিত থেকে আলাদা করে টেনে মানে করা, চটজলদি সিদ্ধান্ত নেয়া। আমার প্রাথমিক মনস্থিতি হোল বিরক্তি। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে টানাটানি কেন? লোক কি কিছু কম পড়িয়াছে?
(১.৩) ‘তুমহারা পলিটিক্স ক্যা হ্যায় পার্টনার’?
কিন্তু ইদানীং ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে খোদ আমেরিকাতেও যখন অনেক মহাপুরুষের মূর্তি ধরা টানা হচ্ছে তাহলে পরাধীন ভারতের মহাপুরুষরা কেন বাদ যাবেন? বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ? নতুন তথ্যের আলোকে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন অবশ্যই কাম্য। ইতিহাস সব সময়েই ক্ষমতার ইতিহাস, বিজয়ীরা লেখে। অন্য স্বর চাপা পড়ে যায়। তাহলে সব ইতিহাস লেখনেরই অ্যাজেন্ডা থাকে। ভিন্সেন্ট স্মিথ আর রমেশচন্দ্র দত্ত, যদুনাথ সরকার বা রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা একরকম হতে পারেনা। দু’দলেরই নিজস্ব অ্যাজেন্ডা (কলোনিয়াল বনাম অতীত গৌরবগাথা) অনুযায়ী নিজস্ব অতিকথনের ঝোঁক থাকে। তাহলে চক্রবর্তী মশায়ের অ্যাজেন্ডাটি কী?
আধুনিক হিন্দি কবিতার সবচেয়ে উঁচু আসনে যাকে অকাদমিক দুনিয়া বসিয়ে রেখেছে তিনি হলেন ছত্তিশগড়ের গজানন মাধব মুক্তিবোধ। রাজনৈতিক বিশ্বাসে সাম্যবাদী কিন্তু কবিতার আঙ্গিকে সুকান্ত-সুভাষ নয়, বরং বিষ্ণু দে-অরুণ মিত্র ঘরানার।
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁর বহু উচ্চারিত একটি বাক্য হল - ‘তুমহারা পলিটিক্স ক্যা হ্যায় পার্টনার’? একই প্রশ্ন ছিল আমারও, তবে গোটা বইটি বার দুই পড়ার পর আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে ইনি বাংলার কলোনিয়াল হিস্ট্রির অপর স্বরের নির্মাণে ব্যস্ত। এঁদের প্রেমিসগুলো মোটামুটি এইরকম:
১) বৃটিশ কলোনিপ্রভুরা বাণিজ্যিক লুঠের স্বার্থে যেমন ভারত তথা বাংলাদেশের কৃষি ও হস্তশিল্পের বারোটা বাজিয়েছে, তেমনই পরম্পরাগত শিক্ষা, সমাজনীতি ইত্যাদিকেও নিজেদের স্বার্থে ঢেলে সাজিয়েছে।
২) আমরা, মানে কলোনিয়াল রুলের বাইপ্রোডাক্ট মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালিরা, ওদের প্রবর্তিত রেল, ডাক, যাতায়াত, আধুনিক শিক্ষার ফল পেয়েছি ভেবে ধরে নিই, ওদের হাত না পড়লে আমাদের উন্নতি হত না, আমরা অন্ধকার যুগে পড়ে থাকতাম। ফলে উন্নতির বিকল্প সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাই করি নি।
৩) তাই আমরা সতীদাহ ও বহুবিবাহ রদ, হিন্দু কোড এসব নিয়ে খুব খুশি। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না এরা মাথাব্যথা সারাতে মাথাই কেটে ফেলল কিনা।
৪) কলোনিয়াল অ্যাজেন্ডায় যেমন হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভাজন বেড়ে গেল, তেমনই ওদের ভাষা সংস্কারে বাংলা থেকে আরবি, ফার্সি ও অন্যান্য প্রাকৃত শব্দ ছেঁটে দিয়ে এক কৃত্রিম উচ্চবর্গীয় সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা ভাষা তৈরি হল তার ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণ ও মুসলমানেরা অবহেলিত হয়ে রইল। আমাদের কবিতা ও গল্পে এরা হয় অনুপস্থিত, নয় প্রান্তিক চরিত্র। এরা আমাদের ‘অপর’ হয়েই রইল। আর সেই বিষবৃক্ষের ফল আজ পেকেছে।
বেশ, এতে বিদ্যাসাগর, রামমোহন আদি চরিত্রের কী দোষ? সেটা হল এঁরা এই গ্র্যান্ড ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এঁরা সমাজসংস্কার, শিক্ষাসংস্কারের নামে যা করেছেন তা কলোনিয়াল প্রভুদের তালে তাল দিতে। সুফল বলতে আমরা যা পেয়েছি কুফলগুলো পাল্লায় তুললে ওজনে ভারি।
এই হল আমার পূর্বপক্ষ বা লেখকের বক্তব্যের সার - আমি যেমন বুঝেছি।
(২.০) আমার উত্তরপক্ষ
(২.১) লেখকের পদ্ধতি
প্রথমেই বলতে চাই লেখক চিরাচরিত মহাপুরুষের জীবনীর নামে একরৈখিক মাহাত্ম্য বা কুৎসা রটনার শৈলীটি পরিত্যাগ করে এঁদের একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও কালখণ্ডের উপজ হিসেবে দেখেছেন। তাই প্রথমে যত্ন করে কোম্পানির রাজত্বে খাজনা আদায়ের পদ্ধতি , চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও তার ফল এবং কীভাবে নব্য জমিদার ও মুৎসুদ্দি বানিয়া শ্রেণির জন্ম ও বিকাশ হল তা পর্যাপ্ত দস্তাবেজ ও দলিলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। এই প্রারম্ভিক পরিচ্ছেদগুলি বইটির সম্পদ।
লেখক এই বইটিতে গোপাল হালদারের সম্পাদিত “বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ”কে প্রামাণ্য ধরে তাঁরই অনুসরণে বইটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন - শিক্ষাসংস্কার, সমাজসংস্কার ও বাংলা ভাষা সংস্কার।
আমরাও পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় ওই ছকটিই অনুসরণ করব।
(২.২) আমার পদ্ধতি
তথ্য -
এই বইয়ে তথ্য এবং তথ্যসূত্র বিস্তারিত ভাবে দেয়া হয়েছে এবং লেখক পরস্পর বিরোধী তথ্যের মুখোমুখি হলে যা গ্রহণ বা বর্জন করেছেন তার ভিত্তিটুকুও স্পষ্ট করেছেন। এখানে তথ্যের স্বল্পতা নয় বরং বহু আয়াসে সংগৃহীত তথ্য এত বেশি রয়েছে যে খেই হারিয়ে যাবার যোগাড়। এর থেকে ছেনে তথ্যের তুল্যমূল্য বিচার অনেক পরিশ্রম সাপেক্ষ। তাই আমার সীমিত সাধ্যে তথ্য নিয়ে কথা বলা উচিত হবে না। অতএব, আমি আমার লেখায় উদ্ধৃতি দিলে আলোচ্য লেখকের বইটিরই পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখ করব। এর দুটো দিক। পাঠপ্রতিক্রিয়ায় বিশ্লেষণ বা যুক্তির ভুল হলে তার দায় নির্দ্বিধায় আমার। কিন্তু তথ্যসূত্রে বা উদ্ধৃতিতে কোন ভুল থাকলে তার দায়িত্ব লেখক চক্রবর্তী মশায়ের।
আমার কাজ -
আমি দেখব তথ্যের ভিত্তিতে লেখক যে হাইপোথেসিস দাঁড় করাচ্ছেন তার বিশ্লেষণ, যুক্তিপ্রয়োগ এবং অন্য বিপরীত ব্যাখ্যার সম্ভাবনাগুলো। দেখব লেখক নিজের অ্যান্টি-কলোনিয়াল অ্যাজেন্ডার জোরে কোথাও কোথাও এমন সিদ্ধান্ত টানছেন কিনা যাকে স্ট্যাটিসটিক্সের লোকেরা বলেন ‘প্রসিকিউটর’স বায়াস’।
আমরা দামোদর সাঁতরে পার হওয়ার গল্প নিয়ে মাথা ঘামাব না। বিদ্যাসাগরের আপন ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের সাক্ষ্যই এসব গালগল্পকে খারিজ করার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু দেখব নারীশিক্ষার জন্যে বেথুন ও বিদ্যাসাগরের মডেলের সাফল্য ও বিফলতা নিয়ে তুলনা। দেখব সেই সময়ে ইংরেজ প্রভুদের আনুকূল্যেই সই, উত্তরভারতে এবং মহারাষ্ট্রে নারীশিক্ষার জন্যে কী কাজ হচ্ছিল এবং ব্যালান্টাইন-বিদ্যাসাগর বিবাদে সত্যিই বিদ্যাসাগর বেদান্তের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের এনলাইটেনমেন্টের প্রতীক মিলের লজিক পড়াতে চাইতেন কিনা। দেখব শুধু উচ্চবর্ণের ছাত্রদের জন্যে শিক্ষার দ্বার খুলে দেয়া বিদ্যাসাগরের জাতিঘৃণার লক্ষণ, নাকি নতুন কোন উদ্যোগ শুরু করার জন্যে আবশ্যক সমঝোতা।
মধুকবিকে বিদ্যাসাগর জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে টাকা ধার দিয়েছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে বিদ্রূপ করলেও একটা স্নেহের টান ছিলই। পরেও অনেকবার টাকা দিয়েছেন - মধুকবির কবিতায় যার স্বীকৃতি রয়েছে। কখনও কখনও প্রশ্ন জাগত - কত টাকা ছিল বিদ্যাসাগরের? এবং এই অগাধ আয়ের উৎস কী?
এ নিয়ে অনেক অজানা তথ্য দিয়েছেন লেখক। তাতে এক ব্যবসাবুদ্ধি সম্পন্ন সুচতুর ব্যক্তির ছবি ফুটে উঠেছে যা আপাত বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলন এবং শিক্ষার মশাল জ্বালিয়ে এগিয়ে চলা বাঙালির ছবির সঙ্গে একেকবারেই খাপ খায় না। আমরা জানি যে বাঙালি ব্যবসাবিমুখ এবং ব্যবসায়ীদের সততাকে সন্দেহের চোখে দেখে। অতএব এই নির্মাণটিকেও দেখা দরকার যে বিদ্যাসাগর ব্যবসার ডুবজলে নেমে নিজের কোন সযত্নলালিত মূল্যবোধ ও নীতির সঙ্গে আপস করেছেন কিনা।
সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে দেখতে হবে নিজের ছেলেকে দিয়ে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের শুরু করেও কী কারণে পিছিয়ে এলেন? এছাড়া লেখক ইংরেজদের মনুকে কেটে ছেঁটে হিন্দু কোড বিল বানানোয় নারীদের আগের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন — এটা গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই নেড়েচেড়ে দেখতে হবে এতে বিদ্যাসাগরের দায়িত্ব কতটুকু।
সাহিত্য পর্যায়ে দেখব সমসাময়িক মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, মদনমোহন তর্কালংকারের তুলনায় বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্ম ও ভাষার সৌকর্য নিম্নমানের ছিল কিনা। রচনায় নারীচরিত্র ও প্রান্তিক মানুষেরা কেন অনুপস্থিত ইত্যাদি।
তাহলে এবার বিসমিল্লা বলে শুরু করা যাক।
(৩.০) কোম্পানিরাজ, চিরস্থায়ী বন্ডোবস্ত এবং শিক্ষা সংস্কার
(৩.১) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
মোঘল আমল থেকে কোম্পানির আমলে, মানে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’র আগে, জমির খাজনার ব্যাপারটা কেমন ছিল?
লেখক সঠিকভাবে বলছেন - কৃষক এবং রাজা বা রাষ্ট্রের মাঝখানে কোন জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগী ছিল না। সমগ্র গ্রামের উপর রাজস্ব ধার্য হত, এবং গ্রামসমাজগুলি রাজস্ব আদায়কারী ‘জমিদারে’র মারফত সমবেতভাবে রাজস্ব প্রদান করত। ‘রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জমিদার নির্দিষ্ট দিনে গ্রামে উপস্থিত হয়ে রাজস্ব হিসেবে সমগ্র ফসলের এক-তৃতীয়াংশ আদায় করত এবং এই আদায়ীকৃত ফসলের এক-দশমাংশ নিজের কাছে পারিশ্রমিক হিসেবে রেখে বাকি ফসল রাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য থাকত’। [1] এর মানে তো দাঁড়াল যে আদায়ীকৃত ফসলের বাকি নয়/দশমাংশ রাষ্ট্রকে দিতে হবে। উনি ব্যাখ্যা করে বলছেন যে তখন জমিদাররা জমির মালিক ছিল না, তারা ছিল নিছক সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রতিনিধি। তাদের নবাব ইত্যাদিরা নিযুক্ত করতেন। এ যেন ডাকু গব্বর সিংহের প্রতিনিধি এসে গোটা গাঁয়ের থেকে নির্ধারিত আনাজ আদায় করছে!
কিন্তু এরপরেই লেখক বলছেন, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ঠিক হয় যে, জমিদারেরা আদায়ীকৃত রাজস্বের নয়-দশমাংশ কোম্পানির কাছে হস্তান্তরিত করবে। বছরের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই নির্দিষ্ট রাজস্ব কোম্পানির ঘরে জমা দিলে, জমিদাররা বংশানুক্রমে জমির স্বত্বাধিকারী থাকবে, ভবিষ্যতে জমির মূল্য যাই হোক না কেন, তাতে তাদের সঙ্গে কোম্পানির রাজস্ব বন্দোবস্তের কোনও পরিবর্তন হবে না’। [2]
তাহলে কী দাঁড়াল? আগের ও পরের দুটো নিয়মেই জমিদারেরা ‘আদায়ীকৃত ফসলে’র এক/দশমাংশ নিজের কাছে রেখে বাকি নয়/দশমাংশ রাষ্ট্রকে দেবেন?
তফাৎ কোথায়? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদাররা স্থায়ী ভাবে জমির মালিক হলেন। আগে গ্রামে উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ খাজনা হিসেবে আদায় করে তার ভাগাভাগি হত। এখন জমির মূল্য হিসেব করে তার (ফসলের নয়, জমির মালিকানা স্বত্বের) স্থায়ী খাজনা নির্ধারিত হলে জমিদারেরা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে তা কোষাগারে জমা দেবেন, নাহলে মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যাবে। অর্থাৎ আগে রাষ্ট্র আদায় করত ফসলের ভাগ, এখন আদায় করছে জমির মালিকানার খাজনা জমিদারদের থেকে। সেই খাজনা আবার জমিদারেরা আগেই উশুল করছে চাষিদের থেকে, তাতে যুক্ত করছে নিজের একটা অংশ।
এটা একভাবে দেখলে এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রামীণ সমাজের উপর ইউরোপিয় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো চাপিয়ে দেয়া।
আমরা কী ভাবে দেখছি? কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ? কৃষকদের দিক থেকে দেখলে দুটোই খারাপ। তাহলে মন্দের ভাল কোনটা? লেখকের মতে আগের ব্যবস্থা-তাতে যে গাঁয়ে থেকে চাষ করে তারই জমির মালিকানা স্বত্ব ছিল। কী চাষ করবে নাকি করবে না সেটা সেই ঠিক করত। কিন্তু নতুন নিয়মে জমির মালিক জমিদার, সে উলটে চাষির থেকে খাজনা আদায় করবে।
আমার মতে দুটো খারাপের মধ্যে ১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কম খারাপ। কেন?
এক, এতে ফসলের হিসেবে প্রতি বছর নতুন নতুন খাজনা ধার্য করার বদলে একটা ফিক্সড খাজনা। জমিদার ও কৃষক উভয়েই জানে কত দিতে হবে, তাতে অ্যানার্কির বদলে শৃংখলা আসে, অ্যানার্কির দিনে গরিবের ভোগান্তি বেশি হয়।
দুই, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারের খানিকটা দায়িত্ব বা ইনভল্ভমেন্ট থাকে যাতে চাষটা ভাল ভাবে হয়। ফলে হাল-বলদ-বীজধান ইত্যাদির যোগান এবং দরকারমত আর্থিক সাহায্য (অবশ্যই চড়া সুদে) দিতে একরকম বাধ্য থাকে। আগের ব্যবস্থায় এসবই অনিশ্চিত।
লেখক সহমত নন। উনি দেখাচ্ছেন যে ‘কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে নতুন জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি করে, তেমনই তাদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য অসংখ্য কৃষক সংগ্রামের সৃষ্টি হয়’(নজরটান আমার)। উদাহরণ হিসেবে লেখক উল্লেখ করেছেন সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৬-৮৩), ত্রিপুরায় সমশের গাজির বিদ্রোহ ( ১৭৬৭-৬৮), সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক-তন্তুবায়দের লড়াই (১৭৭০-৮০), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭), এবং রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩)। [3]
দেখুন, সবক’টি কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের অনেক আগে। বরং এই নতুন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পরে কোন বড় কৃষক বিদ্রোহের নজির দেখছি না।তাহলে লেখকের যুক্তি পরম্পরা অনুসরণ করলে কোন সিস্টেমকে মন্দের ভাল বলব?
(৩.২) নতুন মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের উদ্ভব
কেন নতুন করে বড় বিদ্রোহ হল না? এখানে লেখক সঠিক ভাবে আঙুল তুলেছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের দিকে।
১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চ তারিখে লর্ড কর্নওয়ালিশ ‘চিরস্থায়ী বদোবস্তে’র প্রবর্তন করেন। ঠিক তার আগে ৬ই মার্চ কোম্পানির ডিরেক্টরদের একটি চিঠিতে লেখেন- ‘ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই এদেশীয়দের হাতে যে বিরাট বিত্ত আছে, তা তারা অন্য কোনও ভাবে নিয়োগ করার উপায় না পেয়ে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবে’। [4]
লেখক চমৎকার ভাবে দেখিয়েছেন যে ৪০ বছর পরে লর্ড বেন্টিংক মন্তব্য করছেন -
‘আমি মানতে বাধ্য যে ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লব থেকে নিরাপত্তার প্রশ্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটা বিরাট সুবিধে আছে। অন্ততপক্ষে এর বদান্যতায় এমন এক বিপুলসংখ্যক ধনী জমিদারশ্রেণী উদ্ভূত হয়েছে যারা বৃটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে প্রচণ্ড আগ্রহী, জনসাধারণের ওপরও তাদের সম্পূর্ণ আধিপত্য আছে’। [5]
এই সমর্থকদের শ্রেণিবিন্যাসের বিশ্লেষণ করেছেন বিনয় ঘোষ -
‘গ্রাম্যসমাজে নতুন জমিদারশ্রেণী, বৃহৎ একটি জমিদারি-নির্ভর মধ্যসত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণী, এবং নাগরিক সমাজে নতুন অর্বাচীন অভিজাত-ধনিকশ্রেণী, খুদে-ব্যবসায়ী দোকানদার চাকরিজীবী প্রভৃতিদের নিয়ে বড় একটি নাগরিক মধ্যশ্রেণী এবং তার মধ্যে সোনার চাঁদের মতো একদল ইংরেজিশিক্ষিত ‘elite’। [6]
(৩.৩) কৃষি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগর
মন্বন্তর: ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ(বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত্রের প্রায় আড়াই দশক আগে, যার ভয়াবহ বর্ণনা বঙ্কিমের দেবী চৌধুরাণী ও আনন্দমঠে রয়েছে। এরপরে বাঙালি পেল সোজা পঞ্চাশের মন্বন্তর যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, ১৯৪২-৪৩ সালে ঘটেছিল। এর মধ্যে কোন বড় দুর্ভিক্ষ উনবিংশ শতাব্দীতে ঘটেনি। কাজেই আমার মনে হয় কর্নওয়ালিশ স্থায়ী বৃটিশ স্বার্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বংগের কৃষিতে যে স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন আনেন, কিন্তু তার আপাত সুফল বাংলার কৃষক পেয়েছে। তাই বড় দুর্ভিক্ষ বা বিদ্রোহ কোনটাই হয়নি।
এই আলোচনাটা জরুরি কেন? এইজন্যে যে এখানে লেখক আঙুল তুলেছেন বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগরের দিকে, তাঁদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণকীর্তন করার দোষে।
তার প্রেক্ষাপটে লেখক বলছেন -
‘উনিশ শতকের প্রথম থেকে এদেশে যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়, তার সুযোগ প্রধানত গ্রহণ করে এই জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির প্রতিনিধিরাই। ভুমিরাজস্ব থেকে প্রাপ্ত বিপুল আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তীকালে তারা শিক্ষাদীক্ষা, সরকারি চাকরি এবং ডাক্তার-ওকালতি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত থেকে এক নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সৃষ্টি করে। চাকরি-নির্ভর এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ও স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ অনুরাগী হিসেবে গড়ে ওঠে। তারা এমন একটি সামাজিক শ্রেণির রূপ গ্রহণ করে, যাদের শ্রেণিস্বার্থ বাঁধা থাকে ভুমিব্যবস্থার স্রষ্টা, পালক ও রক্ষক ব্রিটিশদের সঙ্গে’। [7]
এইটাই আসল কথা। গোটা গবেষণার ধ্রুবপদ হোল যে বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, রামমোহন এবং রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বতন দুই পুরুষ হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপজ নব্য জমিদার বা নব্য মুৎসুদ্দি ধনিক অথবা ইংরেজের চাকরিনির্ভর নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ইতিহাসের সাক্ষ্য কী বলে?
অভিযোগ অনেকটাই সত্যি। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথের পিতামহ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত দ্বারকানাথ ইউনিয়ন ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন, রানিগঞ্জের কয়লাখনি, জুটমিল,আসামের চা বাগান কিনেছিলেন, বিমা কোম্পানি, জাহাজ কোম্পানি খুলেছিলেন। এসব আমরা জানি, কিন্তু সবই ব্রিটিশদের হাত ধরে, তাদের ছোট তরফ হয়ে। ওড়িশা ও পূর্ব বাংলার জমিদারি ওঁর পালকপিতা রামলোচন পেয়েছিলেন ওই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনের সুবিধেয়। তথ্য ঘাঁটলে পাওয়া যায় খাজনা আদায়ে দ্বারকানাথ ‘রুথলেস’ ছিলেন।
আবার প্রিন্স দ্বারকানাথের তৈরি দেশের প্রথম অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ম্যানেজিং এজেন্সির নাম ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’। কিন্তু যেটা বলা হয় না সেটা হোল এঁদের প্রধান কাজ ছিল আফিমের ব্যবসা। বঙ্গে তৈরি আফিম লুকিয়ে চিনে জোগান দেওয়া। আর বঙ্কিমচন্দ্র ও বিদ্যাসাগর ছিলেন অবশ্যই ইংরেজ সরকারের চাকুরিজীবা - একজন ম্যাজিস্ট্রেট, অন্য জন শিক্ষাবিভাগে বিভিন্ন পদে।
এরপর লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাচ্ছেন বঙ্কিমচন্দ্র তৎকালীন কৃষিব্যবস্থায় কৃষকদের দুর্দশা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত, লেখনীতে ফুটে উঠেছে হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত-পরাণ মণ্ডলদের দুর্দশা। কিন্তু লেখকের চোখে এ’সবই কুম্ভীরাশ্রু; কেননা এরপর বঙ্কিম দুটো বক্তব্য রেখেছেন।
এক, ভাল জমিদার ও মন্দ জমিদারের মধ্যে ফারাক করেছেন, ‘সিস্টেম -অ্যাজ এ হোল’কে কাঠগড়ায় দাঁড় করান নি।
দুই, চাষির দুঃখকষ্ট দেখেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে কথা বলেছেন।
“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃংখলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি”।
আরও,
“যে দিন ইংরাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেদিন সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেইদিন সে পরামর্শ দিব। --- আমরা কেবল ইহাই চাহি যে সেই বন্দোবস্তের ফলে যে সকল অনিষ্ট ঘটিতেছে, এখন সুনিয়ম করিলে তাহার যত দুর প্রতীকার হইতে পারে, তাহাই হউক”। [8]
লেখক এবার দেখাচ্ছেন বিদ্যাসাগর কীভাবে দেখেছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে। “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে সবিশেষ উপকার দর্শিয়াছে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। এরূপ না হইয়া যদি পূর্বের ন্যায়, রাজস্ব বিষয়ে নিত্যনতুন পরিবর্তের প্রথা থাকিত, তাহা হইলে, এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না”। [9]
গ্রন্থটির প্রথম ভাগের এই দ্বিতীয় অধ্যায়টির শীর্ষক ছিল “হেস্টিংস থেকে কর্নওয়ালিস, সাহেব ও মোসাহেবদের লুঠ কিসসা”। বিদ্যাসাগরের উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি দিয়ে লেখক ধরে নিয়েছেন তাঁর উপপাদ্যটি প্রমাণিত। তাই শেষ করেছেন এই বলে - ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান’!
অর্থাৎ,
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতে ইংরাজদের লুঠের ভিত্তি।
বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমর্থক।
অতএব, ওঁরা দু’জন ইংরেজের মোসাহেব এবং ওদের লুঠের ভাগীদার।
একেবারে অবরোহ তর্কপদ্ধতির হদ্দমুদ্দ।
আমার উত্তরপক্ষ:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মোঘল আমল থেকে চলে আসা কৃষি রাজস্বের পদ্ধতির চেয়ে মন্দের ভাল। লেখকের বর্ণনা থেকেই দেখা গেছে পুরনো ব্যবস্থায় কোম্পানির রাজস্ব আদায়কারী প্রতিনিধিরা (পড়ুন জমিদারেরা) একেকবছর একেক রকম দাবি নিয়ে সোজা মাৎসন্যায় শুরু করেছিল। ফলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও একগাদা কৃষক বিদ্রোহ। নতুন ব্যবস্থায় একবার যা খাজনা ধার্য হয়েছে তাই প্রতি বছর কোম্পানিকে দিতে হবে। ফলে একধরনের অরাজকতা বন্ধ হোল। মন্বন্তর ও কৃষক বিদ্রোহ হল না। বিদ্যাসাগর সঠিক বলেছেন - ‘যদি পূর্বের ন্যায়, রাজস্ব বিষয়ে নিত্যনতুন পরিবর্তের প্রথা থাকিত, তাহা হইলে, এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না”।
কিন্তু যে কোন ব্যবস্থারই অন্ধকার দিক থাকে। দেখাই যাচ্ছে বঙ্কিম সে বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন যা তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ লেখাটির ছত্রে ছত্রে আছে। তাই সংস্কারের দাবি রেখেছেন। নইলে ইংরেজ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কী দায় পড়েছিল ওই অন্ধকার দিকের প্রতি আঙুল তোলার? ‘মোসাহেব’ হলে শুধু গুণ গাইতেন, অন্ধকার দিকের কথা তুলতেন না।
লেখকের আপত্তি যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ আইন বানিয়েছে বঙ্কিম কেন তার কাছেই কিছু সংস্কারের আবেদন করছেন?
আমার প্রতিপ্রশ্ন - তা নইলে আর কার কাছে করতেন? অন্য কোন বিকল্প ছিল কি? থাকলে সেটা কী?
একটা তিনঠেঙে তুলনা টানছি। আজ যে বামপন্থীরা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ বলেছেন, তাঁরাই মমতা সরকারকে বলছেন নিজেদের ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণ করতে, ভোট পরবর্তী হিংসা বন্ধ করতে। এটাই তো স্বাভাবিক। আর কার কাছে এই দাবি করা যায়?
আজকে ২১ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যেসব বিকল্প ভাবনা আমরা ভাবতে পারি দুশো বছর আগের কলোনিয়াল ভারতে, তখনও হয়ত দিল্লির তখতে মোগল সম্রাট বা মাত্র ভিক্টোরিয়া হাতে ক্ষমতা নিয়েছেন — কতদূর সম্ভব ছিল?
বিদ্যাসাগরের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমর্থনের কোন বিষময় প্রভাব তাঁর শিক্ষা সংস্কারে পড়েছিল কিনা তা আমরা দেখব পরের অধ্যায়ে।
(৩.৪) ইতিহাসের আয়রনি
আমার কথা হল সমাজ বা রাষ্ট্র পরিবর্তন খাপে খাপে আপনার আমার কেতাবি ফরমুলা মেনে হয় না। বিকাশ ও উত্তরণের সর্পিল গতি অনেক ছোট ছোট সমঝোতার মধ্যে দিয়ে এগোয়। আমাদের ফর্মূলা তার approximation মাত্র।
তাই আয়রনির ছড়াছড়ি। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
এক, মজদুরের মুক্তির তত্ত্ব কোন মজদুরের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং এসেছে মার্ক্স নামের এক প্রুশিয়ান উচ্চবর্গীয় অভিজাত শিক্ষিত পরিবারের ব্যক্তির থেকে।
দুই, স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘বন্দে মাতরম' নামের ব্যাটল ক্রাই এল ইংরেজের চাকর এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের থেকে, যিনি নিজেকে ওপরের প্রবন্ধে বলেছেন ‘ইংরেজের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী’ বলে।
তিন, যিনি জীবনভর পরিশ্রম করলেন শ্রমিকের শোষণের ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের’ তত্ত্বকে দাঁড় করাতে, তাঁকেই ওই ক্যাপিটাল বইটি লেখার সময় খাওয়াপরার জন্যে বন্ধু এংগেলসের কাপড়ের কলের শেয়ারের ডিভিডেন্ড হিসেবে শ্রমিকের শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্যের উপর নির্ভর করতে হল।
চার, যে মোহনদাস গান্ধী বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় নিজেকে ব্রিটিশ এম্পায়ারের মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সাবজেক্ট বলে লিখছেন তিনিই আর দুটো দশক পরে তাকে বলছেন ‘দ্য ডেভিল’স এম্পায়ার’ এবং ‘কুইট ইন্ডিয়া’র ডাক দিচ্ছেন।
পাঁচ, রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা লেনিনের ‘ইস্ক্রা’ পত্রিকা প্রকাশের খরচাটি সম্ভব হত প্রধানত সাশা মরোজভ বলে এক পুঁজিপতির দাক্ষিণ্যে।
এ নিয়ে আমরা আবার কথা বলব লেখাটির সমাপ্তির সময়। আপাতত লেখকের সমস্ত মূল্যবান পরিশ্রমী সাক্ষ্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেও তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে — চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশংসা করা বঙ্কিম বিদ্যাসাগরেরা ইংরেজের মোসাহেব - এ নিয়ে একমত হতে পারছি না।
আমি বঙ্কিমের লোকরহস্যের অন্তর্গত ‘ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল’ ব্যঙ্গলেখাটির ফুটনোট নং ১ এর উল্লেখ করতে চাইছি -
“পাঠক মহাশয় বৃহল্লাঙ্গুলের ন্যায়শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি দেখিয়া বিস্মিত হইবেন না। এইরূপ তর্কে মক্ষমূলর স্থির করিয়াছেন যে প্রাচীন ভারতীয়েরা লিখিতে জানিতেন না। এইরূপ তর্কে জেমস মিল স্থির করিয়াছেন যে প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা অসভ্য জাতি এবং সংস্কৃত অসভ্য ভাষা, বস্তুতঃ এই ব্যাঘ্রপন্ডিতে এবং মনুষ্যপণ্ডিতে অধিক বৈলক্ষণ্য দেখা যায় না”। [10]
এটা কি আদৌ মোসাহেবি? উনি জীবিকায় ইংরেজ বাহাদুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হতেই পারেন।
(চলবে)
[1] বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান, লেখক, পৃঃ ৩৫।
[2] ঐ, পৃঃ ৩৫।
[3] ঐ, পৃঃ ৩৭।
[4] ঐ, পৃঃ ৩৮।
[5] ঐ, পৃঃ ৩৯।
[6] ঐ, পৃঃ ৩৯।
[7] ঐ, পৃঃ ৩৯।
[8] ঐ, পৃঃ ৪০।
[9] ঐ, পৃঃ ৪১।
[10] বঙ্কিম রচনাবলী, প্রবন্ধ খণ্ড, লোকরহস্যের অন্তর্গত ‘ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল’ লঘুপ্রবন্ধটি।
আপনার লেখাটি পাঁচবার আপলোড হয়েছে। পাঁচটি পোস্ট দেখাচ্ছে। একটু খেয়াল করবেন।
হ্যাঁ, রঞ্জনদার নেট স্লো বলে হয়েছে। উনি ভাটিয়ালিতে সেটা জানিয়ে আডমিনদের বাকি পোস্ট মুছে দিতে বলেছেন।
ইরিব্বাস! লিখছেন এটা নিয়ে? তাও আবার ধারাবাহিক আকারে? লিঙ্কটা সেভ করে রাখছি। যদি এখানে আমার কিছু বলা নিয়ে আপনার কোনও আপত্তি না থাকে, তাহলে লেখাটা শেষ হলে আত্মপক্ষ সমর্থনে দু-চার কথা বলব। আপাতত এটুকুই।
আমার যেটা বলার ছিলো, আমাদের দেশে মহাপুরুষদের যেভাবে পেডেস্টালে বসিয়ে পুজো করা হয়, সেখানে অবজেকটিভ লেখা বা মূল্যায়ন করা খুব জরুরি। দেবোত্তমবাবু সেই চেষ্টা করেছেন, আশা করি অন্যরা ওনার কাজ ক্রিটিকালি রিভিউ করবেন আর ওনার কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
(ডিসক্লেমারঃ আমি বইটা পড়িনি কারন বিদ্যাসাগর নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তবে দেবোত্তমবাবুর উদ্যোগ আমার মতে তারিফ করার যোগ্য)
এলেবেলে-র গবেষণা , পরিশ্রম অবশ্যই কুর্ণিশের দাবি রাখে । রঞ্জন দা-র বিশ্লেষণ - ও ভাল লাগছে । চলুক
ডিসির সাথে অনেকটাই একমত। শুধু তফাৎ এই যে বিদ্যাসাগর রামমোহন দ্বারকানাথ সম্পর্কে আমার মোটামুটি ইন্টারেস্ট আছে।
রঞ্জনদার আলোচনাটা বেশ ভাল লাগল। সমালোচনা অর্থাৎ সম্যক আলোচনা এরকমই হওয়া উচিৎ।
আচ্ছা অন্য একটা কৌতুহল। দ্বারকানাথের যে আফিমের ব্যবসা ছিল চীনে চালানের, সেই নিয়ে ইংরিজি বা বাংলা কোন মুচমুচে থ্রিলারের খবর কেউ জানেন? চীনে আফিম সেসময় ব্যানড ছিল যদ্দুর জানি। তা রি নিয়ে কেউ কোন ফিকশান থ্রিলার লিছু লেখেন নি? কেউ জানলে একটু বলবেন তো।
*কিছু (লিচু নয়)
আমি নিশ্চয়ই চাইব এলেবেলে সব কিছুর শেষে ধরে ধরে আমার তোলা আপত্তি/সংশয় ইত্যাদির জবাব দেবেন। আমার উদ্দেশ্য এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ---কলোনিয়াল হিস্ট্রি বা কথিত বঙ্গীয় রেনেসাঁর পুনর্মূল্যায়ন--- নিয়ে বিতর্ক তোলা , ওপেন এন্ডেড ডিসকাশন।
ডিসি,
আমার লেখার প্রথম প্যারাগ্রাফেই আমি প্রায় আপনার শব্দ ব্যবহার করে ইতিহাসপুরুষদের একমেটের কাজ করে মহাপুরুষ বা প্রায় ভগবান করে তোলার আমি বিরোধী। এবং নিঃসন্দেহে এলেবেলে প্রচুর খেটে খুব বড় কাজ করেছেন। এটাও বলেছি যে ওনার দেয়া তথ্য থেকেই আমি অনেক কিছু জেনেছি, আগে আমার জ্ঞান স্কুলপাঠ্য বইয়ের বাইরে ছিলনা। আমার প্রচেষ্টা ওনার যুক্তি-পরম্পরা ও তথ্যের বিশ্লেষণে কোন বিসংগতি বা অন্য হাইপোথেসিস ফিট হয় কিনা সেটা দেখা।
রঞ্জন বাবুর আলোচনা খুব ভালো এগোচ্ছে। সুন্দর যুক্তি সাজাচ্ছেন। এলেবেলের আত্মপক্ষ পড়ার জন্য আগ্রহী।
তবে দু এক জায়গায় রঞ্জন বাবু বঙ্কিমের দোষ খন্ডন করার পরই বিদ্যাসাগর কেও দোষমুক্ত করেছেন কিন্তু সেই বিদ্যাসাগর এর যুক্তি টা স্পষ্ট হয়নি। যেমন বঙ্কিম কিছুটা চি ব এর বিপরীতে বলেছেন। কিন্তু সেখানে বিদ্যাসাগরকে চি ব -র সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে না।
প্রথমেই আমার তরফ থেকে রঞ্জনবাবুকে অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানাই। তিনি যে অনায়াস দক্ষতায় গোটা বইটার শল্যচিকিৎসা করে তার নানা যুক্তিবিন্যাসকে প্রশ্নজালে বিদ্ধ করেছেন, তার বিকল্প ভাষ্য সন্ধানে প্রয়াসী হয়েছেন – তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাজনক। তাঁর এই সাধু উদ্যোগকে আনত কুর্নিশ।
গুরুর টেক টিমের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাই। আমার অনুরোধে অতি দ্রুত সাড়া দিয়ে তাঁরা যেভাবে রঞ্জননবাবুর গোটা আলোচনাটিকে বিন্যস্ত করেছেন এবং পাদটীকাগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য এনেছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
আমার উত্তর দেওয়ার পদ্ধতি ভারতীয় দর্শন বিচারের পরম্পরা মেনে পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষকে মান্য করে চলবে। সমস্ত রেফারেন্স দেওয়া হবে একই বই থেকে। ফলে এখানে লেখক-পাঠকের কথোপকথন নয়, একজন পাঠক অন্য একজন পাঠকের পাঠ পর্যালোচনার দিকে নজর রেখে তার নিজস্ব যুক্তিজাল সাজাবেন। তিনি বইটি পড়ে তার অন্তর্গত বিষয়সমূহকে যেভাবে বুঝতে চেয়েছেন, সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। খুব প্রয়োজন না হলে বইয়ের বাইরে অন্য কোনও তথ্যের উল্লেখ করা হবে না। বলা বাহুল্য, এখানে রঞ্জনবাবু পূর্বপক্ষ এবং উত্তরপক্ষ এই অধম।
প্রথমে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে প্রচলিত দুটি ভ্রান্ত ধারণার নিরসন করে নেওয়া ভালো। ১. “বরং এক সায়েবের বুটজুতো ট্রেনের জানলা গলিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন!” এই কাহিনিটি আশুতোষের সঙ্গে জড়িত, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে নয়। এবং ২. ‘কলকাতা ছেড়ে কার্মাটারে সাঁওতালদের মধ্যে জীবন কাটানো’ – বিদ্যাসাগর আদপেই কর্মাটাঁড়ে শেষ জীবন কাটাননি। ওটি ছিল তাঁর সাময়িক বিশ্রাম নেওয়ার বাগানবাড়ি মাত্র। কলকাতার দৈনন্দিন কাজে হাঁপিয়ে উঠলে বা খুব গরমের সময় তিনি ওখানে মাসখানেক বা দুয়েক কাটাতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানিয়েছেন, এমনকি সেখানেও বিদ্যাসাগর তাঁর বইয়ের প্রুফ দেখার কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
এবারে মূল আলোচনায় আসা যাক।
পূর্বপক্ষ – (৩.১) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
//কৃষক এবং রাজা বা রাষ্ট্রের মাঝখানে কোন জমিদার বা মধ্যসত্বভোগী ছিল না। সমগ্র গ্রামের উপর রাজস্ব ধার্য হত, এবং গ্রামসমাজগুলি রাজস্ব আদায়কারী ‘জমিদারে’র মারফত সমবেতভাবে রাজস্ব প্রদান করত। ‘রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জমিদার নির্দিষ্ট দিনে গ্রামে উপস্থিত হয়ে রাজস্ব হিসেবে সমগ্র ফসলের এক-তৃতীয়াংশ আদায় করত এবং এই আদায়ীকৃত ফসলের এক-দশমাংশ নিজের চাইছেপারিশ্রমিক হিসেবে রেখে বাকি ফসল রাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য থাকত’। [1] এর মানে তো দাঁড়াল যে আদায়ীকৃত ফসলের বাকি নয়/দশমাংশ রাষ্ট্রকে দিতে হবে। উনি ব্যাখ্যা করে বলছেন যে তখন জমিদাররা জমির মালিক ছিল না, ওরা ছিল নিছক সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রতিনিধি।
কিন্তু এরপরেই লেখক বলছেন, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ঠিক হয় যে, জমিদারেরা আদায়ীকৃত রাজস্বের নয়-দশমাংশ কোম্পানির কাছে হস্তান্তরিত করবে। বছরের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই নির্দিষ্ট রাজস্ব কোম্পানির ঘরে জমা দিলে, জমিদাররা বংশানুক্রমে জমির স্বত্বাধিকারী থাকবে, ভবিষ্যতে জমির মূল্য যাই হোক না কেন, তাতে তাদের সঙ্গে কোম্পানির রাজস্ব বন্দোবস্তের কোনও পরিবর্তন হবে না’। [2]
তাহলে কী দাঁড়াল? আগের ও পরের দুটো নিয়মেই জমিদারেরা ‘আদায়ীকৃত ফসলে’র এক/দশমাংশ নিজের কাছে রেখে বাকি নয়/দশমাংশ রাষ্ট্রকে দেবেন?
তফাৎ কোথায়? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদাররা স্থায়ী ভাবে জমির মালিক হলেন। আগে গ্রামে উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ খাজনা হিসেবে আদায় করে তার ভাগাভাগি হত। এখন জমির মূল্য হিসেব করে তার (ফসলের নয়, জমির মালিকানা স্বত্বের) স্থায়ী খাজনা নির্দ্ধারিত হলে জমিদারেরা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে সেটা কোষাগারে জমা দেবেন নইলে মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যাবে। অর্থাৎ আগে রাষ্ট্র আদায় করত ফসলের ভাগ, এখন আদায় করছে জমির মালিকানার খাজনা জমিদারদের থেকে। সেই খাজনা আবার জমিদারেরা আগেই উশুল করছে চাষিদের থেকে, তাতে যুক্ত করছে নিজের একটা অংশ।
আমার মতে দুটো খারাপের মধ্যে ১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কম খারাপ। কেন?
এক, এতে ফসলের হিসেবে প্রতি বছর নতুন নতুন খাজনা ধার্য করার বদলে একটা ফিক্সড খাজনা। জমিদার ও কৃষক উভয়েই জানে কত দিতে হবে, তাতে অ্যানার্কির বদলে শৃংখলা আসে, অ্যানার্কির দিনে গরীবের ভোগান্তি বেশি হয়।
দুই, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারের খানিকটা দায়িত্ব বা ইনভল্ভমেন্ট থাকে যাতে চাষটা ভাল ভাবে হয়। ফলে হাল-বলদ-বীজধান ইত্যাদির যোগান এবং দরকারমত আর্থিক সাহায্য (অবশ্যই চড়া সূদে) দিতে একরকম বাধ্য থাকে। আগের ব্যবস্থায় এসবই অনিশ্চিত।//
উত্তরপক্ষ –
এখানে রঞ্জনবাবু অনেকগুলো জিনিসকে এড়িয়ে গিয়ে অতি দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। প্রথমত, পূর্বতন রাজস্ব ব্যবস্থার তুলনায় বর্তমান রাজস্ব ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। “১৭৬৪-৬৫ সালে বাংলা ও বিহার থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা। কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের ভার গ্রহণের পরে প্রথম বছরে অর্থাৎ ১৭৬৫-৬৬ সালে, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়ে হয় ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।” (পৃ. ২৯) অস্যার্থ, দেওয়ানি পাওয়ার পরেই ব্রিটিশরা খাজনার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে ফাউ হিসেবে যোগ হয় একচেটিয়া বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য।
দ্বিতীয়ত, খরা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে ফসল উৎপাদন কম হলে রাষ্ট্রের তরফে কোনও কোনও বছর খাজনা কমানো হত বা পুরোপুরি মকুব করা হত। মৃত কৃষি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অল্প সুদে বা বিনা সুদে দেওয়া হত ঋণ বা ‘তাকাভি’। অথচ ক্লাইভ প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ঘটে যায় কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং তার জন্য খাজনা আদায়ের বিষয়ে কোনও ছাড় দেওয়া হয়নি, বরং আদায়ীকৃত খাজনার পরিমাণ ছিল ১৭৬৮-র তুলনায় বেশি। (পৃ. ২৯)
তৃতীয়ত, “মীরজাফরের রাজত্বকাল থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার মধ্যবর্তী প্রায় ৩০ বছরে রাজস্বের হার কী অবিশ্বাস্য পরিমাণে বেড়েছিল, তা স্পষ্ট হবে এই হিসেবটি দেখলে:
The last Mahomedan ruler of Bengal, in the last year of his administration (1764), realised a land revenue of £817,553; within thirty years the British rulers realised a land revenue of £2,680,000 in the same Province.
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৭৬৪-৬৫ সালে মহারাজা নন্দকুমারের আদায়ীকৃত রাজস্বের (৮ লক্ষ ১৮ হাজার পাউন্ড) তিন গুণের সামান্য বেশি এবং ১৭৬৫-৬৬-তে অর্থাৎ কোম্পানির দেওয়ানি প্রাপ্তির প্রথম বছরে, রেজা খাঁ-র আদায় করা রাজস্বের (১৪ লক্ষ ৭০ হাজার পাউন্ড) প্রায় দ্বিগুণ।” (পৃ. ৩৪) তাহলে মোদ্দা ব্যাপারটা কী নেহাতই “আগে রাষ্ট্র আদায় করত ফসলের ভাগ, এখন আদায় করছে জমির মালিকানার খাজনা জমিদারদের থেকে। সেই খাজনা আবার জমিদারেরা আগেই উশুল করছে চাষিদের থেকে, তাতে যুক্ত করছে নিজের একটা অংশ”-তে সীমাবদ্ধ মনে হচ্ছে? মীরজাফরের আমলে যে রাজস্বের পরিমাণ ৮ লাখ ১৮ হাজার পাউন্ড (প্রায়), সেটা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৬ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ডে। অর্থাৎ একে তো জমির ওপর থেকে চাষির মালিকানা গেল, উল্টে খাজনার পরিমাণ বাড়ল প্রায় তিনগুণ। এই বর্ধিত খাজনা কে দেবে? চাষি না জমিদার?
চতুর্থত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে যে চিরস্থায়ী ক্ষতি, সেই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ও রায়তদের ওপর সীমাহীন শোষণের বিষয়ে রঞ্জনবাবু আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ও উদাসীন। অথচ “জমিদারির রক্ষণাবেক্ষণ ও যথাসময়ে খাজনা আদায়ের প্রয়োজনে এই অলস অকর্মণ্য বিলাসপ্রিয় নব্য জমিদারশ্রেণি এক নতুন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি করে। বিনয় ঘোষ লিখেছেন —
১৮৭২-৭৩ সালের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে জমিদারীর সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লক্ষের বেশি হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারীর সংখ্যা পাঁচশ’র কিছু বেশি, বিশ হাজার থেকে পাঁচশ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারী প্রায় ষোল হাজার, এবং পাঁচশ একর ও তার কম ছোট জমিদারীর সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার-পত্তনিদার-জোতদারদের গোমস্তা নায়েব তহশীলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যদের সংখ্যা যোগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে উনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্বনীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজে কমপক্ষে সাত-আট লক্ষ লোকের এমন একটি ‘শ্রেণী’ (সামাজিক ‘স্তরায়ন’) তৈরি হয়েছে, যে শ্রেণী ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভস্বরূপ।
কোম্পানি নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে এই নতুন বংশানুক্রমিক মধ্যস্বত্বভোগীদের আইনসঙ্গত বলে স্বীকার করে নেয়। এর পরিণতিস্বরূপ, মধ্যস্বত্বভোগীরা জমিদারদের মোট প্রাপ্যের ওপর নিজেদের অতিরিক্ত প্রাপ্য কৃষকদের থেকে আদায় করতে শুরু করে। জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের যৌথ শোষণের ফলে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।” (পৃ. ৩৭) এর পরে আর নতুন করে কিছু বলার দরকার পড়ে কি?
পঞ্চমত, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারের খানিকটা দায়িত্ব বা ইনভল্ভমেন্ট থাকে যাতে চাষটা ভাল ভাবে হয়। ফলে হাল-বলদ-বীজধান ইত্যাদির যোগান এবং দরকারমত আর্থিক সাহায্য (অবশ্যই চড়া সূদে) দিতে একরকম বাধ্য থাকে। আগের ব্যবস্থায় এসবই অনিশ্চিত”। কোথায় ইনভল্ভমেন্ট? বরং দেখা যাচ্ছে “...জমি ক্রয় এবং জমির মালিকানায় তারা যতটা আগ্রহী ছিল, কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার তিলমাত্র আগ্রহও তাদের ছিল না। খাজনার মাধ্যমে কৃষি-উৎপাদন থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ করাই ছিল তাদের অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি”। (পৃ. ৩৬) এবং “...বাংলার জমিদাররা প্রতি একরে সরকারকে খাজনা দিত ১০ আনা ৮ পয়সা। অথচ বেআইনি আদায় বাদ দিয়ে তারা কৃষকদের থেকে আদায় করত একর প্রতি ৩ টাকা অর্থাৎ সরকারকে দেয় রাজস্বের প্রায় পাঁচগুণ।” (পৃ. ৩৭)
এবারে আসি এই সম্পর্কিত দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। রঞ্জনবাবু লিখেছেন, “উনি দেখাচ্ছেন যে ‘কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে নতুন জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি করে, তেমনই তাদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য অসংখ্য কৃষক সংগ্রামের সৃষ্টি হয়’(নজরটান আমার)। উদাহরণ হিসেবে উনি উল্লেখ করেছেন সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৬-৮৩), ত্রিপুরায় সমশের গাজির বিদ্রোহ ( ১৭৬৭-৬৮), সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক-তন্তুবায়দের লড়াই (১৭৭০-৮০), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭), এবং রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩)। [3]
দেখুন, সবক’টি কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের অনেক আগে। বরং এই নতুন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পরে কোন বড় কৃষক বিদ্রোহের নজির দেখছি না।” অথচ বইতে এই বিদ্রোহগুলোর উল্লেখের অব্যবহিত পরেই লেখা রয়েছে – “বস্তুতপক্ষে পলাশির যুদ্ধ ও মহাবিদ্রোহের মধ্যবর্তী দীর্ঘ একশো বছরে এমন কোনও সময় যায়নি, যখন ভারতবর্ষের কোনও না কোনও প্রান্তে ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি।” (পৃ. ৩৮) দুঃখজনকভাবে তিনি এই বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছেন। ইচ্ছে করলে সুপ্রকাশ রায়-এর বইটির (রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে) সূচিপত্রে নজর বোলালেই চোখে পড়বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও মহাবিদ্রোহের মধ্যবর্তী সময়ে কৃষক বিদ্রোহগুলি হল যথাক্রমে — নীল বিদ্রোহ (১৭৭৮-১৮০০), লবণ কারিগরদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০৪), রেশম চাষিদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০), দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯), মেদিনীপুরের নায়েক বিদ্রোহ (১৮০৬-১৬), ময়মনসিংহে কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২), ময়মনসিংহের পাগলপন্থী বিদ্রোহ (১৮২৫-২৭) সহ ছোট-বড় আরও অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ। রঞ্জনবাবু স্বয়ং কিন্তু ময়মনসিংহের লোক!
পূর্বপক্ষ – (৩.৩) কৃষি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগর
//১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ (বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত্রের প্রায় আড়াই দশক আগে, যার ভয়াবহ বর্ণনা বঙ্কিমের দেবী চৌধুরাণী ও আনন্দমঠে রয়েছে। এরপরে বাঙালী পেল সোজা পঞ্চাশের মন্বন্তর যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২-৪৩ সালে ঘটেছিল। এর মধ্যে কোন বড় দুর্ভিক্ষ উনবিংশ শতাব্দীতে ঘটেনি। কাজেই আমার মনে হয় কর্নওয়ালিশ স্থায়ী বৃটিশ স্বার্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বংগের কৃষিতে যে স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন আনেন, কিন্তু তার আপাত সুফল বাংলার কৃষক পেয়েছে। তাই বড় দুর্ভিক্ষ বা বিদ্রোহ কোনটাই হয়নি।//
উত্তরপক্ষ –
রঞ্জনবাবু নিজেকে বামপন্থী বলেছেন এবং আমি নিজে মনে করি তিনি ও কল্লোলবাবু মার্ক্সীয় রাজনীতির পড়াশোনা সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। অথচ পুরনো বামপন্থীদের ‘বাইবেল’ রজনী পাম দত্ত তিনি পড়েননি, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। সম্ভবত বয়সজনিত বিভ্রমের কারণে তিনি ভুলে গেছেন যে ১৮০০-১৮৫০-এর মধ্যে ৭টা, ১৮৫০-১৮৭৫ সময়কালে ৬টা এবং ১৮৭৫-১৯০০-তে ২৪টা মিলিয়ে গোটা উনিশ শতকে মোট ৩৭টা দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল। [R. Palme Dutt, India Today, People’s Publishing House, 1947, p. 106]
এই বিভ্রমের বশবর্তী হয়ে তিনি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন – “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মোগল আমল থেকে চলে আসা কৃষি রাজস্বের পদ্ধতির চেয়ে মন্দের ভাল। লেখকের বর্ণনা থেকেই দেখা গেছে পুরনো ব্যবস্থায় কোম্পানির রাজস্ব আদায়কারী প্রতিনিধিরা (পড়ুন জমিদারেরা) একেকবছর একেক রকম দাবি নিয়ে সোজা মাৎসন্যায় শুরু করেছিল। ফলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও একগাদা কৃষক বিদ্রোহ। নতুন ব্যবস্থায় একবার যা খাজনা ধার্য হয়েছে তাই প্রতি বছর কোম্পানিকে দিতে হবে। ফলে একধরণের অরাজকতা বন্ধ হোল। মন্বন্তর ও কৃষক বিদ্রোহ হল না। বিদ্যাসাগর সঠিক বলেছেন- “যদি পূর্বের ন্যায়, রাজস্ব বিষয়ে নিত্যনতুন পরিবর্তের প্রথা থাকিত, তাহা হইলে, এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না” — তা সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
এবারে বঙ্কিমের প্রসঙ্গে আসি। তিনি লিখেছেন, “দেখাই যাচ্ছে বঙ্কিম সে বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন যা তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ লেখাটির ছত্রে ছত্রে আছে। তাই সংস্কারের দাবি রেখেছেন। নইলে ইংরেজ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কী দায় পড়েছিল ওই অন্ধকার দিকের প্রতি আঙুল তোলার? ‘মোসাহেব’ হলে শুধু গুণ গাইতেন, অন্ধকার দিকের কথা তুলতেন না।” এই প্রসঙ্গে তাঁকে কেবল মনে করিয়ে দিতে চাই যে বঙ্কিমের পরিবার থেকে ‘ইংরেজ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের’ সংখ্যা ৫। তাঁর বাবা যাদবচন্দ্র, তিনি নিজে ও তাঁর তিন ভাই শ্যামাচরণ, সঞ্জীবচন্দ্র ও পূর্ণচন্দ্র। একই সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতো তিনিও সি আই ই বা Companion of the Indian Empire। কাজেই আমি আবারও বলতে চাই ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান!’
পূর্বপক্ষ – (৩.৪) ইতিহাসের আয়রনি
//দুই, স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘বন্দে মাতরম’ নামের ব্যাটল ক্রাই এল ইংরেজের চাকর এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের থেকে, যিনি নিজেকে ওপরের প্রবন্ধে বলেছেন ‘ইংরেজের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী’ বলে।
চার, যে মোহনদাস গান্ধী বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় নিজেকে ব্রিটিশ এম্পায়ারের মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সাবজেক্ট বলে লিখছেন তিনিই আর দুটো দশক পড়ে তাকে বলছেন ‘দ্য ডেভিল’স এম্পায়ার’ এবং ‘কুইট ইন্ডিয়া’র ডাক দিচ্ছেন।//
রঞ্জনবাবুর সঙ্গে মার্ক্স, এঙ্গেলস বা লেনিন নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি তাই বঙ্কিম ও গান্ধীতে সীমাবব্ধ থাকতে চাইছি। ‘বন্দে মাতরম’ নামক ব্যাটল ক্রাই কাদের জন্য? ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত আপামর ভারতবাসীর জন্য নাকি কতিপয় হিন্দু সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীর জন্য? এই ব্যাটল ক্রাই-এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ কলম ধরতে বাধ্য হয়েছিলেন কেন? রঞ্জনবাবু আলোচনাটির পূর্ব দিকে (৩.৩) আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরাণী-র উল্লেখ করেছেন। অথচ ওই দুটি উপন্যাসে বঙ্কিম ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ অর্থাৎ সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের যে বিকৃত ন্যারেটিভ সৃষ্টি করেছেন, তা কি তাঁর নজর এড়িয়ে গেল? আর গান্ধী? থাকুক বরং! ওটা আমার ‘ম্যাগনাম ধপাস’ কি না!!
সেকেন্ড রাউন্ডঃ
আমার পালটাঃ
প্রথম পর্বে ইস্যু ঠিক কী ছিল?
- আগের ফসলের ভাগ আদায় ভিত্তিক খাজনার বদলে ১৭৯৩ সালের জমির মালিকানা ভিত্তিক খাজনার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ভাল না খারাপ?
আমার বক্তব্য ছিলঃ
· দুটোই খারাপ; আগের ব্যবস্থায় ক্লাইভ ইত্যাদি কোম্পানির আমলাদের যা-ইচ্ছে লুঠের চেয়ে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেসার ইভিল। কারণ তাতে বছরের পর বছর খাজনার হার বদলায় না, যদিনা জমিদার সময়মত খাজনা জমা করতে অপারগ হয়।
· বিদ্যাসাগর বলেছেন- “যদি পূর্বের ন্যায়, রাজস্ব বিষয়ে নিত্যনতুন পরিবর্তের প্রথা থাকিত, তাহা হইলে, এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না”। আমি একমত। কারণ এনার্কিতে গরীবদের ভোগান্তি বেশি।
· আবার বলছি, দুটোই ইভিল; কম আর বেশি। তিনো না বিজেপি?
বঙ্কিম নিজেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। সেটা তাঁর প্রবন্ধে দেখা গেছে। এবং উনি কি কৃষক বিদ্রোহের ডাক দেবেন? ওনার সামনে কোন বিকল্প মডেল ছিল? নয়া, কাজেই একজন সংবেদনশীল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যতটুকু সম্ভব তাই করেছেন। সরকারের কাছে আবেদন করেছেন, যাতে লুপহোল গুলো বন্ধ হয়। বর্তমান আবস্থায় আমরাও কি তাই করছি না?
· আমি এটাও বলেছি যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে কোন বড় মন্বন্তর বা বড় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে নি। লেখকের উদাহরণগুলো সব তার আগের।
লেখকের জবাবের পর্যালোচনাঃ
· লেখকের জবাবের প্রথম, দ্বিতীয় প্যারা আমার বক্তব্যকেই সমর্থন করছে, অর্থাৎ ক্লাইভ আসার পর থেকে কোম্পানির আমলাদের খাজনা আদায়ের নামে এমন লুঠ চলেছিল যে ইংল্যান্ডের পার্লিয়ামেন্টে প্রশ্ন উঠেছিল এবং ক্লাইভের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। সেইজন্যেই ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রাজস্বের হার বেঁধে দেওয়া হয়।
· তৃতীয় প্যারায় যে মোট রাজস্ব আদায়ে বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে তার কারণ ‘মধ্যস্বত্ত্ব ভোগী জমিদারদের মাধ্যমে অনেক নতুন জমি চাষের জমি হয়ে রেভিনিউ রেকর্ডে আসে, ফলে মোট রাজস্ব আদায় বেড়ে যায়, কিন্তু শোষণের হার বাড়ে কি? সেটা মোট রাজস্ব বৃদ্ধি দিয়ে বোঝা যাবে না। তার জন্য অন্য তথ্য চাই।
· সামন্ত ও কলোনিয়াল ব্যবস্থায় কৃষক বিদ্রোহ হবে না, বা দুর্ভিক্ষ ঘটবে না—এ অসম্ভব, এরকম হতেই পারেনা। আমি খালি বলেছি বড় বিদ্রোহ হয়নি, দুর্ভিক্ষ হলেও মন্বন্তর হয় নি।
· লেখকের মূল বইয়ের উদাহরণগুলো ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ (১৭৯৩)এর বেশ আগের। এবারের নতুন উদাহরণগুলো?
-নীল বিদ্রোহ, আগে থেকেই শুরু, কারণ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নয়, বরং জোর করে কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং।
অন্য উদাহরণগুলোঃ লবণ কারিগরদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০৪), রেশম চাষিদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০), দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯), মেদিনীপুরের নায়েক বিদ্রোহ (১৮০৬-১৬), ময়মনসিংহে কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২), ময়মনসিংহের পাগলপন্থী বিদ্রোহ (১৮২৫-২৭)।
--এরমধ্যে কোনগুলি ঠিক ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’এর কারণে কৃষক বিদ্রোহ? লবণ কারিগর? রেশমচাষীর কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং? চুয়াড়, নায়েকদের জাতিসত্তার সংগ্রাম? লেখক বলছেন সুপ্রকাশ রায়কে কোট করেঃ ‘ছোটবড় অনেক বিদ্রোহ’।
- সংখ্যায় অনেক অর্ধ শতাব্দী জুড়ে হবেই, কিন্তু তাতে আমার মূল বক্তব্য কোথায় ব্যাহত হচ্ছে?
· লেখক বলছেন আমি মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের ভূমিকা নাকি এড়িয়ে গেছি?
- আমার পুরো একটি প্যারা ওই নিয়েঃ(৩.২) নতুন মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার ও মুৎসুদ্দিদের উদ্ভব।
- এছাড়া আমি লেখকের সমর্থনে প্রিন্স দ্বারকানাথের আফিম ব্যবসা ইত্যাদি প্রশ্নে লেখককে সমর্থন করেছি।
“লেখক চমৎকার ভাবে দেখিয়েছেন যে ৪০ বছর পরে লর্ড বেন্টিংক মন্তব্য করছেন -
‘আমি মানতে বাধ্য যে ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লব থেকে নিরাপত্তার প্রশ্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটা বিরাট সুবিধে আছে। অন্ততপক্ষে এর বদান্যতায় এমন এক বিপুলসংখ্যক ধনী জমিদারশ্রেণী উদ্ভূত হয়েছে যারা বৃটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে প্রচণ্ড আগ্রহী, জনসাধারণের ওপরও তাদের সম্পূর্ণ আধিপত্য আছে’।“ [5]
-খোদ বৃটিশ শাসক মানছেন যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বিদ্রোহ বিপ্লব কম হয়েছে, অথচ লেখক মানতে নারাজ!
· এই পয়েন্টে আমার শেষ কথাঃ
-চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুধু সুবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় লাগু হয়েছিল। বাকি ভারতে রায়তওয়ারি ব্যবস্থা ছিল।
যদি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ‘লেসার নয় গ্রেটার ইভিল’ প্রতিপন্ন করতে হয় তাহলে দেখাতে হবে যে ওই শাসনে বাকি রাজ্যের কৃষক বাংলার চাষিদের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ভালো ছিল।
· আর বঙ্কিমচন্দ্রের সাতপুরুষও যদি বৃটিশের আমলা হয় তাতে কী? বঙ্কিমের মূল্যায়ন হবে তাঁর লেখা ও কাজকর্ম দিয়ে, ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন কদাপি দাদু দ্বারকানাথের আফিম চাষ দিয়ে হবে না।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশ্নে আমার ভুল স্বীকারঃ
এব্যাপারে লেখক দেবোত্তমের সঙ্গে আমার কিছু ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। এনিয়ে আমি জনৈক ইতিহাসের অধ্যাপকের সঙ্গে আলোচনা করে আমার অবস্থান কিছু বদলেছি। যেখানে দেবোত্তম ঠিক, আমি ভুল এবং যে বিন্দুতে আমি নিজের অবস্থান পরিবর্তনের দরকার দেখছি না --সেগুলো স্পষ্ট করে দিচ্ছি।
* যেখানে দেবোত্তম ঠিক, আমি ভুলঃ
১ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বঙ্গের কৃষকদের কোন স্থায়ী উপকার হয় নি, কৃষির উন্নতি হয়নি, অবনতি হয়েছে।
ব্বিদ্রোহ হয়নি তার কারণ কোম্পানির ব্যবসার ছোট শরিক বা কর্মচারিগিরি করে হাতে কাঁচা পয়সা পাওয়া মুৎসুদ্দি থেকে উদ্ভূত নতুন জমিদারশ্রেণী পুরনো নীলরক্তের জমিদারদের হঠিয়ে দিয়ে নীলাম ডাকা পদ্ধতির মাধ্যমে জমির মালিক হয়েছে। এরা বেশির ভাগই কোলকাতা কেন্দ্রিক অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ড। এদের কৃষিতে কোন স্টেক নেই, মুনাফা কামানো ছাড়া। উদাহরণ রামমোহনের উর্ধতন পুরুষ এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
২ কিছুদিন যে বড় কোন কৃষক বিদ্রোহ হয়নি তার বড় কারণ নব্য জমিদাররা সরকার ও কৃষকদের মধ্যে বাফার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে কোম্পানির ইজারাদারদের যথেচ্ছা লুঠের ফলে কৃষকদের কোমর ভেঙে গেছল, তারা বিদ্রোহ করার অবস্থায় ছিলনা।
নীলরক্তের জমিদাররা ছিলেন পুরুষানুক্রমে ওই অঞ্চলের অধিবাসী। তাই দুর্ভিক্ষে এবং অন্য দরকারে বিপর্যস্ত প্রজারা তাঁদের কাছে আবেদন নিবেদন করতে পারত। শের শাহ সুরীর সময় থেকেই ভূ সংরক্ষণ ও কয়েক বছর পর পর জমিকে বিশ্রাম দেয়া গোছের কৃষির উন্নতিমূলক কাজ তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। কিন্তু নতুন উচ্চিংড়ে জমিদার শ্রেণীর মূল লক্ষ্য ব্যবসা। ফলে তাদের প্রজাদের আপেক্ষিক স্বার্থ নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিলনা। তাদের ছোঁয়া অসম্ভব ছিল। উপরের আগের দিনের পোস্টে আমার উল্লিখিত লর্ড বেন্টিঙ্কের মন্তব্যে এই কথাটাই ফুটে উঠেছে।
** যেখানে আমি ঠিক।
শেষ বিচারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজদের জন্য লাভপ্রদ হয়নি তাই ওরা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ছেড়ে বাকি ভারতে এটার প্রয়োগ করেনি।
১ কোম্পানির ইজারাদারদের কয়েক দশক যথেচ্ছ লুঠের বদলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কৃষকদের জীবনে একধরণের নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল, ঠিক কি ভুল?
ঠিক। মোঘল রাজস্ব ব্যবস্থার তুলনায় ব্রিটিশ প্রবর্তিত সমস্ত বন্দোবস্ত ক) চিরস্থায়ী, খ) রায়তওয়ারি,, গ) মহলওয়ারি সবই ভারতের কৃষিকে অবনতির দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু ইজারাদারদের লুঠের সময় 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' অ্যানার্কি বন্ধ করে তুলনাত্মক রিলিফ দিতে পেরেছিল সেটা ঠিক। সে হিসেবে বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত'কে সমর্থন যুক্তিযুক্ত।
২ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে কলোনিয়াল ব্রিটেনের বিশেষ লাভ হয়নি, তাই তারা এটাকে অন্য প্রদেশে লাগু করেনি; ঠিক কি ভুল?
ঠিক। ওরা চেয়েছিল 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটেনের মত স্থায়ী কৃষিতে নিযুক্ত এক নীল রক্তের জমিদার শ্রেনী তৈরি হবে। অর্থাৎ ওরা বঙ্গের কৃষি ব্যবস্থাকে ওদের মডেলে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিল। কিন্তু শিব গড়তে বাঁদর হোল। জমিদারীর নীলাম ডাকার মাধ্যমে খাজনা নির্ধারণের ব্যবস্থা শুরু হওয়ায় প্রাচীন নীল রক্ত হঠে গিয়ে মুৎসুদ্দি বানিয়ারা জমিদার হয়ে বসল। অথচ এই বন্দো বস্তে খাজনা ফিক্সড হওয়ায় ওরা বছরের পর বছর একই খাজনা পেতে লাগল। হার বাড়ানো গেলনা। নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারল।
তাই অন্য রাজ্যে রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি সিস্টেম এল।
Ranjan Roy,
দুঃখিত, আপনার এই বিস্তারিত আলোচনাটি আমার একটু দেরিতে চোখে পড়ল, ইতিমধ্যে আপনি বহু এপিসোড লিখে ফেলেছেন। আমি আগ্রহের সঙ্গে সবকটি পড়ে প্রতিক্রিয়া দেব, তবে বোধহয় বেশ একটু সময় লাগবে।