৭.১ স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে আগের অধ্যায়ের (৪) একটা কথা শেষ করা দরকার।
হিন্দু মেয়েদের স্কুলে পড়ানোর জন্যে হিন্দু শিক্ষিকা ছাত্রীদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হবে – এই প্রেক্ষিত থেকে যখন মিস কার্পেন্টার চাইলেন হিন্দু মহিলাদের জন্যে টিচার্স ট্রেনিং স্কুল বা নর্মাল স্কুল খোলা হোক, তাতে বেথুন স্কুলের কার্যনির্বাহী সম্পাদক বিদ্যাসাগর কেন রাজি হলেন না?
বিদ্যাসাগরের মতে “যে সমাজে সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা তাঁদের দশ-এগারো বছরের বিবাহিত মেয়েদের বাড়ির বাইরে যেতে দেন না, তখন তাঁরা তাঁদের বাড়ির বয়স্কা মহিলাদের শিক্ষিকার কাজ গ্রহণে সম্মতি দেবেন, এ আশা অলীক কল্পনা মাত্র। --- মেয়েদের শিক্ষার জন্য শিক্ষিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও অভিপ্রেত তা আমি বিশেষভাবে জানি --- কিন্তু দেশবাসীর সামাজিক কুসংস্কার যদি অনতিক্রম্য বাধা হয়ে না দাঁড়াত---”।[1]
লেখক সঠিক ভাবে আপত্তি তুলেছেন যে ‘যিনি বিধবাবিবাহ প্রচলন কিংবা বহুবিবাহ নিবারণের জন্য গ্রন্থরচনা করে আন্দোলন শুরু করেন’ বা দেশাচারের দাসত্ব করা অপছন্দ করেন; ‘সেই তিনিই হঠাৎ দেশাচারের অজুহাত খাড়া করে ৩০০টি বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন’। [2]
এবং সেই সময়ে বিদ্যাসাগরের এই মনোভাবকে কটাক্ষ করে বামাবোধিনী বিদ্যাসাগরদের ‘সংসাধন পথের বিঘ্নকারী’ আখ্যা দেয়।
“বয়ঃস্থা ভদ্রকুল রমণী পাইবার এই সকল প্রমাণ সত্ত্বেও যাঁহারা কৃতনিশ্চয় হইয়া বলিতেছেন যে এরূপে বিদ্যালয়ের ছাত্রী পাওয়া যাইবার সময় এখনও বঙ্গদেশে উপস্থিত হয় নাই। তজ্জন্য বিদ্যালয় সংস্থাপনের চেষ্টা নিরর্থক, এই প্রস্তাব এককালে পরিত্যাগ করা শ্রেয়ঃ এবং এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া গবর্ণমেন্টকে যখন বিদ্যালয় সংস্থাপনের চেষ্টা হইতেও এককালে নিরস্ত করিলেন তখন তাঁহাদিগকে ঐ মহোপকারী প্রস্তাবটি সংসাধন পথের বিঘ্নকারী না বলিয়া আর কি বলা যাইতে পারে”![3]
এবং সোমপ্রকাশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয় “তবে প্রশ্ন এই হইতেছে, হিন্দু শিক্ষয়িত্রী প্রস্তুত করার সময় আসিয়াছে কি না? আমরা ইহার আন্দোলন প্রারম্ভকালেই কহিয়াছি সে সময় উপনীত হইয়াছে। অন্ততঃ ইহার পরীক্ষা করা উচিত”।[4]
বিদ্যাসাগর এই প্রশ্নে ভুল ছিলেন কি?
লেখকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ‘বিদ্যাসাগরের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে বাংলা সরকার মিস কার্পেন্টারের পরিকল্পনাকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
বঙ্গ সরকার ১৮৬৮ সালের ৩ মার্চ বেথুন স্কুলের পরিচালন সমিতিকে লেখে-
“ছোটলাট মনে করেন যে স্কুলটিকে ফিমেল নর্মাল স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করলে নারীশিক্ষার প্রভূত উন্নতি হবে।– একজন ইংরেজ সভাপতির অধীনে কমিটির দেশীয় সদস্যরা যেমন বেথুন স্কুল পরিচালনা করেন, তেমন একজন বিভাগীয় পরিদর্শকের অধীনে তাঁরা পরামর্শদাতা কমিটির ভূমিকায় কাজ করতে ইচ্ছুক কিনা, তা ছোটলাট জানতে আগ্রহী”।[5]
এর জবাবে বিদ্যাসাগর প্রায় তিনমাস পরে ১৩ জুন, এ’বিষয়ে তাঁদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেন।
অবশেষে ১৮৬৯ সালের ২৭ জানুয়ারি মিসেস ব্রিটশে বেথুন স্কুল ও নর্মাল স্কুলের যুগ্ম পরিদর্শকরূপে যোগদান করার পর বেথুন স্কুলের পুরনো পরিচালন সমিতির অবসান ঘটে। মানে ইংরেজ সরকার এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের সিদ্ধান্তের সঙ্গে অসহমত হয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনবছর পরে ছোটলাট ক্যাম্পবেলের আদেশে ১৮৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি নর্মাল স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়।
এই উদাহরণ দিয়ে অনেক বিদ্যাসাগর জীবনীকার বলেছেন যে বিদ্যাসাগর ঠিক ছিলেন, অর্থাৎ সময় উপযুক্ত ছিল না।
লেখক এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে দেখিয়েছেন-
ক) ওই একই সময়ে (১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭১) কেশব চন্দ্র সেনের নর্মাল স্কুল সাফল্য পায়। সেখান থেকেই পাশ করে রাধারাণী লাহিড়ী বেথুন স্কুলের প্রিন্সিপাল হন।
খ) মিস কার্পেন্টার হাল না ছেড়ে কেশব চন্দ্র ও মিস অ্যানেটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আরেকটি নর্মাল স্কুল খোলেন। মিস অ্যানেট ১৮৭৩ সালের ১৮ই নভেম্বর স্থাপন করেন ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’। ১৮৭৬ সালে এটি নাম বদলে হয় ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’। ১৮৭৩ সালে বেথুন স্কুলের নতুন পরিচালন সমিতির সম্পাদক হন ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপের মনোমোহন ঘোষ। তিনি বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৮৭৮ সালের ১লা অগাস্ট বেথুন স্কুলের সঙ্গে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়কে যুক্ত করে দেয়ার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর ফলশ্রুতিতে বেথুন স্কুল সামান্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ‘রাতারাতি উচ্চ বিদ্যালয়ের রূপ ধারণ করে। ১৮৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট মেয়েদের পরীক্ষায় কিছু শর্ত সাপেক্ষে বসতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।[6]
পূর্বপক্ষ: বিদ্যাসাগর ভুল ছিলেন। মেয়েদের ঘরের বাইরে এসে পড়ার ও শিক্ষিকা হওয়ার সময় শুরু হয়ে গিয়েছিল। গোড়াতে সংখ্যা কম হতে পারে। কিন্তু সোমপ্রকাশের সম্পাদকীয় অনুযায়ী অন্তত চেষ্টা করা উচিত ছিল। মনোমোহন ঘোষ এবং তাঁর বন্ধুরা চেষ্টা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর তাঁর পূর্বাগ্রহের ফলে করেননি।
উত্তরপক্ষ:
১ অবশ্যই এবিষয়ে বিদ্যাসাগর সমাজের ভেতরের আকুতিকে বুঝতে ভুল করেছিলেন।
নিঃসন্দেহে ঈশ্বরচন্দ্র ভগবান নন, এক নিশ্চিত ঐতিহাসিক কালে আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েনে বেঁচে থাকা মানবমাত্র।
কিন্তু এ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের দেশাচারকে অগ্রাহ্য করে বহুবিবাহ এবং বিধবাবিবাহ নিয়ে বই লেখা ও আইন পাশ করাতে আন্দোলন করার সঙ্গে হিন্দু পরিবারের থেকে শিক্ষিকা তৈরির ব্যাপারে দেশাচারের কারণে পিছিয়ে আসার তুলনা একেবারে আপেল ও কমলালেবুর তুলনা। এটা খাপে খাপ হত যদি বিদ্যাসাগর নীতিগত ভাবে হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের শিক্ষিকা হওয়ার বিরোধিতা করতেন।
আমি লেখকের দেয়া তথ্য থেকে দেখিয়েছি যে উনি মেয়েদের শিক্ষা ও শিক্ষিকা হওয়ার সমর্থক, কিন্তু এ নিয়ে তো আইন পাশের ইস্যু নেই যা বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ রোধের জন্য দরকার ছিল। প্রশ্ন উঠেছে সমাজে সহযোগিতা না পাওয়ার। উনি আইন সত্ত্বেও উপরোক্ত দুটি আন্দোলনের তাৎকালিক ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করেছেন, অনীহা স্বাভাবিক। চার বছর পরে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। যদিও কয়েক বছর পরে অন্যদের প্রচেষ্টায় সাফল্য আসে।
২ কিন্তু লেখক বোধহয় খেয়াল করেননি যে বিদ্যাসাগরের ওই ভুলটিই লেখকের মূল থিসিসকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
লেখক ও তাঁর বন্ধুদের থিসিসটি (যা এই মূল্যবান পরিশ্রমী বইটির উপজীব্য) আবার তুলে ধরছি।
বইটির গোড়ায় ‘প্রকাশকের বয়ান’ অংশে বলা হয়েছেঃ
“এই কলকাতা নির্ভর নব্য সাম্রাজ্যপোষিত নবজাগরিত, ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকদের অন্যতম নেতা তাত্ত্বিক হয়ে উঠলেন রামমোহন রায়, তস্য পৌত্তলিকশিষ্য দ্বারকানাথ ঠাকুর, এবং একাকী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। প্রথমে কোম্পানি, পরে রাণীর দক্ষিণ এশিয়াকে আরও বড় লুঠযোগ্য, আরও বড় সাম্রাজ্যভোগ্য করে যাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব প্রাথমিক ভাবে ওই তিন মহাতেজের”। (বড় হরফ আমার)।[7]
কিন্তু উপরে লেখক প্রদত্ত তথ্যে কি উলটো ছবিটাই ফুটে ওঠেনি? বিদ্যাসাগর স্ত্রীশিক্ষার প্রশ্নে ইংরেজ সরকারের পদ্ধতিকে ‘ভুল’ মনে করছেন এবং বিরোধিতা করছেন। এবং ইংরেজ সরকার তাঁদের অ্যাজেন্ডায় সহযোগী না হওয়ায় বিদ্যাসাগরকে পাশে ঠেলে দিচ্ছেন।
৭.২ সিপাহী বিদ্রোহে বিদ্যাসাগর এবং তাঁর পদত্যাগ বিতর্ক
বিদ্যাসাগর সহসা সংস্কৃত কলেজ থেকে কেন পদত্যাগ করেছিলেন?
এ’ব্যাপারে অনেক জীবনীকার ও বিদ্যাসাগর-গবেষক মনে করেন যে জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ঙ-এর জন্যে দায়ী। তাঁদের মতে ইয়ঙের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতবিরোধের হেতু সংস্কৃত কলেজ ও বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে নীতিগত মতভেদ। বিনয় ঘোষ এককাঠি এগিয়ে লিখেছেন: “১৮৫৭ সালে সিপাহীবিদ্রোহের সময় থেকে দেখা যায়, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সরকারী শিক্ষাবিভাগের মতবিরোধের আবার সূত্রপাত হতে থাকে। এবারে বিরোধ ডি পি আই গর্ডন ইয়ঙের সঙ্গে। বিরোধ দিন দিন বাড়তে থাকে এবং ক্রমে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে বিদ্যাসাগর শেষ পর্য্যন্ত তাঁর অধ্যক্ষতার সরকারী চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।[8]
লেখকের মতে উপরোক্ত মন্তব্য পড়লে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হবে যে বিদ্যাসাগরের সিপাহীবিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতি সম্ভবত ওই বিরোধের আগুনে ঘি ঢেলেছে। কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায় এবং সুবলচন্দ্র মিত্রের প্রকাশিত তৎকালীন চিঠিপত্র ও অন্যান্য ডকুমেন্ট পড়লে উক্ত মন্তব্যের যুক্তিযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
যেমন বিনয় ঘোষের বহু আগে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ডকুমেন্টগুলোর ভিত্তিতে বলেন-
“অনেকে বলিয়া থাকেন, বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত ব্যাপারে ডিরেক্টরের সহিত বিরোধের ফলেই বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেন। কিন্তু হ্যালিডেকে লিখিত বিদ্যাসাগরের একখানি আধা-সরকারী পত্রে প্রকৃত কারণগুলি প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে”।[9]
আমরা এই সমস্যাটিকে তিনটি বিন্দুতে বিচার করে দেখব।
এক, আদৌ ইয়ঙের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কোন মতবিরোধ হয়েছিল কিনা?
দুই, বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের ব্রজেন্দ্রনাথ কথিত “আসল কারণ”টি কী?
তিন, সিপাহি বিদ্রোহ ও বাঙালি মধ্যবিত্তের ভাবনা।
৭.২.১ আদৌ ইয়ঙের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কোন মতবিরোধ হয়েছিল কিনা?
তথ্য বলছে কোন মতবিরোধ তো হয়ই নি, বরং ইয়ঙ পদে পদে বিদ্যাসাগরকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। যেমন-
৭.২.২ সিপাহি বিদ্রোহ ও বিদ্যাসাগর
দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ঙ বা ছোটলাট হ্যালিডের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কোন শিক্ষাসংক্রান্ত বা নীতিগত বা প্রশাসনিক বিরোধ ছিল না। তাহলে? অন্য একটি মত হল যে কলেজ বা স্কুল প্রাঙ্গণে বিদ্রোহ দমন করতে আসা সেনাদের শিবির করা নিয়ে বিদ্যাসাগর আপত্তি করেছিলেন। এই মতের প্রবক্তা বিনয় ঘোষ মশাই স্বয়ং। ওঁর মতে আতংকিত ব্রিটিশ শাসকেরা সৈন্যদের শিবির বানানোর জন্যে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের অট্টালিকা দখল করার সময় সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজের বিল্ডিং গুলিও দখল করেন। ‘এই সিদ্ধান্ত বিদ্যাসাগর মশাই সহজে মেনে নেননি’।[13]
বিনয় ঘোষ তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থের ‘শিক্ষাচিন্তা’ অধ্যায়ে আরও লিখেছেন ‘বরং ঘটনাগতি ও এই সময়কার চিঠিপত্রের বিষয়বস্তু থেকে মনে হয় যে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজ সরকারী সেনাবিভাগের কুক্ষিগত করার বিরোধী ছিলেন’[14]।
বিনয় ঘোষ মশাই এই সিদ্ধান্তে কী করে পৌঁছলেন? কোন চিঠি, কোন মেমো? কারও স্মৃতিচারণ? না, বিদ্যাসাগরের দিক থেকে এমন কোন প্রতিবাদের উল্লেখ বা তথ্য বিনয় ঘোষ দেননি, এটা শুধুই ওঁর অনুমান।
অথচ তাঁর বইটি লেখার অনেক আগে সুবল চন্দ্র মিত্রের Isvar Chandra Vidyasagar: Story of His Life and Work (1902) প্রকাশিত হয়েছে। যাতে ওই বিষয়ে বেশ কিছু চিঠি রয়েছে। কিন্তু শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষ মশায় কোন কারণে সেগুলোর উল্লেখ আবশ্যক মনে করেননি। ‘পরে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ”(১৯৩১)তে ওই চিঠি নিয়ে আলোচনা করতে দ্বিধা বোধ করেননি।[15]
সিপাহি বিদ্রোহের মূল্যায়নে বিদ্যাসাগর কি সমসাময়িক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের থেকে আলাদা ছিলেন?
নিঃসন্দেহে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মহারানি ভিক্টোরিয়ার শাসনকে মুঘল সম্রাটের শাসনের তুলনায় অধিক কাম্য। বঙ্কিমের আনন্দমঠের শেষের পৃষ্ঠায় মহাপুরুষ এসে সত্যানন্দকে বলছেন- এক্ষণে ইংরাজ দেশের রাজা হইয়াছে, দেশে শান্তি স্থাপিত হইবে।
মানে, কোম্পানির রাজত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শেষ হোল ভিক্টোরিয়ার রাজত্বে এবং মুসলিম বিদ্বেষে। এবার কাজ শেষ? তাই স্বাধীনতা আন্দোলনে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাবনার জগতে ফারাক রয়েই গেল। এর ফলশ্রুতিতে শিক্ষিত বাঙালি সিপাহী বিদ্রোহকে দেখেছিল “সামন্ত বিদ্রোহ” হিসেবে।
লেখকের যুক্তি ও তথ্য এক্ষেত্রে অকাট্য। কিছু উল্লেখ করা যাক।
ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা লিখল, ‘ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের অধীনতায় অধুনা দুর্বল ভীরু বাঙ্গালিব্যুহ যেরূপ সুখ স্বচ্ছন্দতা সম্ভোগপূর্বক সানন্দে বাস করিতেছে, কস্মিনকালে তদ্রূপ হয় নাই, রামরাজ্য আর কাহাকে বলে’?[16]
কোম্পানিরাজের অবসান এবং মহারানির অধিগ্রহণে খুশি হয়ে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নাটকের ভূমিকায় লেখেন-
“প্রজাবৃন্দের সুখ-সূর্্যোদয়ের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে। দাসীদ্বারা সন্তানকে স্তনদুগ্ধ দেওয়া অবৈধ বিবেচনায় দয়াশীলা প্রজা-জননী মহারাণী ভিক্টোরিয়া প্রজাদিগকে স্বক্রোড়ে লইয়া স্তন পান করাইয়াছেন”।[17]
একসময়ে নীল বিদ্রোহের পক্ষে “পেট্রিয়ট” পত্রিকায় কলম ধরে যে হরিশ মুখোপাধ্যায় জেল খেটে ছিলেন তিনি, শিবনাথ শাস্ত্রীর বকলমে “তেজস্বিনীভাষাতে কর্তৃপক্ষের মনে এই সংস্কার দৃঢ় রূপে মুদ্রিত করিবার প্রয়াস পাইলেন যে, সিপাহী বিদ্রোহ কেবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিপাহিগণের কার্য মাত্র, দেশের প্রজাবর্গের তাহার সহিত যোগ নাই। প্রজাকুল ইংরাজ গবর্ণমেন্টের প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুরক্ত এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে”।[18]
১২৭৮ বঙ্গাব্দের এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় ইংরেজি শেখার পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে ইংলন্ডের পত্রিকার মন্তব্য উদ্ধৃত করে ছাপা হয় –“ কোন ইংরাজী ভাষাভিজ্ঞ ভারতবর্ষীয় লোক সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দেন নাই। ইহাতেই সপ্রমাণ হয় যে ইংরাজি শিখিলে ইংরাজ গবর্ণমেন্টের প্রতি দৃঢ় ভক্তি জন্মিয়া থাকে”।[19]
এ’বিষয়ে বিদ্যাসাগর কি সমসাময়িকদের থেকে আলাদা পথে হেঁটে ছিলেন?
ঐতিহাসিক তথ্য উলটো সাক্ষ্য দেয়।
বিদ্যাসাগর তাঁর বহুবিবাহ নিবারণ বিষয়ক প্রথম পুস্তকের বিজ্ঞাপনে লেখেন:
“—কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশের দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই সময়ে রাজবিদ্রোহ উপস্থিত হইল। রাজপুরুষেরা বিদ্রোহনিবারণ বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপৃত হইলেন। বহুবিবাহনিবারণ বিষয়ে আর তাঁহাদের মনোযোগ দিবার অবকাশ রহিল না”।[20]
তাহলে কলেজকে সেনাবিভাগের হাতে ছেড়ে দেবার জন্য সরকারের আদেশের কি উনি বিরোধিতা করেছিলেন?
একেবারেই নয়। বরং তদানীন্তন সরকারি নথিপত্রে দেখা যায় বিদ্যাসাগর ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় এবং বকরি ঈদ ও মহরমের জন্যে উনি বিনা পূর্বানুমতি পাঁচদিনের জন্যে কলেজ ছুটি করে দেন এবং অন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে তাতে কলেজের ফার্নিচার স্থানাতরিত করেন। এসব করে তারপর উনি শিক্ষা অধিকর্তা ইয়ঙ সায়েবকে অনুমোদনের জন্যে ১ অগস্ট লিখিত অনুমতি চেয়ে পাঠান এবং ইয়ঙ সহজেই তা দিয়ে দেন। কারণ বিদ্যাসাগর কর্নেল স্ট্র্যাচির আদেশ পালন করতে গিয়ে ওইসব ডিসিশন নিয়েছেন।[21]
এরপরে উনি একতরফা ছুটি বাড়িয়ে আটদিন করে ২৪ অগস্ট ফের ইয়ঙকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে post facto approval চাইলেন এবং ইয়ঙ বিনাবাক্যব্যয়ে তা অনুমোদন করলেন।
“Two squads of the Volunteer Corps having occupied the Sanskrit College premises from Saturday evening when it is understood that they will be on duty for the day and night during the Mohurrum, I have the honour to report for your information that in anticipation of your sanction I have this day closed the Institution for 8 days”.[22]
কোথায় কলেজে সেনাবাহিনীর কব্জার বিরোধ? উনি তো ওপরওয়ালার অনুমতি না নিয়ে আগ বাড়িয়ে ফৌজের জন্য কলেজ খালি করে দিয়েছেন। এ’ব্যাপারে বিদ্যাসাগর ও শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়াঙের মধ্যে মতবিরোধ মিথ মাত্র।
তার এক বছর পর বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেন।
তাহলে শিক্ষা অধিকর্তা ইয়ঙ বা ছোটলাট হ্যালিডের সঙ্গে শিক্ষানীতি বা সিপাহী বিদ্রোহ দমনে কলেজ খালি করা নিয়ে মতবিরোধ বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ নয়, কারণ ওই ঘটনাগুলো আদপে ঘটেনি। কোন তথ্য বিনয় ঘোষ দের থিসিসকে সমর্থন করছে না।
পূর্বপক্ষ: শিক্ষা অধিকর্তা ইয়ঙ বা ছোটলাট হ্যালিডের সঙ্গে শিক্ষানীতি বা সিপাহি বিদ্রোহ দমনে কলেজ খালি করা নিয়ে মতবিরোধ বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ—একটি মিথ, এর সমর্থনে কোন তথ্য নেই, বিপরীতে আছে।
উত্তরপক্ষ: নিঃসন্দেহে। এখানে লেখক পর্যাপ্ত বিপরীত তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে উপরোক্ত মিথগুলিকে খারিজ করতে পেরেছেন। কিন্তু আমার একটি পাদটীকা আছে।
নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে লেখক সিপাহি বিদ্রোহের চরিত্রের যে মূল্যাঙ্কন করেছেন সেখানে দ্বিমতের অবকাশ রয়েছে।
লেখকের মতে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ কেবল সিপাহী বিদ্রোহ নয়, বরং গোড়ায় মার্ক্স এবং পরে সাভারকর আখ্যায়িত ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। একে ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ বলার ‘কোন কারণই থাকতে পারে না। কারণ এই বিদ্রোহে সামন্ত ব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ রাজন্যবর্গের একজনও যোগ দেননি।
এই জায়গায় থমকে গেলাম। বিঠুরের নানাসাহেব, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, আরা-জগদীশপুরের কুঁয়র সিং, ফৈজাবাদের মৌলবী এরা কারা? কোন সন্দেহ নেই যে আজমগড় ইস্তেহারে ‘কোম্পানির অপশাসনের প্রকৃত ছবি তুলে ধরা হয়’। এবং উত্তর ভারতের চারটি এলাকার ব্যাপক জনসাধারণ এতে যোগ দেন। কাজেই এটি স্বাধীনতা সংগ্রামও বটে আবার ক্ষমতাচ্যুত রাজন্যদের ফিরে আসার চেষ্টাও বটে। এই লড়াইয়ে, অন্য যেকোন লড়াইয়ের মত, বহুবিধ স্বার্থের ধারা এসে মিশেছে। লেখক নিজেই মানছেন যে আজমগড় ইস্তেহার সম্রাট বাহাদুর শাহের নামে জারি করা হয়েছিল।[23]
অন্যে পরে কা কথা—লেখক নিজে পরের অধ্যায়ে অন্য প্রসঙ্গে মার্ক্সিস্ট ইতিহাসবিদ দামোদর কোসাম্বির একটি মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন:
“The new class that rose in the second half of the 19th century—after the last upsurge of feudalism in the 1957 Mutiny---”.(মোটা অক্ষর আমার) [24]।
তাহলে সিপাহী বিদ্রোহের মূল্যায়নে বিভিন্ন মতের অবকাশ আছে!
৭.২.৩ তাহলে বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের “আসল কারণ”?
লেখক প্রখ্যাত বিদ্যাসাগর গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে উল্লেখ করে বলেছেন যে “পদত্যাগের আসল কারণ” বোঝার চাবিকাঠি হল ছোটলাট “হ্যালিডেকে লিখিত বিদ্যাসাগরের একখানি আধা-সরকারী পত্রটি”। আমরা প্রথমে লেখককে অনুসরণ করে ঘটনাক্রমটি বোঝার চেষ্টা করব।[25]
“দেখেছি পদোন্নতির আর কোনও আশা নেই এবং একাধিকবার আমার ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। অতএব আশা করি, আপনি স্বীকার করবেন যে আমার অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।”[27]
হ্যালিডে সহমত হননি; উনি ২৫শে সেপ্টেম্বর মন্তব্য করেন:
“দুঃখের বিষয় এই যে পণ্ডিত কিঞ্চিৎ অশিষ্টভাবে অবসর গ্রহণ করা সঙ্গত বিবেচনা করলেন, বিশেষত তাঁর যখন অসন্তোষের কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই”।[28]
শেষে বিদ্যাসাগর ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর সংস্কৃত কলেজ থেকে পাকাপাকি ভাবে অবসর নিলেন এবং মিঃ কাওয়েলকে চার্জ হ্যান্ড ওভার করলেন। লেখক বলছেন যে বিদ্যাসাগর যখন মাসিক ৫০০ টাকার চাকরি ছাড়ছেন তখন বই বিক্রি থেকে তাঁর মাসিক আয় অনেক বেশি। বাকল্যান্ড জানাচ্ছেন-
Vidyasagar’s monthly benefactions amounted to about Rs. 1500 and his income from his publications for several years ranged from Rs. 3000 to 4500 a month.[29]
পূর্বপক্ষ: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যো এবং সুবলচন্দ্র মিত্র প্রকাশিত ছোটলাট হ্যালিডে ও শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ঙের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পত্রাবলির থেকে এটা স্পষ্ট যে তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রমোশনের আশা পূর্ণ না হওয়ায় ভগ্নমনোরথ বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেছিলেন।
অথচ বিনয় ঘোষ এই পত্রগুলো উল্লেখ করেননি এবং সিপাহী বিদ্রোহের সময় সৈনিক শিবিরের জনয়ে কলেজ বিল্ডিং ছেড়ে দেওয়া নিয়ে বিদ্যাসাগরের বিরোধিতার কোন তথ্য বা ডকুমেন্টেড প্রমাণ দেখানোর চেষ্টা করেননি। শিক্ষানীতি নিয়ে মতবিরোধের কোন প্রমাণ নেই, বরং পদে পদে বিদ্যাসাগরের স্বাধীন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে হ্যালিডে ও ইয়ঙের সমর্থনের প্রমাণ রয়েছে।
উত্তরপক্ষ: এই ইস্যুতে লেখক একেবারে দশে দশ। উপলব্ধ সমস্ত সাক্ষ্য লেখকের অবস্থানের পক্ষে বললে কম বলা হয়। খুব টেনে মানে করেও বিদ্যাসাগর সিপাহি বিদ্রোহের সময় কলেজ বিল্ডিং সৈনিকদের জন্যে ছেড়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন বা বিশেষ শিক্ষানীতির জন্যে ছোটলাট হ্যালিডে এবং শিক্ষা অধিকর্তা ইয়ঙের সঙ্গে পাঞ্জা লড়িয়েছিলেন—এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কঠিন। বিনয় ঘোষদের মত বিদগ্ধজনেরাও এখানে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে এক বিপ্লবী আপসহীন বিদ্যাসাগরের ছবি দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই।
তবু বাঙালের দুটো কথা- বিদ্যাসাগর এখানে আবিষ্কৃত হচ্ছেন একজন চাকুরি ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী মানুষ হিসেবে যাঁর সুসম্পর্ক এবং কাজের হিসেবে একটি বিশেষ প্রমোশন প্রাপ্য ছিল, কিন্তু সেটা না পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিলেন এমন ভাবে- প্রতিবাদ জানিয়ে- যেটা ছোটলাটের কাছে ‘অশিষ্ট’ মনে হল।
এই ছবিটি বিদ্যাসাগরকে হয়ত মহাপুরুষের পাদপীঠ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনবে, কিন্তু একজন দৃঢ়চেতা শক্ত মেরুদন্ডের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, মোসাহেব হিসেবে নয়।
পরের পর্বটি হবে ছোট কিন্তু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাতে জনশিক্ষা নিয়ে মেকলের “চুঁইয়ে পড়া” মডেল এবং তার পালটা অ্যাডাম, রেভারেন্ড লালবেহারী দে, পাদরি লঙ ও রবীন্দ্রনাথের চোখে এই মডেলগুলির মূল্য নিয়ে কাটাছেঁড়া হবে যার কেন্দ্রে অবশ্যই থাকবেন বিদ্যাসাগর।
(চলবে)
@রঞ্জন, টুপি খুললাম। অনবদ্য বিশ্লেষণ। এক মাত্র শিক্ষা বিশেষ করে নারীশিক্ষার সঙ্গে জড়িত অংশ টুকু ছাড়া আর বিশেষ কিছুই জানি না। কাজেই কে ঠিক কে ভুল তা তথ্য দিয়ে বোঝা মুশকিল। তবে এই ভাবে বিশ্লেষণ যে করা যায় তা আপনি দেখিয়ে দিলেন।
আর হ্যাঁ বলছি যে আপনি কি বই পড়ার সময় মার্জিনে নোট নেন? তাহলে আপনার সংগ্রহের বইগুলোর কি অসীম মূল্য ভেবে শিহরিত হচ্ছি।
এইটে ভারী চমৎকার আলোচনা হচ্ছে। আগেই বলেছি আলোচনা হলে এরকমই হওয়া উচিৎ।
প্রোমোশান না পেলে পাতা ফেলা ত খুবই যুক্তিযুক্ত একটা ব্যপার। আমরা অনেকেই ফেলেছি বিভিন্ন সময়। আইটি কোম্পানিগুলোতে রিজাইন করার কারণ হিসেবে বেটার অপরচুনিটি, লোকেশান চেঞ্জ ইত্যাদির সাথে প্রোমশান ডিনায়েড বলেও একটা অপশান থাকে। অর্থাৎ প্রোমোশান না দেওয়ায় পদত্যাগ করিতেছি।
স্বাতী ও দময়ন্তীকে ধন্যবাদ।
@স্বাতী,
আমি বিচ্ছিরি হাতের লেখায় বইয়ের মার্জিনে নোট নিই, তাতে বই এত নোংরা হয়যে পরে অন্য কেউ টেনে গাল পাড়ে। আমাকে পেনসিল কিনে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে মন ভরেনা। ইদানীং ছোট ছোট নোটবুকে নোটস নেয়া আরম্ভ করেছি। তাতে পাঠ্য বইটির পেজ নং টুকে রাখি। পরে লেখার সময় বই ও নোটবই কম্প্যুর দু'দিকে রাখি।ঃ)))
রন্জন লিখেছো (বা লেখকে কোট করেছো) "মার্ক্স এবং পরে সাভারকর আখ্যায়িত ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম"।
নাঃ, মার্ক্স কস্মিন কালেও সিপাহি বিদ্রোহকে "ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম" বলেন নি। ওনার আর এঙ্গেল্সের কিছু প্রবন্ধ একত্র করে একটা কালেকশন বার করে সোভিয়েত দেশ থেকে - এবং সেই সংকলনের ওরকম নাম দেওয়া হয়েছিলো। নিঃসন্দেহে একটি বাজে সম্পাদনার উদাহরণ।
এই বিষয়ে আমার একটা সংক্ষিপ্ত বুক রিভিউ লিখেছিলাম ,সেটার লিংক দিচ্ছি -<https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=18307&srchtxt=%E0%A6%A6%E0%A7%80%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%A8
ডিডি মুখ খুলেছেন। জয়তু বিদ্যাসাগর।
জয়তু বিদ্যাসাগর! জয়তু ডিডি!
আসলে আমরা সোভিয়েত পাবলিকেশনের ওই টাইটেলের বই পড়ে বড় হয়েছি।
কিন্তু ডিডি ঠিক। ওর মধ্যে মার্ক্সের নিউইয়র্ক ট্রিবিউনের জন্যে লেখা কিছু আর্টিকল ও ডেসপ্যাচ আছে। কখনও কখনও যুদ্ধের দুই পক্ষের ট্যাক্টিক্স নিয়ে এবং ফলাফল নিয়ে কিছু কথাবার্তা আছে। মনে পড়ছে যে ওইরকম কোন ডেসপ্যাচে ইংরেজদের সম্বন্ধে "কুত্তা" ও ঔরংজেবের জন্য (নাকি মোগল বাদশার জন্য, আজ মনে পড়ছেনা) "গাধা" বিশেষণ ব্যবহার করা আমাকে কিশোর বয়সে বিমর্ষ করেছিল। মনে হয়েছিল এটা কেমন ইতিহাস-চর্চা? সেমার্ক্সই হোন বা অন্য কেউ।
আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করছি ডিডির পুরনো গুরু লিং একটি চমৎকার সংযোজন।
দীপ্তেনবাবু, ধন্যবাদ এই ভুলটির দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। আমি রঞ্জনবাবুর প্রতিটি পর্বের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি প্রতি শুক্রবারে। প্রথম পর্বেরটা আপাতত দিয়েছি রঞ্জনবাবুর অনুমতি নিয়েই। এটারও দেব তবে সময় লাগবে।
আসলে বইতে কোথাও মার্ক্স মহাবিদ্রোহকে 'ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম' বলেছেন এমনটা লেখা নেই। সাভারকরের উল্লেখ তো নেই-ই। আসলে সারা বইতে এই একবারের জন্যই মার্ক্সকে ব্যবহার করে একটি বাক্য লেখা হয়েছে সেটা এইরকম --- বিদ্রোহের যথাযথ কারণ হিসেবে ‘destruction, through free trade, [of] the domestic handicraft industry in India’-কে চিহ্নিত করে, ১৮৫৭ সালের ৩০ জুন নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে মার্ক্স যে বিদ্রোহকে ‘national revolt’ এবং ‘the only social revolution ever heard of in Asia’ বলে আখ্যায়িত করেন, সেই বিদ্রোহকে তৎকালীন তাবৎ অগ্রগণ্য হিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবী ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ বলতে দ্বিধা করেননি। তথ্যসূত্র: Karl Marx, ‘The Revolt in the Indian Army’; The First Indian War of Independence, 1857-1859, Moscow, 1959, p. 40
এখানে একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া আছে। https://www.4numberplatform.com/?p=27444
এ ত ভক্তিবাদী সমিতির দেবাশিস ভটচাজ! দেবোত্তমের কাছা খুলে দিইচে গো!
লেখক নিজে একজন উচ্চবর্ণ ‘ভদ্রলোক’, এবং শিক্ষকতার মত একটি মার্কামারা ভদ্রলোকি পেশায় যুক্ত, এবং তার ওপর আবার তিনি ইংরেজি ভাষারই শিক্ষক, যা কিনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রকট সাংস্কৃতিক আমদানি। তবুও সম্পূর্ণ অকারণে নিজেদেরকে ‘ছোটলোক’ পক্ষ সাব্যস্ত করে, এবং পূর্ববর্তী সমস্ত বিদ্যাসাগর-গবেষককে (বস্তুত যাবতীয় শিক্ষিত ভদ্রলোককুলকেই) সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের অংশীদার এলিট-শ্রেণি সাব্যস্ত করে, এই রকম বাতিকগ্রস্ত আত্মগর্বী পাগলপারা গর্জনে বইটি ভরপুর। এতটাই, যে, কোথাও কোথাও হাস্য সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কাজেই, তারও দু-একটা নমুনা চেখে না দেখলেই নয়। তবে, বইটির শিরোনামে কিন্তু একটা বেশ নিরীহ ভাব আছে, ‘নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণ’ শব্দগুচ্ছের মধ্যে আছে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি— তথ্যযুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ ও পরিশ্রমসাধ্যভাবে প্রতিপাদ্য নির্মাণের মিথ্যে আশ্বাস।
চমৎকার আলোচনা হচ্ছে। সবগুলো জমাচ্ছি। একসঙ্গে পড়ব ও সংগ্রহে রাখব বলে।
চলুক।
খিকখিক
যতটুকু দেবাশিসকে উল্লেখ করেছেন তা দেখে ওই লিং পড়ার ইচ্ছে চলে গেল। এমনিতেও আমার লেখা সম্পূর্ণ হলে তবেই দেখতাম, প্রভাবিত হতে চাইনা। এখন মনে হচ্ছে দেখার দরকার নেই।
ওতে লেখক দেবোত্তমবাবুর ব্যক্তি পরিচয় ইত্যাদি নিয়ে ভদ্রভাষায় ব্যক্তি আক্রমণ করা হয়েছে, যা অনভিপ্রেত। কারণ আমরা দেবোত্তমবাবু কী লিখেছেন তানিয়ে চর্চা করছি, উনি কী করেন, কোথায় থাকেন, কীদিয়ে ভাত মেখে খান সেসব নিয়ে নয়। আর ইংরেজির টিচার হলে ভারতে কলোনিয়াল সময়ে ইংরেজি শিক্ষার কুফল নিয়ে কিছু বলা যাবেনা? সমালোচনা করা যাবেনা? তাহলে ম্যাঞ্চেষ্টারে কাপড়ের কলের শেয়ারের মালিক এঙ্গেলসেরও মজদুরের অতিরিক্ত শ্রম শোষণ নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই, এমন ভাবনাকে জায়গা দিতে হয়।
দেবোত্তমের বিশ্লেষণ নিয়ে সহমত হতেই হবে এমন নয়। কিন্তু বিশাল বইটিতে যে পরিমাণ রিসার্চ হয়েছে তার মূল্য অপরিসীম। নিশ্চয়ই একদিন কোন যোগ্য ব্যক্তি সঠিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে এর গ্রন্থ-সমালোচনা করবেন, আমি যা করছি সেটা সাধারণ পাঠকের এক 'ওপেন এন্ডেড ডিসকাশন', এই টুকুই।
তপনবাবু লিখেছিলেন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোককে হাতি বিষয়ে লিখতে বলা হয়েছিল। তাতে ফরাসিরা লেখে 'হাতির প্রেম' নামে ফুরফুরে পাতলা বই, জার্মানরা 'হস্তি বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ' নামে সাত খন্ডে সমাপ্য ফুটনোটকণ্টকিত একটি সিরিজ, আমেরিকানরা লেখে 'হাতির ব্যবসায় বিপুল মুনাফা', আর ইহুদীরা 'হস্তীর ইহুদি বিদ্বেষ'। মোটামুটি এইরকম আরকি, একটু এদিক ওদিক হতে পারে।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক, ফুটনোটকন্টকিত কথাটা পড়ে ছোটবেলায় মজা পেয়েছিলাম, তাই মনে পড়লো।
মার্জনা করবেন অস্থানে ছ্যাবলামি করলাম।
বাঙালিদের লেখা দু ভল্যুম বইটার কথা উল্লেখ করলেন না দেখে দুঃখ পেলামঃ সিআইয়ে ও গুপ্তহাতি।