৮.০ লেখকের দেয়া তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে কোম্পানি আমল থেকেই ইংরেজ কলোনিয়াল প্রভুরা তাদের নিজেদের স্বার্থে দেশজ শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারি সাহায্য ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মজবুত এবং উন্নত করতে চেয়েছিল। কিন্তু কীভাবে সেটা হবে বা আজকের শব্দাবলীতে তার রোডম্যাপ কেমন হবে তা নিয়ে স্পষ্ট দুটো মত ছিল।
এক, মেকলের ‘চুঁইয়ে পড়া’ প্রগতির মডেল। যার টার্গেট গ্রুপ হল উচ্চবর্গীয় শহুরে মধ্যবিত্ত, যাঁরা মনেপ্রাণে ইংরেজ হবেন। এতে অবশ্যই জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ, বিশেষ করে দরিদ্র ও অহিন্দু এবং নিম্নবর্ণ, এই বৃত্তের বাইরে ব্রাত্যজন হয়ে থাকবে। সরকার শুধু কিছু মডেল স্কুলকে আর্থিক সাহায্য দেবে। ওই ‘সেন্টার অফ এক্সেলেন্স’(শব্দবন্ধ নির্বাচন আমার)গুলোর বা জ্ঞানের আলোকস্তম্ভের প্রভাবে দূরে কিছু রশ্মি পৌঁছবে, অন্ধকার খানিকটা দুর হবে। এই মডেলের প্রয়োগ হল বঙ্গে।
দুই, ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে চালু প্রবর্তিত হয়েছিল টোমাসন প্রবর্তিত হলকাবন্দি বিদ্যালয়, যার সমর্থনে কলম ধরেছিলেন অ্যাডাম এবং তৃতীয় রিপোর্টে উপরোক্ত মডেল স্কুলের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বাইরে থেকে কিছু চাপিয়ে দেবার বদলে যেখানে যতটুকু অসম্পূর্ণতা চোখে পড়বে তার উন্নয়ন করার কথা বলেছিলেন।
বঙ্গে অ্যাডামের রিপোর্টের সুপারিশ – to improve what is imperfect, and to extend to all what is at present confined to a few--[1] গৃহীত হল না। চালু হল মেকলের সরকারি সাহায্য পুষ্ট উচ্চবর্গীয় মডেল স্কুলের সারি।
মজার ব্যাপার হল- দুই মডেলেরই ঘোষিত লক্ষ্য: ‘মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মানোন্নয়ন’।
লেখক বলছেন যে সে বিষয়ে যে মডেল স্কুলগুলি ‘ ব্যর্থ হয় তা শিক্ষাসম্পর্কীয় সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়’।[2]
তখন পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্যালয় পরিদর্শক উড্রোর সুপারিশ মেনে বঙ্গে টোমাসন প্রবর্তিত হলকাবন্দি বিদ্যালয় ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হোল ১৮৫৭ সালের গোড়ায়।
কিন্তু দুই মডেলের অমিলও খেয়াল করার মত, সেটা হল প্রকল্প রূপায়ণের টাকাটা আসবে কার পকেট থেকে?
মেকলের ‘চুঁইয়ে পড়া’ মডেলে অনুমোদিত স্কুলগুলোর আর্থিক দায়ভার সরকারের।
কিন্তু টোমাসন-অ্যাডাম সমর্থিত হলকাবন্দি মডেলে অর্ধেক ব্যয় বহন করবে সরকার। বাকি অর্ধেকের জন্যে স্থানীয় জমির মালিকেরা সরকারকে দেয় রাজস্বের উপর অতিরিক্ত ১% শিক্ষা কর (education cess) দেবেন। একেবারে আজকের ভারতবর্ষের পিপিপি বা পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টিসিপেশন!!
ইতিমধ্যে কোম্পানির বদলে মহারানির শাসন শুরু হয়ে গেছে। ভারত সরকারের সচিব মিঃ বেইলি ১৮৫৯ সালে লিখলেন যে বঙ্গের জমিদারেরা যদি এ জাতীয় কোনও ব্যবস্থায় নিজে থেকে সহযোগিতা না করেন তাহলে আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বাংলার জমিদারেরা এই প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করেন।[3] এই বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে লেখক যথেষ্ট তথ্য দিয়েছেন। এগুলো অবশ্যই আমাদের বঙ্গ-রেনেসাঁর সময়ে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের শিক্ষা সংক্রান্ত অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
৮.১ আলোকপ্রাপ্ত জমিদারবর্গ ও অন্যান্য ভদ্রজনের শিক্ষার প্রসার নিয়ে চিন্তা -ভাবনা
পাদ্রি লং বড়লাট লরেন্সকে লেখা চিঠিতে লেখেন, ‘দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রসারের ব্যবস্থা না করা হলে বৃহৎ সংখ্যক কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ চিরদিনই অজ্ঞানের অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবেন’।[4] বাংলায় পঁচিশ বছর কাটানোর পর তাঁর উপলব্ধি “I have known but rare cases where either Zaminders or educated natives would do anything to raise the Bengal ryot to the status of a ‘man and a brother’.”[5]
তাই তিনি সরকারকে জনশিক্ষায় আরও অর্থব্যয় করার এবং জমিদারদের ওপর প্রয়োজনমত শিক্ষা কর বসিয়ে অর্থসংগ্রহের অনুরোধ করেন।
এর বিরোধিতায় দাঁড়ালেন উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ‘বৃটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’এর সান্মানিক সম্পাদক যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, সদস্য কিশোরীচাঁদ মিত্র, ভারততত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রদের মত অনেক শিক্ষিত ও সম্পন্ন মানুষেরা। এঁরা সমর্থন করলেন মেকলের ‘ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন’ শিক্ষানীতিকে।
জনশিক্ষা প্রসারের পক্ষে দাঁড়ালেন রেভারেন্ড লালবিহারী দে। সোমপ্রকাশ পত্রিকা বলছে যে লালবিহারী দেখান বঙ্গের ৪ কোটি জনসংখ্যার জন্য প্রতি ১০০০ লোকপিছু একটি করে বিদ্যালয় হলে ৪০ হাজার প্রাইমারি স্কুল চাই। তার সঙ্গে ৮০টি নর্মাল ও ৮০টি হাইস্কুল, সব মিলিয়ে মাসে মোট ব্যয়ভার ৬০ লক্ষ টাকা। কথা হল টাকাটা আসবে কোত্থেকে?
লালবিহারীর মতে, ছাত্রছাত্রীদের মাসিক ফি এক আনা ধরে ১০ লক্ষ, লবণ কর থেকে ২২ লক্ষ, জমিদারদের উপর শিক্ষা কর ৭ লক্ষ, সরকারের তহবিল থেকে বাকি ২১ লক্ষ।[6]
কিন্তু শিক্ষা কর চালু করে জনশিক্ষা প্রসারের পরিবর্তে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের বেশিরভাগ ইংরেজি শিক্ষায় ব্যয় করার মডেলটির সমর্থনে কলকাতার টাউন হলে ১৮৭০ সালের ২ জুলাই আয়োজিত সভায় রাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের গলায় যেন মেকলের সুর:
“এদেশীয়রা সুশিক্ষিত হইলে শাসনকার্যে ব্যয় অল্প হইবে। যে টাকায় এদেশীয় কর্মচারীগণ কাজ করেন, সেই প্রকার গুণবিশিষ্ট ইউরোপীয় কর্মচারী আনিতে অনেক ব্যয় পড়িবে”।[7]
এর বিপরীত অবস্থান নিয়ে অ্যাডাম বললেন- To make the superstructure lofty and firm, the foundation should be broad and deep; and, thus building from foundation, all classes of institutions and every grade of instruction may be combined with harmonious and salutary effect.[8]
এতদসত্ত্বেও ভারতবর্ষের বড়লাট এবং বাংলার ছোটলাটেরা কেউই আগের নীতি (মেকলে মডেল) থেকে সরে আসেননি। কিন্তু ব্যতিক্রমী হলেন বড়লাট লর্ড মেয়ো (১৮৬৯-৭২) এবং ছোটলাট জর্জ ক্যাম্পবেল। বন্ধুর কাছে লেখা একটি চিঠিতে মেয়ো স্পষ্ট বললেন,
“আমি এই ‘ফিল্ট্রেশন’ নীতি অপছন্দ করি। বাংলায় আমরা বিপুল সরকারি খরচে অল্পসংখ্যক বাবুকে ইংরেজি শিক্ষা দিচ্ছি। এদের অনেকেই নিজের খরচে এই শিক্ষা নিতে পারে। এরা সরকারি চাকরির যোগ্য হওয়ার জন্য বিবেচিত হওয়া ছাড়া আর অন্য কিছুর জন্য এই শিক্ষা নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে অগণিত জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আমরা কিছুই করিনি। বাবুরা কখনই এটা করবে না। যতই এদের শিক্ষা দাও, এরা ততই তা নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ রাখবে এবং অতিরিক্ত শিক্ষাকে এরা অত্যাচারের কাজে লাগাবে। বাবুরা যেভাবে খুশি ইংরেজি শিখুক। আমরা গ্রামবাংলায় লেখা, পড়া আর অংক শেখার কিছু ব্যবস্থাই না হয় করি।[9]
এরপর ১৮৭০ সালে ক্যাম্পবেল বাংলার ছোটলাট হলে মেয়ো-ক্যাম্পবেল যুগলবন্দিতে বাংলার শিক্ষানীতিতে বিপুল পরিবর্তন হয়। লেখক জানাচ্ছেন-
“জনশিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি কম খরচে বহু সংখ্যক প্রাথমিক স্কুল খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সরকারি টাকা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করার নীতি সাব্যস্ত করেন। তাঁর অনুসৃত নীতিতে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র চার বছরের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যায়”।[10] এটা কি সত্যিই ঘটেছিল, নাকি লেখক কিছু আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃজন করছেন?
হান্টারের রিপোর্ট[11] থেকে একঝলক দেখা যাক।
“In 1870-71 the Department of Public Instruction was educating 163,854 children in Lower Bengal at a cost of 186,598 pound to the State. In 1874, when Sir George Campbell la id down the Lieutenant Governorship, he left 400, 721 children being educated at a cost to Government of 228, 151 pound. He had, in the interval, covered Bengal with primary schools; pieced together and resuscitated the old indigenous mechanism of rural instruction, and, without in any essential feature curtailing high-class education, created a bona fide system of public instruction for the people of the country”.
লেখক বলছেন যে ক্যাম্পবেলের এবম্বিধ কাজকম্মে বাংলার ভদ্রজনের তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ্যে ফেটে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শহরে শহরে ক্যাম্পবেলের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয় যে ক্যাম্পবেল বাংলা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। অল্প আগে বড়লাট লর্ড মেয়ো আন্দামানে বন্দিদের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। ফলে ‘আবারও শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ সরকারি অর্থের অধিকাংশ উচ্চবর্ণের জন্য নির্দিষ্ট উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যেতে থাকে।[12] বাংলায় সরকারি শিক্ষানীতি নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও উত্তেজনা শুরু হয়।
এই বিতর্কে বঙ্কিমচন্দ্র[13] ক্যাম্পবেলের পদক্ষেপের সমর্থনে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় লেখেন-
‘ইহা স্মরণ করিতে হইবে যে, সকল মনুষ্যেরই শিক্ষায় সমান অধিকার। শিক্ষায় ধনীপুত্রের যে অধিকার, কৃষকপুত্রের সেই অধিকার। রাজকোষ হইতে ধনীদের শিক্ষার জন্য অধিক অর্থব্যয় হউক , নির্ধনদিগের শিক্ষায় অল্প ব্যয় হউক, ইহা ন্যায়বিগর্হিত কথা। বরং নির্ধনদিগের শিক্ষায় অধিক ব্যয়, এবং ধনীদিগের শিক্ষার্থ অল্প ব্যয়ই ন্যায়সংগত; কেন না ধনীগণ আপন ব্যয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইতে পারে, কিন্তু নির্ধনগণ, সংখ্যায় অধিক, এবং রাজকোষ ভিন্ন অনন্যগতি। কিন্তু ভারতবর্ষীয় বৃটিশ গভর্নমেন্ট পূর্বাপর শিক্ষার্থে যে প্রণালীতে ব্যয় করিয়া আসিয়াছেন, তাহা ন্যায়ানুমোদিত নহে। ধনীর শিক্ষার্থ সে ব্যয় হইয়া আসিতেছে, দরিদ্রের শিক্ষার্থ প্রায় নহে।-------------
যদি উচ্চশিক্ষার ব্যয় হইতে কিছু টাকা লইয়া তাহা দরিদ্রশিক্ষায় ব্যয় করিবার জন্য সর্ জর্জ কাম্বেল উচ্চশিক্ষার ব্যয় কমাইয়া থাকেন, তবে আমরা তাঁহার নিন্দা করিতে পারি না”।
৮.২ শিক্ষাভাবনার এই দুই মেরুর মধ্যে বিদ্যাসাগরের অবস্থানটি কী?
লেখক জানাচ্ছেন যে জনসাধারণের জন্য অল্প খরচায় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা এবং সাধারণভাবে মাতৃভাষা শিক্ষার বিস্তার ও উন্নতিসাধনের উপায় হিসাবে এই হলকাবন্দি প্রণালী বাংলায় কতদূর কার্যকর হতে পারে সে বিষয়ে বাংলার ছোটলাট বিদ্যাসাগর আরও ক’জন ইউরোপিয় ও ভারতীয় শিক্ষাবিদের মতামত জানতে চেয়ে ১৮৫৯ সালের ১৭ জুন একটি সার্কুলার লেটার জারি করেন। তার উত্তরে বিদ্যাসাগর ১৮৫৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জুনিয়র সেক্রেটারি টমসনকে দীর্ঘ পাঁচটি অনুচ্ছেদের চিঠিতে লেখেন-
“সরকার যে ভেবেছেন বিদ্যালয় পিছু মাসিক পাঁচ-সাত টাকা মাত্র ব্যয় করে কোনও শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন করবেন, আমার মতে দেশের বর্তমান অবস্থায় তা কার্যকর হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। লেখা-পড়া-অংক শেখানোর মত যোগ্য লোক, যাঁদের নিজ নিজ গ্রামের প্রতি যত আকর্ষণই থাক, এমন যৎসামান্য বেতনে তাঁদের পাওয়া যাবে না”। অথচ পাঁচ বছর আগে হলকাবন্দি বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন ছিল, ১৫ টাকা, আদৌ পাঁচ-সাত টাকা নয়।[14]
“ I have no precise information about the systems pursued in the Hulkabandee Schools in the North -Western Provinces”.[15]
শেষ অনুচ্ছেদে লেখেন-
“আমার বিনীত মতে, একমাত্র কার্যকর উপায় নাহলেও বাংলায় শিক্ষাবিস্তারের শ্রেষ্ঠ উপায়, উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে বিস্তৃত মাত্রায় শিক্ষা দেওয়ার মধ্যেই সরকারের নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। একশো জন ছেলেকে শুধু পড়তে, লিখতে ও কিছু অঙ্ক শেখানোর চেয়ে একটিমাত্র ছেলেকে যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে, সরকার প্রকৃত জনশিক্ষার অভিমুখে অধিকতর সহায়তা করবেন”।
লেখক বইটির অষ্টম অধ্যায়ে দেখিয়েছেন যে হলকাবন্দি বিদ্যালয়ে ওই রিডিং-রাইটিং-অ্যারিথমেটিক ছাড়াও ভূগোল, ইতিহাস, জ্যামিতি ইত্যাদি পড়ানো হত, এবং মাতৃভাষায়।[16]
দেখা যাচ্ছে যে হলকাবন্দি বিদ্যালয়গুলোর সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের সম্যক ধারণা ছিল না, তা শিক্ষকদের মাইনে সংক্রান্তই হোক, বা কারিকুলামই হোক। অবশ্যই ওই মডেলের ভিত্তি হল দেশজ পাঠশালাগুলি। কিন্তু বিদ্যাসাগর নিজে গ্রামীণ দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছিলেন এবং পাঠশালার ছাত্র ছিলেন। অথচ কেমন এক নাক সিঁটকানো মনোভাব দেখিয়ে তিনি লেখেন-
‘কিন্তু আমি বলতে বাধ্য, এইধরণের শিক্ষা নিতান্ত তুচ্ছ হবে এবং তা কখনও জনসাধারণের কাছে -যদি জনসাধারণ বলতে শ্রমিক শ্রেণিকে বোঝানো হয়—পোঁছবে না। কারণ এখনও পর্য্যন্ত বিহারে ও বাংলায় এই শ্রেণি থেকে পাঠশালায় খুব কম ছাত্র আসে’।
কারণ?
“শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা সাধারণত এতটাই নিচু স্তরে যে, সন্তানদের শিক্ষার জন্য খরচ করা তাঁদের সাধ্যে কুলায় না।”
তাহলে কী করা উচিত?
বিদ্যাসাগরের মতে “এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণিগুলির শিক্ষার চেষ্টা নিষ্প্রয়োজন। সরকার যদি জনশিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবে, তাহলে সরকারকে অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”[17] তিনি এও বলেন যে এর আগে এ’ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি।
সমস্যা হত না যদি এই বিদ্যাসাগরের এই মন্তব্যটি বস্তুনিষ্ঠ হত। কিন্তু অ্যাডামের তৃতীয় রিপোর্ট থেকে বিদ্যাসাগর জানতেন যে, পাঠশালার অধিকাংশ ছাত্রই ছিল দরিদ্র নিম্নশ্রেণির পরিবারের সন্তানসন্ততি। যেখানে সরকার এই সন্তানদের শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসতে আগ্রহী, সেখানে তাঁর এই মন্তব্য আমাদের হতাশ করে বইকি![18]
৮.৩ জনশিক্ষাঃ বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ
আমরা দেখলাম, জনশিক্ষার বিষয়ে বঙ্কিম ও বিদ্যাসাগর দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। প্রথম জনের মতে আইন এবং রাষ্ট্রের চোখে ধনী-দরিদ্র, কৃষক-জমিদার সবাই সমান। কাজেই রাষ্ট্রের থেকে শিক্ষা পাওয়ার অধিকার দুই বর্গেরই সমান। আবার দুর্বল অথচ জনসংখ্যার যারা বহুসংখ্যক তাদের জন্যে রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যয় বেশি হওয়া উচিত, কারণ তাঁরা ‘অনন্যোপায়’। তাই রাষ্ট্রের বা ছোটলাট ক্যাম্পবেলের উদ্যোগে সরকারী খরচে প্রাইমারি স্কুলের বেড়াজাল গড়ে তোলা তাঁর মতে ন্যায়, আগে যা হয়ে এসেছে সেটা অন্যায়।
বিদ্যাসাগর আবার আর্থিক কারণে সন্তানের স্কুলে পড়াশোনা বেশিদূর চালিয়ে না যেতে পারা খেটে খাওয়া পরিবারের পেছনে খরচা না করে অধিক ব্যয়ে উচ্চবর্গীয় সক্ষম পরিবারের সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষার পেছনে সরকারের অধিক ব্যয়ের মেকলে মডেলের পক্ষপাতী। এ ব্যাপারে কয়েক দশক পরের ছাত্র, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ও নর্মাল স্কুলে পড়া রবীন্দ্রনাথের কী উপলব্ধি?
এটা বলছি এই জন্যে যে আজকাল আমরা কোন প্রজেক্ট ক্রিয়ান্বয়ন করার পর অল্পকালীন ভ্যালুয়েশনে টার্গেট অ্যাচিভমেন্ট বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু তার দীর্ঘকালীন তুল্যমূল্য বিচার বা সমীক্ষার সময় জোর দিই আউটকাম ও ইম্প্যাক্টের উপর। কাজেই ওই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। আরও বড় কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজে একজন শিক্ষাবিদ, হাতেকলমে বিকল্প মডেলের প্রয়োগ করেছেন।
লেখক বোধহয় পাঠকের আগ্রহ এবং সম্ভাব্য আপত্তিটি আগে থেকে আন্দাজ করে সেই কাজটিও করে দিয়েছেন।
মেকলের উচ্চবর্গীয় মডেল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন-
শিক্ষার অভিসেচনক্রিয়া সমাজের উপরের স্তরকেই দুই-এক ইঞ্চি মাত্র ভিজিয়ে দেবে আর নীচের স্তরপরম্পরা নিত্যনীরস কাঠিন্যে সুদূরপ্রসারিত মরুময়তাকে ক্ষীণ আবরণে ঢাকা দিয়ে রাখবে, এমন চিত্তঘাতী সুগভীর মূর্খতাকে কোন সভ্যসমাজ অলসভাবে মেনে নেয় নি। ভারতবর্ষকে মানতে বাধ্য করেছে আমাদের যে নির্মমভাগ্য তাকে শতবার ধিক্কার দিই।[19]
আবার মেকলে প্রবর্তিত ও বিদ্যাসাগর সমর্থিত শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবি পরিবারের সন্তানদের আলাদা ধরনের স্কুলের মডেলের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন-
চাষা একটু সম্পন্ন অবস্থার হইলেই ভদ্রসমাজের সীমানার দিকে অগ্রসর হইয়া বসিতে তাহার স্বভাবতই ইচ্ছা হয়। এমন-কি, তাহার ছেলে একদিন হাল-লাঙল ছাড়িয়া দিয়া বাবুর চালে চলিবে এ সাধও তাহার মনে উদয় হইতে থাকে। এইজন্য সময় নষ্ট করিয়াও, নিজের ক্ষতি করিয়াও ছেলেকে সে পাঠশালায় পাঠায় অথবা নিজের আঙিনায় পাঠশালার পত্তন করে।
কিন্তু চাষাকে যদি বলা হয়, তোর ছেলেকে তুই চাষার পাঠশালায় পাঠাইবি, ভদ্রের পাঠশালায় নয়, তবে তাহার উৎসাহের কারণ কিছুই থাকিবে না। এরূপ স্থলে ছেলেকে পাঠশালায় পাঠাইবার উদ্দেশ্যই তাহার পক্ষে ব্যর্থ হইবে।
শুধু তাই নয়। পল্লীর মধ্যে চাষার পাঠশালাটা চাষার পক্ষে একটা লজ্জার বিষয় হইয়া দাঁড়াইবে। কালক্রমে ভাগ্যক্রমে যে-চাষাত্ব হইতে তাহারা উপরে উঠিবার আশা রাখে, সেইটাকে বিধিমত উপায়ে স্থায়ী করিবার আয়োজনে, আর যেই হউক, চাষা খুশি হইবে না।[20]
৮.৪ লেখকের পূর্বপক্ষ:
১ বিদ্যাসাগর স্বীকার করছেন উনি হলকাবন্দি বিদ্যালয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা মডেলটির ব্যাপারে বিশদ জানেন না। ওই মডেলের কোর্স ও শিক্ষকদের মাইনে নিয়েও তাঁর ধারণা বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মেলে না।
২ ব্যাপক জনসাধারণের জন্যে শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়াতে সরকার এগিয়ে এলেও উনি বিরোধিতা করছেন, ভয় দেখাচ্ছেন—পুরো অবৈতনিক করতে হবে, অর্থাৎ পুরো ব্যয়ভার সরকারের ঘাড়ে চাপবে। এড়িয়ে যাচ্ছেন হলকাবন্দি মডেলের মত জমিদারদের খাজনার উপর ১% শিক্ষা কর চাপিয়ে খরচ জোগাড়ের ব্যাপারটা।
৩ এর কারণ জনশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের কুলীন মনোভাব। যা ফুটে উঠেছে ওঁর এই বক্তব্যে,
“একশো জন ছেলেকে শুধু পড়তে, লিখতে ও কিছু অঙ্ক শেখানোর চেয়ে একটিমাত্র ছেলেকে যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে, সরকার প্রকৃত জনশিক্ষার অভিমুখে অধিকতর সহায়তা করবেন”। এ’ব্যাপারে সমসাময়িক বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্য দেখা যেতে পারে।
আমার উত্তরপক্ষ:
অত্যন্ত খেদের সঙ্গে মানতে হচ্ছে যে জনশিক্ষার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের ভাবমূর্তিটি বর্ণপরিচয়, সীতার বনবাস, উপক্রমণিকা বা কৌমুদী রচনা ও মেট্রোপলিটান স্কুল পরিচালনার একমাত্রিক ছবি দিয়ে তৈরি। আমরা খেয়াল করিনি যে সে সময় দ্বিস্তরীয় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। এবং আমাদের আশার বিপরীত, বিদ্যাসাগর আসলে জনশিক্ষার নয় উচ্চবর্গীয় কুলীন শিক্ষার পক্ষধর। এছাড়া উনি শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়কে চাষাভুষো-শ্রমিকদের বাচ্চার পেছনে নষ্ট না করে একমুঠো উচ্চবর্গীয় পরিবারের সন্তানদের পড়াশুনোর পেছনে খরচা করার পক্ষপাতী। উত্তর ভারতে জমিদাররা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থাকে মজবুত ও উন্নত করার জন্যে ১% শিক্ষা কর দিয়ে যাচ্ছেন, বাংলার জমিদার ও ভদ্রজনেরা খড়গহস্ত।
এই বিন্দুতে বিদ্যাসাগর উচ্চবর্গের স্থবির চিন্তাধারার পাশে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য আমার মনের শেষ সন্দেহের কফিনের উপর পেরেক পুঁতে দিয়েছে। লেখকের সঙ্গে দ্বিমত হবার কোন অবকাশ নেই।
অর্থাৎ, বিদ্যাসাগর বঙ্গে জনশিক্ষার নায়ক নন। তবে কারা?
৮.৫ জনশিক্ষার জননায়কেরা
লেখকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই সম্মানের হকদার আরও অনেক অনামাদের মধ্যে পশ্চিম ভারতের জ্যোতিবা ফুলে ও সাবিত্রী বাঈ ফুলে ( দলিত ও স্ত্রীশিক্ষার বিদ্যালয়), এবং পূর্ব ভারতে অন্ত্যজ হিন্দুদের মতুয়া ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর ( ১৮৪৬-১৯৩৭)। আমার মতে এর পরে আসবেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২), বা বেগম রোকেয়া।
সাবিত্রী বাঈ ফুলের কথা অন্য পর্বে আমরা আলোচনা করেছি, বেগম রোকেয়ার স্কুলের কথা কোলকাতায় অপরিচিত নয়। কিন্তু দেবোত্তমের আলোচ্য বইয়ের প্রথম ভাগের শেষ অধ্যায়ে (১১শ অধ্যায়) করা বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে নিজস্ব উদ্যোগে দলিত নমঃশূদ্র সমাজের জন্য সংগঠিত শিক্ষা আন্দোলনের কথা জানতে পেরেছি, এর জন্যে লেখককে ধন্যবাদ।
লেখকের ভাষায়
এই বিপুল সংখ্যক ‘চণ্ডাল’দের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র ভূমিহীন কৃষিজীবী। উচ্চবর্ণের জমিদার ও মহাজনরা এই নিরক্ষর কৃষকদের খাজনা, ঋণ এবং দৈনন্দিন ব্যবসার বিষয়ে প্রতারণা করতেন। গুরুচাঁদ উপলব্ধি করেন, এই নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নমঃশূদ্র সমাজের আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য শিক্ষাবিস্তারই একমাত্র উপায়।[21]
আমার কেমন পড়ছে বাবাসাহেব আম্বেদকরের কথা। পশ্চিম ও উত্তর ভারতে উনিও দলিতদের মুক্তির জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন- শিক্ষিত হও, সংগঠিত হও, সংঘর্ষ করো।
১৮৮০ সালে ওড়াকান্দি গ্রামে নিজের বাড়িতে গুরুচাঁদ প্রথম পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর গুরুচাঁদের সভাপতিত্বে খুলনার দত্তডাঙায় নিখিল বঙ্গ নমঃশূদ্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় মূলত দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের জন্য একের পর এক পাঠশালা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, এবং নিম্ন ও উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।
১৯০২ সালে গ্রামে সবার ঘর থেকে মুষ্টিভিক্ষা বা এক মুঠো চাল রোজ সংগ্রহ করে মাসের শেষে বিক্রি করে সেই টাকায় স্কুলবাড়ি তৈরি, আসবাবপত্র, শিক্ষকদের বেতন, গরীব ছেলেদের বইখাতা কেনায় সাহায্য এসব হত।
১৯০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনারি মিড সাহেবের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ওড়াকান্দির পাঠশালাটি মিডল ইংলিশ স্কুলে পরিণত হয়। [22]
গবেষক অতুল চন্দ্র প্রধান জানাচ্ছেন, ‘১৯৩১ সাল পর্য্যন্ত গুরুচাঁদ অন্ত্যজ শ্রেণীর সন্তানদের জন্য প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে ৫৬৯টি, বর্ধমান ডিভিশনে আদিবাসীদের জন্য ২৪৬টি এবং ঢাকা ডিভিশনে ১০৬৭টি পাঠশালা, নিম্ন প্রাইমারি, উচ্চ প্রাইমারি, মিডল স্কুল, এবং হাইস্কুল মিলিয়ে মোট ১৮৮২টি স্কুল স্থাপন করেন।[23]
৮.৬ বিদ্যাসাগরের শেষ বড় কাজ-মেট্রোপলিটান ইন্সটিট্যুশন
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘সংস্কৃত কলেজের কাজ ছাড়িয়া দিবার পর বিদ্যাসাগরের প্রধানকীর্তি মেট্রোপলিটান ইন্সটিট্যুশন’।[24]
লেখকের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ -রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের স্মৃতি নিয়ে প্রশস্তিমূলক যে প্রবন্ধ লিখেছেন তার ওই একটা লাইন নিয়ে আমরা উলুত পুলুত থাকি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের শিক্ষার মডেলের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ মন্তব্য ও বিকল্প জনমুখী শিক্ষার জন্যে যুক্তিগুলো দেখেও দেখি না।
বেশ, আমরা লেখককে অনুসরণ করে দেখি মেট্রোপলিটান ইস্নটিট্যুশনের গড়ে ওঠার গতিপথটি।
কিছু ভদ্রজনের চেষ্টায় ১৮৫৯ সালে স্থাপিত হয় ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’। উদ্দেশ্য বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু ছেলেরা যাতে অল্প খরচে ইংরেজি শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে। তারপর বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নতুন পরিচালন সমিতিতে নিয়ে নেওয়া হয়। ১৮৬৪ সালে স্কুলটির নাম হয় ‘হিন্দু মেট্রোপলিটান ইন্সটিট্যুশন’। বিদ্যাসাগর সমিতির সম্পাদক। ১৮৬৮ সালে স্কুলের দায়িত্ব মূলত বিদ্যাসাগরের একার উপরে পড়ে।
১৮৬৪ সালে বিএ পড়ানোর অনুমতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যাখ্যান করে। ১৮৬৮ সালে তিনি সিন্ডিকেটের কাছে এফ এ (ফার্স্ট আর্টস) পড়ানোর অনুমতি চেয়ে কারণ হিসেবে বলেন - প্রেসিডেন্সির ফি অনেক বেশি এবং হিন্দু পরিবারের অভিভাবকেরা সন্তানদের মিশনারি স্কুলে পড়াতে চান না। তাই স্বল্প ফি নেওয়া মেট্রোপলিটান ইন্সটিট্যুশনকে পড়ানোর অনুমতি না দিলে ছেলেগুলোর পড়াশুনো বন্ধ হয়ে যাবে। আবেদন পত্রে ‘হিন্দু’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দিল। ১৮৮১ সালে বিএ, পরের বছর ল’ শুরু হয়। ‘এবং ১৮৮৩, ১৮৮৫ ও ১৮৮৬ সালের পরীক্ষায় মেট্রোপলিটানের ছাত্ররাই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়।
লেখকের পূর্বপক্ষ:
নাগরিকদের একটা ছোট অংশের (মধ্যবিত্ত হিন্দু ভদ্রলোক) জন্য একটু কম পয়সায় ভাল কলেজ গড়লেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু এই পড়ার কোয়ালিটি কী? বিদ্যাসাগর নিজে বলছেন:
“তাহাদের কলের মধ্যে ফেলিয়া চাবি ঘুরাইয়া দিই। কিছুকাল পরে কলে তৈয়ারি হইয়া তাহারা কেহ সেকেন ক্লাস দিয়া, কেহ এন্ট্রান্স হইয়া, কেহ এল এ হইয়া, কেহ বিএ হইয়া, কেহ বা এম এ হইয়া বেরোয়। কিন্তু সবাই লেখে I has; একপাকের তৈরি কি না” ![25]
হিন্দু কলেজের ছাত্র রাজনারায়ণ বসু লিখেছিলেন, ‘এক হিসাবে বর্তমান ইংরাজী শিক্ষার প্রণালী মানুষ মারিবার কল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না’।[26]
বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের নিম্ন মন্তব্যে বোঝা যায় যে এই শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কত অসার, কত ফোঁপরা- Nothing could more clearly show that it was not education at large, but English education, and specially English education preparatory to the university course, which aroused the enthusiasm of Bengal.[27]
উপরোক্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে লেখকের অভিযোগ- “কিন্তু হায়, সারাটা জীবন এই অর্থহীন ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার হয়েই সওয়াল করেন বিদ্যাসাগর। আর জনশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, প্রান্তজনের শিক্ষা, প্রকৃত শিক্ষা ক্রমে দূরে, আরও দূরে সরে সরে যেতে থাকে”।[28]
আমার উত্তরপক্ষ:
নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগর জনশিক্ষার নায়ক নন, সেটা তাঁর মিশন এমন দাবি তিনি জীবৎকালে কখনও করেননি।
তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা থেকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অন্ত্যজ নমঃশূদ্র মুসলমানদের জন্যে দ্বার বন্ধই রেখেছেন, খোলার কোন উৎসাহ দেখাননি। সে সংস্কৃত কলেজই হোক বা মেট্রোপলিটান ইন্সটিট্যুশন। এখানে আমি ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা বলতে আদৌ ব্রাহ্মণ জাতের কথা বলছি না। জনশিক্ষার পক্ষধর বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথও তো জাতিপরিচয়ে ব্রাহ্মণ। আমি বলতে চাইছি এক আধিপত্যবাদী (হেজেমনিস্টিক) মানসিকতার কথা যা সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায়।
কিন্তু আপামর জনসাধারণের পক্ষধর জনশিক্ষার নায়ক বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিম এমনকি রবীন্দ্রনাথই বা কেন হবেন? যদিও রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকা চিন্তানায়ক এবং একই সঙ্গে নিজের সীমাবদ্ধতার বিষয়ে সচেতন।
“মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে”।[29]
তাই জনশিক্ষার নায়ক উঠে আসে দলিত ও মুসলমান বঞ্চিতদের মধ্যে থেকেই, ফুলে দম্পতি বা আম্বেদকর বা বেগম রোকেয়া হয়ে।
কিন্তু বিদ্যাসাগর ও রাজনারায়ণ বসুর রেটোরিক ও মেটাফরের খোসা ছাড়িয়ে বক্তব্যের যে অন্তর্বস্তু তা কি আজকের স্বাধীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সম্বন্ধেও সমান ভাবে প্রযোজ্য নয়?
তাহলে দেড়শ বছর সময় পিছিয়ে সেই নতুন গড়ে উঠতে থাকা নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে খালি ‘অর্থহীন ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা’ বলে গাল দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত? বিকল্প ‘অর্থবহ জনগণের শিক্ষাব্যবস্থা’ আজও গড়ে উঠেছে কি?
খেয়াল করুন, ফুলেদের বা গুরুচাঁদ ঠাকুরদের সমস্ত প্রচেষ্টা সরকারি আনুকূল্য ছাড়া কমিউনিটি মবিলাইজেশনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। সেটা তাঁদের জন্য জীবনব্রত ছিল।
কিন্তু বিদ্যাসাগরের সমস্ত প্রচেষ্টা কোম্পানি বা মহারানির সরকারের আমলা হিসেবে। সেই দিক দিয়ে দেখলে তাঁর মেট্রোপলিটান ইন্সটিট্যুশনের ছাত্ররা যদি প্রেসিডেন্সিকে টপকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পর পর মেরিটে আসে আমার কাছে তার গৌরব মোহনবাগানের ১৯১১ সালে গোরাদের টিমকে খালি পায়ে খেলে হারিয়ে দেবার মত।
আমার মতে জনশিক্ষার অধ্যায়ে লেখকের বিশ্লেষণ বস্তুনিষ্ঠ, সমস্যা হচ্ছে বিদ্যাসাগর বিপ্লবী নন, অথচ তাঁর থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব আশা করায়।
শেষে বাঙালের দুটো কথা-
আমার মতে জনশিক্ষার অধ্যায়ে লেখকের বিশ্লেষণ বস্তুনিষ্ঠ, সমস্যা হচ্ছে বিদ্যাসাগর বিপ্লবী নন, অথচ তাঁর থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব আশা করায়।
এযেন ময়মনসিংহের বিয়ের গান-
‘ও জামাই, জামাই রে, তুই ক্যান রে ভাতার হইলি না’?
লেখক খেয়াল করুন, তাঁর মূল প্রতিপাদ্য থেকে তিনি সরে এসেছেন। বিদ্যাসাগরের পালটা যে জনশিক্ষার মডেলের (টোমাসনের হলকাবন্দি) তিনি পক্ষধর তাও এসেছে টোমাসন, অ্যাডাম, পাদ্রি লং, বড়লাট মেয়ো বা ছোটলাট ক্যাম্পবেলের হাত ধরে, যাঁরা খোদ বৃটিশ কলোনির আমলা। কাজেই শিক্ষার ক্ষেত্রে ক্রমশ ঔপনিবেশিক শিক্ষার মোসাহেবি ও জনশিক্ষার পক্ষপাতীদের মধ্যের সরল সাদা-কালো বিভাজন মুছে যাচ্ছে না কি?
(চলবে)
পড়লাম পুরো আলোচনাটা।
এই শেষে ময়মনসিঙের গানটা এখানে দেবার কোন দরকার ছিল বলে মনে হয় নি।
মূল আলোচনাটায় চারটে সংশোধন করে নিলে ভালো হয়।
১. লালবিহারী দে দলিত বা মু্সলমান - কিছুই ছিলেন না। তবুও তিনি জনশিক্ষার পক্ষে ছিলেন।
২. ঔপনিবেশিক শিক্ষার দায়ভার আজ অবধি ঝেড়ে ফেলা যায়নি বলে অধ্যায়টির শেষ দুটি বাক্য এইরকম --- ফলে শিক্ষা আর বাহন হবে না আমাদের, তাকে বহন করে চলেই খুঁজে বেড়াব জীবনের সার্থকতা। একই সঙ্গে একরাশ হতাশার বিপজ্জনক চোরাবালিতে আমরা নিমজ্জিত হতে থাকব ক্রমশ, যেখান থেকে পরিত্রাণের উপায় আমাদের ইহজীবনে জুটবে না।
৩. অ্যাডাম ও লং সরকারি আমলা ছিলেন না।
৪. গুরুচাঁদ ঠাকুর যথেষ্ট সরকারি আনুকুল্য পেয়েছিলেন। বইতে তার সবিস্তার উল্লেখ আছে।
দ,
সমালোচনা যথাযথ। ওই গানটা দেওয়া ছ্যাবলামি হয়ে লেখাটার ওজন অনেক কমিয়ে দিয়েছে , যা অনভিপ্রেত। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকব।
এলেবেলে এবং যাঁরা এই সিরিজটি পড়ছেনঃ
প্লীজ, প্রথম পর্বের শেষে পাঠক ফীডব্যাকের জায়গাটায় দেখুন আমি 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে'র প্রশ্নে যে যে বিন্দুতে আমি ভুল ছিলাম, এবং লেখক দেবোত্তম ঠিক ছিলেন তা অকুন্ঠ চিত্তে স্বীকার করে ব্যাখ্যা করেছি। আমার নিজের অবস্থানের বিষয়ে সন্দেহ উৎপন্ন হওয়ায় একজন ইতিহাসের অধ্যাপকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর ওই পরিবর্তন। সেই সঙ্গে যে বিন্দুতে আমি এখনও নিজের অবস্থান বদলানোর প্রয়োজন দেখছি না, সেটাও জানিয়েছি।
এলেবেলে,
প্রস্তাবিত 'সংশোধন' বিষয়ে আমার বক্তব্যঃ
১ " লালবিহারী দে দলিত বা মু্সলমান - কিছুই ছিলেন না। তবুও তিনি জনশিক্ষার পক্ষে ছিলেন"।
--নিঃসন্দেহে, আমিও লেখকের থেকে কোট করেছি। সেতো বঙ্কিমচন্দ্রও। কিন্তু 'পক্ষে' থাকা এক কথা, আর 'জনশিক্ষার নায়ক' হওয়া অন্য কথা।
আপনি এই বিষয়ে তৃতীয় পর্বের একেবারে শেষ অধ্যায়ে বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গের আলোচনায় তার অজস্র উদাহরণ পাবেন। কারণ তখন তাঁকে ঔপনিবেশিক শাসকদের ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়েছিল। বানিয়ার জাত লেনা আর দেনা ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না।
@রঞ্জন,
পাঠ-্প্রতিক্রিয়া, ১-৬ পড়লাম।
দেখুন, মূল লেখাটার প্রধান সমালোচনা হল, এই পাতায় বা অন্যত্র, এই যে লেখক প্রথমেই ধরে নিয়েছেন যে বিদ্যাসাগর হীরো নন, এবং সেইটা ধরে নিয়ে সেইভাবেই পুরো লেখায় উনার যুক্তি সাজিয়েছেন।
[আমার মত নয়, বিভিন্ন আলোচনা/সমালোচনা পড়ে যা মনে হল, সেটাই সরল করে লিখলাম]
তো আপনার পর্ব ১-৬, বিশেষ করে পর্ব ৬, পড়ে কারুর মনে হতেই পারে যে, যেন আপনিও প্রথমেই একটা উত্তরপক্ষ সাজিয়ে নিয়েছেন, আর তার ওপর (প্রমানসাপেক্ষে) যুক্তিগুলো প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় আছেন। যদিও অধ্যায় ৮.৬ঃ পূর্বপক্ষ আর উত্তরপক্ষের মধ্যে খুব তফাত দেখতে পেলাম না।
লেখাটার শুরুর অধ্যায়্গুলোতে, মানে যেটা গুরুতে বেরিয়েছিল তার ভিত্তিতে বলছি, ভাষা সংক্রান্ত একটা আলোচনা ছিলো। প্রাক গৌড়ীয় বা প্রাক হ্যালহেড-কালে বাঙ্গালা ভাষার একটা রূপ ছিলো। সেটা কিভাবে হ্যালহেড-জোনস-্কেরী-রামমোহন-বিদ্যাসাগর-্ডেভিড হয়ার প্রমুখের তত্ত্বাবধানে সম্পূর্ণভাবে বদলে গেল, ভাষার সংকৃতায়ন এবং পরে ইঙ্গকরন হল, সে বিষয়ে আলোকপাত করলে খুব ভালো হয়।
পরিশেষে বলি, আপনি যে নিষ্ঠা আর উদ্যম নিয়ে এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে চলেছেন, তা সত্যি প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়, এই দীর্ঘ পাঠ-প্রতিক্রিয়ার শেষে আমরা কি পাচ্ছি? শুধুই আলোচনা-সমালোচনা, পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষ, বিদ্যাসাগরের এক বাঙ্গালী হীরো হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্টা, না তার বাইরে আর কিছু?
ar,
আপনি ঠিক ধরেছেন। লেখক দেবোত্তম এবং পাঠক রঞ্জন -দুজনেরই একটি করে এজেন্ডা আছে, এবং সেগুলো গোপন নয়। এ'ব্যাপারে আমরা দুজনেই সম্যক অবহিত, এবং কেউই অ্যাপোলজেটিক নই।
লেখক দেবোত্তমের ও প্রকাশকদের এজেন্ডা বইটির প্রকাশকের ভূমিকায় স্পষ্ট করে বলা আছে, কোট করছি।
তিনজন ভিলেন। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও বিদ্যাসাগর।এদের অপরাধ?
"প্রথমে কোম্পানি, পরে রাণীর দক্ষিণ এশিয়াকে আরও বড় লুঠযোগ্য, আরও বড় সাম্রাজ্যভোগ্য করে যাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব প্রাথমিকভাবে এই তিন মহাতেজের। ------ সমান্তরাল্ভাবে এরা ইউরোপ গঠনে বাংলা লুঠে সাম্রাজ্য নির্দেশ পালন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে, সেই ইতিহাস রচনা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃত"। (বইটির পৃঃ ১৩)। এটা হোল এঁদের থিসিস। এঁদের উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও আমার আশংকা - এইভাবে আগে থেকে স্ট্র ম্যান খাড়া করে ইতিহাস চর্চা করলে তাতে একপেশেপনার সম্ভাবনা প্রবল। জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার ধারায় এই ঝোঁক আগে দেখা গেছে।
বিপরীতে আমার অ্যান্টি-থিসিস। যার মূল কথা হল ইতিহাস পুরুষদের বিচার হবে দু'ভাবে। এক, তাঁদের সমকালীন ভ্যালু সিস্টেমে ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে, এবং আজকের ভ্যালু সিস্টেমে তার কতটুকু গ্রহণযোগ্য। এবং দেবোত্তমের বিশাল তথ্যভান্ডার ও রেফারেন্সকে স্বীকার করেও এটা পরীক্ষা করা যে ওই ডেটা স্বীকার করেও কোন বিকল্প ব্যাখ্যা বা ন্যারেটিভ সম্ভব কিনা।
এবার আপনার প্রশ্নঃ শুধুই আলোচনা-সমালোচনা, পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষ, বিদ্যাসাগরের এক বাঙ্গালী হীরো হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্টা, না তার বাইরে আর কিছু?
আমার মতে ফল দ্বিবিধ। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত।
এক, আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। আর ঐ পিরিয়ড নিয়ে আমার জ্ঞান একেবারে ক্লাস এইটের পাঠ্যবইয়ে সীমিত বললেই হয়। কিন্তু আমি বিদ্যাসাগরের 'ভক্ত' ছিলাম, হ্যাঁ, অনেক তথ্য না জেনেই। দেবোত্তমের পরিশ্রম এবং বিশাল তথ্যকে এক জায়গায় জড়ো করা আমাকে বাধ্য করেছে ওই সময় নিয়ে কিছু পড়াশুনো করতে, ওঁর এবং অন্যদের পাঠানো বই ও পিডিএফ ডাউনলোড করে নাড়াচাড়া করতে। ইতিহাসের অধ্যাপকের সঙ্গে ক্রস চেক করতে।
এটা আমার ব্যক্তিগত লাভ। এছাড়া বিভিন্ন বাদ-প্রতিবাদ (ট্রোলিংকে ধরছিনা) আমাকে সুযোগ দিচ্ছে নিজের বিশ্বাসের ভিত কতটুকু পোক্ত তা ইতিহাসের আলোকে যাচাই করে নিতে। বহু জায়গায় লেখক সঠিক, সে আমার লালিত বিগ্রহে চোট লাগলেও--এটা সবগুলো কিস্তিতেই যথাযোগ্য স্থানে স্বীকার করেছি।
সমষ্টিগতঃ আমার আশা, আপনার মত অনেকেই আলোচনায় অংশ নেবেন, আমাদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার দিকে আঙুল তুলবেন, আর এসবের মধ্য থেকে গড়ে উঠবে এক কালেক্টিভ সিন্থেসিস। তাতে বিদ্যাসাগর নিশ্চিতভাবে আর দামোদর সাঁতরে পেরোনো রূপকথার হিরো থাকবেন না, কিন্তু ঘৃণ্য মোসাহেব বা চাটুকার ভিলেনও হবেন না। আমরা তাঁর মূল্যায়ন করব একটি নির্দিষ্ট আর্থ -সামাজিক পরিবেশে একটি কালখণ্ডের উপজ হিসেবে। কোন দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন অবতার হিসেবে নয়।
পরিশেষে আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে কেউ যদি এই পরিশ্রমী বইটিকে একটি আকর গ্রন্থের মর্য্যাদা দিয়ে নিজের বইয়ের সংগ্রহে রাখার আগ্রহ বোধ করেন তাহলে এই বুড়োর প্রয়াস সার্থক হবে।
ar
"---ভাষার সংকৃতায়ন এবং পরে ইঙ্গকরন হল, সে বিষয়ে আলোকপাত করলে খুব ভালো হয়"।
--নিশ্চয়ই। বলতে ভুলে গেছি এই প্রসঙ্গটি লেখকের বইয়ে তৃতীয় বা শেষ পর্বে রয়েছে। আমি পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় মূল বইয়ের ক্রম অনুসরণ করছি।
ইদানীং আমাকে এবং বইটির প্রকাশককে একাত্ম করে ন্যারেটিভ নির্মাণের ধারাটি চেগে উঠেছে। কাজেই প্রকাশকের বানাম্ভুলের দায়িত্ব এবং তার প্রুফ চেকিং-এর দায়িত্ব অযথা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি প্রকাশকের একটি চার পাতার বয়ানকে ৪৪০ পাতা ধরে ফেনিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটিও আমার নজর এড়ায়নি। যেমন আমাকে কেউ কেউ নকশালপন্থী হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে, কেউ উত্তর-ঔপনিবেশিক স্ট্যাম্পো মেরে পরম সন্তোষ লাভ করছেন। বলা বাহুল্য, এর প্রত্যেকটিই নিকৃষ্ট রকমের ব্যক্তিচর্চা ও জঘন্যতম হাইপোথিসিসের চাষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রঞ্জনবাবু সেই লুপে পড়ে পাক খেয়ে চলেছেন। সবিনয়ে তাঁকে জানিয়ে রাখি, ওই বয়ানটি পাণ্ডুলিপি পাঠানোর পরে বইতে সংযুক্ত হয়েছে।
আমি ঠিক করেই নিয়েছি এখানে আমি আর কোনও মন্তব্য করব না। রঞ্জনবাবুকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি বলে এই ধরণের অহেতুক ও অপ্রতিষ্ঠিত ফাঁদ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করছি। বাকিটা তাঁর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম।
এলেবেলে,
এটা কী বললেন? আমি 'প্রুফ চেকিং' বা 'বানান ভুল' নিয়ে কোন কথা বলিনি। আপনাকে কোন রাজনৈতিক ট্যাগে চিহ্নিত করিনি। উত্তর-ঔপনিবেশিক ইত্যাদি কিছুই নয়। আমি ইচ্ছে করেই আপনার বইয়ের প্রশংসাসূচক বাংলাদেশের রিভিউ বা ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক 'চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের' লেখাগুলো পড়িনি। এই পাতাতেই জানিয়েছি কারণ অন্যের চিন্তায় প্রভাবিত না হয়ে নিজের মুখে ঝাল খাব।
আপনি আমাকে লিখিত ভাবে আপনার প্রথম প্রকাশিত বইয়ের 'কাটাছেঁড়া' করার অনুমতি দিয়েছেন। সেই কারণে আমি বইটি কয়েকবার পড়েছি। ভূমিকায় ওই প্যারাটি এভাবেই নজরে এসেছে। এবং বইয়ের মধ্যে বিদ্যাসাগরের জন্য 'প্রভু' হ্যালহেডের 'ভৃত্য' বিদ্যাসাগর (পৃঃ ৪৭) এবং 'মোসাহেব' শব্দগুলো নজরে পড়েছে। এছাড়া প্রকাশক ওই লেখাতেই জানিয়েছেন " গবেষক দেবোত্তম কথা দিয়েছেন রামমোহন-দ্বারকানাথের সাম্রাজ্য-বন্ধুত্ব নিয়ে তাঁর খোঁজের কাজ শুরু হবে'। এটা আপনার বক্তব্যেও আমরা গুরুতে জেনেছি।
ওই প্রেক্ষিতে আমার চোখে এই বইটি প্রকাশকের ঘোষিত প্রোজেক্টের অঙ্গ ধরে নেওয়া কি অস্বাভাবিক? বা কোন ফাঁদে পা দেওয়া?
আপনি কি বলতে চাইছেন যে প্রকাশকের উপরোক্ত বক্তব্য ( যা আমি ar কে লেখা পোস্টে উদ্ধৃত করেছি) ঠিক আপনার বক্তব্য নয়? তাহলে ওটা নিয়ে আর কোথাও কিছু বলছিনা।
তবে আমি মনে করি কিছু পয়েন্টে মতদ্বৈধ সত্ত্বেও আপনার বইটি একটি কালেক্টর্স আইটেম। সে হিসেবেই যত্ন করে আমার বইয়ের আলমারিতে রাখব, লোককে পড়াব। আরে যদি কোন বই প্রভোক না করে, আমার মত আলসে লোককেও,ঊঠে বসে খুঁটিয়ে দেখতে না বলে, কেবল ঘুম-পাড়ানিয়া লোরি শোনায়-সে কীসের বই?,
এই প্রকাশকটিও এককালে গুরুতে লিখত। সেম এজেন্ডা নিয়ে। শাক্যজিৎ ঠিকই বলেছিল, আঁতেল চাড্ডি।
ওই করেই নিরঞ্জন ধর, আর রাজাগোপাল কালেক্টরস আইটেম হইয়াছেন। সোজা রাস্তা, সহজ পথ।
খাঁটি কথা বলেচেন। ইতিহাস চর্চায় পন্ডিত গাঁজাগোপালের পরেই আমাদের গাঁজাবেলেবাবু।
রঞ্জনবাবু, 'কেউ কেউ'-টা আর যারাই হোক, আপনি অন্তত নন। লেখাটাকে যথেচ্ছ কাটাছেঁড়া করুন, আপত্তি নেই। থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু দোহাই, প্রকাশকের বয়ানের দায়ভার আমার ওপর চাপাবেন না। আপনি যথেষ্ট বিনয় দেখিয়ে বলছেন বটে যে আপনি ইতিহাসের ছাত্র নন কিন্তু আপনার কাটাছেঁড়াটি আপনার প্রচুর পড়াশোনা, পরিশ্রম ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের সাক্ষী। এই লিঙ্ক সেভ করা আছে। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে (যার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও আছে) আপনাকে যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান করে কিছু অংশ অবশ্যই শুধরে নেওয়া হবে।
ইতিহাস অ্যাকাডেমিশিয়ানদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, তার ঘরানাও একমাত্রিক নয়। কাজেই আপনার ইতিহাসজ্ঞান ক্লাস এইটে শেষ হয়ে গেছে কি হয়নি, তাই দিয়ে কিস্যু বিচার করা যায় না। করা উচিত নয়। ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাটাছেঁড়া করেন তাঁদের প্রত্যেকের অ্যাজেন্ডা থাকে। নতুবা তিনি নতুন করে কলম ধরতে যাবেন কেন? এখন সাভারকর-আম্বেদকর বা মনুচর্চার ক্ষেত্রে আপনার যে অ্যাজেন্ডা, আমারও তাই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়তো আপনার ও আমার অ্যাজেন্ডার মধ্যে ফারাক থাকতে পারে। কিন্তু মোদ্দা কথা অ্যাজেন্ডা আছে এবং তার জন্য অ্যাপোলেজেটিক হওয়ার দরকার নেই। কাজেই আপনি এক প্রকাশকের বয়ান ছাড়া বাকি প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ে আপনার নিজস্ব অনুসন্ধান জারি রাখুন - এই অনুরোধ করি।
এলেবেলে
থ্যাংক্যু থ্যাংক্যু!
"--নিশ্চয়ই। বলতে ভুলে গেছি এই প্রসঙ্গটি লেখকের বইয়ে তৃতীয় বা শেষ পর্বে রয়েছে। আমি পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় মূল বইয়ের ক্রম অনুসরণ করছি। "
ধন্যবাদ!। তৃতীয় পর্বের পাঠ-্প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
এইবার আসি ভ্যালু সিস্টেমের কথায়।
--"বিপরীতে আমার অ্যান্টি-থিসিস। যার মূল কথা হল ইতিহাস পুরুষদের বিচার হবে দু'ভাবে। এক, তাঁদের সমকালীন ভ্যালু সিস্টেমে ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে, এবং আজকের ভ্যালু সিস্টেমে তার কতটুকু গ্রহণযোগ্য। এবং দেবোত্তমের বিশাল তথ্যভান্ডার ও রেফারেন্সকে স্বীকার করেও এটা পরীক্ষা করা যে ওই ডেটা স্বীকার করেও কোন বিকল্প ব্যাখ্যা বা ন্যারেটিভ সম্ভব কিনা।"
দেখুন, ভ্যালুসিস্টেম তো কোনকালে একমাত্রিক ছিল না। কিন্তু মহাপুরুষ রচনা হয় খুব একমাত্রিক ভাবে। তো বিদ্যাসাগর বা তাঁদের সমকালীন ভ্যালু সিস্টেম বলতে আপনি কোনটাকে বেছে নেবেন?
একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই।
খুব ছেলেবেলায় আমার কাছে একটা বই ছিলো- আমরা বাঙ্গালী না বাংলার মনীষী এই জাতীয় নাম ছিল মনে হয়। বইটার চেহারাটা ছিল পুরোনো আনন্দমেলার মতন (যেগুলো বিপ্লবী না হওয়ার বসনায় নিয়মিত পড়তাম!!!ঃ)-)। ভিতরে দুপাতা জুড়ে একেকজন মনীষীদের কথা থাকতো। ক্রোনোলোজিক্যাল অর্ডারে। সেখানে রাজা রামমোহন রায়ের আগে একজনের কথা থাকতো, হাজী মুহম্মদ মহসিন। সেই বইএর বাইরে আমি আর কোথায়ও মহসিন সাহেবের দেখা পাইনি; কেজি, মিডিল, হাই, কলেজ, ইউনি কোথাও নয়। রামমোহন, দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে আর সবাই ছিলেন। মুহম্মদ মহসিনের কথা কখনও কোন পাঠক্রমে ছিল বলে আমার মনে পড়ে না। এইখানেই আমার প্রশ্ন পায়, কেন?
আবার দেখুন, তারানাথ তর্ক বাচস্পতিঃ শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বয়ান অনুযায়ী সংস্কৃত কলেজের সেরা রত্ন। আমরা ব্যাকরণ কৌমুদি লোকের ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দিলাম। কিন্তু "বাচস্পত্যাভিধান" বা "তুলাদানাদিপদ্ধতি" কে ফসিল বানিয়ে ফেল্লাম। তো আপনি যে " তাঁদের সমকালীন ভ্যালুসিস্টেমের" কথা লিখেছেন, সেইখানে এই মাত্রা যোগ না করলে কি করে হবে?
ar
ঠিক বলেছেন। আমার ছোটবেলায় ও পড়েছি হাজি মহম্মদ মহসীন ও বেগম রোকেয়ার কথা। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ব্যাস যেত পার্কাসার্কাসে আমাদের পাড়া দিয়ে। হুগলী গিয়ে দেখেছি দাদা পড়ছে মহসীন কলেজে। দর্শনীয় স্থান হিসেবে দেখতে গিয়েছে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত ইমামবাড়া।
কিন্তু কয়েক দশক পরে এঁরা পাবলিক ডোমেনে আর সেভাবে নেই। এটাই চিন্তার। আর তারানাথ তর্কবাচস্পতির ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। যৎসামান্য জেনেছি দেবোত্তমবাবুর বইটি পড়ে। এঁদের নিয়ে কথা আসবে তৃতীয় অধ্যায়ে, সমাজসংস্কার অধ্যায় শেষ হলে।