১২.০ বইটিতে আলোচিত কিছু বিতর্কিত বিষয়ঃ
১২.১ ‘দায়ভাগে’ বিধবার সম্পত্তির অধিকার ছিল?
বিদ্যাসাগর ও রামমোহনকে কোম্পানি তথা বৃটিশের ঘৃণ্য দালাল হিসেবে থিসিস দাঁড় করাতে গিয়ে গোটা বইটিতে বারবার ধ্রুবপদের মত উঠে এসেছে একটি কথাঃ হিন্দু সমাজে সম্পত্তির অধিকার/ভাগ / বাঁটোয়ারার ব্যাপারে বাংলায় প্রচলিত ছিল পন্ডিত জীমুতবাহনের ‘দায়ভাগ’ পদ্ধতি আর বাকি ভারতে ছিল পরাশর সংহিতার উপর বিহারের বিজ্ঞানেশ্বর প্রণীত টীকা ‘মিতাক্ষরা’। মিতাক্ষরায় বিধবাদের সম্পত্তির অধিকার ছিল না। ‘দায়ভাগে’ ছিল। (?) অর্থাৎ বঙ্গদেশে বিধবারা মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। হ্যালহেডের জেন্টু ল’ এবং পরবর্তী হিন্দু ল’ মুড়িমিছরির এক দর করে বঙ্গের বিধবাদের স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করল। বিধবাবিবাহ আইনে বিদ্যাসাগর সেই ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে এই ব্যাপারটায় মোহর লাগিয়ে দিলেন। তাই বিধবাবিবাহ ইত্যাদি নিয়ে বিদ্যাসাগরের নারীদরদী ভূমিকা নিয়ে যাও বলা হয় সব দুষ্প্রচার। আসলে উনি নারীহিতৈষী নন, ঔপনিবেশিক এজেন্ডার দাস মাত্র।
দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি কথাটা ঠিক নয়। মিতাক্ষরা ও দায়ভাগ কোনটাতেই বিধবার সম্পত্তির অধিকার নেই। এ’ব্যাপারে দুটো সিদ্ধান্ত মূলতঃ এক, তাহল—বিধবা নারী তার মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার পাবে মাত্র একটি ব্যতিক্রমী শর্তেঃ যদি মৃত স্বামীর কোন পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্র না থাকে তবেই, নচেৎ নয়।
তাহলে দুটোর মধ্যে তফাৎ কী?
মিতাক্ষরা মতে বিধবা যদি ( মৃত স্বামীর পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্র না থাকলে) সংযুক্ত পরিবারের সদস্য হন তাহলে সম্পত্তি পাবেন না, শুধু খোরপোষ পাবেন, আর যদি সংযুক্ত পরিবারের আশ্রয় ছেড়ে একা থাকেন তবেই সম্পত্তি পাবেন।
দায়ভাগ মতে বিধবা (মৃত স্বামীর পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্র না থাকলে ) সংযুক্ত পরিবারের সদস্য হন বা একা থাকুন, উভয় ক্ষেত্রেই সম্পত্তির অধিকার পাবেন।
এটুকু বাদ দিলে মূল প্রশ্নে দুটো ব্যবস্থাই এক।
যেমন ১) দুটো ব্যবস্থাতেই এই সম্পত্তির অধিকার মাত্র জীবিতকালে ভোগের অধিকার। বিধবা এটা কাউকে বিক্রি বা দান করতে পারবেন না।
২) দুটো ব্যবস্থাতেই এই অধিকার মাত্র যে বিধবারা ‘পবিত্র জীবনযাপন’ করবেন, নচেৎ নয়। বরং ১৮৮০ সালের অ্যাংলো -হিন্দু ল’, প্রিভি কাউন্সিলের অনুমোদিত, বলল- একবার বিধবা কোন সম্পত্তির অধিকার পেলে সেটা তার জীবৎকালে কখনই খারিজ করা যাবে না , সে তিনি যতই ‘অনৈতিক জীবনযাপন’ করুন না কেন!
কাজেই বিধবাদের ব্যাপারটা বোধহয় এত সরলরৈখিক কলোনিয়াল/অ্যান্টি কলোনিয়াল লড়াইয়ের গল্প নয়।
এটি নিয়ে এত কথা বলা হয়েছে যে আমি লেখকের উদ্ধৃত অথেন্টিক সোর্স, লুসি ক্যারলের “ The Hindu Widow’s Right of Succession“ থেকে পুরো প্যারাগ্রাফ উদ্ধৃত করতে বাধ্য হচ্ছি।
Prior to 1937, under both the Dayabhaga and the Mitakshara schools of Hindu Law, the widow only succeeded to her husband’s estate in the absence of a son, son’s son, or son’s son’s son of the deceased; and the estate which she took by succession to her husband was an estate which she held only for her lifetime; ------
According to the Dayabhaga school, the widow (given the absence of a son, son’s son, or son’s son’s son) succeeded to her husband’s share whether or not he was a member of an undivided coparcenary; according to Mitakshara school, she succeeded to his estate only if he were separate and had simply a right to maintenance if he were a joint coparcener.
Under Hindu Law of both schools, it is only the chaste wife who is entitled to succeed to her husband’s estate. It is further a rule of Anglo-Hindu Law, as laid down by the Privy Council in 1880, that once a widow has succeeded to her deceased husband’s estate, she does not forfeit her right to the enjoyment of that estate until her death by living an unchaste life”.[1]
১২.২ সতীদাহ প্রথা বকলমে বৃটিশের দান?
পূর্বপক্ষঃ
- হ্যালহেডের ১৭৭৬ এর হিন্দু আইনে বাংলার প্রচলিত দায়ভাগ প্রথা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ঔদাসীন্য দেখানো হয়। ফলে মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে বিধবাদের অধিকারের বিষয়টিকে মূলশুদ্ধ উপড়ে ফেলার জন্য মৃত ব্যক্তির পরবর্তী বৈধ উত্তরাধিকারীরা দ্রুত সম্পত্তি লাভ করার লোভে বাংলায় ঘৃণ্য সতীদাহ প্রথা চালু করে।
- ১৭৮৭ সালে পুনে থেকে সতীদাহের প্রথম সরকারি রিপোর্ট পাওয়া যায়। “এই তথ্য প্রমাণ করে, মৃত ব্যক্তির বিধবা স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলার নৃশংস অমানবিক প্রথা বকলমে ব্রিটিশদের দান”।[2]
- ১৮১৫ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে সতীদাহের নথিভুক্তি শুরু হয়। ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৪ এর মধ্যে বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সতী হওয়ার মিলিত সংখ্যা ৬৬৩২। কিন্তু এরমধ্যে বাংলা প্রেসিডেন্সিতে সতীর সংখ্যা ৫৯৯৭, প্রায় ৯০.৪%।
- “শাসকের হৃত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার কাজে সহায়তা করার জন্য, বৃটিশদের একনিষ্ঠ স্তাবক ‘ভারতপথিক’ রামমোহন মনুবাদের সাহায্যে সতীদাহ ‘শাস্ত্রনিষিদ্ধ’ বলে প্রমাণ করেন”।[3]
- কিন্তু সতীদাহের সংখ্যা মোট ভারতীয় বিধবাদের মাত্র ০.২%। কিন্তু এই সামান্য সংখ্যক বিধবাদের আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ১৮২৯ সালে সতীদাহ নিবারণ আইন পাশ হয়।[4]
উত্তরপক্ষঃ
- লেখক বলছেন, “ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনাপর্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথার চল সেভাবে ছিল না”। এটাও বলছেন- ‘মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ১৩৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আইন জারি করেন যে, মুঘল নিয়ন্ত্রিত দেশের কোথাও কোনও পরিস্থিতিতে সতীদাহের সরকারি অনুমতি দেওয়া হবে না’।[5]
- কীসের ভিত্তিতে লেখক উপরোক্ত সিদ্ধান্তে এলেন? কোন ডকুমেন্ট বা নথি? বরং দেখা যায় যে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সতীদাহ ছিল, তাই ঔরঙ্গজেব গোটা দেশের জন্যে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ফরমান জারি করলেন। আসলে ১৮১৫ সালের আগে , মানে কোম্পানির আগে সতীদাহ নিয়ে সরকারি নথিভুক্তির ব্যাপারটা ছিল না, যা লেখক নিজেই বলেছেন।
- যদি হ্যালহেডের আইনে বিধবার সম্পত্তির অধিকার খারিজ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে মৃত স্বামীর পরিবারের পুরুষদের কী দায় পড়েছে তাকে মেরে যে সম্পত্তি তার নেই সেটা হাতাবার?
- বাংলা ভিন্ন কোথাও দায়ভাগ প্রচলিত ছিল না। আমার কিস্তি নং ৭ ও ৮ এ উল্লেখ করেছি যে বাকি দেশে ছিল মিতাক্ষরা, যাতে বিধবার সম্পত্তির অধিকার ছিল না। এটা গবেষক ডঃ নন্দিনী ভট্টাচার্য্য পন্ডাও বলেছেন। হ্যালহেডের আইন মিতাক্ষরার হিসেবে বিধবার কথা বলেছিল। আর পুনেতে কোনকালে দায়ভাগ ছিল না। তাহলে পুনে থেকে আসা প্রথম সতীদাহের কেসের ভিত্তিতে কী করে বলা যায় যে সতীদাহের প্রথা বকলমে ব্রিটিশদের দান?
- যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে সতীদাহের প্রথা বকলমে ব্রিটিশদের দান অথচ বৃটিশরাই ফের তাদের “একনিষ্ঠ স্তাবক” রামমোহনকে দিয়ে সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রবিরোধী প্রমাণ করিয়ে তারপর সতীদাহ নিবারক আইন পাশ করল? যুক্তি পরম্পরা ঠিক বোধগম্য হল না।
- সতীদাহের মত প্রথাকে লেখক স্বাভাবিক ভাবেই ঘৃণ্য, নৃশংস ও অমানবিক বলেছেন। সেই কারণেই এর গুরুত্ব কত প্রতিশত (০.২%) তা দিয়ে বিচার করা ভুল। আর বাংলার দায়ভাগেও বিধবার মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে ‘স্বাভাবিক’ অধিকার ছিলনা। এটা উপরে ১২.১ এ দেখিয়েছি।
১২.৩ বিদ্যাসাগর সবসময় নারীদের দোষ ধরেছেন, পুরুষের নয়ঃ
পূর্বপক্ষঃ
- বিদ্যাসাগর তাঁর বিধবাবিবাহ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তিকার “ ‘মানবিক’ আবেদনটিতেও নারীর যৌনতাকে নিয়ে তাঁর দীর্ঘকালীন উদ্বেগ ও আশংকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না --”।[6]
- এবং “বিধবাদের যৌনতার ওপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির ‘বৈধতা’র ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ করে রাখতে নামবেন তাঁদের”।[7]
উত্তরপক্ষঃ
- বিদ্যাসাগর ১৭০ বছর আগে নিখাদ পুরুষতান্ত্রিক ধর্মভীরু সমাজের মধ্যে নারীদের অবস্থার কিছু পরিবর্তনের সামাজিক আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন এবং বিধবাবিবাহ আন্দোলনে নিঃসন্দেহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা তখন তিনি ( লেখক উদ্ধৃত বক্তব্যে) নারীদের স্বতন্ত্র যৌনতা ও তার স্বাভাবিকতার কথা সামনে তুলে ধরে ছিলেন। যা তখন ব্যতিক্রমী ও সাহসিক প্রয়াস।
- আঙুল তুলেছেন পুরুষদের মূর্খতা ও সংবেদনশীলতার অভাবের দিকে। দেখুনঃ
“ তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয়না; যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয়না; দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়।--- যে দেশে পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিতবোধ নাই, সদাসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে”।[8]
১২.৪ বিধবাবিবাহ আইনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হোল নিম্নবর্ণের নারীরা?
লেখকের এই প্রতিপাদ্যটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তাই বিদ্যাসাগর-৮ এ এবিষয়ে একটু আলোচনা থাকা সত্ত্বেও এখানে আবার বিস্তারিত চর্চা শুরু করছি।
লেখকের বক্তব্যঃ এক, ৮০% শূদ্র ও নিম্নবর্ণের সমাজে বাল্যবিবাহ ও বিধবাবিবাহে বাধা -কোনটাই ছিল না। দুই, বিদ্যাসাগর মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণের বিধবাদের জন্য বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন করিয়ে বৃহৎ অংশের ক্ষতি করলেন, তাও ঔপনিবেশিক প্রভুদের নির্দেশে।
আমরা এই বক্তব্যটিকে তথ্যের আলোকে মিলিয়ে দেখব।
পূর্বপক্ষঃ
- নিম্নবর্ণের সমাজে বিধবাবিবাহের যথেষ্ট প্রচলন ছিল। আনুমানিক ষোড়শ শতকে বিখ্যাত স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ‘শুদ্ধিতত্ত্ব সপিণ্ডাদ্যশৌচ প্রকরণ’ গ্রন্থে শূদ্রদের জন্য বিধবাবিবাহ বিধিসম্মত বলে ঘোষণা করেন।[9]
- “সমাজে নিম্নবর্ণের সংখ্যাধিক্যের স্পষ্ট উল্লেখ করে লুসি ক্যারল জানিয়েছেন, নিম্নবর্ণ বিশেষত শূদ্র ও তথাকথিত ‘অস্পৃশ্য’ সমাজে—যাঁরা হিন্দু জনসংখ্যার প্রায় ৮০% --বাল্যবিবাহও প্রচলিত ছিল না, বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রথাও নিষিদ্ধ ছিল না”।
- অথচ এই আইনে বিধবাকে প্রথম (মৃত) স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হোল। এবং এলাহাবাদ হাইকোর্ট বাদে বাকি তিনটে হাইকোর্ট—কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজ— নতুন আইনটিকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমস্ত বর্ণের বিধবাদের জন্য প্রযোজ্য বলে বিবেচনা করতে লাগল। [10]
- ফলে এই আইনের লাভ পেল অতি অল্পসংখ্যক উচ্চবর্ণের বিধবা। কিন্তু বিপুল সংখ্যক নিম্নবর্ণের বিধবারা—যাঁরা তাঁদের প্রচলিত প্রথা অনুসারে পুনর্বিবাহ করতেন এবং সেই সুবাদে তাঁদের প্রথম স্বামীর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন না—এবার বঞ্চিত হতে শুরু করলেন।[11]
- “ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্দেশে বিধবাবিবাহ আইনটিকে পাশ করানোর জন্য সহায়তা করা ছাড়া বিদ্যাসাগর সারা জীবনে তার ঢক্কানিনাদ সমাজ সংস্কার প্রকল্পের একটিতেও সফল হতে পারেননি। তিনি যেমন কতিপয় হিন্দু উচ্চবর্ণের বিবাহজনিত সমস্যা ছাড়া অন্য কোন সামাজিক সমস্যার প্রতি দৃকপাত করেননি, তেমনই শাসকশ্রেণিও কোনও ক্ষেত্রেই তাঁর আবেদন বা পরামর্শকে গ্রাহ্য করেননি। কাজেই উপনিবেশের একান্ত দাস মনোভাবাপন্ন ভক্তবৃন্দের তাঁকে ‘সমাজসংস্কারক’ -এর উচ্চবেদিতে বসিয়ে পূজার্চনা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই”।[12]
উত্তরপক্ষঃ
- লেখক উদ্ধৃত লুসি ক্যারলের বিশিষ্ট গবেষণাপত্র “Law, Custom and Statutory Social Reform” (The Hindu Widow’s Remarriage Act of 1856) কে ভিত্তি করেই আলোচনা হোক। বৃটিশ রা কেন এই আইন প্রণয়ন করেছিল? লেখকের মতে বিধবাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে। বিধবারা কি বৃটিশ বাণিজ্য ও সাম্রাজ্যের জন্য এত বড় বিপদ ছিল?
- লুসি বলছেনঃ The Hindu Widow’s Remarriage Act was enacted by the British Indian Government in response to the social reform agitation organized by Pandit Vidyasagar and others.[13] তাহলে লুসি’র গবেষণা বলছে ঠিক লেখকের উলটো কথাটি, বিদ্যাসাগর ঔপনিবেশিক শাসকের নির্দেশ মেনে বিধবাবিবাহ আইনে সহায়তা করেছেন তা’নয় , বরং বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলে শাসক এই আইন পাশ করে। লুসি আরও বলেছেন—the social reform movement thus required legal sanction.
- লুসি অবশ্যই দেখেছেন-যেমন লেখক বলেছেন—শূদ্র, অস্পৃশ্য বা নিম্নবর্গের মানুষেরা হলেন হিন্দু সমাজের প্রায় ৮০%। তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহ বা বিধবাবিবাহে নিষেধ -কোনটাই ছিল না। বিধবাদের পুনর্বিবাহের সমস্যা মূলতঃ অল্পসংখ্যক উচ্চবর্ণের হিন্দু বিধবাদের সমস্যা। বাচ্চা বয়সে বিয়ে হয়ে প্রায় অদেখা অপরিচিত স্বামীর মৃত্যুর ফলে মেয়েটি পূর্বজন্মের পাপের ফল ভুগছে বা স্বামীকে খেয়েছে এই অপবাদে অসম্মানের জীবন যাপন করতে বাধ্য হত। বাকি জীবন কাটত প্রার্থনা, উপবাসে, সরিয়ে দেয়া হত পারিবারিক ও সামাজিক উৎসবে -অশুভ বলে।
- লেখকের আপত্তি বিদ্যাসাগর শুধু উচ্চবর্ণের মুষ্টিমেয় বিধবার জন্য আন্দোলন করেছেন বলে। আমার প্রশ্নঃ এই অল্পসংখ্যক বিধবারা কি মানুষ নয়? তাদের প্রতি অমানবিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কি দাঁড়ানো উচিত নয়? এহ বাহ্য, আমি স্মার্ত রঘুনন্দনের কথা আনছি লেখকেরই উদ্ধৃত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থেকে।
“এতদ্দেশীয় স্মৃতি -সংগ্রহ-কর্তা রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণাদি সর্ববর্ণের মধ্যে ঐ প্রথা প্রচলিত করিবার নিমিত্ত উদ্যত হন, কোনরূপে কৃতকার্য না হইয়া শূদ্রবর্ণের পক্ষে সুস্পষ্ট বিধি প্রদান করিয়া গিয়াছেন”।[14]
অর্থাৎ স্মার্ত রঘুনন্দন ওই সমাজের ৮০% বিধবাদের জন্য তাদের প্রচলিত আচারকে শাস্ত্রানুমোদিত ঘোষণা করে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন। কিন্তু বাকি ২০% এর জন্যে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। দুই শতাব্দী পরে আরেক স্মার্ত বিদ্যাসাগর আইন করে সেই ২০% বিধবাদেরও পুনর্বিবাহ আইনের আওতায় এনে দিলেন ষোলকলা পূর্ণ হোল। আপত্তিটা ঠিক কোথায়?
এতে জাতপাতের প্রশ্ন তুলে বিরোধিতা ঠিক আজকের পার্লামেন্টে নারীদের ৩৩% রিজার্ভেশনের বিরুদ্ধে কিছু কথিত সমাজতন্ত্রী দলের জাতপাতের প্রশ্ন তুলে মেয়েদের পক্ষের বিলটাই আটকে দেওয়ার সঙ্গে তুলনীয়।
- দলিত বিধবাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া? এ’নিয়ে লুসি ক্যারলের বিস্তৃত গবেষণা রয়েছে এবং লেখক নিজে তাঁর লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছেন তথা কিছু যুক্তিও নিয়েছেন। আমরাএবার এই প্রশ্নে লুসির গবেষণার মূল বিন্দুগুলোকে খতিয়ে দেখব। ওঁর বক্তব্যঃ
- বিধবাবিবাহ আইনের প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা নিয়ে ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন হাইকোর্টের মধ্যে বিবাদ ও বিতর্ক চলেছে। একদিকে কোলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই হাইকোর্ট অন্যদিকে এলাহাবাদ।
- এলাহাবাদ রায় দিতে থাকল যে এই আইনের আগে যে যে সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল বা মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে বিধবার অধিকার ছিল তাদের জন্যে এই আইন অপ্রাসংগিক। অন্যদিকে বাকি তিন হাইকোর্টের মতে মানুষের তৈরি এই আইন প্রাচীন প্রথা বা ধার্মিক অনুশাসনের চেয়ে বেশি প্রাসংগিক, তাই সবার উপর প্রযোজ্য। এর মধ্যে বিধবার নৈতিক জীবনের প্রশ্নে প্রিভি কাউন্সিল রায় দিল যে বিধবা একবার সম্পত্তির অধিকার পেলে তার পুনর্বিবাহ বা অনৈতিক জীবন যাপনের অজুহাতে সেটা ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না।[15]
- ৮১ বছর পরে The Hindu Women’s Rights to Property Act (XVIII of 1937) বিধবাকে তার মৃত স্বামীর ছেলে থাকলেও সম্পত্তিতে ছেলের সমান অংশের মালিকানা হক দিল, তবে সেটা শুধু যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনের জন্য। [16]
- এই বিবাদের অন্তিম নিষ্পত্তি হোল স্বাধীন ভারতে ১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নে, যার ফলে হিন্দু বিধবা, যে কোন জাতের হোক, তার মৃত স্বামীর যে অংশটুকুতে আগে (ছেলেদের সমান) সীমিত অধিকার পেত, এখন তার full and absolute owner (section 14) হবে।
- বিদ্যাসাগরদের গাল পাড়বার আগে দেখা দরকার বিধবাবিবাহ আইন (১৯৫৬) প্রণয়নের সময় প্রণেতাদের উদ্দেশ্য কী ছিল। সেটা বোঝা যায় যে কোন আইনের মুখবন্ধ বা Preamble দেখলে। ঠিক যেমন আজও কোন মৌলিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনের সময় আমরা বারবার ফিরে আসি আমাদের সংবিধানের Preamble পড়তে। এই আইন প্রণয়নের কী দরকার ছিল? Preamble বলছেঃ এই আইন সেইসব হিন্দুদের জন্যে যাদের ধর্মীয় অনুশাসন স্বামী গত হলে পুনর্বিবাহের অনুমতি দেয় না, অথচ তাঁরা চান তাঁদের বিবেকবুদ্ধি অনুযায়ী নতুন প্রথা গ্রহণ করতে এবং তাতে আদালত বাধক হবে না।
“where it is just to relieve all such Hindus from this legal incapacity of which they complain , and the removal of all legal obstacles to the marriage of Hindu widows will tend to the promotion of good morals and to the public welfare’.[17]
- তাহলে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ত্রুটি এবং তৎকালীন সামাজিক পরিবেশ ও মানসিকতার পূর্বাগ্রহের—যার থেকে অনেক বিচারক মুক্ত ন’ন—জন্যে বিদ্যাসাগরকে “ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্দেশে বিধবাবিবাহ আইনটিকে পাশ করানোর জন্য সহায়তা করা” গোছের অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
১২.৫ সমাজ-সংস্কারক বিদ্যাসাগরঃ পরাজিত নায়ক অথবা কলোনিয়াল প্রভুর ভেঁপু?
এ’বিষয়ে লেখকের মূল্যায়ন নিম্নরূপঃ
“ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্দেশে বিধবাবিবাহ আইনটিকে পাশ করানোর জন্য সহায়তা করা ছাড়া বিদ্যাসাগর সারা জীবনে তার ঢক্কানিনাদ সমাজ সংস্কার প্রকল্পের একটিতেও সফল হতে পারেননি। তিনি যেমন কতিপয় হিন্দু উচ্চবর্ণের বিবাহজনিত সমস্যা ছাড়া অন্য কোন সামাজিক সমস্যার প্রতি দৃকপাত করেননি, তেমনই শাসকশ্রেণিও কোনও ক্ষেত্রেই তাঁর আবেদন বা পরামর্শকে গ্রাহ্য করেননি। কাজেই উপনিবেশের একান্ত দাস মনোভাবাপন্ন ভক্তবৃন্দের তাঁকে ‘সমাজসংস্কারক’ -এর উচ্চবেদিতে বসিয়ে পূজার্চনা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই”।[18]
বক্তব্যের সমর্থনে লেখক বিদ্যাসাগরের সমকালীন পত্রিকা এবং আমাদের সময়ের গবেষকদের কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেনঃ
ব।মাবোধিনী পত্রিকার সম্পাদকীয়ঃ
“সাধারণ লোকে যুক্তিও বুঝে না, শাস্ত্রও বুঝে না, দেশাচারও মোটামুটি একটা সংস্কার ধরিয়া কার্য করে। তাহারা বিধবা বিবাহ শুনিলে মহাপাপ বলিয়া বিজাতীয় ঘৃণা পোষণ করে । এই প্রকারে বিবাহিত দম্পতি সাধারণের চক্ষুশূল”।[19]
স্বপন বসুঃ তৎকালীন সমাজ মনে করত মেয়েরা বিধবা হয় পূর্বজন্মের পাপের ফলে।
বিনয় ঘোষঃ
‘বিধবাবিবাহ হিন্দুসমাজ গ্রহণ তো করেই নি, শিক্ষিত উচ্চসমাজে যাঁরা আদর্শের দিক দিয়ে একদা তা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেননি। বিধবাবিবাহের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামাজিক প্রথা, যেমন নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা, যৌথ পরিবার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি -যেমন ছিল ঠিক তেমনি রেখে শুধু প্রথা হিসেবে বিধবাবিবাহ সমাজে প্রচলিত হতে পারে না’।[20]
অশোক সেনঃ
‘[21]There was his [ Vidyasagar’s] drawback of missing the wood for a few trees’.
ইতিহাসবিদ সুমিত সরকারঃ
“The limits of Vidyasagar’s ideas and reform activities still remain clear, particularly from today’s feminist perspectives. --- The fundamental impulse, as in all 19th century male ‘stri-swadhinata’ initiative, was ‘protectionis’t rather than egalitarian”.[22]
উত্তরপক্ষঃ
- উপরের প্রত্যেকটি মন্তব্যই মূল্যবান। সেগুলো বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার দিকগুলো তুলে ধরেছে। কিন্তু সেসবই তার সময়ের সীমাবদ্ধতা, ঐতিহাসিক কালখন্ডের সামাজিক সীমাবদ্ধতা। খেয়াল করুন, বিদ্যাসাগরের চেয়ে ৪১ বছরের ছোট রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করেছেন ৯ বছরের বালিকা মৃণালিনীকে। প্রথম জীবনে প্রবন্ধ লিখে সমর্থন করছেন হিন্দুবিবাহের আদর্শকে এবং ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ নীতিকে( বিদ্যাসাগর-৯ ইস্যুতে সোর্স উদ্ধৃত করেছি)।
- বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহ-বিধবাবিবাহ বিষয়ক আন্দোলনের সাফল্য আজকে দাঁড়িয়ে কীভাবে মাপব? তার সংখ্যা দিয়ে? নাকি তার ‘ইম্প্যাক্ট’ দিয়ে?
কার্ল মার্ক্সের সাফল্য কি দিয়ে মাপা হবে? তাঁর জীবদ্দশায় ফ্রান্স ও জার্মানিতে বিপ্লব প্রয়াসের ব্যর্থতার পর শেষজীবনে লন্ডনে দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন, হাইড পার্কে বাচ্চাদের পিঠে চড়িয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলা এবং জামাই পল লাফার্গের সঙ্গে সন্ধ্যেয় এক পাব থেকে আর এক পাবে ঘোরা, ঢিল ছুঁড়ে কাঁচ ভেঙে পুলিশের তাড়া খেয়ে তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার ন্যারেটিভ দিয়ে?
নাকি গত দুই শতাব্দী ধরে গোটা দুনিয়ার সমাজজীবনে অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে তাঁর চিন্তার ‘ইম্প্যাক্ট’ দিয়ে?
- ডক্টর মীরা কোশাম্বীর বক্তব্য আগের ইস্যুতে ( বিদ্যাসাগর-৯) উল্লেখ করেছি। এই ইস্যুতে লেখকের পছন্দের গবেষক লুসি ক্যারলের বক্তব্য তুলে ধরেছি। তাতে ওনারা স্পষ্টভাবে বলেছেন কীভাবে উনবিংশ শতাব্দীর বিধবাবিবাহ-বহুবিবাহ-সহবাস সহমতি আইন ভারতে নারীমুক্তির প্রশ্নে জরুরি দিকচিহ্ন। বিদ্যাসাগরকে ছোট করতে গিয়ে আমরা এই প্রেক্ষিতকে তুচ্ছ না করে ফেলি!
১২.৬ ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের কিছু কীর্তিঃ
- বিদ্যাসাগর বহুবিবাহকে শাস্ত্রবিরুদ্ধ প্রমাণ করার জন্য মনুর শরণাপন্ন হলেও এবং শর্তসাপেক্ষে বহুবিবাহ অনুমোদনযোগ্য বলে স্বীকার করে নিলেও তাঁর শাস্ত্রব্যাখ্যার বিরোধিতা করেন যে পন্ডিতকুল তাঁদের সঙ্গে বিতর্কে উনি সংযম হারিয়ে স্থুল ও কুৎসিত ভাষায় ব্যক্তিআক্রমণ করেন। বিশেষ করে বেছে নেন সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপক , তাঁর প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ মিত্র তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে।[23]
- স্মৃতিশাস্ত্র নিয়ে বিতর্কে বিদ্যাসাগর এমন সংযম হারালেন যে ‘অশ্লীল কটুক্তি’ গ্রাম্য রসিকতায় আহত তারানাথ নিরুত্তর হলেও উনি ‘কস্যচিৎ ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে ‘অতি অল্প হইল’ এবং ‘আবার অতি অল্প হইল’ শীর্ষক দুটো প্যাম্ফলেট প্রকাশ করলেন। এমনকি উনি যে তারানাথের সংস্কৃত কলেজে চাকরি করে দিয়েছিলেন সেই কথা তুলে লিখলেন যে ‘খুড়র গায়ে মানুষের চামড়া নাই’।
- যদিও বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন এই বিবাদে তারানাথের পক্ষে লিখে গেছেন যে তারানাথ নিজের ঘরে চতুষ্পাঠী চালাতেন। এছাড়া নেপাল থেকে কাঠ আনিয়ে বিক্রি, মেদিনীপুরের রাধানগর গ্রামে কাপড়ের কুঠিতে তাঁত বসিয়ে কাপড় উত্তরপ্রদেশে রপ্তানি করে এবং একগাদা ঢেঁকি বসিয়ে চালের ব্যবসা করে লক্ষাধিক টাকা আয় করেছিলেন। যার থেকে তাঁর গৃহনগর কালনায় এক বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি কাউকেই চাকরির জন্য অনুরোধ করেননি। কেবল বিদ্যাসাগরের বন্ধুত্বের খাতিরে সব ছেড়েছুড়ে সংস্কৃত কলেযে মাসিক ৯০ টাকা মাইনের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।[24]
- একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিদ্যাসাগরের শ্বশুরবাড়ি ছিল ক্ষীরপাই গ্রামে। সেই গ্রামের মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় কাশীগঞ্জের কাশীনাথ পালধির বিধবা মেয়ে মনমোহিনী দেবীকে বিয়ে করবেন। কিন্তু ক্ষীরপাই গ্রামের হর্তাকর্তা এই বিয়ে ঘোর বিরোধী। ফলে ওঁরা দু’জন বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে পুত্র নারায়ণচন্দ্রের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। বিদ্যাসাগর প্রথমে সম্মত ছিলেন। কিন্তু হালদারবাবুরা বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করলেন তাঁদের ‘ভিক্ষাপুত্র’ মুচিরামের বিধবাবিবাহে তাঁরা অমত। কাজেই বিদ্যাসাগর যেন এ’বিয়েতে সাহায্য না করেন বিদ্যাসাগর তাতে রাজি হয়ে বললেন—তাই হবে, আপনারা দু’জনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘরে ফেরত নিয়ে যান।
তখন বিদ্যাসাগরের মেজোভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও অন্যান্যরা মিলে অন্য একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পরদিনই ওদের বিয়ে দিলেন। তাতে বিদ্যাসাগর অতিশয় ক্ষুব্দ হয়ে ভাইদের বললেন যে উনি হালদারবাবুদের কথা দিয়ে এখন মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন হলেন। যদি তোমাদের এমনই ইচ্ছে ছিল ‘তাহা হইলে ভিন্ন গ্রামে লইয়া গিয়া বিবাহ দিলে এরূপ মনঃকষ্ট হইত না’। শুনে ছোটভাই ঈশানচন্দ্র জবাব দিলেন, “লোকের খাতিরে এই সকল বিষয়ে পরাঙ্মুখ হওয়া ভবাদৃশ ব্যক্তির পক্ষে দূষণীয়”।[25]
উত্তরপক্ষঃ
- উপরের দুটি ঘটনাই সত্যি এবং বিদ্যাসাগর চরিত্রের একটি দিক প্রকাশ করে, তাহল অহং ও একগুঁয়ে জেদী মনোভাব। মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবাবিবাহে উনি ভাই ঈশানচন্দ্রের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন যে প্রস্তাবটি শাস্ত্রসম্মত। অন্য গ্রামে গিয়ে বিয়ে দিলে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এই গ্রামে এবং তাঁর অনুজ ভাইদের যোগসাজশে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ায় হালদারবাবুদের কাছে তিনি নাকি ‘মিথ্যেবাদী’ প্রতিপন্ন হলেন।
- লেখক এই ঘটনাটিকে দেখছেন ‘দেশাচারের ভক্ত’ বিদ্যেসাগর হিসেবে।[26] কিন্তু তা’তো নয়। এটা থেকে বোঝা যায় বয়েস এবং খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে বিদ্যাসাগর অহংকারী ও তোষামোদ ভক্ত হয়ে পড়েছেন। এর চেয়ে নিন্দার্হ হোল যেভাবে উনি বন্ধু ও সুহৃদ তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে তাঁকে চাকরি পাইয়ে দেয়ার কথা শরণ করিয়ে তাঁর পান্ডিত্যে শংকা প্রকাশ করেছেন, এমনকি তাঁর ছেলে জীবানন্দকেও খোঁচা দিতে ছাড়েননি । যদিও বয়েসে ছোট বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সিনিয়র আরেক ‘বিদ্যাসাগর’ তারানাথের থেকে একসময় পাঠ বুঝে নিতেন।
কারণটা কী? না, তারানাথ বহুবিবাহ প্রশ্নে মত পরিবর্তন করে বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করেছেন।
- এর থেকে কী দাঁড়ায়? বিদ্যাসাগর ‘সমাজসংস্কারক’ নন, বরং কলোনিয়াল প্রভুর ভেঁপু?
মনে হয় না। বরং এটাই বোঝা যায় যে বিদ্যাসাগর ঈশ্বর ন’ন। আমাদেরই মত মানুষ, রিপুর প্রভাবে ক্রোধ, ঈর্ষা, স্তাবকতাপ্রিয়।
- এদিকে নিজের ছেলের প্রথম বিয়ে আইন মেনে ১১ বছরের বিধবার সঙ্গে দিয়েছেন।[27] ৬০টি বিধবাবিবাহ নিজের খরচে করিয়ে ধারদেনায় নিমজ্জিত হয়েছেন। বিতর্কের ফলে শত্রু বাড়িয়েছেন। নিজের মেয়েরও গৌরীদান করেননি। বহুবিবাহ করেননি। তাঁর উদাহরণে তাঁর ভাইয়েরা এবং অনেক পরিচিত ও অপরিচিত অনুপ্রাণিত হয়েছেন। স্বপন বসু দেখিয়েছেন মেদিনীপুর এবং অন্যান্য জেলার গ্রামে অনেক অপরিচিত বিধবা মহিলারা বিদ্যাসাগরের প্রয়াসে নতুন করে স্বপ্ন দেখেছেন।
উপসংহারঃ ‘সমকালীন নিন্দা-প্রশংসার মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগরের যে ছবিটি বেরিয়ে আসে, সেটিও কিন্তু কম উজ্বল নয়। আর নয় বলেই, বিদ্যাসাগর আজও বাঙালীসমাজে এক সমাদৃত পুরুষ হয়ে আছেন, আর থাকবেন-ও’।
স্বপন বসু, ‘সমকালে বিদ্যাসাগর’, পৃ-২০৫
[ এবার সত্যি শেষ কিস্তি (মানে ১১ নং) আসবে, সাহিত্য ও ভাষা সংস্কারে বিদ্যাসাগর]
[1] The Hindu Widow’s Right of Succession, in Women and Social Reform in Modern India, ed. By Sumit Sarkar and Tanika Sarkar; published by Permanent Black, 2017.
[2] ঐ, পৃঃ ২৬৮।
[3] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ২৬৮।
[4] ঐ, পৃঃ ২৬৯।
[5] ঐ, পৃঃ ২৬৮।
[6] ঐ, পৃঃ ২৭৭।
[7] ঐ, পৃঃ ২৭৮।
[8] বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, দ্বিতীয় খন্ড, (গোপাল হালদার সম্পাদিত); পৃঃ ১৫৫-৫৬।
[9] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ২৭৯
[10] ঐ, পৃঃ ২৮০।
[11] ঐ, পৃঃ ২৮০।
[12] ঐ, পৃঃ ৩৩৪।
[13] Lucy Carroll; in Women and Social Reform in Modern India, ed. By Sumit Sarkar and Tanika Sarakar; P. 114.
[14] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ২৭৯
[15] মনিরাম কলিতা বনাম কেরী কলিতানি, ILR 5, CAL. 776 (PC).
[16] Lucy Carroll; in Women and Social Reform in Modern India, ed. By Sumit Sarkar and Tanika Sarakar; P.139.
[17] Preamble, The Hindu Widows’ Remarriage Act, 1856.
[18] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ৩৩৪।
[19] বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, তৃতীয় খন্ড, কলকাতা ২০১৫, পৃঃ ১৬৬-৬৭।
[20] বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, কলকাতা, ১৪২৩, পৃঃ ১৬২।
[21] Ashok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestone, New Delhi, 2016, p. 217.
[22] Sumit Sarkar, Writing Social History.
[23] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ৩০৩।
[24] শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, পন্ডিত কুলতিলক মহাত্মা তারানাথ তর্কবাচস্পতির জীবনচরিত, কলিকাতা ১৩০০, পৃঃ ১৪-১৬।
[25] শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর জীবনচরিত, পৃঃ ২১৩।
[26] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ২৬৩।
[27] চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, কোলকাতা , ১৯০৯; পৃঃ ২৯২।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।