তিনভাগে বিভক্ত বইটির অন্তিম পর্বের শীর্ষক ‘সাহিত্য সংস্কারক বিদ্যাসাগরঃ নতুন চিন্তা, নতুন চেতনা।
এই পর্ব চারটি অধ্যায়ে বিন্যস্তঃ ১) বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন, ২) বিদ্যাসাগরের পাঠ্যপুস্তক(বেতাল ও বোধোদয়) , ৩) বিদ্যাসাগরের পাঠ্যপুস্তক ( বর্ণপরিচয়), এবং ৪) বিদ্যাবণিক বিদ্যাসাগর।
এই পর্বে লেখক বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামত ও অনেক আকর গ্রন্থের সহায়তায় খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন কিছু মিথ—যেমন বাংলা গদ্যের শৈলীর গঠনে বিদ্যাসাগরের অবদান ঠিক কতখানি। এর জন্যে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন ভাষার গঠন পর্বেই বাংলাভাষার চলনে সংস্কৃতের প্রভাবে বাঁক বদলের গতিপ্রকৃতি এবং তার পেছনে ঔপনিবেশিক শাসকদের চিন্তা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের কু-প্রভাব।
আমরা লেখকের অধ্যায় বিভাগ অনুসরণ করে আলোচনায় প্রবৃত্ত হব। বর্তমান পাঠকের মতে এই অধ্যায়টি বইটির সেরা পর্ব, তারপরে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত “ নিয়ে আলোচনার অংশটুকু।
১৩.১ বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন
লেখক সঠিকভাবে দেখিয়েছেন যে বৃটিশ কলোনিয়ালিস্টদের ভারত দখল করার লড়াইয়ে ক্রমশঃ দিল্লির মুঘল, দাক্ষিণাত্যের টিপু আদি মুসলিম শাসক ও বঙ্গে সিরাজদৌল্লাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাদের কাছে মুসলিম শাসকেরা ছিল ভবিষ্যতের কাঁটা। সেই মানসিকতায় এশিয়াটিক সোসাইটিতে উইলিয়ম জোন্সের নেতৃত্বে ভারতাবিদেরা গড়ে তোলে হিন্দু রাজত্বের স্বর্ণিম যুগ ও মুসলিম রাজত্বের মধ্যযুগীয় অন্ধকারের এক সরলীকৃত আখ্যান যা চলে আসে ২০০ বছর ধরে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে।
এদিকে হ্যালহেড বাংলাভাষার কাঠামো বাঁধতে গিয়ে ব্যাকরণ লিখলেন, কিন্তু প্রচলিত বাংলাভাষার থেকে (অশুদ্ধ?) ফারসী ও দেশি শব্দ ছেঁটে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের কন্যা সিদ্ধ করে সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে ‘শুদ্ধ’ করতে উঠে পড়ে লাগলেন। এ’ব্যাপারে তাঁদের প্রবল সমর্থক ও সহায়ক হলেন ফোর্ট উইলিয়ম ও সংস্কৃত কলেজের পন্ডিতেরা। এঁদের চোখে ভাষাকে হতে হবে উচ্চবর্ণের এলিট, কাজেই সংস্কৃত ঘেঁষা। [1]
এর ফলে বাংলায় বইপত্রে এবং সাহিত্যে মুসলমান সমাজ প্রান্তিক হয়ে গেল। মুসলমান চরিত্র খুঁজে পাওয়া গেল না। আমাদের শৈশবে অবচেতনে নির্মিত হোল মুসলমান বা যবনদের ‘বহিরাগত’ ও ‘প্রান্তিক’ ছবি।
এই ধারার প্রবল সমর্থক হলেন বিদ্যাসাগর এবং বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ।
এই মূল্যায়নের পক্ষে প্রস্তুত সাক্ষ্যগুলো দেখা যাক।
১৩.১.১ বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের রাজপথ
- হ্যালহেড তাঁর A Grammar of the Bengali Language এ খোলাখুলি আক্ষেপ করেছেন—বাঙালিরা কেমন করে মুসলমান শাসকদের প্রভাবে তাদের দেশি কথ্যভাষায় অবলীলাক্রমে পার্শিয়ান শব্দগুলো বাঙালী উচ্চারণে আত্তীকরণ করে নিচ্ছে।[2] সজনীকান্ত দাস লিখেছেন- ‘সাহেবরা সুবিধা পাইলেই আরবী-পারসীর বিরোধিতা করিয়া বাংলা ও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতেন, ফলে দশ পনের বৎসরের মধ্যেই বাংলা গদ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়াছিল’।[3]
- সংস্কৃত কলেজে ২২ বছর পড়িয়েছেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার যাঁর তিন বিখ্যাত ছাত্র হলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি, বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালংকার। মদনমহনের ‘শিশুপাঠ’ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। কিন্তু এহেন জয়গোপাল পারসীক অভিধান লিখে তাতে ২৫০০ যাবনিক বা ফার্সী শব্দের জায়গায় সংস্কৃত শব্দ যোগ করলেন। এরপর উনি লিখলেন ‘বঙ্গাভিধান’, তার উদ্দেশ্য নিয়ে বললেন-‘ইহাও উচিত হয় যে সাধুলোক সাধুভাষাদ্বারাই সাধুতা প্রকাশ করেন অসাধুভাষা ব্যবহার করিয়া অসাধুর ন্যায় হাস্যাস্পদ না হয়েন’।[4]
- তাঁর এই ভাষা শুদ্ধিকরণ মিশন নিয়ে সজনীকান্ত দাস বলছেন,” পন্ডিত জয়গোপাল তর্কালংকার পরবর্তী শ্রীরামপুর সংস্করণে কৃত্তিবাস ও কাশীদাসের উপর কলম চালাইয়া ‘অবিশুদ্ধ’ মূলকে ‘বিশুদ্ধ’ করিয়াছিলেন।[5]
- এই ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের জন্যেই বাংলা প্রবাদটি—‘কৃত্তিবেসে কাশীদেসে আর বামুন ঘেঁষে, এই তিন সর্বনেশে’— সম্ভবতঃ চালু হয়েছিল। এটা আমি ছোটবেলায় কাশীরাম দাসের বর্ধমান মহারাজার প্রকাশিত রাজ সংস্করণের ভূমিকায় পড়েছি বলে মনে হচ্ছে।
- এ’বিষয়ে বিদ্যাসাগরের মত কী? ১৮৫১ সালে ‘বোধোদয়’ -এ ছাত্রদের বলেছেন ‘সংস্কৃত ভাল না জানিলে, হিন্দি , বাঙ্গালা প্রভৃতি ভাষাতে ব্যুৎপত্তি জন্মে না’। এবং পরে একটি অভিভাষণে বলেন যে ভারতে হিন্দি বাঙ্গালা ইত্যাদিকে ‘হীন’ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে হলে টোটকা হোল ‘ভুরি পরিমাণে সংস্কৃত কথা লইয়া ঐ সকল ভাষায় সন্নিবেশিত করা’। [6]
১৩.১.২ বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের রাজপথের খানাখন্দ
- বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে ‘ভট্টাচার্য অধ্যাপকেরা’ যে ভাষায় কথা বলতেন সেটা সংস্কৃত জানা লোকজন ছাড়া অন্য কারও পক্ষে বোঝা কঠিন। যেমন তাঁরা ‘খয়ের’, চিনি, ঘি,কলা বা চুল না বলে বলবেন- খদির, শর্করা, আজ্য,রম্ভা বা কেশ। ফলাহারে বসে দই চাইতে চেঁচাবেন- দধি! দধি! ‘তবে তাঁহাদের লিখিত বাঙ্গালা আরও কি ভয়ংকর ছিল, তাহা বলা বাহুল্য’।[7]
আমরা শুনেছি, বঙ্কিমের উপন্যাসে অপেক্ষাকৃত সরল ও সাধারণ লোকের উপযোগী বাংলা নামপদ, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের ব্যবহারে বিরক্ত পন্ডিতকুল ওই ভাষাকে ‘গুরুচন্ডালি’ দোষে দুষ্ট আখ্যা দিয়ে এঁদের নামকরণ করলেন-‘শবপোড়া মড়াদাহের দল’। বঙ্কিমরা পন্ডিতদের পালটা আখ্যা দিলেন-‘ভট্টাচার্য্যের চানা’। (সোর্স বলতে পারছি না)।
- বিদ্যাসাগরের বিশেষ স্নেহধন্য শিবনাথ শাস্ত্রী ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের হাতে পড়ে বাংলা ভাষার কৃত্রিম রূপ ও সর্বনাশ হওয়া দেখে লিখতে ছাড়েননি। শিবনাথের মতে বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের মত ‘ উভয় যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল’। অধিকাংশ লোকের কাছে ‘ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্বোধ্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল’। লোকজনের এ’নিয়ে ঠাট্টাতামাসা –যেমন জিগীষা, জিজীবিষা শব্দকে ভেঙিয়ে ‘চিঢ্ঢীমিষা’ শব্দ যোগ করে হাসাহাসি ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ প্রকাশিত হত[8]।
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১২৮৮ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শনের শ্রাবণ সংখ্যায় সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ও যুক্তিযুক্ত কথা বলেছেন।
“কথাটা এই যে, যাঁহারা এ পর্য্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাঁহারা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই। হয় ইংরাজী পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন । কতকগুলি অপ্রচলিত সংস্কৃত ও নূতন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন। নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেননাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কয়েয়ে আছে না আছে তাহাতে তাঁহাদের নজরও পড়ে নাই”। এবং “ লিখিত ভাষা ক্রমেই সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য ও দুস্পাঠ্য হইয়া উঠিল। অথচ এডুকেশন ডেসপ্যাচের কল্যাণে সমস্ত বঙ্গবাসী বালক এই প্রকারের পুস্তক পড়িয়া বাংলাভাষা শিখিতে আরম্ভ করিল। বাংলাভাষার পরিপুষ্টির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল”।(বোল্ড অক্ষর আমার)। [9]
- বাংলাভাষার এই কৃত্রিম সংস্কৃতায়নের বিরোধিতা করে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার তাঁর ‘বাঙলা ভাষার কুলজী’ নামক প্রবন্ধে বলেনঃ ‘—বাঙলার প্রাকৃত বা তদ্ভব রূপটিই যে এর আসল রূপ, একথা রামমোহন রায় মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের আর শ্রীরামপুরের পন্ডিতদের হাতে প’ড়ে বাংলা ভাষা ভোল ফিরিয়ে বসল, বাংলা ব্যাকরণ বলে লোকে সংস্কৃত ব্যাকরণের সন্ধি আর কৃৎ তদ্ধিত শব্দসিদ্ধি পড়তে লাগল’[10]।
১৩.১.৩ বাংলার সংস্কৃতায়ন ও দীর্ঘকালীন ক্ষতিঃ বিভেদের বীজ বপন
- লেখক দেবোত্তম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাহল কথিত মোগল-পাঠান যুগে (১২০৫ এ বখতিয়ার খিলজি থেকে ১৭৫৭র সিরাজদ্দৌল্লা পর্য্যন্ত) সময়ে রচিত হয়েছিল কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, একাধিক মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যমঙ্গল ও চৈতন্যচরিতামৃত। অর্থাৎ এসময়ে পদ্য বাঙ্গলা সাহিত্য ছিল রত্নপ্রসবিনী।
- “ সেই আমলে যেমন একাধিক মুসলমান কবি বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছিলেন; সৈয়দ আলাওল লিখেছিলেন ‘পদ্মাবতী কাব্য’; তেমনই রামপ্রসাদ সেন কিংবা ভারতচন্দ্রের সাহিত্যকর্মেও বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্রাত্য ছিল না”।[11]
- দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন— ‘ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে ব্রাহ্মণ পন্ডিত-মন্ডলী ‘দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধী-সমাজের অপাংক্তেয় ছিল’।
- তাহলে বাংলা ভাষা সম্মান পেল কবে? দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে মুসলমান বিজয় বাঙ্গলাভাষার সেই শুভদিন নিয়ে এল। মুসলমানেরা ইরাণ ,তুরাণ যেখান থেকেই আসুন, ‘বঙ্গদেশ বিজয় করে বাঙালী সাজলেন। তাঁরা বাণিজ্যের অছিলায় বিদেশ থেকে লুঠতরাজ করতে আসেননি। এদেশে এসে দস্তুরমত এদেশবাসী হয়ে গেলেন। ‘হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাভাষা যেমন আপনার , মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল’। শেষ করলেন এই কথা বলে ‘ এ হেন প্রতিকূল ব্রাহ্মণসমাজ কই হিন্দুরাজত্ব থাকিলে বাঙ্গলাভাষাকে রাজসভার সদরদরজায় ঢুকিতে দিতেন? সুতরাং এ কথা মুক্তকন্ঠে বলাযাইতে পারে যে, মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলাভাষাকে রাজদরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতন ভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন’।[12]
আজকে ভুতপূর্ব পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং সমান্তরাল সাহিত্য চর্চার নিরিখে দীনেশচন্দ্র সেনের বক্তব্য বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়।
- অথচ, আমাদের পাঠ্যপুস্তক এমন ঘরাণায় তৈরি হোল যে মুহম্মদ শহিদুল্লাকে কলম ধরে আফশোস করতে হচ্ছেঃ “আমাদের শিশুগণকে প্রথম হইতেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভাল ছেলে। কাসেম বা আবদুল্লা কেমন ছেলে, সে তাহা পড়িতে পায় না। এখান হইতেই সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে পাঠ্যপুস্তকে ----- হিন্দু মহাজনদিগের আখ্যানই পড়িতে থাকে। স্বভাবতঃ তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের মধ্যে বড় লোক নাই। এই সকল পুস্তক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্ববিহীন করা হয়। হিন্দু বালকগণ ঐ সকল পুস্তক পড়িয়া মনে করে , আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয়। মোসলমানেরা নিতান্ত ছোট জাত। তাহাদের মধ্যে ভাল লোক জন্মিতে পারে না। এই প্রকারে রাষ্ট্রীয় একতার মূলোচ্ছেদ করা হয়”[13]।
- এই কটু সত্য হজম করতে কেমন কেমন লাগছে? বেশ, রবীন্দ্রনাথ এ’ব্যাপারে কী বলেছেন দেখা যাক।
“ বাঙালি হিন্দুর ছেলে তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ও ইতিহাস এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দু শাস্ত্র ও ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না।
--বাংলা বিদ্যালয়ে হিন্দু ছেলের পাঠ্যপুস্তকে তাহার স্বদেশীয় নিকটতম প্রতিবেশী মুসলমানের কোন কথা না থাকা অন্যায় এবং অসংগত। ---বাঙালি মুসলমানে্র সহিত বাঙালি হিন্দুর রক্তের সম্বন্ধ আছে, এ কথা আমরা যেন কখনো না ভুলি”। [14]
এই গুরুত্বপূর্ণ অবহেলিত প্রেক্ষিতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখক দেবোত্তম বর্তমান পাঠকের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
১৩.২ বিদ্যাসাগর রচিত দুটি পাঠ্যবইঃ ভাষা ও অন্তর্বস্তু
লেখকের বক্তব্যঃ বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্ম শুরু হয় অনুবাদ গ্রন্থ থেকে- বেতাল পঞ্চবিংশতি (হিন্দি), বাঙ্গালার ইতিহাস (ইংরেজি) ও বোধোদয় দিয়ে। এগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সিবিলিয়ানদের জন্য প্রাথমিক বাংলা পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা, কারণ তখন ভাল বই ছিল না। প্রথম অনুবাদ বেতাল পঞ্চবিংশতি- ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ মার্শালের নির্দেশে।
এবার আসা যাক লেখকের আপত্তিগুলোতে।
পূর্বপক্ষঃ
- “ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে গ্রন্থটি পাঠ্য হিসেবে চালু হওয়ার পরে, মার্শালের অনুরোধে বাংলা সরকার বাংলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বেতালপঞ্চবিংশতিকে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে মনোনীত করে। কিন্তু হিন্দু কলেজের থেকে আপত্তি ওঠে অশ্লীল ও আদিরসাত্মক অংশ নিয়ে। দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে স্বয়ং বিদ্যাসাগর জানান যে ‘অশ্লীল পদ, বাক্য ও উপাখ্যানভাগ পরিত্যক্ত হইয়াছে’।[15]
- “ সুকুমারমতি বালকেরা এই পাঠ্যপুস্তকের দৌলতে জীবনের প্রথম থেকেই বুঝবে স্ত্রীলোকের পক্ষে ‘সতীত্বপ্রতিপালন করাই সর্বাপেক্ষা প্রধান ধর্ম’ এবং ‘সতীত্বভঙ্গে প্রবৃত্ত হওয়া অসতীর কর্ম’।“ নারীদের সম্মান বলতে বালকদের কী শিক্ষা দিচ্ছেন বিদ্যাসাগর?
- এর ভাষা বেশ আড়ষ্ট। “জীবনের প্রথমেই এই ছাত্ররা বাংলা ভাষার ‘দৈনন্দিন ব্যবহৃত চলতি বুলির পরিবর্তে অভ্যস্ত হতে হবে এই ধরণের সংস্কৃতাশ্রয়ী, সমাসবহুল, কৃত্রিম গদ্যভাষার সঙ্গে—”।[16]
- মার্শাল প্রথম যে দু’টি বই অনুবাদের জন্য বেছে নিলেন তার একটিতে রয়েছে ‘হিন্দু রাজার মাহাত্ম্য বর্ণনা এবং অন্যটিতে ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের প্রশংসা’। এবং এই নির্বাচনের গভীরে লুক্কায়িত ছিল শাসকদের দীর্ঘদিনের মুসলমান বিদ্বেষ’’।[17] উদাহরণ, বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগের বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগর জানিয়েছেন যে পুরো বইটি পাদ্রী মার্শম্যানের লেখা ইংরেজি বইটির হুবহু অনুবাদ নয়। শেষ নয় অধ্যায় নিলেও কিছু অংশ বাহুল্যবোধে পরিত্যক্ত হয়েছে এবং কোনও কোনও বিষয় আবশ্যকবোধে যুক্ত হয়েছে। এই পুস্তকে “ অতি দুরাচার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন আরোহণ অবধি, চিরস্মরণীয় লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক মহোদয়ের অধিকারসমাপ্তি পর্য্যন্ত , বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে”। [18] (নজরটান লেখকের)।
- কাঁচরাপাড়ার বৈদ্যনাথ বন্দোপাধ্যায় মার্শম্যানের গ্রন্থটির সমালোচনা করে লেখেন যে মার্শম্যান তাঁর ওই ইতিহাস বইয়ে আসলে খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের জন্য হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রপদায়ের মানুষদের বিকৃত রূপে উপস্থাপিত করেছেন।। এতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মান্তিক ঘটনার জন্য বিদ্যাসাগর মাত্র তিনটি বাক্য বরাদ্দ করেন। ক্লাইবকে বীর দেখান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভুয়সী প্রশংসা করেন। ঔপনিবেশিক হিন্দু আইন নিয়ে ‘ইচ্ছাকৃত’ নীরবতা পালন করেন। এভাবে ‘ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শক্তির’ গুণগানে অনুবাদটি শেষ করেন। এভাবে বিদ্যাসাগরের সৌজন্যে ‘শিশুদের মনে রোপণ করা হয় বৃটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য ও মুসলমান শাসকদের প্রতি বিদ্বেষের বীজ’।[19]
- রবীন্দ্রনাথ এই ধরণের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কয়েক দশক পরে আপত্তি তুলেছিলেন। “ অস্ত্র হস্তে ধর্মপ্রচার মুসলমানশাস্ত্রের অনুশাসন, এ কথা যদি সত্য নাহয় তবে সে অসত্য আমরা শিশুকাল হইতে শিখিলাম কাহার কাছে? হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মনীতি ও ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে ইংরাজ লেখক যাহাই লিখিতেছে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রগণ কি তাহাই নির্বিচারে কন্ঠস্থ করিতেছে না? এবং বাংলা পাঠ্যপুস্তক কি তাহারই প্রতিধ্বনি মাত্র নহে”?[20]
উত্তরপক্ষঃ
- ১ এবং ২ঃ শুধু দুই দশক আগেই নয়, আজও স্বাধীন ভারতবর্ষের জনমানসে নারীদেহ নিয়ে ভিক্টোরিয়ান মর্যালিটি প্রবলভাবে রয়েছে। তাই আজও আইনে ডোমেস্টিক রেপের ধারণা স্বীকৃতি পায়নি। বহুক্ষেত্রে ধর্ষিত মেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। প্রায় একশ’ সত্তর বছর আগে বিদ্যাসাগরের থেকে কোন মূল্যবোধ আশা করা যায়? বর্তমান শতাব্দীর? তার চেয়ে বড় কথা বইটি ফরমায়েসি অনুবাদ, বিদ্যাসাগরের নিজস্ব নয় । বেতালপঞ্চবিংশতির গল্পগুলো কয় শতাব্দী আগের? মহাভারত রামায়ণ থেকে সমস্ত পুরাণকথায় ‘সুকুমারমতি বালকেরা’ নারীর পাতিব্রত্য ও সতীত্ব নিয়ে কী শেখে?
- ৩ বইটি বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রচেষ্টা, তায় মননে রয়েছে সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা। এই আড়ষ্টতা উনি কাটিয়ে উঠেছেন অভিজ্ঞান শকুন্তলম এর অনুবাদে। কোলকাতায় একসময়ের অনুমোদিত পাঠ্যবইয়ে “ শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা’ অংশটি মনে করুন। এছাড়া রয়েছে বিদ্যাসাগরের একটি মৌলিক রচনা-‘প্রভাবতী সম্ভাষণ ‘যা উনি বন্ধুর শিশুকন্যা প্রভাবতীর অকালমৃত্যু হওয়ায় লিখেছিলেন। এটায় একেবারে মুখের কথ্য ভাষা রয়েছে-যেমন “তুই আমাকে ভালবাসবি না? আমি ভালবাসব”।
--আর দুই শতাব্দী আগে কোন এশিয়াটিক ভাষায় বা ইংরেজিতে পাঠ্যবইয়ে এলিট ভাষার রূপ ( যেমন চীনে মান্দারিন) না শিখিয়ে কথ্য বা দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষা শেখানো হত?
- ৪ বেতালপঞ্চবিংশতির গল্পগুলো হিন্দুরাজার মহিমা প্রচার? কোন দেশের রূপকথায় রাজা ও রাজপুত্র নায়ক নয়? তাহলে আরব্যোপন্যাস মুসলিম রাজার মহিমা প্রচার? রুশ ও উইক্রেনীয় রূপকথা জারের মহিমা প্রচার মাত্র?
- ৫ এবং ৬ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য যথাযথ। কিন্তু পাদ্রী মার্শম্যানের লেখা প্রচারমূলক ইতিহাসে আর কী থাকবে? আমরা কি ভুলে যাচ্ছি যে এটি কলেজে চাকরি করতে আসা বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় ফরমায়েশি অনুবাদগ্রন্থ মাত্র? ঠিক কথা, উনি কোন কোন জায়গা বাদ দিয়েছেন, কিছু জুড়েছেন। কিন্তু মূল বইয়ের সঙ্গে তুলনা করে ঠিক মত সেই জায়গাগুলো খুঁজে বের না করে অপছন্দের জায়গাগুলো সম্ভবতঃ বিদ্যাসাগরের বলে ইশারা করা?
১৩.৩ বিদ্যাসাগরের পাঠ্যপুস্তকঃ বোধোদয় ও বর্ণপরিচয়
এর পরে বিদ্যাসাগর বালকদের জন্য যে প্রাইমার (বর্ণ পরিচয়) ও নীতিশিক্ষার জন্য ‘বোধোদয়’ লিখলেন। লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন—বোধোদয় লেখা হয়েছিল ১৮৫১ সালে শিশুশিক্ষার চতুর্থভাগ হিসেবে। বোধোদয় এর কনটেন্ট নিয়ে লেখক কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন এবং পূর্ববর্তী গবেষকদের নির্মিত কিছু মিথ সফল ভাবে ভুল প্রমাণিত করেছেন।
১৩.৩.১ তার মধ্যে প্রধান হোল ‘ঈশ্বর’ নিয়ে বিদ্যাসাগর বইটিতে কী পাঠ রেখেছেন। গোপাল হালদার ও বিনয় ঘোষের মত বিদ্যাসাগর গবেষকদের মতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগরের ‘ঈশ্বর’ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। বিনয় ঘোষের মতে বোধোদয়ের প্রথম কয়েক সংস্করণে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন আলোচনাই নেই। পরে কোন সংস্করণে যুক্ত হয়েছে এক ‘নিরাকার’ ঈশ্বর, যার তাৎপর্য বোঝা বালকদের সাধ্যের বাইরে।[21]
কিন্তু লেখক পরমেশ আচার্যের গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন যে প্রথম সংস্করণ থেকেই বিভিন্ন প্রসঙ্গে ঈশ্বর রয়েছে। বইটি ১৬প্রকরণে বিভক্ত; তার ১ম, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ষষ্ঠ প্রকরণে ঈশ্বর রয়েছেন স্বমহিমায়। উনি সর্বত্র বিদ্যমান, দয়ালু। আমাদের আহার দিচ্ছেন। মানুষকে হাত-পা ও কথা বলার শক্তি তিনিই দিয়েছেন। ‘অতএব, ঈশ্বরকে ভক্তি, স্তব ও প্রণাম করা আমাদিগের কর্তব্য কর্ম’।[22]
সত্যি কথা, খামোখা বিদ্যাসাগরকে ‘নাস্তিক’ সাজাবার দরকারটা কী?
১৩.৩.২ বর্ণপরিচয় ও শিশুশিক্ষা
লেখক দাবি করেছেন যে ‘বিদ্যাসাগরের বর্ণ-পরিচয়ের মাধ্যমেই বাঙালির অক্ষরজ্ঞানের সংগে প্রথম পরিচয় হয় ‘—এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। আগে ছাপাখানা ছিলনা, কিন্তু তালপাতার ভূর্জপত্রের বা তুলোট কাগজের হাতে লেখা পুঁথি ছিল যার মাধ্যমে পাঠশালায় বালকদের অক্ষরপরিচয় হত। শ্রীরামপুরের মিশনারীদের ছাপাখানা স্থাপিত হওয়ার পরে বিশেষ বিশেষ স্কুলের কথা ভেবে আলাদা আলাদা প্রাইমার তৈরি শুরু হল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোল বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের কথা ভেবে মদনমোহন তর্কালংকারের রচিত ‘শিশুশিক্ষা’। ১৮৪৯ সালে এর প্রথম ভাগ ছাপা হয় সংস্কৃত প্রেসে যার যূগ্ম মালিকানা ছিল বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন-এই দুই বন্ধুর। ১৮৫০ সালে স্কুল বুক সোসাইটির প্রেসে ছাপা হয় এর দ্বিতীয় ভাগ। মদনমোহনের ছিল ছড়ার হাত ও দেখার চোখ। তাঁর প্রাইমারে লেখা সহজ চিত্রময় ছড়া ১০০ বছর পরেও বালক-বালিকা সবার মধ্যে জনপ্রিয় ছিল।
আমিও পড়েছি।। আমার ঠাকুমার মুখেও শুনেছি। যেমনঃ
পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।।
এবং
উঠ শিশু মুখ ধোও পর নিজ বেশ।
আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ।।
বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় ( দুই ভাগ) লিখলেন ১৮৫৫ সালে। কিন্তু এর সঙ্গে আগের সমস্ত প্রাইমারের একটা মৌলিক তফাৎ হোল এটি কোন নির্দিষ্ট পাঠশালা বা স্কুলের জন্য নয়, বরং লেখকের ভাষায় বিদ্যাসাগর “আপামর বাঙালি পড়ুয়াদের বর্ণ ও বানানশিক্ষার জন্য বই দুটি লেখেন” এবং বর্ণমালার সংস্কার করে ১৬টি স্বরবর্ণ ও ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ নির্ধারিত করেন। বর্তমানে কেবল লি’কার বাদ দিয়ে তাই মেনে চলা হচ্ছে।
আপত্তি উঠেছে প্রাথমিক স্তরে তৎসম শব্দের বাহুল্য এবং ‘অপূপ’ বা ‘আরূঢ়’ গোছের অপ্রচলিত শব্দ ও বানানকে পাঠের অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে। আপত্তিগুলো যথাযথ , সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে তবে পন্ডিতের হাতে প্রথম প্রাইমার হিসেবে বিরাট কোন বিপর্যয় ঘটেনি বলে আমার মনে হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ আপত্তিগুলো বইয়ের কনটেন্ট বা অন্তর্বস্তু নিয়ে।
- প্রথমেই চোখে পড়ে ‘পড়া ও পাঠশালা যাওয়া সংক্রান্ত একাধিক বাক্য বা গদ্যাপাঠ’। স্পষ্টতঃ বিদ্যাসাগরের কাছে ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ এবং শিশু ও বালকদের বই লিখতে গিয়ে উনি খালি ওদের ছাত্রসত্ত্বাই দেখেছেন। ফলে খালি উপদেশ ও নিষেধাত্মক বাক্যে ভরা বই-‘গোল করিও না, খেলা করিও না’ ‘কখন পড়িতে যাইবে’ ,’ঈশান কিছুই পড়িতে পারেনা’ ইত্যাদি। গোটা বইটাতে কোথাও আনন্দ নেই, মজা নেই। ওই একটা ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ আছে, ব্যস।
- লেখকের উল্লিখিত শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। “বারণ-নিষেধ-ধমকের ব্যাপক আয়োজনেই বর্ণ-পরিচয়ে ‘পড়ো’ ক্রিয়াপদের বাড়বিহার।[23] শিবাজী খেয়াল করেছেন যে ‘পড়া’ ক্রিয়াপদটি প্রথমভাগে ৪০ বার এবং দ্বিতীয় ভাগে ৪৬ বার পরিবেশিত হয়েছে।[24]
- দ্বিতীয় পাঠের সমাপ্তিতে ভুবনের ফাঁসি কাঠে চড়ার আগে দাঁত দিয়ে মাসির কান কেটে নেওয়ার মত বীভৎস বর্ণনা কোনমতেই বালকদের পাঠ্য হওয়া উচিত নয়। এনিয়ে কোন দ্বিমত হতে পারেনা। রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠের (দুই ভাগ) সঙ্গে তুলনা করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়।
- এর চারদশক পরে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের নীতিশিক্ষা দেওয়ার তীব্র[25] বিরোধিতা করে রবীন্দ্রনাথ সাধনা পত্রিকায় লিখেছেন “শুদ্ধমাত্র ‘মরাল টেক্সটবুক’ পড়াইয়া নৈতিক উন্নতসাধন করা যায় একথা যদি কেহ বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে এ প্রকার বিশ্বাসকে সকৌতুকে প্রশংসা করাও ছাড়া আমি আর কিছু বলিতে চাহি না।।----- ‘চুরি করা মহাপাপ’, ‘কদাচ মিথ্যা কথা বলিয়ো না’ এই প্রকার বাঁধি বোল দ্বারা যদি মানুষের মনকে অন্যায় কার্য হইতে নিবৃত্ত করা যাইতে পারিত তাহা হইলে তো ভাবনাই ছিল না।“
- এখানে লেখকের সঙ্গে কেউ ভিন্নমত হবেন বলে মনে হয় না। সব কাজ সবার দ্বারা হয় না। সেই সময় অন্য উপযুক্ত প্রাইমার এবং পাঠ্যপুস্তক খুব বেশি না থাকায় বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণ পরিচয়’ কয়েক দশক ধরে খুব বিক্রি হয়েছিল, অনেক সংস্করণ হোল। কিন্তু নীতিশিক্ষার চোখ রাঙানো এবং ভুবনের ফাঁসির বীভৎস রসের কাহিনীযুক্ত বইটি কালের বিচারে শিশুশিক্ষার জন্য উপযুক্ত নয় বলেই ধরা হয়। ‘সহজ পাঠ’ এর মত প্রাইমার একজন রবীন্দ্রনাথই লিখতে পারেন।
১৩.৪ “বিদ্যাবণিক বিদ্যাসাগরঃ নীতিবোধের পরাকাষ্ঠা”
ওপরের পংক্তিটি বইটির তৃতীয় ভাগের চতুর্থ অধ্যায়ের শীর্ষ নাম। লেখক শুরুতেই বলেছেন যে বিদ্যাসাগর কখনও নিজেকে ‘শিক্ষাসংস্কারক’ বা ‘সাহিত্যসংস্কারক’ বলে চিহ্নিত করেননি, এবং তাঁর উপার্জন যে মূলতঃ নানাবিধ গ্রন্থের রচনা, মুদ্রণ ও প্রকাশনার সুবাদে অর্জিত তাও গোপন করেননি। ‘গ্রন্থবণিক’ বলে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জিত হননি। একটি আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নিজের পরিচয়ে বলেছিলেন—লেখক ব্যবসায়ী। ভূতপূর্ব প্রিন্সিপাল, অনেক সংস্কৃত ও বাঙ্গালা পুস্তকের লেখক।[26]
বিনয় ঘোষের প্রশংসা—‘মুদ্রক, প্রকাশক ও গ্রন্থকার হিসেবে তিনি যে স্বাধীন বাণিজ্যের পরিকল্পনা করেছিলেন তা তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে আর কেউ বিশেষ করেননি’—লেখকের কটাক্ষের হেতু হয়েছে।
এই অধ্যায়ে লেখকের বক্তব্যের সার হোল বণিক হতে গিয়ে বিদ্যাসাগর টাকাপয়সা লাভ-লোকসানের ঘোলাজলে ডুবে নিজের হাঁই মর্যাল স্ট্যান্ডিং থেকে নীচে নেমে এসেছিলেন। লেখকের ভাষায় “তাঁর গ্রন্থব্যবসাকে মসৃণ রাখার জন্য তিনি নীতিভ্রষ্ট হয়েছিলেন কিনা—সেই প্রসঙ্গটিও আমাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হবে”।[27]
পূর্বপক্ষঃ
- বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক থাকার সময়ে তাঁর বন্ধু ও কলেজের অধ্যাপক মদনমোহন তর্কালংকারের সঙ্গে আধাআধি ভাগীদারিতে প্রকাশনা ব্যবসায়ে নেমে পড়েন, পুঁজি না থাকায় ৬০০ টাকা ধার করে সংস্কৃত যন্ত্র নামে ছাপাখানা কেনেন এবং প্রথম প্রকাশিত বই ‘অন্নদামঙ্গল’এর ১০০ কপি প্রিন্সিপাল মার্শাল সায়েবের সৌজন্যে ৬০০ টাকায় কিনিয়ে সেই ধার শোধ করেন।
- নিজের সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল পদে থাকার সুযোগ নিয়ে এবং শিক্ষা সংসদের সম্পাদক মোয়াট সাহেবের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর এমন ব্যবস্থা করলেন যে মেডিক্যাল কলেজে বাংলা কোর্সের জন্য নির্বাচিত বইয়ের বেশির ভাগই তাঁর ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত । তারপর স্কুলে মাতৃভাষা শিক্ষার জন্য এমন কোর্স তৈরি করলেন যে অধিকাংশ পুস্তক তাঁর ছাপাখানা থেকে কেনা হবে।
- এভাবে তাঁর ব্যবসা এতটা ফুলে ফেঁপে ওঠে যে একটা সময়ে আকাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি না পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন। তার পরেও সরকারের তরফে বই ছাপার পুরো টাকা আগাম নিয়ে তাঁর বই বিক্রির প্রক্রিয়া অটুট থাকে।[28]
- তাঁর বইয়ের দাম বরাবরই বেশ বেশি। ‘বাজারে তাঁর বইয়ের বিপুল চাহিদা দেখে বিদ্যাসাগর এই দাম আরও বাড়িয়ে দেন। তখন ১৮৫৬ সালে জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডনের নিযুক্ত একটি কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে তার সম্পাদক রজার্স বিদ্যাসগরকে চিঠি লিখে জানান যে দাম কমাতে হবে, নইলে সরকার তাদের সাহায্য প্রাপ্ত এবং মডেল স্কুলগুলোর জন্য অন্য সুলভ বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেবে। এব্যাপারে বিদ্যাসাগরকে তাঁর সিদ্ধান্ত নভেম্বর মাসের মধ্যেই জানাতে হবে।
- বিদ্যাসাগর ওই ‘নভেম্বরের মধ্যেই জানাতে হবে’ শর্তকে ‘ so very objectionable’ বলে কটাক্ষ করে উত্তর দিলেন ১৩ ডিসেম্বরে। সোজা জানিয়ে দিলেন নির্ধারিত দাম আদৌ অযৌক্তিক নয়, ফলে কমানো সম্ভব নয়। কমিটি ইচ্ছে করলে অন্য জায়গায় যেতে পারে।[29]
- ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহ স্তিমিত হলে বিদ্যাসাগর দরাদরি করে সাতটি বইয়ের দাম লিস্টি করে প্রায় ২৮% কমাতে রাজি হন, কিন্তু এক শর্তে। সরকার যদি বইগুলোর আগামী দুই বছরে চাহিদা অনুমান করে পুরো বই ছাপানোর টাকাটা তাঁকে আগাম দেন! এভাবে বিদ্যাসাগর চার মাসেরও কম সময়ে সরকারের থেকে অগ্রিম বাবদ ৮২০৩ টাকা ২ আনা আদায় করেন।[30]
- ব্যবসার খাতিরে বিদ্যাসাগর একই বিষয়ে অন্য লেখকের বইকে পাঠ্যতালিকা ভুক্ত করতে বাধা দিতেন। দুটো উদাহরণ যথেষ্ট। কোন প্রেস তাদের প্রকাশিত কোন বাংলা বইকে সরকারি তালিকাভুক্ত করতে চাইলে শিক্ষাবিভাগ বিদ্যাসাগরের মত জানতে চাইত। যেমন, উনি ১৮৫৭ সালের ২৯শে অক্টোবর কালিদাস মৈত্রের ভুগোল বাতিল করলেন এই বলে যে বইটিতে কয়েকটি জায়গায় ‘হিন্দুদের ধার্মিক গ্রন্থের থেকে ভিন্নমত রয়েছে’। বইতে বাসুকিনাগের মাথায় পৃথিবী ইত্যাদি পৌরাণিক ধারণাকে খন্ডন করা হয়েছে। কালিদাস মৈত্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ পুস্তকের প্রতিবাদ করে একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। আবার পাঁচ মাস পরে বিদ্যাসাগর তাঁর ‘ভূগোল বিবরণ’ এর জন্য প্রথমে ১৫০০ কপি এবং বছরের শেষে ৫০০০ কপি বরাত পেয়েছিলেন।[31]
- আবার ওনার প্রিয় ছাত্র কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য বলছেন যে শ্যামাচরণ সরকার খাঁটি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় একখানি ব্যাকরণ লিখেছিলেন, বইটা ভাল হয়েছিল। কিন্তু যেই” বিদ্যাসাগর সে বইখানাকে pooh pooh করিলেন আম্রাও সকলে বিদ্যাসাগরের সহিত যোগ দিলাম। শ্যামাচরণ বাবু মাথা তুলিতে পারিলেন না”।[32]
- কৃষ্ণকমল আরও জানিয়েছেন যে বিদ্যাসাগর ঈশ্বর গুপ্ত, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র মাইকেলের ব্ল্যাংক ভার্স –এসব কিছুই পছন্দ করতেন না। ওঁর আপত্তি ছিল ম্যাটার নিয়ে নয় , স্টাইল নিয়ে। কৃষ্ণকমল এর অনুমান--বিদ্যাসাগরের প্রফেশনাল জেলাসির পেছনে হয়ত একটা আশংকা কাজ করত যে অন্য কেউ সাহেবসুবোর কাছে বেশি খাতির না পেয়ে যায় ![33]
- রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে ‘বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ আখ্যা দিয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিয়েছেন।। আবার শিশিরকুমার দাশ জানিয়েছেন যে বিদ্যাসাগর ১৮৫০ পর্য্যন্ত কোন ইংরেজি যতিচিহ্ন গ্রহণই করেননি। কাজেই যতিচিহ্নের প্রথম সার্থক ব্যবহারের কৃতিত্ব কী করে তাঁকে দেয়া যায় ! আর আমরা খেয়াল করিনা যে পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের অতিরিক্ত বিরামচিহ্ন ব্যবহারের পক্ষে সায় দিতে পারেননি। [34]
উত্তরপক্ষঃ
- ১ থেকে ৬ নম্বর নিয়ে বলার কিছুই নেই। বিদ্যাসাগর বাজার বুঝে নিজের ব্র্যান্ড নেম দাঁড় করালেন এবং ইংরেজ সরকারে চাকরির অভিজ্ঞতা ও ‘কনেকশনে’র পুরো সুযোগ নিয়ে বাজারে কব্জা জমালেন। বিশুদ্ধ ‘গ্রন্থবণিক’।
- ৫ এবং ৬ থেকে দেখা যায় শক্ত মেরুদন্ড। নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু সম্বন্ধে সঠিক তথ্য থাকায় ইংরেজ বড়কর্তাদের মুখের উপর বইয়ের দাম কমানোর নির্দেশকে ‘না’ বলা—এটা ঠিক লেখকের নির্মিত ‘শাসকের মোসাহেব’ ছাবির সঙ্গে খাপ খেল কি?
- ৭ ও ৮ থেকে এটা স্পষ্ট যে বিদ্যাসাগর ঈশ্বর ছিলেন না, নিরাকার তো নয়ই। বরং ক্রোধ, ঈর্ষা, অহংকার পুরোমাত্রায় বর্তমান।
- ৯ নিয়ে আর একটু বলার যে ভিন্নরুচির্হি লোকাঃ। সাহিত্য ও তার বিচারে পছন্দ-অপছন্দ পূর্বাগ্রহ থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ ও কল্লোল যুগ খেয়াল করুন। বা তার পর পরিচয় ও কল্লোল যুগ! বিদ্যাসাগর সাহিত্যরুচিতে একেবারে প্রাচীনপন্থী। মজার ব্যাপার হোল উনি মাইকেলের অমিত্রাক্ষর পছন্দ করতেন না। এ’নিয়ে ব্যঙ্গ করে ছড়াও বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মাইকেলকে টাকা দিয়ে ঋণজাল থেকে মুক্ত করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে এসেছিলেন বিদ্যাসাগর।
- রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের পরের দিকের রচনাতে যতিচিহ্নের বাড়া বাড়ি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন –এই তথ্য তুলে ধরে লেখক আমার মত অনেক পাঠকের ধন্যবাদের পাত্র হবেন। কিন্তু যতিচিহ্ন ও গদ্যরীতি কি এক হোল?
লেখক মেনেছেন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরকে “বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী” বলে আখ্যা দিয়েছেন। বলছেন” বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃংখল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন”। রবীন্দ্রনাথ জানেন যে তাঁর পর বাংলাভাষা অনেক এগিয়ে গিয়েছে। তবু নির্দ্বিধায় বলেন, “ কিন্তু যিনি এই সেনার রচনাকর্তা, যুদ্ধজয়ের যশোভাগ সর্বপ্রথমে তাঁহাকেই দিতে হয়।“[35]
অথচ লেখক মাত্র যতিচিহ্নের সমালোচক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে বিদ্যাসাগরের গদ্যশিল্পের প্রশংসক রবীন্দ্রনাথকে খারিজ করতে চাইছেন। তাই অনায়াসে দাঁড়ি টানলেন এই বলে যে ‘আদ্যন্ত একটি ভ্রান্ত ধারণার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়ে চলে ‘গদ্যশিল্পী’ বিদ্যাসাগরের স্মৃতিসৌধ’।[36]
১৪.০ উপসংহার
তাহলে কী দাঁড়াল? দুটো জিনিস, ব্যক্তি বিদ্যাসাগর এবং তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা।
ব্যক্তি বিদ্যাসাগর অবশ্যই কোন ঈশ্বর নন, ষড়রিপুর মধ্যে ক্রোধ এবং মাৎসর্য তাঁর মধ্যে প্রবল হয়ে মাঝেমধ্যেই বিচারবুদ্ধি ঘুলিয়ে দেয়। তাঁর অহংবোধ প্রবল। গাঁয়ের এক মুরুব্বি পরিবারকে কথা দিয়েছেন বলে চাইতেন যে বিধবাবিবাহ করতে আসা একটি পরিবারকে তাঁর ভাইয়েরা যেন আশ্রয় না দেয়, বিয়ে দিলে অন্য গ্রামে নিয়ে গিয়ে তবে। বহুবিবাহ প্রশ্নে মত পাল্টানোয় এতদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে খেউড় চালিয়ে যান, তারানাথের পুত্রকেও রেহাই দেন না। বইয়ের ব্যবসায়ে নিজের ব্র্যান্ডের খাতির প্রতিযোগী অন্য বইগুলোকে অনেক সময় অন্যায় ভাবে খারিজ করেছেন। বিশিষ্ট ব্রাহ্ম পরিবারের বিধবাবিয়েতে যেতে রাজি হননি তাঁরা হিন্দু নয়, ব্রাহ্ম বলে। তবে চাকরির লোভ দেখিয়ে প্রথম বিধবা বিবাহ করানোর অভিযোগটি তথ্যগত ভাবে ভুল, লেখকের অনিচ্ছাকৃত।
আবার একই বিদ্যাসাগর নিজের একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন জনৈক বিধবা নারীর সঙ্গে। নিজের মেয়েকে বাল্যবিবাহ/গৌরীদান করেননি। নিজে বা তাঁর পরিবারের কেউ বহুবিবাহ করেননি। ব্যবসায়ে অর্জিত অর্থ অকাতরে সামাজিক আন্দোলন ও প্রচারে ব্যয় করেছেন। বিধবাবিবাহ দিতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। শিরদাঁড়া সোজা রেখে সায়েবদের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। বইয়ের দাম কমাতে শিক্ষাবিভাগের বড়কর্তাকে চিঠি লিখে অস্বীকার করেছেন। তাঁকে ঠিক ঔপনিবেশিক প্রভুদের ধামাধরা বলা যায় কি?
লেখকের মূল বক্তব্য-সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর ডাহা ফেল। বিধবাবিবাহ আইন কেবল উচ্চবর্ণের বিধবাদের জন্য এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্যএবং এতে নিম্নবর্ণের বিধবাদের সর্বনাশ ।
এই বিশ্লেষণটি বড্ড সরলীকৃত। মিতাক্ষরা হোক কি দায়ভাগ, কোন ব্যাখ্যাতেই মৃত স্বামীর ছেলে বা নাতি থাকলে বিধবার সম্পত্তির অধিকার ছিলনা। যা ছিল না তাকে কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ কল্পিত। আর বিধবাবিবাহ আইনের ২নং ধারায় বিধবার স্ত্রীধনকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। এছাড়া হিন্দুবিধির উপরের দুটো ব্যাখায়তেই বিধবার নৈতিক জীবনযাপনকে অবশ্যপালনীয় পূর্বশর্ত রাখা হয়েছিল। বিধবাবিবাহ আইন এই ছদ্ম- নৈতিকতাকে বাদ দিল।
স্মার্ত রঘুনন্দন অনেক চেষ্টা করেও সমস্ত হিন্দু জাতের জন্যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রানুমোদিত সিদ্ধ করতে না পেরে কেবল শূদ্র বা নিম্নবর্ণের জন্য বিধান দিলেন। বিদ্যাসাগর করলেন বাকি ২০% এর জন্যে।
বিধবাবিবাহ আইনের ভূমিকা (Preamble) স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে এই আইনের উদ্দেশ্য কেবল হিন্দুসমাজের যে অংশের বিধবাদের বিবাহ নিষিদ্ধ তাদের রাস্তা খুলে দেয়ার জন্যে।
গবেষক লুসি ক্যারল ও সমাজতত্ত্ববিদ মীরা কোশাম্বি দেখিয়েছেন যে সহবাস সম্মতি আইন, বিধবাবিবাহ আইন ও বহুবিবাহ নিরোধক আইন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং সহবাস সম্মতি আইন পাশ করানো নারীমুক্তির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কাজেই লেখকের থিসিসটিকে-- ‘ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্দেশে বিধবাবিবাহ আইনটিকে পাশ করানোর জন্য সহায়তা করা ছাড়া’ বিদ্যাসাগর ব্যর্থ—মেনে নেওয়া কঠিন।
গবেষক স্বপন বসু বলছেনঃ
‘সমকালীন নিন্দা-প্রশংসার মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগরের যে ছবিটি বেরিয়ে আসে, সেটিও কিন্তু কম উজ্বল নয়। আর নয় বলেই, বিদ্যাসাগর আজও বাঙালীসমাজে এক সমাদৃত পুরুষ হয়ে আছেন, আর থাকবেন-ও’।
স্বপন বসু, ‘সমকালে বিদ্যাসাগর’, পৃ-২০৫
কিন্তু দেবোত্তমের বইটির থিসিসের সঙ্গে একমত না হলেও তাকে উপেক্ষা করা কঠিন। চারশ’ পাতার বইটি ওই সময়ের রাজস্ব আদায় পদ্ধতি, সামাজিক আন্দোলন ও বাংলা গদ্যের গড়ে ওঠার অসাধারণ সব দলিলের রেফারেন্সে পূর্ণ, চমৎকার আকরগ্রন্থ।
দেবোত্তমের তিনটে বিশ্লেষণ মূল্যবানঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশের পথে কারকনতত্ব্বগুলোর পরিচয় এবং ভাষার সংস্কৃতায়নের ও বামুনগিরির ফলে আমাদের পাঠ্যপুস্তক এবং সাহিত্য থেকে দলিত, নারী ও মুসলমানদের প্রান্তিক হয়ে যাওয়া –যার মূল্য আজও চোকাতে হচ্ছে।
(সমাপ্ত)
[1] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৪১।
[2] A Grammar of the Bengali Language, পৃঃ ২০৭-০৮।
[3] সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস, কলকাতা, ১৩৬৬, পৃঃ ৩২-৩৩।
[4] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৪৯।
[5] সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস, পৃঃ ১৪১।
[6] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৫০।
[7] ঐ।
[8] শিবনাথ শাস্ত্রী, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, কলকাতা , ২০১৯, পৃ-৯২-৯৩।
[9] হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনাসংগ্রহ, দ্বিতীয় খন্ড, কলকাতা ১৯৮১, পৃঃ ৫৬৪।
[10] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৪৭।
[11] ঐ, পৃঃ ৩৪৪।
[12] দীনেশ্চন্দ্র সেন, ‘বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব’, বিচিত্রা, মাঘ ১৩৩৫, পৃ- ১৮৩-৮৬।
[13] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৭৩।
[14] ‘মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা’; রবীন্দ্র রচনাবলী, সপ্তদশ খন্ড, কলকাতা ১৪১০, পৃঃ ৩৫০।
[15] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৬০।
[16] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৬১।
[17] ঐ, পৃঃ ৩৫৮।
[18] ঐ, পৃঃ ৩৬৩।
[19] ঐ, পৃঃ ৩৬৫।
[20] ঐ, পৃঃ ৩৬৫।
[21] বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, কোলকাতা, ২০১১, পৃঃ ৩৮১।
[22] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বোধোদয়, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ২০১১; পৃঃ ১-২।
[23] শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘আবার শিশুশিক্ষা’, ২০১০, পৃঃ ৭২।
[24] ঐ, পৃঃ ৭১।
[25] ছাত্রদের নীতিশিক্ষা; রবীন্দ্র রচনাবলী, সপ্তদশ খন্ড, কলকাতা , ১৪১০; পৃঃ ৩৪১।
[26] বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৯; পৃঃ ২৫৫।
[27] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৯০।
[28] ঐ, পৃঃ ৩৯৫।
[29] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৩৯৩।
[30] ঐ, পৃঃ ৩৯৫।
[31] ঐ, পৃঃ ৩৯৭।
[32] বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৯৫৯, পৃঃ ২৭।
[33] ঐ, পৃঃ ৪৫।
[34] ‘চিহ্নবিভ্রাট’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃঃ ১৬৯।
[35] ‘বিদ্যাসাগর চরিত’, রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খন্ড, কলকাতা, ১৩৬৮, পৃঃ ৩৮৩।
[36] দেবোত্তম চক্রবর্তী, ‘বিদ্যাসাগরঃ নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নিমাণের আখ্যান, পৃঃ ৪০১।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।