৯.০ হিন্দু আইন প্রণয়ন ও বিদ্যাসাগর
আমাদের আলোচ্য বইটির দ্বিতীয় পর্বের বিষয় হল ‘সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগর’। তাতে লেখক নতুন তথ্যের দৌলতে বিদ্যাসাগরের উপরোক্ত বাঁধানো ছবিটির উপর নতুন আলো ফেলার দাবি করেছেন। রয়েছে হিন্দু কোড বিল প্রণয়ন, বহুবিবাহ এবং বিধবাবিবাহ আইনের আন্দোলন ইত্যাদির জেনেসিস এবং তাতে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা।
লেখক দেখিয়েছেন যে ইংরেজ আসার আগে মোগল আমলে ভারতে বিচারপদ্ধতি কী ছিল ও কলোনিয়াল শাসক তাতে কী কী পরিবর্তন করল। উনি বিস্তারিত আলোচনা করে দেখাতে চেয়েছেন যে ইংরেজের গ্রন্থিত হিন্দু আইন কতটুকু শাস্ত্র মেনে তৈরি হয়েছিল বা তার কোন অংশটুকু সাহেবরা নিজেদের স্বার্থে বিকৃত করেছে এবং তার ফলে মেয়েরা এবং বিধবারা তাদের প্রাচীন প্রথায় কতটুকু সম্পত্তির অধিকার ছিল জয়া হারিয়েছে। এবং সর্বশেষে এই আইন প্রণয়নে এবং তাঁর সংশোধনে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ঠিক কী ছিল।
খুব মূল্যবান আলোচনা সন্দেহ নেই।
৯.১ ‘জেন্টু ল’ ও হিন্দু আইন:
প্রাক-ঔপনিবেশিক ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) ও দেওয়ানি (সিভিল) বিচারব্যবস্থা কেমন ছিল?
লেখক দেখাচ্ছেনঃ ফৌজদারি আদালতে অপরাধের মাত্রা অনুসারে শাস্তির বিষয়টি দেখভাল করতেন একজন কাজি, একজন মুফতি ও দু’জন মৌলবি।
“অন্যদিকে দেওয়ানি আদালতে হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের উত্তরাধিকার, বিবাহ, জাতপাত এবং ধর্মসংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য, যথাক্রমে শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ও মৌলবিদের সাহায্য বা পরামর্শ নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে এ বিষয়ে কেবল আদালতের কাজিরাই চূড়ান্ত রায়দানের অধিকারী ছিলেন”। [1]
প্রাক-ঔপনিবেশিক ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) ও দেওয়ানি (সিভিল) বিচারব্যবস্থা কেমন ছিল?
১৭৬৫-৭২ দেওয়ানি আমলে বাংলার রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী মহম্মদ রেজা খাঁর বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে – হিন্দু প্রজাদের উত্তরাধিকার, বিবাহ, জাতপাত ইত্যাদি সম্পর্কিত বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের পরামর্শ নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। তাঁদের দ্বারা বিরোধের নিষ্পত্তি না হলে আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করা হত। তাঁদের মতামতকেই চুড়ান্ত মান্য করা হত।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরে লেখকের কতগুলো বক্তব্য মনে হয় একটু ঘেঁটে গেছে। আইন নিয়ে চর্চার আগে দরকার এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করে নেওয়া।
৯.১ প্রাক-ঔপনিবেশিক বঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি:
পূর্বপক্ষ:
১ ‘ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য আলাদাভাবে নির্দিষ্ট কোনও বিধিবদ্ধ আইন ছিল না’। সেই সময়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে স্থানীয় স্তরে যাবতীয় বিবাদ-বিসংবাদের নিষ্পত্তি হত, তাতে সন্তুষ্ট নাহলে কেউ আদালতে যেতে পারত। সেক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ব্যতিরেকে বাদী বা বিবাদী -দুপক্ষের জন্য একই আইন প্রযোজ্য ছিল।
২ ‘হিন্দু প্রজাদের উত্তরাধিকার, বিবাহ, জাতপাত ইত্যাদি সম্পর্কিত বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতদের পরামর্শ নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে পণ্ডিতদের মতামতকে আইন হিসেবে বিবেচনা করা হত না’।[3]
৩ পঞ্চদশ শতাব্দীর ভাষ্যকার রঘুনন্দন তাঁর “ব্যবহারতত্ত্বে” জানিয়েছেন-প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি শাস্ত্রীয় রীতিনীতির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় স্তরে বিবাদের মীমাংসা নাহলে লোকে রাজার শরণাপন্ন হবে। রাজা শাস্ত্র ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন। বিশেষজ্ঞ বাদী-বিবাদীকে প্রশ্ন করে মতামত দিলে রাজা চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করবেন।
৪ ফলে প্রাক-ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থায় যাবতীয় আইনি বিবাদের মীমাংসার বিষয়ে ব্রাহ্মণ অথবা শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতরা নন, রাজাই ছিলেন চূড়ান্ত রায়দানের অধিকারী।
৫ ভারতবর্ষে বৃটিশ প্রশাসন নিজেদের স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে প্রথম থেকেই প্রচলিত আইনব্যবস্থাটিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যে দেওয়ানি আইন আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়। [4]
উত্তরপক্ষ:
লেখকের উপরোক্ত বক্তব্যের সার-সংক্ষেপ করলে দাঁড়াবে—১) প্রাক -ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থায় হিন্দু এবং মুসলমানের জন্যে পৃথক আইন ছিলনা। এসব বৃটিশদের কীর্তি। ২) সাধারণতঃ স্থানীয় স্তরে বিবাদের মীমাংসা হত শাস্ত্রজ্ঞদের বিধান মেনে। ৩) সন্তুষ্ট না হলে প্রাচীন কালে রাজা, পরবর্তী কালে কাজী শেষ রায় দিতেন। এটাই ইংরেজ আমলে ম্যাজিস্ট্রেট হবে।
উপরোক্ত বক্তব্যে আমার আপত্তি কোথায়? আপত্তিটি ফৌজদারী ও দেওয়ানি বিধিকে গুলিয়ে ফেলায়।
ফৌজদারি অপরাধ কী?
নাগরিকের সম্পত্তি ও শারীরিক নিজতার উপর অপরাধ। এ হ’ল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। ক’ যদি খ নামক ব্যক্তির সম্পত্তি চুরি করে বা বলপূর্বক কেড়ে নেয় বা আক্রমণ, অপহরণ ও হত্যার মাধ্যমে শারীরিক ক্ষতি করে তবে তা’হবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক’য়ের অপরাধ। মামলা হবে ‘স্টেট বনাম ক’। কারণ এতে রাষ্ট্রের আইন শৃংখলাকে চ্যালেঞ্জ করে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে।
এ’ব্যাপারে কখনই হিন্দু-মুসলমানের জন্যে আলাদা আইন ছিল না। না প্রাক ঔপনিবেশিক যুগে, না ইংরেজ রাজত্বে, না আজকের স্বাধীন ভারতবর্ষে।
দেওয়ানি বিবাদ কী?
ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার, বাঁটোয়ারা, বিবাহপ্রথা, মৃতদেহ সংস্কার, ধর্মাচরণের বিধি, জাতপাত ইত্যাদি সামাজিক রীতিনীতি বা খাদ্যাখাদ্য সংস্কার জনিত বিবাদ, ব্যবসায় ও জীবিকা জনিত বিবাদ ইত্যাদি।
এ’ হল ব্যক্তি বনাম ব্যক্তির বিবাদ। ক’ যদি খ’য়ের মোটরবাইক চুরি করে বা পিস্তল দেখিয়ে কেড়ে নেয় –সেটা হল ফৌজদারী মামলা। কিন্তু যদি বলে তুমি আমার কাছে গাড়িটি বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছিলে। সময় পেরিয়ে গেছে , এবার তোমার বাইক আমার হয়ে গেল। এটা দেওয়ানি মামলা।
কোন যুগে হিন্দু এবং মুসলমানের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি আইন ছিল না। না প্রাক ঔপনিবেশিক যুগে, না ইংরেজ রাজত্বে, না স্বাধীন ভারতবর্ষে।
কারণ, হিন্দুর বিয়ে হয় সপ্তপদী গমন করে, মুসলমানের বিয়ে হয় বর-বৌয়ের তিনবার সম্মতি নিয়ে নিকাহনামা লিখিয়ে তাতে সাক্ষীর দস্তখত করিয়ে। হিন্দুর হয় দাহ, মুসলমানের গোর। হিন্দুর বিয়েতে দেনমোহর নেই, বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ম নেই, মুসলমানের তিন তালাক আছে, আবার পুনর্বিবাহের নিয়ম আছে। হিন্দুর সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা হত মিতাক্ষরা বা দায়ভাগ মেনে। মুসলমানের সব হয় শরিয়ত মেনে।
ব্যাপারটা হল সিভিল কোডের সঙ্গে বিশেষ সমুদায়ের আচার-ব্যবহার সংস্কৃতি সব মিশে আছে। লেখক কি বলতে চাইছেন প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে হিন্দু-মুসলমান সবার জন্যে একরকম ইউনিফর্ম সিভিল কোড ছিল? ইতিহাসের সাক্ষ্য, আমি যতদূর বুঝেছি, এর বিপরীত।
ফলে, লেখকের বক্তব্যঃ কোম্পানির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের একদল পন্ডিত ও মৌলবীকে দায়িত্ব দিয়ে তিনবছরের মধ্যে ধর্মশাস্ত্র, বিশেষ করে মনুসংহিতা ও শরিয়ত অনুসারে পৃথক ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’ আইন তৈরির জন্যে উদ্যম আসলে একটি ভ্রান্ত ধারণার ফসল। [5]
৯.২ মনুসংহিতা আদি হিন্দুদের জন্য আইন অথবা শুধু আচরণবিধি?
এবার লেখক পেশ করলেন আরেকটি সিদ্ধান্ত যার সঙ্গে একমত হওয়া বেশ কঠিন। সেটা হল “যে ধর্মশাস্ত্রের উপর বৃটিশরা এত গুরুত্ব আরোপ করে তাকে ‘আইন’ -এ পর্যবসিত করে, সেই ধর্মশাস্ত্রগুলি কোনকালেই হিন্দুদের কাছে ‘আইন’ হিসেবে বিবেচিত হত না। এই গ্রন্থগুলি ছিল মূলতঃ তাদের ‘Code of Conduct’ বা আদর্শ আচরণবিধির দ্যোতক”।[6]
পূর্বপক্ষ:
১ প্রখ্যাত স্কলার পি ভি কাণে বলেছেন যে ধর্মশাস্ত্রকাররা আসলে এমন আচরণবিধির কথা বলেছেন যা সমাজের সদস্য হিসেবে একজন ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাকে মানব অস্তিত্বের চরম লক্ষ্যে ক্রমান্বয়ে পোঁছতে সক্ষম করে তোলে।
২ ‘মনুর মতে, সমস্ত বর্ণের কাছে ধর্মের সংক্ষেপিত রূপ হল -অহিংসা, সত্যবাদিতা, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ না করা, পবিত্রতা ও ইন্দ্রিয়ের সংযম’।
৩ ‘অধিকন্তু ধর্মশাস্ত্রগুলি ‘অন্যায়’ কর্মকে অপরাধের পরিবর্তে ‘পাপ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিল এবং শাস্তি বা দন্ডদানের বদলে অনুতাপের প্রতীক হিসেবে কঠোর প্রায়শ্চিত্তের কথা বলেছিল।[7]
৪ “এই গ্রন্থগুলি ছিল মূলতঃ তাদের ‘Code of Conduct’ বা আদর্শ আচরণবিধির দ্যোতক”, আইন নয়।
উত্তরপক্ষ:
১ মনুসংহিতা আইন না আচরণবিধি সেটা ঠিক হবে কীভাবে?
পন্ডিত কাণে বা মনু নিজে সংহিতার উদ্দেশ্য নিয়ে যেসব ভাল ভাল কথা বলেছেন তা দিয়ে? নাকি মনুসংহিতায় বাস্তবে কী আছে, কেবল আচরণবিধি নাকি দন্ডেরও প্রাবধান আছে সেটা দেখে? সে তো আমরাও অহরহ শুনছি -সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস’!
অহিংসার পূজারী মনুর সংহিতার ভেতরে হিংসা ভর্তি। প্রাণদন্ড, হাত-পা-আঙুল ও লিঙ্গচ্ছেদের বিধান রয়েছে যে!
২, ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন আচরণবিধি, যেমন বিয়ের পদ্ধতি বা সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নিয়ম –এগুলোই তো দেওয়ানি আইন। সেযুগে স্থানীয় বিবাদের সমাধান বা কনসিলিয়েশন শাস্ত্রে বর্ণিত বিধি মেনেই হত। সেজন্যেই বিবাহ, দাহ ও শ্রাদ্ধে শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতের দরকার পড়ে। এবং ফাইনাল আর্বিটার বলুন বা অ্যাপেলেট কোর্ট হিসেবে রাজা অথবা কাজীর দল পন্ডিতের বা মৌলবীর শাস্ত্রব্যাখ্যা শুনেই তো শেষ রায় দিতেন। আইন আর কাকে বলে? রাজারা কিসের ভিত্তিতে ঠিক বা ভুল, উচিত বা অনুচিত ঠিক করতেন? অবশ্যই ধর্মশাস্ত্র মেনে।
স্থানীয় স্তরে আজও দেওয়ানি মামলার সমাধান হয়, যেমন ‘লোক আদালত’। কিন্তু তার পেছনে রাষ্ট্রের অনুমোদন থাকে এবং তাতে অনেক সময় আইনের খুঁটিনাটির চেয়ে সামাজিক প্রথা ও ব্যবহারকে গুরুত্ব দেয়া হয়। আরবিট্রেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী বিজনেসে বিবাদের সমাধান খোঁজা একটি আইনানুগ স্বীকৃত পদ্ধতি।
প্রথা বা আচরণবিধি ও আইনের মধ্যে তফাৎ?
আমার মতে যেটা অমান্য করলে শুধু পারিবারিক বা সামাজিক তিরস্কার জোটে বা পঞ্চায়েতের নিয়মে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় সেটা প্রথা বা আদর্শ আচরণবিধি। কিন্তু যে নিয়ম ভাঙলে প্রায়শ্চিত্ত নয়, দন্ড পেতে হয়, সামাজিক সংস্থার দন্ড বা রাজদন্ড (সরকারের প্রদত্ত শাস্তি) ঘাড়ে পড়ে সেটা অবশ্যই আইন। সেই অর্থে প্রায়শ্চিত্তের বিধান এবং রাজদন্ডের বিধান দুটোই মনুস্মৃতিতে আছে। কাজেই তার একটা অংশ অবশ্যই আইন।
লেখক এ’ব্যাপারে যাঁকে অনুসরণ করছেন সেই ডঃ নন্দিনী ভট্টাচার্য পন্ডা প্রথা ও আচরণবিধির তফাৎ বোঝাতে অধ্যাপক ডেরেটকে উদ্ধৃত করেছেন।
Derrett: Law is the body of rules(namely positive and negative injunctions, commands and prohibitions) which can be enforced by judicial actions
.[8]
অধ্যাপক ডেরেটের বক্তব্য ও আমার নিজস্ব প্রতীতির মধ্যে কোন মৌলিক তফাৎ আছে কি?
আবার ডঃ নন্দিনী ধর্মশাস্ত্রে ‘ব্যবহার’এর দায়রা বোঝাতে গিয়ে বলছেন Any dispute involving debt, trust, deposit, breach of contract, Sale, Purchase----- boundaries, limits, ----- distribution of legacies--- could be tried under the vyavahara.
[9] এগুলিই যে দেওয়ানি আইন বা সিভিল কোড, এ’নিয়ে কোন সন্দেহ আছে?
৩ গন্ডগোলটা হচ্ছে হাতীর লেজ বা শুঁড় নিয়ে। ধরুন, মনুসংহিতায় ১২টি অধ্যায়। এতে সৃষ্টিতত্ত্ব, পুরাণকথা, রাজার, ব্রাহ্মণের, নারী-পুরুষের আদর্শ আচরণবধি, যেমন আছে, তেমনই বিবাহ নিয়ে উচিত অনুচিত নিষেধ, মৃতের অন্তিম সংস্কার, সম্পত্তির উত্তরাধিকার রয়েছে। এমনকি ল অফ এভিডেন্স বা সাক্ষ্যদানের স্বীকৃত পদ্ধতিও রয়েছে। অর্থাৎ, ওতে সিভিল কোড, ট্রেসপাস অ্যাক্ট, গাঁয়ের বর্ডার ডিমার্কেশন, সিভিল প্রসিডিওর কোড, পেনাল কোড ও এভিডেন্স অ্যাক্ট, ট্যাক্সেশন কোড
—সবই রয়েছে, অবশ্য সে যুগের হিসেবে।
তাহলে মনুস্মৃতি আদর্শ আচার ব্যবহারের কোড , নাকি সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড, এভিডেন্স অ্যাক্ট, ট্যাক্সেশন অ্যাক্ট? আগেই বলেছি,মনুস্মৃতিওর ১২টি অধ্যায় বিবিধ বিষয়ের সমাহার। তাতে পুরাণকথা, আদর্শ আচরণবিধি ও রাজধর্ম এবং সাক্ষ্য বিধি ও দন্ডবিধি সবই আছে। মুশকিল হচ্ছে মনুস্মৃতিকে শুধু পুরাণ, শুধু আচরণবিধি, শুধু পাপ-পুণ্য ও প্রায়শ্চিত্তের নিদান বা শুধু হিন্দুর আইন ধরে নেওয়ায়। হাতির শুঁড়ও রয়েছে, দাঁতও আছে—সবটা মিলেই হাতি। কিন্তু দাঁতের কাজ দাঁত করে, শুঁড়ের কাজ শুঁড় করে।
৪ মনুতে ‘অন্যায়’কে পাপ বলে ‘দন্ডের’ বদলে প্রায়শ্চিত্তের কথা বলা হয়েছে—এই কথাটা একতরফা। কিছু কার্যকে পাপ এবং “মহাপাতক” ও “গৌণপাতক” বলা হয়েছে এবং তার জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান আছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় অংশে অন্যায়কে অন্যায় এবং তার জন্যে আর্থিক ও শারীরিক দন্ডের বিধান রয়েছে। এবং রাজ্য ও সমাজের রক্ষার জন্যে দন্ডদানে রাজাকে কঠোর হতে বলা হয়েছে।
যেমন মনুস্মৃতির অষ্টম অধ্যায়ে (রাজধর্ম) শ্লোক নং ৫১ থেকে ৪১২ পর্য্যন্ত কেবল দণ্ড নির্ধারণ। নবম অধ্যায়ের শ্লোক ২২৪ থেকে ২৯৩ অব্দি ফের দন্ডের বিধান, এমনকি ক্ষুর দিয়ে টুকরো টুকরো করে দোষীকে কাটতে বলা হচ্ছে। (৯/২৯২)।
✜ স্পষ্টতঃ লেখক এখানে বিশিষ্ট গবেষক ডঃ নন্দিনী ভট্টাচার্য্য পন্ডার থিসিস “Appropriation and Invention of Tradition: The East India Company and Hindu Law in Early Colonial Bengal” এর বক্তব্য থেকে প্রভাবিত। উনি ধর্মশাস্ত্রের বিধান সম্বন্ধে বলছেন - They lacked the necessary coercive element, the essential component of the law. The sastras defined ‘wrong’ actions as sins rather than crimes, and they could at best impose strictures and penances as symbolic of repentance.
[10]
লেখকের লেখায় প্রায় তাঁর শব্দশঃ প্রতিধ্বনি, লেখক সেই ঋণ খোলাখুলি স্বীকারও করেছেন।
✜ ওঁর পান্ডিত্যের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়েও আমি এই বিন্দুতে তীব্র অসহমত। নীচের শ্লোকগুলো খেয়াল করুন। এগুলো যদি coercive না হয় তাহলে আমার বলার কিছু নেই।
পাপ ও প্রায়শ্চিত্তের কথা রয়েছে মাত্র একাদশ অধ্যায়ের শ্লোক নং ৪০ থেকে ২৬৩ পর্য্যন্ত। দেখাই যাচ্ছে—পাপ ও প্রায়শ্চিত্তের বিধান রয়েছে মাত্র একটি অধ্যায়ে ২২৩টি শ্লোকে। অথচ দন্ড, মূলতঃ রাজা কর্তৃক আর্থিক ও শারীরিক দন্ডের (অঙ্গচ্ছেদ থেকে মৃত্যুদন্ড পর্য্যন্ত) বিধান রয়েছে অষ্টম ও নবম দুটি অধ্যায়ের সম্মিলিত ভাবে ৪৩০টি শ্লোকে।
এই দুটো শ্লোক খেয়াল করুন। রাজা কী শাস্তি দেবেনঃ
I am proceeding slowly, but surely, in this retired place, in the study of Sanskrit; for I can no longer bear to be at the mercy of our pundits, who deal with Hindu Law as they please, and make it at reasonable rates when they cannot find it readymade.[11]
পাঠকগণ! এই উর্দি ও তকমাওয়ালা বিদ্যালঙ্কার, ন্যায়লঙ্কার, বিদ্যাভূষণ ও বিদ্যাবাচস্পতিদের দেখচেন, এঁরা বড় ফ্যালা যান না। এঁরা পয়সা পেলে না করেন হ্যান কর্মই নাই! ---- যত ভয়ানক দুষ্কর্ম এই দলের ভিতর থেকে বেরোবে, দায়মালী জেল তন্ন তন্ন কল্লেও তত পাবেন না।[12]
“ My study examines inter alia how far the codification of the Hindu Law displaced Indian agencies”.
[1] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ৪৩।
[2] ঐ, পৃঃ ২০৬।
[3] ঐ, পৃঃ ২০৬।
[4] ঐ, পৃঃ ২০৭।
[5] ঐ, পৃঃ ২০৮।
[6] ঐ, পৃঃ ২০৮।
[7] ঐ, পৃঃ ২০৯।
[8] Derrett on Western notion of Law as quoted by Dr. Nandini Bhattacharya Panda, Appropriation and Invention of Tradition: The East India Company and Hindu Law in Early Colonial Bengal, Chap 1
[9]Ibid, Chap. 1.
[10]Appropriation and Invention of Tradition: The East India Company and Hindu Law in Early Colonial Bengal, Chap. 1 by Dr. Nandini Bhattacharya Panda
[11] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ২১৯।
[12] ঐ, পৃঃ ২৩১।
[13]N B Halhed, A Code of Gentoo Laws, Chapter II, Sec. I, page 29.
[14] ঐ
[15] মনুসংহিতা, অনুবাদ ও টীকাঃ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ, কলকাতা।
[16] দেবোত্তম চক্রবর্তী; “বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান”, পৃঃ ২১১।
[17]N B Halhed, A Code of Gentoo Laws, Chapter II, Sec. III, page 29.
[18]Appropriation and Invention of Tradition: The East India Company and Hindu Law in Early Colonial Bengal, Chap. 1 by Dr. Nandini Bhattacharya Panda
[19] মনুসংহিতা, অনুবাদ ও টীকাঃ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ, কলকাতার ভূমিকা।
[20] উইকিপিডিয়া।
[21]Appropriation and Invention of Tradition: The East India Company and Hindu Law in Early Colonial Bengal, Chap. 1 by Dr. Nandini Bhattacharya Panda
[22]E Hobsbawm and Terence Ranger, The Invention of Tradition. 1987.
[23] O’Hanlon and Washbrook, Histories in Transition. P. 115.
এতো বিস্তারিত লেখা পাওয়াই মুশকিল। লেখক সত্যি ধন্যবাদার্হ।