এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  প্রথম পাঠ

  • বীরসিংহের সিংহশিশু বিদ্যাসাগর বীর: পাঠ-প্রতিক্রিয়া (২)

    রঞ্জন রায়
    পড়াবই | প্রথম পাঠ | ১০ জুন ২০২১ | ২৮০২ বার পঠিত

  • (৪.০) ইংরেজের কলোনিয়াল শিক্ষা সংস্কার ও বিদ্যাসাগর

    (৪.১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেন প্রাচ্যভাষা শেখার মাথা ব্যথা?

    আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উদ্ভুত নব্য জমিদার ও নব্য ধনী মধ্যবিত্ত শ্রেণির গাঁটছাড়া বাঁধা রয়েছে কলোনিয়াল প্রভু ইংরেজের কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার একটি অভিমুখ হল ইংরেজি শিক্ষালাভ।

    কিন্তু এহ বাহ্য। আগে কোম্পানি যে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ শুরু করল তাতে পড়ানো হত-আরবি, ফার্সি, হিন্দুস্তানি, সংস্কৃত, বাংলা ও অন্যান্য দেশিয় ভাষা।

    কেন? উত্তরে লেখক সঠিক ভাবে দেখিয়েছেন ‘সওদাগরি ব্যবস্থা মসৃণভাবে চালাতে গেলে সওদাগরদের সওদার ভাষা শিখে নেওয়া খুব জরুরি। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার রায় যাতে শাসকস্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখে, সেদিকে দৃষ্টি রেখে আদালতে ভাষার ওপর দখলদারিও প্রয়োজনীয় বটে। তাই ইংল্যান্ড থেকে আগত ছোকরা সাহেব কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্য ১৮০০ সালে কোলকাতায় স্থাপিত হয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ’।[1]

    সেসময় দিল্লিতে মোগল বাদশা, গোটা দেশে রাজকাজ হয় ফার্সীতে।

    লেখকের মতে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস নব্যধনী আশরফ মুসলমান ও হিন্দু দেওয়ান-বেনিয়াদের দেখাতে চাইলেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’। তাই রাজধানী কোলকাতায় ১৭৮১ সালে স্থাপিত হোল কোলকাতা মাদ্রাসা এবং ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি। লেখক এদের প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার আগ্রহের চাবিকাঠি দেখেছেন ওয়ারেন হেস্টিংসের স্বীকৃতিতে – ‘to graft Western notions and methods on to the main stem of Eastern Institutions’.[2]

    বিদ্যাসাগর পরবর্তী কালে তাঁর অনুবাদগ্রন্থ বাঙ্গালার ইতিহাসে লেখেন যে গভর্নর জেনারেল লর্ড ময়রার (হেস্টিংস অফ মার্কুইস) আগে (১৮১৩-২৩) প্রজাদের বিদ্যাদান করা ‘রাজনীতির বিরুদ্ধ বলিয়া বিবেচিত হইত’। কিন্তু উনি ওই আদেশ অগ্রাহ্য করে প্রজাদের শিক্ষার জন্যে স্থানে স্থানে বিদ্যালয় স্থাপিত করালেন।

    লেখক লিখলেন ‘ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্ভবত শূন্য’, কাজেই তাঁর প্রশংসা করা বিদ্যাসাগরের মোসাহেবির পরিচয়। দেখা যাচ্ছে, লেখক বিদ্যাসাগরকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে রাজি নন। ভালো কথা, কিন্তু প্রমাণ কোথায়?

    আমার কথা হচ্ছে – দুশো বছর আগের বিদ্যাসাগরের ‘স্থানে স্থানে বিদ্যালয় স্থাপিত’ মন্তব্যকে নস্যাৎ করতে হলে এ’রকম স্ট্রং স্টেটমেন্ট দেয়া যথেষ্ট নয়, বরং পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে হবে যে লর্ড ময়রার কার্যকালে শিক্ষাক্ষত্রে বিশেষ কিছুই হয়নি। পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলে ওই ঘটনার সমসাময়িক বিদ্যাসাগরের বক্তব্যকেই প্রামাণ্য বলে মানতে হবে।

    লেখক দেখিয়েছেন যে ‘বিস্তর টানাপোড়েনের পরে ১৮২৩ এর ১৭ জুলাই, বাংলায় শিক্ষাবিভাগ পরিচালনার জন্যে’ দশ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা সংসদ’ স্থাপিত হয়।তাদের সিদ্ধান্ত হয় যে সংস্কৃত আরবি ইত্যাদি প্রাচ্যভাষা শেখানোর জন্যে বছরে এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা এবং কোলকাতাতে কাশীর মত সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করা; (নজরটান আমার)।[3] এর ঠিক ছ’মাস আগে লর্ড ময়রার কার্যকাল শেষ হয়। তাহলে কি এটাই স্বাভাবিক নয় যে ওই ‘বিস্তর টানাপোড়েন’ (অবশ্যই কলকাতা এবং লন্ডনের মধ্যে) বাস্তবে লর্ড ময়রার দেশিয় শিক্ষার পক্ষে দাঁড়ানোর ফল যার ইশারা বিদ্যাসাগরের ওই অনুচ্ছেদে রয়েছে?

    শিক্ষা সংসদ ১৮২৪ সালে কোলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করল, এবং ১০ বছরের মধ্যে ‘কলকাতা মাদ্রাসা ও কাশীর সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠন ও উন্নতির ব্যবস্থা’; সংস্কৃত ও আরবি বই প্রকাশের ব্যবস্থা করল। এই কলেজে পড়তে গেলে ফি নেয়া হত না, উলটে ছাত্রদের বৃত্তি দেয়া হত।

    তাহলে ইংরেজি স্কুল কবে এবং কোত্থেকে এল?

    এ ব্যাপারে লেখক গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীকে অনুসরণ করে তিনি জানাচ্ছেন যে ১৮১৩ সালের সনদ অনুযায়ী পাদরিরা ভারতের সর্বত্র অবাধ যাতায়াতের অধিকার পেলেন। তাঁদের ও বেসরকারি উদ্যোগে কলকাতা ও তার আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত হল বেশ কিছু ইংরেজি স্কুল ও কলেজ। ১৮১৭ সালে খুলল হিন্দু কলেজ। এই সময় কলকাতাতে অনেক বাপ-মা তাঁর সন্তানদের ইংরেজি শেখাতে ব্যগ্র হলেন। যদিও দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র ( ডিএল রায়ের পিতা?) জানাচ্ছেন যে কোলকাতার বাইরে সবাই ফার্সি শিখতে চাইত কারণ ‘সমস্ত জেলার রাজকার্য পারস্য ভাষায় নির্বাহ হইত’, কিন্তু কলকাতার মধ্যবিত্ত বুঝতে পারছিলেন আগামী দিনে শুধু ফার্সিতে চাকরি পাওয়া যাবে না, ইংরেজি শিখতে হবে। আজকাল যেমন অনেক বাঙালি বাপ-মা ইংরেজির সঙ্গে হিন্দি শেখাতে চান আর কী!

    (৪.২) ইংরেজি কবে থেকে সরকারি ভাষা হোল?

    লেখক এইখানে তিনটে মূল্যবান পয়েন্ট তুলেছেন:

    ১) চার্লস গ্র্যান্টের ১৭৯২-এর পুস্তিকায় এশিয় প্রজাদের নৈতিক উন্নতির জন্যে খ্রিস্টধর্মের প্রচার এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন এবং তার ফলশ্রুতিতে বৃটিশ সংসদের ভারতের ‘শিক্ষা সমস্যা’কে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে স্বীকার করে নেয়া। তাই ১৮১৩ সালের সনদে ৪৩ সংখ্যক ধারা যুক্ত হয়ে ভারতে মিশনারি প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়।

    ২) গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংকের আমলে (১৮২৮-১৮৩৫), ‘অর্থাৎ বাণিজ্যপুঁজি থেকে শিল্পপুঁজিতে উত্তরণের সময়কালে, প্রশাসনের প্রয়োজনে এবং আর্থিক সম্পদকে ব্যবসা ও শিল্পের স্বার্থে শোষণের উদ্দেশ্যে, বেন্টিংক ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষপাতী হন’।[4] (নজরটান আমার)।

    ৩) ‘এরপর ১৮৩০ সালে, সমস্ত সরকারি কাজকর্ম থেকে ফারসি ভাষাকে বিদায় করা হয় এবং ১৮৩৩ সালে বেন্টিংক ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন’।

    তারপরে ১৮৩২-এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, কলকাতা মাদ্রাসা ও সংস্কৃত কলেজের সমস্ত ছাত্রকে বাধ্যতামূলক ভাবে ইংরেজি পড়তে হবে।[5]

    এই ধারায় শেষ খুঁটি নয়, লৌহস্তম্ভ দাঁড় করালেন মেকলে তাঁর ২রা ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫ তারিখের বিখ্যাত প্রস্তাবে, যাতে কলোনিয়াল ভারতে শিক্ষার নীতি, মাধ্যম, পদ্ধতি ও লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। স্পষ্ট উদ্দেশ্য এমন একটি দোভাষী শ্রেণির নির্মাণ ‘যার সদস্যরা রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হয়েও রুচি, মতামত, নীতি এবং মননে হবে ইংরেজ’।

    শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে ইয়ং বেঙ্গলদের একই ধুয়ো: ‘প্রাচীতে যাহা কিছু আছে তাহা হেয়, এবং প্রতীচীতে যাহা আছে তাহাই শ্রেয়ঃ’।[6]

    এখানে বিদ্যাসাগরের অপরাধ?

    পূর্বপক্ষ:

    লেখকের মতে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ নামক অনুবাদকর্মটিতে বিদ্যাসাগর লিখেছেন - শিক্ষা খাতে সরকারের অনুমোদিত বার্ষিক এক লক্ষ টাকা কেবল সংস্কৃত ও আরবি ভাষা শিক্ষায় খরচ হত, বেন্টিংক ওই দুটো ভাষার ওপর ব্যয়সংকোচ করে ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় ‘অধিক উপকার বিবেচনা করিয়া’ বেশির ভাগ ‘স্থানে স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করিবার অনুমতি দিলেন। তদবধি, এতদ্দেশে ইংরেজি ভাষার বিশিষ্টরূপ অনুশীলন হইতে আরম্ভ হইয়াছে’।[7]

    উত্তরপক্ষ:

    এটা সায়েবের লেখা বইয়ের অনুবাদ, যাতে বেন্টিংক কী করলেন, কেন করলেন বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য বা পদ্ধতি সবই বেন্টিংকের, বিদ্যাসাগরের নয়। কোথাও বিদ্যাসাগরের নিজস্ব ভ্যালু জাজমেন্ট দেখছি না তো।

    লেখক বলতেই পারেন যে বিদ্যাসাগর নিজেই লিখেছেন যে এটা আক্ষরিক অনুবাদ নয়, কোথাও কোথাও নিজস্ব সংযোজন আছে। কিন্তু এর মানে তো এটা নয় যে গোটা বইটাই নিজস্ব মৌলিক রচনা। বরং উপরের লাইনে কোথাও কোন ইন্টারপ্রিটেশন পাচ্ছিনে, যা পাচ্ছি তা’হল বক্তা নিরপেক্ষ স্টেটমেন্ট অফ ফ্যাক্ট।

    (৪.৩) প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও নবীন ইংরেজি শিক্ষা বিস্তার নীতি

    গোটা বইয়ে এই ইস্যুটি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। কারণ, দেবোত্তমের মত যাঁরা বঙ্গের কলোনিয়াল হিস্ট্রির পুনর্নির্মাণের আখ্যান তৈরি করছেন তাঁদের একটি জরুরি প্রেমিস হোল পরম্পরাগত দেশিয় (ইন্ডেজেনাস) পদ্ধতিটি নষ্ট করে কলোনিয়াল স্বার্থে যে ইংরেজিমুখী পদ্ধতিটি গড়ে উঠল তা এলিটিস্ট, এবং তার ফলে দলিত, মুসলিম ও সমাজের প্রান্তিক অবস্থানের মানুষদের আরও পেছনে ঠেলে দেয়া হোল।

    তার থেকে এটা দাঁড়ায় যে তাঁদের মতে দেশিয় শিক্ষা ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের জন্যে বেশি কাছের এবং ভেদরহিত ছিল। এই থিসিসের পক্ষে দেবোত্তম যে যে প্রমাণাদি পেশ করেছেন সেগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

    এর জন্যে উনি আশ্রয় করেছেন সে সময় কোম্পানির নির্দেশে মাদ্রাজ, বোম্বাইয়ে কলেক্টরদের সার্ভের রিপোর্টএবং পরে বিহার ও বাংলার জন্যে লর্ড বেন্টিংকের নির্দেশে উইলিয়াম অ্যাডামের করা তিনটি সার্ভের রিপোর্ট। এছাড়াও সেই সময়ের তৃণমূল স্তরের বাস্তব ছবি তুলে ধরার জন্যে লেখক ব্যবহার করেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী ও বিপিনচন্দ্র পালের স্মৃতিচারণ।

    [ স্বীকার করা ভাল এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞানগম্যি ছিল না। অ্যাডামস রিপোর্টের নামও শুনিনি কস্মিনকালে, সেটা আমারই পাহাড়প্রমাণ অজ্ঞতা। কিন্তু আলোচ্য বইটি আমাকে প্রচুর প্রাসংগিক তথ্য ও দস্তাবেজের সন্ধান দিয়েছে, লেখকের কাছে তার ঋণ রয়ে গেল।]

    এর থেকে যে ছবিটি উঠে আসে তা মোটামুটি এ’রকম -

    ১) তখন বাংলার প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার মত প্রাতিষ্ঠানিক বা কেন্দ্রীভূত ছিল না।

    ২) সেখানেও উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির জন্যে ছিল সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি শিক্ষা। রাজানুগ্রহে প্রাপ্ত নিষ্কর জমির আয় থেকে এর ব্যয়নির্বাহ হত।

    লোকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সরকারি চাকরির জন্যেই রাজভাষা ফারসি শিখত। পরে মোঘল শাসনের জায়গায় কলোনিয়াল শাসন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে ফারসির বদলে ইংরেজি শেখার দাবি উঠল যার জন্যে রামমোহন রায় লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লিখেছিলেন।

    ৩) দ্বিতীয় স্তরে ছিল গ্রামে পাঠশালা ও মক্তব পদ্ধতি যা রাজানুগ্রহের বদলে ‘সাধারণ মানুষের অর্থে পরিপুষ্ট ও তাঁদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় লেখা, পড়া আর অংক শেখার শিক্ষাধারা’। লেখক জানাচ্ছেন মক্তবের তুলনায় পাঠশালার শিক্ষা প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ ছিল এবং তা’ ছিল ব্যবহারিক জ্ঞানে পূর্ণ। “পাঠশালা শিক্ষা ছিল এই কৃষিজীবী, কারিগর, দোকানদার, জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারি ইত্যাদি সাধারণ শ্রেণির মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এক সাধারণ শিক্ষাধারা।” [8]

    মীর মশারফ হোসেনের ও শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে পাচ্ছি গ্রামে আরবির বিশেষ চল ছিল না। হিন্সু-মুসলমান নির্বিশেষে পাঠশালায় গিয়ে গুরুমশাইয়ের কাছে প্রথমে মাটিতে, পরে তালপাতায়, তার পরে কলাপাতায় লিখে বাংলা ও অংক শিখত। অ্যাডাম তাঁর রিপোর্টে বলেছেন স্কটল্যান্ডের গ্রামের স্কুলেও এত দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত ব্যবহারিক শিক্ষা দেয়া হত না।[9] উনি এটাও লক্ষ্য করেছেন যে মুসলমান শিক্ষকের কাছেও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ছাত্র পড়তে যায়। তাঁর তৃতীয় রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে পাঠশালার শিক্ষকদের মধ্যে অধিকাংশ কায়স্থ ও ব্রাহ্মণ, কিন্তু অন্য জাতের লোকও ছিলেন ১৬ থেকে ২৪%।

    তাই অ্যাডাম তৃতীয় রিপোর্টের শেষে প্রস্তাব দিলেন দেশজ ভাষায় দেশজ শিক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করার পক্ষে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ ওই প্রস্তাব খারিজ করে ‘শহর ও জেলাসদরগুলোয় ইংরেজি মডেলের শিক্ষা’ প্রসারে জোর দেয়, যুক্তি ‘জনসাধারণের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষাসংক্রান্ত সংস্কার ক্রমশ নিচের দিকে গ্রামাঞ্চলের দেশজ বিদ্যালয়গুলির কাছে দ্রুত পৌঁছবে’।[10]

    ট্রিকল ডাউন এফেক্ট!! নিও-ক্ল্যাসিক্যাল ইকনমির এই মন্ত্রটি শিক্ষার ক্ষেত্রেও? এবং দেড়শ বছর আগে?

    লেখক সঠিক ভাবেই বলছেন ‘ফলে শিক্ষা হয়ে ওঠে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের ক্রয়যোগ্য বস্তু’।

    এঁর পরের সিদ্ধান্তের সঙ্গেও সহমত না হয়ে উপায় নেই।

    ‘এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চশ্রেণির বিশেষত নব্য ভদ্রলোক শ্রেণির পক্ষে যতটা প্রয়োজনীয় ছিল, নিম্নশ্রেণির পক্ষে ছিল ঠিক ততটাই অপ্রাসঙ্গিক’। একদম ঠিক!

    কিন্তু পরের লাইনগুলো?

    “তাই ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক-মিডল-মাধ্যমিক স্কুল আর কলেজের ক্রমসম্পর্কিত ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার গোড়া ধরে টান মারে। উচ্চ ও নিম্নশ্রেণির জন্য একই কেন্দ্রীভূত শিক্ষাব্যবস্থায়, স্বভাবতই শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে যায় অগণন দরিদ্র অন্ত্যজ হিন্দু ও নিম্নশ্রেণির মুসলমান শিশু। সরকারি নিয়মের এক খোঁচায় তারা হয়ে ওঠে ব্রাত্য ও অবাঞ্ছিত। আর সেই শূন্যস্থান ভরাট করতে চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ঊঠতে থাকে অজস্র অ্যাংলো-বেঙ্গলি স্কুল”।[11]

    লেখকের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একেবারেই সহমত হতে পারলাম না।

    এক, লেখকের আগের দেয়া তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে উচ্চবর্গের জন্যে যে এলিট স্কুল ছিল সরকারি আনুকূল্যে মাত্র সেগুলোতে ফার্সির বদলে ইংরেজি চালু করা হচ্ছে বা মাদ্রাসা ও সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি একটি অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে পড়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

    পাশাপাশি তৃণমূল স্তরে চলতে থাকা পাঠশালা-মক্তব ব্যবস্থা তো বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়নি। আর সেগুলো, লেখক দেখিয়েছেন, চলতো সাধারণ মানুষের সহায়তায়; রাজানুগ্রহে নয়।

    দুই, সরকারি খরচা স্পষ্টত রাজধানী ও জিলা সদরে হচ্ছিল। তাহলে এতদিনের সমান্তরাল দেশিয় ব্যবস্থায় ছেদ পড়বে কেন? এরজন্যে লেখক কোন সাক্ষ্য, কোন তথ্য দেন নি। এমনকি, পরের দু’পাতায়, ৭৮ ও ৭৯তে রবীন্দ্রনাথের যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে, তাতেও দেখা যাচ্ছে যে তাঁর সময়েও কোলকাতা মহানগরীতে পাঠশালা ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল।

    আমি নিজে ১৯৫৩-৫৪ সালে বাড়িতে ধারাপাতে কড়াকিয়া, গণ্ডাকিয়া, পণকিয়া, বুড়িকিয়া, শতকিয়া এক বছর পড়েছিলাম যদিও সেটা তখন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছল।

    তিন, ব্যাঙের ছাতার মত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুল? গাঁয়েগঞ্জে? কোথায় এমন সার্ভে বা তথ্য, অন্তত স্মৃতিকথা নির্ভর বর্ণনা? এমনকি কলকাতায়ও সে’সময় ক’টি এমন স্কুল?

    আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু বইয়ে উদ্ধৃত তথ্যের ভূমিতে এই সিদ্ধান্ত একেবারেই কপোলকল্পনা বলে মনে হচ্ছে। এখানে লেখক তাঁর অ্যান্টি-কলোনিয়াল ইতিহাস লেখনের অ্যজেন্ডার ফলে বিশ্লেষণে কিছুটা একপেশে হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে।

    এ যেন স্ট্যাটিসটিক্সের সম্ভাবনা তত্ত্বের অনুসিদ্ধান্ত: যেহেতু সরকারি নীতি ও অর্থানুকূল্যে ইংরেজি বিদ্যালয়কে পুশ করা হচ্ছে তাহলে দেশি পদ্ধতি কোণঠাসা হওয়ার সম্ভাবনা ৮০% বলে ধরে নিতে হবে।

    আবার লেখকই এই পঞ্চম অধ্যায়ের শেষ প্যারায় পরমেশ আচার্যের দেশজ শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বইটি এবং হান্টারের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে লিখছেন ‘১৮৮১-৮২ সালে, ততদিনে টিঁকে থাকা প্রায় ৫০ হাজার পাঠশালাকে পুনরায় শিক্ষা বিস্তারের আওতায় নিয়ে আসা হবে’। তাহলে? ওঁর মূল প্রতিপাদ্য কোথায় দাঁড়াল?

    লেখক রবীন্দ্রনাথের ১৯৩৬ সালের প্রবন্ধ উদ্ধৃত করে বলছেন “রাজার অনাদরে আধমরা হয়ে এল সর্বসাধারণের নিরক্ষরতা দুর করবার স্বাদেশিক ব্যবস্থা”।[12]

    কিন্তু আমরা কথা বলছি ওই বক্তব্যের ১০০ বছর আগের সময়ে। পাদ্রি অ্যাডামের দ্বিতীয় ও তৃতীয় রিপোর্টটি পেশ হয়ে গেছে ১৮৩৫ ও ১৮৩৮ সালে। যখন কোম্পানির আমল।

    এই একশ’ বছরে ভারত তথা বঙ্গের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই লেখকের ভাষায় ‘কেঁচে গণ্ডুষ করে’ ১৮৮২ সালে অ্যাডাম প্রদর্শিত পথে চলেও আগের মত সাফল্য পাওয়া যায়নি। পঞ্চাশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তিতে তার প্রকাশ।

    কিন্তু অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণের মধ্যে একটিকে ধরে ‘দেশি ধানক্ষেতে বিদেশি ওক রোপণের’ দায়ে ধরা পড়বেন একা বিদ্যাসাগর? একটু এগিয়ে যাই।

    (৪.৪) বিদ্যাসাগরের চাকুরিজীবন ও সাহেবদের কৃপাদৃষ্টি

    ষষ্ঠ অধ্যায়ের শীর্ষক “বিদ্যাসাগরের কর্মজগতের শুরু - সাহেবসুবোর সুধাসঙ্গ”। বা এর গোড়াতে লেখক তিনটে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

    এক, ঈশ্বরকে পাশ করলে আদালতে জজপন্ডিতের চাকরি পাবার সম্ভাবনায় সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করা হয়েছিল। উনি প্রায় সাড়ে বারো বছর নাগাড়ে পড়ে একুশ বছর বয়সে কোর্স শেষ করেন।

    দুই, ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পাওয়ার জন্যে ল’ কমিটির পরীক্ষায় বসতে হত। সেটা উনি প্রায় সতের বছর বয়সে পাশ করেন এবং উপাধিটি পান।‘উনি ছাড়া কলেজের আরও অনেক পড়ুয়া এই উপাধিটি লাভ করেন’।[13]

    তিন, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ছিল আজকের রাইটার্স বিল্ডিং ভবনে।

    কিন্তু অধ্যায়টির প্রতিপাদ্য: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাবিভাগের বিভিন্ন চাকরি পাওয়া এবং উন্নতির মূলে কলেজের পর গৃহশিক্ষক রেখে হিন্দি ও ব্যবহারিক ইংরেজি শেখার চেয়েও সাহেবদের মোসাহেবি বেশি কাজে এসেছিল। সূত্রবাক্য-বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্রের ‘বিদ্যাসাগর জীবনচরিতে’র পৃঃ ১৪২এর একটি দীর্ঘ উক্তি, যাতে তিনি বলছেন শিক্ষাবিভাগের তিন হোমরাচোমরা মার্শাল, মোয়াট ও বেথুনের কথা; ‘ইঁহারা তিনজনেই তাঁহার উন্নতি, প্রতিপত্তি ও মানসম্ভ্রমের আদি কারণ’। বিদ্যাসাগর এই তিনজনের ছবি আঁকিয়ে বাদুড়বাগানের বাড়িতে রেখেছিলেন এবং ‘প্রতিমূর্তিগুলি একবার না দেখিয়া থাকিতে পারিতেন না’।[14]

    নিঃসংশয়ে এ’কথা বলা যায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে চাকরি এবং সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হওয়ার মধ্যে বিদ্যাসাগরের এঁদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন।

    অনেক নিযুক্তিতে তাঁর হাত ছিল। এই সময়ে তাঁর চাকরিগুলো চোখ বুলিয়ে নিলে দেখবঃ

    সাল । সংস্থা । পদ

    ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৪১ । ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ । প্রধান পন্ডিত
    ৬ই এপ্রিল, ১৮৪৬ । সংস্কৃত কলেজ । সহকারী সম্পাদক
    [*১৬ জুলাই, ১৮৪৭ পদত্যাগ (সম্পাদকের সঙ্গে মতভেদ)]

    ১লা মার্চ, ১৮৪৯ । ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ । হেড রাইটার/ট্রেজারার
    ৫ই ডিসেম্বর, ১৮৫০ । সংস্কৃত কলেজ । সাহিত্যের অধ্যাপক
    ২২ জানুয়ারি, ১৮৫১ । সংস্কৃত কলেজ । প্রিন্সিপাল (নতুন পদ)

    এই সময়ে বিভিন্ন সময়ে শূন্য পদে বিদ্যাসাগরের সুপারিশে নিযুক্তিঃ

    নাম ও সম্পর্ক । সংস্থা । পদ

    মদনমোহন তর্কালংকার(বন্ধু) । ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ । পন্ডিত
    মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ(সহপাঠী) । কোলকাতা মাদ্রাসা । পন্ডিত
    তারানাথ তর্কবাচস্পতি । সংস্কৃত কলেজ । ব্যাকরণ পন্ডিত

    এই সময়ে আমরা দেখেছি বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠতা এতটাই যে তিনি আবেদন করলে বড়কর্তারা প্রায় সেদিনই সুপারিশপত্র লিখছেন, তাঁর নতুন চাকরি হয়ে যাচ্ছে। খালি পদে কাউকে নিযুক্ত করার জন্য তাঁকে বলা হচ্ছে ভালো লোক খুঁজে দিতে।

    সংস্কৃত কলেজের উন্নতির জন্যে তাঁর থেকে লিখিত রিপোর্ট চাওয়া হচ্ছে। তাঁর পরামর্শ মেনে সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি ও অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ইত্যাদি পদ তুলে দিয়ে শুধু প্রিন্সিপালের পদে ওই ক্ষমতাগুলো অর্পিত করে তাঁকে নিযুক্ত করা হচ্ছে।

    এসবের মধ্যে লেখক সাহেবের দাক্ষিণ্যের ফললাভ দেখছেন। আমি দেখছি যোগ্য লোকের স্বীকৃতি। তখনও ভারত ভিক্টোরিয়ার সাম্রাজ্যের অধীন নয়। আজ থেকে ১৭০ বছর আগে কোম্পানির আমলের শেষ দশকে কতজন সংস্কৃত এবং ইংরেজিতে কৃতবিদ্য ছিলেন? ফলে স্বাভাবিক চেনাজানার মধ্যে থেকেই নিযুক্তি হবে। আজকের মত গেজেটে বা দৈনিক পত্রিকায় কর্মখালির বিজ্ঞাপন বেরোনোর বা লিখিত পরীক্ষা ও ফর্মাল ইন্টারভিউয়ের সিস্টেমের কড়াকড়ি হবে না।

    এখনও ভারতে বিভিন্ন উচ্চপদে, বিশেষ করে বেসরকারি সংস্থায়, চেনাজানা ও রেকমেন্ডেশনের মাধ্যমে নিযুক্তি হয়। অনেক ক্ষেত্রে পদপ্রার্থী ও ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্য দিল্লি ও কোলকাতার একই বিশিষ্ট কলেজের (ধরুন সেন্ট স্টিফেন বা জেএনইউ, দিল্লি; প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর কোলকাতা) প্রাক্তনী হলে নিযুক্তিতে প্রভাব পড়ে।

    মোসাহেবি?

    মোসাহেবের নিজস্ব মতামত বা সত্তা থাকে না। তার কাজ প্রভুর কথায় দিনকে রাত করা, কখনও ‘না’ বলা নয়।

    তাই মোসাহেব অযোগ্য হলেও নিযুক্তি পেয়ে যান।

    বিদ্যাসাগর শিক্ষা বিভাগে অধ্যাপনা বা সম্পর্কিত অন্যান্য কাজে অযোগ্য প্রার্থী ছিলেন না। এমনকি যাঁদের উনি রেকমেন্ড করেছেন বন্ধু অথবা ভাই — সকলেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোন কম ন’ন।

    আর বিদ্যাসাগর, লেখকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সাহেবপ্রভুদের সঙ্গে আদৌ ‘উঠতে বললে ওঠ, বসতে বললে বোস’ গোছের ব্যবহার করেননি, বরং অনেক ক্ষেত্রে নিজের শর্ত আরোপ করেছেন - নইলে চাকরিতে যোগ দেন নি।

    আর চাকরিতে উচ্চাকাঙ্ক্ষা? প্রিন্সিপাল হতে চাওয়া? অস্বাভাবিক কী? বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন হবে তিনি কেন আর্থিক লাভ, ভালো মাইনে - এসব চেয়েছিলেন বলে নয়, বরং আর দশটা সাধারণ মানুষের মত ওসব চেয়েও উনি শিক্ষা, সমাজ ও ভাষার সংস্কারের ক্ষেত্রে যা করেছিলেন তার নিরিখে।

    (৪.৫) বিদ্যাসাগরের ব্যবসা ও সাহেবদের কৃপাদৃষ্টি

    বিদ্যাসাগর পুস্তক প্রকাশনার ব্যবসা করতেন এবং বেশ সফল ব্যবসায়ী ছিলেন এই তথ্য আমার জানা ছিল না। লেখক এই বিষয়টির পৃষ্ঠভূমি নিয়ে বেশ খুঁটিয়ে দেখে যা লিখেছেন তার সার -

    ১) মার্শালের সঙ্গে আলোচনার পর সহকারী সম্পাদক বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা সংস্কারের জন্যে একটি প্রস্তাব সম্পাদক রসময় দত্তের কাছে পেশ করেন ১৮৪৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর। সম্পাদক মশায় “তাঁর অনুরোধ সত্ত্বেও সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি না পাঠিয়ে রসময় দত্ত তার সামান্য অংশ খন্ডিত আকারে শিক্ষা সংসদে পাঠান। পরিশেষে ১৮৪৭ এর ৭ এপ্রিল বিদ্যাসাগর সরাসরি শিক্ষা সংসদের কাছে তাঁর ইস্তফাপত্র দাখিল করেন”।[15]

    - লেখকের প্রশ্ন কেন সাড়ে ছ’মাস বাদে? উনি নিজেই বলছেন এরমধ্যে কী কী হয়েছে - যেমন মার্শাল-মোয়াট আলোচনা হয়েছে কিনা - তা’ জানা যায়নি।

    - তাহলে যেটুকু তথ্য জানা গেছে তার ভিত্তিতে অনুমানের সাহায্য নেয়া ছাড়া গত্যন্তর কী? লেখকের আপত্তি কেন অধিকাংশ গবেষক এরজন্যে রসময় দত্তকে দায়ি করছেন?

    - আমার কথা, আর কাকে দায়ী করা যায়? স্বাভাবিক ভাবে ওই প্রস্তাবে কোন নির্ণয় না হয়ে ইস্যুটি লম্বিত থাকায় বা খারিজ হওয়ায় বিদ্যাসাগর রসময় দত্তকে খন্ডিত অংশের বদলে পুরো প্রস্তাবটি পেশ করার জন্যে বারংবার অনুরোধ করে থাকবেন। এই প্রক্রিয়ায় সাড়ে ছয়মাস লাগা কি অস্বাভাবিক? শেষে হতাশ হয়ে পদত্যাগ - এটা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প সম্ভাবনা লেখকের জানা আছে কিনা তা’স্পষ্ট নয়।

    ২) কিন্তু কলেজের সম্পাদককে ইস্তফা জমা দেওয়ার ডিউ প্রসিডিওর না মেনে সরাসরি শিক্ষা সংসদের সম্পাদকের কাছে দেয়ায় শিক্ষা সংসদ ওই আবেদন খারিজ করে। “অবশেষে ২০ এপ্রিল যথাবিহিত উপায়ে বিদ্যাসাগর ফের ইস্তফার আবেদন জানালে তা’ ১৮৪৭ এর ১৬ই জুলাই গৃহীত হয়”।[16]

    - এর থেকে কি মনে হয় না যে সাহেবদের সঙ্গে ‘খাতিরদারি’ সত্ত্বেও তাঁদের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ‘ডিউ প্রসিডিওর’ মানতে বাধ্য করে তাঁরা বিদ্যাসাগরকে একটু রগড়ে দিলেন! এটা কি আগের অধ্যায়ের বারবার বলা ‘মোসাহেব’ ছবির সঙ্গে আদৌ খাপ খায়?

    ৩) লেখকের দেয়া প্রামাণ্য তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ইস্তফা দেবার অল্প আগে বিদ্যাসাগর বাল্যবন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে ৫০:৫০ শেয়ারে সংস্কৃতযন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা খোলেন। টাকা না থাকায় আরেক বন্ধুর থেকে প্রেস কেনার জন্যে ৬০০ টাকা ধার করতে হয়। এই টাকা শোধ করা সম্ভব হয় মার্শাল অন্নদামঙ্গলের ১০০ কপি ৬০০ টাকায় কিনতে রাজি হওয়ায়। এর জন্যে মদনমোহন মার্শালকে চিঠি লেখেন ১৮৪৭ সালের ৭ই জুন তারিখে।

    লেখক বলছেন, ‘বিদ্যাসাগর তাঁর প্রকাশনার ব্যবসা শুরু করেন “অন্নদামঙ্গল” ছেপে। এর থেকে এটা স্পষ্ট যে বিদ্যাসাগর যখন প্রেস কিনে ছাপাখানা খুলছেন তার কয়েকমাস আগেই ওঁর দ্বিতীয়বার পদত্যাগপত্র জমা হয়ে গেছে। টেকনিক্যালি প্রেস খোলার সময় উনি চাকরিতে রয়েছেন বটে, কিন্তু যে কোনো সময় পদত্যাগপত্র অনুমোদিত হয়ে চাকরিটি চলে যেতে পারে। এইসময় যদি দুই বন্ধু মিলে মার্শালকে অনুরোধ করে প্রথম বইটি ভাল কাগজে ভাল ভাবে ছাপার গ্যারান্টি দিয়ে ১০০ কপি কলেজের জন্যে বুক করে থাকেন তার মধ্যে ‘অনৈতিক’ কী হল? ব্যবসাবুদ্ধি? অবশ্যই। আজ আমরা যে কেউ যদি ছাপাখানা খুলি তাহলে চেনাজানা লোকজনের কাছে অনুরোধ করব না?

    ভাই শম্ভুচন্দ্রের লেখা থেকে জানতে পারছি মার্শালের সঙ্গে সুসম্পর্কের দৌলতে বিদ্যাসাগর ‘ইহার পর যে সকল সাহিত্য, ন্যায়, দর্শন, পুস্তক মুদ্রিত ছিলনা, তৎসমস্ত গ্রন্থ ক্রমশ মুদ্রিত করিতে লাগিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ও সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরীর জন্য যে পরিমাণ নূতন নূতন পুস্তক লইতে লাগিল, তদ্বারা ছাপানর ব্যয় নির্বাহ হইয়াছিল। অন্যান্য লোকে যাহা ক্রয় করিতে লাগিলেন, তাহা লাভ হইতে লাগিল’।[17]

    একবছর আটমাস পরে বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের পদে যোগ দিলেন। এর মধ্যে তিনি প্রেস খোলার পাশাপাশি ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি’ নামে বইয়ের দোকানও খুলে ফেলেছিলেন। তাতে কমিশন বেসিসে অন্য প্রকাশনের বইও বিক্রি হত।

    ফলে যখন আবার চাকরিতে যোগ দিলেন ততদিনে ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেছে।

    ভাল বুদ্ধি; আমরা কি বাঙালির চিরাচরিত ব্যবসাবিমুখতার মানসিক পূর্বাগ্রহে আটকে থাকব?

    ফের ১৮৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর মাসিক ৯০ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তারপর রসময় দত্ত কলেজের প্রিন্সিপাল পদ ছেড়ে দিলে এবং কলেজের উন্নতি (আজকের হিসেবে ‘ইকনমিক ভায়াবিলিটি’) এবং শিক্ষা ও ম্যানেজমেন্টের সংস্কারের জন্যে বিদ্যাসাগরের পেশ করা রিপোর্টে সন্তুষ্ট হয়ে সেক্রেটারি ও অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি পদ তুলে দিয়ে বিদ্যাসাগরকে প্রিন্সিপাল করে পুরো ক্ষমতা সঁপে দেয়া হল। সময়টা ১৮৫১ সালের জানুয়ারি শেষ।

    লেখকের ভাষায় এবার শুরু হল ‘তাঁর শিক্ষাসংস্কারের কর্মযজ্ঞ’। এ’বিষয়ে আমরা কথা বলব পরের কিস্তিতে।

    (চলবে)

    [1] বিদ্যাসাগর: নির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আখ্যান, লেখক, পৃঃ ৫১।
    [2] ঐ।
    [3] ঐ, পৃঃ ৫৪।
    [4] ঐ, পৃঃ ৬০।
    [5] ঐ, পৃঃ ৬২।
    [6] ঐ, পৃঃ ৬৫।
    [7] ঐ, পৃঃ ৬৫।
    [8] ঐ, পৃঃ ৬৯।
    [9] ঐ, পৃঃ -৭১।
    [10] ঐ, পৃঃ ৭৭।
    [11] ঐ, ৭৭।
    [12] ঐ, পৃঃ ৭৯।
    [13] ঐ, পৃঃ ৮৪।
    [14] ঐ, পৃঃ ৯৪।
    [15] ঐ, পৃঃ ৮৮।
    [16] ঐ, পৃঃ ৮৮।
    [17] ঐ, পৃঃ ৯০।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ১০ জুন ২০২১ | ২৮০২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কৃশানু নস্কর | 2405:201:8007:8063:b8bd:e94e:66eb:***:*** | ২৯ আগস্ট ২০২১ ২০:২৮497359
  • একটি Clerical mistake চোখে পড়লো। Adam's report এর সালটা 1935 হয়ে গেছে ওটা 1835 হবে।
    আর Adam's report এর ঐ দেশীয় শিক্ষা কেমন ছিল তা ওখান থেকেই তুলে দিচ্ছি।
     
    In only one Bengali school the Guru
    Bandana was found in use, a doggerel composition containing an
    expression of the respect and devotion due from the scholar to
    his teacher. The arithmetical rules of Subhankar were employ-
    ed in 32 schools. The Guru Dakshina, another doggerel com- ·
    position which is sung by the elder boys of a school from house
    to house to elicit donations for their master, was taught in three
    schools. In addition to these vernacular works, a small portion
    of the Sanscrit vocabulary of Amara Singh was found to be in use
    in one Bengali school; in another & work called Sabda Subanta,
    containing the rules of Sanscrit orthography, the permutations
    of letters in combination, and examples of the declension of
    nouns; and in 14 schools the Sanscrit verses of Chanakya, con-
    taining the praises of learning and precepts of morality, were
    read or committed to memory. All the preceding works,
    hoth vernacular and Sanscrit, taught either from
    manuscripts or memoriter; but in five schools the Shishu Bodh
    was employed, a modern compilation in print, containing
    Subhankar, Chanakya, and Guru Dakshina. One teacher I found
    in possession of the following works in manuscript, which
    he professed to employ for the instruction of his scholars; viz.,
    the arithmetic of Ugra Balaram, consisting of practical and
    imaginary examples which are worked; the modes of epistolary
    address by the same author; Subhankar; Saraswati Bandana;
    and Aradhan Das's Man Bhanjan or Anger Removed, and
    Kalanka Bhanjan or Disgrace Removed, both relating to the
    loves of Radha and Krishna. In addition to the preceding,
    which were all in Bengali, he had also in Sanscrit the verses of
    Chanakya and the conjugation of the substantive verb bhu.
    Another teacher had the following printed works, viz., Hito-
    padesh, & Serampore school-book; the School Book Society's
    Nitikotha or Moral Instructions, 1st Part, 3rd Edition, 1818;
    the same Society's Instructions for modelling and conducting schools, 1819; Do.'s Geography, Chapter III. Introduction to
    Asia, 1819; Jyotis Bibaran, a Serampore school-book on astro-
    nomy; the seven first numbers of the Serampore Digdarsan or
    Indian Youth's Magazine; and a Serampore missionary tract
    called Nitivakya. This person was formerly in the employment
    of a European gentleman who supported a Bengali school subse-
    quently discontinued, and the books remaining in the teacher's
    hands are preserved as curiosities, or as heir-looms to be admired,
    not used.
    মনে হয় এটা ব‍্যবহারিক শিক্ষার নমুনা?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন