মাৎস্যন্যায়, তিমিঙ্গিল ও সোহাগদির পাঠশালা।
আমাদের থেকে বয়সে খানিকটা বড়ো বলে আমরা সবাই তাঁকে সোহাগদি বলেই ডাকতাম – সোহাগ সান্যাল আমাদের আধা গ্রাম, আধা শহরের প্রথম ছোটদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের স্থপতি। সোহাগদির পড়াশোনা পরিচিত এক কনভেন্টে। ফলে তাঁর চলন বলন সবই ছিল স্বতন্ত্র – আমাদের থেকে অনেকটাই আলাদা। সোহাগদির মা, চিনু মাসিমা ছিলেন আমার মায়ের বন্ধু । ফলে মাঝে মাঝেই সোহাগদি আমাদের বাড়িতে আসতো এবং এলেই আমাদের বঙ্গীয় অ্যাকসেন্টের ইংরেজি শুনে হাসতো। আমরা বিলকুল হ্যাটা হতাম।
এরপর কেটে গিয়েছে বেশ অনেকগুলো বছর। আমরা বড়ো হয়েছি, স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলেজে ঢুকেছি। চিনু মাসিমারা আমাদের পাড়া ছেড়ে অন্য পাড়ায় বাড়ি তৈরি করে চলে গেছেন। ফলে আগের মতো যোগাযোগ আর রইলো না। এরই মাঝে একদিন ভাই এসে খবর দিল – জানিস্ দাদা, সোহাগদি একটা স্কুল খুলেছে …. পল্লীর ভেতরে। মেলা স্টুডেন্ট। ছোট্ট স্কুল হলে কি হবে? বেজায় নামডাক। এখানকার স্টুডেন্টরা সবাই কলকাতার নামীদামী স্কুলে ভর্তি হয়! মনে মনে বেশ খুশিই হই । শত হলেও অনেক দিনের পরিচিত মানুষ।
এহেন সোহাগদির সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা চার রাস্তার মাথায়। একটা বিশেষ প্রয়োজনে ওদিকে গিয়েছিলাম।বাড়ি ফিরবো বলে অটোরিকশার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ এক মহিলা হাতে একটা বিজ্ঞাপনী লিফলেট ধরিয়ে দিলেন। অন্য সময় হলে হয়তো ফেলেই দিই বা হাত বাড়িয়ে নিতে অস্বীকার করি কিন্তু ইংরেজিতে লেখা বলেই হয়তো পড়তে শুরু করি।আরে ! এতো সোহাগদির স্কুলের বিজ্ঞাপন ! ঘাড় উঁচু করে সোহাগদির খোঁজ করি। পেছন থেকে কেউ হেঁকে বলেন – দাদা, এগিয়ে যান। এক সময় জায়গা পেয়ে অটোতে উঠে পড়ি। অটো চলতে শুরু করে।
( ২ )
বাড়িতে এসে বিজ্ঞাপনটা পড়ি। স্কুলে ভর্তির জন্য বিজ্ঞাপন। বয়ান বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখা। “ছোটদের জন্য মুক্ত ভাবনার স্কুল। নতুন বছরের জন্য ভর্তি চলছে…….” নিচে ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। ফোন করলাম।
হ্যালো, এটা কি …..স্কুল ? আমি কি সোহাগদির সঙ্গে কথা বলতে পারি?
আমি সোহাগ সান্যাল বলছি …….
অনেকদিন পর কথা বলতে গিয়ে দুজনেই খানিকটা নস্টালজিক হয়ে পড়ি। স্কুল প্রসঙ্গে কথা উঠতেই সোহাগদির গলা বুজে আসে। ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা ভীষণ কমে গেছে। সবাই এখন চোখ ধাঁধানো নামডাকওয়ালা স্কুলের দিকেই ঝুঁকছে। ফলে সোহাগদির সেই ছোট্ট স্কুলের আঙিনায় এখন খরার মরশুম। একদিন যাবো বলে তখনকার মতো কথা শেষ করি।
( ৩ )
আমাদের বৃহত্তর শিক্ষাঙ্গনে এখন বুঝি মাৎস্যন্যায় নীতির প্রয়োগের পর্ব চলছে। মাৎস্যন্যায় হলো একটি বিশেষ অবস্থা যখন অধিক ক্ষমতার অধিকারী তাঁর তুলনায় কমজোরীদের ওপর নিজের আধিপত্য কায়েম করে। বঙ্গের শক্তিশালী শাসক শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এক চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেই সুযোগে শক্তিশালীরা আধিপত্যবাদের আশ্রয় নেয়। পুকুরে থাকা নানান চেহারার মাছেদের মধ্যে বড়ো চেহারার মাছেরা সুযোগ পেয়েই টপাটপ গিলে খেয়ে ফেলে ছোট ছোট মাছেদের। এটাই নাকি দস্তুর বীরভোগ্যা বসুন্ধরায়।
( ৪ )
হালফিলের শিক্ষার গুণগতমান কতটা উন্নত হলো তা নিশ্চয়ই অনুসন্ধান সাপেক্ষ এবং হয়তো খানিকটা বিতর্কিতও বটে। সাদা চোখে দেখলে বলতেই হবে যে বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফলকে সাফল্যের মাইলফলক হিসেবে মান্যতা দিলে বলতেই হয় যে একালের পরীক্ষার্থীরা তথাকথিত শিক্ষাকে উন্নতির শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। সর্বমোট নম্বরের সবটাই পকেটস্থ করে ফেলা এখনকার পরীক্ষার্থীদের কাছে যেন বাঁয়ে হাতকা খেল। আমাদের কালে পাড়ার কেউ প্রথম ডিভিশনে পাশ করলে সব লোক ঝেঁটিয়ে দেখতে আসতো আহাম্মকটি কে? তাই দেখতে।আর এখন পার্সেন্টেজ অথবা পার্সেন্টাইলের যুগ। কে কেমন দরো পড়ুয়া তা নাকি বোঝা যাবে ঐ পার্সেন্টেজের বহরে।
এটা হলো প্রচারের যুগ। প্রচারের ঢাক যে যত জোরে বাজাতে পারবে এ কালে জয় তারই । চার মাথার চারদিকে টাঙানো ঢাউস সাইজের ব্যানারগুলো দেখতে দেখতে সোহাগদির স্কুলের লিফলেটটিকে বড়ই বেমানান মনে হচ্ছিল। বেশ মনে পড়ে দ্রুত গতিতে বেড়ে ওঠা প্রাইভেট স্কুলের হাতছানিতে যখন আশেপাশের সরকার পরিপোষিত স্কুলগুলোতে ছাত্র ভর্তি কমছিল তখন এক অসহায়ত্ব ঘিরে ধরেছিল সকলকে। অক্ষমের আস্ফালনের মতো আমরা কেউ কেউ অন্ধকার ঘরের দরজায় কপাল ঠুকেছি আর প্রার্থনা করেছি – হে ঠাকুর, এই বছরেই ঘর যেন একেবারে ফাঁকা না হয়ে যায়!
অনেক স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল রাতারাতি। এমন ঢল শুরু হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি পড়া বাতিল করার পর।
তারপর ঘোষণা করা হলো পাশ ফেল তুলে দেওয়া হলো। এই দুটি মূল্যবান সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা, ঠিক না ভুল এসব নিয়ে আলোচনা এই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক হবে, তাই এড়িয়ে যাচ্ছি। সোহাগদি খুব যত্ন করে, অনেক দূরপথের পথিক হবেন বলে স্কুলটি করেছিলেন। ওই স্কুলটি গড়ে তোলার পেছনে স্মরজিৎদা, মানে সোহাগদির আদর্শবাদী অধ্যাপক কর্তামশাইয়ের (ঐ নামেই ডাকতেন সোহাগদি) খুব বড়ো ভূমিকা ছিল। আরও বেশকিছু গুণী মানুষ তাঁদের স্বপ্নকে জুড়ে দিয়েছিলেন ঐ ছোট্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সোহাগদির স্কুল একেবারে জিরো থেকে হীরো হয়ে উঠলো। কিন্তু সবাই তো আর সোহাগদি নন ! রাতারাতি মাশরুমের মতো পাড়ায়, পাড়ায়, অলিগলিতে গজিয়ে উঠলো ছোট ছোট সব প্রিপেরেটরি স্কুলের নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট বাড়ির নব্য অভিভাবকরা এসে ভিড় জমালেন এই সব বিদ্যা বিপণন আখড়ায়। বছর শেষের ‘সেল’ এর বাজারের মতো জমে উঠলো বিদ্যা ব্যবস্থার সেলের বাজার। ডিঙ্ ডঙ্ বেল আর জ্যাক এন্ড জিলের আবাহন মন্ত্রে তখন প্রতিদিনই শ্রী পঞ্চমী !
( ৫ )
এভাবেই ধীরে ধীরে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা পরিমণ্ডলের একটা নতুন আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হলো । এই মঞ্চে এবার ধীরে ধীরে, একে একে অবতীর্ণ হলো বড়ো বড়ো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। জলসার আসরে যেমন শুরুতে সব লোকাল আর্টিস্টদের গান গাইতে বসিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা গান গেয়ে ভিড় জমায়। মাইকে প্যা পো করে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে শুনলেই লোকজন ঘরের কাজ কম্মো ফেলে ভিড় জমায় সেখানে। নামীদামী শিল্পীরা আসেন পরে। জমা ভিড়কে জমাটি করে তোলার করতব তাঁদের বিলকুল জানা আছে। তাই জলসা জমে উঠতে সামান্যতম বিলম্ব হয় না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেও ওই আসর জমানোর কাজ করতে হয়েছে একাধিক আসরে। পঙ্কজ মল্লিক মশাই এসে পড়তেই প্রায় চ্যাংদোলা করে তাঁকে মঞ্চ থেকে তুলে দিয়েছিলো আয়োজকরা। মল্লিক মশাই যেন এলেন দেখলেন জয় করলেন। আসরতো জমেই ছিলো, এখন তা ক্ষীরে পরিণত হলো।
এসব বড়ো বড়ো হাউজের কেতাই আলাদা। স্কুলে পঠনপাঠনের কাজ শুরু হবার আগেই তাঁদের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার লেখা সুদর্শন শকট বাহিনী রাস্তায় রাস্তায় টহল দেওয়া শুরু করে। লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। মনে মনে ভাবে আর স্বপ্ন দেখে নিজের সন্তানদের ওখানে ভর্তি করানোর। একদিন পায়ে পায়ে হাজির হয়ে যায় তাঁরা। তারপর? সোহাগদির স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা একটু একটু করে কমতে থাকে। অথচ সোহাগদি এর ভেতর বড়ো আয়োজন করে ফেলেছেন এই বিশ্বাসে যে তাঁর খাতের জল একই মাত্রায় বইবে। তা কখনো হয় !
এতো মাৎস্যন্যায় কাল। দরিয়ায় এখন তিমি তিমিঙ্গিলদের আবির্ভাব হয়েছে। একবার মুখ হাঁ করলেই ঢুকে পড়ছে কয়েক ডজন কি তার থেকে বেশি সংখ্যায় বামন স্কুলেরা। রণে আর প্রেমে কাউকে গিলে খাওয়াতে কোনো অন্যায় নেই। তিমি আর তিমিঙ্গিলেরা তো রণেই নেমেছে। তাইনা!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।