
১৯৭৫। বাঁকুড়ার ছোট্ট মফস্সল শহর বিষ্ণুপুর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন দুই তরুণ। দুনিয়া ঘুরে দেখার আগে সাঙ্গ করছেন ভারতভ্রমণ। সাইকেলে। কিছু পরে হাল ছাড়লেন একজন। ঘুরতে থাকে দ্বিতীয়জনের সাইকেলের চাকা। ১৭ বছর। ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। ১৫৪ টি দেশ। আজও এ কীর্তিতে তিনি অদ্বিতীয়। এই প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সে পরমাশ্চর্য সফরের অনুপুঙ্খ কাহিনি শোনাচ্ছেন জয় মণ্ডল। আলাপে নীলাঞ্জন হাজরা। এ পর্বে অর্থ সংগ্রহের কঠিন পরিশ্রমের কাহিনি। নীলাঞ্জন হাজরা—অনেক কষ্টে আফ্রিকার দুটো ফ্রি টিকিট তো জোগাড় করলে? কিন্তু টাকা? ১৯৭০-এর দশকের আফ্রিকা। তোমরা জীবনে কখনও বিদেশ যাওনি। কতদিনের জন্য যাচ্ছ তাও ঠিক নেই। কোথায় থাকবে? কী খাবে? শরীর খারাপ করলে কী করবে? পকেটে বেশ মোটা টাকা থাকলে, এসবের থেকে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকা যায়। ওই যে বলে না—Money speaks! টাকা কথা বলে! সেই টাকা তোমরা পেলে কোথায়?
জয় মণ্ডল—পাইনি তো। হোটেল-টোটেলে থাকার মতো টাকার কথা তো ছেড়েই দাও। স্বপ্নেও ভাবিনি। ভীষণ খিদে পেলে রাস্তার পাশের কোনো ঝুপড়ি দোকান থেকে পেট ভরানোর মতো সস্তায় কিছু কেনা আর জল। নইলে স্থানীয় মানুষ যদি দয়া করে কিছু খেতে দেন। সামান্য কিছু টাকা নিয়ে আমরা দুজন—আমি আর মনু (মনমোহন চক্রবর্তী)—বেরিয়ে পড়েছিলাম।

রিপ্লে-র ‘বিলিভ ইট অর নট’ সিরিজে জয় মণ্ডল। ১৯৮৪ সালে। তখন তিনি ১০২টি দেশে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল সাইকেলে ঘোরা সাঙ্গ করেছেন। পরে অবশ্য আরও বহু দেশ ঘুরেছিলেন। ছবিসৌজন্য — The Statesman.
নী.হা. — কত?
জ.ম. — ঠিক অ্যামাউন্টটা আজ আর মনে নেই। কিন্তু খুবই সামান্য, আর সেটা জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
নী.হা. — আর তাই নিয়েই একটা গোটা মহাদেশ?!
জ.ম. — হ্যাঁ। দ্যাখো, ঘুরে তো এসেছি। হাল তো ছাড়িনি। একটু একটু করে, এর কাছে চেয়ে, ওর কাছে চেয়ে টাকা তুলেছিলাম। তোমরা যাকে ক্রাউড-ফান্ডিং বলো এখন। এখনকার মতো টাকা তোলার অর্গানাইজ্ড ব্যবস্থা তো তখন ছিল না, নিজেকেই ঘুরে ঘুরে তুলতে হয়েছিল। বাবা তো প্রথমেই বলেদিলেন এক পয়সা পাওয়া যাবে না বাড়ি থেকে।
নী.হা. — তাহলে?
জ.ম.— খুঁজতে বেরলাম। অর্থের খোঁজ, সবথেকে কঠিন খোঁজ। তোমার মনে আছে বম্বেতে আমার মিহির সেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
নী.হা. — হ্যাঁ-হ্যাঁ।
জ.ম. — অনেক কষ্টে দেখা করলাম সেই মিহির সেনের দেওয়া কন্ট্যাক্ট অনিল বোরিয়ার সঙ্গে। তিনি একটা ব্যবস্থা করলেন, যাতে মিনিস্ট্রি অফ এজুকেশন এনসিসি-র কাছে আমার নামে দু-হাজার টাকা পাঠাবে। সেটা আমাকে এনসিসি থেকে তুলতে হবে। সেই টাকা এজুকেশন মিনিস্ট্রি থেকে ফিনান্স মিনিস্ট্রির মাধ্যমে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি হয়ে দিল্লি এনসিসি হয়ে মুম্বইয়ের এনসিসিতে আসতে লাগল ন-মাস। দু-হাজার টাকা। সেটাই তখন আমার কাছে অনেক।

জয় মণ্ডল ও তাঁর সেই বিখ্যাত সাইকেল। ছবি সৌজন্য: জয় মণ্ডল
ইত্যবসরে, আমার হাতে তো কোনো টাকা নেই। লজ্জার মাথা খেয়ে চিনুর বাড়িতে রাতে খেতে যাই। সেই নাটকটা রোজ হয়! এখন ভাবি, কী করিনি আমি। যাই হোক, কিছু টাকা তোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। এর মধ্যে আর-একজনের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল একটা কলেজে লেকচার দিতে গিয়ে—ওটা আমি সুযোগ পেলেই করতাম, লেকচার দিয়ে টাকা তোলা। শেখর চক্রবর্তী। তার দিদি একদিন শেখরকে বললেন, তুই জয়কে রিঙ্কিদির কাছে নিয়ে যা না। রিঙ্কিদি অনেক হেল্প করতে পারবেন। রিঙ্কিদি পাশের বাড়িতেই থাকেন।
নী.হা. — রিঙ্কিদি কে?
জ.ম. — জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাসু ভট্টাচার্যের স্ত্রী। থাকেন খাড় বলে একটা জায়গায়। আর জানতে পারলাম রিঙ্কিদি বিমল রায়ের মেয়ে। শেখর নিয়ে গেল। উনি খুব আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, বাসু তো আজ নেই, তুমি পরশু দিন এসো। আমাদের এখানে ডিনার করবে। সেইদিন, রিঙ্কিদি একটা চিঠি করে দিলেন, ‘হৃষিকাকুর’ কাছে। হৃষিকেশ মুখার্জি।
খুঁজে খুঁজে গিয়ে হাজির হলাম। দারোয়ান ঢুকতেই দিল না। বললাম রিঙ্কি ভট্টাচার্য চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন। তো সে চিঠি নিয়ে চলে গেল। তারপর ফিরে এসে আমায় একটা জায়গায় বসতে বলল। ঘণ্টাখানেক বসার পর দেখি এক বয়স্ক ভদ্রলোক অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাইরের ঘর থেকে বেরোচ্ছেন। অমিতাভ দেখলাম নিজেই একটা গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন। তারপর, হৃষিকেশবাবু চিঠি পড়ে বললেন, বাঃ! খুব ভালো। শোনো, তুমি কাল আমার স্টুডিওতে চলে এসো। দেখি কী করতে পারি।

বিশ্বভ্রমণে বেরনোর আগে তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ জানাচ্ছেন শুভেচ্ছা। ১৯৭৫। জয়ের টি-শার্টের পিছনের বার্তাটি উল্লেখযোগ্য — Make Love, Not War! ছবিসৌজন্য জয় মণ্ডল
গেলাম। যথারীতি গার্ড ঢুকতেই দিল না। বললাম, হৃষিকেশ মুখার্জি নিজে আমায় ডেকেছেন। কে কার কথা শোনে। এদিকে আমাকে তো ঢুকতেই হবে। পরের দিন আবার গেলাম। আবার ঢুকতে দিল না। তৃতীয় দিনে কিন্তু ওই গার্ডই ঢুকতে দিল, এই বলে যে আমি বেশিক্ষণ যেন না থাকি। গিয়ে দেখি শুটিং চলছে। অমিতাভ বচ্চন। একগাল দাড়ি। যদ্দূর মনে আছে একটা গানের শুটিং হচ্ছে, ছায়াদেবী একটা গানের রেয়াজ করাচ্ছেন। আর রয়েছেন রেখা। ছবির নাম আলাপ! তো শুটিং শেষ হতে, হৃষিকেশবাবু আমার সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের পরিচয় করিয়েদিলেন। তুমি বিশ্বাস করবে না, নীলাঞ্জন, I got so carried away, আমি যে কারণে গেছি, সেই টাকা চাইতেই ভুলে গেলাম। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থেকে হাতের ডাইরিটা বাড়িয়ে শুধু বলতে পেরেছিলাম, একটু অটোগ্রাফ দেবেন!
নী.হা. — তারপর?
জ.ম. — তারপর আর কী? অমিতাভ বচ্চন চলে গেলেন! কিন্তু বলিউড থেকে আমি কিছু টাকা তুলেছিলাম। এরপর একটা সূত্রে দেখা হল বিজয়ওয়ালে রঙ্গিন বলে একজনের সঙ্গে। ইনি হলেন রামানন্দ সাগরের ছেলে! সেটা নটরাজ স্টুডিওতে। তিনি আমাকে কয়েকজনের নাম দিলেন, আর চিঠি দিয়েদিলেন—সায়রাবানু, রাধা সালুজা, সুজিতকুমার, রাজকুমার, বিনোদ মেহরা আর শশী কাপুর। স্টুডিওগুলোতে ঢোকাই একটা কঠিন কাজ ছিল। আমি দারোয়ানদের সেই চিঠি আর খবরের কাগজে আমাদের বিষয়ে যেসব খবর বেরিয়েছিল তার ক্লিপিং দেখাতাম।
নী.হা. — একটু আটকাচ্ছি, এই টাকা তোলার ব্যাপারটা তুমি একাই করেছিলে? মনমোহনবাবু?
জ.ম. — না, ও থাকতে পারেনি। একাই করতে হয়েছিল।
নী.হা. — আচ্ছা, বলো, সেই স্টুডিওতে ঢোকার কথা বলছিলে…
জ.ম. — হ্যাঁ, তো দিনের পর দিন গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শেষে হয়তো মায়া হত, একটু ঢুকতে দিয়ে দিত। সিকন্দর বলে একটা ছবির শুটিং করছিলেন রাজকুমার। শেষ হতে আমাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। তারপর পকেট থেকে একটা ১০০ টাকার নোট বার করেদিলেন। তখনকার দিনে সেটা অনেক টাকা। বিনোদ মেহরা দিয়েছিলেন ২০০ টাকা। সায়রাবানুর বাড়িতে যেতে কাজের লোক চিঠিটা নিয়ে গেল। একটু পরে উনি এলেন, চিঠিটা হাতে। আমাকে ডাকলেন, বসার ঘরে। গেলাম। বললেন, ‘বাঃ! বহৎ আচ্ছা কাম কর রহে হো! বেস্ট অফ লাক!’ বলে আবার ভিতরে চলে গেলেন। শশী কাপুরকে ধরতে আমার দিন দশেক লাগল। তিনি সব শুনে টুনে আমার ডাইরিতে লিখেদিলেন—Narinder, please do the needful। নরিন্দরকে খুঁজে পেতে আরও দিন দশেক লাগল। শশী কাপুরের সেক্রেটারি। তিনি সেই নোট দেখে বললেন, ‘ম্যায় কেয়া করুঁ, মুঝে তো কুছ নেহি বোলা!’ তারপর আমায় ফোননাম্বার দিলেন। যতবার ফোন করি কেউ ধরে না। শেষে একদিন ধরে বলেদিলেন, ‘নেহি! উনহে ম্যায়নে পুছা, উনহোনে কুছ নেহি বোলা!’

প্রাক্তন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ-এর সঙ্গে, তামিল নাড়ুর কুনুরে তাঁর বাড়িতে। ছবি সৌজন্য: জয় মণ্ডল
এরপর একদিন চিনুর বাবা আমায় পাঠালেন তাঁর এক বন্ধুর কাছে—বাসু চ্যাটার্জি! উনিও আমাকে একদিন রাতে বাড়িতে খেতে ডেকে, গল্প টল্প করে স্টুডিওতে যেতে বললেন। গিয়ে দেখি একটা শুটিং হচ্ছে। একটা ঘর। বাইরে একটা টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। তার নীচে কিছু বাসন পড়ে আছে। আর টিউবওয়েলটার হ্যান্ডেল চাপবেন শাবানা আজমি। আর সেই জলে মুখ ধোবেন বিক্রম। ছবির নাম স্বামী। তো সব রেডি। হঠাৎ বাসু চ্যাটার্জি আমাকে দেখে বললেন, ‘জয়, তুমি তো বাংলার গ্রামের ছেলে। দ্যাখো তো সেটটা ঠিক লাগছে কি না!’ আমি তো অবাক! আমি বললাম, না-না, আপনি যা করেছেন খুবই অথেন্টিক লাগছে। গ্রামবাংলায় এরকমই হয়। তো শুটিং শুরু হয়ে গেল। তারপর যখন ব্রেক হল, এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসেছিলেন তাঁকে গিয়ে বাসু চ্যাটার্জি বললেন, আম্মা! এই ছেলেটি সাইকেলে ঘুরছে। একটু সাহায্য চায়। ইনি জয়া চক্রবর্তী। ছবির প্রডিউসার ছিলেন বোধহয়। তো তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাতে যে পার্স ছিল সেটা খুলে একগোছা নোট বার করে আমাকে দিয়েদিলেন। আমিও না গুনে পকেটে রাখলাম। ভেবেছিলাম ১০০-২০০ টাকা পাব। বাইরে বেরিয়ে গুনে দেখি ১২০০ টাকা! এই গেল বলিউড থেকে আমার টাকা তোলা।
নী.হা. — জয়া চক্রবর্তী কে?
জ.ম. — আরে, জান না? হেমামালিনীর মা!
নী.হা. — ও! যাক, তারপর?
জ.ম.— সবশেষে, আমার পরিচয় হল একজন এয়ারফোর্স অফিসারের সঙ্গে। এয়ারমার্শাল দানি। তিনি সব দেখে টেখে, আমাকে পাঠালেন রজনি প্যাটেল নামের এক বিখ্যাত কংগ্রেস নেতার কাছে। খুঁজে খুঁজে তাঁর বাড়িতে গেলাম। তিনি এসে চিঠিটা দেখলেন। সাদা প্যান্ট, সাদা কুর্তা। উনি কোনো কথা না বলে পকেট থেকে কতগুলো নোট বার করে আমায় দিয়েদিলেন। গুনে দেখলাম ১৫০০ টাকা! আর রতন টাটা আমায় ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন।
এইভাবে আমার প্রথম বিদেশ যাওয়ার জন্য ফরেন এক্সচেঞ্জ তোলার টাকা জোগাড় হল। ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর আমরা রওনা দিয়েদিলাম—কিনিয়ার রাজধানী নাইরোবি।
(ক্রমশ…পরের কিস্তি পড়ুন ৯ ডিসেম্বর)
Subhajit Sekhar Naskar | 165.225.***.*** | ২৬ নভেম্বর ২০২০ ১৫:১১100676এই রাজনী পাটিল মনে হয় অমিশা পাটিল এর দাদু
জমাটি সিরিজ। অপেক্ষায় থাকি।
স্বপ্নের কোনও অবয়ব হয় না। তাকে কল্পনা থেকে বিন্দু বিন্দু গড়ে নিতে হয়, দিতে হয় মজবুত খাঁচা, যথেষ্ট পেশী ও চামড়া। তারপর রূপটান। তখন পছন্দ হ'লে তবে সে প্রাণস্পন্দন পায়। প্রতি স্তরে মনোযোগ ও যত্নেই বেড়ে উঠতে পারে সে।
সাইকেলে মহাদেশ পাড়ি - আর তার নির্মাণ প্রক্রিয়াও এত বিশদে দেওয়ার জন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ। এটা ছাড়া সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ থাকত।
ASHIS GOON | ১২ ডিসেম্বর ২০২০ ০৭:২৪101055অসাধারণ। এই হচ্ছে সংকল্পের দৃঢ়তা! অবিশ্বাাস্য! প্রতিটি সংখ্যায় জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যাাচ্ছে ।
দুর্দান্ত
reeta bandyopadhyay | ০৩ ডিসেম্বর ২০২১ ২২:৪৩501665