খাদ্যসংস্কৃতি। শুনেছেন তো কথাটা? এতটা বয়স হল, তবে তো জানতে পারলাম খাওয়াটাও একটা সংস্কৃতি। নাচ, গান, নাটক, লেখালেখি... এইসবই তো জানতাম কালচারের আঙিনায় পড়ে। যেমন উল্লেখ করবেন, অমুকচন্দ্র তমুক এক বিখ্যাত অভিনেতা, বা প্রবন্ধকার বা চিত্রশিল্পী। আগে তো কখনও শুনিনি—ইনি হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় তমুকবাবু, দেশের এক তন্নিষ্ঠ খাইয়ে লোক, বলে কারও পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। এটা নতুন, ইদানীং যেমন তর্কশিল্পীও বাজারে খুব খাচ্ছে পাবলিকে।
আগে ধরুন খেয়ে পছন্দ হলে বলতাম, কী ফাটাফাটি হয়েছে! বা অমন কিছু। খারাপ লাগলে এক কামড় দিয়ে নাক সিঁটকে সরিয়ে দিতাম। ব্যাস, খাবার সমালোচনা ওখানেই শেষ। তবে খুব অন্তরঙ্গ মহলে বিপুল খেয়ে মেঘগর্জনের মতন ঢেঁকুর তুললেও লোকে খারাপ ভাবত না। রাঁধিয়ে খুশিই হতেন।
কিন্তু এখন লোকে চায় বিভিন্নভাবে খাবারের গুণাগুণের সূক্ষ্ম বিচার। গন্ধ, টেক্সচার, প্রিয়দর্শন কি না, কেমন রং এবং অবশ্যই স্বাদ।
তা ধরুন তিরিশ বছর ধরে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছি। সব সময়েই ফ্যাকটরিতেই কাজ ও সেখানকার ক্যান্টিনে খাওয়া—যা অনেক সময়েই লাঞ্চ তো নয়, লাঞ্ছনামাত্র, সেগুলোই খেয়েছি। উপায় কী?
সবই স্থানীয় তরকারি—আইডেন্টিফাই করা অসম্ভব। কিন্তু নির্দ্বিধায় গিলে নিতাম কাঁকরোল, চিচিংগা, ধুঁধুল বা আরও কীসব। নাম না জানলেও বিভিন্নভাবে ক্লাসিফাই করে রাখতাম।
যেমন ধরুন টেক্সচার ছিল তিনরকমের—কচকচে, ল্যাৎপ্যাতে আর হড়হড়ে। রংও তিনটি—যেমন বেবাক সবুজ, খুনখারাপি লাল ও ডায়রিয়া হলুদ। গন্ধ হচ্ছে টকটক, গড়গড়ে ও পিওর মূলো। খেতে প্রায় সবই এক।
চিফ কেমিস্টও বাঙালি। তিনিও ঠিক ধরতে পারতেন না, বলতেন, ব্লটিং পেপার তো ডেফিনিটলি আছে আর সেটা গাঁদাল পাতার রসে ম্যারিনেট করেছে। কিন্তু অ্যাসবেস্টস দিয়ে এরকম ম্যাজেন্টা রংটা আনল কী করে?
আর দইও সবসময়ে খাওয়া যেত না। এক চামচ মুখে দিতেই পায়ের নখ থেকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠত—এইসা টক। চারিদিক থেকে তৃপ্তির হুসহাস আওয়াজের মধ্যে আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকতাম।
বাধ্য হয়েই আমি, ওই একবারই, একটা নতুন খাবার ‘আবিষ্কার’ করেছিলাম। সেটি কলার রোল। বাড়িতেই করতে পারেন। শেষপাতে একটা কলা থাকত। সেটিকে বরাদ্দ দুটি আটার রুটির মধ্যে দিয়ে রোল বানিয়ে খেয়ে নিন। যেমন সিম্পল তেমনই স্বাস্থ্যকর।
এই নিয়ে বেশি লেখাও যাবে না। সবারই তো ৫৬ ইঞ্চি সেন্টিমেন্ট—কার কোথায় আঘাত লেগে যাবে, কে জানে?
বাংলাদেশের সাইফুর রহমানের লেখায় পড়লাম ধৃতিকান্ত লাহিড়ি চৌধুরী মহাশয় ‘দেশে দেশে মোর ডিশ আছে’ কইতেন ও স্বচ্ছন্দে বাদুড় খেতেন। আরে না রে বাবা, না। তখন কোভিড-টোভিড কোথায়। সে তো অনেকদিন আগের কথা, তখন বাদুড়েরাও খুব ভালোমানুষ ছিল। আর ভ্লাদিমির নবোকভ, যখন নভেল-টভেল লিখতেন না, তখন খেতেন প্রজাপতি আর হেমিংওয়ের প্রিয় ছিল কাঠবিড়ালি শিকার করে খাওয়া।
মেদিনীপুরের দিকে ‘কাকমারা’ নামে তেলুগুভাষী একগোষ্ঠী আছে, যাদের প্রিয় খাদ্য কাক (ওনাদের সম্পর্কে একটু খোঁজ নিতে চাইলে পড়ুন উমা ভট্টাচার্যের ছোটো লেখা ‘বিচিত্র জনজাতি কাকমারা’)। সম্প্রদায়ের নামই হয়ে গেল খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। খুবই পোলিটিকালি ইনকরেক্ট আরও উদাহরণ তো নাকের সামনেই, মছলিখোর (বঙ্গালি), বা ছাতুখোর (পশ্চিমা), বা জাস্ট তেঁতুল। ইশকুল জীবনে অনেক জেলায় অনেক স্কুলে পড়েছি—সেখানে আমার বাঙাল পরিচয় প্রকাশ পেতে সহপাঠীদের সে কী হাসি! আঙুল তুলে একজনা বলে “তোরা তো শুঁটকি খাস।” চারিদিকে সশব্দ নাসিকাকুঞ্চন। এর থেকে খারাপ আর কী হয়? আচ্ছা, এই যে ভেতো বাঙালি—সেটা ভাতের থেকেই তো নাকি ভীতুর অপভ্রংশ?
যে ফরাসি জাত ৩৬০ ডিগ্রি সংস্কৃতিতে গলা অবধি ঠেসে আছে, তাদেরকে লোকে অপমান করে ‘ফ্রগ’ বলে? কেন? না, ওদের প্রচণ্ড কালচার্ড মেনুতে ব্যাঙের ঠ্যাংও আছে। শুধু ওই একটি কারণেই। ভাবতে পারেন? খাদ্যসংস্কৃতির আনাচে কানাচে কত যে সব এরকম অলিগলি আছে, সে হিসেব কে রাখে, বলুন?
খুব শখ চাগলে মুরশিদাবাদের মুর্গ ইয়াখনি খেতে পারেন। একটি জোয়ান মোরগকে খুব শক্তিশালী বিষ আটার সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দিন। সেটি মারা গেলে তার বিষাক্ত মাংস খাওয়ান আর-একটি মোরগকে, সেটি মারা গেলে… এরকম করে কয়েকবার করলে শেষে একটি মোরগই থাকবে, বিষক্রিয়ায় যার পালক সব পড়ে যাবে, কিন্তু সে বেঁচে থাকবে। একেবারে রোমহর্ষক ব্যাপার। ব্যাস। সেটিকে রান্না করে বাদশাকে খেতে দিন। তারপরে বুঝে নিন বাদশাহের জমজমাট ক্ষমতা! এর থেকেও আরও এলাহিভাবে তৈরি হত একধরনের জাফরানি মুর্গ, সেটি বিস্তারিত ভাবে পড়ুন এই গুরুচণ্ডালিতেই প্রকাশিত শ্রীযুক্ত ন্যাড়াবাবুর ‘খানাকুল’ লেখায় (সার্চ মারুন)। তবে এইসব খাওয়ার মূল উদ্দেশ্যে ছিল এক বলবর্ধক হেকিমি দাওয়াই তৈরি করা। ‘ভোজ কয় যাহারে’, ঠিক তেমনটি নয়।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, আর-একটা নবাবি রূপকথা বলি। কোনো লিংক-টিংক নেই, তথ্যপ্রমাণাদি কিছুই দিতে পারবো না। সাক্ষীও না।
পুরাকালে, দুই নবাবে খুব রেষারেষি ছিল, মানে ফ্রেন্ডলি ঝগড়া। কার সুইকার বেশি ভালো, সেই নিয়ে। তো এক নবাব অন্যজনকে ডেকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ালেন সাত রঙের পুলাউ। সাতরকমের রঙের চালের এক রামধনু ভোজ। খেতে যেরকমই হোক, সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল। দ্বিতীয়জন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের প্রাসাদে ফিরে পালটা নেমন্তন্ন করলেন, সবাই উদ্গ্রীব, এইবারে না জানি কী হয়। তো খাবার এল প্রকাণ্ড থালায়, জাস্ট একচামচ ফ্যাটফ্যাটে সাদা ভাত। তার সাথে কিস্যু না, খালি ঘড়া ভরতি করে ঠান্ডা জল। আমন্ত্রিত নবাবের তো জিভের বদলে চোখে জল চলে এল। ওই একচামচ ভাতে কী হবে?
ওইখানেই তো ম্যাজিক। ঘিয়েতে জারিয়ে জারিয়ে সেই চাল এমনই গুরুপাক যে কয়েকদানা পেটে যেতেই প্রাণ আইঢাই। ভুঁড়ি ফেটে যায় আর কী। তখন ওই ঠান্ডা জল গিলে গিলে স্বস্তি। বুঝুন, সংস্কৃতি কাকে বলে।১
আধুনিক এই খাদ্যসংস্কৃতির একটা বড়ো প্রস্তাব হচ্চে কোনো খাবারই ফ্যালনা নয়। ইটি বাড়ির খাবার আর সেটি কায়দার রেস্তোরাঁয় বসে ইংরেজিতে অর্ডার দিয়ে খাব—অমন ফারাক নেই। আমি তো থাকি ব্যাংগালোরে—এখন দেখছি স্পেশালিটি বাঙালি রেস্টুরেন্টে তেলেভাজা, বোঁদে, ঝালমুড়ি এইসব তো বেশ পুরোনো হয়ে গেছে, একেবারে সর্বভারতীয় খাবার যেমন খিচুড়ির এক্সক্লুসিভ দোকান হয়ে গেছে, হয়েছে শিঙাড়ারও (সামোসা মশাই সামোসা)। ঠান্ডাঘরে বসে খান বা বাড়িতে অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসুন, পাবেন গুড়ের চা-ও।
কলকাতায় কি পাওয়া যাবে কোনো খাবারের দোকানে পান্তা ভাত বা ফ্যানা ভাত? আলুসেদ্দো ডিম সেদ্দো বা বড়া ভাজার সাথে? এখন তো খুবই চালু ব্র্যান্ডেড চানাচুর। দু-তিনরকমের নাড়ুও বিক্কিরি হচ্ছে শপিংমলে। তা আমাজনে নাকি পয়সা দিলে ঘুঁটেও সাপ্লাই করে, এসব খাবার তো তুচ্ছু।
আর অ্যামবিয়েন্স?
লেখক শংকর বলেছিলেন সাহেবমেমদের দেশে থিম রেস্টুরেন্টে কীরকম খুঁটিনাটির দিকে নজর। এ আপনার ধাবা নামে রেস্টুরেন্ট খুলে কোনের দিকে একটা আস্ত ট্যাক্সি বসিয়ে আর দেয়ালে কয়েকটা টায়ার ঝুলিয়ে দিলেন বা ফিশারম্যান কোভে ছাদের থেকে একটা মাছের জাল ঝুলিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললেন ওরকম গাজোয়ারি ‘ডেকরেশন’ বা ওইরকম শৌখিন মজদুরি নয়।
উনি সাজেস্ট করেছিলেন, হোক একটা বাঙালি রেস্তরাঁ, মাটিতে পিঁড়ির উপর বাবু হয়ে বসুন, খাবার আসুক কাঁসার থালায় আর বাটিতে। মেনু হবে একেবারে ছাপোষা আর ঘরোয়া। এক বৃদ্ধা পিসিমা গোছের মহিলা হাতপাখার বাতাস করতে করতে বলবেন, “আর দুটি ভাত দিই?” “কাতলার ওই পেটিটাও নাও না বাছা, কাঁটা কম হবে?” পান চিবুতে চিবুতে চলে যাওয়ার সময় সহাস্য জ্যাঠামশাই গোছের একজন সস্নেহে বলবেন, “পেট ভরে খেয়েছেন তো? হেঁহেঁহেঁ।” এইরকম।
এসব শুনে এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আরও বললেন, উত্তম প্রস্তাব। বেশ পোটেনশিয়াল আছে। দুটো তিনটে হুলোবেড়াল থাকলেই বা মন্দ কী? আপনি মাছ খাবেন আর সে জুলজুল করে তাকিয়ে মাঝে মধ্যেই থাবা উঁচিয়ে মিয়াও ফ্যাঁস আওয়াজ করবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে, খবরদার ওই ভাটিয়ালি বা রবীন্দ্রসংগীত নয়। সাইকেল রিসকার প্যাঁকপোক, অটোর মেঘগর্জন, বাসের ব্রেক কষার আওয়াজ আর দূরাগত কিছু ঝগড়াঝাঁটি, মৃদুস্বরে কিছু সম্পূর্ণ দিশি অসভ্য কথা, আর স্লোগানের মন্দ্রধনি। আপনেরা যাঁরা উদ্যোগী বীরসিংহ, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন।
এই সপ্তাহে খান মাংসের কেওড়ামি।
মাংস বা মুরগি—ওই যেমন রান্না করেন, আস্ত মশলা, প্যাঁজ, আদা-রসুন, লঙ্কা, হলুদ, ধনে, জিরে আর অপশনাল টমেটো। এইবারে একেবারে নামানোর আগে একটু কেওড়ার জল দেবেন।
ভালো করে পড়েছেন তো? ‘একটু’ আর ‘কেওড়ার জল’, দুটোই ইম্পর্ট্যান্ট। ওই কেজিখানেক মুরগি/মাটন হলে একছিপিই যথেষ্ট। আর শুনুন, বাজারে (মানে দেশে) দুইধরনের কেওড়া পাওয়া যায়। একটা থাকে ছোটো শিশিতে—সেটি কত জিবির কে জানে? ভীষণ স্ট্রং। ওটা দেবেন না। একটু নার্ভাস হয়ে হাত কাঁপলেই হয়ে গেল। রান্না তো বটেই, পুরো বাড়িটাই কেওড়াময় হয়ে যাবে। দ্বিতীয়টি ডাইলুটেড ভার্শান, মানে keora water—দেশে ডাবর কোম্পানির পাওয়া যায়, আমি এটাই ইউজ করি।
যদি শান বা ওরকম নামি কোম্পানির ‘কোর্মা’ মশলা পান, তো চুপচাপ সেটা দিয়ে রেঁধে সামান্য কেওড়ামি করুন। দেখুন, গেস্টরা কী বলে? আমার পরিচিত কয়েকজন তো স্রেফ কেঁদে ফেলেছিলেন।
১) ডিডি মহাশয়ের একাহিনির বীজ যে আবদুল হালিম শরর-এর বিখ্যাত কেতাব ‘হিন্দুস্তান-মে মশরিকি তমদ্দুন কা আখরি নমুনা ইয়ানি গুজ়িশ্তা লখনও’-তে (হিন্দুস্তানে প্রাচ্য সংস্কৃতির শেষ নমুনা অর্থাৎ হারানো লখনও) রয়েছে তা সন্দেহাতীত। শরর-বর্ণীত কাহিনিটা এরকম— শুজা উদ-দৌলার জমানায় নবাব সালারজঙ্গ্-এর রকাবদারের ছিল সবথেকে ডাকসাইটে রকাবদার—মাসে ১২০০ টাকা মাইনে, ‘যেমনটা ইতিহাসে আর কোনও রকাবদার পাননি কোনওদিন।’ এই রকাবদার স্রেফ সালারজঙ্গ্ বাহাদুরের জন্য রাঁধতেন এমন একটি পোলাও, যা হজম করার হিম্মত আর কারও ছিল না। একদিন নবাব শুজা-র বড়ো খোয়াহিশ হল এই পোলাও চাখার। এত্তেলা পাঠালেন সালারজঙ্গ্কে—‘জনাব, আপনার সেই মশহুর পুলাও আমাকেও খাওয়ান না একদিন।’
‘অবশ্যই আলম-পনা। আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার দস্তরখওয়ান লাগার আগেই।’
তারপরেই সালারজঙ্গি হাঁক—ওরে কে আছিস, রকাবদারকে বলে দে আমার জন্য যে পুলাও হয়, আজ হবে তার দ্বিগুণ। খবর হয়ে গেল বাওর্চিখানায়। রকাবদার সোজা হাজির সালারজঙ্গ্-এর আরামখানায়। ‘কী ব্যাপার হুজুর? আমি তো আপনার জন্য ছাড়া আর কারও জন্য খানা পাকাই না।’
‘নবাব খোদ খেতে চেয়েছেন। আর তুমি বলছ রাঁধতে পারবে না?’
‘ঠিক! পারব না। আপনার জন্য ছাড়া আর কারও জন্য না, তিনি যেই হন না কেন।’
হুকুম অচিরেই গলে গেল অনুরোধে, শেষে খোশামদ— রেঁধে দাও ভাই একবার।
অনেক কাকতি-মিনতির পর রকাবদারের জবাব, ‘ঠিক হ্যায়। দেব। কিন্তু শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত আবার?’
‘পুলাও আপনি নিজে হাতে নবাবের কাছে নিয়ে যাবেন। নবাবের সামনে বসে তাঁকে খাওয়াবেন। কয়েক গরসের বেশি কিছুতেই খেতে দেবেন না। সঙ্গে রাখবেন প্রচুর ঠান্ডা জল। রাজি?’
‘রাজি ভায়া। যাও এবার হেঁশেল যাও দেখি।’
সেই পুলাও নিয়ে সালার হাজির হলেন শুজার খাস দিওয়ানখানায়। কয়েক গরস মুখে দিয়ে শুজার আহ্লাদ আর ধরে না। কিন্তু এরই মধ্যে সালারজঙ্গ্-এর বাধা—আর না আলম-পনা, এই থাক। শুজাউদ-দৌলা যে চাহনিটা দিলেন তাকে বাংলায় বলে ভস্ম-করে-দেওয়া। এবং যেভাবে খেতে থাকলেন তাকে বাংলাতে বলে—গোস্তাখি মাফ—গোগ্রাসে গেলা। আর কয়েক গরস খাওয়ার পরেই নবাব বুঝলেন। কী যেন একটা ঘটছে। গলা একেবারে শুকিয়ে আসছে— কয়েক মুহূর্তে মনে হল তাঁর ছাতিটা ফেটে যাবে তৃষ্ণায়। শেষে সালারজঙ্গ্-এর নির্দেশে তৈরি রাখা ঠান্ডা পানি প্রাণ ভরে খেয়ে ধড়ে প্রাণ এল তাঁর। এমনই ছিল সেই রকাবদারের রোয়াব!—সম্পাদক নীলাঞ্জন হাজরা
ওহ ডিডি! কতা হবে না।
অসাধারন লেখা, দুর্দান্ত লেখা। দুবার পড়ে ফেল্লাম :-)
কেঁদে ই ফেললেন ? :))
এই জিনিষটা ঠিক কি আর কোথায় কিভাবে পাওয়া যায়? নাকি কালের কপোলতলে বিলুপ্ত?
ধুত্রর বীজ দিয়ে তৈরি করুন। তবে কাউকে দেওয়ার আগে নিজে টেস্ট করে নেবেন। এখনো অব্দি কোনো কমপ্লেন জমা পড়েনি।
এটা খানাকুল সিরিজের জন্যে লিখে রেখেহছিলাম, পোস্ট করা হয়নি। এই কিচাইনের সূত্রে মনে পড়ল।
------------
দারুণ। পড়েই খিদে পেয়ে গেল।
লাস্টটাইম নন্দীগ্রামে নয়, হরিপুরে। ২০০৬ সাল।শীতকাল।পরমাণু বিদ্যুত প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের তথ্যচিত্র তৈরির নিমিত্ত মূল রাস্তা ছেড়ে গ্রামে ঢুকেছি সকাল সাতটা।বসতবাড়ী,ধানের গোলা,সজনে গাছের ছায়া মাখানো গুলজারের“ইজাজত” ছবির জাপানি ফ্রেম গৃহস্তের পুকুরে গোয়ালের ধারে লটকে আছে।তারপর সবজি খেত মাটির রাস্তা,তেঁতুল গাছ,নলেন গুড়ের ভাঁটি,বট গাছের ছায়ার মায়া টপকে একদম সমুদ্রের ধারে মাছের খটিতে পৌছতে পৌছতে দশটা বেজে গেলো।বাসনা ছিল “ আঁখো দেখি হাল” মানে কয়েকশো মাছের খটি থেকে উৎখাত হতে পারেন এমন ফিশারমেনের অন্দরের কথা ক্যামেরাবন্দি করা । সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া ও অস্থায়ী চায়ের দোকানের আবহে ক্যামেরা চালু করার আগে প্রায় দু ঘণ্টা আমাদের ইন্তারভ্যু দিতে হোল । “কী কাজ কী কথা সেটা বড়ো কথা নয় আগে বলো তুমি(তোমরা) কোন দল”।ভুললে চলবে না,মেদিনীপুর নন্দীগ্রামের আগে দু-দুবার স্বাধীন হয়েছিল,এই বহিরাগতের ধরাধামে ল্যান্ড করার দশ বছর আগে।হরিপুরও স্বদেশৗ,ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। বারোটা বেজে গেলো।প্রয়োজনীয় সাক্ষাৎকার শেষ হোল প্রায় দেড়টায়।এদিকে পাকস্থলীতে আট দফা ভোটের মহড়া।ফলে মগজে অক্সিজেনের ঘাটতি ।পাঁচ হাত দূরে প্রবীণ দম্পতির অস্থায়ী চালাঘর ডিপ-টিউবওয়েলের পাশে।পান,বিড়ি, পার্লে-জি,সিগারেট,লেবেঞ্চুস,চানাচুর,ডিস্পিরিন,কান খুসকি, গুটকার দোকানের এককোনে ছোট একটি কেরোসিন স্টোভ,শিরে হাঁড়ি শোভিত,দন্তবিকশিত।দম্পতি সংসার পাতেন ( না,হাওয়া বদলাতে দক্ষিণ সমুদ্র তীরে আসেন ?) প্রতিবছর,যে-কদিন মাছ ধরা ও সমুদ্রের বেলাভুমিতে মাছ শুকোনোর মরশুম। “মাসীমা,ভাত খামু”।তো মাসীমা রাজি ।দিম্ভাত ।“নীড় ছোট ক্ষতি নেই...” গুনগুন করতে করতে বালিতে সদ্য সমুদ্র ফেরত নৌকোর লো এঙ্গেল শট নিয়ে আধ ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। সমুদ্রের নোনা হাওয়া ও গভীর নলকূপের অতি ঠাণ্ডা জলের যৌথ সঙ্গতে কাকস্নান সেরে কাঁপতে কাঁপতে মাসীমার পাতা মাদুরের আসনে বসে গরম গরম মোটা লাল চালের ধোঁয়া ওঠা ভাত, পেঁয়াজ শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া মুসুর ডাল ও ডিমের ঝোলে ডুব দিলাম,তিনজন। একটু ধাতস্থ হয়ে চোখ গেলো হাঁড়ির কোনে রাখা ছোট একটি বাটির দিকে। লালচে রঙের(এ রং,সে রং নয় )টাটকা চুনো মাছের চচ্চড়ি,নিজেদের জন্য রেঁধে রেখেছিলেন।লজ্জাহীন,বলে ফেললাম ,মাসিমা একটু হবে? তারপর, এতো বছর, নন্দীগ্রাম,সিঙ্গুর,ইউ-পি-এ,সিঙ্ঘু সীমান্ত ,শীতলখুচি,সেকেন্ড ওয়েভ,থার্ড ওয়েভের আক্রমণের মুখেও, টাগরায় টিকে আছে,উদাসীন চুনো মাছের ঝাঁঝালো ঝাল।আ-হা। প্রবীণ দম্পতিকে মাছের ঝালের জন্য অতিরিক্ত মুল্য দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সফল হই নি।