দাঁড়ান। ক্ষণকাল তিষ্ঠান। ব্যাপারটা বুঝুন।
এই এমন দুই কি আড়াই প্রজন্ম আগেও ছোঁচা, হ্যাংলা, পেটুক এইসব ছিল গালিবিশেষ। কর্ণও ভীমকে গালি দিতে গিয়ে ‘উদরপরায়ণ’ বলেছেন। আর এখন দেখুন, ‘আমি একজন ফুডি’ এই কথা সগর্বে কইতে পারবেন আড্ডায়। লোকে মানবে, এমনকি সমীহও করবে। ‘আমিও কম ফুডি নই’ বলে হয়তো সদর্পে চ্যালেঞ্জ করবেন অন্য কেউ।
তারপর ধরুন, ওই আছে না? ওই গ্লোবালাইজেশন? লোকে বিদেশে যাচ্ছে বিস্তর। তায় সোস্যাল মিডিয়া। হাতের মুঠোয় বিশ্ব। খাবারের খবরের একেবারে এক্সপ্লোশন। চাপ কি কম? কতরকমের কুইজিন যে শহরের পথেঘাটে। কতরকমের ভ্যারাইটির খাবার। এ ছাড়াও তো নিত্তিনতুন বিভিন্ন খাবারের ‘আবিষ্কার’ চলছে।
রথের মেলার তাই আইকন আর শুধুই তেলেভাজা আর জিলিপি নয়—স্বচ্ছন্দে ঠাঁই নিয়েছে চাউমিন আর মোমোও। কোথায় জানি হারিয়ে গেল টিপিকাল চপ আর কাটলেটেরা। এইজন্যই তো কবি বলেছেন... মানে নিশ্চয়ই কিছু বলেছেন। পরে মনে পড়লে লিখে দোব।
বেশ কয়েকটি ট্রেন্ড আছে এই ‘নতুন খাব, দেদার খাব’ বিবর্তনের। আজ দুটোর কথা বলি।
একটা তো ফিউশন, অন্যটি অথেন্টিক।
ফিউশন নাম নিয়ে কনফিউশন? আমার তো নিজেরই একটু ধন্দ আছে। আমার তো মনে হয় হাইব্রিড কথাটা বেশি কাছের। সে যাকগে, পাত্রাধার তৈল না তৈলাধার পাত্র, সে নিয়ে আর তক্কো করে কী হবে? পাবলিক যখন খাচ্ছে—মানে নাম এবং খাবার—তো সেটাই বহাল থাকুক। গোদা বাংলায় ব্যাপারটা হাঁসজারু। খুব কঠিন ভাবে বলতে গেলে আত্মীকরণ। যাকগে, আপনারা তো সবাই জানেন ব্যাপারটা কী, আমি খামোখা এককথায় প্রকাশ করতে ব্যস্ত হই কেন?
তাই রাস্তায় ‘অন্ধ্র স্টাইল চাইনিজ ফুড’ দেখলে, আগে ভাবতাম ইয়ার্কি মারছে কেউ। কিন্তু এখন সেটা খুব ন্যাচারাল ব্যাপার। ‘বেঙ্গালুরুতে বাঙালি চাইনিজ ফুড কোথায় সবচে’ ভালো?’ এই প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর পাবেন। কেউ হতভম্ব হয়ে যাবে না। তাই স্বচ্ছন্দেই মেনুকার্ডে স্থান পায় গোবি মাঞ্চুরিয়ান আর চিলি পটাটো। ‘ইন্দো-চাইনিজ ফুড’ স্বমহিমায় নিজের জায়গা করে নেয় খাওয়ার ঘরানার লিস্টে।
হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি তো হয়ই। ঠাট্টা করে বললেন, ‘হি হি হি, সেদিন একজন চাউমিনের পায়েস খাওয়াল, হো হো’ বলে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে দেখলেন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি গম্ভীর হয়ে বলছেন, ‘আমিও বানাই ওটা, তবে হ্যালোপেনো কম দিই’।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব আমরা জানতাম একটি প্রবাদবাক্য মাত্র। ইকুয়াল টু সোনার পাথরবাটি। কিন্তু এখন আর নয়। কাঁঠালের বিরিয়ানি তো দিব্বি চলে। বেঙ্গালুরুতে বড়ো স্ট্রিটফুড চেইন ‘নাইনটিনাইন ধোসা’। তাতে ধোসার মধ্যে যা ইচ্ছে তাই (ম্যাগি, কিমা, কলা, আলুপোস্তো... এনিথিং) ঠেসে দিয়ে ৯৯ টা ভ্যারাইটি হাজির। লোকে খায়ও বিস্তর। কলকাতায় দেখলাম ওই মতনই এক দোকানে ৯৯ ধরনের রসগোল্লা আছে। নলেন গুড়ের রসগোল্লা তো সুপারহিট। স্ট্রবেরি, আম, ভ্যানিলা, গন্ধলেবু, এমনকি ভদকা ফ্লেবার্ড রসগোল্লাও দিব্বি চলে।
না, মনু থাকলে তো খুশি হতেনই না এইসব অনাছিষ্টি কাণ্ডে, পাণিনিও না। কিন্তু এখনকার ছেলেছোকরারা বলবে এ সব হচ্ছে ডিকন্সট্রাকশান। কোন্ এক সাহেব নাকি বলে দিয়েছেন আগেই। না, না আমাদের মার্কস বাবু নন। যদিও উনিও অ্যান্টিথিসিস, সিনথেসিস এইসব কী সব জানি বলেছিলেন। সে অন্য এক সাহেব। তা আমাদের বিশ্বকবিও তো বলেছেন ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’… হ্যান ত্যান। আর সত্যি বলতে কি দু-একটা পদ খেতেও কিছু খারাপ হয় না।
তো এই যুগাবতারের শেষে হুজুগবতারের কল্পে এই ট্রেন্ডের শেষ কোথায়কে জানে? মালপোয়ার কালিয়া নাকি পিৎজার নাড়ু? সে যাই হোক, আমি তো আপত্তির কিছু দেখি না। পাবলিকে খেলে—চলবে।
তো, আপতত এই রান্নাটা খেয়ে দেখুন। এটার রেসিপি এতই সামান্য যে এটাকে রেসিপি না বলে টেসিপি বলতে পারেন।
১. ফুলকফির ছোটো ছোটো টুকরো, টম্যাটো আর আলুও অমনি, হলুদ আর নুন ছিটিয়ে, কাঁচালঙ্কার কুচি দিয়ে, মটরশুঁটির সাথে একত্তর করে সরষের তেল দিয়ে চটকে মটকে মেখে একটা ঢাকনাওলা কড়াইতে দিয়ে দিন। ননস্টিক হলে তো কথাই নেই।
না আর ২ নেই। ব্যাস। এটাই রেসিপি।
এইবারে গ্যাসে বসিয়ে দিন। মাঝে মধ্যে উঁকি মেরে দেখুন সেদ্দ হল কি না। শেষের দিকটায় একটু ধনেপাতাও দিন। আর কিছু না। খেয়ে দেখুন, জমল কি না?
আর-একটা কথা, আমি সব তরকারিই মিনিট দুই-তিন ‘ব্লঞ্চ’ করে নেই। করোনাকালে এ তো খুবই স্বাস্থ্যসম্মত বিধি, তা ছাড়াও, আমার মতে ওতে টেস্টও খোলে।
বেশ। এইবারে আসুন ‘অথেন্টিক’ কুইজিনে।
অথেন্টিক ব্যাপারটাই বেশ গোলমেলে। এখন যেটা আপনার চোখে ফিউশন বা বিভ্রাট মনে হচ্ছে আগামী দিনে সেটাই হবে অথেন্টিক।
এই চাইনিজ ফুডই দেখুন। ‘ট্যাংরা স্টাইল চাইনিজ’ খাওয়ায় আপনি যদি আপত্তির কারণ খুঁজে পান তো একটু সবুর করুন, শিগগিরই দেখতে পাবেন ‘অথেন্টিক ট্যাংরা স্টাইল চাইনিজ’ খাবারের বিজ্ঞাপন। সিনেথেসিসের একেবারে হদ্দমুদ্দ।
আসলে শুধু খাওয়ার পদই শুধু নয়, আমাদের চিরকালীন খাওয়ার যেটা চল আছে সেটা যাবে কী করে? আমরা ছোটোবেলার থেকেই তিন চাট্টে মাংসের টুকরো আর এক বাটি ঝোল দিয়ে দিব্বি এক কাঁসি ভাত সাঁটিয়ে ফেলি। অথেন্টিক চিনা খাবারেও এই সিস্টেমই চালাতে হয় আমাদের। তাই একথালা ফ্রায়েড রাইস বা নুডল, গোটা চারেক চিলিচিকেনের টুকরো দিয়ে (উইথ গ্রেভি, মাইন্ড ইট, উইথ গ্রেভি) উড়িয়ে দেই আমরা স্বচ্ছন্দে। নিকুচি করেছে চিনাদের অথেন্টিক খাবার এস্টাইল। আমরা তাই ভাত আর মাংসের ঝোলের পরম্পরাই মেনে চলি, চিনা কুইজিনেও।
চিরস্থায়ী হলে, তবেই তো অথেন্টিক। তো বহমান জীবনের কোন্টাই বা পার্মানেন্ট? নাচ, গান, ভাষা—সবই তো বদলে যায়। অথেন্টিক কথাটাও, তাই কালনির্ভর। আ মরি বাংলা ভাষা—সে মঙ্গলকাব্যে যা ছিল, পরে রামমোহন, বঙ্কিম, রবিবাবু, কল্লোল যুগ থেকে একেবারে রিসেন্ট ডিডি (আমি নিজের কথাই কইলাম, হেঁ হেঁ হেঁ), সবাই কি আর একই ভাষা বলেন? এর মধ্যে তাহলে অথেন্টিক বাংলা কোন্টি? উত্তর হচ্ছে—সব ক-টিই, যদি ভাষার সাথে সেই সময়টাকেও যোগ করে দেওয়া যায়।
তাও, লোকে চেষ্টা করে। কারণ মানুষের হাতে সময় ও টাকা, দুটোই প্রচুর।
যাকে বলে রেপ্লিকেট করা। ইতালিয়ানরা এখন যেরকমভাবে মিলানে বসে পিৎজা খাচ্ছেন, সেটাই তালতলায় বসে তৈরি করা।
যেমন ধরুন আমার ভাগ্নে। কলকাতার এক বিজ্ঞানী। আবার ইতালির কোথায় জানি ভিজিটিং প্রফেসর। কয় মাস পর পরই যায়। খুব রান্নার শখ। তার পাস্তা বানানো দেখে আমার এক্কেবারে আক্কেল গুড়ুম।
সে চিজই দেয় তিন রকমের—মোজরেল্লা, চেডার আর গরগনজোল্লা। সবই আমদানি মাল। পাস্তা, সস আর তেলের তো কথাই নেই, এমনকি টমেটো পেস্ট, মাশরুম, প্যাঁজ ,অলিভ—সবই কৌটোবন্দি হয়ে এসেছে ইতালি থেকে। রোদে শুকানো টমেটোও।
সে সগর্বে আমায় দ্যাখায় তার রান্না উপাচার। আমি হাঁ হাঁ করে উঠি। ‘ও কী, ও কী? অমন ডুরুমগমের পাস্তা, স্রেফ কলকাতার জলেই সেদ্দো করেছিস?’ ভাগ্নের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে, চোখ ছলছল করে। অস্ফুটে বলে ‘কিছু কমপ্রোমাইজ তো করতেই হয় গো, মামু’।
খেয়ে দেখি, যেমন ভেবেছিলাম সেরকমই, নিশ্চয়ই খুব অথেন্টিক পাস্তা হয়েছে, কিন্তু তেমন টেস্টি হল কই?
আসলে দেশে বসে বিদেশের রান্নাতেও একটা স্নবারি এসে গেছে। কে কীরকম দুষ্প্রাপ্য জিনিস এনে একটা ‘ক্যামন দিলাম’ গোছের ভাব দেখাতে পারে সেটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। কীসের জন্য এই ‘অথেন্টিক’-এর জন্য ক্ষ্যাপামি?
হ্যাঁ, এইবারে মনে পড়েছে, কবি তো বলেইছেন ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’। রবি ঠাকুর ছাড়া, সত্যি, রেসিপিও লেখা যায় না।
আচ্ছা, এবার একটা রেসিপি দেই। ইটিও ভেজেটারিয়ান, কিন্তু খেয়ে দেখবেন কীরকম একটা নবাবি ভাব এসেছে। ভিগানরা খুশি হবেন, জাতে নিরামিষ হলেও চরিত্রে একটা ‘মাংস মাংস’ ভাব এসে গেছে।
ভালো কথা, আমি লিখছি বিন্স, সে তো ঠিক আছে। কিন্তু এটি কোন বিন্স? দেখুন, ইংরেজিতে বলে গ্রিন বিনস। সেটাকে আপনারা কোন্ নামে ডাকেন, সে তো জানি না। ‘Green beans’ বলে গুগলে ইমেজ সার্চ করে দেখুন, তাহলে হদিশ পাবেন।
১. একটু নুনের ছিটা দিয়ে ঘিতে সাঁৎলে নিন বিন্সগুলি। দুমিনিট নেড়ে চেড়ে সরিয়ে রাখুন।
২. এবার কড়াইতে আবার ঢালুন ঘি, ছোটো এলাচ আর মৌরীর ফোড়োন দিন।
৩. আদা, রসুন আর কাঁচালঙ্কা দিন।
৪. পেঁয়াজ (আমি বেটে দেই)।
৫. টম্যাটো (কুচিয়ে) আর নুনটা দিয়ে দিন।
৬. গুঁড়ো গরমমসল্লা + লাল লঙ্কাগুঁড়ো + ধনে গুঁড়ো + হলুদ
৭. এবারে বিনগুলো ঢেলে দিন।
৮. জল দিয়ে, ঢাকা দিন। মিনিট পাঁচেক পর ধনেপাতা দিন। আবার ঢাকনা দিয়ে রান্না করুন কম আঁচে যতক্ষণ না মর্জিমতন সেদ্দো হচ্ছে চাপা দিয়ে রাখুন।
আমি যে পাকামিটা করি, সেটা হচ্ছে ওই গরম মশলার বদলে বিরিয়ানি মশল্লা দিয়ে দেই। তবে আপনাদের ভাবাবেগে ব্যথা লাগলে এমনি সাধরণ মশল্লাই দিয়েন।
আর, এটা তো নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন আমি ওইসব ছেঁদো মেজারমেন্টের মধ্যে যাইইনি। আরে, আপনারা সব পাকা খেলুড়ে, যাকে বলে বিদগ্ধজন, আপনাদের ওইসব তুচ্ছ ডিটেইল্স দিয়ে অশ্রদ্ধা করতে, কেমন কেমন লাগে!
ডিডিদা, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রেলিংটা ভালো করে ধরে থাকবেন। উড়ে যাওয়ার পোচুর সম্ভাবনা ।
তোমারই তুলনা তুমি প্রাণ...
আরেব্বাস! নতুন রকমের রান্নিবান্নি। লেখাটিও খাসা।
হাইকু টি তো ঘটিদের বাটি চচ্চড়ি ., অখাদ্য খেতে -
চিনি দিতে হবে না ? চিনি অভাবে গুড় ?
Mozarella, gorgonzola নাহয় হলো। Cheddar তো হ্যাংলা ইংরেজেদের উৎপাদন। Pasta তে cheddar বাকি রাখা খাজনার মত হল।
কাল এই টইটা উঠে আসতেই কেমন ছ্যাঁত করে উঠেছিল।
আবার তুলে দি। নামটা তো দেখাবে। মনে হবে, এই তো, আছেই।
কুমুদির নামটা তালিকায় এরকমই এখনো, কখনো সখনো এসে যেতে পারে। আর ক'দিন আসবে। এই মন্তব্যের পরে কোন মন্তব্য আসলেই আর দেখাবেনা।
কুমুদিকে খুঁজে পেতে পুরানো পাতারাই ভরসা।