বাব্বারে বাব্বা। নয় নয় করে এই কিচাইন সিরিজও তো নয় নম্বরে পড়লো। এইবারে তো, "আর নয়, আর নয়" বলে মোমবাতি মিছিল না বেরিয়ে পড়ে।
জানেন তো, আমার বয়সে (আঁটে ষাটে আটষট্টি) এসে সব থেকে সহজ কাজ হচ্ছে নস্টালজিয়া। "আমাদের সময়ে হ্যান ছিলো,ত্যান ছিলো" বলে নাগাড়ে গুলগাপ্পা চালিয়ে গেলেই বা ধরছে কে? আর নেহাৎই ধরা পড়লে, "আরে বুড়ো মানুষ টাইপো হয়ে গেছে। স্তালিনের সাথে আমার বৈঠকের কথা লিখেছিলাম বুঝি? আসলে ওটা আমার পাড়ার ব্রজদা যাকে আমরা গরচা সেকেন্ড লেনের স্তালিন বলে ডাকতাম, তাঁর কথাই কয়েছি। অন্যমনস্ক হয়ে টাইপো হয়ে যাওয়ায় - দেখুন তো কী রকম একটা মিসানডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গ্যালো"- বলে কাটিয়ে দেওয়া। খুবই ইজি।
তো আমি সেই স্মৃতি নির্ভর লেখাই লিখছি কিন্তু লঘুভাবে নয়। নট অ্যাট অল। এটা একেবারে নিজস্ব অভিজ্ঞতার তেলে জারিয়ে নিয়ে সুগন্ধী মৌতাতে মাতিয়ে দিয়েও একটি কঠোর বাস্তবানুগ সমাজ বীক্ষণ। সবজেক্টটা হচ্ছে ( দাঁড়ান, একটু দম নিয়ে নিই)- "বাঙালি বিয়ের মেনুর ক্রমবিবর্তনের প্রেক্ষিতে এক আর্থ সামাজিক কৌম ইতিহাসের পরম্পরা ও অল্প হা হুতাশ"।
পুরো প্রেক্ষিতটা না বুঝলে শুধু মেনু নিয়ে লিখলেই হবে? শুনুন, প্যান্ডাল হতো। মাঠঘাট থাকলে সেখানে, নয়তো ছাদের উপর। কাঠের বেঞ্চের উপর নিউজরিলের কাগজ পেতে, তার উপরে কলা পাতা আর মাটির ভাঁড়। হ্যাঁ, টেবিল প্রায় সব সময়েই নড়বড়ে হত, বিশেষত মাঠের উপর হলে। সিগারেটের প্যাকেট ভাঁজ করে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা হত আর মাটির ভাঁড়ে প্রায়ই ফুটো থাকত। একটু অন্যমনস্ক হলেই কুলকুলিয়ে জল চুপিসাড়ে এসে কলাপাতা ভিজিয়ে একেবারে পাঞ্জাবির উপরে এসে পড়ত। আর ভিয়েন হত খাবার জায়গার পাশেই। সেই ভিয়েন ঘেঁষে বসলে একটা সুবিধে, খুব ভিড়ভাট্টার সময়ে গরম লুচি বা ফিশ ফ্রাইটা ঝট করে পেয়ে যাবেন, কিন্তু অগুন্তি ধোঁয়া সহ্য করতে হবে। চোখ জ্বলবে কিন্তু খাবারটা গরম পাবেন।
না, বসবার জায়গারও প্রচুর ঘাঁতঘোঁত আছে। সাতটা কি সাড়ে সাতটা থেকেই ফার্স্ট ব্যাচ বসত। তখন ডেকে ডেকে লোক পাওয়া যেত না। আমরা কি সাহেব? সাতটায় ডিনার করবো? এসেছি তো বাঙালি নেমন্তন্ন খেতে।
কড়াগোছের কোনো দাদু গোছের কেউ থাকলে (সব সময়েই থাকতেন) যতো এন্ডি গেন্ডি ছানাপোনাদের (যাও, যাও, খেয়ে নাও - এরপর তো বড়দের ব্যাচে সার্ভ করতে হবে) ধমক দিয়ে বা ভুজুং ভাজুং দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হত।
ব্যাস, সাড়ে আটটা থেকেই উসখুস শুরু। বাড়ির ছোটটাকে বলা হলো, যা তো দেখে আয় এই ব্যাচটার কদ্দুর? সে কিছু পরে নাচতে নাচতে এসে খবর দেয় "প্লাস্টিকের চাটনি দেছে"। ও, আপনারা প্লাস্টিকের চাটনি চেনেন না? ওটা বিশুদ্ধ পেঁপেকে পাতলা স্লাইস করে চিনির রসে চুবিয়ে করা একটা চাটনি। রসের মধ্যে ভাসমান স্বচ্ছ পেঁপের ফালি। কপাল ভালো থাকলে এক আধটা কিসমিসও জুটে যেতে পারে।
যদি খাওয়ার জায়গা চারতলার ছাদে হয় তাহলে এক মুহূর্তও দেরি নয়। তখুনি, মানে তক্ষুনি, মানে একেবারে তক্ষুনি, উঠে পড়তে হবে। সামান্য দেরি হলেই - ব্যাস। তিনতলাতেই আটকে গেলেন। সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে থাকা পরের ব্যাচকামী মানুষে পুরো ট্র্যাফিক জ্যাম। ভয়ানক ভিড়। খাওয়া শেষ হতে না হতেই হুড়মুড়িয়ে লোক ঢুকে পড়ছে। জিমন্যাস্টিকের কসরৎ না জানলে আর সিট জুটবে না। তায় যদি গোটা দু তিনেক বাচ্চা এবং বাতের রোগী মা বা বাবা সঙ্গে থাকেন তো হয়েই গ্যালো।
আর যদি ন্যাকাটে বাচ্চা থাকে তো আরো যন্ত্রণা। সে ততক্ষণে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিয়েছে, "আমি থাম্মির পাছেই বছবো ওওও" আর ঠাম্মি তাঁর আলাভোলা স্বামীর পাশে না বসে ক্রমাগত ডিরেকশন দিতে না থাকলে ওঁর গরদের পাঞ্জাবির তো চোদ্দটা বেজে যাবে।
আর সেই ব্যাচটাও মিস করলে? ক্রমশই সকলের মেজাজ গরম হচ্ছে। খিদেও পাচ্ছে। মুখ ফুটে আপনি বলতেও পারবেন না যখন চাটনির খবরে আপনি উত্তেজিত হয়ে তাড়া দিচ্ছিলেন তখন আপনার উনি এক সরস গল্পে এমনই মজেছিলেন যে তাঁর উঠতেই ক্রিটিকাল ছয় মিনিট দেরি হয়ে গেলো।
আর চান্স নেওয়া নেই। চাটনির জন্য অপেক্ষা করলে দশটার ব্যাচও মিস। আপনি মাংস থেকেই তিনতলায় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আর চাটনির সময় থেকেই তাক করে একটা টেবিলের সামনে খাড়া সপরিবারে। কিন্তু ঠিক সেই টেবিলেই বসে জমিয়ে খাচ্ছে - খেয়েই চলেছে, অসম্ভব স্বার্থপর, অলস ও হ্যাংলা এক পরিবার। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। চাট্টে কমলাভোগ খেয়েও আরেকটার জন্য নোলা ফেলছে। ওরা উঠলেই দুদিক দিয়ে চেপে আপনারা বসে পড়লেন, মুহূর্ত মাত্র দেরি করলেই একেবারে সেই শেষ ব্যাচ।
পরিবেশনকারীরা খুবই রুষ্ট। "আরে পাতগুলান তো ফেলতে দ্যান"। না, সেটা লোকলজ্জার সময় নয়। আপনি তখন কৈবল্যের ও পারে। জাগতিক মান অভিমান আপনাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। আপনাদের ভ্রুক্ষেপই নেই। খুব মজা করে দেখছেন কিছু লোক হাঁপাতে হাঁপাতে এসেও ফিরে যাচ্ছে শুকনো মুখে। আপনি বিজয়ীর মতন খেতে বসলেন।
অ্যাই, অ্যাই, অ্যাতোক্ষণে কোনোরকমে মেনুর কথায় আসতে পারলাম। নাঃ, কোনো চমক নেই। তখন সব বিয়েবাড়িতেই মোটামুটি একই খাবার ফিরিস্তি। লম্বালম্বি আধখানা করে কাটা বেগুন ভাজা, মাথায় টিকির মতন বোঁটাও লম্বমান, (এখনকার মতন চাকা টাইপের নয়), লুচি না হলে রাধাবল্লভি, মুগের ডাল, লাবড়া বা অন্য কোনো মরসুমি সবজি। দু বার তিনবার চারবার করে সেগুলোই ফিরে ফিরে আসছে। একটু পদ বাড়াতে চাইলে ফিস ফ্রাই বা ভেজিটেবল চপ - যার প্রায় আশি ভাগই এক বিশাল বিটরুটের কিউব। মাছ কই? মাংস? মাছেও ভ্যারাইটি নেই। সেই রুই বা কাতলা। মাংস যদি বা হয় নিতান্ত পাঁটা। ভাত অথবা ভেজেটেবেল পুলাউ। সত্তরের প্রথম দিকে ইতি উতি শুনতাম অমুক বাবুর ট্যাঁক অ্যাতোই মাসকুলার যে মেয়ের বিয়েতে চিকেন খাইয়েছেন। সে সময়ে এক মহার্ঘ খাবার। আর যদি একটা আস্ত ঠ্যাংই পেয়ে যান তো লটারিই জিতেছেন। চাটনি, ভয়ানক তেল চপচপে পাঁপড় ভাজা (ওটি খাবার পরে জল খেলেই একেবারে তেলেংকারি ব্যাপার, রাতের বেলায় পেটে জাগ্রত ভিসুভিয়াস)। দই আর মিষ্টি। মিষ্টিরও খুব রকমফের ছিল না। রসগোল্লা, লেডিকেনি, কমলাভোগ, বাড়ির ভিয়েনের কাঁচাগোল্লা - ঐ পাঁচ ছয়টার মধ্যেই এনি টু, বা মেরে কেটে তিনটে। কোনো কারনে নিরামিশাষী হলে কপালে থাকবে ঐ পনিরের ট্যালট্যালে ঝোল - এ ছাড়া কোনো এক্সক্লুসিভ পদ থাকত না।
আর পরিবেশন করবার লোকের অভাব প্রায় কোনো বাড়িতেই হত না, নেহাৎ আটকে গেলে পাড়ার ভাসমান ছেলেরা তো সব সময়েই হাজির। এর মধ্যেই ছোটকা বড় বৌদির মাসতুতো বোনকে একটু বেশি অ্যাটেনশন দিচ্ছে। প্যান্টের উপর কোমরে গামছা বেঁধে যত দূর সম্ভব স্মার্টনেস দেখানো যায়। তবে পাল্টি ঘর, তায় তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন - দেবে থোবেও ভাল। গুরুজনেরা তাই আড়চোখে ড্যাবড্যাবিয়ে দেখছেন আর সশব্দে মুচকি হাসছেন। এ-ও বিয়েরই অঙ্গ।
মেনু কার্ড তখনো ছিল না, মানে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়িতে। তার মধ্যেই কিছু লোক থাকতেন, যতোই সাধাসাধি করুন ঐ বেগুনভাজা, ছ্যাঁচরা (ওটা পরিবেশণের সময়ে ঐ ছ্যাঁচড়াকে ছ্যাঁচরা দাও বলে একটাই জোক, সেটা আপনাকে শুনতেই হত, প্রতিটি বিয়েবাড়িতেই) এইসব আলতু ফালতু জিনিস খেতেন না। কতক্ষণে মাছ আর মাংস আসবে তার অপেক্ষায় গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতেন। আকাট হ্যাংলামি যথেষ্ট চালু ছিলো।
আরো দুটো ব্যাপার ছিল - ভিয়েনের সামনে বাড়ির একজন একটা মোড়ার উপর বসে থাকতেন। তিনি কী সামলাতেন অমন অতন্দ্র প্রহরী হয়ে? কেউ জানে? আসলে ওটাও একটা ট্র্যাডিশন। আর মাছ কেনাও একটা পর্ব। একদম ভোর পাঁচটায় উঠে ট্যাক্সি হাঁকিয়ে যেতে হতো হাওড়ার পাইকার বাজারে। সেই ট্যাক্সিতে ছোটোদাদু (উনি ক্যাশিয়ার), সন্টুদা (উনি একজন পাইকারকে পার্সোনালি চেনেন) আর পাড়ার ভবেন জেঠু (উনি ঐ তল্লাটের মাছ বিশেষজ্ঞ)। ভবেন জেঠুকে যেমন তেমন পাকা রুই গছানো অসম্ভব। উনি মাছের ল্যাজ টেনে, কান মলে, দরকার হলে দোকানদারের গন্ধ শুঁকেও সেরা মালটি খুঁজে নিতেন। গল্প শুনেছি এক আধবার তাঁর পছন্দ দেখে মাছ বিক্রেতা স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছিলেন।
ও হ্যাঁ, পাঠকদের মধ্যে যারা ছেলে মানুষ তাঁদের কাইন্ড অবগতির জন্য জানাই, কাঁচা রুই বলে কিছু হয় না কিন্তু পাকা রুই হয় - এই ওজনে মিনিমাম পাঁচ কেজির হলেই ঐ মাছের ‘পাকা’ সুনাম জোটে - তার কমে হয় না। বাইরে পানের থালা আর সিগারেটের প্যাকেট হাতে সহাস্য এক গুরুজন। ছেলে ছোকরারা তাঁর কাছ থেকে কোন সাহসে সিগ্রেট চাইবেন?
অনল আবেদিন আর দেবাশিস বন্দোপাধায়ের লেখাটা পড়তে পারেন। এ সব কটাই রাজা গজাদের বিয়েবাড়ির খাওয়া দাওয়ার কহানি। বিয়ে বাড়ির প্রথম মেনু ছিলো ১৯০৬ সালে, আইটেম ছিল ৩৬ রকমের। তার অনেকগুলোকে আর আইডেন্টিফাই করা যায় না - যেমন একটা খাবার ছিলো সন্ধানিকা। সেটার সন্ধান আর কে দেবে? তবে এই ছত্রিশ পদের অর্ধেকেরও বেশি শুধু নানান মিষ্টি দিয়েই। তার দশ বছর পরে কাশিমবাজারের রাজবাড়ির বিয়ের মেনুতে ছিলো ২০৭ রকমের পদ। নদিয়ার রাজবাড়ির মেনুকার্ডও দেখতে পাবেন নেটে - সেটা ১৯৪৭ সাল। নিরামিষ তরকারিই ছিল পনেরো রকমের। দেখুন তো একটাকেও চেনা লাগে না কি? ‘কুমড়োর হুসেন শাহ’, ‘ফুলকপির মিটি মুখ’, ‘বিট শানাদ’, ‘বাঁধাকপির বুক ধড়ফড়ি’, ‘আলুর জয় হিন্দ’? আলুর জয় হিন্দটা বোঝা যায় - সময়টা ১৯৪৭'র শীতকালে। তাই আলু আর স্বাধীনতা মিলে মিশে একাক্কার। তিরিশ রকমের মিষ্টির মধ্যেও দুটোকে কেউ চিনতে পারেন- ‘গাল চাপড়া’ আর ‘প্রাণ ধড়ফরি’?
মেনুর একেবারে শেষে আছে হজমি, জোয়ানের আরক, সোডি বাই কার্ব এবং সারিডন। সে তো লীলা মজুমদারের বিয়েতে গলদা চিংড়ির মালাইকারি হয়েছিলো। তবে আমি অমনি চিংড়ি বাড়ি কখনো যাইনি, সেই আদি যুগে শুনিওনি। আমার বাবার কাছে শুনেছিলাম যে ওঁর ছোটোবেলায় বিয়েবাড়িতে কোনো স্পেশাল মেনু হত না, একেবারেই রোজকার ঘরোয়া মেনু। সেই লাউয়ের বা বাঁধাকপির ঘন্ট, আলু কুমড়োর ছক্কা - এইসব। আলাদা বলতে দুই বা তিন রকমের ডাল হত। ব্যাস।
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে কি পাও? তারই রথ নিত্যই উধাও। এ যেন সেই সময়ের বাস বা ট্যাক্সির কথা হচ্ছে। শেষ ব্যাচে খেয়ে বাড়ি ফেরা বা আদৌ ফিরতে না পারার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা সেই সময়ের সকলের ঝুলিতেই এক আধটা আছে। আপনারা গুরুজনদের কাছ থেকেই জেনে নিন, আমি আর খামোখা লিখি কেনো ?
আঁচানোর কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। হয় অন্ধকারে একটা ডিজেলের ব্যারেলে জল থাকতো আর একটা মাটির ভাঁড়। ইটের উপর দাঁড়িয়ে নিজেই জল তুলে কুলকুচি করতে হতো। বা যে ভাঁড়ে জল খাচ্ছিলেন তাতেই ঐ পাতের পাশে জমিয়ে রাখা লেবুর টুকরোটা চিপে তাতে হাত ডুবিয়ে টেবিলের উপর পাতা নিউজরিলের এক পিস ছিঁড়ে হাত মুছতে হত।
না, এই সব - এই সবই পাল্টে যাবে। এক দশকের মধ্যেই। পরবর্তী কিস্তিতে আসছে মধ্যযুগের ইতিহাস। সে তো শুধু ইতিহাসই নয়, এক সামাজিক বিপ্লবের ইতিকথা। জানতে হলে একটু অপেক্ষা করুন (সঙ্গে থাকুন)।
এহ দইয়ের সাথে লাল কমলা বোঁদে দিত তো অনেক বাড়িতে। এই ধরুন ৭৮ এর বন্যার আগে অবধি। তারপরে মেনুতে বেশ পরিবর্তন আসে। ডিমের ডেভিল, ফিশ ওরলি এইসব নামের জিনিষপত্র ঢুকতে থাকে। ও ৭৬ সালে পাড়ার এক বিয়েবাড়িতে লাল সবুজ কমলা থকথকে জেলির কিউব ছিল মিষ্টির মধ্যে। শুনলাম তার নাম বোম্বাই হালুয়া। সে বেশ নৈনং ছিন্দতি শস্ত্রাণি টাইপের ব্যপার।
আরেকটু আদিযুগে যাওয়া যাবে? এই ধরুন ১৮৬০-৭০? এক চন্দননগর নিবাসী জানাচ্ছেন , ভাটপাড়ার নৈয়ায়িক ভটচাজ্জি বিয়েতে বরযাত্রীদের জন্যে বরাদ্দ ছিলো লুচি আর চিনি, তাও তারা বরযাত্রী ছিলো বলেই ইস্পেশাল ( আকার কাছ থেকে নেমন্তন্ন পেলে সাবধানে থাকবেন ) । "অন্যান্য স্থলে লুচির সহিত (কুমড়ার ) তরকারি এবং দধি ও সন্দেশ থাকিতো। ইহার অধিক আর কিছু নয় । "
এই বিয়েবাড়ির মেনু নিয়ে আলোচনাটা খুব ইন্টারেস্টিং। আমি ভারতের উপকথার বিহার পর্বে পড়েছিলাম ওখানের গ্রামের বিয়েবাড়ির ট্র্যাডিশনাল মেনু ছিলো হাতির কানের মত বড় বড় পুরী, বাথুয়ার শাক ভাজা আর লাড্ডু কিম্বা জিলিপী।
মহেন্দ্র দত্ত ঊনবিংশ শতাব্দির শেষার্ধে বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কীরকম খাওয়ান হত বিষয়ে লিখেছেন "লোক খাওয়ানো" প্রবন্ধে। প্রথমে বড় লুচি আর নুনবিহীন কুমড়োর ছক্কা। এই আলুনি কুমড়োর ছক্কার স্বাদের যা প্রশংসা করেছেন, তাতে অন্য সব খাবারের স্বাদ ফিকে হয়ে আসে। আসত কলাপাতায়। কলাপাতার কোণে নুন। এরপর আসত খুরি-সরা। সরাতে আসত কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর। কড়াইডালের পুরে আদা, মৌরী দিয়ে কচুরি হত। খাজা ছিল খাবারের প্রধান অঙ্গ। খুরিতে থাকত চার রকমের সন্দেশ। এরপরে ক্ষীর, দৈ দেওয়া হত। ১৮৭৩-৭৪ নাগাদ থেকে রসগোল্লা আর তিলকুট চালু হয়। রাবড়িও পরের ব্যাপার। লক্ষ্ণৌ থেকে আমদানী। বিখ্যাত ছিল পেনেটির গুপো সন্দেশ। আর খাজা দিয়ে ক্ষীর খাওয়া হত।
ন্যাড়াদা,
তাহলে বেশির ভাগটাই মিষ্টি? নোন্তা খাবারের মধ্যে শুধু লুচি, কচুরি আর কুমড়োর ছক্কা থাকতো?
তাই লিখেছেন দেখছি। কবে থেকে যে সাবেক লুচি-ডাল-ছক্কা-মাছ-মাংস-চাটনি-পাঁপড়-দই-মিষ্টি-পান স্ট্রাকচার চালু হল, কে জানে!
কচুরি নিমকি ও রয়েছে দেখছি।
আগেকার দিনে, মানে মহেন্দ্র দত্ত র আমলে কি বাঙালি বিয়েতে শুধু নিরামিষ রাখার কিছু ব্যাপার ছিল ? যেমন সাউথ ইন্ডিয়ায় অনেক র বিয়েতে এখনো দেখেছি তারা বাড়িতে নন-ভেজ হলেও বিয়েতে কিন্তু শূধু নিরামিষ থাকে। আর সেটা শুধু ব্রাহ্মণ দের বিয়ে তে নয়। অব্রাহ্মণ দেরও। মানে অনেক বছর থাকা এবং কাজের সুবাদে যতটা সার্কলে মেলামেশার সুযোগ ঘটেছে। শহরেই মেনলি।
@ডিডি,
"যেমন একটা খাবার ছিলো সন্ধানিকা। সেটার সন্ধান আর কে দেবে?"
সন্ধানিকাঃ- ইতি বিশ্বকোষ।
এই পর্বও যথারীতি দুর্দান্ত।
এতো রাতের খাওয়ার কথা।
নেমন্তন্নবাড়ির দুপুরে খাওয়ার একটা পাট থাকতো। বাড়ির লোকজন, বা রাতে আসতে পারবেন না এই রকম মানুষজনের খাওয়ার বন্দোবস্ত।
যে প্যান্ডাল রাতে আলো টালোয় ঝকঝক করবে, সে তখনও সেহেগুজে ওঠেনি- সেখানেই দুপুরের খাওয়া - একটা দুটো লম্বা টানা টেবিল, সেই কমলা হলদেটে নড়বড়ে চেয়ার, তখনও বাঁশের কাঠামোয় কাপড় লাগানো চলছে, ইলেকট্রিকের কাজ চলছে; রাতে ফ্যান থাকবে, দুপুরে হয় লাগানো হয় নি নয় কানেকশন টানা হয় নি, ফলে দুপুরে খাওয়ার সময় দরদর ঘাম -
বিয়েবাড়ির দুপুরের খাওয়ায় একটা হৈ চৈ বাঁধত গায়ে হলুদের তত্ত্ব দেরিতে এলে- তত্ত্বের মাছ ভাজতে দেরি হয়ে যেত।
দুপুরের খাওয়ায় শুক্তো থাকতই। বিয়েবাড়ির দুপুরের নেমন্তন্নে যে শুক্তোর স্বাদ তা আর কোথাও পেতাম না।
একবার এক দুপুরের নেমন্তন্নে (বিয়ের নয়) শুক্তো হয় নি- লাউয়ের খোসাভাজা ছিল। হ্যাংলার মত জিগ্যেস করতে বাধা ছিল না সেই বয়সে; তখন একজন বলেছিলেন, সুখের শুক্তুনি, দুঃখের বাকলাভাজা- এইটা মনে রাখবি।
কি অসাধারন আর দুর্দান্ত লেখা! পড়তে পড়তে এক গামলা জিভের জল ঝরিয়ে ফেল্লাম, আর কতো যে পুরনো বিয়েবাড়িতে খাওয়ার কথা মনে পড়লো! খুব ছোটবেলায় বিয়েবাড়িতে দিতো লুচি আর ছোলার ডাল, তো প্রায় গোটা দশেক লুচি মেরে দেওয়ার পর আর কিছু খাওয়ার জায়গা থাকতো না। তারপর আমার পিসতুতো দাদা শিখিয়েছিল, অতো লুচি খাস না, চার পাঁচটা লুচি খেয়ে বসে থাকবি, পোলাও আর মাংস দিলে তারপর খাওয়া শুরু করবি। আর কোন একবার যেনো নেমন্তন্নে বিজলি গ্রিল ক্যাটারারের খাবার খেয়েছিলাম, সেই প্রথমবার ফিস বাটার ফ্রাই খেয়েছিলাম।
আর ইন্দ্রাণী যেমন বললেন, বিয়েবাড়ির দুপুরের খাওয়াও অসাধারন হতো, কারন পরিবারের কয়েকজন মিলে খাওয়া হতো। তবে দুপুরের খাওয়ার সময়ে কিন্তু মাঝে মাঝে পেডেস্টাল ফ্যান থাকতো, লম্বা তার দিয়ে কানেকশান দিতো। আর তত্বর মিষ্টি পাওয়া যেতো।
টু গুড। স্মৃতি সততই সুখের। এই অনবদ্য লেখা পড়ে এমন কি সেই লম্বা করে কাটা, বোঁটা ওলা বেগুন ভাজাটির জন্যও মন কেমন করল।
বছর ৩৫-এর একজনকে জিগালাম, অমন বেগুন ভাজা বিয়ে বাড়ীতে খেয়েছে কিনা। কেমন আশ্চর্য চোখে চেয়ে রইল :-(
কলাপাতায় খেতে দিলে কী ভালো লাগতো। আর নুন লেবু, নিদেন পক্ষে মাটির খুরি ভরে দেবার ভার পেলেও। মনে হতো সাবালকত্ব প্রাপ্তি হলো।
দারুণ লেখা। পড়তে পড়তে হারিয়ে ফেলা বিয়েবাড়ি ঘুরে এলাম, খেয়েও এলাম।
আর একটা কথা, খাসির তেলের বড়া এখন বাসি বিয়ের দিন কেউ খাওয়ায়?
মারহাব্বা - তবে সব কিছু পাষ্ট টেন্সে করে দেবান না প্লীজ। আপনারা যেগুলো লিখলেন তার অনেক গুলোই এখনো তো হইহই করে চলে।
এই তো ঘোষবাড়ির ছাদে খাওয়া হচ্ছে পাত পেড়ে - এটা অবশ্য বেশ কিছু বছর আগের ছবি। এখন সব ফোর-সিটার টেবিল হয়েছে, বাকি সব একই
লুরুর ব্রজদা, দের আতে হ্যাঁয়, পর দুরুস্ত আতেঁ হ্যাঁয় । নস্টোলজির চূড়ান্ত,
অ ডিডি, গরমকালে আম খাওনিকো বে বাড়িতে ? তাবলে শীতকালে মোট্টেও কম্লানেবু দিতো না। আর বরযাত্তি ঢুকলেই গোলাব্জল স্প্রে ?
@কল্লোল। হ্যাঁ। আম তো নিয়মিত ছিলো গ্রীষ্মকালীন বিয়ের শেষপাতে। সুসজ্জিতা মহিলারা যাদের একাধিক বাচ্চা ছিলো - তারা যে কী পরিমান নাজেহাল হতেন সে আর কহতব্য নয়।
আরেকটা ট্র্যাডিশন ছিলো "লুচি কেস"। নিরুচ্চারিত প্রেমে তখন ভেসে যেতো সুবে বাংলা। মানসীর বিয়ের দিনে ভগ্নহৃদয় তরুনটি মোটেই পালিয়ে বেরাতো না। কষে গামছা বেঁধে, বেতের ঝুড়ি কাঁখে নিয়ে তিনি "লুচি চাই লুচি চাই" বলে ঘুড়ে বেরাতেন। ডাকসাইটে সুন্দরীর বিয়েতে এরকম তিন চারটে "লুচি কেস" খুব কমন ছিলো।
মাইকে সানাইএর মীড় আর গমকে হৃদয়ের তন্ত্রী ছিঁড়ে যাচ্ছে, ফিস ফ্রাইএর ধোঁয়াতে চোখ ঝাপসা , কিন্তু অবিচলিত ভাবে তরুনটি লুচি বিলিয়ে যাচ্ছেন। ওফ।
সে যুগে কি পনির হতো, নাকি ছানার বা ধোঁকার ডালনা?
আমি আর ডিডি প্রায় সমবয়েসি।
তাই ডিডিকে বলি 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে'!
ভিলাইয়ে এমনই এক বাড়িতে কোমরে গামছা বেঁধে লুচি, নুন, লেবু পরিবেশন করলাম। সব ব্যাচ শেষ হলে যখন বরকনে খেতে বসেছে এবং তাদের ঘিরে বন্ধু ও সখির দল, তখন ঠাকুর চাকর পরিবেশনকারীরা অন্য প্রান্তে খাচ্ছে, আমিও তাই। এদিকে মিষ্টি বাড়ন্ত তাই আমার প্লেট নিয়ে আমি অন্য প্রান্তে মিষ্টির খোঁজে যাচ্ছি, হঠাৎ সবাই হায় হায় করে উঠলো। ওখানে ভোজনরত বরবৌয়ের ফটো সেশন হচ্ছিল, আমি ন্যালাক্যাবলা না বুঝে ঠিক ক্যামেরা ক্লিক করার মুহুর্তে ক্যামেরা ও যুগলের মাঝে রাহু হয়ে ধীর লয়ে হেটে গেছি। অনেকে ফিসফিস করল, ন্যাকাচৈতন! ইচ্ছে করে করেছে। হাফসোল খেয়ে বোকার মত বদলা নিচ্ছে। কী হিংসুটে রে বাবা!
তখন পনীর শব্দটি জানা ছিলনা। অবশ্যই ছানার ডালনা নতুন শুরু হয়েছে। ফলে বাঙালিরা তখনও ওই পদটি ভালো করে রাঁধতে শেখেনি।
সুকি যে ছবি দিলেন, আমার কাকাদের বিয়েতে (ছয় কাকা) এটাই ছিল পরিচিত দৃশ্য। হায়, সেই কলাপাতা, মাটির খুরিতে ঠান্ডা জল, লেবু নুন! আর নাকভাঙা দই! কোথায় লাগে আইসক্রিম?
ওই লম্বা বোঁটাওলা বেগুনভাজা নিয়ে আমার অবজেকশন! ওটা সবচেয়ে আগে ভেজে তুলে রাখা হয় । তাই পরিবেশনের সময় হয়ে যায় ন্যাতনেতে ঘুমিয়ে পড়া বিচ্ছিরি! আর যখন বোঁটা ধরে পরিবেশন করে মনে হয় ল্যাজ ধরে মরা ইঁদুর!