না, আমি ইতিহাসচর্চা নিয়ে মোটেই ক্ষুব্ধ নই। লিখুন না, লিখুন, সেই নিয়ানডেরথালের খাদ্যসংস্কৃতি থেকে পাপুয়া নিউগিনির নরখাদকের নবতম রেসিপি। হ্যাঁ, সবই লিখুন। কিন্তু এটাও তো একবার মাথায় রাখবেন যে কবি কি খামোখাই বলেছেন ‘‘আমরা চলি সমুখপানে কে আমাদের বাধবে?’’ একটু তো ভবিষ্যৎচর্চাও করতে পারেন? মানে কুড়ি কি পঞ্চাশ বছর পরে কীধরনের খাওয়াদাওয়া হবে? সেসব নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা? আরে, সেইসব হলে পরে, তবে তো জিজ্ঞেস করতাম আর ধরুন দুশো বছর পরে? তখন কী খাবেন?
কিন্তু, ওই যে, আপনাদের যাকে বলে অবসেশন। হিস্ট্রি নিয়ে হিস্টিরিয়া। তবে এখন আর চিন্তা নেই। এই শর্মা, হাজির যখন হয়েইছি, তখন একটা হিল্লে করেই ছাড়ব।
আপনেরা তো লাখে লাখে বই পড়েন। তাতে সায়েন্স ফিকশনও প্রচুর। কিন্তু মনে হয় অরওয়েল সাহেবের বা হাক্সলে বাবুর ভবিষ্যতের খাওয়া নিয়ে অ্যাতোটুকুও ভাবনা ছিল? তবে ডগলাস অ্যাডাম সাহেব সেই সুদূর ভবিষ্যতের এক আশ্চর্য খাওয়ার গল্প লিখেছিলেন। নায়কবাবু রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভালোমানুষের মতন একটি বিফস্টেকের অর্ডার দিলে একটি নধর গোরু হেলে দুলে তার কাছে এসে খুব আহ্লাদের সাথে বলেন, ‘‘ওয়েলকাম স্যার, ওয়েলকাম। আজকের আপনার অর্ডার, আমারই, ইয়ে মানে পাছুর থেকে কেটে স্টেক বানানো হবে। গ্রান্টি দিয়ে বলছি আপনার খুবই ভালোলাগবে। নিজের পাছু বলেই বলছি, তা তো নয়, আমি সত্যই খুবই সুস্বাদু।’’ নায়ক কিছুটা অপ্রতিভ হলে গোরুটি বিমর্ষ হয়। ‘‘আরে এতে লজ্জার কী আছে?’’ (হুলিয়ে প্যারাফ্রেজিত, অমনি ভুল ধরতে বসবেন না)।
বা, এসিমভ বাবু যে ছোটোগল্পে লিখলেন দূর ভবিষ্যতে এক রন্ধন প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট প্রাইজ পেলেন একজন কারণ (কেন কী) তার ডিশ ছিল অতীব সুগন্ধি। পরে ফাঁস হয়ে গ্যালো উনি হাইড্রোপোনিক পদ্ধতিতে না চাষ করে বাড়ির টবে সম্পূর্ণ অর্গানিক ভাবে রসুন ফলিয়েছেন। সেটি একে বেআইনি তায় অপসংস্কৃতি। সভায় গা গুলোনো ও বমির বন্যা বয়ে গেল। সমবেত ছিছিক্কারের মধ্যে তার খেতাব কেড়ে নেওয়া হল।
এ ছাড়া আমার তো স্মরণে আসছে না, ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে তেমন ভাবে কেউ রান্নবান্নার কথা বলেছেন। আপনেরা কেউ কিছু মনে করতে পারছেন? ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন। বা সিনেমা টিনেমার কথা ভাবুন। স্টারট্রেক বা ওরকম—কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসছে মেগাসিরিয়াল। যদি বা ডাইনিং হলের সিন কিছু দেখাল তো সেটা একটা চৌকো গ্লাসে, একটা ডিস্পেন্সার থেকে থকথকে হলদেটে কী একটা ঢেলে নিয়ে বা একটা তেকোনা প্লেটে একটা আলুসেদ্দোর দলার মতন কিছু নিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সাথে অন্যমনস্ক ভাবে খুঁটে খুঁটে খেল। না আছে কোনো চকাস চকাস শব্দ না আছে কোনো তৃপ্তির ঢেঁকুর। ধুর। লোকে এক গেলাস জল খেয়েও আরেকটু ইমোশনাল হয়ে পড়ে।
আপনারা অ্যাতো দিন ধরে যা ভাবেননি সেটা হচ্ছে এথিক্স। খাওয়া হলেই হল? একটা সমাজিক অর্থনৈতিক অভিঘাত নিয়ে চিন্তা করবেন না? এই যে অ্যাতো অ্যাতো মাংস খাচ্ছেন, জানেন না এক কেজি মাংসে কত জল লাগে? আরে ধুর, আমি রান্নার কথা বলছি না। মানে একটি ছাগল বা গোরুকে প্রাপ্তবয়স্ক বা যথেষ্ট হৃষ্টপুষ্ট করতে গেলে কত জল খচ্চা হয়? কতটা চারণভূমি লাগে? এইসব পশুদের, ইসের থেকে কত মিথেন গ্যাস বিষাইছে তব বায়ু? এইসব নিয়ে গাব্দা গাব্দা কত যে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, সেগুলো পড়লে একেবারে হেড অপিসে তিরিতংক লেগে যাবে।
তো ঠিক আছে। সমাজসচেতন বিজ্ঞানী আছেন না? তেনারা মাথা খাটিয়ে বার করেছেন বিলকুল ভেজেটারিয়ান মাংস। কিছুদিন আগে হলেও এটাকে লোকে মশকরা ভাবত আর এখন দেখুন, অলরেডি চার বিলিয়ন ডলারের বেশি বিককিরি হচ্ছে এই ‘মাংস’। মূলত সয়াবিন গাছের মূল থেকে নানান কায়দা-টায়দা করে এটা তৈরি হয়েছে। রূপে, গুণে, কলচরেতে—সবদিক দিয়েই ইটি নাকি আসল মাংসের খুব কাছাকাছি। তেমন করে রেঁধে দিলে কেউ টেরও পাবে না। আর যাবতীয় খাবার পাবেন, সে সসেজ বলুন বা পেপারনি। বার্গার বা স্টেক। সবকিছুই পাবেন। তবে হ্যাঁ, খচ্চা আছে। এখন পর্যন্ত দামটা একটু বেশির দিকেই।
হেমে জানেন তো? Heme? আরে, আপনারা তো সবই জানেন। তাও লিখি। ওই হেমে নামক মলিকিউলই নাকি মাংসের আত্মা। উটি জিভে এলেই আমিষের ইচ্ছা সম্পূর্ণ হয়। আমরা আহ্লাদে আটখানা হই। গাছপালাতে কমই আছে, যেমতি রয়েছে সয়াবিন গাছের মূলে। কিন্তু সেটিকে বার করে, প্রসেস করা যথেষ্ট ঘাম ও টাকার ব্যাপার।
তবে ঠাকুর নানান দিক দিয়ে মেরে রেখেছেন। সয়াবিন, জানেনই তো, কটনের মতন সারা দুনিয়ায় প্রায় ৯০ শতাংশ GMO। সেসব বাদ দিয়ে খেতে গেলে দাম আরও বেশি হবে। আবার এই Bt সবজি খেলে স্বদেশি জাগরণমঞ্চও বাদ সাধবে। হরি হে!
তাই বিজ্ঞানীরা Yeast-কে জেনেটিকালি মডিফায়েড করে এই ‘হেমে’-র আস্বাদটা আনেন। বুঝুন! এ যেন আমাদের দেশের ভোটের কথা—কারে আপনি লেসার ইভিল সব্যস্ত করবেন? প্রেডাটর নাকি এলিয়েন?
এই তিন দশক হল দক্ষিণ ভারতে আছি—এসে দেখেছি যারা খুব কট্টর নিরামিষাশী তারা সয়াবিন খায় না, মাশরুমও না। এমনকি পনিরকেও অনেকে ত্যাজ্য করেছেন, কেন কী (কারণ) এইগুলোতে নাকি বড্ড মাংসের মতন টেস্ট আছে। এক সহি ভেজেটেরিয়ানকে প্রশ্নও করেছিলেম, হ্যাঁ মশাই, সারা জীবনে আমিষের একটা অ্যাটমও খেলেন না, তাহলে বুঝলেন কী করে এইসব খাবারে মাংসের মতন টেস্ট আসে? নাঃ, কোনো সদুত্তর পাইনি। তবে চিরকালই তো পাড়ার দোকানে মাংসের চপে দু-এক টুকরো মাংসের কিমা থাকলেই যথেষ্ট, বাকিটা নিছক এঁচোড় কুচিয়ে দেওয়া হত, আমরাও দিব্বি খেয়ে নিতাম। অসুবিধে কিছু তো হয়নি।
আমি যদি স্টারট্রেকের একটা এপিসোড বানাই তো দেখবেন ডাইনিং হলে কী কাণ্ড চলছে। এই ব্বড়ো ইলিশ মাছের গাদা, ভেটকি মাছের ফ্রাই, আলু পোস্ত... সব পাবেন। আরে পেট ভরে না খেলে ইউনিভার্সটা দেখবেন কী করে? এলিয়েনদের সাথে মারপিট করতে হবে না?
শুধু কি সয়াবিন বা মটরশুঁটি দিয়েই এইসব কারসাজি? না, আরও কায়দা ক্রমে আসিতেছে। মলিকিউলেদের ধরে ধরে একটু ইদিক উদিক করে দিয়ে বিজ্ঞানীরা এইরকম করছেন। ওই একটি বা দুটি হাসিখুশি কোষ নিয়ে এসে তাতে পোয়াটাক ইলেকট্রিসিটি দিয়ে এইরকম সব খাবারই তারা তৈরি করে রেখেছেন। পাঁঠা আর মাঠে হয় না, ল্যাবেই ‘তৈরি’ হয়। খান, পেট ভরে খান।
অনেকে এটাও বলেন ভবিষ্যতে খাওয়াদাওয়ার পাটই চুকে যাবে, একটা ক্যাপসুল ঢুক করে গিলে নিন—ব্যাস! সারাদিনের মতন খাদ্যপ্রাণ আপনার শরীরে হাজির। বা আরও এগিয়ে ভাবুন, একটা ছোট্ট মতন প্যাচ নিজের দেহের যে-কোনো জায়গায় আটকে দিন, ওটার থেকেই বিন্দু বিন্দু ক্যালোরি, ভিটামিন তারপরে যাবতীয় ধাতু—নিঃশব্দে আপনাকে উজ্জীবিত করে রাখবে? সত্যি! এইসব যাঁরা ভাবেন তাঁদের কি কোনো একটা সাধারণ কমনসেন্সও নেই? খাওয়া মানে কি শুধুই শরীর সচল রাখা? খাওয়া একটা উৎসব, একটা আনন্দ।
সেই কোরিয়ান সিনেমাটা দেখেছিলেন—দ্য ওল্ড বয়? নায়ককে এক ভয়ানক প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ কিডন্যাপ করে একটা ঘরে বন্দি করে রেখে শুধু একটা, শুধু একটাই রেস্টুরেন্ট থেকে চিকেন ডাম্পলিং দিত। প্রতিদিন। পনেরো বছর ধরে রোজ রোজ, প্রতিদিন। একই খাবার খেয়ে খেয়ে খেয়ে খেয়ে, হিরো কিন্তু যথেষ্ট গাঁট্টাগোট্টাই ছিলেন, মাইন্ড ইট—কিন্তু কীরকম মানসিক ভাবে ধ্বস্ত ছিলেন, একবার আইডিয়া করুন।
তবে উনি কোরিয়ান না হয়ে তামিলিয়ান হলে বোধহয় এই অত্যাচার ততটা কার্যকরী হত না। আমার সহকর্মী, পরিবার ছেড়ে আমার মতনই একাই থাকতেন মাদ্রাজে, তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ওহে, সকালে ইউজুয়ালি কী খাও হে? সে বলে ইউজুআলি আবার কী কথা। আমি নিত্যই দোসা খাই। আমি অবাক হয়ে বলি, তোমাকে তো লাঞ্চেও দেখি সেই দোসাই খাচ্ছ, প্রতিদিন। তা ডিনারেও কি... সে বিগলিত হেসে উত্তর দেয় ‘‘ওইত্তো, দোসাই খাই।’’
আর দেখুন ওই যে থ্রি-ডি প্রিন্টার? জানেন কি, তাতে খাবারদাবারও তৈরি হচ্ছে আজকাল। বৃষ্টি পড়ছে দেখে ঝট করে নিজের প্রিন্টার থেকে একপ্লেট গরম সুলতানি খিচুড়ি আর বেগুনভাজা ‘ছাপিয়ে’ টপাটপ খেয়ে নিন। শেষপাতে মিষ্টি দই আর সরভাজা খেতেও ভুলবেন না যেন।
হ্যাঁ, মশাই। সন্দেহ থাকলে নিজেই দেখে নিন, গুগুলে বা ইউটিউবে।
আর একটু তো মেনুটাও নিজে নিজেই চেঞ্জ করতে পারেন। নাকি? সারাক্ষণ শুধু টেকনলজির উপরই বা কেন ডিপেন্ড করবেন বলুন তো? পোকা খান। আরশোলা খান, পঙ্গপাল খান, মাছি খান... । আপনেরা তো দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ান, দেখেননি পুরো এশিয়া জুড়ে পোকামাকড়ের বিরাট বাজার? আমাদের দেশেও নর্থ ইস্টে পিঁপড়ে বেশ সুখাদ্য বলেই ধরা হয়। একবার মানসচক্ষে দেখুন, জামাইকে আদর করে গুবরেপোকা ভাজা আর আরশোলার চচ্চড়ি দেওয়া হছে, তার সাথে ফড়িং-এর কালিয়া। হ্যাঁ, এখন তো এসব পড়ে আপনার গা গুলাচ্ছে। কিন্তু আরও পাঁচ ছ-দশক যেতে দিন, দেখবেন এগুলো অভ্যেস হয়ে গেছে।
তবে মশার কোনো পদ হবে না। নো। ততদিনে পৃথিবীর শেষ মশাটির সাথে সেলফি তুলে বিখ্যাত হয়ে গেছেন কেউ। হায়! শেষপাতে অ্যানোফিলিসের পুডিং বা কিউলেক্সের পাই—সেটি আর হবে না।
নাঃ। আর রেসিপি-টেসিপি দিয়ে কাজ নেই। আপনারা বরং একটু সিরিয়াস হন। হাঁ করে প্রবন্ধ পড়ার সময় মুখে মাছি ঢুকলে চেটে-পুটে খেয়ে নিন। জমবে!
সাইফাই গপ্পে খাবারের বটিকার কথা আমাদের ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুবাবু বোধহয় বলেছিলেন। কিন্তু কথা হলো, মশার ব্যাপার এলেই পাইয়ের কথা বলতেই হবে। সে "কিউলেক্সের পাই" হলেও!
পড়তে ভালো লেগেছে, তবু ভাবছি একটা ভবিষ্যতের রেসিপি পেলে হয়ত মন্দ হতো না।
স্টার ট্রেক ভয়েজার
ভেজিটেরিয়ান মাংসের আদি ও অকৃত্রিম স্রস্টা হচ্ছেন চীন (তাং সাম্রাজ্যের সময় থেকে), কোরিয়া, জাপানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। রসনাকে আমিষ খাওয়ানোর মায়ায় ভুলিয়ে সিউইড (সমুদ্রের সবজি), টোফু (সোয়াবিনের ছানা), নানা রকমের মাশরুম (ছত্রাক), আর গ্লুটেনের সমারোহে যাদুকরী রান্না করে এসেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে।
সাউথ চায়না মরনিং পোস্টের এই রিপোর্টটা পড়ে দেখতে পারেন,
আরেকটা:
"You want it to be simple. Food is not something you should desire," explains Shih. "But if we have an important holiday like Buddha's birthday or Chinese New Year, then our spread is more abundant."
It's during these special occasions that the faux meats are brought out on silver platters, like soy-based "steaks" dressed with black pepper sauce and a braised "eel" made with tofu and seaweed. The base of most of these dishes is a tofu-based mash. Made mostly out of crushed firm tofu, it is bound together with a sticky pink paste made from isolated soybean protein and wheat.
"That's what gives it its fibrous and chewy texture," says Shih Pao-chin, the culinary director of the monastery (no relation to Shih Chang-ren; many Buddhist monastics adopt the last name Shih when they're initiated into a monastery). I hang out in the kitchen with Shih, where she has the head chef demonstrate the technique. The mash is mixed and compacted together with diced shitakes, water chestnuts, ginger, carrots, butter, and flour, then seasoned with salt, sugar, soy sauce, white pepper, and sesame oil. The final product is incredible; when grilled or deep-fried, it has the resistance and chew of a real meatball."
এই সেই সিন। হিচহাইকার্স গাইড । আশির দশকের শেষের দিকের বিবিসি সিরিজ।
*প্রথম দিকে
দারুন উপভোগ্য...