তো, নস্টালজিয়ার একটা সেট প্যাটার্ন আছে। প্রথমটায় ঠাট্টা, ফাজলামি প্রচুর করুন। এমন কি বুঝিনা বুঝিনা করে একটু অসভ্য টাইপের জোকও করতে পারেন - কিন্তু সেটা ইশারাতেই। তারপরে একেবারে শেষটায় একটা হুল্লাট ইমোশনাল মোচড় - একটা দগদগে চোখ ছলছলে ভাব - বুক চাপা একটা কান্না গোছের। তাইলে জমবে।
আমি প্রথমেই জানিয়ে দি'- আমার এই নস্টালজিক খানা পিনার ব্যাখ্যান একেবারে পুরো ফ্যামিলি নিয়েই পড়তে পারবেন। রেটিং একেবারে ইউনিভার্সাল। আর শেষটাতেও কোনো হায় হায় রে ক্লাইম্যাক্স নেই। খুবই সহজপাচ্য।
আসলে এই আমাকে দেখুন। জন্ম ৫৩ সালে (AD), সেই কলেজ বেলার থেকে কতো যে নতুন নতুন খাবার খেয়ে অবাক হলাম। এবং এখনো সেই অবাক হওয়া শেষ হয় নি।
এখনকার তরুণরা, বুঝলেন তো, অবাক হওয়াটাই ভুলে গেছে। এভারেস্ট থেকে ইয়ং ম্যানটি ফিরে এলে তাকে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করি, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল তো কী কী দেখলি? গুছিয়ে বলতো। সে নিরুত্তাপ গলায় বলে, বলার কী আছে? ঐ ত্তো, উঁচু উঁচু সাদা সাদা। অক্সিজেনও বেশ কম। আর ইয়ে, শীত আছে। ব্যাস। মাসাইমারা গিয়ে পালে পালে সিংহ দেখেও চমৎকৃত হয় না। বলে টুরিস্টরা নাকি সিংহের গায়ে নাম আর ফোন নাম্বার লিখে আসে। বেশির ভাগই টেলিমার্কেটিং কোম্পানি।
অথচ আমাদের সময়টাই ছিল অগাধ বিস্ময়ের। অনন্ত ও নিরলস বিস্ময়ের। সত্তরের মাঝামাঝি, সবে চাকরীতে ঢুকেছি। সহকর্মী অভীকের সাথে পার্ক স্ট্রীটে হাঁটতে গেলে সে বলে চল পিজ্জা খাই। নাম শুনেছি। চোখে দেখি নি তখনো, চেখে দেখার প্রশ্নই নেই। সদ্য খুলেছে একটা এক্সক্লুসিভ পিজ্জার দোকান। দামও প্রচুর - টাকা দশেক তো হবেই। খুব সাহস করে কাঁচুমাচু মুখে বসলে ওয়েটারই বুঝিয়ে দেয় কোন পিৎজাটা কিনতে হবে। না, ব্রান্ডেড কোনো ফুড চেইনের দোকান নয়। একেবারেই সরল গোলগাল দুই দিশি মানুষেরা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে লোক দেখানো পিজ্জা বানাচ্ছে। প্রচুর টমেটো ও সামান্য চীজের ছোঁয়া লাগানো বেশ শক্ত রুটি। আর কিছু মনে নেই- শুধু মনে আছে যে বিকট লেগেছিল। সেই দোকানও টেঁকে নি। কয়েক মাস পরেই সেখানে অন্য দোকান খুলে গেলো।
তারপরে এই বছর তিরিশেক আগে ব্যাঙ্গালোরে এসে পিজ্জা খাই। অতো কায়দার কিছু নয়। প্রচুর টমেটো দিয়ে টিয়ে তৈরি হতো। পাড়ার বেকারিতেও "ভেজ পিজ্জা" পাওয়া যেতো। আরো বছর খানেক পরে (৯০'র মাঝামাঝি) আসবে ১০০% অথেনটিক আমেরিকান পিজ্জা চেইন। তার আগেই এসে গেছে KFC। ওহো, সে কী ভক্তি, সে কী মা হর্ষ!!
লম্বা লাইন পড়তো। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পাহারাদার। লোক বের হলে তবেই তারা গুনতি করে লোক ঢোকায়। ঘণ্টা খানেক লাইনেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তার উপর একজন মানুষ একটি বিশাল মুরগী সেজে গটগটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপন!! লাইনে দাঁড়ানো বাচ্চারা ভয়ের চোটে হাউমাউ করে কেঁদেই আকুল। এরই মধ্যে PETA'র লোকজন সেজেগুজে বিক্ষোভ জানাচ্ছে। একদিন স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের লোকজন এসে ইট পাটকেলও ছুঁড়ে গেলো। বাটার চিকেন না খেয়ে এসব কী বিদেশী ভাজা মাজা খাওয়া হচ্ছে শুনি? কিন্তু এই জনজোয়ার রুখবে কে? তখন ইতিউতি বিদেশ যাচ্ছে অনেকেই। NRIরাও সহজলভ্য। তাদের নাক কুঁচকানি শেষও হয় না। এ যেনো ঝালমুড়ি বা আলুর চপ নিয়ে মাতামাতি। তারা আমাদের বোঝাতে চায় - এ মোট্টে ভালো জিনিস নয়। আমরা তো খাইনে। কিন্তু জনতাকে কে আর কবে বোঝাতে পেরেছে বলুন? পলিটিকাল পার্টিরা হেরে গেলেই যেমন বলেন, 'মানুষকে ভুল বোঝানো হয়েছে'। সেই ব্যাপার।
KFC র হট্টগোল শেষ হতে না হতেই এসে গেলো ম্যাকডোনাল্ড। দু পিস বানের মধ্যে হাবিজাবি আর এক পিস চিকেন প্যাটি - ক্রমশঃই সেই প্যাটি হৃষ্টপুষ্টতা ছেড়ে পাঁপরভাজার মতন স্লিম হয়ে যাবে আর হরেকরকম্বা নানান কিসিমের বার্গারে ভরে যাবে তামাম হিন্দুস্তান। থিংক গ্লোবালি, অ্যাক্ট লোকালি মতাদর্শে ভেজ তো বটেই এমন কি জৈন বার্গারও চালু হবে। ভয়ের চোটে কখনো জানতেও চাই নি বান দুটির মাঝে কোন সাত্ত্বিক খাবারের প্যাটি থাকে।
হাত ধরাধরি করে আরো আসবে পিৎজা হাট আর ডমিনোস। আরো কতো কী। দেশী দোকানের "চেইন" ও এসে যাবে। হরে মুরারে মধুকৈটভারে। এই ফাস্ট ফুড তরঙ্গ রোধিবে কে?
ঐ অবাক হওয়ার কথা কইছিলাম না? এই এখন যেমন লোকে দেখা হলে কুশল সংবাদের হেড লাইনগুলো জেনেই জিজ্ঞেস করে "এখন কী দেখছেন?" তখন বিস্তারিত ভাবে নেটফ্লিক্স ইঃ ইঃ সমস্ত OTT প্ল্যাটফর্মের সালতামামি বিস্তারিত জানাতে হয়। আর সেই সময়ের - একটি অবশ্য জিজ্ঞাস্য ছিল পিৎজা হাট টেস্ট কল্লেন? ক্যামন লাগ্লো? বার্গার কিং এখনো যান নি? সে কি? এবং তুলনামূলক আলোচনা।
এই নতুন ধারার খাওয়া দাওয়া, তাদের আদব কায়দা দেখে টেখে আমরা যেমনি অবাক হতাম তেমনই বিস্মিত হতাম। মুগ্ধতার সীমা ছিল না। কোন কোন দোকানে আবার হঠাৎ করে করে ওয়েটারেরা নাচতে শুরু করতো। কাঁচে ঘেরা দোকানে এরকম সংস্কৃতি দেখতে, রাস্তায় বেশ ভিড় জমে যেত। কালচারের হদ্দ মুদ্দ।
সেই কবে জানি টাকো বেল আবির্ভূত হলেন নগরীতে। কী ভিড়, কী ভিড়। লাইন দিয়ে কাউন্টারে পৌঁছালে সহৃদয়া মেয়েরা বুঝিয়ে দেয় নাচোই বা কী, বুরিটো ই বা কাকে বলে? দু হাত এ ধরেই খেতে হয় তো? না কাঁটা চামচ লাগে? সবেরই উত্তর দিয়ে দেন দয়াবতীরা। লোকশিক্ষা হয়।
আপনারা যারা পঞ্চাশের এইদিকে, এমন কী আরো কুট্টি মতন। তারা এই হাঁ হয়ে যাওয়ার আনন্দই পেলেন না। জন্ম থেকেই এই বিদেশী খাবার খেয়ে টেয়ে আপনাদের কোনো রোমাঞ্চই নেই। প্রথম চুম্বনের মতন তড়িৎ তাড়িত আশুতোষ লাভ হতো জীবনের প্রথম পিৎজায়। প্রথম বার্গারের স্পর্শে ও আস্বাদে মনে হয়েছিলো এই কি অমরাবতীর ভোজ্য? আমার তো চোখে জল এসে গেছিলো।
এখন তো বঙ্গাব্দ টঙ্গাব্দ নিয়ে গাব্দা গাব্দা লেখা হচ্ছে। কিন্তু এটা জানেন কি আমাদের বয়সী লোকেদের কাছে জীবনটা ছিল ম্যাগী পূর্ব ও ম্যাগী অব্দের? চোখের সামনে দেখলাম হেঁসেলে হট্টগোল। ব্যাচেলর, অলস, কর্ম-ক্লান্তের একমাত্র সান্ত্বনা ম্যাগী। এক বন্ধুর বাড়িতে গেলে সে হোমমেড নুডলস এনে সগর্বে জানায় আমার দিদি বানাইছে। আমাদের ফুর্তি হয়, কিন্তু বাকস্ফূর্তি হয় না। বাড়িতে নুডলস? কী করে সম্ভব? ম্যাজিক না কি? চীনা দোকানের বাইরে, ঘরে বসেও এরকম চ্যাং ব্যাং রান্না করা যায়?
সেই কবেকার স্মৃতি হাটকে - যদ্দুর মনে পড়ছে, তেমন জমে নি ঐ চাউমিন। কিন্তু ভোজন সাম্রাজ্যবাদ যে মধ্যবিত্তের হেঁসেলে ঢুকে যাচ্ছে, আর সেই আগ্রাসী আক্রমণ আমরা গোগ্রাসে গিলছি, সেটা টের পাচ্ছিলাম।
TVতে দেখছিলাম, এক মহতী বিতর্ক সভায় বাঙালীর বিপন্নতা বিষয়ে বিতর্কে এক প্রাজ্ঞ জানালেন কী ভাবে আমাদের রসনা দখল করে নিচ্ছে ব্যাবাক বিদেশীরা। চীন, কোরিয়া আর অবশ্যই আম্রিগা। খুব ইচ্ছে করছিলো তাকে জানাতে, রে প্রাজ্ঞ, এই যে আলু সেদ্দো খাস কাঁচা লংকা দিয়ে - সেও তো শ দেড়েক বছরের বিদেশী আগন্তুক। লেড়ে বিসকুট দিয়ে চা? সেটাও। যাগ্গে, এই কুটিল বিষয় বলার যা, তা চন্দ্রিলই বলবেন। আমি বলার কে?
এদিকে আপনারা ঘন ঘন বিলেত আমেরিকায় যান। অথবা, আরো ভালো, বিদেশেই গ্যাঁট হয়ে বসবাস করেন। নানান দেশের ভালোমন্দ খেয়ে, ছবি তুলে একশা। তবে যদি বড় শহরে থাকেন, (আমি থাকি ব্যাঙ্গালুরুতে), তবে সারা দেশের তো বটেই, কতো যে বিদেশী খাবারের দোকান হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। নতুন খুলেছে দেখলাম একটা বার্মিজ খাবারের দোকান। সব বাঙালীই জানেন 'বার্মার ঙাপ্পিতে বাপ্রে কী গন্ধ'। এমন কি লাতিন আমেরিকা খাবারও পাবেন এক স্পেসালিটি রেস্তোরাঁয়। লাতিন আমেরিকানরা, সবাই জানেন, খুবই ফুটবল খেলেন। না পারলে কোকেইনের ব্যবসা করেন। আর সেটাও না জমলে খুব কঠিন সাহিত্য লিখে পুরস্কার পান। তাহলে ভাবুন, রোনালডিনো বা মেসি, নেরুদা কি মার্কেজ, এস্কোবার বা এলো চাপো - বাড়ীতে কী খান বা খেতেন, সেটা এ দেশেই বসে খেতে পারবেন। জাস্ট আইডিয়া করুন!
কে কতো অদ্ভুতুড়ে খাবার খেলেন সেই নিয়ে যেনো কম্পিটিশন চলে। চীনে দোকানে ঢুকে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন চাইলে ওয়েটারও অপমানিত বোধ করবেন। বরং বলুন "ও হে, গাধার রক্ত আছে? ফ্রেশ চাই কিন্তু" তাহলে সব মোগাম্বোই খুশী হবেন। না দিতে পারলে ক্ষুব্ধ হয়েই গোবি মান্চুরিয়ানই না হয় এক প্লেট অর্ডার করবেন। লোকে খুঁত ধরবে না।