এই যে আপনারা, মানে যারা জুনিয়র বা সাব জুনিয়ার সিটিজেন, তাদের যে জিনিস দেখে আমি মুগ্ধ হই তা হচ্ছে আপনাদের গভীর আত্মবিশ্বাস আর দুঃসাহস। আমরা সিনিয়র সিটিজেনরা, কীরম একটা ন্যাকাটে ও ক্যাবলা কার্তিক ছিলাম। এখনো।
তো, সেই সময়টাই সেরকম ছিল। মা বাবা গুছিয়ে ক্যালাতো, অংকের মাস্টারের তো কথাই নেই। এমন কি ভূগোলের মাস্টার মশাইও সাতটা রাজধানীর নাম না বলতে পারলে উত্তাল পেটাতেন। "শালা" বলেছি, শুনতে পেয়ে পাড়াতুতো এক কাকা উদ্যোগ নিয়ে কান মলে দিতেন। সে এক মুক্তাঞ্চল। যে যখন খুশী ধমকাচ্ছে। শিক্ষা দিচ্ছে। এইসব।
আপনেরা যেরকম দেশ বিদেশের একটা চোখ ধাঁধানো রেস্তোরায় ধাঁ করে ঢুকে,একটা ডোন্ট কেয়ার ভাবে ওয়েটারকে স্বচ্ছন্দে হুকুম দেন এটা আনো তো, সেটা আনো তো, আর শোনো, সেফকে বলবে আমার ডিশে কেভিয়ারটা কমই দিতে, আর ট্রাফেলটা বেশি দিও, এমনটা করেন, আমাদের এরকম আস্পর্ধা ছিলই না। কোনো রকমে সাহেবি পাড়ায় একটা দোকানে যদি বা বুক ঠুকে ঢুকলাম তো ওয়েটারের ভয়ে সিটিয়ে থাকতাম। কী তাদের স্যুটেড বুটেড মশমশানি আর কী গ্র্যাভিটি। মাঝে একবার বাথরুমে ঢুকে প্যান্টুলের পকেট থেকে মানিব্যাগ করে বার করে আরো একবার টাকা গুনে নিতাম, কম পড়বে নাতো?
খানদানী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান উচ্চারণে ওয়েটার সাহেব যখন জিগান 'অ্যাপেটাইজার দিবো কি?' তখন বেমালুম আঁতকে উঠি। ঢ্যাঙা দেবুর কাকা জেনিভায় থাকতেন, তো তারই সাহস ছিল। পরম নির্লিপ্ততায় কোনো রকম ইয়েস বলে দেয়। তারপরে দেখি দিয়েছে ছোটো গেলাসে করে জিরার জল। "চরণামৃত, চরণামৃত, না জানি সে কী অমৃত - খেয়ে দেখি যে জল'। সে ই কেস।
তবে ঠিকই, যা খাবার খেয়েছি তা একেবারে অবিস্মরণীয়। সেই খাওয়ার লোভেই আমাদের বন্ধু গবাই ইংরেজি শিখে গেলো।
সেই কনফিডেন্স দেখেছি আমার এক প্রবাসী কাজিনের মধ্যে। সে ও প্রায় তিন দশক আগে। ব্যাঙ্গালুরুর নামকরা চীনা রেস্তোরায় ঢুকলে আদ্যোপান্ত চীনা হেড ওয়েটার শুদ্ধ ইংরাজিতে আমাদের সম্ভাষণা জানিয়ে চামড়ায় বাঁধানো মেনু কার্ড এগিয়ে দিলে সে ভ্রুক্ষেপই করে না। ওয়েটারের বুকের ব্যাজে নাম দেখে এক্কেবারে পরিষ্কার বাংলায় বলে "জেমস, একটু মাছ ফাচ খাওয়ান না। চিকেন, গোরু, শুয়োর খেয়ে মুখ পচে গেলো যে'। চীনা ওয়েটারকে বাংলায় নির্দেশ!! সে ও ব্যাঙ্গালুরুর ৫ তারা হোটেলে বসে?এ কি পাগল না কি? আমরা তো লজ্জায় ল্যাজে গোবরে। কিন্তু জেমস এক গাল হেসে পরিষ্কার বাংলায় বলে,'চিন্তা নেই স্যার। আমি মাছ এনে দিচ্ছি। আজকের চিংড়িও ফ্রেস। সেটাও দেবো'। বলে মেনু কার্ড নিয়ে চলে গেলো। ওর পছন্দ মতন খাবার খেয়ে প্রচণ্ড খুশী হয়েছিলাম, এটা পরিষ্কার মনে আছে।
পরে আমার কাজিন বলে, দেখছিস না, জেমস বেশ বুড়ো। চল্লিশ তো হবেই, পঞ্চাশও হতে পারে। এই বয়সী সব চীনাই কলকাতার ছেলে আর বাংলাই তো এদের মাদার টাং রে'।
হ্যাঁ, যদিও খাওয়া বিষয়ক নয়, তা ও আপনাদের মোটা সমরের গল্পটা বলি। আমাদের সময়ে যে অল্প কজন খুবই আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিল তার মধ্যে একজন হচ্ছে মোটা সমর। আরে না, সমর একজনই ছিল। আলাদা করে মোটা বলে তাকে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন ছিলই না। কিন্তু সে সত্যিই মোটা ছিল। আর সেই যুগে আমরা সরল গোলগাল হলেও পলিটিকাল কারেক্টনেস বা বডি শেমিং'এর কিচ্ছুটি জানতাম না।
আমাদের মতনই মফঃস্বলের বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ছেলে। ইংরেজিতে কথা বলতে হলেই মুখ শুকিয়ে যেতো। চাকরীর শুরুতেই মুম্বাইতে ট্যুর। তখন (সত্তরের মাঝামাঝি) হোটেলের ঘর পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। রেলের টিকিটে পাওয়ার থেকেও বেশি। তো যা হোক, হোটেলে বুক করাই ছিল, গিয়েও বড় ডবোল রুমও পেয়ে গেলো (বড় ঘর উইথ ডবোল বেড)। চেক ইন করে কাজ টাজ সেরে সন্ধ্যে বেলায় হোটেলে ফিরতে রিসেপসনের মহিলা ইংরাজিতে যেটা জানালেন যে মোটা সমর কি পাশের রুমে শিফট করবেন? কাইন্ডলি? একটি ফ্যামিলি এসে গেছে কিন্তু একটাই ফাঁকা ঘর আছে আর সেটা সিংগল রুম - তো মিস্টার সমর তো একাই আছেন,যদি সেখানে শিফট করেন তাহলে খুবই উবগার হয়। সকলেরই শান্তি কল্যাণ। কিন্তু দুপুরে ওর গুজরাতি বস ভেজেটারিয়ান লাঞ্চ খাওয়ানোয় মোটা সমরের মেজাজ বিলকুল খাপ্পা হয়ে ছিল। তা ছাড়া সিংগল বেডে ওর ঠিক সুবিধে হয় না। কিন্তু ইংরেজিতে এতো গুছিয়ে কী করে বলবে? সে শুধু কটমটিয়ে তাকিয়ে জানিয়ে দিলো ' নো,নো, ওয়ান্স অ্যালোটেড, ক্যান নট বি ট্যালোটেড'। রিসেপসনিস্ট মহিলা থতমত খেয়ে আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মোটা সমর তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো" ওয়ান্স ডিসাইডেড ক্যান নট বি খিসাইডেড। সরি'। বলে গটগটিয়ে চলে গেছিলো। হ্যাঁ, এর নাম কনফিডেন্স।
ছোটবেলায় তো সব কিছুতেই ভয় পেতাম। নতুন কিছু দেখলেই পেট গির গির করতো। তো সেই সময়ে মানে মান্ধাতারও শৈশবে (ধরুন ৬০+ বছর আগের ঘটনা) সবে মাত্র আইসক্রিম কোন (Cone) এসেছে কলকাতায়। একদিন তো সাহস করে দিদির হাত ধরে গিয়ে দুটো কোন কিনে পার্কের বেঞ্চে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে দুজনে খেতে শুরু করলাম। তখনই খেয়াল হল, আরে এটা খাওয়ার টেকনোলজি তো জানি না। চেটে চুটে কিছুতেই শেষটুকু খেতে পারছি না, তখন একজন প্রৌঢ় কিন্তু দয়ালু ভদ্রলোক (তা বছর তিরিশ বয়স তো হবেই) ডেকে বললেন, "অ খুকি, অ খোকা। ঐ কোন টাও খাওয়া যায়। ওটা বিস্কুটের"। সত্যি? সাহসে ভর করে একটু চিবিয়ে দেখি, আরে তাই তো। এটা তো পিচবোর্ডের নয়। বেশ মুচমুচে খাসা খেতে। বাকীটুকু পরম আহ্লাদে আমরা খেয়ে ফেললাম। ব্যাস! আইসক্রিম কোন খাওয়ার কলা কৌশল আমাদের হাতের মুঠোয়।
আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমি ধোসাও প্রথম খাই প্রাপ্তে তু ষোড়শ বর্ষে। মফঃস্বলে বড় হয়েছি। সেই স্টেশনের কাছে অথবা বাস গুমটির কাছে, যা দু একটা নিতান্ত সাদামাটা খাওয়ার দোকান ছিল। খুব বেশি হলে চপ, কাটলেট - এই সবই পাওয়া যেতো। আদার ওয়াইস ভাত, ডাল, মাছ। এইসব।
কলেজে পড়তে কলকাতায় এসে উঠলাম যাদবপুরে। সেই খান থেকে ধ্যাড়ধ্যাড়িয়ে গরিয়াহাট এলাম ধোসা খেতে। নিতান্ত ধোসা ইডলি খেতে হলেও তখন অদ্দুরই যেতে হতো। নির্মলা বলে একটা রেস্তোরাঁ ছিল সেখানে। সেই খানেই জানতে পারলাম ধোসার সাথে ছোটো বাটিতে দেয় সম্বার আর রসম। একটা রোগা আরেকটা মোটা। খুবই ছোটো বাটি - তবে চাইলেই আবার ভরে দেয়। সে শুধু খাওয়া নয়, যাকে বলে এক্সপেডিশন। পাড়ায় ফিরে সে কী জাঁক। সবাই তাজ্জব বনে গেছিলো।
প্রথম ধোসা খাওয়া - এটাও যে কেউ মনে রাখে, আবার আদিখ্যেতা করে লিখে টিখে সবাইকে জানায়, এটাও তো বিস্ময়কর।
হ্যাঁ। নেশার কথাও বলি।
তখন শহরের মাঝেই সরকারি গাঁজার দোকান থাকত। কারা খেত কে জানে। অতিশয় রদ্দি মাল থাকত। যেরকম লিচু কিনতে হলে একগাদা ডালপালা কিনতে হয়, সেই সরকারি গাঁজাও শুকনো কাঠ কুঠোয় ভর্তি থাকত।
গাঁজার ঠেক থাকত সব পাড়াতেই। বেশির ভাগ সময়েই গাড়ি সারানোর গ্যারাজ গুলোতে। সেখানেই শিখলাম নানান ব্র্যান্ডের গাঁজার কথা। খুব ভালো ছিল মনিপুরী। তবে সব থেকে সেরা ছিল কেরালার মাল। আর সব পাড়াতেই এক বা একাধিক গাঁজা মাস্টার থাকত। আমাদের পাড়ারটির নাম ছিল ভগবান। সিরিয়াসলি। কল্কেতে সামান্য গোলাপ জল, পোয়াটাক ইলেকট্রিসিটি, আদার কুচি এইসব দিয়ে সে যা ককটেইল বানাত - সে কথা স্মরণ করলে এখনো মন কেমন করে।
আর এই সব গল্প কাকেই বা আর চোখ গোল গোল করে বলবো,আপনেরা আরো বেশিই জানেন। সাহেবরা যেদিন থেকে গাঁজা ধরলো তখন থেকে গাঁজা স্নবারিই'ও শুরু হল দুনিয়া জুড়ে, সিংগল মল্ট হুইস্কির মতন। ইউরোপ, আমেরিকা আর ওদিকে সাউথ ইস্ট এশিয়ায় লিগ্যালি পাওয়া যায়। আর অমনি পিলপিলিয়ে নানান ভ্যারাইটি, নানান ব্র্যান্ডের গাঁজাও বিক্রি শুরু হল।
আর মদের কথা আর কী বলবো? সরস্বতী পুজোর দিন এক পাঁইট রাম কিনে ছ' সাতজনে ভাগ করে খেতাম। কেউ এক ড্রপও বেশি খেলে মারপিট লেগে যেতো।
আর একটা ট্র্যাডিশন ছিল - নিতান্ত মাতাল হলে পাড়ার ডাকসাইটে আঁতেলদারা খুব শেক্সপিয়র আওড়াতেন। অনেকে তো পিকনিক যাবার কথা শুনলেই বাড়ীতে গিয়ে "পড়া' মুখস্থ করে নিতেন। ওটার খুব কদর ছিল সেই সময়। এক একটা ওরকম পিকনিক টিকনিক হলে পরের দু মাসে কে কতো মাতাল হয়ে কী সব অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড করেছিলো, সেই ব্যাখ্যান চলতো সবিস্তারে।
আমার বন্ধু বড় বাচ্চু (তখন সব পাড়াতেই গাদা গাদা বাচ্চু ছিল) একদম বেহেড টালমাটাল হয়ে গেলে বাকী বন্ধুরা খুবই সমস্যায় পড়ি। ওর বাবা মা, খুবই আপাদমস্তক কড়া মেজাজের। আর এক জ্যাঠাও থাকেন। পুরু চশমা আর লোমশ ভুরু র ফাঁকে ওনার গোল গোল চোখ সদাই জ্বলজ্বলিং। স্বভাবে আর চেহারাতেও, অসুর ভাব খুবই প্রকট। তাদেরকে এড়িয়ে বাচ্চুকে ওর বাড়ীতে ঢুকাব কী করে? বাচ্চু, বলতে নেই, সেই কলেজ বেলাতেই বেশ ইসে, মানে হোঁৎকা মতন ছিল, এবং দাড়ি গোঁপে একাক্কার।
যা হোক, বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে ধরে ধরে নিয়ে গেলাম। বার বার বলা হল, কোনো দিকে তাকাবি না, সোজা গটগটিয়ে হেঁটে নিজের ঘরে চলে যাবি। কারুর দিকে তাকাবি না, কথা তো বলবিই না। সে দরজা খুলে ঢুকেই দেখে মা বাবা জ্যাঠা- সবাই বাইরের ঘরে হুলো বেড়ালের মতন বসে আছে। বাচ্চু তখন অদ্ভুত বুদ্ধি খাটিয়ে ওদের চোখের সামনে স্রেফ হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করলো, তায় আবার ছয় জোড়া বিস্ফারিত চোখে চোখ পড়তেই তার সে কী উচ্ছ্বসিত ফিচেল হাসি! ঐ ভাবেই গুড়গুড়িয়ে আর খিকখিকিয়ে সে চলে গেলো। আমরাও মুহূর্তে কুয়াশা।
পরে কী ঘটেছিলো, তা আর মনে নেই। তবে সে বড় সুখের সময় ছিল না।
মদ খাওয়ার তেমন সুযোগ সুবিধে ছিল না। মদের দোকানও খুব কম। আর সেগুলো ব্যাংক ভল্টের থেকেও সুরক্ষিত। লোহার খাঁচার ভিতরে কর্মচারী আর বাইরে ক্রেতারা। দেখে শুনে কোনবার কোনো সিনই নেই। যেটা পাওয়া যাবে সেটাই খবরের কাগজে মুড়ে দিয়ে দিতো, সোনা মুখ করে সেটাই খুব সাবধানে নিয়ে আসতে হতো। কালি পুজোর সময় তো লম্বা লাইন পড়তো দোকানের সামনে, সেই লম্বা লাইনেই পাড়ার পাকা বাবুজি দেখে একটু দূরেই তস্য পিতৃদেব, আর তারও সামনে, তার উদ্যোগী ঠাকুরদা। আ ছি ছি। কেউ কারুর চোখের দিকে তাকাতে পারে না।
সে যাজ্ঞে, যেটা বলার ছিল - সেই যে কবি বলেছিলেন, 'চটকে গেলো নেশার ঘোর, লেখার পালা সাংগ মোর'। সেই বৃত্তান্ত।
ডিডির কেচাইনের সিরিজ টু এখানেই খতম।
কে জানে, আবার কোন সুদূর প্রভাতে, রবির কর টর, প্রাণে পশে গেলে না হয় ফের একটা সিরিজ থ্রি শুরু হবে। এখন তাহলে বাই বাই।