অলৌকিক নিশিকুটুম্ব
ঘটনাটা ঘটেছিল দুহাজার ছয় সালের পয়লা ফেব্রুয়ারী। আমার সেই ভাঙাবাড়ি এখন প্রায় গোটা। সে বাড়িকে অনেক রকম নির্মান এবং স্থাপত্যকলার সাহায্যে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। মা আগেই এসেছিল, ক’দিন হ’ল বৌ ছেলেও চলে এসেছে। মেয়ে এখন বিলেতে, তবে ফিরলে এবাড়িতেই উঠবে।
টানা হ্যাঁচড়া ক’রে কিছু একতলার মাল ওপরে তোলা হ’ল, কিছু ওবাড়ি থেকেও এসেছে কিন্তু ওপরে এত জায়গা নেই যে সব ধরে যাবে তাতে। তাই একতলাতে কিছু জিনিষ থেকে গেল।
পয়লা ফেব্রুয়ারী একটু রাত করেই ছেলে ফিরল ক্যারম ট্যারম খেলে। আমি বললাম, যে শেষে ঢুকবে, তালা লাগানো তার কাজ। যা নীচে সবগুলো তালা লাগিয়ে আয়। মিনিট দশেক পর সে উঠে এসে বলল, বাবা, অনেক চেষ্টা করলাম, তালা কিছুতেই লাগছেনা। আমি বললাম,সেকী! ঠিকই তো ছিল, নেমে দেখলাম নাঃ ঠিকই তো আছে। তবে ও কেন লাগাতে পারলনা ? আসলে ওটা ইঙ্গিত ছিল, বুঝতে পারিনি।
পরদিন, ছেলের ছ’টায় স্কুল। সকাল সকাল নেমে তালা খুলতে হয়। খুলতে হলনা, সিঁড়ির বাঁক থেকেই দেখলাম, তালার ওপরের ভাঙা অংশটা নীচে পড়ে আছে। চমকে একতলার দরজার দিকে তাকালাম, সেটার তালাও ভাঙা, দরজাটা হাট ক’রে খোলা।
গলাটা শুকিয়ে গেল, দৌড়ে নীচে নেমে ঘরে ঢুকে দেখি চারিদিক লন্ডভন্ড। কী গেছে, অথবা কী কী গেছে হিসেব করাই মুশকিল। যে স্যুটকেসটা নিয়ে গৃহিনীকে কেরালার হাসপাতালে রাখতে গেছিলাম, সেটা হাঁ করে পুরো উল্টোনো, কাগজপত্রগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারিদিকে। মায়ের ঘরে তাকের ওপর কটা ছোট ছোট মূর্তি ছিল, সেগুলো উল্টে পড়ে আছে, রান্না ঘরের দরজাটাও খোলা। দৌড়ে আবার সিঁড়ির কাছে ফিরে এলাম। পুত্র নামছে ওপর থেকে, স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে, বাবা, সাইকেল কই?
আমার শুকনো গলা আরও শুকিয়ে গেল। এতক্ষণ খেয়ালই করিনি, সিঁড়ির তলাতেই তো ওর নতুন সাইকেলটা ছিল। বললাম, নিয়ে গেছে বাবা, দেখনা গেটের তালা ভাঙা, তুই রিক্সো করে চলে যা, দেরী হয়ে যাবে। ছেলেটা কিছুক্ষণ হতভম্বের মত তাকিয়ে থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময়ে বলে গেল, ইসস এটাতে চড়ে কত যায়গায় যেতাম-
কল্যান রোজ সকালে চা খেতে আসে, আজও এসেছে। দীনেশও এল। এসেই হাঁক ডাক শুরু হয়ে গেল, থানায় ফোন করল কল্যান। ঝটিতি একজন এ,এস,আই আর একজন কনস্টেবল এসে গেলেন। সামান্য চুরির ঘটনায় একটা ফোনে বাড়িতে পুলিশ চলে আসছে, দিনকাল পাল্টাচ্ছে বোধহয়। পুলিশ(আসলে ‘পুলিস’ হবে)অফিসার নোট বই বাগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী কী গেছে আপনার? শুকনো গলায় বললাম, আমার ছেলের সাইকেলটা- কত দাম হবে? –এই তো সবে কিনলাম উনিশশো টাকায়। -আর? আর আমার ছোট পাম্পটা। -সেটার কত দাম? –তিন হাজার ছ’শো। - আর কী গেছে? –ক’টা জামাকাপড়, কিছু সৌখীন জিনিষ আর,- আর কী? ঠিক করে ভেবে বলুন। রান্না ঘরের বাসন কোসন? – দেখুন সেটা ঠিক নিশ্চিত বলতে পারছিনা, তবে এই স্যুটকেসে একটা চেন আর তালা ছিল চাবি সমেত, তা ছাড়া- তা ছাড়া?
আমার গৃহিনীকে যখন কেরালার হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম, তখন যেতে হয়েছিল দু’বার। প্রথমবার ওখানে রেখে ফিরে এসেছিলাম, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খুব রাগ করেছিলেন। অ্যাডমিন্সট্রেটিভ অফিসার মহিলা ভুরু কুঁচকে বললেন, য়ু কান্ট সিম্পলি ডাম্প ইয়োর পেশেন্ট হিয়ার অ্যান্ড গো আওয়ে। কী করে তাঁদের বোঝাই, যে চাকরি করি, তার বত্রিশ সিংহাসনের ওজন কত। গিন্নী স্যুটকেস বোঝাই ক’রে শাড়ি নিয়ে গেছে, আমি বললাম, বেড়াতে এসেছ নাকি? এত শাড়ি কী হবে? সে বলল, বাঃ এতদিন হাসপাতালে থাকব, পরতে হবেনা? ওরা বলল, নো নো দিদি, য়ু কান্ট ওয়্যার সারিস হিয়ার। য়ু হ্যাভ ব্রট ওনলি ওয়ান ম্যাক্সি? বাট য়ু নীড মেনি মোর। তিনি বললেন, দেখনা, বাজারের দিকে গিয়ে, এখানে ম্যাক্সি পাওয়া যায় নাকি, এরা তো খুব বকাবকি করছে।
ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ কোট্টাকাল। ওইটুকু জায়গায় অতবড় জমকালো বাজার দেখে তো আমার মাথা ঘুরে গেল। কোনোটা জামাকাপড়ের দোকান, কোনোটা কনফেকশনারির, কোনোটা স্যানিটারি ফিটিংযের, আবার কোনোটা ফার্নিচারের – আমাদের কোলকাতার বড়রাস্তার ওপর নামকরা দোকানগুলো এদের স্টকের কাছে নস্যি। ব্যাপারটা কী? জিজ্ঞেস করলে ওখানকার লোকই মুচকি হেসে বলে ‘গাল্ফ-মানি’।
যাকগে, বৌয়ের ম্যাক্সি কিনতে গিয়ে কেরালার একটা লুঙ্গি আমার দারুন পছন্দ হয়ে গেল। আমরা ‘লুঙ্গি’ বললেও কেরালায় ওটা ‘মুন্ডু’,তামিল ভাষায় ‘ভেশ্তি’ আর অন্ধ্রে ওটা ‘আদ্দা পাঞ্চা’।
ওরা অবশ্য আমাদের মত সেলাই করে পরেনা, ভাঁজ করে জড়িয়ে জায়গা বুঝে কখনও হাফ, কখনও ফুল। একাধারে ক্যাসুয়াল ও ফরমাল ড্রেস। পাড়ের নক্সাটার জন্যই আমার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল লুঙ্গিটা। সব দক্ষিণ দেশেই সাদা জমির ওপর নক্সা কাটা পাড় থাকে তবে এখানকার নক্সাটা দারুন। দাম তো মাত্র একশো দশ। হাসপাতালে ফিরে এসে গিন্নীকে দেখাতে তিনি বললেন, দেখতে তো খুবই সুন্দর, তবে তোমার যা স্বভাব, ও তোলাই থাকবে, প্রাণ ধরে আর পরা হবে না কোনওদিন।
কেরালা থেকে যখন ফিরেছি, তখনও বাড়ি মেরামত হয়নি। ভাঙা বাড়ির একতলাতেই স্যুটকেসটা ছিল। পরে নতুনভাবে তৈরী ওপরতলায় মালপত্র সব তোলা হলেও, স্যুটকেসটা আর ওঠেনি। সকালে মা, কল্যান আর নিজের জন্য চা বানাতে যখন রান্না ঘরে যেতাম, যাবার পথে বাক্সের ঢাকনাটা খুলে প্যাকেটটা নেড়ে চেড়ে দেখতাম আর গায়ে সস্নেহে হাত বোলাতাম। ওটা ওপরে আনবার কথা প্রায়ই ভাবতাম, তারপর ভাবতাম, থাকনা, কী আর হবে। মনে হয়, গৃহিনী ঠিকই বলেছেন, ওটা পরা বোধ হয় আর এজম্মে হবেনা কোনওদিন।
তালা ভাঙা ঘরে সব জিনিষ লন্ডভন্ড, ওদিকে তাকানো যাচ্ছেনা। স্যুটকেসটা খুলে সব ছড়িয়েছে মাটিতে। হাসপাতালের রশিদ আর ক্যাশমেমোগুলো রিইমবার্সমেন্টের জন্য জমা দেয়া হয়নি, বাক্সের মধ্যেই ছিল, সেগুলো কাটা ঘুড়ির মত উড়ছে চারিদিকে। ট্রেনে লাগে বলে দুটো চামচ রেখেছিলাম, সেদুটো ছিটকে পড়ে আছে মাটিতে। একটা নতুন চেন-তালা ছিল, সেটা নেই। পুলিশ অফিসার বলছেন, বলুন, আর কী গেছে আপনার, বলুন-
তিনি বললেন, বলুন আর কী কী গেছে, আমাকে তো ডায়ারীতে লিখতে হবে। সাইকেল হ’ল, পাম্প হ’ল, কিছু জামাকাপড় গেছে বলছেন, ওগুলো আর লিখলাম না, ওগুলোর কোনও দাম হয়না। আমি কিন্তু কিন্তু ক’রে বললাম, শার্টগুলো একেবারে নতুনই ছিল, তবে যাকগে, না-ই লিখলেন। কিছু বাসন কোসন গেছে মনে হচ্ছে – মনে হচ্ছে বললে হবেনা, ঠিক করে বলুন। কোনও মূল্যবান জিনিষ গিয়ে থাকলে বলুন, লিখে নিচ্ছি। আর কী গেছে আপনার? কল্যান বলছে, বলুননা, ভাল ক’রে ভেবে বলুন, আর কিছু গেছে? আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি –
কি করে বোঝাই কী সর্বনাশ ঘটে গেছে কাল রাত্রে
এমন বস্ত্র গেঁড়িয়েছে, যেটা এখনও ওঠেনি গাত্রে
ভীষন আঘাত বেজেছে হৃদয়ে, হতাশা হয়েছে তুঙ্গী
বড় দাগা দিয়ে নিয়ে গেছে ব্যাটা কেরালার সেই লুঙ্গি
যদিবা শুধান মূল্য কী তার, কতটা হয়েছে loss?
কি করে বলব, “অমূল্য” তার মূল্য একশো দশ ?
শুনুন স্যার(পুলিশদের স্যার না বললে ভীষণ খচে যায়) আর যা গেছে, তা হ’ল আমার একটা মুন্ডু। কি বললেন ? মুন্ডু তো ঘাড়ের ওপরেই আছে ? না স্যার, এ মুন্ডুটা কোমরের তলায় থাকে। না স্যার, মাথার গোলমাল মোটেই হয়নি। ঐ যে, সাদা লুঙ্গির মত, কেরালায় একে ‘মুন্ডু’ বলে। যদি দাম জিজ্ঞেস করেন, তবে ধরুন ইংরিজিতে দামের অনেক প্রতিশব্দ, যেমন, প্রাইস, কস্ট, ওয়র্থ, ভ্যালু – বিক্কিরী করার সময়ে ‘প্রাইস’ আর কেনার সময়ে ‘কস্ট’, তাইতো? তবে লিখুন কস্ট-একশো দশ, মানে ওয়ান হান্ড্রেড টেন ওনলি, ওয়র্থ-ভেরি মাচ সেন্টিমেন্টাল আর ভ্যালু? ওটা লিখুন ইনভ্যালুয়েবল। কল্যান ধমক দিল, আঃ বদ্দা, মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি আপনার? আসলে সার ভোরবেলা উঠেই এইসব দেখে না- আপনি এদিকে আসুন তো, দামী বলতে ঐ সাইকেল আর পাম্পটাই লিখে নিন। ওরা কথা বলতে বলতে ওদিকে যাচ্ছে, কনস্টেবল মশাই চোরের ফেলে যাওয়া করাত, ব্লেডের টুকরো, সাইকেলের কাটা চেনটা, আরও টুকটাক জিনিষ একটা প্যাকেটে ভরছেন। ওগুলো কেসের ‘এক্সিবিট’।
অফিসার মশাই ভাঙা তালাটা দেখিয়ে বললেন, ওটাও নাও।
অফিসে যেতেই হবে, বেরোলাম। ট্রেনে গুম মেরে বসে আছি দেখে মহুয়া, শ্রাবণী, পিকুরা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে কাকু? এমন গোমড়া মুখতো সচরাচর দেখিনা। আমি বললাম, লুঙ্গি চুরি গেছে। সত্যি বলনা কাকু, কী হয়েছে? –বললামতো, লুঙ্গি চুরি গেছে। অবশ্য ছেলের সাইকেলটা, পাম্পটা, আরও বেশ কিছু জিনিষ গেছে। যে শার্টগুলো দেখে শ্রাবণী ‘দারুন দারুন’ বলত, অথচ এ বয়সে আমাকে একদম মানায়না, সেগুলোও গেছে। তা গেছে আপদ গেছে। ওগুলো ছেলেকেই দিয়ে দেব ভেবেছিলাম, তা চোরের যদি বয়স কম হয়, সেও পরতে পারে। কিন্তু লুঙ্গিটা যে বড় আশ করে কিনেছিলামরে- অফিসেও গোমড়া মুখ। ছেলেরা জিজ্ঞেস করতে একই গল্পের পুনরাবৃত্তি।
দীনেশ ছুটল পার্টির নেতাদের কাছে। সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স দেখে বোঝাই যাচ্ছে এটা প্রোফেশনাল চোরের কাজ নয়, আশেপাশেরই কেউ। তারা বলল, “দেখছি” – সব ব্যাপারেই যেমন বলে। রাস্তার নাইট গার্ডটাকে ধরে কল্যান এই মারে তো সেই মারে। ‘ব্যাটা তুম তিন বাজে হিঁয়া বৈঠা থা তাহলে চুরি কেমন করে হুয়া?’ কল্যানের হিন্দী অনেকটা আমার বাবার মত, বেচারা নাইট গার্ড মারের ভয়ে হাসতেও পারেনি।
অফিস থেকে ফেরার সময়ে ঐ টীচারদের দলটা থাকেনা। থাকবে কি করে, তখন তো অনেক রাত্তির। অফিসের কর্মীরাও ‘গুড নাইট সার’ বলে বিদায় নিয়েছে একে একে। কখনও সখনও একজন দুজন অফিসারকে সঙ্গে পাই, বেশী রাত হ’লে এক্কেবারে একা। সেদিন একাই ছিলাম, এককোনে বসে কায়মনোবাক্যে কী চেয়ে বসলাম কে জানে। আমার বয়স হয়েছে, বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ও হয়েছে। পুরো ধানাই পানাইটা পড়লে ব্যাপারটা বিশদে বোঝা যেত। সবাই মনে মনে অনেক কিছু চায়, কিন্তু যেটা পাবার চান্স কম, সেক্ষেত্রে মনের মধ্যে আর একটা আমি বলে, ধ্যাত এটা কি করে পাবি, এতো অসম্ভব। যদি কখনও সেই ‘আমি’টার গলা টিপে ধরতে পার, অসম্ভব জিনিষ পাওয়া যাবে। আমি বহু, বহুবার পেয়েছি। তবে হ্যাঁ, সে আমি-র গলা টেপা খুবই কষ্টসাধ্য।
এখন একতলার ঘরে আর ঢুকতে হয়না, চা এখন ওপরেই হচ্ছে। দীনেশ বলল, একদিন নীচে গিয়ে আর যা যা আছে তুলে আনুন। বলাতো যায়না, ব্যাটারা আবার আসতে পারে। গেলাম নীচে। মাঝের ঘরে ঢুকে কালো স্যুটকেসটার দিকেই প্রথমে চোখ গেল। ওদিকে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছিল। যে কটা কাগজ পেয়েছিলাম, তুলে রেখেছি। ভাবলাম, দেখি একবার, মেডিক্যাল বিলের খানিকটাও যদি উদ্ধার হয়। একটা একটা করে কাগজগুলো সরাতেই কোট্টাকালের দোকানটার নাম লেখা প্লাস্টিকের প্যাকেটটা চোখে পড়ল। - সেকী? এটা কী করে – তড়বড়িয়ে প্যাকেটটা ফাঁক করতেই আর একটা ব্রাউন পেপারের প্যাকেট। সেটা খুলতেই দেখতে পেলাম- নিজের চোখকে কখন বিশ্বাস আর কখন অবিশ্বাস করতে হয়, আমার জানা নেই। ধবধবে সাদা, পাড়ে নেভি ব্লু আর লাল কল্কার কাজ করা কেরালার মুন্ডু চকচক করছে।
কল্যান মুখ বেঁকিয়ে এমন হাসি হাসল, যে গায়ে জ্বালা ধরে গেল। আপনি না, পারেন মাইরি। ওটা এর ভেতরেই ছিল, আর কস্ট, ওয়র্থ, মূল্য ফূল্য কিসব বলে পুলিশটাকে আর একটু হলেই বমকে দিয়েছিলেন। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, তুমি দেখনি, বাক্সটা ডালা ফাঁক হয়ে উল্টে পড়েছিল? একটা একটা করে কাগজগুলো তোমার সামনেই তো তুললাম। ভেতরটা তো একদম ফাঁকা ছিল। - ধুর মশাই, ছাড়ুন তো, পাগলের মত কথা – এই বলে একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে কল্যান দীনেশের দিকে তাকাল। আমি ভেবে দেখলাম, চেপে যাওয়াই ভাল।
হন্তদন্ত হয়ে কমলাকান্তের প্রবেশ। বলল, পাগল হতে খুব দেরী নেই জানতাম, তবে সেটা এত তাড়াতাড়ি হবে ভাবিনি। সকাল বিকেল আফিম খেয়েও আমি এত ভুলভাল বকিনা। তোর বক্তব্যটা পরিষ্কার করে বলতো, তোর সাধের লুঙ্গি চোর এসে ফেরত দিয়ে গেছে? আমি বললাম, চোর কেন ফেরত দিতে যাবে, ওটা হয়ত ছিলই, আমি হয়ত ওটাকেই কাগজ মনে করেছি। যদিও একটা কাগজের থিকনেস আর অত মোটা প্যাকেটটার থিকনেস এক ভাবাটাও পাগলামির লক্ষণ। খুড়ো কোয়ান্টাম ফিজিক্স টিজিক্স পড়েছ নাকি? বঙ্কিমবাবু তো লিখেছেন শেক্সপীয়র তোমার কাছে জলভাত। তা শুধু সাহিত্য পড়লে হবে? অবশ্য শেক্সপীয়রবাবুও কোয়ান্টাম নিয়ে নাড়াচাড়া করেননি তা নয়, ঐ যে, ‘টু বি অর নট টু বি ‘টিস দ কোয়েশ্চেন,’ দুটো পসিবিলিটি, দুটোই ঠিক। সেই শ্রোডিংগারের বেড়ালের মত, মরেও গেছে, আবার বেঁচেও আছে– কোয়ান্টাম থিয়োরি বলছে একই বস্তুকণার ভিন্ন জায়গায় অবস্থান সম্ভব। আবার হালে শোনা যাচ্ছে, কণা ফণা নয়, পুরো বস্তুই। আসলে আমি ভাবছি লুঙ্গি আমার বাক্সে আছে, আবার চোর ভাবছে তার থলিতে আছে। আচ্ছা খুড়ো আর একটা গল্প শোন, এসব গল্প কল্যান ফল্যানকে বলা যাবেনা।
সে অনেকদিন আগের কথা, আমার মেয়েটার তখন বছর ছয় সাত বয়স। ও খুব গয়নাগাঁটি পরতে ভালবাসত। ওইটুকু মেয়েকে তো আর সোনার গয়না দেয়া যায়না, অবশ্য দুই ধরণের পরিবার বাচ্চাদেরও সোনা পরায়, বোকালোক আর বড়লোক। আর তাই মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠে। বেচারা বাচ্চাগুলো বুঝতেই পারেনা কী অপরাধে তাদের প্রাণটা যাচ্ছে। যাই হোক, আমার মেয়েকে সোনা পরানো হতোনা। আমি বোকা নই বলে আমার ধারণা, বড়লোক নই, তা আমি জানি।
একটা ঝুটো সোনার হার, ঐ যে গো, যাকে বাংলায় ‘ইমিটেশন’ বলে, সেটা আমার মেয়ের খুব শখের ছিল। প্রাণ থাকতে কাছছাড়া করতনা। আজকাল ইমিটেশন জুয়েলরি খুব সুন্দর সুন্দর বেরিয়েছে, বেশ দামীও হয়। হারটা আবার সাতনরী টাইপ, লম্বা লম্বা কি সব ঝোলে তার থেকে। তা সেই হারটা একটু ময়লা হয়েছিল বলে সেটাকে ধুয়ে টুয়ে জানলার তাকে শুকোতে দিয়েছিল মেয়ে।
আমাদের বাড়িতে তখন এক সহায়িকা ছিলেন তাঁর নাম নমিতা। হঠাৎ তাঁর চিল চীৎকার- ও বৌদি, নিয়ে গেল, নিয়ে গেল গো- সবাই দৌড়ে এসে দেখলাম, একটা কাক ঝলমলে জিনিষটা মুখে করে উড়ে যাচ্ছে। নিমেষের মধ্যে গাছপালার ফাঁক দিয়ে, বাড়ি ঘরের পাশ কাটিয়ে উধাও হয়ে গেল। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। তার সে দৃষ্টির দিকে তাকানোই সম্ভব না। কত বললাম, এক্ষুণি আর একটা কিনে আনব, ওটা কি, ওর ডাবল সাইজের এনে দিচ্ছি, তাতে আবার পাথর বসানো। ফ্যালফ্যালে দৃষ্টির নড়চড় নেই।মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বেচারা, সামান্য জিনিষ, কিন্তু – ফেরত দাও। একহাতে সেই ব্যাটা ‘আমি’-র গলা টিপে রেখেছি। ‘কী করে ফেরত পাবি?’ সে বলার যো নেই। ঠিক তিন দিন পর সেই জানলার তাকেই পাওয়া গেল হারটা। খুড়ো আমি জানি, হারটা যদি সোনার হ’ত, আর লাখ খানেক টাকা দাম হত, পেতাম না। সেই ব্যাটা হাত ছাড়িয়ে গলা মুক্ত করে ঠিক বলে দিত কথাটা।
খুড়ো, যদি যুক্তিবাদী সমিতির লোকরা শোনে কী বলবে? আচ্ছা তাদের কথা ছাড়, এই কল্যান টোল্যান-ই যদি শোনে? প্রথম কথা, হারটা যায়নি মোটেই। নমিতা ভুল কিছু দেখে চেঁচিয়েছে আর আপনার হ্যালুসিনেশন হয়েছে। কাক আসলে বাসা বানানোর জন্য খড়কুটো মুখে নিয়ে যাচ্ছিল। যদি বলি শুধু আমার? বাড়ি শুদ্ধু সবাই দেখলাম তো। তখন বলবে, হয়না? গনেশের দুধ খাওয়ায় মাস হ্যালুসিনেশন হয়নি? যদি বলি ঘর মোছার মেয়েটা তিন দিন পর যে বলল, ওমা, এই তো খুকির হার! তাহলে তিন দিন ধরে সে সব তাক মুছেছে শুধু ঐটা বাদ দিয়ে? তখন বলবে হতেই পারে। কাজের লোকরা একটু চোখ ঘোরালেই ফাঁকি দেয়। যদি বলি, আর তিন দিন ধরে যেতে আসতে অত চকচকে জিনিষটা কারো চোখে পড়লনা? তখন বলবে, পড়েছে ঠিকই, তবে আপনারা তো জানেন ওটা নেই, তাই রিভার্স হ্যালুসিনেশন হয়েছে।
তাহলে বলছিস দেখবারই ভুল? ঠিক ক’রে বল বাবা, আমি আফিমখোর মানুষ, মাথাটা খারাপ করিস না। বললাম, খুড়ো, আমি জানি ফাঁকা তাকটার দিকে মেয়েটা কেমন করুন চোখে তাকিয়েছিল, আর মনে মনে গাইছিল – শুণ্য এ তাকে হার মোর ফিরে আয় ফিরে আয় // তোরে না হেরিয়া সকালের দুল বিকেলে হারিয়ে যায় -আসল ব্যাপারটা হল,হারটা কাকটাই ফেরৎ দিয়ে গেছে। একথা জানাও গেছে কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান থেকে, কিন্তু লুঙ্গিটা -
খুড়ো, মনটা খুব খারাপ লাগছে জান, যদি লুঙ্গিটা না চেয়ে ছেলের সাইকেলটা চাইতাম। সে বেচারাও তো কত মন খারাপ করে ঘুরছে। নতুন একটা কিনে দিতেই পারি, দেবও। কিন্তু নিজের জিনিষে একটা মায়া পড়ে যায়। অনেক দোকান ঘুরে, অনেক বেছে ওর এইটে পছন্দ হয়েছিল। যাকগে পুঁ পুঁ করে কি একটা আওয়াজ আসছে, খুড়ো, তুমি এখন এস।
বাঁশি
রাত এখন গভীর। পুঁ পুঁ করে আওয়াজটা বেশ স্পষ্ট। মনে হচ্ছে বাড়ির পেছন থেকেই শব্দটা আসছে। হঠাৎ মনে হ’ল, পেছনের বাড়ির পাপু তো বাঁশি বাজায়, মাঝে মাঝেই রেওয়াজ করে। আবার রাত একটু নিশুতি না হ’লে ওর সুর সাধনা হয়না। ওরই বাঁশির আওয়াজ হবে। তবু একবার সরেজমিন তদন্ত না করলে কেমন কেমন লাগে। যাই দেখেই আসি। বাড়ির পেছনটা এখনও ভাঙাচোরা, ঝোপজঙ্গল হয়ে আছে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে। ওদিকে যেতেই বাঁশির আওয়াজটা প্রবল হ’ল। বুঝলাম, এ আওয়াজ পাপুর বাঁশির নয়, অন্য কারো। আবছা আলোয় হলদে ধুতিও দেখা যাচ্ছে। ওপাশ থেকে ভেসে এল, -
“অশোচ্যানণ্বশোচস্তং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষতে
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পন্ডিতাঃ”
যে বস্তুর জন্য শোক করা উচিত নয়, তারই জন্য শোক করছিস, আবার মুখে বড় বড় কথা। আমি বললাম, উরি বাবা, এতো গীতা, তুমি কোন কেষ্টদা গো, বৃন্দাবনের, না কুরুক্ষেত্রের? কোনও উত্তর না দিয়ে আর একটা গোলা উড়ে এল –
“ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম
স্থিরবুদ্ধিরসংমূঢ়ো ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মণি স্থিতঃ”
ব্রহ্মজ্ঞ মানুষ প্রিয় জিনিষ পেয়ে উৎফুল্ল হননা, আবার অপ্রিয় জিনিষ পেয়ে বিমর্ষও হননা। আমি বললাম, কেষ্টদা, কেন মিছিমিছি ব্যাটারি খরচ করছ, কষ্ট পেয়েছে আমার ছেলে, সাইকেল হারিয়ে। ওর পনের বছর বয়স কিন্তু বুদ্ধি পাঁচ বছরের। ব্যাটার বাহ্যজ্ঞানই হয়নি তো ব্রহ্মজ্ঞান। বরঞ্চ তুমি চোর ব্যাটাকে কিছু উপদেশ দিয়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে জবাব চলে এল, -
“হরতি পরধনং নিহন্তি জন্তুন বদতি তথামৃড়ণিষ্ঠুরাণিযশ্চ
অশুভজনিতদুর্মদস্য পুংসঃ কলুষমতের্হৃদি তস্য নাস্ত্যনন্তঃ”
যারা পরের জিনিষ চুরি করে, পশু হত্যা করে আর কর্কশ কথা বলে, তাদের হৃদয়ে আমার স্থান নেই। আমি এসবের মধ্যে নেই।
আমি বললাম, ও কেষ্টদা, তুমিতো আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের সেই ছেলেটার মত গো, সেও তো বলত ‘আমি এসবের মধ্যে নেই’।
তোমার সঙ্গে অনেক মিল, সেও বাঁশি বাজাত।
আমার শ্বশুরমশাই চন্দননগরে থাকতেন, তবে তাঁর বাপ দাদার ভিটে ছিল হুগলীর কোদালিয়ায়। ওঁদের দেশে এক ক্ষয়িষ্ণু বড়লোকের ভিটে, সে বাড়ির বোলবোলাও এখন আর নেই। বাড়ির পলেস্তারা খসেছে, বটগাছ বেরিয়েছে দেয়াল বেয়ে, মানে, মৃণাল সেনের ‘খন্ডহর’ সিনেমার বাড়িটা মনে মনে ভিসুয়ালাইজ করে নিলেই চলবে। সে বাড়ির এক বিবাগী ছেলে, সেও তোমার মত সারাদিন বাঁশি বাজাত। বাড়ির কোনও কাজ করতনা, কোনও খবরও রাখতনা। কেউ কিছু বললেই বলত, আমি এসবের মধ্যে নেই। বৈষয়িক, সাংসারিক, যে কোনও ব্যাপারে তাকে কিছু বলা চলবেনা, বললে একটাই উত্তর – ‘আমি এসবের মধ্যে নেই’।
নামে তালপুকুর, কিন্তু ঘটি ডোবেনা। তা না ডুবলেও ঘটিগুলো যাবে কোথায়। যে হেতু এককালের বড়বাড়ি, তাই পুরনো আমলের পেল্লায় পেল্লায় এবং ভারী ভারী প্রচূর কাঁসার বাসনপত্র ছিল, বাড়িতে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য বেরোত। কোনও এক উৎসবের আগে হবে, বাড়ির এক মহিলা, মানে ছেলেটির পিসিমা, বাড়ির পুকুর ঘাটে সব বাসন তেঁতুল মাখিয়ে ভিজিয়ে রেখে ভেতরে গেছেন। কাজকর্ম সেরে এসে পরে মাজবেন।
পুকুর, বাগান সমেত বিশাল এলাকা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেই পাঁচিলের ওপর বসে বাবু বাঁশি বাজাচ্ছেন। পিসিমা বলে গেলেন, বাসনগুলো রইল, দেখিস-।
এদিকে পাঁচিলটারও বাড়ির মতই অবস্থা, তার গায়েও বটগাছ, এখানে ওখানে মস্ত ফোকর। খানিক পরে ফিরে এসে পিসির মাথায় হাত। একী! সব বাসন কোথায় গেল? একটাও নেই? ভাইপোর দিকে তাকিয়ে বললেন, কিরে, বাসনগুলো কোথায় গেল? বাঁশি বাজানো থামিয়ে সে বলল, নিয়ে গেল। -কে? কে নিয়ে গেল? –ঐতো একটা লোক বস্তা কাঁধে নিয়ে পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে এল, তাপ্পর সব বাসন বস্তায় ভরে চলে গেল। -সেকীরে, তুই কিছু বললিনা? – “আমি এসবের মধ্যে নেই।“
বাঁশির আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে। হলদে ধুতি পরা ছায়ামূর্তিও ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিক দূর থেকে খুব আস্তে আস্তে ভেসে আসছে কিছু কথা। কান খাড়া ক’রে অনেক চেষ্টার পর শোনা গেল-
যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে
মত্ত এবেতি তান বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি
এটার বাংলা ট্রান্সলেশন কানে আসার আগেই হাওয়ায় ভেসে গেল। মানেটা তাই বুঝলাম না। তবে মনে হ’ল, ‘আমি এসবের মধ্যে নেই’ বলে যে খোঁটা দিয়েছিলাম, তারই জবাবে খানিক সংস্কৃত কপচে গেল।
(চলবে)