মরণের পারে
এমন একটা সময় ছিল, যখন কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা যেত, হ্যাঁ হে, ‘বিষবৃক্ষ’ পড়েছ? সে হয়তো বলল, বিষ – বৃ-ক্ষ? ও, হ্যাঁ, নীহাররঞ্জন গুপ্তর সেই রহস্য উপন্যাস তো? আবার যদি কাউকে বলা হত, আচ্ছা ‘শেষের কবিতা’ সম্বন্ধে আপনি কি বলেন? সে হয়তো বলল, হ্যাঁ সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবি হিসেবে সত্যিই অনবদ্য। কিন্তু এঁরা দুজন সমেত, বঙ্গভূমির আপামর জনসাধারণ পড়া টড়ার ব্যাপারে এক জায়গায় এক নৌকোয়। তা হল, স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’। আমাদের সময়ে, এ বই পড়েনি এমন লোক আমি অন্ততঃ দেখিনি। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ এটা লাইব্রেরী থেকে নিয়ে (তখন হানেশাই হত, গ্যাঁড়ানোও চলত সমানে) পড়েনি। সবার বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলী থাকুক না থাকুক, দুটো বই মাস্ট। রামকৃষ্ণ কথামৃত আর মরণের পারে। মানে, লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলি, আমার বাড়িতেও দুটোই আছে। অবশ্য রবীন্দ্র রচনাবলীও আছে।
স্বামীজি বইটা লিখেছেন। তা বেশ করেছেন, তবে ছবিগুলো না দিলেই পারতেন, তাও খানিক বিশ্বাসযোগ্য হত। অবশ্য বেশ কিছু পাবলিক তাতেও গোল খেয়েছে। তখনকার লোকজন বড় সরল ছিল। একজন আমায় তেড়েফুঁড়ে বলল, ছবিগুলো দেখেছিস? এর চেয়ে বড় অকাট্য প্রমাণ আর কী হতে পারে। আমি বললাম, ভাইটি, আমার নিজের একটা ফোটো ল্যাব আছে জানিস তো? কত সুপারইম্পোজ, মাল্টিপ্ল এক্সপোজার করলাম, তুই আমাকেও ছবির গপ্পো শোনাবি? তখন অবশ্য ‘মরফিং’ শব্দটা শুনিনি, টেকনোলজিও অনেক পেছনে। তবু ছবিগুলো দেখে ভাবতাম, কেন উনি এগুলো দিলেন। একে তো সবই বিদেশি ছবি, তাও আদ্যিকালের। মানে, তখনকার লোক যত বোকা, আরও আগের লোক আরও বোকা ছিল, এগুলোও গিলত। কিন্তু ওদিকে, লার্জ ফরম্যাট ক্যামেরায় সরাসরি ফিল্মের ওপরই সুপারইম্পোজ করা যেত। ল্যাব অবধি যাবার দরকার পড়তনা। প্রথম কথা ভূত বলে কি কিছু আছে? দ্বিতীয় কথা, যদি থাকে। তাদের কি ছবি তোলা যায়?
সত্তরের দশকের প্রথম দিক। একদিন বুলবুলদা বলল, চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, খুব ভাল লাগবে দেখিস। যে জায়গাটায় গেলাম, সেখানে এখন কেউ গেলে ধারণাও করতে পারবেনা কেমন ছিল সেই জায়গা।
জায়গাটা সন্তোষপুরে, মানে আক্রার সন্তোষপুর, যাদবপুরের পাশেরটা নয়। একেবারে গঙ্গার ধারে, অনেকটা জমির ওপর একটা কাঠ, টিন ইত্যাদি দিয়ে বানানো দোতলা বাংলো। স্থলভাগের অংশটা ছোট গাছের ‘হেজ’, কাঠের বেড়া, এইসব দিয়ে ঘেরা থাকলেও নদীর দিকটা উন্মুক্ত। একটা ঘাট এবং কয়েক ধাপ সিঁড়ি, যেটি সংস্কারের অভাবে খানিক ভগ্ন, সোজা নেমে গেছে গঙ্গার বুকে। বাড়িটি প্রথম দর্শনেই ইঙ্গিত দেয়, যে সম্ভবতঃ কোনও বিলেতী সাহেব এটি এর বর্তমান মালিককে বিক্রী করে চলে গেছেন।
সে বাড়িটা নিশ্চয় এখন নেই, থাকা সম্ভব নয়। ওই অঞ্চলে অতবড় প্রপার্টি নিয়ে কোনও বিশেষ নৃগোষ্টির লোক সেখানে এখন বাস করছেন, তা ভাবাও অন্যায়। যাক, সে সময় ছিল অন্যরকম। আমি গিয়ে অবধি চারিদিকের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলাম, কত সৌভাগ্য থাকলে এমন বাড়িতে লোকে থাকতে পায়।
যিনি থাকতেন, তিনি অবশ্য খুব একটা ভাগ্যবান বলে মনে হলনা। তিনি বৃদ্ধ, সাথে তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রীও আছেন। কাজের লোক থাকলেও শুধু দিনের বেলাটুকু থাকে, কারণটা সহজেই অনুমেয়, ওই রকম নির্জন জায়গায় রাত্রে বাইরের লোককে থাকতে দেয়াটা সেই সময়েও কিছুটা বিপজ্জনক বলে গণ্য হত।
বাড়ির মালিক বুলবুলদার কাকা। তিনি গোঁড়া ব্রাহ্ম, বাড়ির সাজসজ্জা, আসবাব ও সার্বিক পরিবেশে তার ছাপ স্পষ্ট। এই ধণের ব্রাহ্ম পরিবার তখন অনেকই দেখতাম, আমার সহপাঠীও ছিল বেশ ক’জন। ছেলেবেলায় যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, তার মালকিনই ছিলেন কট্টর ব্রাহ্ম। এখন বোধকরি ‘প্রসারিত’ এবং লিবারাল হিন্দু ধর্ম এঁদের গিলে খেয়েছে।
কাকীমা, পুরোন বাংলা ছবিতে যে রকম ব্রাহ্ম মহিলা দেখতাম, সেরকমই। ফুলহাতা ফ্রিল দেয়া ব্লাউজ, শাড়ি পরাটাও যেন একটু অন্যরকম। বাঙালি ক্যাথলিক ক্রিশ্চানদের সঙ্গে ভীষন মিল চেহারায়। অসম্ভব ভাল রান্না করেন, তবে রান্নাগুলোও ঠিক আমাদের বাড়ির মত নয়, ক্রিশ্চান বাড়ির সঙ্গে স্বাদেও খুব মিল। বড় অদ্ভুত লেগেছিল কাকিমার ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে। তাকের ওপর সারি দিয়ে বিশাল বিশাল চিনে মাটির বয়ামে ভর্তি নানা রকমের আচার আর মোরব্বা। কোনও আচারের দোকানেও অত রকম এবং ঐ পরিমাণে আচার দেখিনি। এগুলোকে ঐ ভারি ভারি বয়াম শুদ্ধু রোদে দেয়া, তোলা ইত্যাদি কী করে করা হয়, সেটাতেই শুধু অবাক হইনি, ভাবছিলাম এত আচার খায় কে?
আচার ও মোরব্বা কয়েকটা চেখে দেখলাম, অপূর্ব বললেও খুব কমই বলা হবে। লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, কিন্তু কাকীমা, এত আচার আপনারা দুজনে – বুক খালি করা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল দুজনেরই। শুধু আচার? এই এত বড় সম্পত্তি, এই বাড়ি, বাগান, কার জন্য রেখে যাব? জানা গেল, উত্তরাধিকারীরা সকলেই বিলেতে। কারোর ফেরার কোনও ইচ্ছে নেই। দু চার বছরে একবার এসে দেখাটাও করেন না। কাকা বললেন, পাড়ার লোকেদের বলেছি, আমি মরলে যেন বাড়ির বাগানেই সৎকার করা হয়। জায়গাটাও উনি বেছে রেখেছেন। আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখালেনও সেটা। গঙ্গার একেবারে ধারেই, একটা ছোট বাঁকা মত গাছের নীচে একটু বেদীর আকারে চৌকো একটা জায়গা। আমি বললাম, তখন কাকীমার কী হবে? কাকা শক্ত করে বাহুপ্রান্ত চেপে ধরলেন, খুব জোর তাঁর হাতে। সেই জন্যেই তো যেতে পারছিনা, বুঝলেনা?
বুড়ো মানুষরা নতুন লোক পেলে মহা উৎসাহে অনেক গল্প করেন, অনেক কিছু দেখাতে চান, নিজেকে দিয়ে তা এখন খুব ভাল বুঝি। হয়তো অল্প বয়সীরা সে সব দ্রষ্টব্যে এবং বক্তব্যে খুব একটা উৎসাহ পায় না। তারা সেটা গোপনও করেনা। বুড়ো মানুষগুলো দুঃখ পায়, আহত হয়। আমি কিন্তু একটুও দুঃখ দিইনি কাকাকে। খুব আগ্রহ ভরে শুনেছি সব কথা। না, জোর করে নয়, আমার শুনতে ভাল লাগছিল। নানান জিনিষ দেখাতে দেখাতে কাকা বললেন, দাঁড়াও একটা অদ্ভুত জিনিষ দেখাই তোমাকে।
খুব সন্তর্পনে উনি একটা ব্রাউন পেপারের বড় খাম নিয়ে এলেন। সাবধানে আস্তে আস্তে তার থেকে বেরোল একটা কাঁচের ফোটোগ্রাফিক প্লেট। এখন এই প্লেট ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এখন তো ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবিটবি তোলা হয়, আমাদের কালের ক্যামেরাকে এখন নাকি বলে অ্যানালগ ক্যামেরা। যাই হোক, সেই অ্যানালগেও ভিউ ফাইন্ডারে চোখ লাগিয়ে দেখতে হত। তার আগে লার্জ ফরম্যাট ক্যামেরা ছিল। সেটা কোলের কাছে ধরে, ওপর থেকে ছবির ফ্রেম ঠিক করতে হত। এবার তারও আগে ছিল এই প্লেটওয়ালা ক্যামেরা।
এতে শাটার থাকতনা। একটা মস্ত বড় ট্রাইপড বা তিনঠ্যাঙা স্ট্যান্ডের ওপর ক্যামেরা বিশাল বড় কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। ছবি তোলার আগে চিত্রগ্রাহক সেই কালো কাপড়ের মধ্যে ঢুকে পড়তেন। শুধু লেন্সের মুখটা বাইরে, তার ওপর একটা ঢাকনা। ছবি তোলার মুহূর্তে তিনি, রেডি, ওয়ান...টু...থ্রী বলে বোঁ করে হাত বাড়িয়ে ঢাকনাটা খুলে আবার ধাঁ করে লাগিয়ে দিতেন। কতক্ষণ এক্সপোজার দেবেন, পুরোটাই আন্দাজ। ফ্ল্যাশ বলে কিছু ছিলনা। রাত্রে তুলতে হলে ফোটোগ্রাফারের একজন অ্যাসিট্যান্ট পাশে দাঁড়িয়ে একটা টিনের প্লেটের ওপর গন্ধক জাতীয় কিছু ছড়িয়ে তাতে আগুন দিত। ফস্ করে তা জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঢাকনা খোলা আর পরানো করতে হবে। একটু এদিক ওদিক হলেই গেল। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ফোটো তোলায় মেলাই হ্যাপা ছিল সে সময়ে। হ্যাঁ, ভাল কথা, সেই সব ক্যামেরায় ফিল্ম বলে কিছু থাকত না। একটা ইমালশন লাগানো কাঁচের প্লেটের ওপর উঠত ছবি। সেটাই নেগেটিভ, তাই থেকেই প্রিন্ট হত।
কাকা খুব সাবধানে খামটা থেকে একটা কাঁচের প্লেট বার করলেন। প্লেটটা আড়াআড়িভাবে ফাটা। বললেন, এই কিছুদিন আগে, অসাবধানতায় আমার হাত থেকে পড়ে ফাটলো। কিন্তু তাতে কিছু অসুবিধে নেই, যা দেখার তা দিব্যি দেখা যাচ্ছে। এটা একটা প্লেট। তোমরা যাকে নেগেটিভ বলো, তারই আগের সংস্করণ। আমার কাছে এই ছবির প্রিন্টটাও ছিল, বেশ কিছুদিন হল খুঁজে পাচ্ছিনা। ভাল করে দেখ তো, কী দেখতে পাচ্ছ ।
আমি বললাম, এটা তো একটা গ্রুপ ছবি মনে হচ্ছে, কোনও বাড়ির মধ্যে তোলা, ভাইবোনদের গ্রুপ। কাকা বললেন, ভাইদের গ্রুপ, কোনও বোন নেই। আমি বললাম, তাহলে এই মেয়েটি কে? কাকা বললেন, সেটা আমারও প্রশ্ন, এই মেয়েটি কে? আমি বললাম, ও, তার মানে আপনি এই বাচ্চা ছেলেগুলোর সবাইকে চেনেন, কিন্তু মেয়েটিকে চেনেন না? কাকা বললেন, ওই বাচ্চা ছেলেগুলো আমরা ক’ভাই। আমাদের ঢাকার বাড়িতে তোলা ছবি। ওর মধ্যে আমিও আছি, এই তো, এইটা। কিন্তু মেয়েটিকে আমরা কেউ চিনিনা, আমাদের বাড়ির, পাড়ার, আশেপাশের কেউ চেনে না।
আমি বললাম, সে কী, আপনারা কেউ চেনেননা, অথচ সে আপনাদের মধ্যে দিব্যি দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বেরিয়ে গেল আর আপনারা কেউ কিচ্ছুটি বললেননা? কাকা বললেন, আমরা যখন ছবিটা তোলাই, তখন ওখানে আমরা ক’ভাইই ছিলাম। বড়রা তফাতে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। আমাদের মধ্যে ওরকম কোনও মেয়ে থাকার কোনও সম্ভাবনা ছিলনা। আরে আমরা তো জানি আমরা কজন ছিলাম। তাছাড়া প্লেটটা ভাল করে দেখ, আরও কিছু বুঝতে পারবে।
প্লেটটার ওপর ঝুঁকে পড়ে, ভাল করে দেখলাম। অবশ্য তার দরকার ছিলনা, দূর থেকেই দিব্যি দেখা যাচ্ছিল, মেয়েটির অবয়ব স্পষ্ট হলেও, বাকিদের ছবি থেকে সামান্য হালকা, আবছা ধরণের। ছবিটা একটা বাড়ির ভেতরে তোলা। বড়লোকদের বাড়িতে যেমন বসবার ঘরের মাঝখান দিয়েই সিঁড়ি উঠে যায়, ঠিক তেমনি। ফোটোগ্রাফার নীচে দাঁড়িয়ে তুলেছেন। সিঁড়ির ওপরের তাক গুলোয় ওঁরা ক’ভাই বসে। সবাই ধুতি আর পিরেন পরা, ওঁদের ঠিক মাঝখানে এই বালিকা, বয়স আন্দাজ সাত আট বছর, মাথায় কদমছাঁট চুল, গায়ে একটা ডুরে শাড়ি, কোলে একটা বেড়াল। দ্রষ্টব্য জিনিষটা হচ্ছে এই, যে দেখে মনে হচ্ছে, তাকে মাঝখানে দাঁড়ানোর জায়গা করে দেয়া হয়েছে। কোনও রকমেই তার সামান্য আবছা চেহারাটা অন্য কারোর ওপর ওভারল্যাপ করছেনা। মেয়েটি বাকিদের মতই ক্যামেরার লেন্সের দিকে তাকিয়ে ‘পোজ’ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, তাহলে মেয়েটি আপনাদের পরিচিত নয়। আচ্ছা ডাব্ল এক্সপোজার হতে পারে কি? কাকা বললেন, প্রথমে তো সবারই তাই মনে হয়েছিল। তোমাদের এখনকার ক্যামেরায় তো শুনেছি রিওয়াইন্ড করে ফিল্ম না এগোলে শাটারই পড়েনা। তা বড় ফরম্যাটে বোধহয় – আমি বললাম, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, বড় ফরম্যাটে ফিল্ম না ঘুরিয়েও একের ঘাড়ে আর এক ছবি তোলা যেত। আমার নিজের অন্নপ্রাশনের ছবি আমার সেজকাকার পোট্রেটের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। কিন্তু কাঁচের প্লেটেও কি –
কাকা বললেন। কাঁচের প্লেট তো ছবি তুলেই গিয়ে প্রোসেস করা হয়, ক্যামেরার ভেতর প্লেট থেকে যাওয়ার সুযোগ কম, তবে টেক্নিকালি অসম্ভব নয়। কিন্তু ফোটোগ্রাফার তো বলছেন তিনি নিজেও এই মেয়েকে জন্মে দেখেননি। কথার কথায় ধরে নিচ্ছি, তিনি নিজেই ইচ্ছে করে এই দুষ্কম্মোটি করলেন, কিন্তু তাতে লাভ? মাঝখান থেকে তো এই ছবিটার পয়সাও পেলেননা।
এর পরের কথাটা শোনো। ধরে নিচ্ছি, সেকথাও মিথ্যে। উনি একটা চমক বা ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলেন। ভয় অবশ্য আমাদের বাড়ির কেউই পায়নি। আসল কথাটা কিন্তু কেউ ভাবছিনা। ছবিটা সিঁড়ির মাথায় তোলা। তাহলে, দুবার এক্সপোজার নিতে গেলে, আগের থেকে মেয়েটাকে ওই রকম একটা উঁচু জায়গায় দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে প্লেট ভেতরেই রেখে দিতে হয়। সেই উঁচু জায়গা একেবারে মাপে মাপে আমাদের বাড়ির সিঁড়ির ওপরের ধাপটার সঙ্গে মিলে গেছে বলছ? আর আমদের কোনও ভাইয়ের অবস্থান তার সঙ্গে ক্ল্যাশ করলনা, ওভারল্যাপও হলনা? তাছাড়া মেয়েটা কি শুন্যে ভাসছিল? তার আসেপাশের কোনও জিনিষের ছাপই তো নেই। বাপু, আমাদের ছোটবেলায় লোকজন বড় কম ছিল পৃথিবীতে। আমরা তো আমাদের এলাকার প্রায় সবাইকেই চিনতাম। ঢাকা শহরের যত লোককে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, কেউ তো ছবি দেখে মেয়েটাকে চিনতেই পারেনি।
আমি বললাম, তবে? কাকা বললেন, আমাদের বুদ্ধিতে তো কুলোয়নি। তাই তো এত বছর বয়ে বেড়াচ্ছি জিনিষটাকে। কেউ যদি
কোনও এক্সপ্ল্যানেশন দিতে পারে। বাড়িতে যে আসে, তাকেই জিজ্ঞেস করি, বলতে পার, এমন কী করে হয়?
পাগল
সত্তরের দশকের গোড়ায় কোলকাতায় দুটো নতুন জিনিষ আমদানি হল। প্রথমটা কনজাংটিভাইটিস, যেটা পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি যুদ্ধের সমকালীন বলে নাম দেয়া হল জয় বাংলা আর দ্বিতীয়টি পাওয়ার কাট, যাকে সঙ্গত বা অশুদ্ধভাবে বলা হত, লোডশেডিং। সেই লোডশেডিংএর সময়ে একদিন অন্ধকারে দেখলাম দুটো জ্বলজ্বলে চোখ।
চাকরি জীবনের একদম প্রথম দিকে যেখানে ছিলাম সেটা নিউ আলিপুর অঞ্চলের একটা বাড়ি। বিখ্যাতা গায়িকা অল্কা ইয়াগ্নিক তখন ইস্কুলে পড়ে, থাকত আমাদের ওপরতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে, কিরে এবার কোন ক্লাস হল? এবার সরস্বতী পূজোয় আমাদের অফিসে গাইছিস তো? এই সব এখন অবিশ্বাস্য কথাবার্তা হত। বাড়িটায় ঢুকতে হত একটা গ্যারেজের মধ্যে দিয়ে। কোলকাতায় লোডশেডিং নিয়মিতভাবে শুরু হওয়ায় সব অফিস দপ্তরে জেনারেটরের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কিন্তু কেউ তো জানতনা এমনটি হবে, তাই এখন যেমন জেনারেটর বসানোর এবং ধোঁয়া নির্গমনের পরিকাঠামো তৈরী হয়েই থাকে, তখন তা ছিলনা। আমাদের অফিসের জেনারেটর বসল সেই গ্যারাজে।
সেখানেও গোলমাল। জেনারেটর জিনিষটা তখন নতুন। কতখানি ক্ষমতাবান হলে সে কতক্ষণ নিষ্প্রদীপের মোকাবিলায় সক্ষম, তা জানা ছিলনা বলে, কিছুক্ষণ চালানোর পর, গরম হয়ে যাচ্ছে, এই অজুহাতে, বা ন্যায্য কারণেই সেটি বন্ধ করে দেয়া হত। সেদিন সেইভাবে বন্ধ করার পর, ঘুটঘুটে অন্ধকার, রাতও প্রায় ন’টা। কাজ করা সম্ভব নয়, তাই ভাবলাম রাস্তায় বেরিয়ে একটু হাওয়া খাই। গ্যারাজের ভেতর দিতেই বেরোতে হবে। বেরিয়ে যাচ্ছিলামও। কেন হঠাৎ পেছনে তাকালাম, সে যুক্তি আমি দিতে পারবনা, তবে তাকিয়ে দেখলাম অন্ধকারে দুটো চোখ জ্বলছে।
যে সব জন্তু অন্ধকারে শিকার ধরে অথবা নিজেরাই শিকার হয়, তাদের অন্ধকারে চোখ জ্বলে। বাঘ, বেড়াল, এদের যেমন জ্বলে, গরু, হরিণ, এদেরও জ্বলে, মানে আমি জ্বলতে দেখেছি। অন্ধকার আসলে পুরোপুরি সাধারণতঃ হয়না, খুব অল্প আলো, যাতে আমরা মানুষরা দেখতে অসমর্থ, তাকেই আমরা অন্ধকার বলি। সেই অন্ধকারেই কিছু প্রাণীর চোখ জ্বলে। এই প্রাণীটা বেড়াল টেড়াল নয়, উচ্চতা কিছু বেশি। বাঘও নয় সম্ভবতঃ, নিউ আলিপুরে আঠারশ একাত্তরে বাঘ ছিল হয়তো, উনিশশো একাত্তরে নেই। তবে কী ওটা?
ফিরে গেলাম অফিসে। বাহাদুরদের কাছে পাঁচ সেলের মস্তবড় টর্চ থাকে, একটা চেয়ে নিয়ে এলাম। জ্বেলে দেখলাম, এ জন্তুটা মানুষের মত দেখতে। গায়ে কোনও জামাকাপড় নেই, উবু হয়ে বসা, চামড়ার ওপর আধ ইঞ্চি পুরু মাটি জমে আছে। লিঙ্গ অনুসারে পুরুষ, বয়স সতের আঠার কিন্তু সে যা করছে, তা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। জেনারেটর চলাকালীন পোড়া লুব্রিক্যান্ট, যাকে আমরা অনেক সময় ‘মবিল’ বলি, চুঁইয়ে চুঁইয়ে মাটিতে পড়েছে। ও সেই কালো চটচটে পোড়া তেল পরম যত্নে হাতে তুলে চেটে চেটে খাচ্ছে। মানুষের চোখ অন্ধকারে জ্বলার কথা নয়, কেন জ্বলছিল, তা আমার বোধবুদ্ধির বাইরে।
পাগল কতরকমের হয় তার কোনও ইয়ত্তা নেই। আমরা সবাই বোধহয় কিছু পরিমানে পাগল। একদিন ব্রাউনিংএর ‘পরফিরিয়াস লাভার’ পড়াতে গিয়ে জে এন সি বলেছিলেন, যে লোকটা একটা দারুন সুন্দর মুহূর্তকে চিরস্থায়ী করার ইচ্ছেয়, বান্ধবীকে গলায় তার নিজেরই লম্বা বেণীর ফাঁস দিয়ে হত্যা করল, সে কি পাগল? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার, লোকটা তো আর সত্যি হত্যা করেনি, আইডিয়াটা তো ব্রাউনিংএর। আমার তো মনে হয় তিনি নিজেই খুব একটা সুস্থ ছিলেননা। পাশ থেকে অক্ষয় বোধহয় কানে কানে বলল, শালা কবিগুলো মোটামুটি সবকটাই পাগল।
পাগল ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়। এক প্রবীন সহকর্মীর মুখে একটা মজার কথা শুনতাম, বদ্ধ পাগল আর অদ্ধ(অর্ধ)পাগল। বদ্ধ পাগল বোধকরি সেই সব লোকজন, যাদের বেঁধে রাখতে হয়। কিন্তু অদ্ধ পাগল কারা? যারা খানিক পাগল, খানিক স্বাভাবিক। এমন লোকও আছে, যে কিছুদিন স্বাভাবিক থাকে, আবার কিছুদিন অস্বাভাবিক আচরণ করে। এই পাগলদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের বাড়িতেই থাকেন, অনেক সময় ধ্বংসাত্মক আচরণ করেন, লোককে আঁচড়ে কামড়ে দেন। তখন হয়তো তাঁদের বেঁধে রাখতে হয়, পায়ে শেকল পরাতে হয়। এদিকে আলগা সমবেদনা জানানোর লোকের অভাব পড়েনা। তাঁরা বাড়ির লোকদের খবরের কাগজে চিঠি লিখে সমলোচনা করেন, পায়ে বেড়ি পড়িয়ে রাখার তীব্র নিন্দা করেন। কিন্তু আমার তো মনে হয়, বাড়ির লোকেদের হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা করানোর সামর্থ নেই, তা সত্বেও তাঁরা এই পাগলের সব অত্যাচার দীর্ঘদিন সহ্য করেন, তাকে চান করিয়ে খাইয়ে দেন, তবু বাড়ির বৃদ্ধ, শিশু ও মহিলাদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচাতে তাকে বেড়ি পরাতে বাধ্য হন, সমবেদনা আসলে তাঁদের পাওয়া উচিত।
আমার এক সহকর্মী এবং অনেক পরে বৈবাহিক সূত্রে কুটুম, কোলকাতার কিছু দূরে এক আধা শহরে থাকতেন। তাঁর স্ত্রীর মস্তিষ্কে এই রোগ বাসা বেঁধেছিল। তিনি বেশ কিছুদিন স্বাভাবিক থাকতেন, কিন্তু মাঝে মাঝে উদ্দন্ড আক্রমনাত্মক হয়ে যেতেন, তখন তাঁকে সামলানো দায়। একদিন অনেক রাতে আমার দরজায় খট খট। খুলে দেখি সেই সহকর্মী। উদভ্রান্ত চেহারা দেখেই বুঝলাম, রাতে বাড়ি যাননি এবং কথাবার্তায় সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি প্রকাশ পাচ্ছে। মাকে ঘুম থেকে তুলে লুচি তরকারি বানিয়ে প্রথমে পেট ঠান্ডা করালাম। এতে মাথাও খানিক ঠান্ডা হয়। তারপর সারা রাত বোঝালাম যে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আছে। আপনি ভাল ডাক্তারের খোঁজ পাননি, আচ্ছা এবার আমি খুঁজছি। খুঁজে পাওয়াও গেল। সেরে যাওয়ার পর সেই ভদ্রমহিলার এত ভাল ব্যবহার, যে মনে হত অবাস্তব, শরৎচন্দ্রের তৈরী চরিত্র।
আমি বেশ কিছুদিন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে চাকরি করেছি, এবং একটা বিশেষ এলাকার আসে পাশে বারংবার আমার বদলি হত। জায়গাটি সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিসার্ভ যেখানে শুরু হচ্ছে, তার খুব কাছে। ওখানে প্রায়ই বিচিত্র ধরণের পাগল দেখা যেত, তাদের কথা বার্তাও অনেক সময় স্থানীয় লোকেরা বুঝতনা। গ্রাম বাংলার একটু গভীরে, টি ভি ভাল করে চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত, হিন্দীই বুঝতনা লোকে ভালমতো। তা এঁরা কেউ মারাঠি বলছেন, কেউ বিহারের কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভাষা বলছেন, বোঝে কার সাধ্য। তবু গ্রামের লোকেরা এঁদের খাওয়া দাওয়া, শীতবস্ত্র, এসবের ভার নিত পালা করে। জায়গাটা ছিল অত্যন্ত মানবদরদী।
এই উন্মাদ বা বলা উচিত অর্ধউন্মাদরা আসত কোথা থেকে? বড় করুণ সেই কাহিনী। প্রতি বছর গঙ্গাসাগর মেলার সময়ে এই ধরণের কিছু আধা পাগল পুরুষ বা মহিলাকে বাড়ির লোকেরা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেত। তাদের মধ্যে যাঁরা অন্ততঃ নিজের ঠিকানা না হোক গ্রামের নাম বা শহরেরর কোনও অঞ্চলের কথা বলতে পারতেন, পুলিস তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিত। কিন্তু হতভাগ্যরা অনেকেই তা পারতেননা। এই গ্রামে তাঁরা আত্মীয় খুঁজে পেতেন।
আমার অফিসের ওপরেই কোয়ার্টার ছিল। একটা গাছ গাছালি ঘেরা সুন্দর প্রশস্ত খোলা ছাদও ছিল। একদিন টিপটিপ করে বৃষ্টির মধ্যে সকালে দাঁত মাজতে মাজতে প্যারাপিটের ধারে গিয়ে দেখি নীচে শাল গাছের জঙ্গলের মধ্যে একটা পাথরের ওপর একজন বৌ গোছের মহিলা ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। জায়গাটা নির্জন, আমি চেঁচিয়ে বললাম, এই যে, শুনছেন, ওখানে বসে বসে ভিজছেন কেন? বাড়ি চলে যান। তিনি শুনতে পেলেন বলে মনে হলনা।
আটটা নাগাদ আমার এক অনুচর আসত, ভালমন্দ খবরাখবর নিয়ে যেত। তাকে বললাম, নীচে গিয়ে জঙ্গলে দেখতো, ওই মহিলা কে, কেনই বা বসে আছেন? সে ফিরে এসে বলল, কী বলছে, কিছুই বুঝলামনা। এতো মহা বিপদ। কিছুক্ষণ পরে একজন মেদিনীপুরের লোক তাঁর ভাষা উদ্ধার করে জানাল, ইনি উড়িষ্যার বাসিন্দা এবং সেই গঙ্গাসাগর কেস। সে-ই বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা সরকারি অফিসের বারান্দায় তাঁর ঠাঁই করে দিল তখনকার মতো।
তারপর থেকে সেই মহিলা সেই গ্রামেরই বিভিন্ন বাড়ির বারান্দায় রাত কাটাতেন এবং খাওয়াদাওয়া করতেন। শাড়ি, জামা, শীতের কম্বল সব জুটে যেত এবং যে বাড়িতে যেদিন খেতেন, জোর করে তাদের বাসন মেজে বা কাপড় চোপড় কেচে দিতেন, বারণ করলে শুনতেন না। বারান্দায় রাত কাটান শুনে আমি ভয়ে ভয়ে আমার চেলাটিকে বললাম, সে কী রে, যদি কেউ রেপ টেপ করে দেয়? সে বলল, এটাই তো এখানকার মজা। এই গেরামের দু কিলোমিটার বাইরে যান, ডাকাতি হচ্ছে, মেয়েছেলে তুলে নে যাচ্ছে, এখেনে রাত একটার সময়ে যুবুতি মেইয়ে এক গা সোনার গয়না পরে ঘুরে আসে, কিচ্ছু হয়নে। সেই গ্রামটা এখন কেমন, তা অবশ্য জানিনা।
এই গ্রামের কিছু দূরে কাকদ্বীপ এবং সে জায়গা গঙ্গাসাগর থেকে আরও কাছে। সাগরতীর্থে ছেড়ে যাওয়া পাগলরা কাকদ্বীপেও আস্তানা গাড়তনা তা নয়। তবে সে জায়গায় পাগলরা অত যত্ন আত্তি পেতনা। অনেকে বড় রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মরত, শীতে কুঁকড়ে কোনও বন্ধ দোকানের সামনে মরে পড়ে থাকত কেউ। এক হিন্দীভাষী পাগল একটা হোটেলের সামনে এসে ভাত চাইত। সে হোটেলে চাকরি বা ব্যবসার কাজে আসা লোকেরা ভাত খেতে আসত। দুপুরের খাওয়া শেষে যা থাকত, তা ফেলে দেয়ার বদলে তাকে দেয়া হত।
একদিন একটু আগে এসে পড়েছে। তখন জোর কদমে খদ্দের সেবা চলছে। ভরা বাজারে একদম ঢোকার মুখে, ওই রকম দুর্গন্ধওয়ালা নোংরা ছেঁড়া কাপড় পরা আরও নোংরা চেহারার পাগল দাঁড়িয়ে থাকলে খদ্দের ভেগে যাবে। তাকে যেতে বললেও যাচ্ছেনা, রোজকার মত দুহাত জড়ো করে আঁজলা পেতে দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলের রাঁধুনি রেগেমেগে ভাতের হাঁড়ি থেকে ফুটন্ত ভাত একটা বিরাট বড় হাতায় তুলে এনে সেই আঁজলা করা হাতে ঢেলে দিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা শিউরে উঠল, একী, এতো পুড়ে মারা যাবে। সে পাগল কিন্তু পরম তৃপ্তিভরে সেই ফুটন্ত ভাত চেটেপুটে খেয়ে চলে গেল। কে বলল মিরাক্ল হয় না? রোজ হয়, আমাদের আসে পাশেই।
এইখানে একটু প্রসঙ্গ পাল্টাতে হবে। কিছু আগে ‘ই এস পি’ সম্বন্ধীয় লেখাটায় একটা কথা বলা হয়নি, আমি লিখতে বসে যখন কিছু খুঁজি, কে যেন মালমশলার যোগান দিয়ে যায়। বহুবার এমন ঘটেছে। সব উদাহরণ এক জায়গায় না দিয়ে, সেই সেই প্রসঙ্গ আসলে বলা যাবে। এবার পাগল নিয়ে লিখতে বসে, আমি খুঁজছিলাম পুরোন সংবাদপত্রে ছাপা কিছু প্রতিবেদন যেখানে, কিছু ব্যক্তি সম্বন্ধে বলা আছে, তাঁরা খুবই নিম্ন আয়ের লোক হওয়া সত্বেও রাস্তা থেকে পাগল ধরে এনে, পরম যত্নে তাঁদের চান করানো খাওয়ানো, চুল কেটে দেয়া ইত্যাদি সেবা করেন। তাঁদের বাড়ির লোকেরাও হাসিমুখে, কোনও আপত্তি না করে তাঁদের সঙ্গ দেন।
পাভলভে বা লুম্বিনীতে পাগল ভাল হয় কিনা, বা কীভাবে হয় জানিনা, তবে এঁদের হাতে শুধু আদর যত্ন পেয়ে বহু পাগল ভাল হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। আমার কাছে সেই খবরগুলোর কাটিং আছে, কিন্তু প্রচন্ড ডিসরগানাইজড লোক বলে আমি কখনওই সময়মতো রেফারেন্সের কাটিং খুঁজে পাইনা। যে যোগান দেয়, সে বলল, দরকার নেই, আবার দিচ্ছি। আজ ১৬/০৭/২০১২ তারিখের টেলিগ্রাফে মোসলেম মুন্সী নামে বেথুয়াডহরির এমনি এক মসিহার ছবিসহ মস্ত প্রতিবেদন। কাল খুঁজছিলাম, আজ হাতে গরম।
এই সব আনসাং ফাদার টিরিজাদের মূর্তি বসেনা পার্ক স্ট্রীটে। জনাব মোসলেম তাও শেষমেশ তাপস পালের এমপিল্যাডের দশলক্ষ টাকা পেয়েছেন, অন্য যাঁদের কথা পড়েছি, তাঁরা তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি হিসেবে যা মাইনে পান, তাতে ছেলেমেয়েদের পূজোর কাপড় হোক না হোক এই অভাগাদের আব্রু জোটে।
ভগবান বলে সাদা দাড়ি আর লম্বা আলখাল্লা পরা কেউ বসে নেই মেঘের ওপারে তা আমি মোটামুটি জেনে গেছি। তবে যে আছে তার নাম ‘কেহনয়’।
কবিতাটা শুদ্ধ করে নিতে হবে –
কেহনয় তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে...দয়াহীন সংসারে...
নাঃ, ডারউইনের লেজখসা ক্রোম্যাগননগুলো মোসলেম মুন্সী হয়নি বোধহয়।
যাক আবার লেখায় ফিরে আসি। আমাদের খাস দক্ষিণ কোলকাতায় রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে একসময়ে প্রচুর পাগল দেখা যেত। কারণটা পরিষ্কার নয়। কাছাকাছি তীর্থক্ষেত্র আছে বটে, সেটা কালীঘাট। তবে এই পাগলরা বেশির ভাগই বাঙালি। কেউ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে বলে মনে তো হতনা। এক পাঞ্জাবী মহিলাও ছিলেন অবশ্য। তবে তিনি যত না পাগল, ভান ছিল তার বেশি। পাঁচজনে পাঁচ কথা বলত। তা বলুক, তবে তিনি পথচারিদের বিরক্ত খুব একটা করতেননা।
আমাকে অফিস ফেরতা বাস বদল করতে ওখানে নামতেই হত। তখন পাতাল রেল টেল হয়নি, ফুটপাথ বিশাল চওড়া, রাস্তার মাঝখানে ট্রাম যাবার জন্য ঘাসে ঢাকা বূলভার্ড আর মোড়টা ঘুরেই ডান হাতে বেশ বড় একটা বাটার শো রুম ছিল। যত পাগলের আস্তানা ঐ শো রুমের আসে পাশে। একদিন ওই খানে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি, একজন মহিলাকে আমার দিকেই আসতে দেখলাম। তাঁর অযত্নের খোলা চুল পিঠের ওপর এলানো। উল্লেখ করা যেতে পারে, সে সময়ে সাধারণতঃ বাঙালি অবাঙালি কোনও মেয়েই সন্ধের পর খোলা চুলে রাস্তায় বেরোত না। সুতরাং দৃশ্যটি অচেনা। তার ওপর তাঁর স্খলিত আঁচল বহুদূর পর্যন্ত বৃটিশ রাণীর রোবের মত মাটিতে লুটিয়ে আসছে।
আমার একটু গোলমেলে লাগেনি তা নয়। শাড়িটা কিঞ্চিৎ বেসামাল হলেও পরা মোটামুটি ঠিকই আছে। তবে আঁচলটা অতদূরে লুটায় কি করে? যাই হোক, হাতে তাঁর একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। কোনও বাসি ফুলশয্যার জঞ্জাল হিসেবে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়া কিংবা কেওড়াতলা গামী মৃতের খাট থেকে খসে পড়া। মুখটা দেখলাম নজর করে। একেবারে এলেবেলে ঘরের বৌ বা মেয়ে নন। ইরিউডাইট লোকেদের মুখে একটা ছাপ থেকে যায়, এনার আছে।
আসছেন আমার দিকেই। বললেন, কিছু যদি মনে না করেন, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? আমি বললাম, ইয়ে, মানে – উনি বললেন, আচ্ছা বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ না নজরুল, কে বড় কবি? যাব্বাবা, এই গুগলিটা আশা করিনি। বললাম, ইয়ে, মানে, - উনি বললেন, যদি বলেন, রবীন্দ্রনাথ, তাহলে বলব, নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা কোথায় তাঁর কবিতায়? আর যদি বলেন নজরুল, আমি বলব, সীমার মাঝে অসীম তুমি, এই চেতনা আছে কি তাঁর কবিতায়? ভাবলাম বলি, আইতেও শাল, যাইতেও শাল, ম্যাডাম কি বরিশাল? কিন্তু মুখ দিয়ে বেরোল, ইয়ে, মানে –
এইবার উনি বললেন, জানি এক কথায় এর উত্তর হয় না। চলুননা, ওই কাফেটেরিয়ায় কফি খেতে খেতে আলোচনাটা বজায় রাখি। ওরে বাবা, এবার তো বাউন্সার। আড়চোখে দেখলাম একটা দোতলা টুবি আসছে। একটা পাঁচ টাকার নোট হাতে গুঁজে দিয়ে বাসের পাদানিতে লাফিয়ে উঠে বললাম, কফিটা আজ একাই খেয়ে নিন ম্যাডাম। আর এক দিন হবেখন। সে সময়ে এক কাপ কফির দাম ছিল আট আনা। ভয়ে দশ বারো দিন কালিঘাট থেকে বাসে উঠেছি, রাসবিহারীর দিকে আসিইনি।
বেশ কিছুদিন পরের কথা, পূজোর কয়েকদিন পর, সেই রাসবিহারীর মোড়। তখন চেতলার দিকে যাওয়া যেতনা সোজাসুজি, ব্রীজটা হয়নি। তাই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়টাকে, চার রাস্তা নয়, তিন রাস্তার মোড় বলেই ধরা হত। বালীগঞ্জগামী বহু লোক ঐ রাস্তার মাঝে তিনকোনা যায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকত। কেননা ট্রাম টালিগঞ্জ বা কালীঘাট, যেদিক থেকেই আসুক, দৌড়ে ওঠা যাবে। আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মোটামুটি রাত হয়েছে। এক ভদ্রলোক এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন।
ভদ্রলোক মানে, ভদ্রলোকই, পাট ভাঙা জামা প্যান্ট, গুছিয়ে আঁচড়ানো চুল, শুধু জামার বুক পকেটে একটা মস্ত বড় ধূপের প্যাকেট। হয়তো বাড়িতে পূজো টুজোর জন্য কিনেছেন। ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কটা বাজে বলতে পারেন? হাতে ঘড়ি ছিল, দেখে বললাম, নটা। ভদ্রলোক বললেন, তার মানে, সময় এখন ন’টা। তিন রাস্তার মোড়ে কটা আলো জ্বলছে বলুনতো? ন’টা। যে বাসটা আসছে, তার নম্বর কত বলুন তো? এল নাইন। কিছু বুঝলেন?
আমি ভাবলাম, উনি বোধহয় জ্যোতিষী গোছের কিছু, নিউমারোলজি নিয়ে কিছু বলছেন। বললাম, আপনি জ্যোতিষ টোতিষ করেন নাকি? উনি কালীঘাটের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ঐ, ঐ, কে পালাচ্ছে বলুন? ওর নাম সুধীর নায়েক। মোজা চুরি করে পালাচ্ছে। ধরুন ধরুন। ততক্ষণে মোটামুটি আইডিয়া পেয়ে গেছি ব্যাপারটার। বললাম, না না, সুধীর নায়েক আসলে চুরি করেননি। বিলেতে যে ভাবে ট্রলিতে জিনিষ নিয়ে এসে বিলিং হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে থাকা ভারতবর্ষের লোক তা জানবে কেমন করে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বিলেতে চোরের সংখ্যা আমদের দেশের চেয়ে বেশি।
ওনার কোনও প্রতিক্রিয়া হল বলে মনে হলনা। কেননা এর পর উনি বললেন, বজবজ লাইনের ট্রেনে চড়েছেন কোনওদিন? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমার অফিস তো ঐদিকেই। উনি বললেন, রেললাইনের পাশে নয়ানজুলিতে দুটো ছায়া পাশাপাশি, পূর্ণিমার চাঁদ আর রিচার্ড নিক্সন। এর পর উনি আর কি কি বলেছিলেন, অত মনে নেই। পকেটের ধূপকাঠির বাক্স নিয়েও কি একটা বললেন। তবে যা যা বললেন, আমি ধৈর্য ধরে সব শুনেছি, আর প্রত্যেকটা কথার ভালমন্দ কিছু একটা উত্তর দিয়েছি। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর তিনি বললেন, আচ্ছা, আপনি বুঝতে পেরেছেন? আমি বললাম, কি বলুনতো? উনি বললেন, আমি যে পাগল? আমি বললাম, এটা আর না বোঝার কি আছে। উনি বললেন, তার পরও আপনি আমার সব কথা শুনলেন? উত্তর দিলেন? আমি বললাম, আরে মশাই আমরা ইতরবিশেষ সবাই পাগল। কেউ বেশি, কেউ কম। তাতে কী হয়েছে। উনি বললেন, সত্যি? আমি বললাম, হ্যাঁ সত্যি। বিশ্বাস করুন।
আলাপ আরও গভীর হল, ভদ্রলোকের নামও জানলাম, অজয় সেন। না বদলানো নাম নয়, এক্কেবারে আসল নাম। তখন উনি নরমাল কথা বলছেন। রেলে চাকরি করতেন বললেন। ডাঃ পঞ্চানন ঘোষালের কাছে ট্রীটমেন্ট হচ্ছে, তাও বললেন। আমি বিয়ে করেছি কিনা জিজ্ঞেস করে আমার একটা সম্বন্ধও পাকা করে ফেললেন প্রায়। পাত্রী ওঁর বাড়ির পাশেই থাকেন। তবে আমার ঠিকানা ওঁকে যে দিইনি, তা আর খেয়াল করেননি।
বছর খানেক পর। সেই রাসবিহারী, সেই বাটার দোকান। তার সামনে জুতোপালিশওয়ালারা বসে। সেই খানে এক পা তুলে পালিশ করাচ্ছেন। বললাম, মিস্টার সেন কেমন আছেন? উনি অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে কি আমি চিনি? বললাম, বাঃ বছর খানেক আগে ঐ মোড়ে দাঁড়িয়ে অত গপ্পো করলাম – উনি বললেন, ওঃ সে কথা কী করে মনে থাকবে, তখন তো পাগল ছিলাম। আমি বললাম, এখন তাহলে পুরোপুরি সুস্থ? বাঃ। উনি বললেন, হ্যাঁ ডক্টর ঘোষাল ফিট সার্টিফিকেট দিয়েছেন, আমি চাকরিতে রিইনস্টেটেড হয়েছি। আমি বললাম, হে হে, আপনি তো প্রায় আমার বিয়েই দিয়ে দিয়েছিলেন। উনি চমকে বললেন, করে ফেলেছেন নাকি? আমি বললাম, না, মানে- উনি বললেন , দেখুন তো। আর একটু হলেই কি সব্বোনাশ করে ফেলছিলাম আপনার। মশাই, পাগল ছাড়া কোনও সুস্থ লোক বিয়ে করে?
কেহনয়
- এইযে, মিস্টার কেহনয় – ঠক্ ঠক্ -
দরজা খুলিয়া গেল। অবশ্য দরাজ ভাবে খুলিলনা, সামান্য ফাঁক হইল মাত্র।
- হু ইজ ইট? মাস্ট বি দা রেচেড পার্সন ফ্রম দা রেচেড প্ল্যানেট।
- হ্যাঁ স্যার, আমি। তবে স্যার আপনি তো আর কেউ না, তাই আপনাকে আর ভয় পাইনা।
- অ্যাজ ইফ ইয়ু ওয়্যার ভেরি মাচ অ্যাফ্রেড অফ মি অল দা হোয়াইল- নাউ, হোয়ট ব্রিংস ইউ হিয়ার?
- স্যার, মোসলেম মুন্সীর সৃষ্টির পেছনে কি আপনার হাত আছে স্যার?
- বাট আই ওয়ান্ডার, হু’জ বিহাইন্ড ক্রিয়েশন অফ সাচ আ বিগ ফূল লাইক ইয়ু – মাই হ্যান্ড? ডু ইউ সী এনি হ্যান্ড হিয়ার?
- আঃ স্যার ওটা ফিগারেটিভ ইয়ে, মানে হাত বলতে আপনার অবদান আছে কিনা।
- নেক্সট ইউ উইল আস্ক মি হোয়েদার আই অ্যাম বিহাইন্ড দা ক্রিয়েশন অফ ম্যানকাইন্ড, দা প্ল্যানেট আর্থ, অল দা আদার প্ল্যানেটস অ্যান্ড দা স্টারস, দা ইউনিভার্স –
- ঠিকই তো স্যার, এই যে মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন, জিলিয়ন গ্রহ সমষ্টি, তার মধ্যে শুধু একটায় মানুষ। কী ব্যাপার কী, আপনার কাজ এটা?
- ওকে, টেল মি হাউ মেনি আইল্যান্ডস আর দেয়ার অন আর্থ?
- কত আর, শ’খানেক হবে ।
- লিস্ন মিস্টার ইউ এফ ও –
- স্যা- স্যার আমি ইউ এফ ও? বলেন কী?
- ইয়েস, আটারলি ফুলিশ অ্যান্ড অবনক্সাস। লিস্ন টু মি। দেয়ার আর নিয়ারলি টু মিলিয়ন আইল্যান্ডস অন ইয়র প্ল্যানেট। আউট অফ দেম, নিয়ারলি টু ফরটি আর ইনহ্যাবিটেড বাই হিউম্যান্স।
- তাতে কী হল স্যার?
- ইউ ওয়্যার আস্কিং মি হোয়াই অ্যামং সো মেনি প্ল্যানেটস ওনলি আর্থ ইজ ইনহ্যাবিটেড। নাউ টেল মি হোয়াই অ্যামং টু মিলিয়ন আইল্যান্ডস, ওনলি গ্যালাপ্যাগোস হ্যাজ ইগুয়ানাস?
- আরে স্যার, সেটাই তো প্রমাণ করল ডারউইনের ইভোলিউশন থিয়োরি। বিভিন্ন জায়গায় প্রাণের বিবর্তন আলাদা ভাবে হয়েছে। সবই অ্যাক্সিডেন্ট স্যার, কারো অবদান টবদান নয়।
- অ্যাবসলিউটলি রাইট। দেয়ার এন্ডস দা ম্যাটার। নাউ গেট লস্ট, লেট মি কনসেন্ট্রেট।
- কেন স্যার, কিছু লিখছিলেন টিখছিলেন?
- অ্যাট প্রেজেন্ট, আই অ্যাম বিজি অ্যারেঞ্জিং অ্যাক্সিডেন্টস।
- অ্যাঁ !!!
‘দড়াম’ শব্দে দরজা বন্ধ হইয়া গেল।
(চলবে)