হরিৎ মরু
এরকম মওকা পেলে কারো ছাড়ার কথা নয়, তা সে যতই আফিমে বুঁদ হয়ে থাকুক না কেন। ধাঁ করে ঘরে ঢুকেই বলল, এ আবার হয় নাকি, মরু কি করে হরিৎ হবে? আমি বললাম, কেন হবেনা? বেশিরভাগ শব্দের, আমরা যে মানেটা জানি, অর্থাৎ প্রচলিত অর্থ ছাড়াও অন্য অর্থ আছে। তোমার মতো পন্ডিতের মুখে এ কথা শোভা পায় না। হরিৎ মানে সবুজ, তাই তো? এই শব্দের আর একটা মানে 'সিংহ', তা জানতো? আর 'মরু' শব্দের আর একটা মানে, পাহাড়, তাও নিশয়ই জান?
খুড়ো বলল, মরু? ওটা মেরু না? আমি বললাম, না স্যার, মেরু হচ্ছে পার্টিকুলার পাহাড়, সুমেরু পর্বত বা হিমালয়। মরু ইজ ইকোয়াল টু যে কোনও পাহাড়। তাহলে হরিৎমরু না বলে মরুহরিৎ বললে কী দাঁড়াচ্ছে খুড়ো? চক্কোত্তিমশাই বললেন, মাউন্টেন লায়ন। কিন্তু সে তো আমেরিকান, আমাদের দেশে তো পাওয়া যায় না? আমি বললাম, না না, আমি মশকরা করছিলাম। এখানে হরিৎ মানে সবুজই আর মরু মানে মরুভূমি। সবুজ মরুভূমি, ইংরিজীতে বলে গ্রীন ডেজার্ট।
এ ডে উইল কাম, হোয়েন দি আর্থ উইল হ্যাভ নো মোর ট্রীস। সে দিন আগতপ্রায়, যখন পৃথিবীর বুকে গাছ বলিয়া আর কিছু থাকিবে না। ফল স্বরূপ গাছকে আশ্রয় করে যে সব প্রাণী বেঁচে থাকে, তারাও থাকবে না। শুধু মানুষ থাকবে। অন্ততঃ তারা তাই ভেবে তাধিন তাধিন নাচছে। হা হা, কি আনন্দ। যাক, চারিদিকে তাই গাছ বাঁচানোর হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে।
মন্ত্রীরা ধুতি গুটিয়ে, শাড়ির বেলা একটু কম, প্লাসটিকের মোড়কে গাছের চারা স্ট্র্যাটেজিকালি ধরে উবু হয়ে পোজ দিচ্ছেন, বিভিন্ন সাইজের মুভি এবং স্টিল ক্যামেরা তাক করা। স্টিলগুলো চিড়িক্ চিড়িক্ করে ফ্ল্যাশ মারছে। পেছনে ঝাঁঝরি হাতে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর ধারণা, তিনিই এক নম্বর। সে ধারণা ভুল প্রমাণ করতে অ্যাহেন ওয়াক্তে, মানে, সঠিক মুহূর্তে, একজন ঝাঁঝরিটা কেড়ে নিলেন। মন্ত্রীর ফুরফুরে পাঞ্জাবী অনেকটা ভিজে গেল। তবুও তিনি ক্ষমাসুন্দর হাসি দিলেন ক্যামেরা লক্ষ্য করে। কিন্তু ঝাঁঝরিওয়ালা ব্যক্তি সাপলুডো বেয়ে অনেকটা নেমে গেল। আবার পোস্টার মারা থেকে শুরু - রেডি সেডি গো ।
সে গাছগুলো কিন্তু ভগবান যে কদিন জল দিলেন, সে কদিন বাঁচল। মানে, বড়জোর মাস দুই। আবার পরের বছর সিক্সথ জুন। ইতোমধ্যে দুজন ফোটোগ্রাফার টস্কে গেছেন। নতুন যাঁরা এলেন, তাঁদের একজন একটু ছটফটে। খুব মৃদুস্বরে তাঁর কানের গোড়ায় কেউ বলল, ভাই, কনুই মারবেন না, বুঝতে পারছি সার্কিটে নতুন। আমি অল্পেশ গোস্বামী, নামটা বোধহয় জানা আছে। সারা জীবনের মত পুটকি জ্যাম করে দেব। ফ্ল্যাশ, ক্লিক্, ঝাঁঝরি কাড়া, পাঞ্জাবী ভেজা, সাপলুডো, ইত্যাদি। রিওয়াইন্ড অ্যান্ড রিপ্লে।
আমার মা তখনও বেঁচে ছিল। দু হাজার ছয় কি সাত হবে। একদিন ঘরে যেতে বলল, একটু দ্যাখ তো, সারাদিন খচ্মচ্ আওয়াজ করে কে? ওপর দিক থেকে আওয়াজটা আসছে। যেদিকে বলল, সেদিকে দেয়ালের একদম উঁচুতে একটা দারুণ সুন্দর ল্যাম্পশেড। নিজেই কিনে এনেছিলাম এজরা স্ট্রীট থেকে। ভেতরে একটা রঙীন চাইনিজ সিএফএল। মা সেটা জ্বালে না। একদম অন্ধকার না হলে মায়ের ঘুম হয়না।
তদন্ত কমিশন বসালাম। নিজেই চেয়ারম্যান, নিজেই মেম্বার। কমিশনের রিপোর্টে বলছে, একজোড়া বুলবুলি ঐ ল্যাম্পশেডের মধ্যে বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে। জানলা বন্ধ করে দিলাম। পুরোন বাড়িতে কাঠের শার্শি দেয়া জানলা ছিল, হাওয়া খেলত ফাঁক দিয়ে। এখন এগুলো কাঁচ ও অ্যালুমিনিয়ামের নিরেট। দম বন্ধ হয়ে হিটলারের গ্যাস চেম্বারের মত হয়ে যাচ্ছিল। ব্যাটারা তাও কী করে যেন – না, ভুল হল, ব্যাটা এবং বেটি কী করে যেন ফুরুৎ ফুরুৎ করে ঢুকে পড়ছে কোথা দিয়ে। মহা বিপদ। একটা ঝুলঝাড়ু নিয়ে তাড়া করছি, বাঁই বাঁই করে ঘোরাচ্ছি, তাও যায় না। সত্যি বিপদ তো ।
বুলবুলি খুব ধূর্ত পাখি। কাকের কাছাকাছি, ক্যামেরা তাক করে দেখেছি, সামান্য ইশারাতে পালায়। বহু দূর থেকে, ফোর হান্ড্রেড জুমেও ধরা শক্ত। সেই বুলবুলিকে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে তাড়াতে হচ্ছে, থুড়ি, তাতেও তাড়ানো যাচ্ছেনা। দিনকাল কী ডেঞ্জারাস হয়ে যাচ্ছে গ্র্যাজুয়ালি। আসলে প্রাণীদের বেঁচে থাকার মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রোক্রিয়েশন এবং প্রতি জেনারেশনে একটু করে জেনেটিক বদল এনে নির্দিষ্ট নিশানার উদ্দেশে এগিয়ে যাওয়া। প্রাণীদের বলতে, মানুষ বাদে আর প্রাণীদের। বেচারিদের প্রোক্রিয়েট করতেই হবে, কিন্তু যে গাছগুলোয় এরা বাসা বাঁধত, সেগুলো কাটা পড়েছে। এবার কী করে? আমিই বা কী করি মায়ের ঘরে খচ্মচ্ বাঁচাতে? মানুষ অসম লড়াইতে চিরকাল জিতে এসেছে, এবারও জিতল। একটা পাতলা তোয়ালে দিয়ে ল্যাম্পটাকে মুড়ে দিলাম। নে এবার ডিম পাড় কোথায় পাড়বি।
গাছ কাটা পড়লে কী হবে? পৃথিবীটা আস্তে আস্তে মরুভূমি হয়ে যাবে। তাই কি? কয়েক বছর আগে জয়সলমীর গেছি। যে হোটেলে উঠলাম, তার ম্যানেজারটি বাঙালি। আমাকে দেখেই বলল, স্যার আপনি বাঙালি? আপনাকে কাকু বলতে পারি? বললাম, সানন্দে। তা তুমি এখানে কী করছ? এই সুদূর রাজস্থানে? সে বলল, আসলে বাবা এখানে দীর্ঘদিন পোস্টেড ছিলেন। রিটায়ার করবেন। বাবার কাছেই এসেছিলাম। হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট পাশ করা শুনে অনেকেই জোরাজুরি করতে লাগল। আমিও ভাবলাম বড় কোনও জায়গায় ঢোকার আগে একটু এক্সপিরিয়েন্স বানিয়ে নিই। চলুন ছাদে চলুন। একটা মজার জিনিষ দেখাই আপনাকে।
ছাদে গিয়ে সে বলে, কী কাকু, এটা ওয়েস্ট বেঙ্গল, না রাজস্থান? আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, শুধু সবুজ আর সবুজ। ক্লোরোফিলে চোখ ভর্তি হয়ে গেল। কী ব্যাপার হে, সত্যি তো, একি ম্যাজিক নাকি? ছেলেটি হেসে বলল, আগে এখানে দশ বছরে একবার বৃষ্টি হত, এখন বছরে তিনবার হচ্ছে। পুরো চেহারাই বদলে যাচ্ছে একেবারে। জমির চরিত্রও পাল্টাচ্ছে ধীরে ধীরে।
সব শুনে খুড়ো বলল, অ, তাহলে এই হল গ্রীন ডেজার্ট? সবুজ মরুভূমি? আমি বললাম, না খুড়ো, তা হলে তো ভালই হত। গ্রীন ডেজার্ট হচ্ছে রমেশের বাগান। খুড়ো রেগে গেল, ধুত্তোর, হেঁয়ালি, হেঁয়ালি আর হেঁয়ালি। এখন বোঝো রমেশের বাগান কী বস্তু। আমি বললাম, আচ্ছা খুড়ো, গিরিশ ঘোষ মশাই তোমার ধম্মোবাপ বঙ্কিমের চেয়ে মাত্র ছ' বছরের ছোট। তা দুজনে তো মোটামুটি এক সময়েই লেখালেখি করেছেন। তুমি গিরিশ বাবুর 'প্রফুল্ল' পড়নি? নাটকটাও কোথাও দেখনি? সেই যে, বাবু অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি অভিনীত রমেশ চরিত্রের মুখে, "আ হা হা হা, আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল-" এতো মোটামুটি লেজেন্ডারি লাইন হয়ে গেছে, শোননি তুমি? গ্রীন ডেজার্ট হচ্ছে সাজানো বাগান।
খুড়ো, ওরকম হাঁ করে তাকিয়ে থেক না, বিরক্ত লাগে। সাজানো বাগান ডেজার্ট বা মরুভূমি কেন হবে, এই প্রশ্ন করবে তো? এখনকার সাজানো বাগানের কনসেপ্ট একটু অন্যরকম তো, তাই।
আজকাল একটা নতুন ট্রেন্ড হয়েছে খবর রাখো? স্টার হোটেলই হোক, বা হাউসিং কমপ্লেক্স, গ্রীনারি চাই। এটা যত না প্রয়োজনে, হুজুগে তার চেয়ে বেশি। হাউসিং প্রজেক্টগুলোর বিজ্ঞাপন কেমন শুনবে? সিক্সটি ফাইভ পারসেন্ট ওপেন এরিয়া উইথ ল্যান্ডস্কেপড গার্ডেন, লাক্সুরিয়াস বাংলোস ইন নেচারস কোর্টইয়ার্ড, ফীল নেচার আউটসাইড ইয়র ডোরস্টেপ, এইরকম। প্রোমোটারদের বিজ্ঞাপনে আজকাল পাখির ছবি থাকে। কয়েক বছর আগে ল্যান্সডাউনের মোড়ে একটা ওইরকম বিজ্ঞাপনে এমন এক বহুবর্ণ পাখির ছবি দিল, যেটা প্রথম কথা, আমাদের দেশের নয়। দ্বিতীয় কথা, প্রায় ষাট বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
খুড়ো বলল, তাহলে এই বাগান গুলোই সাজানো বাগান? আমি বললাম হ্যাঁ। এখানে ঘাসগুলো কার্পেটের মত করে ছাঁটা, গাছগুলোও ডালপালা, পাতাটাতা সমেত এমন করে ছাঁটা, যেন মনে হবে একটা বিশাল ছাতা বা অতিকায় ললিপপ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে আমের মত শেপের টলটলে নীল জলের ডোবা। আসলে জল অত নীল হয়না, ওর তলাটা নীল রঙের টালি বসানো। একটা দুটো শালুক ফুল পাতা সমেত ছেড়ে দেয়। সেগুলো অবভিয়াসলি বেশিদিন বাঁচেনা। আবার দু-একটা নিয়ে আসে। এসব সাপ্লাই দেবার লোক আছে। পাথর বিছানো পথের দুধারে চৌকো চৌকো গর্তের মধ্যে সারি দিয়ে নারকেল গাছ, সবকটা এক সাইজ, একেবারে ল্যাম্প পোস্টের মত সোজা, একটুও বাঁক নেই কোত্থাও।
কমলাকান্ত চক্রবর্তী বললেন, তা এগুলোকে মরুভূমি বলার অর্থ? আমি বললাম, খুড়ো, এই বাগানে ভয়ে কোনও পাখি আসেনা। ডোবাগুলোয় ঘোর বর্ষাতেও একটাও ব্যাং পাবেনা। কোনও ফুলে কোনও প্রজাপতি বসেনা। ঘন কংক্রীটের জঙ্গলের বিকল্প এই মরুদ্যানগুলো আসলে আর এক রকম মরুভূমি, সবুজ রঙের।
আমার বাড়ির গেটের ভেতরে একটা সুন্দর জঙ্গল তৈরী হয়েছিল। সবই আগাছা। আগাছা কথাটা আমার অশ্লীল লাগে। গাছের আগে 'আ' লাগবে কেন? আমেরিকার আবর্জনা, চিরকালের আগাছা 'ল্যানটানা' এখন ফাইভ স্টারের কেয়ারিতে শোভা বাড়াচ্ছে। দেশের আগাছাগুলোই মোয়া পেলনা। অথচ কী দারুণ দারুণ ফুল হয় তাতে, কত বিচিত্র পোকা আমদানি হয়, তাদের খেতে কী সুন্দর সুন্দর গিরিগিটি চলে আসে, কাকে বোঝাই।
আমার বাড়ির বেনামী মালকিন সেদিন তুমুল চ্যাঁচামেচি শুরু করলেন, এই জঙ্গল কবে কাটা হবে আমি শুনতে চাই। লোকের কথায় কান পাতা যাচ্ছে না, কত নেবে একটা মজুর এগুলো কাটতে? দুশো? তিনশো? আমি আর সাতদিন সময় দিলাম। আমি ভাবতে বসলাম, লোকের কথা? কোন সে লোক? লোক না লোকিনী? ভাবতে ভাবতে পেয়েও গেলাম। পরদিন সকালে চায়ের কাপ নিয়ে গেটের কাছে চলে গেলাম। বেশ চেঁচিয়ে বললাম, শুনছো, তোমার কিছু পরিচিত লোককে বোলো, বেঢপ চেহারায় সালওয়ার একদম মানায় না, শাড়িতে বরং অনেক ডিফেক্ট ঢাকা পড়ে।
জঙ্গলটা আর কাটতে হয়নি। পোকা, প্রজাপতি আর গিরগিটিগুলো বিন্দাস আছে।
এ মায়া প্রমঞ্চময়
সেদিন ঠিক সাতটার সময় মনে হল জেলখানার পাগলা ঘন্টি বাজছে, টিংটংটিংটংটিংটং... সব্বোনাশ, ক্ষেপে গেল কে?
আমাদের চক্রবর্তী সাহেবের চেহারাটা ছিল বেতের মত সোজা। ভদ্রলোক দীর্ঘ ও ঋজুদেহী, তাছাড়া সুপুরুষ। কিন্তু ওঁর মুখে ছিল একটা কর্কশ, কাঠখোট্টা ভাব। দেখলে বাঙালি মোটেই নয়, উত্তর ভারতীয় মনে হত। সাফারি স্যুট বস্তুটা সে সময়ে, মোটামুটি বঙ্গদেশের স্টাইল থেকে বিদায় নিলেও, উনি প্রাচীনপন্থী বলে ওটাই পছন্দ করতেন। তার ফলে কেমন যেন লালবাজার লালবাজার ছাপ পড়ে যেত চেহারায়। অবশ্য পুলিশ মানেই ওরকম কাঠখোট্টা হবে তার মানে নেই, আমি চপল ভাদুড়ি টাইপ পুলিশ অনেক দেখেছি, তাঁরাই বেশি ডেঞ্জারাস।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় একটা অফিসের আমি বড়কত্তা ছিলাম। অফিসের ওপরেই বাসস্থান। সকালে আমার এক অনুচর রোজ এসে খবর নিত বেঁচে আছি কিনা। একা মানুষের জন্য এত কম বাজারের প্রয়োজন, যে আমার তা কিনতে যেতে লজ্জা করত। সে-ই এনে দিত কলাটা মূলোটা বাজার থেকে। কোনওদিন সে না এলে চায়ের দোকানের সুকুমার আসত। তার দোকানটা অবশ্য দূরে। তবে ফাঁকা জায়গায় বহুদূরের আওয়াজ শোনা যায়। সকালে চায়ের প্রয়োজন হলে, ছাদের দক্ষিণপূর্ব কোনে দাঁড়িয়ে একটা ক্যানেস্তারার ওপরে ঠ্যাং ঠ্যাং করে দুবার হাতুড়ি দিয়ে মারলেই সুকুমার শুনতে পেত। আর রাত্রে একটা টর্চ নিয়ে ঐ কোনাতেই দাঁড়িয়ে দুবার জ্বালাতে নেভাতে হত। অবশ্য অরুণবাবু আড্ডা মারতে আসলে তিনবার।
এদের আসার সময় মোটামুটি আটটা। ওরা এসে নিচে বেল বাজাত। সব সময়েই একবার টিংটং। দুবার বাজানোর প্রয়োজন কখনই হত না, আমি তো সাড়ে পাঁচটা থেকেই জেগে আছি। বেল বাজানোর পর আমাকে তিনটে তালা খুলে নীচে নামবার কথা, কেননা যাত্রাপথে দুটো কোলাপসিব্ল ও একটা গ্রিলের গেট। তবে আমার অত পরিশ্রম করার দরকার হতনা, আমি চাবির গোছা ছুঁড়ে দিতাম, ওরা তালা খুলে ওপরে আসত।
সেদিন ঠিক সাতটার সময় মনে হল জেলখানার পাগলা ঘন্টি বাজছে, টিংটংটিংটংটিংটং...বাপরে, হলটা কী? আমি তখন বিছানায় বসে আগের দিনের কাগজটা মুখস্থ করছিলাম, সে দিনেরটা ঘন্টা খানেক পরে দেবে কোলকাতা থেকে একমাত্র ট্রেনটা এলে। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে এলাম। এদিকে পাগলা ঘন্টি বেজেই চলেছে, টিংটংটিংটংটিংটং...ভীষণ বিপদ টিপদ নাকি কারোর?
আমি দৌড়ে ছাদের আলসের কাছে এসে নীচে ঝুঁকে দেখবার চেষ্টা করলাম, ঠিক দরজার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে অবশ্য ওখান থেকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কার্ণিশের আড়াল পড়ে। কে? কে? কে ওখানে? একটা সাফারি পরা তালঢ্যাঙা সিপাহিছাঁট চুলের লোক খানিক পিছিয়ে এসে ওপরে তাকাল,
- আরে স্যার আপনি?
- আরে সরকার, আপনি এটার চার্জে নাকি?
- হ্যাঁ স্যার, কিন্তু এত সকালে –
- আরে ভাই কথা পরে, আগে চাবিটা ফেলুন তো, আমার একটু ল্যাট্রিন যেতে হবে।
- একতলার দরজাগুলোর স্যার টোটাল আঠারোটা চাবি। আমাদের মুখস্থ, তাই মিনিট কুড়ি লাগে। আপনি খুলতে গেলে – আপনি বরং ওপরে চলে আসুন আমার কোয়ার্টারে –
- অতদূর কি উঠতে পারব? কিছু দুর্ঘটনা যদি –
- চিন্তা নেই স্যার, কাচা ইস্তিরি করা পাঞ্জাবি পাজামা আছে। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
পাঞ্জাবি পাজামার দরকার অবশ্য হয়নি। সব সেরে টেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চক্রবর্তী সাহেব বললেন, চা পাওয়া যাবে? আমি বললাম, যাবে না মানে? দক্ষিণপূর্ব কোণে গিয়ে ক্যানেস্তারায় ঠ্যাঠ্যাং ঠ্যাং বাজালাম, একবার রিপিটও করলাম। সুকুমার কনফিউজড হয়ে যেতে পারে। এত সকালে একাধিক চা লাগার কথা নয়। সাহেব বললেন, গাড়িতে যাচ্ছিলাম এই পথ দিয়ে, হঠাৎ একটু ইয়ে-
খুব চিন্তাক্লিষ্ট গলায় চক্রবর্তী সাহেব বললেন, ওহ্ তাহলে আপনি এখানে ছিলেন? আমি বললাম, ছিলেন মানে? আছি তো। উনি ঠোঁট দুটো সরু করে মাথা নাড়লেন, না, নেই। আমি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম, বলেন কী, সবে তো আট মাস হ'ল। উনি বললেন, বসুন বসুন, উত্তেজিত হলে নিজেরই শরীর খারাপ হবে। আমাদের ওপর মহলে চুকলি কাটার লোকের অভাব নেই, আর তা শোনার মত কান পাতলা লোকেরও অভাব নেই, তা তো জানেন। আপনি যাচ্ছেন খুব খারাপ জায়গায় আর আপনার রিপ্লেসমেন্ট সুর সাহেবের অর্ডার আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি।
মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল। চাকরি জীবনে বহুবার বদলির অর্ডার এসেছে, নতুন কিছু নয়। কিন্তু এটা কী ধরণের অসভ্যতা? এর আগে যেখানে ছিলাম, মাত্র দুমাস কাটার পর বলল, এখানে এস। আবার মাত্র আটমাস পর বলছে বিদেয় হও। আর মাত্র দুমাস এখানে থাকতে দিলে আমার একটা প্রোমোশন হতো, যদিও সেটা আমি নিতাম কিনা সন্দেহ, কিন্তু এটা তো জোর করে আটকে দেয়া হল। তাও আবার 'খারাপ' যায়গায় যেতে হবে। খারাপ যায়গা মাত্র দুটো আছে এ চত্বরে। সেখানেও কেউ না কেউ যায় নিশ্চয়, কিন্তু প্রশ্ন হল, হোয়াই মি?
আমি খুব কমিক পড়তে ভালবাসি। 'হ্যাগার দ হরিব্ল' আমার খুব প্রিয় কমিক। একদিন হ্যাগারের মাথায় বাজ পড়েছে। হ্যাগার খুব কাঁচুমাচু মুখে ভগবানকে চেঁচিয়ে বলছে, - হোয়াই মি? ভগবান বললেন, ইট'স নাথিং পার্সোনাল। ইউ জাস্ট হ্যাপেন্ড টু বি ইন দা ফায়ারিং লাইন। আমার বেলা কিন্তু তা নয়, বোঝাই যাচ্ছে, ইট'স পার্সোনাল। কিন্তু কেন? কী করলাম আমি? চক্রবর্তী সাহেব বললেন, কী ভাবছেন? মেজাজ খারাপ হয়ে গেল? একটা উপায় আছে। আপনি আমার ওখানে চলুন। আমি মলিন হেসে বললাম, পাঁঠার ইচ্ছেয় কালীপূজো হয় স্যার? আপনার ওখানে যাব মানে? আপনি আছেনই বা কোথায়?
উনি বললেন, বেশি দূরে নয়, এখান থেকে মাত্র পনের কিলোমিটার। খুব কনভেনিয়েন্ট জায়গা। বড় টাউন। থাকার জায়গা আছে। তাছাড়া বিদেশ বিভূঁইয়ে যেটা সবচেয়ে কষ্ট, সেই খাওয়ার কষ্ট নেই। আমার ওখানেই থাকবেন। রান্নার লোক আছে, দুবেলা চর্ব চোষ্য লেহ্য খাবেন। পেয়টা আমি ঠিক এনকারেজ করিনা। সপ্তাহে একবার বাড়িও আসতে পারবেন। কী, যাবেন? আপনি হ্যাঁ বললেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মানুষের পাপী মন, সব সময়ে সন্দেহে পূর্ণ। মনে কু চিন্তা ঢুকল। একনম্বর, উনি সুর সাহেব এখানে আসছেন জানেন, অথচ আমি এখানে আছি দেখে অবাক হলেন? তার মানে জানতেন না? ওই অবস্থায় প্যান্ট খারাপ না করে সিঁড়ি ভেঙে এতটা উঠে আসা যায়? সত্যি ইয়ে পেয়েছিল তো?
বাক্স বিছানা প্যাক করতে লাগলাম। বাক্স একটাই, সামান্য কিছু জামাকাপড় আর অফিসের কাগজপত্র। বিছানার খানিকটা উত্তরাধিকার সূত্রে সেনগুপ্তর কাছ থেকে পেয়েছিলাম, ওটা পরে যিনি আসবেন, তাঁর কাজে লাগবে। শুধু একটা চাদর আর একটা বালিশ। বালিশটাও থাক। একটা টি ভি ছিল, ওটা সুকুমারকে দিয়ে যাব ভাবলাম। অনেক জায়গায় বদলি হয়েছি, কিন্তু নিজস্ব কিছু সমস্যার জন্য যেখান থেকে কোলকাতায় যাতায়াত করা যায়, সেখানেও আমি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়িও আসতামনা। এক এক জায়গায় তিন সাড়ে তিন বছর থেকেছি কিন্তু এখানকার মত মন বসেনি কোথাও। এই জায়গাটার ওপর বড় মায়া পড়ে গেছিল। মায়া বড় জটিল জিনিষ। কার ওপর মায়া পড়বে ওপরওয়ালাই জানেন।
সত্যিই এ বড় জটিল জিনিষ। উনিশশো তিয়াত্তর সালে একটা নাইলনের বাজার করার ব্যাগ কিনেছিলাম ময়দান মার্কেটের সামনে থেকে। দাম নিয়েছিল, সাড়ে তিন টাকা। দেবু দর করে কিনে দিয়েছিল। দুহাজার নয় সালে যখন প্রমোদের দোকানে ওটা নিয়ে চাল কিনতে গেলাম, সে বলে আঙ্কল, ইয়ে অজীব কিসিমকে ব্যাগ আপকো কহাঁসে মিলা? যখন বললাম, ওটার বয়স কত, ব্যাটা তো প্রথমে বিশ্বাস করতেই চায়না। তখন বললাম এরকম আর একটা এনে দে তাহলে কোথাও থেকে। সে বলে, আপনি এত পুরোন জিনিষ 'সমহালকে রখ্খা'? আমি বললাম, ওরে ব্যাটা এর পর কি আর বাজারের ব্যাগ কিনিনি নাকি, গন্ডায় গন্ডায় কিনেছি। সে সব কোথায় গেছে কে খবর রাখে। এটার ওপর মায়া পড়ে গেছে যে। কোন জিনিষের ওপর কার মায়া পড়বে কেউ কি বলতে পারে?
আমার অফিসের কোয়ার্টারের ছাদে একটা ইজিচেয়ার রাখা থাকত বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছর। আমাকে ওখানে অনেক রাত অবধি কাজ করতে হত। শুধু আটটার সময়ে চান টান করে আমি সেই আরাম কেদারায় বসতাম এক ঘন্টা। আকাশের দিকে তাকালে মনে হত তারাগুলো কত কাছে। রোজই ধূমকেতু উড়ে যেত একটা দুটো। বিমলি আসত সন্ধেবেলায় রান্না করতে। বলত, কাকু, তারা খসা দেখলে সাতটা ফুলের নাম বলতে হয়। তাড়াতাড়ি বল, রজোনিগন্দা, গোলাপ, ঘেঁটু, মালোতী, আর তিনটে বলনা তাড়াতাড়ি – আমি বলতাম, না বললে কী হবে রে? তোর বে হবেনা? ধ্যাৎ, বলে পালিয়ে যেত বিমলি।
দিনের বেলায় ছাদে উঠলে সরাসরি দক্ষিণে তাকালে ভূটানের পাহাড় দেখা যেত। আজব ব্যাপার, এটা চব্বিশ পরগণা, পাহাড়ের কোনও সিন নেই, কিন্তু লম্বা লম্বা ঝাউগাছগুলো, দিগন্তে জমা মেঘের পরত আর নদী থেকে চালানি ছোট খালটা একটা ইলিউশন তৈরি করত। একবার এক অল্পবয়সী অফিসার সাপোর্ট জবে এসেছিল কিছুদিনের জন্য। সে বলে, স্যার জায়গাটা দারুণ তো, এদিকে তাকালে তো দার্জিলিং মনে হচ্ছে। দক্ষিণ দিকে দুটো কৃষ্ণচূড়ার গাছ নুয়ে একেবারে ছাদের মাঝ বরাবর। বসন্ত কালে অর্ধেক ছাদ লালে লাল। চারদিক ঘিরেই গাছ। একটা স্পটেড আউলেট সন্ধে হলেই বাঁদিকের নিমগাছে এসে ঝামেলা লাগাত। প্যাঁচা যে অত ছোট সাইজের হতে পারে, আগে জানতাম না। আর প্রত্যেক চাঁদনি রাতে এক ব্যাটা পাপিয়া কানের কাছে চিল্লামিল্লি করে এমন মাথা ধরিয়ে দিত, সকাল অবধি ছাড়ত না। সাধে কি আর ব্রেইন ফীভার বার্ড বলে?
চলে যেতে হবে। পৃথিবী ছেড়েও একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু এ জায়গার মায়া কাটানো বড় মুশকিল। মানুষজনও বড় ভাল এখানকার। কদিনের আলাপ, মনে হয় কতদিনের চেনা। সকালে রোজ যে আসে, সে আমার অফিসেরই কর্মী। কিন্তু তাকে অফিসের লোক বলে ভাবা যায়? আমার ছেলে মেয়ে একবার ছিল কিছুদিন গরমের ছুটিতে। কী কারণে যেন, ছেলেটার গালে একটা চড় মেরেছিলাম। সে কাঁদেনি, কিন্তু ইনি হাউ হাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। তাকে সামলাতে তখন দুটো লোক লেগেছিল। এ তো আমার পরিবারের অংশ। এদের ছেড়ে যাব কী করে?
মায়া কাটানো বড় কঠিন, কিন্তু ঠিক কেটে যায়। যে লোকটা আই সি সি ইউতে শুয়ে প্রাণটা ঠোঁটের ডগায় নিয়ে পড়েছিল, ঢলোঢলো মুখের দগদগে সিঁদুর পরা বৌটার কচি মুখটার দিকে তাকিয়ে কিছুতেই প্রাণবায়ুটা বেরিয়েও বেরোচ্ছিল না, সে যেদিন ঘষা কাঁচটার ওপারে বিভু ঠাকুরপোর আদর করাটা দেখতে পেয়ে গেল, ওমনি ফুস করে – সেদিন রোজকার মত অফিসে নেমেছি ন'টা নাগাদ। আর সবার মতো মেন গেট দিয়ে ঢুকতে হয়না আমাকে। ওপরের সিঁড়ি থেকে নেমেই বাঁ হাতে আমার ঘর। একটা দৃশ্য দেখে আমি থমকে গেলাম। বাকরুদ্ধ তো বটেই, চলচ্ছক্তিরহিত যাকে বলে, তাই।
একে এতটা কাছে পেয়েছিলাম, যে বাড়ির লোক মনে হত। লোকটা ছিলও সে রকমই। পান থেকে চূন খসতে দেয়নি কোনও দিন। অথচ এ সব করার তার কোনও প্রয়োজন ছিল না। অস্থায়ী কর্মীরা মাঝে মাঝে কর্তাদের তেল দেয় স্থায়িত্বের আশায়। অনেকে তাদের অন্যায় ভাবে ব্যবহারও করে, কিন্তু এর তো স্থায়ী চাকরি, আমার থেকে তার কিছু পাওয়ারও ছিল না, কিছুই না। তবু যা করত, তা অবিশ্বাস্য। সেদিন অফিসে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার পা যেন আটকে গেল মাটিতে।
আমি যে যাচ্ছি, সে খবরটা মোটামুটি পাকা। কিন্তু সুর সাহেব এখনও জয়েন করেননি। উনি এলেও প্রথমে দিন সাতেক ট্রানজিট লীভ পাবেন। তারপর আসবেন আমার কাছে চার্জ বুঝতে। তাতেও সাতদিন তো যাবেই। তাই উনি যদি কালও আসেন, তার পরেও পনের দিন আমিই কর্তা এই অফিসের। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ঘরের দরজায় রূপঙ্কর সরকার লেখা কাঠের বোর্ডটা ভেঙে উপড়ে নিচ্ছে লোকটা ডান হাতে, আর বাঁ হাতে ঝুলছে ব্রজগোপাল সুর লেখা পেতলের চকচকে বোর্ডটা। এটার পয়সা অফিস দেয়নি ওকে। নিজের খরচেই করেছে। পরে হয়তো সুর সাহেবের থেকে স্যাংশন করিয়ে নেবে। বি জি সুরের পুরো নাম যে ব্রজগোপাল সুর, তা আমিই জানতাম না, কোনও চিঠিতেও তো দেখিনি।
সিরিয়াস ইনডিসিপ্লিন। আমি ওর বিরুদ্ধে বিধিভঙ্গের অভিযোগে কিছু একটা করতে পারতাম। কিছুই করিনি। শুধু ও যখন বলল, স্যার ঘরে সব বই লাগিয়ে দিয়েছি, চেক করুন। আমি বললাম, ওঘরে তো আর বসব না, ওগুলো বাইরে কোথাও দাও। বাকি অফিসার ও কর্মীদের গুজগুজ কানে এল, এটা তুই কী করলি, বড় সাহেব থাকতেই –
মায়া কেটে গেল এক নিমেষে। মায়া নাকি কাটে না? অরুণবাবু সামান্য মাইনের চাকরি করেন ইস্কুলে। একটা খুব দামি কলম নিয়ে এসেছেন। বকলাম, এটা কী করলেন, এত দামি – উনি বললেন, চুপ স্যার, একদম চুপ। এক ভদ্রলোক একটা বিশাল বড় বাতাবি লেবু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে কোনও দিন দেখেছি বলেই মনে পড়ছে না, কোনও উপকার করা তো দূরে থাক। বললেন, আমার বাগানের স্যার। আরও অনেকে ঘুরছেন খবরের কাগজে কিছু জড়িয়ে। আমার ব্যাগে একটা বিশাল সন্দেশের বাক্স কে যে ঢুকিয়ে দিল পেছন থেকে, বুঝতেই পারলামনা। বিমলি কাছে আসছেনা, দূরে গাছের আড়াল থেকে দেখছে। সুকুমার চোখ মুছল কবার। এ মায়া প্রপঞ্চময়। চলো মন নিজ নিকেতনে।
চক্রবর্তী সাহেবের অফিসে জয়েন করলাম পরদিনই। ওখানে বড় সাহেব ছিলাম, এখানে মেজও নয়, সেজ। যাক, তবু তোফা আছি এখানে। চক্রবর্তী সাহেব বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। অন্য কিছু অফিসারদের মধ্যে একটা চাপা অসন্তোষ টের পাই, দেখেছেন, সাহেব নিজের লোক নিয়ে এসেছেন আমাদের সলিডারিটি ব্রীচ করার জন্য।
থাকার আস্তানাটা ভাল। ওটা চক্রবর্তী সাহেবেরই কোয়ার্টার, কিন্তু চারটে বিশাল ঘর। সবাই তো ব্যাচেলর টাইপ, তাই ছয় সাত জন অফিসার শেয়ার করে থাকি। ওঁর বাড়ি ভাড়াটাও বাকিরা শেয়ার করি। ইলেক্ট্রিকের বিল, কেব্ল টিভির ভাড়া, রান্নার মাসির মাইনে, সবই শেয়ার। রোটেশনে এক মাস করে বাজার করার দায়িত্ব। ভালই আছি। এখানে অফিসারদের মেস দুটো। একটু দূরে করণিকদেরও গোটা দুয়েক।
চক্রবর্তী সাহেব একটা বিদ্ঘুটে অসুখে ভোগেন। ওঁর ধারনা ওটা হাঁপানি, আমার ধারণা, ওটা রিফ্লাক্স ডিজিজ। যাই হোক, উনি কাশেন, ভীষণ কাশেন, কাশতে কাশতে গয়ার তোলেন, হ্যাক থুঃ। আন্দামানে বেড়াতে গিয়ে টেলিগ্রামে মাতৃবিয়োগ। ফিরে এসেই মায়ের শ্রাদ্ধ করতে বসে জ্বরে পড়লেন, সম্ভবতঃ মেনিঞ্জাইটিস। যমে মানুষে টানাটানি, মানুষ জিতে গেল। কিন্তু সেরে উঠেও এই বিপত্তি। খক খক খক, হ্যাক থুঃ।
উনি পন্ডিত মানুষ, শাস্ত্রজ্ঞ। বললেন, কী সরকার, মন খারাপ লাগছে? আপনার জায়গাটা শুনেছি ভাল ছিল। কিন্তু এটা মন্দের ভাল হল না? কোথায় পাঠাচ্ছিল আপনাকে, আমি শুনেই ভাবলাম, এমন অফিসার ছাড়া যায়? মন খারাপ করবেন না।
উপাদি খন্ডনম্, মায়াবাদঅ খন্ডনম্
প্রপঞ্চ মিথ্যাত্ব অনুমানঅ গীতা তাৎপর্যম।
কী বুঝলেন সরকার?
আমার এই নামটা একদম ভাল লাগত না। আমাদের অর্গ্যানাইজেশনে চিরকাল বড়রা রূপঙ্কর আর ছোটরা রূপঙ্করদা বলে ডেকে এসেছে। দক্ষিণ ভারতীয়রাও র-এর পর দীর্ঘ ঊ-টা লম্বা করে টেনে আমার নামটা বলত। সরকার শুনতে ভাল লাগেনা মোটেই, কী আর করা।
খ্যাক্ থুঃ, খোয়াক থুঃ – কয়েক মিনিট পর পরই সাহেবের গয়ার ওঠে। কতবার বাথরুমে ছুটবেন। আবার বাড়িটার উত্তর দিকের ব্লকে বাথরুমটা ঘরের লাগোয়া, কিন্তু পশ্চিমের এই দিকটায় বাথরুমটা ওঁর ঘর থেকে বেশ খানিক দূরে। তাই উনি একটা হাতল ভাঙা, চলটা ওঠা কাপ নিয়ে এসেছেন বাড়ি থেকে। তার মধ্যেই ফেলেন। কাপটা নিজের খাটের ওপরই রাখেন। কখনও বা সামনের চেয়ারে। ঘরে অফিসের লোক বা ক্লায়েন্ট এলে কাপ সরিয়ে, বসুন না বলেন। যাঁকে বলা হল, তিনি, না না স্যার ঠিক আছে, বলে বসেন না। আসলে ঘেন্নায় বসেন না।
ডাইনিং স্পেসের ওধারে আমার ঘর। এঘরে চক্রবর্তী সাহেব বড় একটা আসেননা, আমরাই ওঁর ঘরে যাই সচরাচর। সেদিন উনি এলেন। মুখটা কাঁদো কাঁদো। গলার স্বরটা নকল করতে পারলে খুব ভাল হত, লেখায় ঠিক জমবে না। বললেন, সরকার, কাপটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। বুঝেও ন্যাকামি করলাম, কোন কাপটা স্যার, ওই বোন চায়নার সেটের একটা? – আরে না না, যেটায় ইয়ে ফেলতাম। প্রতিদিনই তো পরিষ্কার করি। বাথরুম থেকে ধুয়ে আনার সময় – বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, কী আর করবেন স্যার, পৃথিবীতে সবই অনিত্য, এ প্রপঞ্চ মিথ্যা, মায়া মিথ্যা, জ্যোতির দোকান থেকে তিন টাকা দিয়ে আর একটা কিনে আনি স্যার? উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ সে তো আমিই কিনে আনতে পারি। আপনি ঠিক বুঝবেননা, কত দিনের সাথি –
বেশ কয়েক বছর পরের কথা। ভাগ্যচক্র, কাক এবং তাল, এই তিনের সমাহারে অনেক জায়গা ঘুরে এসে আমি এখন সেই অফিসের বড় সাহেব। সেই ঘরেই থাকি, তবে আমার থুথু ফেলার কাপ লাগেনা ভাগ্যিস। অফিসে ভারি পর্দাটা ঠেলে, মে আই কাম ইন সার? বলে যে ঘরে ভয়ে ভয়ে ঢুকতাম, সেই ঘরের সেই চেয়ারেই এখন আমার অধিষ্ঠান। কাক আর তালের আরও খেলা, সেই লোকটি বদলি টদলি হয়ে এখন এই অফিসে। প্রচন্ড সেবা করল আমার। অডিটের সময়ে একটু বেশি রাত অবধি সবাই থাকে। এ কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা থাকল টানা দশ দিন। বাড়ি যায় নি মোটে। তবে তার জন্য একটুও মন খারাপ হয়নি চলে আসার দিন। একবারও পেছন ফিরে তাকাই নি।
(চলবে)