আধলা
আজ সাতই সেপ্টেম্বর, দু হাজার চার। জ্বর হয়েছে বলে অফিস যাইনি। সুরেশ পন্ডিত এসে টেলিগ্রাফ আর আনন্দবাজার দিয়ে গেল। তখনই মনে হল, আজ তো অফিস যাবনা, তাহলে বাকি কাগজগুলো পড়ব কি করে ? ইকনমিক টাইমসটা কবিরুল রেখে দেবে আমার জন্য ঠিক, কিন্তু বাকিগুলো তো এদিক সেদিক চলে যাবে। মোড়ের দোকান থেকে দীনেশকে দিয়ে আরও গোটা তিনেক কাগজ কিনে আনালাম। তবু সবগুলো পড়া হলনা বলে আক্ষেপ রয়েই গেল।
অনেকে জিজ্ঞেস করে, এতগুলো কাগজ পড়ে কি লাভ হয় আপনার ? আবার অনেকে বলে, নেই কাজ তো খই ভাজ কিংবা কাগজ পড়। আমার কিন্তু মিনিমাম গোটা পাঁচেক কাগজ না পড়লে চলেনা। এর পেছনে আছে সাংবাদিকতার এক জঘন্য নিদর্শন।
সময়টা আশির দশকের শেষ ভাগে। তখন আমি হুগলি জেলার কোনও এক গ্রামে কর্মরত। ওখানে একটা বাসা ভাড়া করে থাকলেও বছরের কয়েকটা মাস বাদে, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দুবার বাড়ি আসতাম। পরের দিন সকালে যাওয়ার সময়ে ট্রেনের এক নির্দিষ্ট কামরায় উঠতাম। সেখানে ব্যাঙ্কারদের বিরাট দল আর অনেকগুলো কাগজ। ভাগাভাগি করে পড়াও হত সবকটাই। আমি তাস ফাস খেলিনা বলে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত সব মুখস্ত হয়ে যেত যাত্রাপথে।
আমি রাজনীতি বাদ দিয়ে সব রকম খবর, সম্পাদকীয়, সমালোচনা, সবই পড়তাম। রাজনীতিটা অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারতামনা বলে কাগজের অনেকটাই পড়া হতনা, আফশোষ বটে। যাই হোক, একদিন একটা খবর পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। উত্তর কোলকাতার এক গৃহস্থবাড়িতে এক গৃহবধু খুন হয়েছেন। তাঁর স্বামী সরকারি চাকুরে, ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, তাঁরা কেউ সে সময়ে বাড়ি ছিলেননা। খবরে আরও প্রকাশ, সে বাড়ির এক পুরোন ভৃত্যকে সন্দেহ করা হচ্ছে। বাংলা, ইংরিজি, সব কাগজেই খবরটা ছিল।
খুন ব্যাপারটা কোলকাতায় নতুন নয়। আজকাল নিত্য শোনা যায়। যে সময়ের কথা বলছি, তখন হয়তো কিছু কম ছিল, তা বলে বিরল কিছু ঘটনা নয়। কিন্তু এই ঘটনাটা আমায় ভীষণ নাড়া দিয়ে গেল। আমি চোখের সামনে সেই সরকারি কর্মচারি ভদ্রলোকের অসহায়তা দেখতে পেলাম। স্ত্রী বিয়োগের বেদনা ছাড়াও ঘকন্নার কাজ এখন একা সামলাতে হবে। ভৃত্যের হাতেই ব্যাপারটা ঘটেছে বলে, কাজের লোকও চট করে রাখতে সাহস হবেনা। বেচারা ছেলেটার সামনে জীবনের প্রথম ধাপ পেরোনর পরীক্ষা, সেটা সে কেমন দেবে আর ফল খারাপ হলে, মানে, হবেই দেখা যাচ্ছে – তখন বাকি জীবনের সব কটা ধাপ –উঃ আর ভাবা যাচ্ছেনা।
এ রোগটা আমার পুরোন। কাগজে কোনও দূর্ঘটনার খবর পড়লেই, মানে একটু বিশদে পড়লেই, আমি যেন কেমন হয়ে যেতাম। মনে হত সে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছি, কান্নাকাটি শুনতে পাচ্ছি। যার কোনও প্রিয়জনের কিছু একটা হল, তার জায়গায় নিজেকে প্লেস করে শিউরে উঠতাম। নিজের অভিজ্ঞতা বলে মনে হত। এ জন্য পরিবারে বা অফিসে টিটকিরিও কম শুনতে হয়নি।
কুখ্যাত গোমিয়া মার্ডার কেসটা পড়ার পর আমি যে কত রাত্তির ঘুমোইনি কে জানে। আর নিজেই একটা খুন প্রায় করে বসেছিলাম, ভগবান কিংবা যারই হোক দয়ায় বেঁচে গেলাম। লোকটাও বেঁচে গেল সিগারেট ধরাল বলে।
কোলকাতা থেকে তিনশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে বিহারের গোমিয়া। এখন অবশ্য সেটা ঝাড়খন্ডে। সেখানে আই ই এল এর এক বাঙালি অ্যাকাউন্ট্যান্ট, যতদূর মনে পড়ে, খুব সম্ভবতঃ মজুমদার গোছের পদবী। একটা লোক, তাঁদের পুরো পরিবারের সবাইকে যে যখন বাড়ি ফিরেছে, একজন একজন করে মেরেছে। লোকটা হয়তো পরিচিত, কেননা আগের দিন সন্ধেবেলা সে এঁদের বাড়িতে এসেছে, রাত্রে ছিল, পরের দিন সারা দিন সে এই বাড়িতেই ছিল। রাস্তার উল্টোদিকের দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনেছে, কাজের মাসিকে তোয়ালে পরে বেরিয়ে, আজ দরকার নেই বলেছে। তোয়ালে পরে, কারণ জামা কাপড় রক্তে ভেজা ছিল। সবচেয়ে নৃশংস ভাবে মেরেছে ছোট মেয়েটাকে ইস্কুল থেকে ফেরার পর কমোডের মধ্যে মুখ গুঁজে ।
খবরটা গ্রাফিক ডিটেলে বেরিয়েছিল বাংলা, ইংরিজী সব কাগজে। তা না হলে আমার অত প্রতিক্রিয়া হতনা। অদ্ভুত ব্যাপার হল, কেসটার কোনও কিনারা তো হয়নি বটেই, ভদ্রলোকের আত্মীয়, বন্ধু, অফিসের লোকজন, কেউ কোনও সূত্র দিতে পারেনি। ছাপোষা গেরস্ত মানুষ, কোনই শত্রু ছিলনা তাঁর। অনেক ক্ষেত্রেই খুনি ধরা পড়েনা, কিন্তু বাড়িশুদ্ধু সবাইকে এক এক করে খুন করার কোনও কারণের কেউ কোনও হদিশও দিতে পারবেনা, এমন ঘটনা বিরল। খুনি কিচ্ছু নিয়ে যায়নি সে বাড়ি থেকে।
আমি খবরটা পড়ার পর কেমন যেন হয়ে গেছিলাম। লোকটার চেহারার নিখুঁত বিবরণ পাওয়া গেছিল। লোকটা বেঁটে, ফর্সা, হাতে বেশ বড় বড় লোম, মুখে গভীর ক্ষতের মত ব্রণর দাগ আর ব্যাটা কালো রিজেন্ট সিগারেট খেত, সামনের দোকানটা থেকে অনেকবার প্যাকেট কিনেছে, দিনে তিন চার প্যাকেট তো বটেই। এত সব শুনেও ঐ পরিবারের আত্মীয়, বন্ধু বা অফিসের লোকেরা এমন চেহারার লোককে কোনওদিন দেখেছে বলে মনে করতে পারেনি।
ঘটনাটি নিতান্তই অদ্ভুত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুনি খুন করে পালিয়ে যায়, তাকে কেউই দেখেনা। এবার পুলিশ বা গোয়েন্দারা বাড়ির লোক, প্রতিবেশি, অফিসের সহকর্মী, এইসব ব্যক্তিদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা না একটা ক্লু পেয়ে যান। এর পর খুনি ধরা পড়ুক বা না পড়ুক, খুনের কারণ বা সম্ভাব্য খুনির পরিচয় জানা যায়। এক্ষেত্রে তাকে অনেকেই দেখেছে। তার চেহারার নিখুঁত বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু সে কে বা কেন এই এতগুলো খুন, কিছুই বোঝা গেলনা।
আমার কিন্তু লোকটার চেহারাটা ছবি হয়ে গেছিল মনে। দীর্ঘকাল কেটে গেছে, প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছর, সে ছবি মিলিয়ে যায়নি এখনও। আগেই বললাম, আমার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হত। বিশেষতঃ নির্দোষ বাচ্চাদুটোর অমন বীভৎস খুন আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলামনা। আমি পথে ঘাটে লোকটাকে খুঁজতাম। একবারও মনে হয়নি, বাঙালিকে মেরেছে বলে সে নিজেও বাঙালি বা কোলকাতায় থাকে, এটা কোথায় লেখা আছে। ওদিকে খুনি পাওয়া যায়না নাকি?
সেই বছরই একবার, জামির লেনে লোকটাকে পেয়ে গেলাম। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সামনের ফুটপাথে। দূর থেকেই মেপে নিয়েছি, কাছে গিয়ে মিলিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, বেশ ফর্সা, হাতে ভাল্লুকের মত লোম, হাইট পাঁচ ফুটের কাছাকাছি, ওঃ গালে আবার এবড়ো খেবড়ো ব্রণর গর্ত, এ না হয়ে যায়না। একটা আধলা ইঁট কুড়িয়ে চুপিসাড়ে এক্কেবারে পেছনে চলে গেলাম। এক ঘায়ে শেষ করতে হবে। তার আগে অবশ্য কানের কাছে মুখ নিয়ে হঠাৎ বলব, গোমিয়া থেকে কবে ফিরলেন ? রিঅ্যাকশনটা কেমন হয় দেখতে হবে।
লোকটা হঠাৎ থেমে পকেট থেকে সিগারেট বের করল। হলদে রঙের গোল্ডফ্লেকের প্যাকেট। না কালো রিজেন্ট নয়। সে যখন সিগারেট ধরাচ্ছে, আমার সম্বিত ফিরল, আরে পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি ? ইঁটটা আস্তে করে নামিয়ে রেখে উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম।
সেই আমি, এই ভদ্রমহিলার ছেলেটিকে নিয়ে চিন্তায় পড়লাম। হয়তো ভাল ছাত্র, পরীক্ষার পরে হয়তো জয়েন্ট দিত, হয়তো ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। পরীক্ষাটা খতম হয়ে গেল। পুরো জীবনটাই অন্যরকম হয়ে গেল। ইস্কুল থেকে ফিরে বইখাতা ছুঁড়ে দিয়ে, মা, আজ আলুর পরোটা ভাজছ মনে হচ্ছে? আর বলতে পারবেনা কাউকে। ব্যাটা চাকরটা ধরা হয়ত পড়বে, তবে আজকাল আইন কানুন যে ভাবে এগোচ্ছে, বড়জোর বছর সাতেক। আজকাল চাক্কিও পিষতে হয়না, ঘানিও টানতে হয়না। মাদুর বুনে আর রঘুপতি রাঘব গেয়ে সাত বছর কাটালেই আর একটা খুন করার জন্য ছেড়ে দেয়। ট্রেনের বন্ধুরা বলত, ও সরকারদা, অমন উদাস কেন? আগের হপ্তায় যাননি বলে বৌদি বকেছে ? আমি ভাবতাম ইস্ একটা আধলা ইঁট যদি –
এরকম ঘটনা ঘটলে, পর পর কয়েকদিন ফলো-আপ-রিপোর্টিং হয়। দু তিন দিন সব কাগজেই হল। তারপর চাকরের ব্যাপারটা কনফার্মড হয়ে যেতে বেশির ভাগ কাগজই ব্যাপারটায় দাঁড়ি টেনে দিল। সত্যিই আর কিছু লেখার নেই তখন। একটা বাংলা কাগজ কিন্তু ঘটনাটা টানতে লাগল। ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিজমের নামে তারা এক ‘স্কুপ’ ছাড়ল, - সন্দেহ করা হচ্ছে যে, ভদ্রমহিলার সঙ্গে এই ভৃত্যটির অবৈধ সম্পর্ক ছিল। তার কারণ হিসেবে তারা লিখল, যে ভদ্রমহিলাকে ‘প্রায় বিবস্ত্র’ অবস্থায় পাওয়া গেছে। খবরটা পড়ে আমার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। ছোট্ট পরিবার। বাবা, মা আর ছেলে। পরিবারের কেন্দ্র হারিয়ে পুরো পরিবারটাই প্রায় ধ্বংস। তার ওপর এরকম খবর কাগজে বেরোলে, যারা বেঁচে রইল, তারা সমাজে মুখ দেখাবে কেমন করে ?
কেন জানিনা, খবরটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। আমি লোকের কাছে চেয়ে চিন্তে সেই ঘটনার দিন থেকে তিন চার দিনের অনেকগুলো কাগজ যোগাড় করলাম। যেগুলো ট্রেনে পড়েছি, সেগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটা। কোলকাতায় প্রকাশিত দৈনিক এবং সান্ধ্য প্রায় সবকটাই হাতে এসে গেল। রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে আমার স্থানীয় ভাড়া বাড়িতে করার বিশেষ কিছুই থাকতনা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, আন্ডারলাইন করে সব কাগজে সেই খবরটা পড়তে লাগলাম। তার সারাংশ এই রকম বেরোল,- লোকটা পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল, কেউ তাকে দরজা খুলে দেয়নি। তখন ভদ্রমহিলা সবে চান করে বাথরুম থেকে বেরিয়েছেন, তাই সায়া-ব্লাউজ পরা ছিলেন। পুরোন কলকাতার বাড়িগুলোয় এখনকার মত আধুনিক বাথরুম থাকতনা। ছোট্ট অপরিসর, ভিজে বাথরুমে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরা কোনও মহিলার পক্ষেই সম্ভব হতনা। সবাই ঐভাবে সায়া ব্লাউজ পরে শাড়ি হাতেই বেরোতেন। তা ছাড়া বাড়িতে যখন আর কেউ নেই তখন বিশেষ আব্রুর প্রয়োজনই না কোথায় ? সায়া ব্লাউজ পরা মহিলাকে ‘প্রায় বিবস্ত্র’ বলা যায় কি ?
আগেই বলেছি অন্য সব কাগজ খবরে ইতি টেনেছে অনেক আগেই কিন্তু এরা চালিয়ে যাচ্ছে সেই ‘বিবস্ত্র’, ‘অবৈধ সম্পর্ক’ ইত্যাদি বেশ বড় বড় ক্যাপশনে। আমি খালি ভাবছিলাম, ভদ্রলোকের সহকর্মীরা, আত্মীয় স্বজনরা, ছেলের স্কুলের বন্ধুরা বা তাদের পরিবারের লোকেরা কেউ না কেউ এ কাগজ পড়ছেন নিশ্চয়ই আর, ‘যাহা যাহা রটে, তাহা কিছু সত্য বটে’ বলে যাচ্ছেন স্লাইট ব্যাঁকা হাসি সহযোগে। রটে শুধু নয়, যাহা সংবাদপত্রের মত ‘নির্ভরযোগ্য’ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
সে মাসের প্রায় শেষের দিকে, সেই বিশেষ কাগজেই, একদম ভেতরের দিকের পাতায়, যে অবধি অনেকে পৌঁছতেই পারেননা, সেখানে একটা ছোট্ট খবর ছাপা হয়েছিল। তাতে ছিল, চাকরটা চুরি করতেই ঢুকেছিল এবং এতদিন যা সন্দেহ করা হচ্ছিল, তা ঠিক নয়।
আজ সাতই সেপ্টেম্বর দু হাজার চার। অনেকগুলো কাগজ এসেছে বাড়িতে। জ্বর হয়েছে বলে কাজে বেরোইনি। অম্লান এল দেখা করতে। অম্লান একটা বাংলা কাগজের জার্নালিস্ট। ভাগ্যিস সেই কাগজটার নয়। ওকে অনেক বছর ধরে বলে আসছি, তোদের তো নিজেদের মধ্যে ভালই যোগাযোগ, তুই একবারটি জেনে আমায় বলনা, সেই সাংবাদিকের নামটা কি বা কোথায় তাকে পাওয়া যায়। ওই দ্যাখ একটা আধলা ইঁট বারান্দায় রাখা আছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, এর পর হাতের জোরও কমে যাবে। অম্লান বলল, দাদা তোমার বয়স হচ্ছে, পাগলামি কমছেনা কেন বলত ? লক্ষণ ভাল নয়।
বিপত্তারণ
বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়
ভগবান চালাক লোক, রবীন্দ্রনাথ আরও চালাক। বিপদে রক্ষা করার প্রার্থনা করে লাভ নেই, তা উনি বিলক্ষণ বুঝেছেন। যা হবার তা হবেই। তবে হ্যাঁ ভয় কমিয়ে দেবার প্রার্থনা করা যেতে পারে, ব্যাপারটা তো আসলে নিজের হাতেই।
সেই গোমিয়ার ঘটনার পর থেকেই একটা জিনিষ নিয়ে আমার ঔৎসুক্য বাড়ল, মানে আরও নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়লাম। এই উপপাদ্যে পৌঁছলাম যে, বিপদ যাতে না আসে সে প্রার্থনা যার যা বিশ্বাস সেই মতে করা যেতেই পারে, তবে বিপদ একবার হাজির হলে আর কিচ্ছু করার নেই।
গোমিয়া জায়গাটা আমাদের বাংলার বাইরে। তখন বিহারে ছিল, এখন বোধহয় ঝাড়খন্ডে। সেখানকার খবরের ফলো আপ রিপোর্টিং কোলকাতার কাগজে দীর্ঘদীন ধরে বেরোবে আশা করাই অন্যায়। কলকাতার সমাধান না হওয়া কেসগুলোই কি আর হয়। তবে হ্যাঁ, সেই যে আগের বার বললাম, ‘বিবস্ত্র’ টিবস্ত্র কিছু খুঁজে পেলে হয়, বেশ কিছুদিন ধরেই হয়। ‘সংবাদপত্রের সামাজিক ভূমিকা’ বা এই ধরণের কিছু আর্টিক্ল লিখে পুরষ্কার পাওয়া যেতে পারে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিন্তু এখন সংবাদ শুধুই বিক্রয় নির্ভর। আর শুধু সাংবাদিকরাই বা কেন, আমরা সবাই কেমন বিক্রয় নির্ভর হয়ে যাচ্ছি দিন কে দিন। বহুদিন আগে শোনা নচিকেতার গানটা মাথায় কেমন আটকে গেছে – “সবাই পণ্য সেজে, কাকে কিনবে কে যে, সারাদেশ জুড়ে সোনাগাছি। কেন বেঁচে আছি” –
আসল কথায় ফিরি। সেই গোমিয়ার কেসটা এত নাড়া দিয়েছিল, যে কতকাল আগের ঘটনা, তাও কাগজে পড়া, কিন্তু ভিভিড ডিটেলে মনে আছে সব। লোকটা আগের দিন এসেছিল, রাত্রে ছিল। ভদ্রলোকের এক সহকর্মী সন্ধে বেলা কি কারনে একবার গেছিলেন ওঁর বাড়ি। তখন তাকে দেখেছিলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী এদের দুজনকে চাউমিন তৈরী করে খেতেও দিয়েছিলেন। পরের দিন ভদ্রলোক অফিসে বেরোন, বাচ্চারা স্কুলে যায়, লোকটা কিন্তু ছিল। সবাই বেরিয়ে যেতে সে ধীরে সুস্থে বাড়ির গৃহিণীকে খুন করে। তারপর সারাদিন অপেক্ষা করে বাচ্চারা আলাদা আলাদা সময়ে ফিরলে তাদের এক এক করে মারে। সব শেষে ভদ্রলোক অফিস থেকে সন্ধেবেলা ফিরলে তাঁকেও মারে।
সে খুনগুলো করেছিল হয় উদোম হয়ে কিংবা নিজের কাপড় খুলে রেখে গৃহস্বামীর জামাকাপড় পরে। পরের দিন সকালে কাজের লোক বাসন মাজতে এলে একটা তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে, ‘আজ কাজ করতে হবেনা’ বলে দিয়েছিল। সব শেষে চান টান করে, গায়ের রক্ত ধুয়ে নিজের জামাকাপড় পরে পরের দিন সকালে বেরিয়ে গেছিল। তাকে অনেকে দেখেছে, অফিসের সহকর্মী মশাই, উল্টোদিকের সিগারেটের দোকানী, যার কাছ থেকে সে বার কয়েক ব্ল্যাক রিজেন্টের প্যাকেট কিনেছে, বাড়ির কাজের লোক, এইরকম। একটু আবছা মনে পড়ছে, বোধহয় সকালে দুধওয়ালার থেকে দুধও নিয়েছে। একি পরিচিত লোক ? তা না হলে তাকে রাত্তিরে থাকতে দেয়া হয় ? সবাই বেরিয়ে গেলে একলা গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে তাকে রেখে স্বামী অফিস যান ? যদি তাই হবে, তার চেহারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা শুনেও অফিস, বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, বন্ধুবান্ধব, কেউ আইডেন্টিফাই করতে পারলনা? কি করে হয়।
খুনের সম্ভাব্য মোটিভ নিয়েও পুলিশ যত না, কাগজওয়ালারা তার তিনগুণ গবেষণা করেছে। ডাকাতি নয়, প্রথমেই আউট। নিজের বা স্ত্রীর পুরোন প্রেম প্রীতির ব্যাপার হলে বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কিছুটা জানবেই। আর একটা সম্ভাবনা হল, কারোর কাছ থেকে ঘুষ টুস নিয়ে তারপর তার কাজটা করে না দেয়া । অফিস থেকে জানা গেল, ভদ্রলোক এক্সিকিউটিভ ছিলেন ঠিকই, তবে কেউ মোটা অঙ্কের ঘুষ দেবে এমন ক্ষমতা ছিলনা তাঁর হাতে। তবে?
হয়তো এতদিনে জানা গেছে, হয়তো সে ধরা পড়েছে, কিন্তু আমি কোথাও সে খবর পাইনি। ঝাড়খন্ডের কাগজ অবশ্য পড়িনি।
সেই ঘটনাটা পড়ার পর থেকেই একটা জিনিষ মাথায় ঘুরছে, এত যে কাগজে পড়ি খুনের আখ্যান, চুরি ডাকাতির কথায় আসছিনা এখন, শুধু খুন, বাড়িতে ঢুকে বা রাস্তায়। কেউ কোনওদিন শুনেছে, যে ঠিক সময়ে অন্য কেউ এসে পড়ল, বা তাড়া করল, বা ধরে ফেলল? আমি শুনিনি। হতে পারেনা? এই গোমিয়ার কেসটাতেই লোকটা দু রাত্তির কাটিয়েছে সে বাড়িতে। ওখানে সহকর্মী, ছেলে মেয়ের স্কুলের বন্ধু, পাড়ার লোক, এরা যেতনা এমন নয়, কিন্তু ওই দেড় দিনে একবারও যায়নি। কাজের লোকের মনেও এ প্রশ্ন আসেনি, যে একটা অচেনা উটকো লোক, ওরকম খালি গায়ে তোয়ালে পরে কেন বলবে কাজ করতে হবেনা? আসলে এক দিন ছুটি পেয়ে তার মহা আনন্দ, সে সময়ে স্বাভাবিক যুক্তিগুলো কাজ করেনা। লোকটা কি জানত, একটা পুরো দিন ও রাত্রে কেউ আসবেনা ? এলে কি করত, তাকেও খুন করত ? একাধিক বা বলশালী কেউ এলে ?
এটা দুহাজার বারো সালের সেপ্টেম্বর। গত দিন দুয়েকের মধ্যে বেহালার প্যারিস পাড়ায় ঐ রকম এক বাড়ির চারজন খুন হয়েছেন। এখানেও মোটিভ পাওয়া যাচ্ছেনা, কারণ বোঝাও যাচ্ছেনা। অবশ্য এটা কোলকাতা পুলিশের এলাকা, ঝাড়খন্ড নয়, এনারা চাইলে সব কিনারা করতে পারেন। ( এই ঘটনাটি লেখার দু-একদিন পরেই পুলিশ কেস সমাধান করে ফেলেছে, খুনিও ধরা পড়েছে, আগেই বলেছিলাম এটা কোলকাতা(কলকাতা) পুলিশ)। অবশ্য প্রসিকিউশন ঠিক মত হবে কিনা জানা নেই, নাকি সেই নাতনির বয়সী মেয়ের সঙ্গে ইন্টু করে, তার বাড়িশুদ্ধু সবাইকে খুন করে, কিছুদিন ‘মুক্ত’ সংশোধনাগারে কাটিয়ে তারপর ড্যাং ড্যাং করে – নাঃ এবার আমার নিজেরই ফাঁসি হয়ে যেতে পারে আইন কানুন নিয়ে প্রশ্ন তোলার অপরাধে। বেহালার অক্সিটাউনের ঘটনাটা তো আরও চমৎকার, সবাই সব জানে, অথচ কেউ কিচ্ছু জানেনা। এখানকার খুনিকে তো সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ধরাই গেলনা। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়, খুন কি আটকানো যায় ? কোথাও গেছে ? কেউ শুনেছে এমন ঘটনা ?
শুধু খুন নয়, ক’দিন আগে একটি আড়াই বছরের ছেলে, তার নিজের বাড়িতে, বালতির জলে ডুবে মারা গেল। তার মায়ের সুগার ছিল বলে সকালে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, বাবা ঘুমোচ্ছিলেন, সে গুটিগুটি বাথরুমে ঢুকে বালতির মধ্যে প্রথমে একটা ব্রাশ ফেলে, তারপর সেটা তুলতে গিয়ে নীচু হয়, তারপর আর সামলাতে পারেনা। বেচারা সঙ্গে সঙ্গে তো মারা যায়নি, ঐভাবে ঝুঁকে পড়ার বা বালতিতে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে মা ফিরে আসতে পারতেন, বাবার ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারত, কিন্তু এসব কিছুই হয়নি।
ম্যানড্রেক, ফ্যান্টম, স্পাইডারম্যান বা সুপারম্যান ঠিক সময়ে চলে এসে কত কিছু আটকে দিয়েছে। সলমন, শাহ্রুখ বা আগেকার ধর্মেন্দ্র, মিঠুন কিংবা অমিতাভ-ও। সেই জন্যই মাল্টিপ্লেক্সেও টিকিটের হাহাকার। মানুষ অবচেতনে জানে বিপদে রক্ষা করার কেউ নেই, তাই স্বপ্নের রক্ষাকর্তাদের আঁকড়ে ধরে। ড্যানিয়েল পার্ল, সঞ্জয় ঘোষ বা সৌম্যদীপ বসুও হয়তো ভেবেছেন, আহা, শেষ মুহূর্তে কিছু একটা হবে, হয়নি।
আমরি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভয়ার্ত পনের বছরের মেয়েটা বাবা কে ফোন করেছিল, খুব ধোঁয়া, ভয় করছে। ওটা অর্থোপেডিক ওয়ার্ড, তার একটা পায়ে পুরোটা প্লাস্টার। দৌড়নো বা হাঁটার ক্ষমতা ছিলনা। বাবা উর্ধশ্বাসে পৌঁছে গেছিলেন সময়মতই, তখন ক্যাটাস্ট্রফির অনেক বাকি। সিকিওরিটির লোকেরা ওপরে উঠতে দেয়নি। বিল না মিটিয়ে পেশেন্ট ছাড়া যাবেনা। আর বিল মেটানোর কেউ নেইও এখন। সব যখন শেষ,আনন্দবাজারের সাংবাদিককে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাবা বললেন, মেয়েটা শুধুশুধু মরে গেল, জানেন ?
আজমল কাসভের ফাঁসি হবে শোনা যাচ্ছে। সিকিওরিটির লোকটার নামই জানেনা কেউ, ফাঁসি হওয়া বা নিদেনপক্ষে এক সপ্তাহ জেল হওয়ারও গল্প নেই। অপরাধ কিন্তু একই, অপরের নির্দেশে বহু লোকের মৃত্যু ঘটানো। এটাকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ বললে, আর যে মানে মানুক, আমি মানতে রাজি নই। সে তো বলতে পারত, নামিয়ে আনতে পারেন, তবে রিসেপশনে বসে থাকতে হবে, বাড়ি যেতে পারবেননা। মালিক টোডি বেল পেয়েছেন, আখেরে কেসটা কি হবে সেটা প্রশ্ন নয়। পনের বছরের মেয়েটা হয়তো স্পাইডারম্যানের কমিক পড়তনা, তার কাছে সব মেয়ের মত বাবা-ই সর্বশক্তিমান। বাবাও পারলেননা, ‘মেয়েটা শুধুশুধু মরে গেল, জানেন’ ছাড়া আর কিছু বলতে।
যাঁদের তর্ক করার ইচ্ছে, তাঁরা বলবেন আমরিতে সবাই মরেছে নাকি ? পাশের বস্তির ছেলেগুলো তো প্রায় স্পাইডারম্যানের মতই দেয়াল বেয়ে উঠে কতজনকে বাঁচিয়েছে। আমার উপপাদ্য একটু অন্য। যাঁদের মরার কথা ছিল, তাঁরা মরেছেন, কেউ বাঁচাতে পারতনা তাঁদের। এই মেয়েটির বাবা তো আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয়েছিলেন। দেয়াল বেয়ে নয়, ধীরে সুস্থে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই তো মেয়েকে নামিয়ে আনতে পারতেন।
আমার মাঝে মাঝে মাথায় সব উদ্ভট কথা খেলে যায়। এই যে ডেঙ্গুজ্বরে (কিছুতেই ডেঙ্গি লিখবনা) কতলোক মারা যাচ্ছে, একসময়ে ম্যালেরিয়া বা এনসেফেলাইটিসেও মরেছে। প্রতি বছর রোড অ্যাকসিডেন্টে কত লোক মারা যায়, তার খতিয়ান তো কাগজে প্রায়ই দেয়। তাছাড়া নেট খুললেই সব স্ট্যাট এখন নখের ডগায়। এই সব খুন টুনের কেসে যারা কনভিকটেড হয় বা পার পেয়ে যায়, তাদের একজনেরও কি সেভাবে পরলোকপ্রাপ্তি হয়েছে, যাতে বলা যায়, দেখেছ, ‘ভগবানের মার, দুনিয়ার বার’ ?
হ্যাঁ হয়েছে। সম্পদ মুখার্জী মুখে গ্যাঁজলা উঠে আর বাবুলাল পাইখানার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে নাকি জেলের মধ্যেই মারা যায়। এ খবর পড়ে কেউ হাসতেও পারে কাঁদতেও পারে। আসলে কি হয়েছে শ্যামলাল জানে কিংবা সেও জানেনা। তবে ডিভাইন জাস্টিস কোনও মতেই নয়। অনুমান জিনিষটার ওপর কারো হাত নেই, তবে আমি যতটুকু কাগজে বেরোয় ততটুকুই লিখতে পারব। যদি কেউ বলেন সম্পদ মুখার্জী বা বাবুলাল কে? তবে জানাব, প্রথম জন কুন্তল সাঁই এবং পরের জন ডাঃ শৈলেন দাস হত্যাকান্ডের আসামী। বাকি জানতে খবরের কাগজের আর্কাইভ ঘাঁটতে হবে।
‘পরিত্রাণায় সাধুনাং
বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম
ধর্মসংস্থাপনার্থায়
সম্ভবামি যুগে যুগে’।
স্যারকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এগুলো নাকি আপনার, থুড়ি আপনার অথরাইজ্ড ডিভাইন রিপ্রেসেন্টেটিভের কথা ?
স্যার বাংলা সচরাচর বলেননা, সেদিন বললেন, ‘ওই আনন্দেই থাকো’।
(চলবে)