এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • ধানাই পানাই ২০

    রূপঙ্কর সরকার লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৭ জানুয়ারি ২০১৩ | ১২২২ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০

    ঝিলমিল ঝিলমিল
     
    ছেলেটা বলল, মামা, হোয়াই ডিড দি ওল্ড গাই টেল ইউ, গুঠে পোরে আর গোবর হাসে? হোয়ট ডাস দিস মীন? ফানি ওল্ড ম্যান এইন্ট হি?
     
    ইঁদুরদেব পেডেস্টাল থেকে সব শুনেছেন, বললেন, খাইসে, এ যে দেহি মায়রে মামা কয়, মামারে কি কয় তাইলে, মাসি? অবইশ্য মাসির গুপ হইলে তারে নাকি মামা কওন যায় হুনছিলাম। তা হ্যার মায়ের তো গুপ টুপ নাই?
     
    মা বললেন, নট গুঠে ডার্লিং, ইট’স ঘুঁটে, কেক্‌স মেড অফ কাউডাং। ছেলে বলল, কেক্‌স? ও শ্‌শ্‌শিট্‌। মা বললেন, ইয়া ডার্লিং, শিট্‌ বাট ক্যাট্‌ল শিট্‌। ছেলে বলল, বাট মামা, হোয়ট ডু দে ডু উইথ ক্যাট্‌ল শিট্‌? মা বললেন দে বার্ন ইট হানি, ফর কুকিং। ছেলে বলল, বাট মামা হোয়াই ডু দে – আস্তে আস্তে শব্দটা হালকা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে, ওরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে কার পার্কিং-এর দিকে, ওদিকে অবশ্য কোনও পার্কিং নেই কিন্তু কোলকাতায় নাকি নেই বলতে নেই, সব বাড়ন্ত। মাসিক বন্দোবস্ত করলে গাড়ি কেন, হাতিও পার্ক করা যাবে।
     
    ইঁদুরদেব বললেন হ্যারে, ইয়ারা কি তগো পচ্চিম বইঙ্গের, নাকি আমাগো – বললাম, মনে তো হচ্ছে তোমাদের ‘দ্যাশের’।
    পশ্চিমবঙ্গবাসী এখনো একটু আধটু বাংলা টাংলা বলে। মাউস গড বললেন, তরা বোঝবি না, এইডা হইল ওভিমান, দ্যাশই যখন নাই ভাষাডা আর খাম্‌খা বইয়া বেরাই ক্যান। তয় এইডা কিন্তুন আমারে বুঝাইতে পারলিনা, পোলাডা মায়রে মামা ডাকে ক্যান?
     
    আমি বললাম, দেখ, সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হল, ছেলেটা ‘ঘুঁটে পোড়ে আর গোবর হাসে’ শুনে কিচ্ছু বোঝেনি। ঘুঁটে জিনিষটা সে জীবনে দেখেনি, ভবিষ্যতেও দেখার আশা নেই। শহরে তো নয়ই, কিছুদিন পর গ্রামেও। এর পর যদি এই প্রবচনটা শোনে, ‘যার শিল যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’, তাহলে আরও ঘাবড়ে যাবে কিনা বল তুমি?

    আমাদের কনস্ট্যানশিয়া বিল্ডিং এর পাfশেই নামকরা ইংরিজি মাধ্যমের ইস্কুল। বিত্তবান মানুষদের ছেলেপিলেরা পড়ে। তারা দুধরণের ইংরিজি শেখে, একরকম লেখার জন্যে, আর এক রকম বলার জন্যে। বেশ কিছু কড়া টাইপের ইংরিজি মাধ্যম ইস্কুল আছে, যেখানে ছাত্রদের নিজেদের মধ্যেও কোনও ভারতীয় ভাষায় কথা বলা নিষেধ। আর তারা যাতে সহজেই কথোপকথনটা বজায় রাখতে পারে, তাই তাদের বাবা মা-ও সেই ভাষাতেই তাদের সঙ্গে কথা চালান। তবে সেজ পিসির ছেলে ইউ কে থেকে বেড়াতে এলে ভীষণ মুশকিল। মামা, রিভুদাদা স্পীক্‌স আ ডিফ্রেন্ট টাইপ অফ ইংলিশ না?
     
    তবে যে সব ইংরিজি মাধ্যম ইস্কুল ততটা কড়া নয়, বা যে বাচ্চাদের মায়েদের একটানা কিছুক্ষণ অমন বিচিত্র বাক্যালাপে দখল নেই, তাদের আবার অন্য এক ধরণের কথা শোনা যায়। সেদিন অটোরিক্সাতে শুনলাম, ওকি, ওয়াটার বট্‌লটা ঠিক করে হোল্ড করো, যদি ড্রপ করো, তাহলে ডার্টি হয়ে যাবে।
     
    আমি বললাম, আচ্ছা মূঠা,- মাউস গড খচে গেলেন, কী, তর এত্ত বরো আস্পদ্দা, আমারে মোটা বইল্যা গালি দ্যাস? আমার মালিকরে মোটা কইলে তাও – আমি বললাম, আহা রাগ করো কেন, তোমায় মোটা কখন বললাম, জাননা আজকাল অ্যাক্রোনিমের যুগ, আমি তো ‘মূঠা’ বললাম। বড় করে বললে, মূষিক ঠাকুর। তোমাকে গালি দেব এমন সাহস আছে আমার? ইঁদুরদেব খুশি হয়ে বললেন, আইচ্ছা, বোঝলাম। ক অহন, কি কইতেয়াসিলি।
     
    আমি বললাম, দেখ, জীবন থেকে বেশ কিছু জিনিষ হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন ঘুঁটে আর শিলনোড়ার কথা তো বললাম। কিন্তু প্রবচনগুলো তো এখনও চালু। এই নিয়েই মহা মুশকিল, সময়মত মুখে তো এসে যাবেই। ধরা যাক, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। এবার ছেলে বলবে মামা, হোয়ট ইজ আ কুলো? মা বলবেন, ইট্‌স্‌ আ –আ- সর্ট অফ ট্রে ইউ নো, ইউজড টু সেপারেট হাস্ক অ্যান্ড গ্র্যাভেল ফ্রম রাইস। ছেলে বলবে, বাট মামা, হোয়াই শুড দেয়ার বি গ্র্যাভেল ইন রাইস? মা রেগে গিয়ে বলবেন, বিকজ ইউ লিভ ইন ইন্ডিয়া স্টুপিড। নাউ শাট আপ।
     
    ইঁদুর ঠাকুর, তাও তো এখনও সেইটা বলিনি, সেই যে, ‘ ফোঁস করবার মুরোদ নেই কুলোপানা চক্কর’। এটা শুনলে মামা আর ভাগ্নে, থুড়ি ছেলে আরও বিপদে পড়ত, বল? হারিয়ে যাচ্ছে, জান, বেশ কিছু জিনিষ সংসার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, জীবন থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে, শুধু প্রবচনে টিকে থাকছে। আচ্ছা, তুমি এই প্রবচনটা শুনেছ? ‘সফরি ফরফরায়তে’? জিনিষটা একটু স্যাংস্কৃটাইজড করা হয়েছে, আসলে সমোস্‌ক্রিতো নয়, পাতি বাংলা। মানেটা কি বলতো? পুঁটি মাছ বেশি ছটফট করে। পুঁটি মাছ মানে, চুণোপুঁটি। চুণোপুঁটি নিয়ে একটা গপ্পো বলি শোন। আমাদের বাড়ির একটা বাড়ি পরেই একটা বিশাল ঝিল ছিল। তার একটা দিক রাস্তার প্রায় ধার থেকে শুরু আর ওদিকটা দেখাই যেতনা। মনে হত সমুদ্র। দূরে তপনকাকাদের একমাত্র বাড়িটা রাস্তা থেকে দেখে মনে হত, ঠিক যেন একটা দ্বীপের মধ্যে বাড়িটা একলা দাঁড়িয়ে। ওদের বাড়ির কাছেই একটু কম জলে কয়েকটা তেরছা করে দাঁড় করানো পাথর থাকত। রাত দুটো থেকে ধোপারা এসে সেই পাথর গুলোর ওপর কাপড় কাচত, থপ্‌ থপ্‌ থপ্‌। আমি মাঝে মাঝে ছুটির দিনে রাস্তার ওপর ঝিলের পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম চুপটি করে। একটু হাওয়া দিলেইএকের পর এক ঢেউ এসে ছলাৎ ছলাৎ করে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে। আমার বুকের মধ্যে না, শচীন কত্তার সেই গানটা গুনগুনিয়ে উঠত, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে, ঢেউ খেলিয়া যায়, ঝিলমল ঝিলমিল’-
     
    খারা খারা, অহন ওই পোলাডা যুদি তার মায়রে নাকি ওই মামারে ঝিল মানে জিগায়, হেও তো কইতে পারবনা। কইলকাতায় তো ঝিল বইল্যা অহন আর কিছু নাই। কইলকাতায় ক্যান, গেরামের দিকেও নাই। দুই চাইরডা পুষ্করিণী বাইচ্যা আসে, কিন্তুন তাগো আয়ুও তো বেশিদিন নয়। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, কি জান ঠাকুর, এগুলো হবে, আটকানো যাবেনা। প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীতে কজন জন্মাচ্ছে জান? চার জন। ইঁদুরদেব বললেন, ওহ্‌, মুটে চাইর? তাইলে গাব্‌রাস ক্যান? আমি বললাম, দাঁড়াও, আরও আছে। প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীতে মারা যায় দুজন, তাহলে সারপ্লাস থাকছে দুই। সেকেন্ডে দুই, তাহলে মিনিটে দুই ইন্টু ষাট, মানে একশ’কুড়ি, ঘন্টায় সাত হাজার দুশো আর দিনের শেষে এক লক্ষ বাহাত্তর হাজার আটশ’ বাড়তি লোকের ভার সইছে পৃথিবী। এবার যুদ্ধ, নাশকতা, সুইসাইড বমিং, দুর্ভিক্ষ, অগ্নুৎপাত, সুনামি, ডেঙ্গু, এইডস, ক্যান্সার, শিশুমৃত্যু সব ছাপিয়েও এক লক্ষ বাহাত্তর হাজার করে লোক বাড়ছে । ঝিল কেন, এই ছেলের ছেলে, ‘ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া’ প্রবচনটি শুনে তার মাকে জিজ্ঞেস করবে, মামা, হোয়ট’স ‘ঘাস’? মা বলবেন ডার্লিং, ওয়ান্স দেয়ার ওয়্যার লিট্‌ল স্ট্র্যান্ডস অফ গ্রীন – মূষিক দেব বললেন, থাম থাম, এইসব হুইন্যা আমারই ভয় করতেয়াসে, আমি বলে দেবের বাহন –
     
    আমি বললাম, থাক তাহলে, তোমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। তুমি বরং সেই পুঁটি মাছের গল্প শোনো। আমাদের বাড়ির পাশে ঝিল তো ছিলই, বাড়ির উল্টোদিকেও আর একটা ছিল। পুকুরও ছিল বেশ কয়েকটা বড় বড়। চক্কোত্তিবাবু বলে এক নিঃসন্তান ভদ্রলোক সেই পুকুরে ইজারা নিয়ে মাছ ধরাতেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মাঝে মাঝেই বারান্দায় এসে, ও বৌদি, এটা খোকার জন্য, বলে একটা ধড়ফড়ে কাতলা ছুঁড়ে দিয়ে যেতেন। ভারী বর্ষায় এদিকে জল জমত ভালই। পুকুর ঝিলটিল সব ভেসে যেত। দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে আসেপাশের বাড়ির বাগানে এক হাঁটু জলে ইয়া বড় বড় শোল মাছকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। আমার পুরোন পাড়ার বন্ধুরা একদিন আমায় ধরল, অ্যাই তোদের ওদিকে নাকি ঝিল টিল আছে অনেক? চ’ না, একদিন রোববার দেখে মাছ ধরার প্রোগ্রাম বানাই। দেবু, বাচ্চু আর মোচা চলে এল ছিপ টিপ বাগিয়ে। আমি জীবনে মাছ ধরিনি, তবু আমিও একটা ছিপ আর গোটা কয়েক বঁড়শি কিনে ফেললাম। সারাদিন ঠায় বসে উঠল শুধু একগাদা চুণোপুঁটি। আমি অবশ্য একটাও ধরতে পারিনি।
     
     
    বন্ধুরা বিফল মনোরথে মুখ শুকনো করে বলল, যাঃ শালা, শুধু চুনো? আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলল, মাসীমা, এই দেখুন, কত্ত মাছ। মা বলল, এগুলো কি হবে? দেবু বলল, ভাজা খাবেন, ডালের সঙ্গে, হেভি লাগে। ,মা বলল, পাগল? এই সব ভেজে তেল নষ্ট করি? তোমরা খাবে তো বল, ভেজে দিই। এক পেট সিঙাড়া খেয়ে ওরাও খেতে রাজি নয়, কি আর করি, কোনও জিনিষ নষ্ট হলে আমার বড় কষ্ট হয়। নিজেই গোটা চারেক খেলাম মুখ বেঁকিয়ে, বাকি সব বেড়াল কে ধরে দেয়া হল, সেও খুব একটা ইন্টারেস্ট দেখালনা।
     
    ধীরে ধীরে ঝিল ভর্তি হতে লাগল, পুকুরগুলোও। কি সব আইন টাইন নাকি আছে। আমাদের দেশে আইন লেখা হয়, এক নম্বর, শুধু লেখার  জন্যই, দুই নম্বর, সেটা ভাঙা হচ্ছে কিনা দেখার কথা যাদের, তাদের কিছু অর্থাগমের জন্য। আমাদের এলাকায় এসে কেউ যদি বাড়ি বানাতে চায়, তার জমিও লাগবেনা, অপরের বা সরকারি জমিতেই দিব্যি বাড়ি বানাতে পারবে। স্যাংশন করা প্ল্যানেরও দরকার নেই। তা যাকগে, সেই বিশাল ঝিল ভর্তি হতে হতে শুধু দেবাদের বাড়ির পাশে একটা কাঠা দেড়েক জায়গায় বেঁচে রইল কয়েক বছর। একটা মাছরাঙা পুরোন অভ্যাস বশে প্রতি বর্ষায় দেবাদের ছাদে বসে কির্‌র্‌র্‌র্‌- করে ডাক দিয়ে কাঁদতো। ওই দেড় কাঠা ভরে যাবার পরেও এসেছে বেশ কয়েক বছর।
     
    দেশে তখন সাম্যবাদ। শুধু আমাদের এলাকার ঝিল বা পুকুর ভরাট হবে, তা তো হয়না, চতুর্দিকেই হতে লাগল। একদিন বাজারে গিয়ে দেখি কলাপাতায় চুনোপুঁটি সাজিয়ে বিক্কিরি হচ্ছে। হো হো করে হেসেই ফেললাম, চুনোপুঁটি, তাও আবার বাজারে? আমাদের উঠোনেই তো ভর্তি হয়ে থাকে। তারপর বর্ষার জল শুকোলে রাশি রাশি রূপোর টাকার মত মাছগুলো কাদায় ছটফট করে। পাড়ার গরীব বাচ্চাগুলো আঁজলা করে তুলে নিয়ে যায়, আমরা কোনওদিন বারণও করিনি।
     
    দিনকাল পাল্টাচ্ছে, আমারও বয়স বাড়ছে। তবু নস্টালজিয়া তাড়া করে যে। বৃষ্টিতে জল জমলে আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কত মাছকে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম, এখন শুধু প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ভেসে যায়। দীনেশকে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁরে, এলাকায় কি একটাও পুকুর আর নেই? রাস্তায় আজকাল মাছ দেখিনা? দীনেশ বলল, এখন তিরিশ লাখ টাকা কাঠা যাচ্ছে, পুকুর আর থাকে? আগে বাচ্চারা কাগজের নৌকো ছাড়ত, এখন তো অন্ধকার ঘরে ভিডিও গেম খেলছে, ওসব বোকা বোকা জিনিষে কার আগ্রহ? মনটা খারাপ লাগে। তা লাগুক, দেশ এগিয়ে চলেছে। সেদিন বাজারে গিয়ে আবার দেখি কলাপাতায় চুনোপুঁটি। নাঃ খাবার ইচ্ছে হয়নি, এমনি ঔৎসুক্য বশে জিজ্ঞেস করলাম, কত করে হে? মাছওয়ালা বলল, চল্লিশ করে দিয়েছি, কতটা দেব? আমি বললাম, বাপ্‌রে, চ-ল্লি-শ টাকা কিলো? চুনোপুঁটি? দিনকাল কি হল? মাছওয়ালা ঠোঁটে তর্জনী ঠকিয়ে বলল, আস্তে, আস্তে কাকু, কেউ শুনলে যা হাসবে না – আপনাকে আমি একশ’র দাম বলেছি, কিলো চারশ’ টাকা।
     
    হে মূষিক দেব, গল্পটা এইখানে শেষ করলে একটা বেশ মজাদার অথচ শকিং এন্ড হ’ত। ছোটগল্পে তাই হয়। কিন্তু আমি শেষ করতে পারলামনা। এই জন্যই আমার লেখক হওয়াও হলনা। তা না হোকগে, দুঃখ নেই। কিন্তু এই খানে শেষ করলে বিপদও ছিল। ধর আজ থেকে বছর পাঁচেক পর কেউ এটা পড়ল। সে তো মুখ ভেটকে বলবে, ফুঃ এ কবেকার লেখা গো, এখন তো বারোশ’ টাকা কিলো যাচ্ছে।
     
     গত বছরের আগের বছর, মানে দুহাজার দশ সালের এক বর্ষার জল জমা দিনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম উদাস মনে। রাস্তায় মাছ দেখা যায়না আজ বহুকাল হ’ল। দেখা যাবার কোনও সম্ভাবনাই নেই, গত দশ পনের বছরের মধ্যে দেখা যায়নি। কেননা এই রাস্তার আসেপাশে বা চতুর্দিকে যতদূর দেখা যায়, কোনও ঝিল বা পুকুর নেই। শুধু বিকটদর্শন ফ্ল্যাটবাড়িগুলো দম বন্ধ করা আবহাওয়া মেখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু অঘটন কি ঘটতে পারেনা? ঘটুক না একবার, মাত্র একবার?

    আমি মাঝে মাঝেই লিখি না, যা চাই তা সঙ্গে সঙ্গে হয়, কিভাবে তা বুঝিনা। হঠাৎ দেখি হরেরামের দাঁড় করানো ট্যাক্সিটার তলা থেকে কি একটা কালোমত বেরিয়ে একটু পাক খেয়েই আবার সাঁৎ করে ঢুকে গেল। কিরে বাবা, ব্যাং ট্যাং হবে বোধহয়, যখন ভাবছি, তখন আবার বেরোল। এবার ধীরে সুস্থে, লেজ টেজ নাড়িয়ে, চারদিকে চক্কর খেয়ে আমার কাছাকাছি এসে মুখ তুলে একটু বুড়বুড়ি কেটে আবার ট্যাক্সির তলায় চলে গেল।
     
    সম্ভব নয়, হতে পারেনা, কিন্তু হ’ল। চেয়েছি বলেই বোধহয়। আমার কেবল অযান্ত্রিক ছবিটার শেষদৃশ্যে সেই ভেঁপুটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ও ইঁদুর ঠাকুর, গল্প শেষ, দি এন্ড।



     
     
     
     
    পরেশ চন্দ্র সরকার
     
    হঠাৎ গাঙ্গুলী সাহেবের ফোন, একটু আসতে পারবেন? আমি বললাম, আসছি, এক্ষুণি আসতে হবে? উনি বললেন, হ্যাঁ এক্ষুণি।
     
    কয়েকদিন আগে গাঙ্গুলীসাহেব মারা গেলেন। বাইপাস হয়েছিল। তা ভালই হয়েছিল অপারেশন, কোনও সমস্যা ছিলনা। আই সি সি ইউ তে গিয়ে নিউমোনিয়া হয়ে গেল। এ বয়সে নিউমোনিয়া ধরলে সচরাচর কেউ ফেরেনা, উনিও ফেরেননি।
     
    আমার যখন স্টেন্টিং হয়, আমাকেও আইসিসিইউতে পুরল। সোজা আঙুল বাঁকালে ঘি একটু বেশি ওঠে। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সিনেমায় যে রকম আইসিসিইউ দেখায়, মানে এসি বসানো কাঁচের ঘর, মাথার কাছে মনিটর, ডাক্তার-নার্সরা ছোটাছুটি করছে, বাস্তবে তা নয়। এসি টেসি আছে বটে, তবে এ ঘরটায় যত পেশেন্ট, জেনারাল বেডের ঘরেও তত থাকেনা। একেবারে গায়ে গায়ে বিছানা। বেশ কিছু মরণাপন্ন, মাঝে মাঝেই অক্সিজেনের নল খুলে, সবুজ পর্দায় ঢেকে দিচ্ছে। মারাত্মক রকমের ভাইরাস আর ব্যাক্টিরিয়ারা কবাডি খেলছে, মৃত্যুদূতরা চারিদিকে ড্যাড্যাং ড্যাড্যাং করে ঘুরছে, এখানে থাকলে বেঁচে ফেরার আশা কম। কিন্তু করব কী, মোবাইল ফোনও তো কেড়ে নিয়েছে।
     
    একটা কচি নার্স, পাঁচজনের মধ্যে একটু আলাদা, চোখে পড়ার মত চেহারা। তাকে ইশারায় ডাকলাম, সে বলল, স্যার? আমি বললাম, আরে তুমি এখানে কী করছ, তোমার তো টিভির পর্দায় থাকার কথা, এত সুন্দরী এপ্রন পরে ঘুরবে, তাও দেখতে হবে? সে বলল, স্যার বেডপ্যান লাগবে? আমি বললাম, না, লাগবে একটা অন্য জিনিষ, আমার ভাইপো দুটো বড় সিরিয়াল প্রোডিউস – হ্যাঁ তোমার ফোনটা একটু দেবে? মাত্র একটা ফোন করব। মেয়েটি চারদিকে তাকিয়ে বলল, আইসিসিইউতে পেশেন্টদের ফোন ব্যবহার বারণ স্যার, আমার চাকরি যাবে। আমি বললাম, আঃ, একটা বেডপ্যান নিয়ে এসে পর্দাটা টেনে দাওনা, কেউ দেখতে পাবেনা।
     
    ডাক্তারবাবুর নম্বরটা মনে করার চেষ্টা করলাম, দশখানা ডিজিট, এই বয়সে, জয় মা ভবানী, লেগে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ডাক্তারবাবু, আইসিসিইউতে পুরেছে, আমি মারা যাব। আধ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার শর্মা গাড়ি চালিয়ে হাজির, আমার পেশেন্ট মিস্টার সরকারকে বের করে বেডে দিয়ে দিন। আরএমও বললেন, কিন্তু স্যার, কার্ডিয়াক পেশেন্ট, অপারেশনের পর তো আইসিসি- ডক্টর শর্মা কেটে কেটে বললেন, ওনাকে বেডে দিয়ে দিন। আই উইল গিভ ইউ ফিফ্‌টীন মিনিটস, ইউ হার্ড মি? ফি-ফ্‌-টী-ন।
     
    সবার তো ডকটর শর্মা জোটেনা, সুন্দরী নার্সকে টিভির লোভও দেখায় না সবাই। আমার ভাই-ই নেই তো ভাইপো। যাক, গাঙ্গুলী সাহেব নিউমোনিয়ায় মারা গেলেন। আরো বহু লোক এভাবেই যায়। কী আর করা, দেশটার নাম ভারতবর্ষ, শহরটার নাম কোলকাতা।
     

    আমাদের বাড়ির কাছেই ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, একমাথা ঠাসা চুল আর পেল্লায় গোঁফজোড়া, সবই ধবধবে সাদা। শ্যামলা চেহারায় সাদা চুল আর গোঁফ দারুণ কনট্রাস্ট, ব্লু ডেনিমের প্যান্টস আর ঐ রকমই নীলচে একটা শার্ট পরে একটা রেসিং সাইক্‌ল নিয়ে বাজারের দিকে যেতেন, প্রায়ই দেখা হ’ত, রোববার হলে তো বটেই। হাত তুলে বলতাম, গুড মর্ণিং সার - আর দেখা হবেনা। সেই গাঙ্গুলী সাহেব, বললেন একবার আসতে পারবেন?
     
    দিনটা ছিল শনিবার। তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে, অফিস মোটামুটি ফাঁকা। করণিকরা বহুক্ষণ বাড়ি চলে গেছেন, আধিকারিকরাও মাত্র কয়েকজন আছেন। এই সময়ে গাঙ্গুলী সাহেব ডাকবেন কেন? তাছাড়া আমি ওঁর অধীনে কাজও করিনা, উনি বসেন অন্য বিভাগে, পাশের বাড়িতে। তবু সিনিয়ার অফিসার, ডেকেছেন যখন যেতেই হবে। আবার বললেন, এক্ষুণি। তার মানে কাজ গুছিয়ে যেতে পারবনা, আবার ফিরতে হবে এবং লিফট বন্ধ হয়ে গেছে, মানে, সিঁড়ি দিয়ে, কিন্তু কী এমন পরিস্থিতি যে –
     
    গাঙ্গুলী সাহেব একাই ছিলেন চেম্বারে। শুধু চেম্বারে কেন, ওঁর ডিভিশনেও কেউ নেই, চারিদিক সুনসান। আমাকে ঢুকতে দেখেই বললেন, প্যাক ইয়োর ব্যাগ, আপনাকে ভুটান যেতে হবে। আমি বললাম, ভু-ভুটান? কি-কিন্তু হঠাৎ? গাঙ্গুলী সাহেব বললেন, প্রশ্ন করবেননা, সময় বড় কম। আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্টকে খবর দিয়েছি, টিকিট নিয়ে এল বলে। আমি বললাম, দাঁড়ান স্যার, তাকে বারণ করুন। যদি যেতেই হয়, স্থলপথে যাব। আমি প্লেনে চড়তে বড় ভয় পাই। অফিসে সবাই জানে, আপনি এবাড়িতে বসেন বলে জানেননা বোধহয়। গাঙ্গুলী সাহেব বললেন, এটা কোনও কথা হ’ল? আরও সিনিয়ার অ্যাসাইনমেন্টে যাবেন যখন, তখন প্লেনে চড়তে হবেই। ওসব ভয় ফয় কেউ শুনবেনা। তাছাড়া কাজটা তো সোমবারেই করতে হবে, লাস্ট ডেট অফ সাবমিশন। আমি বললাম, সাবমিশন? কিসের?
     
    উনি বললেন, শুনুন তবে। আমাদের ডিভিশনের এক কাস্টমার ভুটান বাম্পার লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। টিকিটটা সে আমাদের দিয়ে গেছে, প্রোসীড্‌স কালেক্ট করতে। এদিকে ইনসিয়োর্ড পোস্ট করতে গিয়ে জিপিও বলছে, দেশের বাইরে ইনসিওর হয়না। আমি বললাম, হ্যাঁ, তাও তো বটে, ভুটান তো অন্য দেশ। গাঙ্গুলী সাহেব বললেন, তখন সবাই আলোচনা করে ঠিক হল, আমাদেরই একজন চলে যাবে টিকিট নিয়ে। তখন দত্ত যাবে বলে ঠিক হ’ল, তার প্লেনের টিকিট ফিকিটও কাটা হয়ে গেল, তারপর শুরু হ’ল ঝামেলা। ঘোষ এসে বলল, ও কেন যাবে? আমাদের কাডারের কেউ যাবে। দত্তই বা ছাড়বে কেন, এই নিয়ে তুলকালাম। দুটো দল হয়ে গেল ডিভিশনে। যত বোঝাই, মশাই, এটা প্লেজার ট্রিপ নয়, সোজা গিয়ে কাজ ফুরোলেই চেক নিয়ে রিটার্ন। এতে এক দিনও বাড়তি নেই, যে একটু ঘুরেঘারে দেখবেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আসলে দু পক্ষেরই জেদ চেপে গেছে, কেউ ছাড়বেনা। ব্যাপারটা এমন হ’ল, যে বাইরে বেরোলে দেখে নেব টাইপের জায়গায় চলে গেল। এদিকে আমারও জেদ চাপতে শুরু করল, তবেরে, দুদলের কাউকেই পাঠাবনা। এদিকে দিন তো বসে থাকবেনা, সোমবার হচ্ছে টিকিটের প্রাইজ মানি ক্লেম করার শেষ দিন। তাই তো বলি, এবার রামনাম জপতে জপতে কোনও রকমে আপনি প্লেনে চেপে- আমি বললাম, দাঁড়ান স্যার, সবই তো বুঝলাম কিন্তু এর মধ্যে আমি এলাম কোত্থেকে? আমি তো আপনাদের এপাড়ার লোক নই, এই দু দলের কোনওটাতেই বিলং করিনা, তবে?
     
    গাঙ্গুলীসাহেব বললেন, খবরে প্রকাশ যে, আপনি নাকি ভুটান জায়গাটা হাতের তালুর উল্টোপিঠের মত চেনেন? মানে, সময় একদম নেই তো, কোথায় যেতে হবে, কার কাছে ক্লেম সাবমিট করতে হবে, এত দেরীতে অন্য কাউকে পাঠালে – আমি বললাম, বোঝো কান্ড, আমি স্যার বার দুয়েক গেছি মোটে, আমার এক বন্ধু হাসিমারায় চা বাগানের ম্যানেজার বলে। তাই হাতের তালু হয়ে গেলাম? না স্যার, আমি কিচ্ছু চিনিনা ভুটানে। যেমন টুরিস্টরা যায়, আমি তেমনি গেছি। তারা যতটুকু চেনে, আমিও তাই। আপনি অন্য লোক দেখুন।
     
    গাঙ্গুলীসাহেব বললেন, অন্য লোক দেখব? চারদিকে তাকিয়ে দেখুন তো, কাউকে দেখতে পাচ্ছেন? কাল আবার রোববার। সোমবার প্রাইজ মানি দাবী করার শেষ দিন। কত লক্ষ টাকা জানেন? আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের পুরোটা দিয়ে দিলেও তো ওয়ান ফোর্থ হবেনা। আমি বললাম, কিন্তু স্যার, আরও সমস্যা আছে। আমি তো আপনার আন্ডারে কাজ করিনা, এবার আমার বস্‌ এর অনুমতি চাই তো। ট্যুর প্রোগ্রাম তো তিনিই অথরাইজ করবেন। তাছাড়া লটারির টিকিট মার্কা ট্যুর তিনিই বা  অথরাইজ করবেন কী করে, আর কেনই বা করবেন।
     
    গাঙ্গুলীসাহেব আমার হাত ধরলেন, রূপঙ্কর, ভাই আপনি চলে যান। আপনার বস ফস সব আমি বুঝব। দরকার পড়লে হেড অফিসের স্পেশাল পারমিশন আনাব। আপনি রওনা হোন। যদি প্লেনে না যান, তাহলে ট্রেনের টিকিট এই একদিনে পাবেন? দেখুন চেষ্টা করে। আপনার তো পথখরচের টাকাও লাগবে। এখন ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেছে, তাই আমি নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকা তুলে রেখেছি, এই নিন। আপনি ফিরে এসে কনভেয়ান্স বিল তুলে আমায় টাকা ফেরৎ দেবেন। যান, প্লীজ, দেরী করবেননা।
     
    চলে গেলাম ডেকার্স লেন। একজন ট্রাভেল এজেন্ট চেনা ছিল। গিয়েই বললাম, এখন কী করে, অসম্ভব, পাগল নাকি, এইসব ডায়ালগ না মারিয়ে কালকের মধ্যে এনজেপি পৌঁছনোর ব্যবস্থা করুন, টাকাটা ফ্যাকটর নয়। তিনি বললেন, বাঃ- আমি বললাম, আগেই তো বলেছি, চেনা ডায়ালগ চলবেনা। তিনি হাত পা আলগা করে বসে বললেন, মহা মুশকিলে ফেললেন তো। আমি বললাম স্বীকার করছি। বাড়ি গিয়ে দুখানা ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম। ঘরে আনকোরা নতুন বৌ, মা বলল, একলা যাবি কিরে, ওকে নিয়ে যা। আমি বললাম, বেড়াতে যাচ্ছিনা আমি, ঝামেলার কাজ। মা বলল, তবে ক্যামেরার ব্যাগ নিলি যে বড়? আমি বললাম, ওটা অভ্যাস।
     
    ট্রেনটা রাতের, কিন্তু ঘুম টুমের গল্প নেই। গাঙ্গুলী সাহেব বলেছিলেন, দেখুন, একে তো ইনসিওর্ড পোস্ট নেবেনা। তখনই মাথায় এল, ওদের দেশের নিয়ম কানুন কেমন কে জানে। আমরা এমনিতে লটারির টিকিট জমা পড়লে আমাদের সীল দিয়ে ক্রস করে দিই, যাতে আর কারো হাতে পড়লেও টাকাটা তুলতে না পারে। যেই মনে হ’ল ওদের দেশে একুশে আইন থাকতে পারে, ওমনি সেটাও আর করিনি। তার মানে বুঝছেন তো? টিকিটটা ওপেন, যে পাবে তার। আপনি ব্রীফ কেসেটেসে টিকিটটা নেবেননা যেন, আজকাল ট্রেনে ছিনতাই টিনতাই হচ্ছে খুব।
     
    টিকিটটা আমার পকেটে, একটা ফাঁকা সিগারেটের প্যাকেটের অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের পেছনে। মাঝে মাঝে, সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা দেখলেই অবহেলায় কামরার কোনায় ছুঁড়ে ফেলছি প্যাকেটটা। ভাগ্যিস সেই সময়ে কামরা সাফ করার বাচ্চাছেলে গুলো ঢুকতনা। আর ঢুকলেই বা কী, আমি তো ঠায় বসে আছি, তীক্ষ্ণ নজর প্যাকেটটার দিকে। কত লাখ টাকা এতদিন পরে সঠিক মনে নেই, কিন্তু আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, কারো কাছে এক লাখ টাকা আছে শুনলেই চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকাতাম। এখন লাখ টাকা হাতের ময়লা হলেও সে সময় লাখপতি মানে, রীতিমত বড়লোক। আমার কাছে একটা আনক্রস্‌ড ওপেন টিকিট, যার মূল্য কয়েক লাখ টাকা। টিকিটিটা যে পাবে, তার।
     
    আগে যে ক’বার গেছি, কোচবিহার দিয়ে গেছি। নিউ জলপাইগুড়ি দিয়ে যেতে হয় কিভাবে? সে ব্যবস্থাও আছে। নোটন তো নিউ জলপাইগুড়িতেই থাকে। গিয়ে ওর বাসায় উঠব, তারপর নিশ্চয় বাস ফাস আছে সেখান থেকে। যাবার আগের দিন, রোববার হঠাৎ নোটন হাজির বাড়িতে। একিরে, আমি তো তোর ওখানে উঠতে যাচ্ছিলাম। নোটন বলল, যাব্বাবা, আপনি এনজেপি যাচ্ছেন, আমি তো কোলকাতায়। যাগ্‌গে, আপনার প্রবলেম হবেনা। গিয়ে বাড়িওয়ালা পরেশবাবুকে বলবেন, ঘর টর খুলে দেবে, খুব ভাল লোক। ফ্রিজে ডিম আছে, ভাঁড়ারে চাল, ডাল সব আছে। ঘি-ও আছে সম্ভবতঃ। এক রাত্তির চালে ডালে ফুটিয়ে ডিমসেদ্ধ দিয়ে মেরে দিতে পারবেননা? গ্যাসের সিলিন্ডারও ভর্তি। বাড়িওয়ালার নামটা খালি মনে রাখবেন, পরেশ চন্দ্র সরকার। ভদ্রলোক মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ, লোকে এক ডাকে চেনে। যে কেউ বাড়ি দেখিয়ে দেবে। শুধু নামটা খেয়াল রাখবেন, পরেশ চন্দ্র সরকার।
     
    এনজেপি স্টেশনে ট্রেনটা থামল বিকেল চারটে নাগাদ। কাঁধে দুটো হালকা ফুলকা ব্যাগ, একটায় গোটা দুয়েক জামাপ্যান্ট, আর একটায় ক্যামেরা ট্যামেরা। ‘ট্যামেরা’ বলতে জুম, ম্যাক্রো, ফিলটার, ইত্যাদি। ডিজিটাল ক্যামেরা বেরোবার পর থেকে, রাস্তায় বেরিয়ে যার সঙ্গেই ধাক্কা লাগে, সে-ই ফোটোগ্রাফার। তখন তো তা ছিলনা, হাতে গোনা লোক ছবি তুলত। তাছাড়া ক্যামেরা এবং ট্যামেরা, সবই চোরা পথে কিনতে হ’ত। ইম্পোর্ট লাইসেন্স এবং ডিউটি দিয়ে কিনতে গেলে ছ’মাসের মাইনে। আমি যেখানেই যাই, ওই ব্যাগটা সঙ্গে থাকে। অবশ্য পরেশ চন্দ্র সরকারের কাহিনিতে ক্যামেরার কোনও ভূমিকা নেই। তবে বলা তো যায়না, কখন কী কাজে লাগে।
     
    এনজেপিতে নেমে এবার রিক্সা ধরতে হবে। নোটন বলে দিয়েছে, ভাড়া সাত টাকা, কিন্তু নতুন লোক দেখলে দশ ফশ চেয়ে বসবে। আপনি এক কথায় রাজি হবেননা কিন্তু। হাঃ, আমি নাকি রাজি হব না। রিক্সাওয়ালারাই তো রাজি হচ্ছেনা। দশ কেন, বিশ বললেও আমি চলে যাব, কিন্তু কেউ যাবেনা। স্টেশন থেকে বেরিয়েছিলাম খোস মেজাজেই।  স্টেশনের চত্বরেই গাদা গুচ্ছের রিক্সা, প্যাঁক প্যাঁক করে যাচ্ছে সমানে। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে সবাই একে একে উঠেও পড়ছে এক একটায়। আমি যাকেই বলি, ভাই রবীন্দ্রপল্লী যাবেন? সে-ই বলে, না, যামুনা। ধীরে ধীরে ট্রেনের ভিড়টা হাল্‌কা হতে হতে মিলিয়ে গেল। আর কেউ বাকি নেই। ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটায়। স্টেশনের সিঁড়ির সামনেই ঘুরছি এক ঘন্টা যাবৎ। বেশিরভাগ রিক্সা বেরিয়ে গেলেও, এখনও আছে বেশ কিছু কিন্তু কেউ রবীন্দ্রপল্লী যাবেনা। একজনকে ধরলাম, ভাই ভাড়া না হয় একটু বেশিই নেবেন, চলুননা। সে বলল, নাঃ ওই দিকে যাম্‌না, আপনে অইন্য গারি দেখেন।
     
    একজন, স্থানীয় লোক বলেই মনে হ’ল। বললাম, আচ্ছা দাদা, এখানে অনেকক্ষন ধরে ঘুরছি, কোনও রিক্সা রবীন্দ্রপল্লী যেতে চাইছেনা কেন বলুনতো? ভদ্রলোক বললেন, কুনও কারন নাই, শালারা হারামি, বুঝলেন কিনা? আপনে সামনের মোড়ে চইলা যান, ওইখানে ফ্লাইং রিস্‌কা ধইরা নেন, এ শালারা যাইবনা।
     
    সামনের মোড়? আচ্ছা, তাই যাই। বেশ খানিকটা হাঁটতে হ’ল। মোড়ে এসে দেখি বিভিন্ন ডাইরেক্‌শনে রিক্সা যাচ্ছে, ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পেছনে – এবার নিশচয়ই পাব। গোটা পনের রিক্সাকে বললাম, রিকোয়েস্ট করতে করতে পায়ে ধরা শুধু বাকি, একই উত্তর, নাঃ যাম্‌না। প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজে, যদিও আকাশে আলো আছে কিন্তু এবার ভয় ধরেছে। ভয়ের কারণটা যথেষ্ট রকমের মজবুত। রাত হয়ে যাচ্ছে বলে চিন্তা নেই, রেলওয়ে স্টেশনের কাছেপিঠে হোটেল মোটেল নিশ্চয়ই আছে, জলে পড়বনা। যদিও গাঙ্গুলী সাহেব পই পই করে বলে দিয়েছেন, যাবার সময়ে হোটেলটা অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করবেন, কোনও চেনা লোক নেই আপনার ওখানে, যার বাড়িতে ওঠা যায়? টিকিট জমা করে তারপর আপনি ফাইভ স্টারে উঠুন না, কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আজ রবিবার, কালকে অফিস আওয়ার্স,  তার মানে, দশটা থেকে পাঁচটার মধ্যে টিকিটটা জমা করতে হবে। হবে মানে, হবেই।
     
    এবার, এটা কোলকাতা নয়, মনুমেন্টের তলা থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় বাস ছাড়েনা। শুনলাম ভুটান যাবার বাস সেই ভোর বেলা ছ’টা নাগাদ একটা, আবার অনেক বেলায় একটা থাকতেও পারে তবে সেটায় গেলে পাঁচটার মধ্যে ভুটান পৌঁছনর কোনও চান্স নেই। হ্যাঁ, গাড়ি একটা নিয়ে নিতেই পারি, কিন্তু একলা গাড়িতে যাবার সাহস নেই। যদিও আমার পকেটে কয়েক লক্ষ টাকা মূল্যের একখানা কাগজ আছে, তা কারো জানার কথা নয়, তবু সাবধানের মার নেই। তা ছাড়া, আমার পকেটে যা টাকা আছে, মানে গাঙ্গুলী সাহেব যা দিয়ে দিয়েছেন, তাতে গাড়িভাড়া কোনও রকমে হলেও, ফেরার টাকা থাকবে কিনা জানিনা। সেই ভোরের বাস যেখান থেকে ছাড়ে, যায়গাটা এখান থেকে অনেক দূর, নোটনের ভাড়া বাড়ির কাছাকাছি সেটা। তার ওপর এখনই রিক্সা যেতে চাইছেনা, সকাল পাঁচটায় যাবে?
     
    অতএব, রবীন্দ্রপল্লী যেতেই হবে, কিন্তু কী করে? একজন লোককে ধরলাম, আচ্ছা দাদা, রবীন্দ্রপল্লী জায়গাটা কোনদিকে? লোকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, তার মানি(মানে)? আমি বললাম, না, মানে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, চারটে দিক আছে তো, জায়গাটা কোন দিকে। লোকটা হাত দেখিয়ে বলল, সে এই দিকে, কিন্তু দিক জাইন্যা কী লাভ? আপনে রিস্কা ধরেন। আমি বললাম, দাদা, চারটেয় ট্রেন থেকে নেমেছি, এখন প্রায় সাতটা। শ’খানেক রিক্সাকে তো বললাম, কেউ যাবেনা, তাই ভাবছি হেঁটেই যাই, তা কতক্ষণ লাগতে পারে? লোকটা ভাল করে আমায় আপাদমস্তক জরীপ করে বলল, অখন হাটা শুরু করলে কাইল সকাল আটটা ন’টা নাগাদ পৌছাইয়া যাইবেন। আইচ্ছা, আসি দাদা, শুভযাত্রা।
     
    দমে গেলাম। কিন্তু নাঃ, দমলে হবেনা, যেতে তো হবেই। যে দিক দেখাল, সেই দিকেই হাঁটি। লোকটা বাড়িয়ে বলেছে নির্ঘাত। বালীগঞ্জ থেকে আমাদের বাড়ির রিক্সাভাড়া পঁয়ষট্টি পয়সা, ডিসট্যান্স, এক কিলোমিটার। এটা তার দশ কি এগার গুণ, সাতটাকা ভাড়া যখন। অবশ্য সব জায়গার রিক্সাভাড়ার রেট একরকম নাও হতে পারে। যাই হোক, দশ বারো কিলোমিটারের বেশি হতেই পারেনা, শহরটা কতই আর বড়। তাহলে এখন হাঁটলে রাত দশটার মধ্যে পৌঁছব নিশ্চয়। তখন যদি শ্রী পরেশ চন্দ্র সরকার আবার ঘুমিয়ে টুমিয়ে পড়েন? সে দেখা যাবে, যাই তো আগে। রাস্তায় ছিনতাইকারী ধরলে? ফাঁকা সিগেরেটের প্যাকেটের রাঙতা উলটে দেখবে? কি জানি।
     
    হাঁটছি তো হাঁটছি, ট্রেন জার্নির ধকল, তার ওপর এইরকম আনএক্সপেকটেড টেনশন। অনেকটা হাঁটার পর রাস্তার বাঁদিকে একটা চায়ের দোকান পেলাম। একটু জিরিয়ে যাই, এককাপ চা হলে মন্দ হয়না। চায়ের দোকান হোল ওয়েস্ট বেঙ্গলে সবকটা একই রকম। ছিটে বেড়ার দোকান, সামনে বাঁশ আর একটা আড়াআড়ি তক্তা দিয়ে তৈরী বেঞ্চি। বসতে গিয়ে দেখলাম, কয়েকটা ছেলে, জনা পাঁচ ছয়। তাদের চেহারা পত্তর দেখে ইউনিভার্সিটির ছাত্র বলে কারো ভুল হবেনা, লোকাল টাফ মনে হচ্ছে, কথাবার্তাও সেই রকমই। তা যাকগে, আমার কী। ছেলেগুলো আমায় মাপতে শুরু করল, দাদা কি বায়রা থিকা আইলেন? কাঁধে দুখানা ব্যাগ, এটা আন্দাজ করতে ব্যোমকেশের দরকার নেই। বললাম, হ্যাঁ। কই থিকা আইলেন, কইলকাতা? আবার হ্যাঁ। যাইবেন কই? বললাম, আমি রবীন্দ্রপল্লী যাব, মানে, যাবার ইচ্ছে ছিল। তা হাটতেয়াসেন ক্যান, রবিন্দোপল্লী তো দূর আসে, রিস্কা ধরেন।
     
    বললাম, ভাই, একখানা রিক্সা ধরে দিনে পারবেন? বড় উপকার হয়। ট্রেন থেকে নেমেছি চারটেয়। গত তিন ঘন্টা ধরে রিক্সা ধরার চেষ্টা করছি, কেউ যাচ্ছেনা। লাল জ্যাকেট বলল, যাইত্যাসেনা? কী কইসেন আপনে, অগো? আমি বললাম, কী আর বলব, বলেছি, ভাই, রবীন্দ্রপল্লী যাবেন? কালো গলফ ক্যাপ বলল, অ্যাই তো, এইডা তো আপনের কইলকাতা না,  এইহানে ঐ ডায়ালগ অচল। সোজা রিস্কায় উঠবেন। আগে জিগাইলে কিছু কইবেননা। তারপর উইঠ্যা কইবেন, রবিন্দোপল্লী চল্‌। যুদি কয়, যাম্‌না, আপনে কইবেন, তর বাপ যাইব।
     
    আমি বললাম, না ভাই, পারবনা। আমাদের কোলকাতায় মজুর শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে খুব কম বয়সীকে ছাড়া তুমি বা তুই বলা উঠে গেছে বহুদিন, আমাদের ঠাকুদ্দার আমলে। বেঁটেমত ছেলেটা বলল, তাইলে আর আপনের রবিন্দোপল্লী যাওয়া হইলনা, এইহানেই বইয়া থাকেন। অ্যাই পোবীর, দাদারে একটা রিস্কা ধরায়া দে। এনজেপির বদনাম হইয়া যাইবগা, ওই তো এক হালা আইতেয়াসে, হালারে ধর। লাল জ্যাকেটের নাম প্রবীর, তা বোঝা গেল। সে গিয়ে রিক্সাটা দাঁড় করাল। অ্যাই, দারা, দাদারে লয়া যা, রবিন্দোপল্লী যাইব। রিক্সাওয়ালা বলল, যাম্‌না। ঠাস্‌ করে একটা চড় পড়ল গালে। এত জোরে আওয়াজ হ’ল, যে মনে হ’ল, একটা কালীপট্‌কা ফাটল। রিক্সাওয়ালা ছিটকে পড়ল মাটিতে। এবার কালো গলফ ক্যাপ গিয়ে সপাটে লাথি কষাল পেটে। লোকটা কঁক করে উঠল। আমি উঠে গিয়ে বললাম, একি, এভাবে মারছেন কেন ভাই, দরকার নেই, আমি হেঁটেই যাব। বেঁটে বলল, আঃ আপনে ছিটে গিয়া বসেন, এইডা আপনের কইলকাতার রিস্কা না, হ্যারা যে ভাষা বুঝে, তাই কওন লাগে। এই বলে সেও লাথি কষাল। অমানুষিক মার আরম্ভ হয়ে গেল, পাঁচজনই যোগ দিয়েছে। আমি আবার উঠে গেলাম, হাত যোড় করে বললাম, ভাই ছেড়ে দিন, লোকটা মরে যাবে তো। যাঃ বাইচ্যা গেলি, দাদা বালো লুক দেইখ্যা বাচায়া দিল তরে। তবে গারি চালাইতে পাবি না। গারিটা সাইড কইরা হাইট্যা বারি যা। রিক্সাটা রাস্তার ধারে রেখে, তালা দিয়ে, লোকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যাচ্ছে। আর একটা রিক্সা আসছে, প্রবীর হাত দেখাল, অ্যাই হারামজাদা, রবিন্দোপল্লী যাবি? লোকটা প্রবীরের বাবা না হলেও কাকার বয়সী। সে দূর থেকে মার দেখেছে, বলল, হ, যামুনা ক্যান, যামুতো। বেঁটেটাই বোধহয় লীডার, বলল, যান দাদা, উইঠ্যা বসেন। কার বারি যাইবেন য্যান কইলেন? আমি বললাম, শ্রী পরেশ চন্দ্র সরকার। লীডার বলল, অ্যাই, রবিন্দোপল্লী গিয়া হেই পরেশবাবু না কে, তার বারি খুইজ্যা, দাদারে এক্কেরে ঢুকাইয়া দিয়া তবে আইবি। রিক্সাওয়ালা খুব জোরে জোরে মাথা নাড়ল। আমি চায়ের পয়সা দিতে যাচ্ছিলাম, প্রবীর বলল, অ্যাই, নিবিনা। আমি বললাম, কিন্তু – ওরা বলল, আমরা কইলকাতায় গ্যালে আপনাগো পারায় চায়ের দুকানে চা খাইয়া পয়সা দিমু নাকি? অ্যাই, দাদারে ঠিকমত লইয়া যা -
     
     
    রিক্সাটা চলছে তো চলছেই, আমাদের বাড়ি যেতে বালীগঞ্জ থেকে রিক্সায় মিনিট দুত্তিন লাগে। ইনি বেশ জোরেই চালাচ্ছেন, প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। ঐকিক নিয়মের অঙ্ক ধরলেও কোলকাতার পঁয়ষট্টি পয়সার তুলনায় ভাড়া কমপক্ষে পনের টাকা হওয়া উচিত। এইবার গতি শ্লথ হ’ল, রিক্সাওয়ালা বলল, বাবু, রোবিন্দোপল্লী আইয়া পরসি, এইবার কুন দিক?  মনে পড়ল, নোটন বলেছিল, রাস্তার ডান দিকে একটা মাঠ পড়বে, আর একটা মন্দির। ওখানে গিয়ে যাকে জিজ্ঞেস করবেন সেই বলে দেবে, পরেশদা এলাকায় ফেমাস।
     
    ঐ তো মাঠ, ওই তো মন্দির, আঃ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাক। জয় বাবা পরেশনাথ, না, পরেশচন্দ্র। তিনটি মেয়ে আসছে, মাঝখানের জন বিবাহিতা, মানে, সিঁদুর টিদুর পরা। রিক্সায় বসে জিজ্ঞেস করাটা শোভন কিনা কে জানে। নেমেই পড়লাম, ইয়ে, আচ্ছা, এখানে পরেশবাবুর বাড়িটা কোনদিকে? মানে, পরেশচন্দ্র সরকার? ওদের মধ্যে একজন চট্‌ করে মুখ ঘুরিয়ে বলল, জানিনা, বলেই ধাঁ করে মুখ অন্যদিকে। সত্যি সত্যি না জানলে কিন্তু এভাবে মুখ ঝামটা দিয়ে ‘জানি না’ কেউ বলেনা। আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম। এদিকে মেয়েদের সঙ্গে অপরিচিত লোকেদের কথা বলা বারণ নাকি?
     
    একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক আসছেন মাঠের মাঝে পায়ে চলা পথ ধরে। মুখে দাড়ি, পরনে ধুতি, কাঁধে ভাঁজ করা চাদর, টিপিকাল মাস্টারমশাই। ইনি নিশ্চয়ই জানেন। আচ্ছা, আপনি কি এদিকেই থাকেন? মাস্টারমশাইইয়ের ভুরু কুঁচকে গেল, তিনি থমকে দাঁড়ালেন, কেন বলুন তো? না, মানে পরেশ চন্দ্র সরকারের বাড়িটা কোনদি- প্রশ্নটা শেষ হ’লনা, ‘বলতে পারবনা’ বলে তিনি খুব জোর পা চালালেন, প্রায় দৌড়। কিরে বাবা, পরেশবাবু লোকটা ক্রিমিনাল টিমিনাল নাকি? কেউ চেনেনা বলছে, এদিকে যে নোটন বলল সবাই একডাকে চেনে?
     
    রিক্সাওয়ালাকে একটা দশটাকার নোট এগিয়ে দিলাম। সে বলল, ভারা দিত্যাসেন ক্যান, আগে তো বারিটা খুইজ্যা দেই – আমি বললাম, আপনি তো অনেক্ষণ রিক্সা চালালেন, তারপর এখানেও মিনিট পনের কেটে গেছে, সারা রাত থাকবেন নাকি? বাড়ি ঠিকই খুঁজে নেব, আপনি এটা ধরুন। সে বলল, বাবু ছয় ট্যাহা খুচরা নাই? আমি বললাম, ছ’টাকা কেন? সে বলল, ইস্টিশান থিকা সাত ট্যাহা, মোর পার হইলে ছয়। আমি বললাম, আপনি দশ টাকাই রাখুন এতক্ষণ কষ্ট করলেন, আরও বেশি দেয়া উচিত ছিল। সে দুকান ধরে জিভ কাটল, মাফ করেন বাবু, দাদারা জানতে পারলে – আমি বললাম, পারবেনা, আপনি আসুন।
     
    এর মধ্যে আরও জনা দুয়েক লোককে জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে। একজন ‘জানিনা’ বলেছে, আর একজন কালা সেজে শুনতে পায়নি। মাঠের দুপাশে দুটো রাস্তা, একটা দিয়ে ঢুকে অন্যটা দিয়ে বেরোন যায়। প্রায় ছ’সাত বার পাক খাওয়া হয়ে গেছে রাস্তাদুটো দিয়ে, আবার আমি মাঠের সামনে। এবার মাঠের আলপথ ধরে আর একজন আসছে। অল্প বয়স, নব্য যুবক। পরনে জিনস্‌ এর প্যান্টের সঙ্গে নামাবলী পাঞ্জাবী, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, গালে উড়ুউড়ু দাড়ি। জয়গুরু, ব্যাটা নির্ঘাৎ কবি কিংবা শিল্পী, অর্থাৎ কপাল খুলল। কবিরা ওরকম রূঢ়ভাবে ‘জানি না’ বলতেই পারেনা। জানলে বলবেই।
     

    আমি একটু এগিয়েই মাঝপথে ধরলাম, আচ্ছা, এখানে পরেশ চন্দ্র সরকারের বাড়িটা কোথায় একটু বলতে পারেন? ছেলেটি দাঁড়াল, একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলল, মানে, আমি ঠিক এপাড়ায় থাকিনা তো, আপনি পাড়ার কাউকে জিজ্ঞেস করুননা। আমি বললাম, ওঃ আপনিও- ছেলেটি বলল, তার মানে? আমি বললাম, ঘন্টা খানেক ধরে ঘুরছি, যাকেই জিজ্ঞেস করি, কেউ জানে না। এদিকে রাত বাড়ছে, লোকজনও কমে আসছে। ছেলেটি বলল, তা ঠিক, এদিকে রাতের দিকে খুব কাজ না থাকলে কেউ বেরোয় না। কিন্তু কেউ বলতে পারছেনা, তা কী করে হবে, আপনি যার বাড়ি খুঁজছেন, তিনি এই পাড়ায় থাকেন তো? আমি বললাম, মানে, রবীন্দ্রপল্লীতে মাঠের সঙ্গে মন্দির আরো আছে নাকি? ছেলেটি বলল, না, একটাই মাঠ। কেউ বলতে পারছে না? আমি বললাম, না, অথচ তিনি নাকি খুব ফেমাস লোক, মেডিক্যাল রিপ্রেসেনটেটিভ।
     
    ছেলেটি বলল, আশ্চর্য তো, ফেমাস না হলেও এখানে পাড়ার সব লোককে সবাই চেনে, না বলতে পারার তো কোনও কারন নেই। চলুন আমিও আপনার সঙ্গে খুঁজি। আমি বললাম, হেঁ হেঁ, আপনি আবার কষ্ট করে – সে বলল, না না, কষ্ট কিসের, আমার বিশেষ কাজ নেই, আমি হাকিমপাড়ায় থাকি, বেশি দূর নয়। আপনি বাইরের লোক একা বিদেশে এভাবে ঘুরবেন তা কি হয়? চলুন, আমিও খুঁজি।
     
    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০
  • ধারাবাহিক | ০৭ জানুয়ারি ২০১৩ | ১২২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kumu | ***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০৬:৪৭77461
  • বসে আছি,তাড়াতাড়ি পরের অংশ লেখেন----
  • de | ***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০৭:৪১77462
  • টেনশনে ফেলে দিলেন রুপঙ্কর বাবু!
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:২০77463
  • Kumu , de - হা হা, লেখা তো হয়েই আছে, আপলোডাতে যা টাইম লাগছে। তাছাড়া ক'দিন বাদেই তো বইটা আস্ত দিচ্ছি, সব এখানে পড়ে ফেললে সেটা কে পড়বে শুনি?
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:৫৬77465
  • Anjan - না না, তেমন সাংঘাতিক রহস্য বিশেষ নেই। ছবিতে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা ভুটানী মুখোস। তবে বাকিটা জানতে ইচ্ছে তো করবেই। আসলে এটা এত বড়, যে একসঙ্গে দেয়ার অসুবিধে ছিল, তাই দুই খন্ডে।
  • kumu | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ০২:০৪77466
  • ম্লান হাসি-চমৎকার।
    ছবি গুলো কিসে আঁকলেন?কবির ছবি অপূর্ব।
    আর, এইবারে ল্যাখেন।
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ০৫:৫৮77467
  • Kumu - হ্যাঁ, খুব ভাল প্রসঙ্গ। এই বারের দুটো এপিসোড থেকেই আর আঙুল নয়, স্টাইলাসে এঁকেছি। ভাগ্যিস মেয়ে কিনে দিল। এর পর আর গোটা তিন চার পর্বের পরই এবারকার মত 'ধানাই পানাই' শেষ হবে। সেটাই সম্তভবতঃ বই আকারে প্রকাশ হবে আর ক'দিন পর। তবে এটা তো শেষ হবার জিনিষ নয়, তাই আমার ডায়ারিতে লেখাপত্তর চলতেই থাকবে। যদি সৈকত, পাই বা সিকি আবার ডাকে, আবার আসব কিছুদিন পরে।
  • Anjan | ***:*** | ০৯ জানুয়ারি ২০১৩ ১০:৪০77464
  • কি করলেন বলুন তো রূপঙ্কর দা.........।সব সময় ই ভাবছি কখন আপনার লেখা টা আসবে। বসে আছি পথ চেয়ে..........।
  • শুদ্ধ | ***:*** | ১০ জানুয়ারি ২০১৩ ০৮:১৬77468
  • এই পরেশবাবু লোকটা মহা জ্বালায় তো? এতো সেই আছে অথচ নেই কেস! হা হা হা হা হা...
  • ্রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ১০ জানুয়ারি ২০১৩ ১২:০১77469
  • শুদ্ধ, একেবারেই তাই। তবে তাকে না পেলে তো খুব বিপদ...
  • mila | ***:*** | ১৮ জানুয়ারি ২০১৩ ০৩:৪৬77470
  • দারুন :)
  • kumu | ***:*** | ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ ০৬:৫৫77471
  • রোজ একবার দেখে যাই,বাড়ী পেলেন?লেখেন্না তাড়াতাড়ি।
  • S | ***:*** | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ০৭:২০77472
  • এটার শেষে কি হোলো?
  • Prabir | ***:*** | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ১১:১৪77473
  • আর কতদিন দমবন্ধ করে বসে থাকার পরীক্ষা নেবেন স্যার ! আমরাও সমান বিপদগ্রস্থ ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন