সেই লোকটা
লোকটা ঘনিয়ে এল আস্তে আস্তে, গা ঘেঁষেই দাঁড়াল বলতে গেলে। জর্দা দেয়া পান খাচ্ছিল বোধহয়, রইসি নেশা। আজকাল অনেক সস্তা বিকল্প বেরিয়েছে কিন্তু সেসবে এর আগ্রহ নেই বোঝাই যাচ্ছে। মুখ থেকে বেশ বেনারসী গন্ধ ছাড়ছিল। মুখটা আরও নামিয়ে এনে বলল, রাত্তিরে বেরোন নাকি মেসো?
আমি ওর মেসো কোনওদিন নই। ওকে এর আগে জীবনে দেখিনি। ভবিষ্যতেও কোনওদিন দেখব এমন সম্ভাবনা বিরল। কালীঘাটের এক গলি, তস্য গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে সে আমায় জিজ্ঞেস করছে রাত্তিরে বেরোই কিনা, আমার অস্বস্তি হওয়ার কথা, বিরক্ত হওয়ার কথা, কিন্তু সে সব কিছুই না হয়ে আমি বললাম, না তেমন ভাবে আর রাত্তিরে বেরোন হয় কোথায়।
আমি সত্যি যার মেসো, তার আজকে বিয়ে। বুম্বার ভাল নাম নিলয়, আমার বড় শালির ছেলে। বুম্বার বাবা নেই বলে, আমায় একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখলাম সব ব্যবস্থা ও নিজেই করে ফেলেছে। আমায় কিছুই প্রায় করতে হয়নি। বিয়েটা পরে, এখন সেমি ফাইনাল, মানে রেজিস্ট্রি। বুম্বা নিজের গাড়িতে আমার ছোট শালির ছেলের সঙ্গে সামনে যাচ্ছে, আমার ছেলে যাচ্ছে তার বাইকে, আমরা বুড়োবুড়িরা একটা ভাড়া করা সুভ-এ অনুসরণ করছি।
রেজিস্ট্রারের অফিস কালীঘাটে একটা গলির ভেতর। অফিসটা খুব বড় নয়, আমরা যে কজন গেছি, মানে মেয়ের বাড়ির লোক সমেত, তাতে যথেষ্ঠই স্থানাভাব দেখা যাচ্ছে। রেজিস্ট্রার ভদ্রলোক ভীষণ ব্যস্ত হয়ে, আচ্ছা স্যার আপনি এইখেনে বসেন, ম্যাডাম আপনি ইদিকে আসেন, এইসব বলে যাচ্ছেন। আমি বললাম দেখুন, আপনি ব্যাস্ত হবেননা, এতগুলো লোককে অ্যাকোমোডেট আপনি কিছুতেই করতে পারবেননা। সই করতে যে কজন লাগবে তারা ছাড়া বাকিরা বাইরে আসুন। কথাটা জলে গেল, কেননা মেয়ের মেসো আর ছেলের মেসো, মানে আমি ছাড়া আর কেউ বেরোলনা।
তিনি কোনদিকে গেলেন, দেখিনি। আমি রাস্তার মোড়ে এসে সেই ভাড়া করা সুভ-টার কাছে চলে এলাম। যদিও শীতকাল, তবু রোদটা বেশ চড়া, আমি ছায়া খুঁজছিলাম। দেখি রাস্তার দুই পারে দুটো পেল্লায় গাছ। ওপাশেরটা অশ্বত্থ। এ গাছ বিলক্ষণ চিনি কিন্তু এটা কী গাছ? যেমন লম্বা, তেমনি ঝাঁকড়া। আমি ওপরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, এটা কি অশোক? এটা কি অর্জুন?
আজকাল কোলকাতায় গাছ বড় একটা দেখা যায়না। যখন কোলকাতা সবে তার সীমানা বাড়াচ্ছে, তখন রাস্তার ধারে যে সব গাছ বসানো হয়েছিল, সেগুলো বিভিন্ন ছুতোয় কাটা পড়েছে। কিছু সরকারি বদান্যতায়, রাস্তা চওড়া করার নামে, কিছু বিজ্ঞাপন সংস্থার উৎপাতে। তাদের নাকি ধরাও যায়না, কিছু করাও যায়না, এদিকে আইন কানুন, সব আছে। কিছু গাছ ঝড়ে পড়ে যায় প্রতিবছর। তাদের পরিপূরণ হওয়ার কথা, কিন্তু হয়না। ছেলেবেলায় কিন্তু বিভিন্নরকম গাছ দেখতে পেতাম। বাবা ধরে ধরে চিনিয়ে দিত, দেখ, এইটা বকুল, ওইটা জারুল, ওদিকে ছাতিম, এপাশে রেইন ট্রী। এখন লোক দেখানো গাছ লাগানো হয় বটে, কিন্তু সেই ব্যাপক বৈচিত্র হারিয়ে গেছে একেবারে।
মনটা ভীষণ খুঁতখুঁত করছিল। গাছটা চিনতে সমস্যা হচ্ছে কেন? এটা কালীঘাটের একটা অতি পুরোন অঞ্চল। এখানে রাস্তাগুলো ভাগ্যিস ভীষণ সরু, তাই হাইরাইজ ওঠেনি একটাও। বেশ কিছু পুরোন গাছও আছে। কেউ কাটেনি, কেটে কারও লাভ হতনা। গাছটা অশোক কিংবা অর্জুন। ফুল দেখলেই চিনে যেতাম কিন্তু এখন জানুয়ারী, দুটোর কোনওটাতেই ফুল ধরার সময় নয়। লোকটা ঘনিয়ে এল, একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। মেসো, কী দেখছেন, গাছ?
সেই যে জমিবাঁচাও আন্দোলন নিয়ে খুব হৈ চৈ, সেই সিঙ্গুরের পরের স্টেশন নালিকুল। ট্রেন থেকে নেমে বেশ খানিকটা উজিয়ে গেলে আঁকপাড়া। ভাল নাম অবশ্য অঙ্কপাড়া। তার কাছেই আছে চিত্রশালী। এগুলো নাকি রাজাদের আমলে আর্টিস্টদের গ্রাম ছিল, তাই এরকম নাম। সে আজ থেকে পঁচিশ তিরিশ বছর আগের কথা। তখন একেবারে হেলে গ্রাম। সন্ধের মুখোমুখি, মাঠের মাঝখানে একটা গাছ দেখে চোখ আটকে গেল। বেশি বড় নয়, কিন্তু খুব ঝাঁকড়া। দু পাশে শশার ক্ষেত। মাঝখানে আল। আলের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত গাছটা দেখে এগিয়ে গেলাম। ওপরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। পাখি হতে পারে, তক্ষক হতে পারে, অনেক নজর করেও কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। পারছিনা বলেই আরও জেদ চেপে যাচ্ছে। গাছটা চারদিক দিয়ে ঝুলে পড়েছে, অনেকটা ছাতার মত। আমি মাঝখানে ঢুকে গেলাম। মাঝখানটা প্রায় নিকষ অন্ধকার। পষ্টো শুনলাম ফিসফিস করে কেউ বলছে, আয়, আয়, আয় –
কাঁধ ধরে এক ঝটকা টান, প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। জহর বলল, ওখানে কী করছেন স্যার? সন্ধেবেলা ওদিকে কেউ যায়? আমি বললাম কেন, কী আছে ওখানে? জহর বলল, ওটা কী গাছ জানেন? শ্যাওড়া গাছ। আমি হো হো করে হেসে বললাম, ও, আর একটু হলেই শাঁকচুন্নি ধরতো? তা কজনকে ধরেছে তোমার জানাশোনা? জহর বলল, অতশত জানিনা, অন্ধকারে সাপখোপ থাকতে পারে, বিষাক্ত পোকামাকড় থাকতে পারে, আপনি আমার সঙ্গে আছেন, দায়িত্ব আমার, চলুন পা চালিয়ে। দিনের বেলা আসবেন, আপনাকে অনেক গাছ দেখাব, এখন চলুন।
লোকটা অদ্ভুত। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, বিশাল একজোড়া পালোয়ানী গোঁফ, মাথার চুলে একগাদা তেলে জবজব, হাতে বালা। হাতে বালা অনেকেই পরে শিখদের নকল করে, বিশেষতঃ একটু দাদাগিরি করার যাদের শখ। কিন্তু এর বালাগুলো, হ্যাঁ একটা নয়, প্রায় পাঁচ ছ’ টা, স্টীলের নয়, পেতলের। সবকটা এক হাতে পরা। অন্যহাতে মোটা মোটা লাল সুতো জড়ান। এরকম পাঁচ ছ’খানা পেতলের বালাওয়ালা লোক আমি আগে দেখিনি। লোকটার ভাষাও একটু কেমন যেন। কোলকাতায় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় যে সব জেলা থেকে মানুষ এসেছে, তাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের ঐতিহ্য চাপিয়ে বাংলা বলে কিন্তু এর বাংলাটা কেমন যেন। প্রথমে শুনলে মনে হয় বিহারী কষ্ট করে বাংলা বলছে। একটু ঠাওর করলে বোঝা যায়, না এটা বাংলাই কিন্তু যেগুলো আমরা শুনে অভ্যস্ত, তাদের কোনওটাই নয়। আমার কেমন জানি মনে হ’ল, লোকটা মালদা জেলার। লোকটা এই ভাড়া করা সুভ্-গাড়িটার ড্রাইভার। বলল, মেসো, গাছ দেখছেন?
লোকটা বলল, আপনি গাছ ভালবাসেন, না? গাছকে যারা ভালবাসে, গাছও তাদের ভালবাসে, ঠিক কিনা? আমি উত্তর দেবার আগেই বলল, রাত্তিরে বেরোন নাকি, মেসো? এই ধরুন, দুটোর সময়ে? আমার কথাবার্তা ভালনা। অন্য সময়ে কেউ এরকম কথা বললে, আমি ঠিক বলে দিতাম, কেন, আমি চোর নাকি, যে রাত দুটোয় বেরোব? কিন্তু পাঁচ ছ’খানা পেতলের বালা আর লম্বা গোঁফওয়ালা, অদ্ভুত উচ্চারণে বাংলা বলা লোকটাকে আমি তা বলতে পারলামনা। শুধু বললাম, না তেমন ভাবে আর বেরোন হয় কোথায়।
লোকটা বলল, গাছ কথা বলে, জানেন? রাত দুটো নাগাদ বেরিয়ে দেখবেন। অবশ্য ফাঁকা জায়গায় অত রাত করতে লাগেনা, হেঁ হেঁ কোলকাতায় তো বারোটায় সন্ধে। তাই ওদের কথা শুনতে হলে একটু বেশি রাতে বেরোতে হয়। আমি বললাম, জানি। -হেঁ হেঁ জানেন দেখেই তো আপনাকে বললাম। সব্বাইকে বলা যাবে এসব কথা? আমি সোজা ওর চোখের দিকে তাকালাম।
- তুমি কী করে জানলে যে আমি জানি?
– হেঁ হেঁ জানা যায় মেসো, সব জানা যায়।
- কী জান তুমি?
- এই, যে আপনি জঙ্গলে হারিয়ে গেছিলেন, গাছ আপনাকে রাস্তা বলে দিল –
- সে কী, সে তো উনিশশো আটাত্তর সালে। তুমি কী করে জানলে সে কথা?
রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে দলবল বেরোচ্ছে। বুম্বা বলল, ওহ্ প্রচুর বেলা হয়ে গেল। চলো আগে গিয়ে কিছু মুখে দেয়া যাক। অ্যাই সবাই গাড়িতে ওঠো, জলদি ।
লোকটার মুখে বেনারসী জর্দার গন্ধ, মুখটা হাসি হাসি। হাসির কী আছে? এখানে কৌতুক নক্সা হচ্ছে কিছু? লোকটা বলল, কী ভাবছেন, মেসো? আমি ভাবতে ভাবতে সময়ের মধ্যে ডুবে গেলাম। বেনারসী গন্ধের মধ্যে ঝিম ঝিম ভাব। আমরা গাড়িতে উঠে বসেছি, আসেপাশে আত্মীয় কুটুম, এই বড় গাড়িগুলোকে বলে স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্ল, সংক্ষেপে সুভ, অনেক জায়গা, কেমন ঝিম ঝিম করছে মাথাটা, ঘুম ঘুম পাচ্ছে, ফিরে যাচ্ছি অনেক অনেক বছর আগে, কেরালার থেক্কাডির অরণ্যে।
সেবার অনেকগুলো জঙ্গল ঘোরা হয়েছিল। কর্ণাটকের বন্দিপুর থেকে তো বরাতজোরে বেঁচে ফিরলাম। তখন আমরা চারজন, আমি, বিশু, দেবানন্দ আর বাচ্চা ছেলেটার নাম মনে পড়ছেনা, শুকদেব হতে পারে, আবার নাও পারে। হায়দ্রাবাদ লজে জায়গা পেয়েছিলাম, একেবারে জঙ্গলের মধ্যেই। এখন ওই বাড়িগুলো নেই হয়তো। রাত্তিরে মিস্টার রামস্বামী দেশি মুরগির ঝোল যা রেঁধেছিলেন, আমরা অবাক। বললাম, তামিল ব্রাহ্মণ হয়েও মুরগি রাঁধছেন? উনি বললেন, জঙ্গলে জঙ্গলের নিয়ম, ধর্ম বাড়িতে। বাড়ি গেলে বেশি করে তুলসীপাতা খেয়ে নিই।
রাত্তিরে দরজায় ঠক্ ঠক্। দরজা খুলতেই রামস্বামীর ঠোঁটে আঙুল, শ্শ্শ্- একদম আওয়াজ করবেননা, পারলে নিঃশ্বাসও চেপে রাখুন। আসুন আমার সঙ্গে। বাংলোর সামনে অন্ধকারে হাজার চোখ জ্বলে। সে দৃশ্য যে ভুলবে তার নরকবাস। বললাম, কী ওগুলো? বললাম মানে, ফিস্ফিসের ওয়ান ফোর্থ। উনি বললেন পাওয়ারফুল এসএলআর আছে? বললাম, কাজ চালানো মতন। উনি বললেন, তবে হ’লনা। যাই হোক, চোখ সার্থক করুন, এই টর্চ মারছি – পাঁচ সেলের টর্চ পড়তেই ছিলে টানা ধনুকের মত লাফের পর লাফ, আলোর বৃত্তের মধ্যে ছিটকে যাচ্ছে ফুট ফুট চিতল, পাঁচটা, দশটা, একশোটা, দুশোটা, বিশু বলল, ওহ্ মাই গড – আমি বললাম, কম্যুনিস্টের গড? বিশু বলল, ওটা কথার কথা, তবে এমন দৃশ্য দেখলে গড ব্যাটার ভক্ত হতে রাজি।
গড শুনেছেন কথাটা। সকাল বেলা ক্ষমা ঘেন্না করে বাঁচিয়ে দিলেন প্রাণটা। জঙ্গলে তো এমনি ঢোকা যায়না, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়িতে যেতে হবে। ওখানে অদ্ভুত সব নিয়ম, এখন আর সে সব নিয়ম নেই বোধহয়। ওদের গাড়ি প্রতি রেট। তখন ছিল ষাট টাকা। এখন শুনলে লোকে অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। যাই হোক, এই টাকা কিন্তু যতজন উঠবে, তাদের মধ্যে ভাগ হবে। আমরা শুকদেবকে পাঠালাম এন্ট্রি টিকিট কাটতে, কয়েক মিনিটের ব্যাপার, গাড়িটা কিছুতেই দাঁড়ালনা। দাঁড়ালে বেশ সস্তায় হয়ে যেত, জনা দশের লোক ছিল ওটায়।
ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকগুলো ভীষণ অভদ্র হয়, অবশ্য রামস্বামী বাদে। তা ভারতের সব জঙ্গলে একই চিত্র। পরের গাড়িটায় আমরা চারজন, মানে পনের টাকা করে খসবে পার হেড, সে সময়ে বেশ ভালই টাকা। একজোড়া আমেরিকান ছেলে মেয়ে হাত দেখাচ্ছে, থামতে বলছে, ব্যাটারা কিছুতেই থামবেনা। চ্যাঁচামেচি করে থামালাম। যাক এবার পার হেড দশ টাকা হ’ল, খানিক স্বস্তি। গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, দেখি এক মাড়ওয়ারি কিংবা গুজুভাই ফ্যামিলি হাঁসফাঁস করতে করতে থপ্ থপ্ করে ছুটে আসার চেষ্টা করছে, বাপ মা আর দুটো দশ বারো বছরের ছেলে। বিশু বলল, রূপঙ্কর, ছ’টাকা পার হেড, কোনওভাবে থামা। ওরা থামবেনা জানি তাই আমি লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। ওদের নিতেই হবে, ইয়ার্কি নাকি? এমন সুযোগ ছাড়া যায়? ব্যাটারা ওদের তুলে, দক্ষিণী ভাষায় গালাগাল দিতে দিতে ছাড়ল।
গাড়িতে একটা গাইড থাকে,বলতে বলতে যায়, উধর দেকো, সম্বর হ্যায়, উও দেকো, পরকুপাইন, বন্দিপুরে বাঘ দেখা যায়না, আমরা আশাও করিনি। একটা ডোবা গোছের জলাশয়ের পাড়ে বেশ ঘন বাঁশ বাগান। সেখান থেকে রাস্তাটা দুভাগ হয়েছে। আমাদের আগের গাড়িটাকে দূরে দেখা যাচ্ছে, ওরা ডান দিকে বাঁক নিল, অতএব আমরা বাঁ দিকে। বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে কালো কালো ছায়া, গাইড বলল, এলিফ্যান্ট হার্ড হ্যায়, ইয়েস্টার্ডে ভি থা, থ্রি ডে-স সে দে আর হিয়ার।
পরকুপাইন টরকুপাইন দেখে জীপগুলো ফিরে আসছে, সামনেরটা সমান দূরত্বেই আগে আগে যাচ্ছে। সেই ডোবার ধার, সেই বাঁশঝাড়। হঠাৎ বিকট আওয়াজ, মনে হল, রথের মেলায় যে তালপাতার ভেঁপু পাওয়া যায়, তেমন বাঁশি হাজারখানেক কেউ এক সঙ্গে বাজাচ্ছে। দেখি একটা বিশাল ভয়ঙ্কর টাস্কার ধুলোর ঝড় তুলে সামনের গাড়িটাকে তাড়া করেছে। গাড়িটা জঙ্গলের রাস্তায় যত জোরে অ্যাক্সিলেটর চাপা যায়, তত জোরে ছুটছে। আমাদের ড্রাইভার ঘপাস্ করে ব্রেক মারল ঠিক ওই তিনমুখো জাংশানের আগে। গুজুভাইয়ের মাথা ঠুকে গেল সামনের রডে। হাতিটা ওদের ধরতে না পেরে এবার এদিকে ধাবমান। বাঁই বাঁই করে বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পালা, পালা – ড্রাইভার বলল, আপলোগ তোডা (থোড়া) লেট করায়া না, গডনে সেভ কর দিয়া। উও পন্ডকে আগেওয়ালা রোডসে এন্ট্রি লেতা না, একদম টাস্কারকে সামনে আ যাতা। ঠিক কথা, দু মিনিট আগে গাড়িটা ছাড়লে আমরা ডান দিকের রাস্তায়। জঙ্গুলে মাটির রাস্তায় ব্যাক গীয়ারে আর কত জোরে যেত। হাতির থেকে সামান্য কম ওজনের ভদ্রলোককে বললাম, মোটাভাই, আপনে তো বচা লিয়া হম সবকো। তিনি শিবনেত্র হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, শুভ্ শুভ্ বোলো, শুভ্ শুভ্ বোলো। শুকদেব কানে কানে বলল, লোকটাকে মোটা বললেন, রাগলনাতো? আমি বললাম, আরে পাগল, গুজরাটিতে ‘দাদা’ কে ‘মোটাভাই’ বলে।
এবার কেরালায়, থেক্কাডি। রাত্তিরে পৌঁছে ফরেস্ট লজেই ঘর পাওয়া গেল। আজকাল এসব বললে কেউ বিশ্বাসও করবেনা। আসলে পৃথিবীতে কম লোক থাকলে অনেক সুবিধে। পরদিন সকালে, মানে ভোরে উঠেই যাত্রা। তবে এবার গাড়িতে না, লঞ্চে। লঞ্চঘাটায় এসেই দেখি প্রচুর লাল পতাকা। কাস্তে হাতুড়ি তারা দেখেই চিনে গেছি। হুঁ হুঁ বাবা, বাঙালি বলে কথা। স্লোগান চলছে, এখানকার মতই। তবে ‘জিন্দাবাদ’ ছাড়া বাকি শব্দগুলো বুঝছিনা। পরে ঠাওর করে শুনলাম, ‘ভিপ্লবম্ কালাপ্পম্ জিন্দাবাদ’। বা-রে, বেশতো, আমরাই কেবল উর্দুর বাইরে যেতে পারলাম না। আমাদের নিজেদের চেয়ারম্যান নেই, নিজের ভাষায় স্লোগান নেই, বিপ্লব কি ধার করে হয়? বিশুকে বললে অবশ্য গালি দিয়ে নাম ভুলিয়ে দেবে।
বললাম, হয়ে গেল, আজ তাহলে ট্যুর পন্ড। জিন্দাবাদ চলছে তো। বিশু বলল, দাঁড়া না, তুই অল্পেই হাল ছেড়ে দিস, গিয়ে কথা বলে দেখিনা। কথা বলে জানা গেল, ঠিক সাড়ে পাঁচটা থেকে বিপ্লব শুরু। সাড়ে পাঁচটার আগে যে ভেহিক্ল ছাড়বে, সে ডাঙাতেই হোক বা জলে, তাদের ওপর বন্ধ্ অ্যাপ্লিকেবল নয়। সাড়ে পাঁচটার পর আর কোনও গাড়ি ছাড়বেনা। আমি বললাম, দেখলি, দুই সিপিয়েমে কত তফাৎ? বিশু অবশ্য ততক্ষণে টিকিট কেটে ফেলেছে, আজ আমরা আর খদ্দের খুঁজিনি, সাড়ে পাঁচটা বাজলেই কেলো, তাড়াহুড়ো করে বোট ছেড়ে দেয়া হ’ল সাড়ে পাঁচটা বাজার কয়েক সেকেন্ড আগে।
ওরা কেবিনের ভেতরে, আমি ছাদে গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়লাম বলেই এক স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে পেলাম। তখন ছ’টা বেজে গেছে। সূর্য যথেষ্ঠ আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু ঐ জলাশয়টা চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলে ওখানে তখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি শুয়ে ছিলাম বলে সোজা ওপরে দেখছিলাম। হঠাৎ মনে হ’ল, অন্ধকার আকাশ চিরে কিছু আগনের শিখা ভেসে যাচ্ছে। ব্যাপারটা যতখানি নিজে দেখলাম, ততটা বলে বা লিখে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। আসলে সুর্য তখন বেশ খানিকটা ওপরে, ঝলমলে রোদ্দুরও ছড়িয়েছে। কিন্তু সূর্যের আলো কোথাও বাধা না পেলে তো দেখা যায়না। নীচে পাহাড়ঘেরা হ্রদ তখন অন্ধকার, আকাশও অন্ধকার, শুধু তিনটে ধনেশ পাখি উড়ে যাচ্ছে, তাদের গায়ে রোদ। জানি বোঝাতে পারলামনা, নিজে না দেখলে এ জিনিষ বোঝা যায়না।
আমি সুভ্ টার পেছনের দিকে বসেছিলাম। জর্দার গন্ধে আমেজ আসছে ঠিকই, কিন্তু সামনে তাকাতেই দেখি রিয়ার ভিউ মিররে সেই লোকটার চোখ আমার দিকেই। লোকটার মুখে হাসি, চোখেও। ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করি, অতগুলো পেতলের বালা পরে থাকতে অস্বস্তি হয়না?
সেদিন বিকেলে, সেদিন মানে সেই থেক্কাডির জঙ্গলে। বিশুরা খেয়ে দেয়ে সেই যে ঘুম লাগিয়েছে, আর উঠছেনা। বললাম, কীরে, বেরোবিনা? ওরা বলল, ধূর, এখানে বিশেষ কিছু নেই, আমরা ঘুমোব, এ কদিন খুব ধকল গেছে। অগত্যা একাই। ক্যামেরাটাও রেখে এলাম। একটু পরেই আলো খুব কমে যাবে। জঙ্গলে তো ফ্ল্যাশ মারা যাবেনা। একা একা এগোতে লাগলাম। এক যুবতী মাথায় খুব ভারী একটা পেতলের কলসি নিয়ে আসছে, চলার তালে তালে একটু একটু করে কলসির জল চলকে পড়ছে তার গায়ে, তাতে পড়ছে ডুবন্ত সূর্যের লাল আলো। স্বর্গীয় দৃশ্য। ক্যামেরা আনিনি বলে নিজের গালে ঠাস্। এই জঙ্গলের মধ্যে লোকালয় তো দেখছিনা, কোথায় তবে জল নিয়ে যাচ্ছে? আর একটু এগোই।
আস্তে আস্তে আলো কমছে। গাছগুলো চার দিক থেকে ঘিরে ধরেছে আমায়। কী গাছ কে জানে। শাল চিনছি, সেগুন চিনছি, দারচিনিগাছ, জাম গাছ, রক্তচন্দন গাছ, আরও কত গাছ, সব কি ছাই চিনি নাকি। কেমন যেন মনে হ’ল, গাছগুলো ডাকছে, আয় না, আয়, কত মজার জিনিষ দেখাব, আয়। এর আগেও জঙ্গলে ঢুকে গাছের ফিসফিসানি শুনিনি তা নয়, কিন্তু সঙ্গে সব সময়েই কেউ না কেউ থাকে। তা ছাড়া জঙ্গলে হেঁটে ঢোকবার মজাই আলাদা। তখন গাছদের একদম কাছে চলে যাওয়া যায়, তাদেরর দলে ভিড়েও যাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা সব জিনিষ ব্যাখ্যা করে দেন। পৃথিবীতে এবং মহাবিশ্বে বোধহয় অজানা কিছুই আর থাকল না। এই যে যাঁরা ঈশ্বর টিশ্বর দেখেন, মানে রামকৃষ্ণর মতন, তাঁদের নাকি মস্তিষ্কের কিছু নিউরোন হাইপার অ্যাক্টিভ হয়ে যায়, সেরেটোনিন আর ডোপামাইনের ইম্ব্যালান্স দেখা দেয়, তাই নাকি মানুষ ওইরকম হ্যালুসিনেট করে। আবার শরীরের কিছু রুডিমেন্টারি অরগ্যান স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হলে নাকি হ্যালুসিনেশনে ঈশ্বর দর্শন হয়। মিশরের ফারাওদের নাকি তাই হ’ত। কে জানে বাবা, আমরা ম্যাংগো পাব্লিক অত বুঝিওনা, জ্ঞানী বিজ্ঞানীরা যা বলেন মেনে নিই। তাই হয়তো হবে।
দেখলে যদি হ্যালুসিনেশন হয়, শুনলেও নিশ্চয়ই তেমনি কিছু। কিন্তু আমি তো দিব্যি শুনছি, কোনও ভয় নেই, চলে আয়। হঠাৎ একটা অদ্ভুত আওয়াজ, ‘ক্যাঁও’ – অনেকটা ময়ূরের ডাকের মত কিন্তু ময়ূর ডাকছে না এটা বেশ বুঝছি। এতক্ষণে আলো একদম পড়ে এসেছে, সন্ধ্যা হয় হয়, একটু ভয় ভয়ও যে করছেনা, তা জোর দিয়ে বলা যাবেনা। বন্দিপুরেও একবার সন্ধের দিকে জঙ্গলে পা বাড়িয়েছিলাম। রামস্বামী কী বকুনিটাই না দিলেন, ডু ইউ নো, দেয়ার আর ওয়াইল্ড ডগস হিয়ার? জঙ্গ্লি কুত্তাগুলোকে বাঘেরাও ভয় পায় তুমি জান না? এই যে বাংলোর হাতায় রাত্তিরে শ’য়ে শয়ে হরিণ চলে আসে, কেন জান? ওদের ভয়ে। ওরা জানে মানুষ অন্ততঃ অতটা ডেঞ্জারাস নয়। কুকুরগুলো তো এখানেও চলে আসত। একবার একটা হরিণকে খাচ্ছিল। ওরা এত নৃশংসভাবে খায়, দেখলে চোখে জল আসে। বাঘ বা অন্য শিকারিদের মত জুগুলার ভেন কামড়ে মেরে খায়না, ওরা যখন আর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে, তখনও প্রাণীটা বেঁচে। রেঞ্জার সাহেব তো একবার ওই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে গুলি করে দিলেন, কাজটা সম্পূর্ণ বেআইনি তা জেনেও। সেই থেকেই কুকুরগুলো অন্ততঃ বাংলো চত্বরটা এড়িয়ে চলে।
এখানেও আছে নাকি তারা? গাছগুলো বলল যে, ভয় নেই? ক্যাঁও – করে আওয়াজটা ওদিকে, কী ওটা? অদ্ভুত আওয়াজ তো? গাছগুলো বলল, যা না, যা, দেখে আয়। আমি এগোলাম, এদিকে জঙ্গল আরো ঘন, গায়ে কাঁটা ফাঁটা লাগছে, তবু কীসের আওয়াজ, না দেখেই ফিরে যাব? আবার ক্যাঁও। যে দিক থেকে আওয়াজ আসছে সেই দিকে হাঁটা দিলাম। এখন নীচেটা প্রায় অন্ধকার ওপরে একটু হালকা কমলা আলোর রেশ। দেখলাম কতকগুলো বিরাট লম্বা প্রায় পাতাবিহীন গাছের মগডালে কী একটা উড়ে বসল। পাখি? কী পাখি অত বড়? ময়ুর তো নয়, ময়ুর অত উঁচুতে বসেও না। আমি যত তাকে দেখতে এগোই, সে আরও ভেতর দিকে উরে উড়ে যেতে থাকে।
আরও খানিক যেতে প্রাণীটার কাছাকাছি পৌঁছতে পারলাম। দেখি ব্যাটাচ্ছেল গাছটার গা বেয়ে উঠে যাচ্ছে। পাখিতো এভাবে উঠতে পারেনা। এবার যখন আবার উড়ল, দেখে তাজ্জব, এটা একটা বিরাট সাইজের কাঠবিড়ালি কিন্তু উড়ে যাচ্ছে এক গাছ থেকে আর এক গাছে। একেই তবে বলে মালাবার ফ্লাইং স্কুইরেল? বিরাট তো !
নাঃ এবার ফিরতে হবে, হবে মানে? এতক্ষণে ওপর থেকে নীচের দিকে চোখ পড়েছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা জঙ্গুলে পায়ে চলা পথ দিয়ে খানিক এসেছিলাম কিন্তু উড়ুক্কু কাঠবিড়ালির পেছন পেছন মাইল খানেক হাঁটা হয়ে গেছে। সে পথের কোনও চিহ্ন নেই। তাছাড়া সে পথ থাকলেও অন্ধকারে কিছুই দেখা যেতনা। কী করি এবার? কিছুক্ষণ যাবৎ জলাশয়টা পাশে পাশে চলছিল, তাকে দেখেও দিক ঠিক করা যেত কিন্তু এখন তো তারও চিহ্ন নেই।
একবার ভাবলাম বলি, তুমি রিয়ার ভিউ মিররে খালি আমায় দেখছ কেন বলত? আর কোন ব্র্যান্ডের জর্দা খাও? যে খাচ্ছে, তারও নেশা, যার নাকে গন্ধ যাচ্ছে, তারও? সবচেয়ে বড় কথা তুমি জানলে কী করে, আমি যে হারিয়ে গেছিলাম? জানি, বললেই একসারি দাঁত বের করে বলবে, জানা যায় মেসো, সব জানা যায়।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কতখানি এসেছি খেয়াল আছে? ঘড়িতে রেডিয়াম দেয়া কাঁটা, সেদিকে তাকালে প্রায় পৌনে দু ঘন্টা। নাক বরাবর সোজা হেঁটে থাকলে পৌনে দুঘন্টায় মোটামুটি পাঁচ কিলোমিটার। কিন্তু আমি তো উল্টোপালটা হেঁটেছি। গাছের গায়ে শ্যাওলা দেখেও উত্তর দক্ষিণ চেনা যায়, কিন্তু প্রথম কথা এই অন্ধকারে শ্যাওলা দেখবই বা কী করে, আর আমিই কি ছাই জানি, উত্তর না দক্ষিণ কোন দিক থেকে এসেছি?
হিহি হিহি করে একটা বাচ্চা হেসে উঠল, কেমন মজা, এবার? একটা বয়ষ্ক লোক ধমকে দিল তাকে, অ্যাই, চুপ, এ লোকটা ভাল লোক, গাছ কাটলে বাধা দেয়। কী হয়েছে বাবা তোমার? আমি বললাম, হারিয়ে গেছি, ফিরে যাব, খিদে পেয়েছে। তাছাড়া বেশ ভয়ও করছে। বুড়োটা বলল, ভালাতেক্কু পোকু – আমি বললাম, বাংলায় বল, মলয়ালম বুঝিনা। সে বলল, পোকু, পোকু – আমি ভাবলাম, তামিলে ‘পো’ মানে তো যাও। এরাতো কাছাকাছি ল্যাঙ্গুয়েজ, তাহলে পোকু মানেও যাও। কিন্তু ভালাতেক্কু মানে? সর সর করে হাওয়া দিল, ছোট ছোট গাছের ডাল ডান দিকে হেলে পড়ছে হাওয়ায়। আমি বললাম, থ্যাঙ্ক্স, ভালাতেক্কু মানে তাহলে ডানদিক।
বেশ খানিক যাওয়ার পর শুনি ‘নেরে, নেরে’ – নেরে পোকু। কীরে বাবা, পষ্টো মানুষের গলা। ‘নেরে’ মানেই বা কী? তাছাড়া গাছগুলো এতক্ষণ তো বাংলায় কথা বলছিল, হঠাৎ মলয়ালম বলবে কেন? অন্ধকারে পেছনে কী যেন নড়ে? খুব কড়া নজর ফেলে দেখলাম, আমার ঠিক পেছনে একটা লোক। ছেঁড়া ময়লা একটা সাদা মতন জামা, একই রঙের লুঙ্গি এবং মাথার পাগড়ি। লোকটা রোগা ডিগডিগে, তার চোখ দেখা যাচ্ছেনা। হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলল, নেরে, নেরে পোকু – মানে বুঝলাম সামনে সোজা যাও। কাঁটা ঝোপ সরিয়ে সরিয়ে খানিক হেঁটে বললাম, এবার? পেছনে তাকিয়ে তাকে আর দেখতে পাইনা। এবার তবে কী হবে? সামনে যেতে বলেছে যখন, সামনেই যাই, ওই তো দূরে ফরেস্ট লজের আলো টিমটিম করছে।
লোকটা তখনও দাঁত বের করে হেসে যাচ্ছে আয়নার ভেতর দিয়ে। গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, সত্যি।
(চলবে)