চ্যাটার্জীদা
কিছু অসাধারণ মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি জীবনপথে, তাঁদের মধ্যে একজন চ্যাটার্জীদা। তাঁর কথা একটু ফেনিয়ে না লিখলে বড় অন্যায় হবে। আগেকার দিনে এমনি নানা চরিত্র আমাদের আশেপাশে দেখা যেত। এঁরা যেন উপন্যাসের পাতা থেকে সটান উঠে এসেছেন। এঁদের নিয়েই নাটক বাঁধা হত, সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখা হত। এখন এই ধরণের লোক দেখা যায়না। এখনকার মানুষকে কর্পোরেট অ্যানালিস্টরা তিন চারটে গ্রুপে ভাগ করে পর্যবেক্ষণ চালান। যে গ্রুপের লোক, ঠিক সেই রকমই চরিত্র। সবাই সেই একই রকম, ক্লোন টাইপের।
আমাদের নাটকের গ্রুপে আমাকে নিয়ে গেছিল ভাদুড়ি। ছেলেটি একটা ব্যাঙ্কে চাকরি করত, বোধহয় ইউকো ব্যাঙ্ক। ও আবার জ্যোতিষচর্চাও করত। শ্রীরামপুরে বোধহয় ওর একটা চেম্বারও ছিল। যেদিন প্রথম যাই, ভাদুড়ি বলে দিয়েছিল সোজা কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে নেমে হেঁটে চলে যেতে। বলল, রিহার্সাল বাড়ির কথা অন্ধ লোককে জিজ্ঞেস করলেও দেখিয়ে দেবে। তবে আমার একটু দেরি হবে। তুমি একা যাচ্ছ তো, আমাদের ডিরেক্টর কিন্তু যে সে লোক নন; খুব পন্ডিত এবং রাগী লোক। প্রচন্ড পারসোনালিটি। একটু সমঝে বুঝে কথা বোলো। একবার রেগে গেলে আর রক্ষে নেই। কত বড় বড় অভিনেতাকে দরজা দেখিয়ে দিয়েছেন –
কলেজ স্ট্রীটে নেমে রাস্তা পেরিয়ে ওপারে যাওয়া ইস্তক বুক দুরদুর করছে। টুকটাক অভিনয় ছোটখাট জায়গায় করেছি বটে, এটা বড় জায়গা। যদি প্রথম দিনই গেটআউট করে দেন? ভাদুড়ি যা ভয় দেখাল। ডান দিকের বাড়িগুলো খেয়াল করতে করতে যাচ্ছি। কোনও অন্ধ লোককে পাইনি, তাই জিজ্ঞেস করাও হয়নি।
সিটি কলেজ টলেজ পেরিয়ে খানিকদূর গিয়ে একটা পুরোন মতন চারতলা বাড়ি দেখলাম। তাতে ওয়ার্কার্স পার্টির একটা রঙ চটা বিজ্ঞাপনও ঝুলছে। নির্ঘাত এইটা। সদর দরজার ঠিক বাঁদিকে একটা দোতলা দোকান। তখনকার দিনে এইরকম দোতলা দোকান উত্তর, দক্ষিণ, দুই কোলকাতাতেই ছিল। ওপরেরটা সাধারণতঃ পান-বিড়ির দোকান। এখানেও একটা কথা, পান, জর্দা ইত্যাদির সঙ্গে এইসব দোকানে দেশি বিদেশি নানা ব্র্যান্ডের সিগারেট থাকত এবং এঁদো পাড়া ছাড়া, সম্ভ্রান্ত এলাকায় তারা বিড়ি ফিড়ি রাখতনা। তবু এগুলোকে পান সিগারেটের দোকান না বলে পানবিড়ির দোকানই বলা হত।
নিচের দোকানটা অধিকাংশ জায়গায় চায়ের দোকান। কিছু কিছু জায়গায় মুচিদের জুতো সারাইয়ের দোকানও দেখেছি। এই দোকানটা বেশ অদ্ভুত। ওপরেরটা পানবিড়ির, আক্ষরিক অর্থেই। তবে পানের সংখ্যা গোটা তিন চারের বেশি নয়। খুব সস্তা ব্র্যান্ডের সিগারেটও আছে, তবে মাত্র দেড় প্যাকেট। বাকি সব র্যাক খালি। বিড়ি অবশ্য আছে বেশ কয়েক বান্ডিল। আর নীচের দোকানটি চায়ের। তোলা উনুনে কেট্লি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, দুই দোকানের একই মালিক।
দোকানদার ভদ্রলোক ভীষণ রোগা। ঠোঁটের দুই ধারে গোলাপী রঙের হেজে যাওয়া ঘা। তাঁর পরনের গেঞ্জিটা দেখবার মত। সে সময়ে গরীব মানুষ ছেঁড়া গেঞ্জি পরত, তাতে ফুটো ফুটো হয়ে যেত। এবং নাটক বা সিনেমায় গরীব মানুষ বোঝাতে ছেঁড়া গেঞ্জি ব্যবহার করা হত। শখের নাটক হলে, ছেঁড়া গেঞ্জির অভাবে নতুন গেঞ্জিকে কাঁচি, আঙুল ইত্যাদির দ্বারা অনেক জায়গায় ফুটো করা হত, ধপধপে সাদা, কিন্তু বড় বড় ফুটো দেখে হাসি পেলেও তাই চেপে নাটক দেখতে হত। এখন ফুটো গেঞ্জি পরা লোক দেখা যায়না, ফুটপাথে যাঁরা শোন, তাঁরাও ফুটো গেঞ্জি পরেন না।
এই দোকানদার ভদ্রলোকের গেঞ্জিটাকে ফুটো গেঞ্জি বললে, ‘ফুটো’ শব্দটাকে অপমান করা হবে, কেননা গেঞ্জিটার শুধু আউটলাইনটা আছে, মাঝখানটা জাস্ট নেই। ফুটোর কোনও প্রশ্নই নেই। সব কটা পাঁজর দেখা যাচ্ছে। শুধু আউটলাইন বলতে যা আছে, তা-ও চায়ের কষে বাদামী। গেঞ্জিটা, বা ঐ গেঞ্জির আউটলাইনটা উনি কেন পরেছেন, তাই নিয়ে সময় থাকলে গবেষণা করা যেত, কিন্তু সময় বিশেষ নেই। নীচের দোকানটা সেমি-আন্ডারগ্রাউন্ড, মানে, খনিকটা অংশ পাতালে। একজন এসে বলল, হালদারবাবু, একটা বিড়ি দেখি – ভদ্রলোক তড়াক করে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় পাতালদেশ থেকে দোতলায় উঠে এলেন। যাক, নামটা জানা গেল।
আমি বললাম, হালদারবাবু, একটা চা কি হবে? তিনি বললেন, হবে। বলে সমপরিমান ক্ষিপ্রতায় তড়াক করে আবার নীচে চলে এলেন। উনুনে গুঁড়ো কয়লা চাপানো আছে, একটা তালপাখা, যেটা গেঞ্জিটার চেয়ে সামান্য উন্নত শ্রেণীর, মানে আউটলাইন ছাড়াও তালপাতার কিছু কিছু অংশ এখনও বিদ্যমান, তাই দিয়ে প্রচন্ড বেগে হাওয়া করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
আমি বললাম, আচ্ছা হালদারবাবু, এখানে একটা থিয়েটারের দল মহলা দেয়, না? হালদারবাবু চিড়িয়াখানায় ওরাংওটাং দেখার মত মুখ করে বললেন, একটা মানি? (শব্দটা ‘মানে’, ওটা বাঙাল উচ্চারণ) এই বারি(বাড়ি)টাই তো রিহাস্সেল বারি। এখানে উপরের দুই তলে সব ঘরেই তিনটা শিফটে রিহাস্সেল হয়। এরাই তো আমারে বাচিয়ে(বাঁচিয়ে) রেখেছে। আপনে নূতন মনে হয়?
আমি বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি আজই প্রথম এলাম। উনি বললেন, তা কুন দল? আমি বললাম, আসলে দলের নামটা ঠিক মনে নেই, পরিচালকের নাম, শ্রদ্ধানন্দ ভট্টাচার্য। হালদারবাবু ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, খাইসে, বাঘের মুখে পরসেন। দেখবেন উল্টাসিধা কিসু বলবেননা কিন্তু, খুব সাবধান। - বাপরে, এরা দেখি সকলেই ভয় দেখাচ্ছে, বললাম, তা কোন ঘরটিতে উনি বসেন? হালদার বাবু বললেন, তিন তলায় ‘বি’ ঘর। তবে ভাইডি, প্রথম দিন তো, কথা কম বলবেন, কেমন?
সিঁড়িটা আধো অন্ধকার, ভয়ে ভয়ে উঠছি। আগে থেকেই এত লোকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে, যে ভদ্রলোকের সামনে পড়লে নির্ঘাত ভিরমি খাব। তিনতলায় উঠে দেখি বিশাল এলাকা, কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই। সিঁড়ির মাথায়, বারান্দায়, একটা করে টিমটিমে কম পাওয়ারের আলোর বাল্ব। পরিচালকের ভয় তো পরে, এখন তো ভূতের ভয় ধরবে দেখছি। ‘বি’ ঘরটা কোন দিকে জিজ্ঞেসই বা করব কাকে?
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁ দিকের ঘরটা ফাঁকা। বিশাল হল ঘর, দুটো তক্তপোষ আর কিছু চেয়ার ছড়িয়ে আছে। আন্দাজ করলাম এটাই প্রথম ঘর, তাই ‘এ’ ঘর হওয়া উচিত। দেখি, পরেরটায় কি আছে। ‘এ’-র পর তো ‘বি’ হবার কথা। সেটাও একই রকম বড় ঘর। সেখানেও তক্তপোষ, চেয়ার ইত্যাদি। এছাড়া গোটা দুই বইয়ের আলমারি। তবে ঘরটা একেবারে ফাঁকা নয়।
অতবড় ফাঁকা এলাকায় হঠাৎ একজন মানুষ দেখলে বুকের মধ্যে একটু ধড়াস্ করবেই। মানুষটা একটা চেয়ারে বসে একমনে বই পড়ছেন। ভদ্রলোকের পরনে ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবী। পায়ে পাম্প শু। তখন শীতকাল, তাই গায়ে আলোয়ান। ভদ্রলোকের মাথায় টাক, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, সে সময়ে বোম্বের হিন্দি ছবিতে ‘ডেভিড’ নামে যিনি অভিনয় করতেন, তাঁর যমজ ভাই বললে যে কেউ বিশ্বাস করবে।
এই সেই দোর্দন্ডপ্রতাপশালী পরিচালক? বার দুই ঢোঁক গিলে, হাতটাত কচলে, আস্তে গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ভেতরে আসতে পারি? মোটা চশমার ভেতর থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, কী চাই? গলাটাও বেশ জাঁদরেল। বললাম, মানে, আমি, ইয়ে – আজকে, মানে ভাদুড়ি আমাকে – উনি বললেন, হুম, আগে অভিনয় করেছেন কোথাও? আমি গলে গিয়ে বললাম, হেঁ হেঁ, আমাকে আবার আপনি টাপনি কেন, তুমিই বলুন না। উনি কথাটায় খুব একটা আমল না দিয়ে, ‘আপনি’ সম্বোধন করেই আলাপ জারি রাখলেন। বললেন, এই গ্রুপে অভিনয় করতে এলে, অভিনয় না জানলেও চলবে, ওটা শিখিয়ে দেয়া হবে। তবে উচ্চারণ স্পষ্ট আর নিখুঁত হতে হবে। সামান্য ত্রুটিও ক্ষমা করা হয়না। তারপর বললেন, আজ প্রথম দিন, কথা সাবধানে বলবেন, পরিচালকের কিন্তু প্রচন্ড পারসোনালিটি – আমি বললাম, - অ্যাঁ - ?
সব্বোনাশ, তবে ইনি কে? একটু পরেই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। জনা পনের ব্যক্তির আগমন। সামনে যিনি, তাঁর চেহারা দেখেই বোঝা গেল, এতক্ষণ কার কথা শুনছিলাম। তিনি কিরকম রাগী লোক তা ঠিক বুঝলাম না। স্নেহমাখা চোখ আর হাসি মাখা ঠোঁট নিয়ে তিনি বললেন, তুমিই রূপঙ্কর? এসো।
তবে? তবে ডেভিডবাবুটি কে? ভাবলাম গ্রুপের সিনিয়র কোনও সদস্য হবেন। নাটকের মহলা চলছে। ওঁকে কোনও রোলে তালিম নিতে তো দেখছি না। অবশ্য গ্রুপের সবাই সব নাটকে অভিনয় করবে এমন কোনও কথা নেই। তবে আমাদের হাজিরার সময় ইস্কুলের থেকেও কড়া। কারো পাঁচ মিনিট দেরি হলে রক্ষা নেই। শ্রদ্ধানন্দবাবুর অন্য চেহারা তখন। কিন্তু মিস্টার ডেভিড দেখি যখন ইচ্ছে আসেন, যখন ইচ্ছে যান, ইনি কি বিশেষ কোনও সুবিধে পান?
আমাদের তখন ‘হ্যামলেট’ নাটকের মহলা চলছে। অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ক্রিপ্ট। শেক্সপীয়রের নাটকের যে এত ভাল বাংলা অনুবাদ হতে পারে, অজিতবাবুর বাংলা নাটক না পড়লে কেউ জানতেও পারবে না। শ্রদ্ধানন্দবাবু তবুও খুঁতখুঁতে। একদিন ডেভিডকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা চ্যাটার্জীবাবু, অমুক শব্দটার এক্স্যাক্ট মানে কী? তিনি বললেন, এই শব্দের অনেক অর্থ। প্রধান অর্থগুলো হচ্ছে এই এই, তবে অভিধান খুলে দেখি আরও কিছু মানে পাওয়া যায় কিনা- চাবি দিয়ে বইয়ের আলমারি খুলে অনেক কটা অভিধান বেরোল। উনি যা যা বলেছিলেন, তার বাইরে আর কিছু নেই।
দুটো জিনিষ জানা গেল। এক, এনার নাম চ্যাটার্জীবাবু এবং শ্রদ্ধানন্দবাবু নিজে বিরাট পণ্ডিত হওয়া সত্বেও রেফারেন্সের জন্য এঁকে কনসাল্ট করেন। পান্ডিত্যের কথা যখন উঠলই, শ্রদ্ধানন্দবাবু ছিলেন আচার্য করুণাময় সরস্বতীর আপন ভাই। ওঁর কথা এখানে লিখতে গেলে অক্ষরে কুলোবে না। কথা হচ্ছিল চ্যাটার্জীবাবুর।
আমাদের আলো করতেন কণিষ্ক সেন। বড় খুঁতখুঁতে মানুষ। আমাকে বললেন, ওসব দাড়ি ফাড়ি চলবেনা। আমি বললাম, কিন্তু দাড়ি লাগবে যে – উনি বললেন, নকল দাড়ি লাগাও, নরমাল চুলদাড়ি ভীষণ আলো খেয়ে নেয়। একমাত্র আলোর ব্যাপারে শ্রদ্ধানন্দ বাবুও কণিষ্কদার কাছে ট্যাঁ ফুঁ করতেননা। তাহলে তো সবাইকে উইগ পরতে হবে। কণিষ্কদা বললেন, হ্যাঁ তাই হবে। কেমন হবে সেই উইগ ? শ্রদ্ধানন্দ বাবু এবার চ্যাটার্জীবাবুর শরণাপন্ন। আচ্ছা, ডেনমার্কের সব লোকেদের চুলই কি লাল? চ্যটার্জীবাবু বললেন, দেখুন ইওরোপের কোথাও কি রেশিয়াল পিওরিটি আছে? এক দেশের লোক হামেশাই অন্য দেশে গিয়ে বাসা বাঁধছে। সেটা সে যুগেও হত। তবে খাঁটি ডেন যদি হয়, তার চুল লাল হবেই। প্রচূর লাল উইগের অর্ডার চলে গেল। চ্যাটার্জীদা তো খনি দেখছি, জ্ঞানের ভান্ডার। নইলে শ্রদ্ধানন্দ ভট্চাযের মত লোক ওঁকে এত নম্বর দেন?
সেদিন ঝমঝমাঝম বৃষ্টি। কোলকাতা ভাসছে। সব রাস্তা জলের তলায় কিন্তু কি করে জানিনা আমি গ্রুপে পৌঁছে গেছি। খানিক পরে এক কোমর জল ভেঙে শ্যামল এল। অসম্ভব ডেডিকেশন এই ছেলেটির। গলা খারাপ বলে প্রায়শই নন-স্পীকিং ক্যারাক্টার পায়। কিন্তু একদিনও কামাই নেই। সেদিন দেখি, ‘এ’ ঘরে রিহার্সাল হচ্ছে। আমরা যখন ঢুকি, ‘এ’ঘরে তখন সচরাচর কেউ থাকেনা । আজ বোধহয় সারা কোলকাতা ডুবে আছে বলে এঁরা দেরি করে বেরোবেন। ঐ দলে বেশ কিছু সুন্দরী তরুণী, আমি আর শ্যামল দরজায় জলছবি হয়ে গেলাম। মেয়ে যে আমাদের গ্রুপেও নেই তা নয়, তবে ‘ঘরকা মুর্গি ডাল বরাবর’, এতো প্রবাদেই আছে।
সে দলের ছেলেরা অবশ্য ডাকছিল, দাদা ভেতরে এসে বসুন না – আমাদের আবার প্রাণে ভয়ও ছিল, শ্রদ্ধানন্দবাবু জানতে পারলে পিঠের চামড়ার বিপদ। হঠাৎ কাঁধের ওপর দিয়ে হাত জড়িয়ে কে যেন টেনে নিল, দেখি চ্যাটার্জীদা। আরে ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, নিজেদের ঘরে আসুন। ঘরে সেদিন আর কেউ নেই, আমরা তক্তপোষে জমিয়ে বসা। ঐ তুমুল বৃষ্টিতে শ্যামল মুড়ি আর আলুর চপ কিভাবে ম্যানেজ করল জানিনা। হালদার বাবুর পাতালঘর জলের তলায় হলেও, উনি উনুনটা দোতলায় নিয়ে এসেছেন সময়মত, মাঝে মাঝেই চা চলে আসছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চ্যাটার্জীদার গল্প শুনছি। ওনার জাহাজে চাকরির গল্প, সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর গল্প। কোনও গল্প কৌতুকময়, কোনও গল্প রোমহর্ষক, দম বন্ধ করা। শ্যামল বলল, ভাগ্যিস বৃষ্টিটা নেমেছিল, নইলে চ্যাটার্জীদার এই সব অসাধারণ অভিজ্ঞতা – আচ্ছা চ্যাটার্জীদা, আপনি একটা বই লিখে ফেলতে পারেন তো। দারুন কাটতি হবে।
একদিন সিনেমার পরিচালক নব্যেন্দু চ্যাটার্জী এলেন গ্রুপে। তিনি বেশ কিছুদিন বিলেতে ছিলেন। এখন যেমন সব বাড়িরই কেউ না কেউ দুমদাম বিলেত চলে যাচ্ছে, তখন তো তেমন ছিলনা, আমরা, মানে ইনক্লুডিং শ্রদ্ধানন্দবাবু হাঁ করে বিলেতের গল্প শুনছি। এমন সময় চ্যাটার্জীদার প্রবেশ। নব্যেন্দুদা তখন শার্লক হোম্সকে নিয়ে কিছু একটা বলছিলেন, চ্যাটার্জীদা বললেন, টু টোয়েন্টি ওয়ান বি, বেকার স্ট্রীট? এতে অবশ্য আমরা চমকাইনি, কেননা ঐ ঠিকানা সবারই মুখস্থ, কিন্তু তারপর বললেন, আচ্ছা ঐ পার্ক রোড আর গ্লস্টার প্লেসের মোড় থেকে বেরিয়ে রিজেন্ট পার্কের দক্ষিণ দিকে না? অনেক দিন আগে গেছি তো, আচ্ছা, বাড়িটার ফ্যাশাডটা ঠিক তেমনি আছে? বৃটিশরা কিন্তু ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে জানে। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, এই বেকার স্ট্রীট কোথায় জানেন তো? ডিস্ট্রিক্ট অফ মেরিলবোন, সিটি অফ ওয়েস্টমিনস্টার। এখানে ক্রিকেট খেলতে এম সি সি আসে না? বোকারা বলে মেলবোর্ণ ক্রিকেট ক্লাব। আরে ভাই মেলবোর্ণ তো অস্ট্রেলিয়ায়। ওটা হচ্ছে, মেরিলবোন ক্রিকেট ক্লাব, সেই মেরিলবোন।
দুই চ্যাটার্জীতে দারুণ জমে গেল। শুধু চ্যাটার্জীদা যখন নব্যেন্দুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ও মশাই, গ্রিনীচ পার্কের লাল টুকটুকে রেঞ্জার্স হাউসে ঢুকেছেন নাকি? ওখানে তো সবাই রেনেসাঁ পিরিয়ডের ছবি দেখতে যায়, ওখানকার হাতির দাঁতের আর্টিফ্যাক্টের কালেকশনের কথা কজন জানে? তখন দেখলাম শ্রদ্ধানন্দবাবু আর সন্তোষদা কিরকম অদ্ভুত ভাবে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
সেদিন রাত্রে রোজকার মত পাইকপাড়া টু বালীগঞ্জের দু নম্বর বাস ধরেছি। সে সময়ে বালীগঞ্জ থেকে উত্তরে যাওয়ার এবং ফেরার খুব সুবিধেজনক লাল দোতলা বাসগুলো ছিল। একটার নম্বর টু, আর একটা টু-বি। দূর থেকে দেখলেই আমরা বলতাম, টুবি অর নট টুবি। যে কোনওদিন শেক্সপীয়রের নাম শোনেনি, সেও বলত। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ কলেজ স্ট্রীটের মোড় থেকে আমরা পাঁচ-ছ জন সে বাসে উঠতাম। মোটামুটি ধর্মতলার কাছাকাছি বাকিরা নেমে গেলেও রাসবিহারীর মোড় পর্যন্ত সন্তোষদা আর আমি। আমি অবশ্য একদম শেষ বালীগঞ্জের যাত্রী।
তা আমি কথায় কথায় বললাম, আমাদের চ্যাটার্জীদা বিরাট ফান্ডাওয়ালা লোক, কত দেশ যে ঘুরেছেন, আর কত কিই যে জানেন – সন্তোষদা কিরকম অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম অমন করে কী দেখ, ঐ বার্মিংহ্যাম নিয়ে কেমন নব্যেন্দুদাকে চমকে দিলেন? সন্তোষদা বলল, বার্মিংহ্যাম? উনি কোনওদিন বর্ধমানও যাননি। হাওড়া ব্রীজ টপকেছেন কিনা জিজ্ঞেস করিস তো? আমি বললাম, বলছ কী? এত সব জ্ঞান কি এমনি এমনি হয়? তার ওপর সব রাস্তা ঘাটের নিখুঁত বর্ণনা – সন্তোষদা বলল, একদিন তাল বুঝে দাদাকে (দাদা অর্থে শ্রদ্ধানন্দবাবু) ধরিস, সব জানতে পারবি।
সেদিন আমাদের মহলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, হঠাৎ আমাদের দরজার বাইরে, মানে ভেতরের বারান্দায় শুনি তুমুল গোলমাল। ও বাড়িতে চ্যাঁচামেচি মানে রিহার্সালের মধ্যে কিছু থাকলে তাই। তাও এত সুন্দর ব্যবস্থা, এক দলের রিহার্সালে যতই আওয়াজ হোক, অন্য ঘরে তা শোনা যেতনা। এমন খোলা জায়গায় হল্লা শুনে আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম। দেখি চ্যাটার্জীদাকে ঘিরে বেশ কিছু পুরুষ। কয়েকজন মেয়েও আছে, তবে তারা একটু তফাতে মুখ টিপে হাসছে।
চ্যাটার্জীদার গলাই বেশি। - ‘আমি আজই চলে যাব। দেখি তোমাদের নাটকের মহলা কিভাবে চলে। আমার সঙ্গে চালাকি?’- ইত্যাদি। শঙ্করদা টুক করে গিয়ে জেনে এলেন, গোলমালটা ফোন সংক্রান্ত। আমাদের ওখানে ঘরে ঘরে ফোন ছিল, তবে চাবি দেয়া থাকত। ফোন প্রতি কুড়ি পয়সার বিনিময়ে চ্যাটার্জীদা চাবি খুলে দিতেন। ওই পুরুষদের মধ্যে কাউকে নাকি তিনি ফোন করতে দেননি, এদিকে তারা অভিযোগ করছে, -বুড়োটা মেয়েদের কাছ থেকে পয়সা নেয়না, চ্যাটার্জীদা ভীষণ রেগে বলছেন, বেশশ্শ্ করি, কার বাপের কী?
শ্রদ্ধানন্দবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, অ্যাই সব চলে এস। যত্তোসব বাজে ব্যাপার – আমি বললাম, কিন্তু চ্যাটার্জীদা যদি সত্যিই রেগেমেগে চলে যান? আপনার রেডি রেফারেন্সের কী হবে? উনি বললেন, ও কোত্থাও যাবেনা। অমন হুমকি ও প্রায়ই দেয়। বেরিয়ে যাবেই বা কোথায়? তাছাড়া এক প্লেট করে কষা মাংস আর দুটো করে কালীমার্কা কে যোগাবে ওকে রোজ?
কালীমার্কা? বিশ্বাসই হচ্ছে না। এইরকম সৌম্যদর্শন প্রৌঢ়, বাংলা এবং ইংরিজীতে অগাধ ফান্ডা, বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা – শ্রদ্ধানন্দবাবু বললেন, কীসের অভিজ্ঞতা? ওর একটা কয়লার দোকান ছিল ( সে সময়ে অবশ্য কয়লা ছিল ব্ল্যাক গোল্ড, রান্নার গ্যাসের নাম শোনেনি কেউ)। সেই দোকানের বাইরে কিচ্ছু চেনেনা। অবশ্য অভিজাত পরিবারের ছেলে, থিয়েটার রোডে ওর নিজের তিনতলা বাড়ি আছে। তবে সে বাড়িতে ও ঢুকতে পায়না, দোকানেও না। ওর বৌ আর মেয়ে ওকে পেঁদিয়ে তাড়িয়েছে। তাড়াবে না? শুধু মদ? ওর তো পিওর কালীমার্কা বাংলা ছাড়া চলে না। তাও রোজ দু বোতল। বললাম, কে জোগায় ঐ বাংলা আর মাংস? শ্রদ্ধানন্দবাবু বললেন, এই বাড়ির মালিকরা। ওটাই ওর মাইনে, আর কিচ্ছু চাইনা। বড়জোর পূজোয় এক সেট ধুতি-পাঞ্জাবি।
আমি বললাম, তাহলে পৃথিবীর সব দেশের বর্ণনা, মায় রাস্তাঘাট পর্যন্ত? উনি বললেন, দুনিয়ার সব জ্ঞান ওর বই পড়ে। সারাদিনই তো পড়ছে। এবাড়িতে কিন্তু কম বই নেই, খুব দুষ্প্রাপ্য বইও আছে। তা ছাড়া সব লাইব্রেরি চষা ওর। ডিকশনারিও বাদ দেয়না, সেগুলোও মুখস্থ। দেখ না প্রায়ই আমি শব্দের মানে জিজ্ঞেস করি ।
বালতি
আমরা যখন ইস্কুলে পড়তাম, তখম এই ট্রেন্ডটা ছিল। এখনও আছে, কিন্তু অন্যভাবে। সে সময়ে সামান্য সূচনা পেলেই একটা ডাক নাম রেজিস্টার্ড হয়ে যেত। সে নাম আজীবন থাকত। এখনও শুনি সেসব হয়, কিন্তু সেগুলো হয় খারাপ নাম বা ক্ষেপানোর উদ্দেশ্যে দেয়া নাম। আমাদের সময়ে ক্ষেপানোর নাম তো থাকত বটেই, তবে আপাতদৃষ্টিতে(শ্রবণে) পুরোপুরি নিরামিষ নামও থাকত।
উত্তর কলকাতায় আমার এক বন্ধু আছে, সে বাল্যকালে ক্রিকেট খেলার সময়ে বাঁ হাতে বল করত বলে তার নাম হয়ে গেছিল ‘ডেভিডসন’। এবার ক্রিকেট মিকেট কবে ঘুচে গেছে, সে ছেলেও বুড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু লোকে তাকে ডেভিডসন বলেই চেনে। আমি এক সময়ে হুগলি জেলার কোনও এক গ্রামে চাকরির সুবাদে দৈনিক পাষন্ড। রোজ যারা ট্রেনে যায় তাদের মধ্যে বিভিন্ন দল হয়ে যায়। আমাদেরও একটা ব্যাঙ্কার্স গ্রুপ হয়ে গেল, তাতে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন বয়সী লোকজন। তাদের মধ্যে একজন অল্পবয়সী যুবক, তার নামটা কিছুতেই মনে পড়ছেনা, তবে পদবী ‘শীল’। জানতে পারলাম, সে প্যারী মোহন শূর লেনে থাকে। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, আমার তো ওপাড়ায় যাতায়াত আছে, তা কোন বাড়িটা তোমাদের? বাড়িটার আন্দাজ পেয়ে বললাম, আরে, ঐ বাড়িতেই তো আমার বন্ধু থাকত, অলোক চক্রবর্তী। সে বলল, না না, আমাদের বাড়ির কোনও অংশে কোনও চক্রবর্তী পরিবার নেই। আমি বললাম, আরে, অলোক তো মামাবাড়িতে মানুষ, মামাদের পদবী মুখার্জী টুখার্জী হবে। শীল বলল, আমি ও বাড়িতে জন্মেছি, এখনও থাকি, অলোক নামে কেউ ওবাড়িতে কোনওদিনও ছিল না। আমি বললাম আলবাত ছিল, আমি নিজে গেছি ওবাড়িতে। ছোটবেলায় অবশ্য বন্ধুরা ওকে ডেভিডসন বলে ডাকত। ছেলেটি বলল, ও, ডেভিডসনদা? তাই বলুন, ওসব অলোক ফলোক বললে কে বুঝবে। টুটুলের মুখে শুনলাম, ওর নিজের মামীও অলোক বললে চট করে চিনতে পারেন না। - ডেভিডসন ? ও, তাই বল।
ডেভিডসন তো তাও এক বিখ্যাত ক্রিকেটারের নামে নাম পেয়েছে, বাঁ হাতে বল করত বলে। আমার এক বাল্যবন্ধুর পিতৃদত্ত নাম সোমনাথ চ্যাটার্জী। তার নাম হয়ে গেল ‘রামলাল’। নামটা আমিই দিয়েছিলাম, কিন্তু হু হু করে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। সে সময়ের একটা হিন্দি হাসির ছবি, ‘পেয়ার কিয়ে যা’। তাতে ওমপ্রকাশ অভিনীত এক কমিক ভিলেন চরিত্র ‘রামলাল’।
সোমনাথের সঙ্গে না আছে চেহারায় মিল, না স্বভাবে। সোমনাথের বলিষ্ঠ, অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারা। ফুটবল, ক্রিকেট দুটো খেলাতেই দক্ষ। ফার্স্ট ডিভিশনে সইও করেছিল, তবে পড়ার চাপে বেশিদূর খেলেনি। পড়াশোনাতেও খুবই অগ্রণী, তারপর সেই সময়ে ভাল স্টুডেন্টরা যে ভাবে চিনের চেয়ারম্যানের ছবিতে স্টেনসিল কাটত, তাতেও বেশ খানিক – যাকগে, তো তার রামলাল নাম হবার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে পারেনা। তবু তার নাম রামলাল কেন হল, কে বলবে । আমিই কি ছাই জানি নাকি, আমিই তো নামটা দিয়েছিলাম। আজীবন সেই নাম রামলাল থেকে ছোট হয়ে ‘রামু’ হয়ে থেকে গেল।
আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাইরা খুব সরু সুতোর ওপরে হাঁটতেন। এই নামকরণের ব্যাপারে তাঁরাও অবগত ছিলেন। কিন্তু সামান্য পদস্খলনেই একটা নাম জুটে যেত কপালে। একবার নাম হলে আর রক্ষা নেই, ওটা রিটায়ার করা অবধি চলবে। পথেঘাটে বা বাজারে, কেউ চেঁচিয়ে সে নামে ডেকে দৌড়ে পালাবে, এমন ঘটনাও বিরল নয়।
আমাদের হেড মাস্টার ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপেন বাবু। ওঁর রবিঠাকুরের মত দাড়ি ছিল, প্রায় তাঁর মতই সম্মান পেতেন। রাস্তায় ঘাটে অন্য ইস্কুলের অপরিচিত ছেলেদেরও দেখেছি দৌড়ে এসে পেন্নাম ঠুকতে। তিনি রিটায়ার করার পর এলেন প্রফুল্ল ঘোষ। তিনি আমেরিকা ফেরৎ, সারাদিন চুরুট ফুঁকতেন। নাম হয়ে গেল ‘ফেকো’। প্রমথবাবু একটু চিবিয়ে কথা বলতেন, এবং দৃশ্যতঃ একটু পিসিমা টাইপ অ্যাপিয়ারেন্স। তাঁর নাম হয়ে গেল, প্রমথ পিসি। বলা বাহুল্য এটা কলকাতা ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত অধ্যাপক প্রমথ বিশী-র নামানুসারে। অরিন্দমবাবুর নাম ছিল ‘আলু’। ক্লাসে ঢুকলেই চার দিক থেকে ‘আলু-আলু’ ধ্বনি। মাঝে মাঝেই তাঁর টেবিলে আস্ত আলু পাওয়া যেত। একদিন র্যাগিং-এর চূড়ান্ত হতে ভেউ ভেউ করে কেঁদেই ফেললেন। সে ক্লাসের ছেলেরা আর কিছু করে নি তারপর। কিন্তু তারা পাশ করে যেতেই পরের ব্যাচে আবার যে কে সেই।
এখন মজা হল, অরিন্দমবাবুর নাম যেহেতু ‘আলু’, আমাদের পাড়ার অরিন্দম, যে আমাদের স্কুলেই পড়ত, লজিকের কোনও এক ধারায় তার নামও হয়ে গেল ‘আলু’। সে অবশ্য রাগত না মোটেই। এখন ষাট পেরিয়েছে, রাস্তায় দূর থেকে আলু বললেই ঘুরে তাকায়, -আরে বস্ কী খবর? অরিন্দম বলে ডেকে দেখেছি, শুনতে পায় না।
আমাদের স্কুলে পড়ত অরবিন্দ। ক্রিকেট খেলোয়াড় অরবিন্দ আপ্তের মত ব্যাটিং স্টান্স ছিল। নাম হয়ে গেল ‘আপ্তে’। এদিকে আপ্তে যে খুব বিশাল একটা কেউকেটা, তা নয়। রঞ্জি টঞ্জি মহারাষ্ট্রের হয়ে খেললেও, ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেছেন মোটে একটা। তাতেও দুই ইনিংস মিলিয়ে রানের সংখ্যা সাকুল্যে পনের। তাছাড়া তাঁর নামের উচ্চারণও ‘আরভিন্দ্’, অরবিন্দ নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা, অরবিন্দের নাম হয়ে গেছে আপ্তে, আর কিছুই তখন করার নেই। ওর পাড়ার বন্ধুরাও ‘আপ্তে’ বলে ডাকে। একদিন ওকে খুঁজতে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের অরবিন্দ বলতে কিছুতেই বোঝেনা। যখন বললাম ওই যে, ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের এঞ্জিনীয়র – তারা বলল, ও, আপ্তেদা, তাই বলুন।
আমাদের থেকে এক ক্লাস ওপরে পড়ত ‘বালতি’। তার আসল নাম ঈশ্বর জানেন, কিংবা তাঁরও হয়তো খেয়াল নেই। এদিকে আলু বা আপ্তের মত সে নামটা নিরামিষ নয়, কেননা আমরা দেখতাম, ওকে ওর ব্যাচের ছেলেরা ‘বালতি’ – বলেই দৌড় লাগাচ্ছে, আর ও পেছন পেছন তাড়া করছে। এখন এসব দেখে তো আর চুপ করে থাকা যায়না, আমরা, মানে পরের ক্লাসের ছেলেরাও ‘বালতি’ বলে ছুটে পালাতাম এবং সে যথারীতি তাড়া করত।
সময়টা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। এস্প্ল্যানেডের ফুটপাথে কাঁচঢাকা দোকানগুলো দেখতে দেখতে অলস পদচারণা করছি। সে সময়ে ফুটপাথ ভর্তি হকার ছিলনা, সব সাফ সুতরো, পরিষ্কার। গ্র্যান্ড হোটেলের গাড়ি বারান্দার তলাটা বেশ আলো ঝলমলে। যেতে যেতে বাটার দোকানের সামনে সিঁড়ির ধাপে দেখি বালতি দাঁড়িয়ে। ইস্কুলের ছেলে দেখলে অদ্ভুত এক নস্টালজিয়া চেপে ধরে। কিন্তু ওর নামতো জানিনা, ডেকে আলাপ করার উপায় নেই। তবে সেই ছেলে বেলার মত ‘বালতি’ বলে ছুট লাগাতে তো পারি। তাই করলাম। শুনি পেছন থেকে ডাক আসছে, - অ্যাই অ্যাই, শোন শোন। ভাবলাম, দাঁড়াই না, এত লোকজনের সামনে আর যাই করুক মারবে না। দাঁড়াতেই এগিয়ে এসে দুটো কাঁধ চেপে ধরল, অ্যাই, তুই আমাদের ইস্কুলের? নাম কী রে? আমার ব্যাচের ছেলে? কী ভাল যে লাগছেনা, কী বলব তোকে। আমি বললাম, আমার নাম রূপঙ্কর। তবে তুমি নামে চিনবে না, আমি তোমার পরের ব্যাচ। সে বলল, সে যাই হোক, কতদিন পর ইস্কুলের কাউকে পেলাম। আয় আয়, ভেতরে আয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় নাকি।
ভেতরে গিয়ে খানিক এটা সেটা বলার পর বালতি বলে, অ্যাই জুতো কিনবি? আমি ভাবলাম, দেখেছো? সেলসের লোক মানেই ধান্ধাবাজি। ওসব ইস্কুলের ছেলে ফেলে বলে সেন্টু দিলে কী হবে। আমি বললাম, না তো, জুতো কিনতে তো আসিনি। এমনি দোকানের শো উইন্ডো দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া দু জোড়া প্রায় নতুন জুতো তো আছে, আবার খামোখা জুতো কিনব কেন? বালতি বলল, কী করিস? মানে, চাকরি বাকরি করিস কিছু? আমি বললাম, তা ছোটখাটো একটা করি, কিন্তু – সে থামিয়ে দিয়ে বলল, পকেটে গাড়িভাড়া বাদ দিয়ে ষাট সত্তর টাকা আছে? আমি বললাম, তা আছে কিন্তু – বালতি আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ভেতর দিকে একটা কোণায় নিয়ে গেল। নে, পছন্দ কর। আমি বললাম, শোন, বালতিদা, তোমার নামতো জানি না, বালতিদা-ই বললাম, আমার তো জুতোর কোনও প্রয়োজন নেই। সে কোমরে হাত দিয়ে সোজা বলল, পায়ের মাপ কত? আমি বললাম, বাটার সাত। সে বলল, গাধা, বাটায় দাঁড়িয়ে আছিস, আবার বাটার সাত কিরে, সাত, তাইতো? দাঁড়া, তুই যখন পছন্দ করতে পারছিসনা, আমিই বেছে দিচ্ছি – এই নে, এইটা নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে ক্যাশ মেমো বানা। পঁয়ষট্টি টাকা দাম। আমি বললাম, কিন্তু –
আমাকে মোটামুটি ঠেলে গুঁতিয়েই পাঠিয়ে দিল। ক্যাশ মেমো কাটার পর বলল, মনে কর না স্কুলতুতো এক দাদা তোর সিক্সটিফাইভ মেরে দিল। ওটা জলে গেছে ধরে নে। তবে যাওয়ার আগে আসল কথাটা শুনে যা। বাটা কিছু জুতো এক্সপোর্ট করে। তাদের কোয়ালিটি আমাদের দেশের দোকানে রাখা জুতোর থেকে অনেক ভাল। কতটা ভাল, পরে বুঝবি। তারই কিছু সারপ্লাস এখানে মাঝে মাঝে আসে। ভারতের কোনও শহরের অন্য কোনও বাটার দোকানে এগুলো পাবি না। এখানেও সব সময়ে পাবি না। ইস্কুলের ছেলে বলে ডেকে গছালাম। বাড়ি গিয়ে গালি দিস।
জুতো বগলে বাড়ি এলাম। জুতোটা একটু অদ্ভুত। আবরণটা স্বোয়েডের, মানে চামড়ার খস্খসে দিকের। সে সময়ে স্বোয়েডের জুতো খুব চলত। রঙটাও অদ্ভুত। দূর থেকে কালোই মনে হবে, কিন্তু কাছ থেকে দেখলে চকোলেটের মত রঙ, কিন্তু তাতে একটু বেগুনি আভা, তার ওপর আবার সেল্ফ ডিজাইন করা, জিরাফের গায়ের দাগের মত। সবচেয়ে মজার হল ওপরটা। সেটা ফিতে বাঁধাও না, আবার পাম্প শু টাইপের পায়ে গলানোও না। এক দিক থেকে একটা বেল্টের মত চামড়া ওপরটা বেড় দিয়ে এসে একটা বাক্লের মধ্যে ঢোকানো, বেল্টের মতই। বাক্লটা স্টেনলেস স্টীলের, কিন্তু বেশ বড় আর ভীষণ চোখে লাগার মত চকচকে। জুতোর এই রকম স্টাইল আজকাল মাঝেসাঝে দেখি কিন্তু তখন ভাবাও যেত না। জুতোটা বেশ পছন্দ হয়ে গেল। আগেরগুলো আর পরাই হয় না। এটা পরেই যত হাঁটাহাঁটি। হাঁটাও খুব আরামদায়ক।
এদিকে আমাদের তখন হ্যামলেট নাটকের মহলা চলছে। দিন এগিয়ে আসছে, এবার পোশাক বাছার পালা। আমাদের পরিচালক শ্রদ্ধানন্দবাবু ভীষণ খুঁতখুঁতে মানুষ। যখন ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘নরনারায়ণ’ হচ্ছিল, তখন কোলকাতার কোনও সাপ্লায়ার মহাভারতের যুগের কস্টিউম দিতে পারবে না বলে, সবাইকে স্পেসিফিকেশন মোতাবেক দর্জিকে দিয়ে নিজের নিজের পোশাক বানাতে হয়েছিল। এমনিতে যাত্রা-থিয়েটারে রাজা রাজড়ার ঝলমলে পোষাক যা দেখা যায়, সে জিনিষের কথা অন্ততঃ শ্রদ্ধানন্দবাবুর সামনে কেউ বলার মত সাহস রাখত না। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়েও খুব ঝামেলা। সে যুগের বাদ্যযন্ত্রই চাই। শুধু বীণা, মুরলী আর মৃদঙ্গ চলবে। বীণা বাজাতে বীরেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরিকে আনা হয়েছিল। আর জুতো? সে কি ফ্যাচাং, শঙ্করদা বলেন, আরে ভাই এমন জুতোই বানাতে হল, সে নাগরাও না, বিদ্যেসাগরের তালতলাও না। না যাবে রাস্তায় হাঁটা, না যাবে বিয়েবাড়িতে পরা। নাটকের ক’রাত্তির এর আয়ু। তাপ্পর সোজা গঙ্গায়। এবার হ্যামলেটে কেমন জুতো বানাতে হবে? সকলে তো তটস্থ।
শ্রদ্ধানন্দবাবু চিন্তায় পড়েছেন। যখন গভীর চিন্তা করেন, তখন মাথা খানিক নিচে নামানো, চোখ আধ বোজা। সে সময়ে ডাকলে, মাথা নিচে রেখেই মুখটা সরু করে, বড় বড় চোখ ওপরদিকে করে এমন তাকান, সে ভয়াবহ ব্যাপার। সন্তোষদা তাও বলল, দাদা, জুতো – উনি সেই ভয়াবহ দৃষ্টিই দিলেন। মিনিট তিনেক পর বললেন, চ্যাটার্জীবাবুকো বুলাও। দলে কেউ হিন্দিভাষী নেই, তাও। তারপর নীচের দিকে মুখ থাকার দরুণ আমার পায়ের দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলেন, – এই তো, পাওয়া গেছে -। সকলে ঘিরে ধরেছে আমায়, অ্যাই, কোথায় পেলি এই জুতো, বল। আমি বললাম, বালতিতে। সন্তোষদা বলল, মারব এক গাঁট্টা, বুঝবি তখন। আমি বললাম বিশ্বাস কর, বালতিই দিয়েছে। মাত্র এক জোড়াই ছিল।
হ্যামলেটের শো-গুলো হয়ে গেল। বাকিদের মুচির পেছনে অনেক পয়সা গেল, থ্যাঙ্কস টু বালতি আমি ফুরফুরে। এতো আর মহাভারতের জুতো নয়, তাই বাইরেও পরতে লাগলাম। মাস গেল, বছর গেল, অনেক বছর গেল, বিয়ে করলাম, ছেলেপুলে হল, সে জুতো যেমনকার, তেমনি। সে সময়ের বাটার সবচেয়ে ভাল জুতো অ্যাম্বাসাডর। সেও মেরেকেটে দু বছর যায়। যাঁরা গাড়িতে ভ্রমণ টমণ করেন, তাঁদের সাথে আমাদের তুলনা হয়না। আমাদের রোজই খানিক হাঁটতে হয়। মফঃস্বলে গেলে আরও বেশি। বাটার সবচেয়ে ভাল জুতোরও, আর কিছু না হোক সোলটা আড়াআড়ি চিরে যায়। এ জুতোর সোলটা খানিক ক্ষয়ে যাওয়া ছাড়া কিচ্ছু হয়নি। এর পরে কত জুতো কেনা হল, তারা সব যথা সময়ে ভাগাড়ে চলেও গেল, ইনি কিন্তু বহাল তবিয়তে। সব চেয়ে চোখে লাগত সেই স্টেনলেস স্টীলের বাক্ল দুটো। বাজারের স্টীল আসলে লোহার ওপর ক্রোমিয়াম চাপানো, কদিন পরই ভেতর থেকে মরচে উঁকি মারে। যেগুলো সালেম মার্কা, সেগুলোও অব্যবহারে কালচে, ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব ধরে। বালতির জুতোর বাক্ল কিন্তু এত বছর পরেও ঝাঁ চক্চকে। সত্যি কথা বলতে, দেখলে অস্বস্তিই হত।
এক জুতো সারা জীবন পরতে হবে নাকি? বিরক্তিকর ব্যাপার। টান মেরে সিঁড়ির তলায় ফেলে দিলাম। বালতির দেয়া জুতোজোড়া ঝাঁটা, কোদাল, প্যাকিং বাক্স, ইত্যাদির সহচর হয়ে গেল। আরও বেশ ক’বছর পর, কাজের মেয়েটা সিঁড়ির তলা পরিষ্কার করছিল। হঠাৎ চিৎকার, - দাদা, এটা কী গো, রূপোর মতন চক্চক করতেছে? গিয়ে দেখি ধুলি ধুসরিত, মাকড়সার জাল কবলিত, এক্সপোর্ট কোয়ালিটির জুতোয় স্টেনলেস স্টীলের বাক্ল ঝিলিক মারছে, মনে হচ্ছে গতকাল কেনা হয়েছে। মেয়েটাকে বললাম, শোন, এটা নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ফেলে আয় তো। অনেক দূরে ফেলবি। যেন যাবার পথে আমার চোখে না পড়ে।