দীনবন্ধু
আজ দু হাজার চার সালের মে মাসের কুড়ি তারিখ। ক’দিন আগে আমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল বলে মা এবাড়িতে এসে আছে। অনেক রাত্তির পর্যন্ত লেখাপড়া করি বলে মা কে বলেই রেখেছি সকাল সাতটার আগে চা দেবেনা। আজ সাতটারও অনেক আগে দমাদম দরজায় ধাক্কা। ওপাশে মায়ের গলা, অ্যাই, খোকা, বাইরে কে যেন ডাকছে, ওঠ্না একটু –
চোখ ডলতে ডলতে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, ইয়াব্বড় গোঁফওয়ালা এক হাসি হাসি মুখ। -আমাকে চিনতে পারছেন? আমি দীনবন্ধু। চিনতে পারলেননা? আমি দীনবন্ধু – আমি বললাম, এন্ড্রুজ না মিত্তির? রসিকতাটা করেই ভাবলাম, না না, খুব অন্যায় হল। যিনি এসেছেন, ঐ দুটো নামের একটাও তাঁর জানার কথা নয়। সেই দীনবন্ধু তখনও হাসি হাসি মুখে বলে যাচ্ছে, - আমাকে চিনতে পারলেননা, আমি যে – আমি ভাবছি, সত্যি কি আমি কোনও দিন একে চিনতাম? একে কোনওদিন কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছেনা। কিন্তু এতবার এই হাসিমুখ দেখেও কিছু মনে পড়বেনা, এও কি সম্ভব?
সম্ভব না-ই বা কেন? মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। গোরামামার এক ছেলের বিয়ে। গোরামামার ছেলেমেয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষিত, ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত। ওদের সবার বিয়েতেই গেছি। ও বাড়িতে আবার দু দিক দিয়ে সম্পর্ক। গোরামামার বৌ, অর্থাৎ মামী হচ্ছে আমার আপন পিসতুতো দিদি। গোরামামার মেয়েদের রিসেপশনগুলো হয়েছে পাঞ্জাব হাউসে। ছেলেরটাও সেখানেই হবে। তবে আমার নেমন্তন্ন আজকে একডালিয়ার পারিজাত অ্যাপার্টমেন্টে, এটা বরযাত্রী হিসেবে।
আমার একদম যাবার ইচ্ছে ছিলনা। এরকম যোগাযোগ বর্জিত লোকজনের বাড়ি আমি একদমই যাইনা। কিন্তু মায়ের সেন্টিমেন্ট রাখতে যেতেই হয়েছে। ওরা নাকি বার বার করে যেতে বলেছে। কী বলেছে ঈশ্বরই জানেন, তখন তো আমি অফিসে। আমি কিছুক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করলাম, আরে বৌভাতে তো যাবই, আবার এখানে কেন, কাউকে তো চিনিনা, ধুর আমি যাবনা। সঙ্গে সঙ্গে সেন্টু, - আর কটা দিনই বা আছি, আমি না থাকলে তো এইসব আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্কই থাকবেনা ( এখনই যেন কত আছে)।
আর বেশি কিছু বললে এক্ষুণি ফ্যাঁচ ফোঁচ করে কান্না শুরু হয়ে যাবে। -তোর মামা-মামী বিশেষ করে বলে গেছে, ওরা যেন বরযাত্রী যায়। অগত্যা –
বিয়েবাড়িটা বাড়ির কাছেই, এই একটা সুবিধে। ঘুরছি ফিরছি, কাউকে চিনছিনা, একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। প্রথম কথা, পাত্রী পক্ষের কাউকে চিনিনা, চেনার কথাও না। এদিকে যেহেতু তাদের অনুষ্ঠান, তাই তাদের লোকই বেশির ভাগ। পাত্র পক্ষেরই বা ক’জনকে চিনব। ছেলের বন্ধুবান্ধবদের তো চেনার সম্ভাবনা নেই, দূর সম্পর্কের আত্মীয় জনা দুই পেলাম। তারাও ‘ভাল আছো?’ বলে গল্প শেষ। এক্ষুণি একটা রেজোলিউশন নিতে হবে, আর জীবনে এমন অনুষ্ঠানে আসবনা, তা মা যতই সেন্টু দিক না কেন। হঠাৎ দেখি এক চেনামুখ। আহা হাতে যেন চাঁদ পেলাম।
একগাল হাসি নিয়ে দীনবন্ধুর মত এগিয়ে গেলাম, ‘ – দি, আরে কতদিন পরে দেখা, চিনতে পারছ?’ যাঁকে বললাম, তিনি একজন প্রথিতযশা লেখিকা। তিনি অবশ্য খারাপ ব্যবহার মোটেই করেননি। হাসিমুখেই বললেন, - নাতো । আমি নিজের হাসিমুখ আরও চওড়া করলাম,
-আমি রূপঙ্কর।
- কে রূপঙ্কর?
- আরে আমি রূপঙ্কর, কল্পনাদির ছেলে ।
- কে কল্পনাদি? কোথায় থাকেন আপনারা?
- আরে বাবা, নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব, সেই কসবায়, বেদিয়াডাঙায়। তুমি তো কতবার আমাদের বাড়ি গেছ। ( লেখিকা কিন্তু তখনও হাসছেন, যাতে আমি লোকের সামনে খুব একটা অপদস্থ না হয়ে যাই)
- কিন্তু কসবায় আমার পরিচিত কেউ থাকেন বলে তো মনে করতে পারছিনা?
- আরে বাবা, আমরা আগে থাকতাম কেয়াতলায়। সে বাড়িতে তো আপনি (আর তুমি বলা যাচ্ছেনা) বহুবার গেছেন। তারপর আমরা কসবায় বাড়ি করে উঠে এলাম। মনে নেই, এই কসবার বাড়িতেই তো আপনি শারদীয়া দেশ না আনন্দবাজার নিয়ে এসে বললেন, এই দ্যাখ্ এবারের উপন্যাসে তোর নামটা লাগিয়ে দিলাম, মুখ্য চরিত্রের নাম রূপঙ্কর, মনে নেই?
- নাতো –
- আরে আমি তখন কত ঝগড়া করলাম, এই রকম বিচ্ছিরি চরিত্রের নাম রূপঙ্কর? মুখ্য চরিত্র হলেই হল? তারপর আমার সবেধন নীলমণি নামটা যে বাজারে চাউর হয়ে যাবে? গন্ডায় গন্ডায় রূপঙ্কর বেরোবে, তার বেলা? তখন আপনি বলেছিলেন, ভালই তো, তোর কয়েকটা জুড়িদার হবে। মনে নেই? ‘- দি’ মুখের হাসি তেমনি ধরে রেখে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আমিনা, এরকম কোনও কথাই মনে করতে পারছিনা।
আমার তখন ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস পড়ছে, মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে কেননা চার দিকের অনেক জোড়া ভুরু আমার দিকে কুঁচকে আছে। একটা শেষ চেষ্টা – আরে কল্পনাদিকে মনে নেই, কোলকাতা ইউনিভার্সিটির কল্পনাদি, সেই বাটানগরে পিকনিক, দ্বৈত সঙ্গীতকে দৈত্য-সঙ্গীত, কিচ্ছু মনে পড়ছেনা? আপনি তো সামান্য কারণেই কেঁদে ফেলতেন, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবে – কিন্তু নতুন লেখা বেরোলেই মাকে দেখাতে চলে আসতেন আমাদের বাড়ি – কিচ্ছু মনে পড়ছেনা?
– নাঃ সত্যি ভাই, এমন কোনও কথাই মনে পড়ছেনা।
চওড়া গোঁফ আর আরও চওড়া হাসি নিয়ে দীনবন্ধু দাঁড়িয়ে আমার সামনে। - আমাকে চিনতে পারলেননা? আমি যে সেই একবার –
আশির দশকের প্রথমভাগ। আমি তখন মধ্য কোলকাতায় আমাদের ব্যাঙ্কের একটা খুব বড় শাখায় কর্মরত। আমাদের ওখানে প্রতি বছরই নবীন অফিসারদের শিক্ষানবিশীর জন্য পাঠান হয়। সে বছর দুজন এল। তাদের নাম তো বলা যাবেনা, ধরা যাক এক নম্বর আর দুই নম্বর। দুই ছিল অনেকটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ক্লাইভ লয়েডের মত দেখতে। অত কম বয়সেই খুব গম্ভীর, রাশভারি আর কেমন যেন অহমিকা অহমিকা ভাব। সেই তুলনায় এক ছিল খুবই সহজ সরল, মিশুকে এবং আবেগপ্রবণ।
এদের আগের ব্যাচের শিক্ষানবিশরা বলে গেছে, তোমরা কিছু অসুবিধেয় পড়লেই রূপঙ্করদার কাছে চলে যাবে। উনি মোটামুটি এখানকার মুশকিল-আসান। ব্যাপারটা খানিক বাড়িয়ে বলা হলেও কিছুটা সত্যি। একদিন দেখি দুজনে হনহনিয়ে আমার দিকেই আসছে। এক তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছে। - আচ্ছা রূপঙ্করদা, আমরা কি কুকুর বেড়াল? চার তলায় একজন আমাকে বিনা কারনে এমন অপমান করলেন, বলে বোঝাতে পারবনা।
কে অপমান করেছে? চল তো দেখি। গেলাম ওপরে। সেই ব্যক্তিকে ডাকলাম, প্রচন্ড দাবড়ানি দিলাম, ওদের কাছে ক্ষমা চাওয়ালাম, ওরা মোহিত হয়ে গেল। দুই একটু গম্ভীরপানা আগেই বলেছি কিন্তু এক নম্বর আমার ছায়া হয়ে গেল। দিন যায়, মাস যায়, আমি কোলকাতার বাইরে বদলি হয়ে গেলাম।
বেশ ক’বছর পরের কথা। কোনও একটা কাজে কোলকাতা এসেছি, জি পি ও-র সামনে মোড়টা ঘুরতেই দেখি একটা লাল সোয়েটার ছুটতে ছুটতে আসছে। অনেক দূর থেকেই দুই হাত প্রসারিত, সত্তরের দশকের হিন্দী ছবিতে যেমন নায়িকারা সিমলা পাহাড়ের ঢাল থেকে নায়কের দিকে দু হাত বাড়িয়ে ছুটে আসত, ঠিক তেমনি। - ঠিক তেমনি ভাবে জাপটে ধরে,-আরে রূপঙ্করদা, কতদিন পর আপনাকে দেখলাম, কী আনন্দ যে হচ্ছে না, বলে বোঝাতে পারবনা।
তার মাত্র বছর দুই পর। আমি তখন প্রশাসন মূলক কাজকর্ম দেখি। নতুন কোনও অফিসার এক নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়োজিত হলে, তাঁকে আমার সঙ্গে দেখা করে যেতে হয়। হঠাৎ দেখি দু নম্বর। সে এখন পদমর্যাদায় আমার ওপরে, তার ওপর গোড়া থেকেই গম্ভীর ও রাশভারি টাইপ। আমি কাজে মন দিলাম, উচ্ছ্বাস দেখানোর কোনও অর্থই নেই, তাও তার সঙ্গে দেখা এত বছর পরে।
দু নম্বর বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠল, আরে রূপঙ্করদা, চিনতেই পারছেননা দেখি, বলি আছেন কেমন? আমি আমতা আমতা করি, না না, চিনবনা কেন, তোমারই কাগজ রেডি করছিলাম। মনে মনে অনুশোচনা, ছি ছি, কী লোককে কী ভাবছিলাম। দু নম্বর বলে, শুনেছেন তো, এক এসেছে হেড অফিসে। যান একদিন দেখা করে আসুন, আপনাকে দেখলে খুব খশি হবে।
হেড অফিস দূর নয়, পায়ে হাঁটা পথ। গেলাম একদিন। ঢুকে দেখি কোণের টেবিলে বসা। গেলাম সামনে, হাসি চওড়া করে। কিরে বাবা, অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছে তো বলছেই, আমার দিকে দেখলও দু একবার আড় চোখে। মিনিট দশেক পর সে ভদ্রলোক সরে যেতে আমাকে বেশ হাসিমুখেই বলল, হ্যাঁ বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
মাঝে মাঝে হয়না, নিজের চোখ কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়না, এ সেরকম পরিস্থিতি। মাত্র দু বছর আগে জিপিও-র সামনে দুহাত বাড়িয়ে জাপটে ধরে - বললাম, আমি রূপঙ্করদা, রূপঙ্কর সরকার – সে একটু চিন্তা করার ভান করল, রূ–প–ন-ক – নাঃ ঠিক মনে পড়ছেনা, আসলে আমার কাছে বহু অফিসার সমস্যা নিয়ে আসেন তো, সবার নাম ঠিক খেয়াল থাকেনা। তা বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি? আমি বললাম, না, আমার কোনও সমস্যা নেই। আসলে আপনাকে অন্য একজনের মত দেখতে তো, তাই গুলিয়ে ফেলেছিলাম। বলে চলে এলাম।
একদিন চার্টার্ড বাসে উঠে দেখি একটা সীটই খালি, তার পাশেরটায় তিনি বসে। পাশে বসতেই হল। সূর্য কখন ডুবে গেছে, তবু তিনি জানলা দিয়ে পাখি দেখতে দেখতে ঘাড়ে স্পন্ডেলোসিস বাধিয়ে ফেললেন। কী জ্বালা।
দীনবন্ধু, তুমি আছতো? আমাকে একটু ভাবতে দাও। বুড়ো হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু ডিমেনশিয়ায় ধরবে এমন বয়স তো হয়নি, তুমি চা খাবে? কেন মনে করতে পারছিনা?
আরও বেশ কবছর পরের কথা, মন্ডল সাহেবের বাগান বাড়িতে নেমন্তন্ন। অনেকটা পিকনিকের মেজাজ। লোকজন এদিক সেদিক ঘুরছে। সবেদা গাছগুলোর ছায়ার বেতের চেয়ারে কফি নিয়ে আমরা জনা পাঁচেক। আমার ঠিক উল্টোদিকে এক নম্বর। কিছুক্ষণ পর একজনের বাথরুম পেল, দুজন মাছধরা দেখতে গেলেন, রইল বাকি দুই, মুখোমুখি। উসখুস, গলা খাঁকারি,- মানে ইয়ে, আমি মনে হয় আপনার সঙ্গে কোথাও এক সঙ্গে কাজ করেছি। আমি গ্র্যানাইট পাথর, হবে হয়তো। আচ্ছা অমুক ব্র্যাঞ্চে আপনি একাশি বিরাশি সাল নাগাদ ছিলেননা? আমি বললাম, ছিলাম। - ও, হ্যাঁ মনে পড়েছে, ওখানেই তো আপনার সঙ্গে – আমি বললাম, হবে হয়তো, এত লোকের সঙ্গে কাজ করেছি, সবাইকে মনে রাখা সম্ভব? বাথরুম সেরে একজন ফিরলেন, মাছধরা দেখে বাকি দু জন, আলোচনা শেষ।
তোমার নাম দীনবন্ধু? তোমার হাসিটা খুব আন্তরিক, কিন্তু কেন , কেন , কেন চিনতে পারছিনা? আমার স্মৃতিভ্রংশ হল নাকি? এতো বড় কঠিন শংকট। কী হবে এখন?
তখন কলেজে পড়ি। অফ পিরিয়ডে বসুশ্রী হলের সামনে স্টিল ছবি দেখছি, তখন চলছিল অরূপ গুহঠাকুরতার ‘পঞ্চশর’।
সুঠাম চেহারার এক যুবক দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে। গায়ে একটা সাতটাকা দামের ভুটিয়া সোয়েটার আর প্যান্টটা পায়ের কাছে ছেঁড়া (অবশ্য এখন সেটা হলে ফ্যাশনের চূড়ান্ত)।
প্রায় গা ঘেঁষেই দাঁড়ানো, বললাম, আচ্ছা আপনি শমিত ভঞ্জ না? সে একগাল হেসে বলে, আমায় কী করে চিনলেন? আমি বললাম, ঐ তো, বলাই সেনের কেদার রাজা ছবিতে পুলিশ অফিসারের রোল করেছিলেন না? সে আরো হাসে, ওহ্, ওটা তো কয়েক সেকেন্ডের রোল, তাই থেকেই আপনি আমার নাম খুঁজে বের করেছেন? দারুন তো ! আমি বললাম, ওই কয়েক সেকেন্ডেই জাত চেনা যায়। আপনি অনেক বড় হবেন। দুহাত জড়িয়ে বেশ কয়েক সেকেন্ড হ্যান্ডশেক করে সে বলে, আবার কোথাও দেখা হবে, চলি?
অনেক বছর পর। এন টি স্টুডিয়োয় একটা কাজে গেছি। শমিত ভঞ্জ তখন বাংলা সিনেমায় একটা বিরাট জায়গায়। উত্তম সৌমিত্র তাঁদের নিজেদের আসনে, কিন্তু রাফ অ্যান্ড টাফ হিরো বলতে একমাত্র শমিত ভঞ্জ। সেই ‘আপন জন’ এর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ফ্লোর থেকে বেরোচ্ছেন চিন্ময় রায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে। আমার দিকে চোখ পড়তেই, - আরে, অনেক দিন পর, কী খবর, সব ভালো?
আমি পেছন দিকে তাকাই, কিরে বাবা, কাকে বলছে? পেছনে তো দেয়াল, ডান, বাঁ, কোনওদিকেই তো আর কেউ নেই, তবে কি আমাকেই- তিনি আবার বলেন, কত দিন পর দেখা, আজ একটু তাড়া আছে, আবার দেখা হবে –
আরও অনেক অনেক বছর পরে। বালীগঞ্জ স্টেশনের বাইরে ফুটপাথের বাজারে নীচু হয়ে উচ্ছে পটল দর করছি, হঠাৎ সামনে সেই বসুশ্রী সিনেমার সামনে ভুটিয়া সোয়েটার পরা যুবক। এখন মধ্যবয়সী, সেই সুঠাম চেহারা এখন স্থূলকায় কিন্তু একগাল হাসিটা ঠিক তেমনি। - ভালতো? কতদিন পর দেখা –
শালা ক্যান্সার, কেড়ে নিলি বুবুদাকে, নইলে আদাড়ে বাদাড়ে যেখানেই দেখা হোক, একগাল হেসে বলত, ভালতো? আবার দেখা হবে। দীনবন্ধু, আমি তোমায় চিনি, নিশ্চয় চিনি, না চিনলেও চিনি -
কত চেনা মুখ ডাইনে বাঁয়েতে
সামনেও চেনা কত ভাই
পেছনেও কিছু চেনা ছিল তবু
সময় আমার অত নাই
ধীরে ধীরে তুমি এগিয়ে চলবে
চেনারা পিছিয়ে পড়বে
তোমার কী দায়, নিজেও পিছিয়ে
তাদের সঙ্গ ধরবে
একদিন যদি মনে হয়, আহা
কথা বলা কত সুখ
ডাইনে বা বাঁয়ে, সামনে তাকিয়ে
পাবেনা তো চেনা মুখ
তখন ভাববে এমন কী ক্ষতি
একবার পিছে চাওয়া
তাকাও পেছনে – চারিদিক ফাঁকা
হু হু করে শুধু হাওয়া
দীনবন্ধু বলল, আচ্ছা, আপনি প্রবীরদা তো? আমি বললাম, বাঁচালে ভাই, ধড়ে প্রাণ এল। তুমি যে আমায় কী বিপদ থেকে উদ্ধার করলে, তুমি কোনওদিনই জানবেনা। ঐ যে, ঐটা প্রবীর দাশগুপ্তের বাড়ি।
দ্বিতয়
আমি ভদ্রলোককে বললাম, দেখুন দাদা, যদি আপনি পাওনাদার হতেন আর আমি দেনদার হতাম, তাহলে কী কান্ডটাই হ’ত? এতক্ষণে রাস্তায় লোক জমে যেত, তা অবশ্য এখনই গেছে। আর এটা আপনার পাড়া, তাই আমি বেধড়ক মার খেয়ে যেতাম। ভদ্রলোক বললেন, এখনও ইয়ার্কি?
আমি বললাম, জানেন, আমার বাবার না, ঠিক এমনি কেস হয়েছিল। গড়িয়াহাটের মোড় দিয়ে বাবা আসছিল। আসলে বাবা পঁচিশ নম্বর ট্রামে আসত, গড়িয়াহাটে নেমে টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে মুরলীধর কলেজের সামনে দিয়ে পূর্ণদাস রোড ক্রস করে – যাকগে ঘটনাটা হ’ল, বাবা ফুটপাথ ধরে হাঁটছে, যেখানে এখন আনন্দমেলা, সেইখানে একটা পেট্রোল পাম্পিং স্টেশন ছিল। আর ফুটপাথে দোকান টোকান কিছুই ছিলনা, শুধু প্যাকিং বাক্স পেতে কিছু ফলওয়ালা বসতো। একজন হঠাৎ বলল, এ বাবুজি, উস দিন যো আম লিয়ে থে, দাম কব দেঙ্গে?
বাবা সাংঘাতিক হিন্দী বলত, বলল, আম লিয়া থা? কবে আবার আম লিয়া থা। আমার আমওয়ালা ফিক্সড হ্যায়, বাজারের মধ্যে বসতা হ্যায়। আমি উল্টোপাল্টা জায়গা থেকে ফল নেহি কিনতা হ্যায়। আমওয়ালা বলল, ছোড়িয়ে উ সব বাত, উস দিন তো বোলে কল্ দেকে যায়েঙ্গে। কল্ কল্ করতে করতে এক হপ্তা বীত গয়া। আভি প্যায়সা নিকালিয়ে। বলে না, বাবার হাত ধরেছে। আর যায় কোথা, সে তো জানতনা, বাবার একটা অসুখ ছিল, বাবা রাগলে বাবার চোখের মণি দুটো ব্রাউন থেকে নীল হয়ে যেত, অনেকটা ‘এক্সহরসিস্ট’ ফিল্মটার মতো। তারপর সামনে কে আছে, দারা সিং না ক্যাস্সিয়াস ক্লে, বাবার সে হুঁশ থাকতনা। এরপর কী হ’ল, সে আর বলে কাজ নেই।
ভদ্রলোক বললেন, শুনলাম, বেশ ভাল গল্প। লিখলে পার তো, আনন্দবাজারে পাঠিয়ে দাও না, নিয়ে নেবে। যাক, কথা না বাড়িয়ে এটা ধরতো, ফিল্ডিং করতে করতে চলে এসেছি, আমার ইয়ার্কি মারার টাইম নেই। পাশের ছেলেগুলো বলল, হ্যাঁ দাদা, এসব পরে করবেন, খেলা বন্ধ হয়ে আছে দেখছেন না? বাচ্চুদাকে ছাড়ুন।
সেদিনটা ছিল ছুটির দিন। বালীগঞ্জ স্টেশনের দিকে আসছি ফুটপাথ ধরে। সঙ্গে আছে ভোলা, ভোলা নন্দী। আমার আগের পাড়ায় পাশের বাড়ি থাকত। সাংঘাতিক সুপুরুষ, সিনেমায় নামলে তাপস পাল চিরঞ্জিৎ আর প্রসেনজিতের মত পরের প্রজন্মের অভিনেতাদের কপালে দুঃখ ছিল, তাই নামেনি। ওর বাবা অবশ্য সেসময়ের একটা বিখ্যাত সিনেমায় আড়াই মিনিটের একটা রোল করেছিলেন। ভোলা উস্তাদ নাসিরুদ্দিন খান ডাগরের কাছে ক্লাসিকাল গানের তালিম নিত আর রুম ডিওডোর্যান্ট ম্যানুফ্যাকচার করত। আমরা দুজনে ফুটপাথ ধরেই হাঁটছিলাম, ভোলা বলল, চা খাবি?
সে সময়ে ফুটপাথ বেশ চওড়া ছিল, আর একদম ফাঁকা। অনেক দূরে দূরে এইরকম একটা দুটো চায়ের দোকান, তাও ফুটপাথের বাঁধানো অংশটা ছেড়ে মাটির ওপরে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, তার কাছেই একটা বাটার দোকান, সেটা অবশ্য এখনও আছে, আর তার পাশ দিয়েই একটা রাস্তা ঢুকেছে ফার্ণ রোডের দিকে। সেকালে রাস্তায় ট্রাফিক খুবই অল্প থাকত, তাই ছুটির দিনে রাস্তায় ইঁট সাজিয়ে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। দেখে বোঝা গেল, পাড়ার সিনিয়র-জুনিয়র ম্যাচ।
একটা বল গড়িয়ে গড়িয়ে চলে এল বড় রাস্তার দিকে। সিনিয়ররা ফিল্ডিং করছিলেন, একজন দৌড়ে এলেন বলের পেছন পেছন । তিনি বয়সে আমার থেকে বেশ খানিকটা বড়, রোড ক্রিকেটে কোনও ড্রেস কোড নেই বলে, উনি পরেছেন পাজামার ওপর একটা মেরুন রঙের বুশ শার্ট। বলটা ছুঁড়ে দিয়ে মুখ তুলতেই সোজা আমার মুখোমুখি, বললেন, এই যে, ডুমুরের ফুল, অনেকদিন ধরে খুঁজছি তোমায়। নাও এটা ধর, আর ধরে আমায় কৃতার্থ কর।
এই কথা বলে উনি যে জিনিষটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, সেটা স্টেট ব্যাঙ্কের একটা কারেন্ট অ্যাকাউন্টের লাল রঙের চেক। দেখলাম, লেখা রয়েছে রূপীস ওয়ান হান্ড্রেড ফরটি ওনলি। তিনি বললেন, কী হ’ল, ধর, আমায় দায়মুক্ত কর এবার। আমি বললাম, দাদা, আপনি ভুল করছেন। তিনি বললেন, সব সময় ইয়ার্কি ভাল লাগেনা, নাও ধর। সে সময়ে একশ’ চল্লিশ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। আড়াই টাকায় গড়িয়াহাট থেকে ট্যাক্সিতে তারাতলার মোড় চলে যাওয়া যেত, হাটারি রেস্তোরাঁয় বিশাল এক প্লেট চাউমিন খাওয়া যেত, সেখানে একশ’ চল্লিশ টাকা মানে, আমার এক মাসের মাইনের অর্ধেকের কিছু কম। ভদ্রলোক চেকটা বেশ কিছুদিন ধরে পকেটে নিয়েই ঘুরছেন, এমনকি রাস্তায় খেলতে নেমেছেন চেক পকেটে নিয়ে।
আমি আবার বললাম, দাদা, আমি সিরিয়াসলি বলছি, আপনি ভুল করছেন। আমি আপনার কাছে কোনও টাকা পয়সা পাইনা শুধু নয়, আমি আপনাকে চিনিই না। ভদ্রলোকের মুখে রাজ্যের বিরক্তি, আঃ ধরনা চেকটা, ওদিকে খেলার দেরি হয়ে যাচ্ছে, অনেক হয়েছে। আমি বললাম, দাদা, বিশ্বাস করুন, আমি রসিকতা করছিনা, আমি সত্যি আপনাকে চিনিনা। ভদ্রলোক এবার বেশ রেগে গেছেন, দেখ, সিরিয়াস মুখ করে তুমি ইয়ার্কি মারতে পার, একথা পাড়াশুদ্ধু লোক জানে। কিন্তু সবকিছুর একটা সময় আছে। এদিকে অধৈর্য হয়ে বেশ কিছু খেলোয়াড় চলে এসেছে, একজন বলল, আচ্ছা, এখন চেকটা নিয়ে বাচ্চুদাকে ছাড়না, দাদা-ভাইয়ের তামাশাটা একটু পরে করলে হয়না? নাও ধরো চেকটা, ও বাচ্চুদা, ওর পকেটে গুঁজে দিয়ে চলে আসুন।
ওরে বাবা, এখন কী করি? ওরে ভোলা, বাঁচা আমাকে। ভোলার বেশ লম্বা চওড়া, ফর্সা, নায়কোচিত চেহারা। ভোলা এগিয়ে এল, দাদা, আপনারা যাকে ভাবছেন, এ সে লোক নয়। ‘দাদা’ তাই শুনে রেগে কাঁই। আপনি থামুন তো মশাই, আপনি কে? ওর বন্ধু? আমার থেকে ওকে আপনি ভাল চেনেন? এটা আমাদের বিজনেসের ব্যাপার, আপনি নাক গলাবেননা। এদিকে খেলার মাঠের, থুড়ি, রাস্তার লোকেরা দলে ভারি হচ্ছে, তাছাড়া আরও কিছু পথচলতি উৎসুক জনতার ভীড়। আমি আর ভোলা মোটামুটি ঘেরাও। একজন আরও বয়স্ক কাকা টাইপের মানুষ এসে বললেন, আঃ ভাইটি, নিয়ে নে না টাকাটা, দাদা ভাইয়ের ইয়ার্কী ফাজলামি পরে চালাস, খেলাটা বন্ধ হয়ে আছে দেখছিস না?
ওরে ভোলা, এখন কী করি? হঠাৎ ভোলা কাউকে দেখতে পেয়ে হাতে চাঁদ পেল। সে যেন ঈশ্বরপ্রেরিত হয়ে, ওই চায়ের দোকানেই চা খেতে এল। তার নাম কালু, ভোলার কিরকম বন্ধু, এই পাড়াতেই থাকে। ভোলা বলল, অ্যাই কালু, শোনতো এদিকে, এনাদের বোঝা তো, এনারা যাকে ভুল করছেন, সে আমার বন্ধু, নাম রূপঙ্কর সরকার, ব্যাঙ্কে চাকরি করে, কসবায় থাকে আর এই ভদ্রলোকের কাছে কোনওদিন কোনও টাকাপয়সা পায়না।
কালুর মধ্যস্থতায় ক্রিকেট খেলোয়াড়রা খানিক নরম, কিন্তু ভদ্রলোকের সন্দেহ যায়নি। তিনি গাঁইগুঁই করতে লাগলেন, এটা কী করে সম্ভব? একরকম দেখতে দুজন লোক থাকতেই পারে, কিন্তু এতটা সিমিলারিটি যমজ ভাই ছাড়া হয়না। তা ছাড়া আমার ভুল হতে পারে, এরা সবাই ভুল করছে?
আমি বললাম, দেখুন দাদা, ব্যাপারটা যদি উল্টো হত, মানে, একশো চল্লিশ টাকা যদি আপনি পেতেন, আর কালুর দেখা না পেতাম, তাহলে তো আমি আর ভোলা এতক্ষণে গণধোলাই খেয়ে যেতাম। আমার বাবার কেসে ওয়ান ইজ টু ওয়ান ছিল, এখানে তো দুজনের বিরুদ্ধে কুড়ি জন। তাছাড়া আমার ওরকম চোখের মণি নীল ফিল হয়না, বাবার মত বেধড়ক মারতেও পারিনা কাউকে। যাক, টাকাটা যখন আপনিই দেবেন, আমার সঙ্গে আমার বাড়ি চলুন, এক কাপ চা খেয়ে আসবেন, এখান থেকে তো বেশি দূর নয়। তাছাড়া আমি জগবন্ধু স্কুলের ছাত্র। এই পাড়াতেই আমার অসংখ্য বন্ধুবান্ধব থাকে। আজ ছুটির দিন বলে অনেকেই বাড়িতে আছে, তাদের ডাকি চলুন।
ভদ্রলোক একটু থমকালেন, ভীড় পাতলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। উনি তুমি থেকে ‘আপনি’ তে উঠেছেন। দেখুন ভাই মিনিট কুড়ি ধরে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, সত্যি বলছি, আমার এখনও সন্দেহ যায়নি। একরকম দেখতে, অনেকটা একরকম দেখতে, হুবহু এক রকম দেখতে, তাও নাহয় মানছি। হাইট, গায়ের রঙ, গলার আওয়াজ, মায় হাত পা নাড়ার ভঙ্গি পর্যন্ত এক রকম হয় কী করে? আচ্ছা, পেয়েছি, আপনি ভাই লাস্ট দাড়ি কামিয়েছেন কবে? আমি বললাম, তিন চার দিন আগে। বুঝতে পারছি খুব বিচ্ছিরি লাগছে, কিন্তু আমি একটু কুঁড়ে স্বভাবের কিনা – ভদ্রলোক থামিয়ে দিলেন। এতেই বেঁচে গেলেন ভাই। আমি ওকে গত কালও ক্লিন শেভেন দেখেছি। তখন চেকটা ধরিয়ে দিতে পারলে তো ঝামেলাই চুকে যেত। দোতলা থেকে দেখলাম, নীচে নামতে নামতেই হাওয়া।
ভোলার দিকে একবার, কালুর দিকে একবার তাকিয়ে উনি বললেন, বাব্বাঃ, এখন নিশ্চিন্ত। একদিনে এতটা দাড়ি বাড়তে পারেনা, কি, পারে? ভাই, আমিও বাঁচলাম, আপনিও বাঁচলেন। শেকহ্যান্ড করে উনি চলেই যাচ্ছিলেন, আবার ফিরে এসে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, আমি কিন্তু এখনও পুরোপুরি, মানে, হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনভিন্সড নই। তবে কি আর করা যাবে, মন খুঁতখুঁতটা থেকেই যাবে। পাশে একটা ইলেকট্রিক মিস্তিরিদের দোকান ছিল, এই ধরণের দোকান এখন আর দেখা যায়না। সে দোকানের দুজন কর্মচারিও দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল, তারা বলল, আপনার নাকে মুখে কয়েকটা তিল আছেনা? ওনারও ঠিক ওই জায়গাগুলোতে তিল আছে।
আমি বললাম, তা সে থাকে কোথায়? তারা সমস্বরে বলল, কেন, ওই বাড়িটায়। যে বাড়িটা ওরা দেখাচ্ছে, সেটা বড় রাস্তার মোড় থেকে দু একটা বাড়ির পরেই। আমি ভোলাকে বললাম, তাজ্জব তো, আমরা তো এই চত্বরেই ছেলেবেলা থেকে ঘুরছি। জগবন্ধু স্কুলের ছাত্র হিসেবে এই সব অলি গলিতে হাজার খানেক বার হাঁটা হয়ে গেছে। এই যারা রাস্তায় খেলছে, সবার নাম না জানলেও মুখ তো চেনা, এমনকি ওই বাচ্চুদা না কে, তাঁকেও তো আগে দেখেছি। ঠিক আমার মত দেখতে একজন এইখানে থাকে, অথচ কোনও দিন তাকে দেখলামনা, একি হতে পারে?
আচ্ছা আমি না দেখি, আমার বন্ধুরা? ভোলা বলল, আরে বাবা, তারা দেখলেও তাকে তুই ভেবেছে। আমি বললাম, নাঃ ব্যাপারটা চিন্তার। এ বোধহয় এই পাড়ার অরিজিনাল নয়, পরে এসেছে। তবে হ্যাঁ, সুভাষ সেদিন বলল, কিরে, গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে যাচ্ছিলি বলে পুরোন বন্ধুদের চিনতেও পারবিনা? কত ডাকলাম – আমি যত বলি শালা আমি গার্ল ফ্রেন্ড কোথায় পাব, সে তো কিছুতেই শুনবেনা, এখন বুঝছি। ভোলারে, একটা পরিচালক দ্যাখ, যে ‘ভ্রান্তিবিলাস’ সিনেমায় নয়, স্টেজে নামাবে। প্রত্যেকটা শো হাউস ফুল হবে, গ্যারান্টি।
বাড়ি ফিরেও কিন্তু মনে শান্তি নেই। আমার মত দেখতে? ঠিক আমার মত? কোনও তফাৎ নেই? ইস্ একবার তাকে দেখতে পাইনা? মানুষের মনের গোপনে নিজের একটা এক্স্যাক্ট কপি দেখার প্রবল ইচ্ছে লুকিয়ে থাকে। তার বহুকাল পরে,একবার টিভিতে বি আর চোপড়ার একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম। তাতে উনি বললেন, ফরমুলা ফিল্মে দুটো জিনিষের মার নেই, প্রথমটা ডাব্ল রোল, দ্বিতীয়টা লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড। সত্যি তো, দা করসিকান ব্রাদার্স, দা প্রিজনার অফ জেন্ডা, এগুলো তো দারুন পপুলার ছবি। ‘রাম অওর শ্যাম’ বা ‘সীতা অওর গীতা’ ও দারুন চলেছে। আমার মনের অশান্তি কিন্তু বেড়েই চলে। একবার তাকে দেখতে পাইনা?
তাকে অন্ততঃ একবারটি দেখতেই হবে। মন ছটফট, প্রাণ ছটফট, মানুষ প্রেমে পড়লেও এমন উতলা হয়না। আমি রোজ বালীগঞ্জ দিয়ে ফিরতে লাগলাম, যদিও তখন বন্ডেল দিয়ে বাড়ি ফেরা অনেক সুবিধের ছিল। বালীগঞ্জ দিয়ে ফিরলেও পি সি সরকারের বাড়ির পেছন দিয়ে সহজে শর্টকাট ছিল, আমি সেদিকে না গিয়ে বাটার দোকানের সামনে রোজ একপাক ঘুরে যাই। আসলে এত রাত্তির করে ফিরি, তখন রাস্তায় খুব বেশি লোক থাকেনা। মাস খানেক পর একদিন সন্ধে সাতটা নাগাদ ফেরার সুযোগ পেলাম। আজ কি কপাল খুলবে?
বাটার দোকানের কাঁচে হেলান দিয়ে ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে? আমি? আয়নায় উলটো চেহারাটা দেখে দেখে চোখ সয়ে গেছে। সোজা আমিটা এইরকম? সোজা আমিটা চমকে গেছে, বাচ্চুদা বোধহয় একশো চল্লিশের ভ্রান্তিবিলাস নিয়ে গল্পটা ওকে বলেননি। আমি ব্যাপারটা জানি তবুও ভালই চমকেছি। একি সম্ভব? এক হাইট, একরকম চুল আঁচড়ানো, বাটার দোকানের কাঁচের ওপর আঙুল দিয়ে তবলা বাজাচ্ছে। প্রচন্ড উত্তেজনা হলে আমিও তাই করি। চোখে চোখে স্থির – এক, দুই, তিন, কত সেকেন্ড কাটল জানিনা, মনে হল বছর খানেক। সম্বিত ফিরল, বাড়ির পথ ধরলাম, কিন্তু একবারও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাইনি আর।
ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের সামনে ভোলার সঙ্গে আবার দেখা। কিরে, তোর সেই ডুপ্লিকেটের দেখা পেলি? বললাম, হ্যাঁ।
- সেকী, দারুন খবর তো, তারপর কী হ’ল?
- কী আর হবে, কিছুই হ’লনা।
- কথা বললিনা?
- নাঃ।
- সেকীরে, এমন একটা সিচুয়েশন হাত থেকে বের করে দিলি?
- আমি কেন কথা বলব?
- তার মানে?
- ও-ওতো বলতে পারত, ও বলেনি, তাই আমিও বলিনি।
- যাঃ শশালা।
যারা কসবা অঞ্চলে থাকে, তাদের বালীগঞ্জ দিয়ে প্রায়শই যাতায়াত করতে হয়। তার পর চল্লিশ বছর কেটে গেছে, জীবনে আর কোনওদিন তাকে দেখিনি।
(চলবে)