এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রূপঙ্কর সরকার | 126.203.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:৩০630184
  • বিনির্মান

    খুব কষ্ট হচ্ছে জানিস, ভীষণ কষ্ট। বুকের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে, মাথার মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে, কিছুতেই মনে করতে পারছিনা ব্যাপারটা, কিছুতেই না। আচ্ছা, এটা কী করে সম্ভব? সব মনে পড়ছে কিন্তু কে আমাকে লাল চা খাওয়ালো সেটা মনে পড়ছেনা এটা কী করে হয়। পষ্টো দেখছি, একেবারে চোখের সামনে, কেউ একজন একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের গ্লাসে একটা তক্তার ওপরে চা টা নামিয়ে দিয়ে গেল। বিচ্ছিরি স্বাদ। ওকে লাল চা বলে নাকি, লাল রঙের চা মানেই লাল চা? একেবারে কষটা কষটা, গরমও ছিল খুব। জিভে ঠেকাতেই জিভটা মনে হল পুড়ে গেল। আচ্ছা এটা কী করে সম্ভব, বেশি দিনের ব্যাপার তো নয়, খুবজোর কাল কিংবা পরশু। নেহাত আর একটু টানলে তার আগের দিন। এর মধ্যে ভুলে গেলাম কে আমাকে লাল চা খাওয়াতে পারে?

    আচ্ছা, কী করে এমন হতে পারে? চা টা যে খেয়েছিলাম, তাতে কোনও সন্দেহই নেই আমার। অত বিচ্ছিরি চা খেয়ে কেউ ভুলতে পারে? বাড়িতেও তো লাল চা খাই। সেটা তো পাতা চা, জল গরম করে, তার মধ্যে পাতা ফেলে ঢাকা দিয়ে মিনিট পাঁচ সাত পরে – কিন্তু এরা তো চা বানায় সিটিসি চা ফুটিয়ে। ট্যানিক অ্যাসিড গদগদ করে ওদের চায়ে। তার মধ্যে গেদে দুধ, চিনি, এলাচ ফেলাচ দিয়ে কোনও মতে মেক আপ করে গলা ভেজানো। চা খোর বাঙালির তাতেই চলে যায়। ওই যে বলে না ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর – কিন্তু কার মাথা থেকে বেরোয় রাস্তায় বেরিয়ে এই অখাদ্য লাল চা খাওয়ার কথা? চা কে ঠিক খাদ্য বলা যায় কি? তবে আমরা বাঙালিরা তো চা খেয়েই থাকি, তাই খাদ্য। যাকগে যাক, যার মাথা থেকেই বেরোক, সে নিজে খাক, আমায় খাওয়ালো কেন? অবশ্য সেটাও প্রশ্ন নয়, বুঝলি, প্রশ্ন হচ্ছে, চা টা কে খাওয়ালো এবং কবে। সিরিয়াসলি, আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিনা।

    আরও একটা ব্যাপার আছে, সে ব্যাপারটাই আসল ব্যাপার। একটা লোক এসে তক্তার ওপর চা টা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমার অবশ্য খুব একটা চা তেষ্টা পায়নি তখন। তবু হাজার হোক বাঙালি তো, চা পেলে কেউ ছাড়েনা। আমি দু আঙুল দিয়ে সেই প্লাস্টিকের হোমিওপ্যাথি সাইজের গ্লাস বা ভাঁড় যাই বলিস, সাবধানে ধরে জিভে ঠেকালাম, কষটা, বিস্বাদ, খানিক তপ্তপানি। লোকটা বলল, তাড়াতাড়ি খান, এক্ষুনি যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে রে? এই কদিনে কোথাও তো যাইনি আমি।

    আচ্ছা দাঁড়া, ঘটনাগুলো রিকনস্ট্রাক্ট করি। ধরা যাক কাল। কাল আমি কোথায় কোথায় গেছি? আচ্ছা ছাড়, সকাল থেকে কী কী করেছি মনে করি। ভুল বললে বলবি। কাল ঘুম থেকে উঠলাম সাড়ে ছ’টায়। চা বানালাম, মানে জেনুইন চা, যেরকম ভদ্দরলোকে খায়, তেমনি। তারপর টাট্টি করলাম। হ্যাঁরে পাগলা, এটাও বলতে হবে, পীস বাই পীস রিকনসট্রাক্ট করতে হবে। এরপর সদরের কোল্যাপ্‌সিব্‌ল গেট খুললাম, মাধবীর মা আসবে। সে যতক্ষণ বাসন মাজছিল বা ঘরদোর মুছছিল, কোত্থাও যাইনি। দুটো কলা খেলাম, আর একটু দুধ মুড়ি। মাধবীর মা বেরিয়ে যেতে বাজার গেলাম। কী কী কিনেছি ভিভিডলি মনে আছে। তার খতিয়ান দিলে তুই আবার ক্ষেপে যাবি। ফিরে এসে ভাত বসালাম। অন্য দিকের বার্নারটায় কুকারে মুসুরির ডাল সেদ্ধ। বেগুন ভেজেছি, ডিমের ডালনা বানিয়েছি, আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আমি এত ডিটেলে বলছি কেন বুঝলিনা? যেন পাঁচ মিনিটও মাঝখান থেকে গ্যাপ না হয়ে যায়। কোন ফাঁকে যে লোকটা চা খাওয়াতে ঢুকল -

    বাড়ি থেকে বেরোইনি তা নয়। সোজা কাঁঠালিতলার মোড়ে গ্যাসের দোকানে। আজকাল ওই আধার না কী একটা ফ্যাচাং হয়েছে না, সেই ব্যাপারে আর কি। মজা দেখ, শুওরের বাচ্চারা ফর্ম দেবেনা। বলে কিনা পাশে রাস্তায় মিনিট তিনেক হাঁটলে একটা ক্সেরক্সের দোকানে ফর্ম পাবেন। কেন রে ভাই, আই ও সি তো তোদের যতগুলো কাস্টমার ততগুলো ফর্ম পাঠিয়েছে। যাগকে মরুকগে, গেলাম সেখানে। এই দেখ, সেই ফর্ম। ফেরার পথে চা খেয়েছি? তুই তো জানিস, ওপথে চা বলতে দুটো সর্দারজিদের ধাবা, একেবারে মুখোমুখি। সেখানে লাল চায়ের কোনও সীন নেই। একটা শহীদমিনার সাইজের গ্লাসে বিস্তর দুধ আর এলাচের সঙ্গে সামান্য একটু চা মিশিয়ে দেয়। তাই বারো টাকা নিত, এখন হয়ত পনের করেছে, আমি জানিনা। তবে ওখানে আমি বছর দশেক আগে একবারই ঢুকেছিলাম। তাহলে ওপথে চা খাইনি, এটা কনফার্মড তো? তার পর তো ফুটপাথের সব্জিওয়ালির কাছ থেকে একটা বাঁধাকপি কিনে অটোয় চাপলাম। গলির মোড়ে নেমেই সোজা বাড়ি। দুপুরের পর থেকে আর তো কোথাও বেরোইনি। বাড়িতেও কী কী করেছি তোকে প্রত্যেকটা মিনিটের না হলেও পুরোটারই হিসেব দিতে পারি গড়গড়িয়ে। তা তুই ভালমতই জানিস।

    তো ইয়েস্টার্ডে ইজ সেট্‌ল্‌ড। এখন পোশ্নো ডে বিফোর ইয়েস্টার্ডে কী কী করলাম। হ্যাঁ ভাল কথা, একটু আগে মাধবীর মা বলে কিনা, ও দাবাউ, কার সঙ্গে কতা বলতেছ? যা হাসি পেলনা, বললাম, নিজের সঙ্গে গো। আর কাকে পাব কথা বলার জন্যে। অবশ্য গারফিল্ড আছে, তবে সে তো বাংলা বোঝেনা। পায়ের কাছে লাগাতার ম্যাও ম্যাও করলে হিন্দীতে ‘ভাগ হিঁয়াসে’ বলে চেঁচালে চলে যায়। শালা দেশটা নর্থ ইন্ডিয়ানরা কব্জা করে নিলরে। এখন বেড়ালও কেবল হিন্দী বোঝে। মাধবীর মা কপাল চাপড়ে বলে কিনা, হায় হায় গো, আমার দাবাউটা পেগলে গেচে গো – হাঃ হাঃ হাঃ - তা মরুকগে যাক, কথা হচ্ছিল, ডে বফোর ইয়েস্টিডে, মানে হচ্ছে গিয়ে গতকাল। গতকালও সকাল থেকে একই রুটিন মোটামুটি। কখন চা খেলাম, কী কী রান্না করলাম শুনলে তুই আবার খচে বোম হবি, থাক বাবা দরকার নেই, তাছাড়া রুটিন তো একই, রান্নাবান্নাও আইডেন্টিকাল। কালও বেরিয়েছিলাম, সেখান থেকে বলি। না বেরোলে তো প্লাস্টিকের ভাঁড়ে লাল চা খাওয়ার স্কোপ নেই। কিন্তু বিশ্বাস কর, কালকেও সে চা খাইনি, মানে, খেয়ে থাকলেও হিসেবে পাচ্ছিনা।

    কিন্তু পরিষ্কার দেখছি জানিস, একটা লোক, এখন শীতকাল তো, ওইযে সোয়েট শার্টের মত বেরিয়েছে না, মাথায় ঢাকনা দেয়া, কাউন্ট ড্রাকুলা টাইপ, তেমনি একটা পরে, কেমন ছাই ছাই রঙের, বিচ্ছিরি। আবার মাথার ঢাকনাটা অনেকটা টানা, মুখটাও ভাল করে দেখা যায়না, বলল, চা টা খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি, যেতে হবে। আচ্ছা দিনের বেলা, রোদ্দুর মাথার ওপর, এখন কি অত ঠান্ডা থাকে, যে মাথা ঢাকতে হবে? সূর্যটা ওর পেছনে ছিল বোধহয়, তাই মনে হয় মুখটা দেখতে পাইনি। কিন্তু দিনের বেলা এমন হয়? ভীষন কষ্ট হচ্ছে জানিস, কিছুতেই মনে করতে পারছিনা, লোকটা আমায় চা খাওয়ালো কোথায় আর কবে।

    সকাল সকালই বেরোলাম পরশু। ইলেক্ট্রিক বিলের টাকা জমা করব। এখন তো সকাল আটটা টু রাত্তির আটটা, বেশ সুবিধে হয়েছে। মোড় থেকেই অটো পেয়েছি, বাড়ির থেকে তিরিশ পা হাঁটলেই মোড়। তার আগে চা খাওয়ার প্রশ্ন নেই। অটো ভাল করে থামবার আগেই লাফিয়ে নেমেছি ড্রাইভারের হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে। এস এল ছাব্বিশ বাসটা দূর থেকে দেখে রেখেছিলাম আগেই। বাস থেকে নেমে রাস্তা পেরোলেই ইলেক্ট্রিকের অফিস। লাইন অল্পই ছিল, বিল টিল মিটিয়ে ফুটপাথ ধরে কয়েক পা হাঁটতেই গন্ধটা নাকে এল। সেই ছোটবেলায় মা যখন চা বানাতো, এমনি গন্ধ বেরোত। তবে ফুটপাথের চায়ে সেই গন্ধ হয় কী করে? সে কথায় আমার কী কাজ, শীতকালের মিঠে রোদ, আর গন্ধ ম ম করা এককাপ চা, আহা জীবনে আর কী চাই বলতো। না না, অত লাফাস না। প্রথম কথা এ চা কেউ খাওয়ায় নি, নিজের গাঁটের পয়সায় কিনেছি। দ্বিতীয় কথা পুরোপুরি চায়ে দুধে মিলেমিশে একসঙ্গে ফুটছিল, লাল ফাল নয়।

    মায়ের হাতের চা বলতে গিয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। হলুদের ছোপ লাগা নরম তুলতুলে তাঁতের শাড়ি পরা আমার রোগা মা। কেমন একটা সুন্দর গন্ধ বেরোত গায়ের থেকে। এখনকার কোনও মহিলার গায়ে অমন গন্ধ হয়না জানিস, অবশ্য খুব বেশি মহিলাদের কাছাকাছি যাইনি আমি। তবে মনে হয় তাই। আমার মা টা এই ছিল, আবার এই নেই হয়ে গেল। সেসব তো জানিস তুই। মাও নেই, বাপও নেই। আরে বাবা, মা নেই বলেই তো বাপ নেই, সে তো জেলে। তবে অনেক দিন হয়ে গেছে, তা বছর কুড়ি তো হবেই। এবার নাকি বেরোবে। বেরোলে এখানে আসবে নাকি? আমি তো পষ্টো বলব, আগে আমার মা টাকে নিয়ে এস, না হলে এবাড়িতে নো এন্ট্রি। মা টাকে আর আনবে কোত্থেকে, সে তো পুড়ে ছাই, নারে? যাগকে মরুক গে, এখন পোশ্নো হল, লাল চা। আমি কিন্তু সেদিন লাল চা মোটেই খাইনি। লোকটার সসপ্যান থেকে কী সুন্দর একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল, গিয়ে বললাম, ভাই চা কত করে? লোকটা বলল, চার টাকা। তা দেখি এক কাপ।

    লোকটা শুওরের বাচ্চা কী হারামি দেখ, সসপ্যানে যেটা ফুটছিল, সেটা কিন্তু দিলনা। পাশে কেটলিতে রাখা কাল না পরশু কবেকার বানানো কে জানে, খানিকটা চা ঢেলে দিল একটা কাগজের কাপে। বড় রাস্তার ওপর আবার পোরিবেস টোরিবেস, প্লাস্টিক চলবেনা। মাইরি চা টা নিয়ে এক চুমুক দিয়েছি কি দিইনি, কাঁধে এক চড়। আমার চার টাকার চায়ের দেড় টাকাই চলকে গেল। কী ব্যাপার, এখানে? ফিরে দেখি সুপ্রিয়া। আমি বললাম, আমি তো ইলেকট্রিকের বিল মেটাতে, তুমি? আচ্ছা চা খাবে?

    সুপ্রিয়া উত্তর দিলনা। বলল, কেমন আছ, ভালই মনে হচ্ছে? আমি বললাম, ভালই যখন মনে হচ্ছে, তখন আর জিজ্ঞেস করা কেন। আচ্ছা পরপুরুষের গায়ে হাত দিলে কেন? এগুলো অ্যালাউ? এগুলো তিনশো চুয়ান্নোয় পড়েনা? সুপ্রিয়া বলল, তুমি? আরে তুমি পরই বা কোথায় আর পুরুষই বা কিসে। আমি বললাম, সব্বোনাশ, আমি পুরুষ নই? তবে কি এলজিবিটির শেষ অক্ষরটা নাকি? সে বলল, হুঁঃ পুরুষ হলে তো জোর খাটাতে। ছাড় ওসব কথা, বিয়ে করেছ? আমি বললাম, ফাগোল, খাওয়াব কী? সে বলল, কেন তোমার অত বড় চাকরি? আমি হাত ঘুরিয়ে বললাম, নেই নেই। সুপ্রিয়া অবিশ্বাসীর মুখ নিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, সত্যি নেই, মাক্কালি, বিশ্বাস কর। আমাদের জি এম আমাকে বাস্টার্ড বলেছিল। আমি তো জান একটু ইয়ে। ভরা বাজারে খুলে আম বলে দিলাম, শালা খান – সুপ্রিয়া বলল, চুপ কর, হচ্ছেটাকি রাস্তায়? কে না কে শুনবে। ছিঃ ভদ্রলোকের ছেলে এমন কথা বলে নাকি? আমি বললাম, যা ব্বাবা, ভদ্রলোক জেলে থাকে নাকি, তবে আমি ভদ্রলোকের ছেলে কিসে?

    সুপ্রিয়া বলল, বলছকি তুমি, সিরিয়াসলি তাই? আমি বললাম, হ্যাঁগো প্রেয়সী, তাই। সুপ্রিয়া আপত্তি কিছু করেনি, তবে চট করে উত্তর-দক্ষিণ-পূব-পশ্চিম সব দিক দেখে নিল, কেউ শুনল কিনা। তারপর বলল, কিন্তু কেন? আমি বললাম, কেন আবার, আমার একটা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করার কথা ছিল। বিকেলে ফোন করল জিএম, বলল, রেডি তো? আমি বললাম, কী করে রেডি, আমার স্টেশনে অন্য লোককে পাসওয়ার্ড দিয়েছেন কেন, বসে বসে পানু দেখেছে, এত্তো এত্তো ভাইরাস, খুলতেই পারছিনা তো রেডি। ব্যাটাচ্ছেলে বলল, অন্য কারো স্টেশন থেকে করেননি কেন? আমি বললাম, কার কাছে যাব, সবাই তো কাজ করছে। তখন বলেকি, বা-স্টার্ড। বলে ফোন কেটে দিল ঝপাং করে। আমার তো ধাঁক করে চড়ে গেল। শালা লাঞ্চের পর কনফারেন্স রুমে ঢোকার মুখেই সব্বার সামনে বললাম, অ্যাই শালা খা – আচ্ছা থাক। কিন্তু সমস্যা হ’ল, আমায় তো ফোনে বলেছে, কেউ শোনেনি আমি ছাড়া। আমি তো বললাম, সবার সামনে। ডিসিপ্লিনারি প্রোসীডিং হল, মাধবন আর অমূল্যর সামনে প্রোমো, ওরা বলল, হ্যাঁ বলেছে। মাধবন আরেকটা খা – ঐ আর কি, বাংলা একবর্ণও বোঝেনা, তবু বলল। ইউনিয়নের সজলদা বলল, আমি বিশেষ কিছু করতে পারব বলে মনে হয়না, কী করে পারবে, ওর পার্টির নেতাদের তো দুবেলা গালি দিই ক্যান্টিনে। তবু বলল, তোমার যখন এভিডেন্স চাইবে, তুমি বলবে, আমি কিচ্ছু বলিনি। ধু-র, আমায় যখন এইচ আর ডির মাগির দালালটা জিজ্ঞেস করল আপনি কী বলেছেন? আমি বেশ রসিয়ে রসিয়ে আর একবার বলে নিলাম। জোরেই বললাম, আমি জেনেই গেছিলাম, ও শুওরের বাচ্চা আমার চাকরি খাবে বলেই এসেছে। নীতার সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের সময়ে আমি সাক্ষী দিয়েছিলাম না?

    সুপ্রিয়া খুব কষ্ট পেয়েছে মনে হ’ল। বলল, খাচ্ছ কী? আমি বললাম, দিব্যি খাচ্ছি। এই তো সকালে ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, ডিমের কারি করে রেখেছি। গিয়েই খাব। তবে ইয়ে হয়েছে, বাজারে অনেক দেনা হয়ে গেছে। আর বেশি দিন দেবেনা বোধহয়। আরে ছোড়ো ইয়ার, আমি চার্বাকের দেশের লোক। আচ্ছা, একটা পাঁচশো হবে নাকি? ধার নয় গো, ফেরৎ দিতে পারবনা। তবে আর কাউকে না হলেও মাধবীর মায়ের মাইনেটা বাকি রাখতে পারিনা। সেই পনের বছর বয়স থেকে ওর কাঁধে বডি ফেলেই তো এত বড় হলাম, বল? সুপ্রিয়া ব্যাগ ট্যাগ ঝেড়ে ঝুড়ে বলল, তিনশো চল্লিশ হচ্ছে, বিশ্বাস কর – প্রায় কেঁদেই ফেলবে এবার। আমি বললাম, কী পাগলামি হচ্ছে, বিশ্বাস করবনা কেন, তোমার সঙ্গে দেখা না হলে এটাই বা দিত কে। বাপের টাকা যা ছিল ব্যাঙ্কে সব আমার সঙ্গে জয়েন্ট। তাই ভাঙিয়ে ক’বছর দিব্যি গেল। চাকরি করা টাকাও ছিল কিছু। প্রভিডেন্ট ফান্ডের নিজের পার্টটা তো পেয়েছিলাম, সেটা ব্যাঙ্কে রেখে এখন কিছু হচ্ছে। নীচের গ্যারাজটা একটা ইস্তিরিওয়ালা আর এক খৈনিওয়ালা ভাড়ায় নিয়েছিল। এতদিন সিপাহী বিদ্রোহের আমলের ভাড়া দিত, এবার কাউন্সিলারের এক চামচা কে দিয়ে চমকে খানিক বাড়িয়ে নিয়েছি। তাতেই হয়ে যায় মিউনিসিপাল ট্যাক্স, ইলেক্ট্রিকের বিল, গ্যাস – শুওরের বাচ্চারা গ্যাসের দামটা কোথায় নিয়ে গেছে ভাব? আচ্ছা তোমার খবর বললে নাতো, বরটা ভাল পেয়েছ?

    সুপ্রিয়া বলল, হ্যাঁ, লোক তো ভালই। তবে খুব ব্যাস্ত মানুষ, বড় চাকরি তো, সারাদিন তো বটেই, পারলে রাতেও থাকে অফিসে। রোববার টোববারও যেতে হয় মাঝে মাঝে। আমি বললাম, মুশকিল কী জান? বাপ মা যদি দেখেশুনে বিয়ে দেয়, তো বড় চাকরিওয়ালাই খোঁজে। কেরানিদের সঙ্গে বিয়ে দিলেই মেয়েরা সবচে সুখে থাকে, এটাই বোঝেনা। তা ছাড়া মোস্ট অফ দা কেরানিস আর ভেরি সেফ অ্যাজ ফার অ্যাজ ম্যারিটাল ট্রাস্ট ইজ কনসার্ন্ড। যাকগে, ছেলেপুলে? সুপ্রিয়া বলল, আছে একটা। ওকে স্কুলে দিতেই তো এসেছিলাম। ফেরার সময়ে ড্রাইভার এসে নিয়ে যায়। আমি বললাম, ড্রাইভার? গাড়ি আছে নাকি? ওহ্‌ বেসিক ভুল। অতবড় চাকরিওয়ালা মানুষের গাড়ি তো থাকবেই। লিফট পাওয়া যাবে? সুপ্রিয়া বলল, ওমা, এটা আবার কী কথা, এস এস। আমি ব্যাজার মুখ করে বললাম, ইস গাড়িতে না গিয়ে ট্যাক্সি করে নিয়ে যেতে পারতে। নিরিবিলিতে গায়ে ফায়ে একটু হাত দিতাম – ধাঁ করে ঘুরল সুপ্রিয়া, যখন আমার বিয়ে হয়নি, যখন প্রায়ই দেখা হত, কবার গায়ে ফায়ে হাত দিয়েছ, মনে পড়ে? আমি বললাম, ধুস ক্ষেপা, তখন ভাবতাম নিজেরই তো জিনিষ, সেটা আবার কেউ চুরি করে নাকি? সুপ্রিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল, জিনিষ? জি-নিষ? মানে মোটামুটি জড়বস্তু, তাকে তুলে রাখা যায়, ব্যবহার করা যায়, ইচ্ছে হলে ফেলেও দেয়া যায়, তাইনা? শোনো। আমি একটু অন্য দিকে যাব। তুমি বাস ফাস ধরে নাও।

    বাসেই এলাম জানিস, এর পর আর লাল চা খাওয়ার স্কোপই নেই বল? বাস থেকে নেমে অটোয় উঠতে যাচ্ছি, দেখি মদনদা। আমায় দেখেই বলল, কী, পালাচ্ছ কেন, যাক পালাচ্ছ পালাও তবে কাল থেকে দোকানে আর কিছু বাকিতে পাবেনা। কত হয়েছে জান? হাজার পাঁচেক পেরিয়ে গেছে। ভেবেছিলাম চাকরি বাকরি কিছু একটা জুটিয়ে নেবে। বাজারে সবজি টবজিও কি ধারে দেয় নাকি? আমি বললাম, দেখুন এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলছেন কেন। সব শুধে দেব, এলআইসি টা ম্যাচিওর করুক। মদনদা বলল, কিস্যু ম্যাচিওর করবেনা। প্রিমিয়াম দাও কোত্থেকে, আমায় গান্ডু পেয়েছ ? বাপ তো ছাড়া পাচ্ছে শুনছি, ফিরে এলে তো মাথার ওপর ছাদটাও যাবে। আমি বললাম কী ফালতু বকছেন, নিজের ছেলেকে কেউ বেঘর করে? তাই শুনে কী বলল জানিস? – হ্যা হ্যা নিজের ছেলে? তবে আর বৌটার গলা টিপল কেন।

    শোন ইয়ে হয়েছে, জানিস, জিএম ব্যাটাকে খানকিচ্ছেলে বলেছিলাম ও শালা কিছু না জেনেই বলেছে বলে। মদনা শালা জেনেই বলছে বুঝলি, তা সে ঠিক জানুক আর ভুল। বললাম মদনদা, এখন আমার কাছে কিছু আছে, তবে প্যান্টের ভেতরের পকেটে। সবার সামনে বের করবনা, দিনকাল ভালনা। গলিটার ভেতরে একটু আসুন। তুই জানিস তো এদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারলাইন হবে হবে সেই কবে শুনছি, খাটা নর্দমাটা থেকেই গেল সারাজীবন। মদনার একটা পা বেরিয়েই আছে নর্দমা থেকে। বেশি গোঁতাগুঁতি করতে গেলে কেউ দেখে ফেলতে পারে। ফিরে এলাম তাড়াতাড়ি। তুই বল এবার, লাল চা খাবার সময় ছিল?

    একটা কথা বলি তোকে। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘দেজা ভ্যূ’ বলে একটা কথা আছে জানিস? কিছু ঘটনা ঘটবার সময়ে মনে হয়, এতো আগেই হয়ে গেছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি লাল চা আসলে খাইনি আমি, খাচ্ছি এখন। ওইযে, লোকটা আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। আলোর দিকে পেছন ফেরা বলে মুখটা ভাল দেখা যাচ্ছেনা। নারে ওটা সূর্য না, ঘরের সিএফএল। লাল চা খাচ্ছি কেন প্লা্সটিকের কাপে ? আমার নিজের কাপ কই? এটা সত্যি চা নাকি? খৈনিওয়ালার দোকান থেকে সেই যে তামাকপাতা গুলো আনা হল, সেগুলো আবার দুদিন ধরে জলে ভিজিয়ে রেখে জ্বাল দিয়ে দিয়ে কনসেন্ট্রেট করা হল তোর মনে নেই? লালচে লালচে, কালচে কালচে, জিভে ঠেকালেই জ্বলছে রে। পেটের মধ্যে মোচড়াচ্ছে কিরকম, চোখে দেখতে পাচ্ছিনা কেনরে? একি? শ্বাসকষ্ট হচ্ছে যে। বিচ্ছিরি সোয়েট শার্টটা তো আমারই মনে হচ্ছে এখন, মরাসাহেব কিনেছিলাম ফুটপাথে। ভেতরের লোকটা কে? তুই?

    মাধবীর মায়ের জন্য তিনশো চল্লিশ রইল অ্যাশট্রে চাপা। দশ টাকা কম আছে, তা থাক।
    ১১/০১/২০১৪
  • রূপঙ্কর সরকার | 126.203.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০১৪ ১০:৩৯630185
  • একটা ভুল আছে - গত পরশুকে 'গতকাল' লেখা হয়েছে। তারপরও একবার আছে।
  • | ১২ জানুয়ারি ২০১৪ ২০:২৬630186
  • পড়লাম।
  • সিকি | 135.19.***.*** | ১৪ জানুয়ারি ২০১৪ ১৫:০০630187
  • একটু দেরিতে পড়লাম। বেশ লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন