এ লেখার নাম, ‘ধানাই পানাই’। দু হাজার তিন সাল থেকে ডায়েরির পাতায় হিজিবিজি লিখে গেছি, প্রধানতঃ নিজেই অবসরে পড়ব বলে। ডায়েরির পাতায় লিখলেও ডায়েরির মত ক্রোনোলজি নেই। মাঝে মধ্যে তারিখের উল্লেখ থাকলেও আগের বা পরের ঘটনা উল্টে পাল্টে গেছে। আমার তখন গোটা দুয়েক বাসস্থান ছিল। একটা ফ্ল্যাট ছিল, যাতে আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকত, আর আমার পৈত্রিক বাড়িটার তখন জরাজীর্ণ দশা, সেখানে থাকতাম আমি একা। কিছুটা সময় কাটানোর তাগিদেই লিখতে শুরু করেছিলাম ধানাই পানাই।
আমার সঙ্গে দেখা করতে নানা রকম লোকজন আসত, কচি কিশোরী থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ, মাঝে মাঝেই দরজায় টোকা পড়ত। তাদের জন্য চা বানাতে কিছুক্ষ্ণণের জন্য আড়ালে যেতেই ফিরে এসে দেখতাম ডায়েরির পাতা ওল্টানো শুরু হয়ে গেছে। এই বিষম বয়সী পাঠক-পাঠিকাদের আগ্রহ দেখে ভাবলাম বস্তুটা বাজারে ছাড়লে মন্দ হয়না, তাই এই প্রয়াস।
ধানাই পানাই মস্ত বড়। অতখানি নতুন করে লেখা আমার সাধ্যের অতীত। উল্টো পাল্টা দিনপঞ্জীকে আরো উল্টে পাল্টে খামচা খামচা তুলে দিচ্ছি, ফলাফল নিশ্চিত নয়।
আর একটা কথা, আমার ধানাই পানাইতে আমি নিজে ব্যতীত কয়েকটি চরিত্র আছে, তারা মাঝে মাঝে উদয় হয়, কিছু বাক্য বিনিময়ের পর প্রস্থানও করে। পুরোটা এখানে লিখতে পারলে আলাদা করে তাদের পরিচয় দেবার প্রয়োজন পড়তনা, কিন্তু এটা খাবলা খাবলা হরিনাম, তাই তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেই হয় –
১) কমলাকান্ত – ইনি বঙ্কিম চাটুয্যের সৃষ্ট চরিত্র। মাঝে মাঝে আমার গৃহে তাঁর আগমন ঘটে। তাঁর কথাবার্তায় কালোপযোগী পরিবর্তন ঘটেছে, আমার সঙ্গে খুড়ো-ভাইপো সম্পর্ক।
২) ইঁদুরদেব – ইনি গণেশের (একটি বিশেষ গণেশমূর্তির) বাহন। ইনি পূর্ববঙ্গীয় বাংলায় কথা বলেন, মানে, পাতি কথা হল, বাঙাল।
৩) স্যার - এঁকে অনেকে ভগবান বলেন, আমি স্যার বলি। অন্যায় কিছু নয়, রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন মা মা বলে ডাকতে না পারলে শালা শালা বলে ডাক। তা শালার চাইতে ‘স্যার’ নিশ্চয়ই হীন সম্বোধন নয়।
৪) কেষ্টদা – ইনি পুরানে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণ, আমার সঙ্গে সম্পর্কটা মাইডিয়ার গোছের।
বারান্দায় রোদ্দুর
হাল আমলের একটা বাংলা ব্যান্ডের গান বাজারে বেশ পপুলার হয়েছিল, ছোট, বড়, সবার মুখেই প্রায়ই ওই গানের দুটি কলি শোনা যেত, “তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই।" এ গানের প্রথম লাইন হল, “বারান্দায় রোদ্দুর আমি আরাম কেদারায়-“ শীতকালে বারান্দায় মিঠে কড়া রোদ পড়েছে আর বাড়ির কর্তা আরামকেদারায় বসে রোদ পোয়াতে পোয়াতে সমস্ত ইহলৌকিক সুখ শুষে নিচ্ছেন পরিমণ্ডল থেকে – এরকম দৃশ্য আমরা ছেলেবেলায় দেখতাম হামেশাই।
সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে খুবই ঘনিষ্ঠ পরিচিতির একটি মেয়ের সম্বন্ধ দেখতে বেহালার এক প্রান্তিক অঞ্চলে গেছি, যে বাড়িতে ঢুকলাম, তার মালিক ভদ্রলোক অনেকটা আমার দাদুর মতন দেখতে, কথাবার্তাও দাদুর মতই কাটকাট। ভদ্রলোকের নাম ধরা যাক নগেন্দ্র সেন (নামটা সামান্য বদলেছি, এটা বলা বাহুল্য, তাও বললাম। এও বলে রাখি, অনেক নামই বদলে যাবে)। উনি প্রথমেই বললেন, আপনারা এ বাড়িতে সম্বন্ধ করছেন সব জেনেশুনে তো ? আমার এক ছেলে কিন্তু নকশাল, আর ওয়ান্টেড লিস্টে বেশ ওপর দিকে তার নাম। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, সে সময়ে বাম উগ্রপন্থায় বিশ্বাসী এক বিদেশিনীর নাম প্রায়ই কাগজের প্রথম পাতায় দেখা যেত, তিনি এই ছেলের স্ত্রী। আমরা ভদ্রলোককে বললাম, না, আমরা জানতাম না, তবে জানবার পরও আমাদের আগ্রহ কমেনি। ভদ্রলোক বললেন, শুনে খুশি হলাম, কেননা আই অ্যাম প্রাউড অফ মাই সান। তারপরই ভদ্রলোক বললেন, আপনাদের জানিয়ে রাখি, আমার পদবী সেন, কিন্তু আমরা বদ্যি নই, কায়স্থ। আসুন, আপনাদের আমার বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাই।
যে ঘরে আমরা বসেছিলাম, সেখান থেকে খানিক ভেতরে যেতেই চকচকে লাল সিমেন্টের একটা প্রশস্ত অথচ লম্বা টানা ঢাকা বারান্দা, সে সময়ে ‘ডাইনিং স্পেস’ ব্যাপারটা বাজারে খুব একটা চালু হয়নি, বাড়ির ভেতর দিকের লম্বা অংশকে কাভার্ড বারান্দা বা ঢাকা বারান্দা বলা হত। ভদ্রলোক আমার দিকে ঘুরে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, এত লম্বা একটা বারান্দা খামোখা কেন বানালাম, জিজ্ঞেস করলেন না তো ? উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি বললেন, শুনেছেন তো আমার সাতটা ছেলে ? এদের প্রত্যেকের জন্য আমি গর্বিত। এখন এই সাতটা ছেলের প্রত্যেকের যদি সাতটা করে ছেলে হয়, তবে উনপঞ্চাশটা নাতি এখানে পাশাপাশি পাত পেড়ে বসে খাবে আর আমি ইজিচেয়ারে বসে সেই দৃশ্য দেখব, – সেই প্রভিশন করে রেখেছি। কী? আইডিয়াটা কেমন লাগল? ভারতের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ওপর ছোটখাট একটা লেকচার দেবার ইচ্ছে থাকলেও ভদ্রলোকের প্রবল পারসোনালিটির চাপে পড়ে সেটা আর সাহসে কুলোলনা। তাছাড়া এঁর সন্তানরা যেরকম দৃঢ়চেতা এবং সচ্চরিত্র বলে জানলাম, তাতে এরকম জিনবাহিত লোকসংখ্যার বিস্ফোরণে ভারতের লাভই হবে বলে প্রত্যয় হল। অবশ্য মনে আরও কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছিল, যেমন সব কটা বৌমার ফার্টিলিটি রেট সমান হবে এমন গ্যারান্টি আছে কিনা এবং নাতির বদলে নাতনি হলে তারাও পংক্তিভোজনে অংশ নেবে কিনা ইত্যাদি। ভয়ের চোটে সেসবও চাপা পড়ে গেল।
ও সম্বন্ধটা শেষ অবধি পাকা হয়নি, কথাবার্তাও বেশীদূর এগোয়নি। আমাদের মেয়েটি বড়ই রোগা। সম্ভবতঃ সাতটা ডেলিভারির ধকল সে সামলাতে পারতনা।
২০১২ সালের এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে ও পাড়ায় গেছিলাম প্রায় চল্লিশ বছর পরে। আশ্চর্য, সেন বাবুদের বাড়িটা ঠিক একই রকম আছে। সদস্য সংখ্যা এখন কত, তা অবশ্য ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।
আমার বাবার সাতটা নয়, একটাই ছেলে। বাবা তবুও একটা বিশাল লম্বা বারান্দা বানিয়েছিল। একটা ইজিচেয়ারও কিনে রেখেছিল। তাতে অবশ্য কোনওদিন বসা হয়ে ওঠেনি। বারান্দাটা কিন্তু ঢাকা নয়, খোলা, বাড়ির বাইরের দিকে। বাবার শ্রাদ্ধের দিন সেখানে অনেক লোক বসেছিল। এরকম উদ্ভট প্ল্যান বানানোর জন্য মা আর আমি খুব চ্যাঁচামেচি করেছিলাম, এ ভাবে কেউ জায়গা নষ্ট করে? তার উত্তরে বাবার যুক্তি ছিল, বাড়ির পূব-দক্ষিণ দিক একেবারে খোলা, কয়েকটি টালির বাড়ি এবং প্রচুর গাছপালা। তা ছাড়া আমাদের পাশের জমিটার পর থেকেই এক বিশাল ঝিল, যার এমাথা দেখা গেলেও ওমাথা দেখা যায়না। যে কথা বাবার মাথায় ঢোকেনি তা হল ডারউইন সাহেবের বিবর্তনবাদে পৃথিবীতে এক নতুন প্রাণীর আবির্ভাব হবে যারা টালির বাড়ি খেতে ভীষণ ভালবাসবে, তাদের নাম হবে, প্রোমোটার। তারা গাছপালা খেতেও পছন্দ করবে খুব। তা ছাড়া বাবা গান বাজনা বেশী পছন্দ করতনা বলে মান্না দে’র গান শোনেনি - যদি কাগজে লেখ নাম – সে নাম মুছে যাবে। যদি ঝিলকে হিসেবে ধর – সে ঝিল বুজে যাবে। - মান্না দের গানটা অবশ্য ঠিক এরকম ছিলনা। তাতে কি, এরকম হতেই পারত।
ইঁদুর
আজ দু হাজার চারের বারই জানুয়ারী। আজ সকালে একটা অপরাধ করেছি, যাকে আইনের ভাষায় বলে, ‘কালপেবল হোমিসাইড নট অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার’। তার মানে খুন, কিন্তু হত্যা নয়। গোলমেলে ব্রিটিশদের থেকে আমরা আইন শিখেছিতো, তাই সবই সম্ভব।
বেশ কিছুদিন ধরে বাড়িতে খুব ইঁদুরের উপদ্রব। রাতের বেলা খুটুর খাটুর, ঘুম ভেঙ্গে যায় বারে বারে। কাগজপত্র, বইখাতা কেটে কুচিকুচি করছে। দীনেশকে দিয়ে একটা ইঁদুর ধরা কল কিনে আনালাম। আমি আবার খুব দায়ে না পড়লে কোনও প্রাণীকে মারতে চাইনা। খালি মনে হয়, ইঁদুর তো আর বইয়ের মর্মার্থ বোঝেনা, বুঝলে কাটতো না। তা ছাড়া এটা যে পরের বাড়ি, এখানে ঢুকলে ট্রেসপাসিং হচ্ছে, এ ব্যাপারটাও বোধহয় তাদের জানা নেই। তাই কলে ইঁদুর পড়লে টাবলুদের বাড়ির পাশে পাঁচিল ঘেরা জঙ্গলটায় ছেড়ে আসি। অবশ্য ইঁদুর তো আর জঙ্গলে থাকেনা, সে কাছাকাছি কোনও বাড়িতে ঢুকবেই। তখন যদি সে বাড়ির লোক তাকে মারে তো মারুক, আমি খামোখা প্রাণী হত্যা করবনা। কিন্তু ইদানিং হঠাৎ পালে পালে ইঁদুর আসছে। গন্ডায় গন্ডায় ইঁদুর ছেড়ে আসছি জঙ্গলে, আবার কোত্থেকে এসে জুটছে। তা ছাড়া জ্যান্ত ইঁদুর ছাড়তে যাওয়ারও সময় আছে, হয় মাঝ রাত্তিরে, নয়তো কাক ভোরে। লোকের চোখে পড়লে, তাদের বাড়ির কাছে ইঁদুর ছাড়ার জন্য তাড়া করতে পারে। এই তো কদিন আগে হাড় হিম করা শীতের মধ্যে রাত একটার সময় একটাকে ছেড়ে এলাম। কাল আবার একটা পড়েছে। গতরাতে শীতও অসম্ভব বেশী ছিল, ভোর ভোর উঠতে পারিনি, একটু বেলাও হয়েছে, তবু চললাম টাবলুদের বাড়ির দিকে কল হাতে করে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, এবারেরটা ধরা পড়ার পর থেকেই হঠাৎ কেন জানিনা মনে হল, এটা বোধ হয় পার পাবেনা, কাকের পেটে যাবে। এইরকম যা ভাবি-তাই-হয় ধরণের ঘটনা আমার প্রায়ই ঘটে, তা নিয়ে দু কলম লেখাও আছে ধানাই পানাইতে।
জঙ্গলের পাঁচিলটার খুব কাছে যাওয়া যায়না, লোকে ওখানে ময়লা ফেলে। একটু দূর থেকে কলের মুখটা ফাঁক করে এক ঝটকায় ছুঁড়ে দিই, ইঁদুর বাবাজী উড়ে গিয়ে পড়ে জঙ্গলে। আজ একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে এক সুদর্শনা যুবতী অটো ধরবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। সাত সকালে একটা হাফবুড়ো লোক চাদর মুড়ি দিয়ে ইঁদুর নিয়ে লোফালুফি খেললে তার কী রিঅ্যাকশন হবে, এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কলের মুখটা ফাঁক করে এক ঝটকা মারলাম, ইঁদুর বেরোলনা। আসলে ঝটকার সময়ে ব্যাটা প্রাণপনে কিছু আঁকড়ে ঝুলে ছিল। ব্যাপারটা কী হল বোঝার জন্য একটু থামতেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে ছুট লাগাল। তা ছুটবিতো জঙ্গলের দিকে ছোট, তা না উল্টোদিকে যুবতীর দিকে ছুটলেন তিনি। যুবতীদের প্রতি আকর্ষণ ইঁদুরেরও থাকে জানতামনা। সে তখন ইঁদুর দেখে ‘ইঁ-ক’ করে হাইজাম্প ট্রায়াল দিচ্ছে, দু-দুটো কাক কোত্থেকে উড়ে এসে দুপাশ থেকে সাঁড়াশী আক্রমণ করলো। পায়ের কাছে টি-রেক্সের মত একটা ইঁদুর আর দুপাশে টেরোডাক্টিলের মত দুটো ধাবমান কাক, এমত অবস্থায় সব যুবতীদের যা হয়, তাই হল। বিবেক ওবেরয়ের মত দেখতে একটা অটো ড্রাইভার তাকে টুক করে তুলে নিল গাড়িতে, আর ইঁদুরটাকে টুক করে তুলে নিল একটা কাক।
হতভম্ব আমি রি-অ্যাক্ট করার সময়টুকুও পেলামনা। করে লাভও হতনা, ওদিকে দৌড়ে গেলে ভুল বুঝে বিবেক ওবেরয় ঘুষি টুষিও চালিয়ে দিতে পারত। মনটা খারাপই হয়ে গেল, তবে মনকে প্রবোধ দিলাম এই বলে, যে এমনটা হবে সে তো আমি আগেই টের পেয়েছিলাম।
রডন স্ট্রীটের কন্সট্যানশিয়া বিল্ডিং-এ আমাদের অফিস। কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা চওড়া ল্যান্ডিং। সেখানে কার্পেট আর বাহারী গাছের টবের সারি। একদিকে সিঁড়ি আর এক দিকে লিফট। খানিকটা এগোলেই বাঁ দিকের দেওয়ালে একটা বেশ বড়সড় চৌকো অংশ ভেতর দিকে ঢোকানো, সেখানে রিলীফ করা এক পেল্লায় গণেশের মূর্তি। আগে খোলাই থাকত, সকলে পায়ে হাত ঠুকে পেন্নাম করে করে রঙ চটিয়ে দিচ্ছিল বলে এখন কাঁচ দিয়ে ঢাকা। পায়ে হাত দেবার যো নেই, তবে সামনে দাঁড়িয়ে নমস্কার করা যেতে পারে। আমিও অফিসে ওঠার সময়ে একদন্ত বিনায়ককে ভক্তিভরে নমস্কার করেই উঠি। আজও নমো করে পেছন ফিরেছি, হঠাৎ শুনি, সরু গলায় কে যেন বলছে, অ্যাই ছ্যামরা, খারাইয়া যা। ঘাবড়ে গিয়ে থমকে গেলাম, কে রে বাবা! সরু গলা বলল, এই দিকে আউগাইয়া আয়, কী মনে করসস ? খ্যামতা আসে বইল্যা যা ইসসা তাই করবি? আমার নাতিনডারে কাউয়া দিয়া খাওয়াইলি ক্যান? ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি গণেশের পায়ের কাছের ইঁদুরটা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে।
চার দিকে চেয়ে দেখলাম, ধারে কাছে কেউ নেই। সিকিওরিটির লোকগুলোই বা কোথায় গেল? একটা ঢোঁক গিলে বললাম, দাঁড়াও, সব বলছি। কিন্তু তুমি বাঙাল ভাষায় কথা বলছ কেন ? কটমটে চোখ বলল, এই মূর্তি বানাইছে কে জানস? কুমারটুলির পালেরা ওরিজিনালি কইত্থন আইসিল জানস কিসু ? জানস না। হ্যারা তো নর্থ ক্যালক্যাটায় থাইক্যা থাইক্যা ঘটি মনে করে নিজেগো। আমিও আইসিলাম পোটলার মইধ্যে লুকাইয়া। কিন্তুন আমি তো তগো মতন মানবজনম পাইনাই, হেই লিগ্যা তগো মতন নিমকহারামও নই, যে দ্যাশের কথা ভুইল্যা থুমু। আমিই হইলাম গিয়া ফার্ষ্ট মডেল ইন্দুর। আমারে দেইখাই প্রথম গণেশ বাহন তৈয়ার করে হ্যারা। আমি বললাম, তা যেন হল, কিন্তু আমি মোটেই তোমার নাতনিকে ইচ্ছে করে কাকের মুখে দিইনি। ইন ফ্যাক্ট, আমার যথেষ্ট মন খারাপ হয়েছিল।
১৮ই জানুয়ারী, রবিবার। ফুটো মশারীটা অবিলম্বে পাল্টানো দরকার, কিন্তু অলস মানুষের যে যে বিপদ হতে পারে, তার মধ্যে মশার কামড় ইনক্লুডেড কিনা ভাবতে ভাবতে সবে ডায়ারী নিয়ে বসেছি, গণেশ বাহন বলল, কিরে ছ্যামরা, ডায়ালগ শ্যাষ না কইরাই ধানাইপানাই লেখতে বসলি ক্যান ? আমি বললাম, দাঁড়াও, তোমার সব কথার উত্তর দিচ্ছি। প্রথম কথা, তোমার নাতনি তো জঙ্গলের দিকে ছুটতে পারত, তা না করে উল্টো দিকে ছুটল কেন? জঙ্গলটা দু ফুট আর ফুটপাথটা তিরিশ, কোনটা কাছে? তাছাড়া ও তোমার নাতনি হল কী করে? তোমার পর ক’টা জেনারেশন গেছে? তুমি যাদের সঙ্গে এসেছিলে, সে পালদেরই তো ছ-সাতটা জেনারেশন কেটে গেছে। তোমাদের লাইফ স্প্যান তো অনেক কম! তৃতীয়তঃ তোমার নাতি নাতনিরা আমার বাড়িতে বার বার ট্রেসপাস করে কেন? সব কিছু কেটে ছারখার করবে, আর আমি সিটিং সিটিং টলারেটিং?
- খারা খারা উকিলের নাতি, বালোই ওকালতি শিখছস, তর সওয়াল গুলির জবাব দেই, প্রথম কথা হইল, দিগবিদিক জ্ঞান শুইন্য হইয়া ছুটা কারে কয় জানস? তহন কি খেয়াল থাকে, কোনডা শর্টকাট আর কোনডা লং? দ্বিতীয় কথা, নাতির পর পুতি, তারপর আমাগো ভাষায় পরিচয় কই? তাই সবোই নাতি কিংবা নাতিন। শ্যাষ কথা, হে যেন কই অনুপ্রবেশ করসে কইলি?
আমি বললাম, করেছেই তো, আমার বাড়িতে, মাই ওন রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং অ্যাট প্রেমিসেস নাম্বার ওয়ান বাই টেন এ, বেদিয়াডাঙ্গা সেকেন্ড লেন, কলকাতা সেভেন ল্যাক থার্টি নাইন।
- এই বাসাডা তর ?
- হ্যাঁ।
- তর ?
- হ্যাঁ বলছিতো। আমার ছাড়া কার ?
- কি কইরা তর হইল ?
- কেন? একে তো অর্ধেকের বেশীটা আমিই বানিয়েছি। যাকগে, টাইট্ল ছিল বাবার নামে। বাবা মারা যাবার পর, ভাই বোন কেউ না থাকায় ফিফটি পার্সেন্টের মালিক হলাম হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট মোতাবেক। বাকি ফিফটি পার্সেন্ট মা আমাকে দান করেছে গিফট ডীড করে গত বছর।
- বাঃ বাঃ খুব বালো, কথায় কয় না, কার গোয়াল, আর কেডা ধুঁয়া দেয় – তর মায়ে তরে দিসে। মা পাইসে বাবা গত হইলে। তর বাবায় পাইসে কি কইরা ?
- কেন? বাবা জমিটা নগদ টাকা দিয়ে কিনেছিল। এই দেখনা, - দিস ইনডেনচার মেড দিস টোয়েন্টি ফার্স্ট ডে অফ –
- খারা খারা, পেচাল শুইন্যা কাম নাই, তর বাবায় কিনছে কার থিকা ?
- শ্রী মন্মথনাথ দত্ত, সান অফ লেট গোবর্ধন দত্ত অফ ফরটি টু বি, সঈদ আমির আলি অ্যাভিনিউ, পি এস কড়েয়া –
- আইচ্ছা আইচ্ছা, অত প্রমাণ দাখিলের দরকার নাই। কথা হইল, উক্ত মন্মথনাথ কী কইরা পাইল জমিনডা?
- ওরে ব্বাবা, দাঁড়াও, তাও খুঁজে বের করব, হ্যাঁ, তিনি কিনেছিলেন শ্রী মুকুল কুমার বসু, সান অফ –
- হইসে, হেই মুকুল পাইল কেমনে ?
- তিনি জমিটা উনিশশো চুয়াল্লিশ সালে পুর্ণ চন্দ্র পালের –
- পূর্ণ পাইসে কি কইরা, হেইডা ক।
- সে এক ব্যাপার। এর আগের মালিক শেখ ইউসুফ ধার নিয়ে শোধ করতে না পারায় মামলা করে নিলামে –
ইঁদুরদেব খুব উত্তেজিত, আরে ইউসুফরে কে দিল জমিনডা হেই কথা শুনি এইবার।
- কেন, উনিশশো কুড়ি সালে জনৈক শ্যামাচরণ পার্শি শেখ সাহেবকে বিক্রী করেছিলেন এই জমি।
- তা শ্যামাচরণ বিক্রী করার কে ? কুন অধিকারে সে এই জমিন বেচে ?
- আরে, তার নাবালিকা বিধবা কন্যা পাতাসীবালা দাসী তো এই জমি ভোগদখল করছিল।তার গার্জেন হিসাবে –
- ব্যাস। শ্যাষ। এই ভোগদখল কথাডাই শুনবার চাইতে আসিলাম। এই দখল কথাডার মইধ্যেই গায়ের জুর ফলানোর গন্ধ আছে কিনা ক। তা ওই নাবালিকা বিধবার গায়ে কত জুর যে হে জমিনডা দখলে রাখে? হে জুর পাইছে আইনে। হেই আইন বানাইসে কেডা? প্রাণী জগতে হগগলেই জমিন দখল করে। এইবার আরো বলশালী কেউ আইয়া ফের দখল নিতে পারে কিন্তুন তরা হেই জমিন বেচস কী কইরা, কেনসই বা কী কইরা? আমার পচপান্ন পুরুষ, লক্ষ লক্ষ, কুটি কুটি ইন্দুর কুমারটুলি হইতে কুমড়াহাটি দখলিসত্ব ভোগ করতেয়াসে। তর বাসায় তর যত অধিকার, আমার নাতিনেরও তাই। তবে কিয়ের লিগ্যা তুই তারে খাঁচায় বন্ধ কইরা কাউয়া দিয়া খাওয়াইবি ?
গোলাপি জামা
বেশ কিছুকাল আগের কথা। তখন সারা কোলকাতা(কলকাতা নয়)জুড়ে পাতাল রেলের খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। আখেরে কোলকাতার লাভ হয়েছে, বা বলা উচিত, হতে চলেছে, কিন্তু তৎকালীন বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল ধরেছে। বেশ কিছু রমরমে ব্যবসা লাটে উঠেছে। সোজা কথায়, কারো পৌষ মাস, কারো সব্বোনাশ। সেদিন একজন আমায় বলল, এই প্রবচনের ইংরিজী কী? আমি বললাম, হোয়ট ইজ স্পোর্ট টু সামওয়ান, ইজ ডেথ টু আদার্স। সে বলল, এটা তো ঠিক পিঠোপিঠি ইংরিজী হলনা? আমি বললাম, ও, তা সে ব্যবস্থাও আছে। - কি রকম ? বললাম, পৌষ মাসের খানিকটা জানুয়ারীতে থাকে তো, তবে শোন, হোয়ট ইজ সামওয়ানস জানুয়ারী, ইজ সাম আদার্স ওবিচুয়ারী। সে বলল, মাইরী, পারেন বটে।
তা যা বলছিলাম, খননের সময় বহু লোকের ব্যবসা লাটে উঠেছিল। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ এর মোড়ে একটা খুব বড় ওষুধের দোকান ছিল। কেওড়াতলার দিকে মুখ করলে বাঁ হাতে পড়ত। দোকানটার সমুখের বিস্তারটা ছিল বিরাট, পাশাপাশি তিনটে দোকান অনায়াসে হতে পারত। এক সময়ে দেখেছি ভীড়ে গমগম করত। ধীরে ধীরে দোকানটার আলো কমতে লাগল, শো কেসের কাঁচে ময়লা ধরতে লাগল, ফাটা কাঁচের জায়গা নিল খবরের কাগজ। এর জন্য অবশ্য পাতাল রেলের সরাসরি দায়িত্ব থাকতেও পারে, নাও পারে। তবে দোকানটার মুমূর্ষু অবস্থা কাকতালীয় ভাবে পাতাল খননের সমসাময়িক।
সেদিন ঐখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি দোকানে কোনও খদ্দের নেই, সামনে, একেবারে গেটের কাছে, দুটো প্রাচীন কাঠের চেয়ারে দুই প্রাচীন ব্যক্তি বসে দাবা খেলছেন। একজন সম্ভবতঃ দোকানের মালিক, অন্যজনের বাড়ির লোকের কাছে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমি ওখানে একটু দাঁড়িয়ে গেলাম, ঠাওর করে দেখলাম, দাবার চালগুলো দিতে হয়, তাই দেওয়া, জেতার ইচ্ছে কারোরই নেই। দোকানটার দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপই হয়ে গেল।হঠাৎ শুনি পথে একটা গোলমাল।
ওদিকটায় রসা রোড অনেকটা চওড়া, তার এক দিকে বূলভার্ড, অন্য দিকে ফুটপাথ (পেভমেন্ট)। এখানে আবার টিপ্পনী লিখতে হবে, প্রথম কথা এ রাস্তা এখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নামে, রসা রোড চলে গেছে সে-ই কোথায় বাঙ্গুর হাসপাতালের পাশে ছোট্ট একটা গলিতে আর দ্বিতীয়তঃ বূলভার্ড বলে আর কিছু নেই ওখানে। একটা আঠারো নম্বর বাস এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার একেবারে মাঝখানে। সেখান থেকে কন্ডাক্টর টেনে হিঁচড়ে ওই স্টপে যাদের নামার কথা, তাদের বিদায় করছে। উদ্দেশ্য মোটেই মহৎ নয়, একই দিকে গন্তব্য এমন কোনও বাস বা মিনিবাস নিশ্চয় পেছনে তাড়া করে আসছে। এই বাস তাকে আটকাবার জন্য রাস্তার ডান দিক ঘেঁষে একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। তবে যে আসছে, তার উদ্দেশ্যও এর চেয়ে মহত্তর হবার কথা নয়। সে নিশ্চয়ই বাঁ দিকটা আলগা পেয়ে সে দিক দিয়েই ওভারটেক করার চেষ্টা করবে, আর সেই প্রয়াসে যদি দু এক জনের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিতেও হয়, আমাদের বর্তমান আইনের ফাঁক ফোকরে অসতর্ক শকট চালনার জন্য বরাদ্দ সাজা মাত্র দুইমাস কারাবাস অথবা মাত্র দুই হাজার টাকা জরিমানা। ওটাও নাকি ড্রাইভারকে দিতে হয়না, মালিক টাকাটা রেডী করেই রাখেন। বলা তো যায়না, কখন লাগে। বাজারে আলু পেঁয়াজের দাম বাড়ে, আজকাল খুব ঘন ঘনই বাড়ে, চাকরীবাবুদের মাইনেও বাড়ে কিন্তু চাপা দিয়ে লোক মারার জরিমানা অনাদি অনন্ত কাল ধরে দু-হাজার টাকা।
স্টপে নামবার লোক অনেকই ছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করতে লাগল, - বাঁ দিক দিয়ে গাড়ি এলে কী হবে ? মাঝখানে দাঁড় করানো একটা স্বভাব হয়ে গেছে, একদিন মজা বুঝিয়ে দোবো – তোরা এইজন্য মার খাস, - কিছু বলিনা বলে বড্ড বেড়েছিস – ইত্যাদি। কন্ডাক্টর নির্বিকার, কেননা এই কথা গুলো সে রোজই শোনে, পর পর মুখস্থ বলেও যেতে পারে। ও জানে যে শেষ লোকটাকে খালাস করে ও লাফিতে উঠে চলো-ও বলবে, গাড়িটা সোজা সেকেন্ড গীয়ারে স্টার্ট নেবে আর গুটোনো লেজ সমেত খ্যাঁক খ্যাঁকরা যে যার গলিতে ঢুকে পড়বে।
ওষুধের দোকানটার সামনে দিয়ে, একেবারে দেয়াল ঘেঁষে একজন নিম্ন-আয় বর্গের হাফবুড়ো আসছিলেন। চেহারাটা ভীষন কমন, প্রায় সব পাড়ায় দেখা যায়। মাথার চুল সল্ট অ্যান্ড পেপার, সল্টের ভাগ বেশী, প্রায় আশি-কুড়ি। গালে দিন চারেক ক্ষুর পড়েনি, চারাগুলো ধবধবে সাদা। গায়ে একটা ময়লা ফ্যাকাশে গোলাপি রঙের জামা। এঁরা সব পাড়াতেই গোলাপি জামা পরে ঘোরেন। এঁদের দেখে দেখে আমার বোতাম গুলোও মুখস্থ হয়ে গেছে, যেমন, ওপরের বোতামটা নেই, তার পরেরটা ট্রান্সপারেন্ট সাদা কিন্তু কালো সুতো দিয়ে সেলাই করা, তার পরেরটা গাঢ় সবুজ আর তার পরেরটা অরিজিনাল। জামাটা ফ্যাকাশে মেরে গেছে কিন্তু বোতামটা এখনও চকচকে গোলাপি।
জামার তলায় ময়লা গেঞ্জিটার তিনকোনা যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, তাতেই গোটা দুই ছ্যাঁদা আর গেঞ্জির ওপর দিয়ে পর্য্যাপ্ত পরিমানে সাদা ধবধবে বুকের লোম। কোমরের তলা থেকে হাঁটু অবধি যেটা ঝুলছে, সেটা আধখানা লুঙ্গি, একখানা গামছা কিংবা ভাঁজ করা বৌয়ের শাড়ি, যার রঙ রূপ দুটোই অতীত। প্রত্যেক পাড়ার লোকটার হাতে যা থাকে, এঁর হাতেও তাই। একটা ছোট নাইলনের থলি, যার রঙ কী ছিল, তাই নিয়ে বাজি ধরা যেতে পারে। সব সময়েই উইন-উইন সিচুয়েশন।
লোকটি দাবাড়ুদের পরিচিত কিন্তু ‘কেমন আছিস’ এই কথাটা দু হাজার সাতশ আটাশ বার বলার পর এখন আর বলার প্রয়োজন মনে করেননা, তাই তাকিয়ে ভুরু দুটো ওপরে তুলে ধপাস করে ফেলে দেন। লোকটি রোগা, শান্ত এবং নির্জীব।
গোলমাল শুনে তিনিও আমার মত ঐ দিকে তাকালেন, তারপর হাতের থলিটা দোকানের সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে রেখে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, হনহন করে হেঁটে রাস্তায় ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। কন্ডাক্টর নির্বিকার মুখে খ্যাঁক খ্যাঁক শুনতে শুনতে যাদের টিকিট সে কেটে উঠতে পারেনি তাদের দাঁড় করিয়ে টিকিট কাটছিল। সে কিছু বুঝে ওঠবার আগেই শান্ত, নির্জীব লোকটি তার গালে ঠাস্ করে একটা চড় কষালেন। হতভম্ব কন্ডাক্টর হাঁ করা মুখ বন্ধও করতে পারেনি, চার দিক থেকে চড় বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল।
খ্যাঁক খ্যাঁকরা বেমালুম হালুম হালুম হয়ে গেল। এরপর হাতের মুঠো বন্ধ হল, চড় থেকে ঘুষি। বাসের গেটের কাছে বড়জোর জনা সাতেক লোক ছিল, এখন দেখি সত্তর। দমাদম ঘুষি লাথি চলছে, নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে, ব্যাগ থেকে খুচরো পয়সা বৃষ্টি হচ্ছে রাস্তার অনেকটা জুড়ে।
শান্ত নির্জীব লোকটি কিন্তু একটা চড় মারার পরে আবার শান্ত এবং নির্জীব ভাবে ফিরে এসেছেন, থলিটা তুলে নিয়ে আবার তিন রকম বোতামওয়ালা গোলাপি জামা গায়ে দেয়ালের ধার ঘেঁষে হাঁটতে আরম্ভ করেছেন। মনে হল বাড়ি থেকে বেরোনর সময়ে গিন্নী পইপই করে বলে দিয়েছেন, ভাল করে শুনে নাও, - একপো সরষের তেল, পঞ্চাশ সাদা জিরে, একটা কাপড় কাচা সাবান আর কন্ডাক্টারকে একটা থাপ্পড়। ভুলে যেয়োনা যেন আড্ডা মারতে গিয়ে –
এই প্রায়বৃদ্ধ লোকটি বাসে ছিলেন না, রেগুলার বাসযাত্রী বলেও মনে হলনা। উনি সাতেও ছিলেননা, পাঁচেও ছিলেননা। তা হঠাৎ কন্ডাক্টারের ওপর আক্রমণের হেতু কী? আসলে অনেকগুলো রাগ গলার কাছে আটকে ছিল। ফ্যাক্টরিটা অনেকদিন লকআউট তাই রাগ, খুকির মা আজকাল বড় খ্যাঁক খ্যাঁক করে তাই রাগ, খুকির বিয়ে দেয়ার অদূর ভবিষ্যতে কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা তাই রাগ, বাজারে ভাল ইলিশ উঠেছে কিন্তু ছুঁলেই হাত পুড়ে যাবে তাই রাগ, ভোম্বলটা আজকাল রাত করে বাড়ি ফেরে, এবার মাধ্যমিক পাশ করতে পারেনি, মুখের কাছে কথা বললে কেমন পালিশ পালিশ গন্ধ ছাড়ে, এরকম অনেকগুলো রাগ। এই সব রাগ জমে জমে তিন বছর হল টক ঢেকুর কিছুতেই বন্ধ হচ্ছেনা, গোলাপি জামার পকেটে সব সময় ঘামে ভেজা গোলাপি জেলুসিল, তাই আরও রাগ।
সালটা বোধকরি দুহাজার কিংবা দুহাজার এক। অফিসে বসে কাজে ডুবেছি, হঠাৎ কানে এল, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ জোরে চেঁচিয়ে বলছে, এই যে ভাই, শুনুন, শুনুন, এই যে ভাই, আপনি একটু দাঁড়ান তো – বেশ উত্তেজিত ভাবে জোরে জোরেই বলছে। ও খুবই শান্ত এবং অতিরিক্ত রকমের ভদ্র। এরকম জোরে কথা ওর মুখে কখনও শোনা যায়না। সবাই তাই ওদিকে তাকিয়েছে, আমিও। আমার কিউবিক্লটা হলের একেবারে শেষ প্রান্তে, এক কোণায়। তাই ওখান থেকে পুরো হলটাই দেখা যায়। দেখলাম, যার উদ্দেশে আবেদন, সে শুনছেওনা, দাঁড়াচ্ছেওনা। ভাস্করের থেকে হাত দশেক তফাতে বেশ জোরে হাঁটছে। এবার ভাস্করও গতি বাড়িয়েছে, - দাঁড়ান, দাঁড়ান বলছি – সামনের লোকটি এবার ছুটতে আরম্ভ করেছে। ভাস্করও এবার ছুটছে, সামনে কাউকে বলছে, এই যে, ওকে থামান তো, ধরুন ওকে, ধরুন, ধরুন – হলের ঠিক মাঝামাঝি ঢোকার প্রধান দরজা, সেটা কাঁচের। তার উল্টোদিকের সোফায় সারাদিন কিছু লোক বসে থাকে। তারা বিভিন্ন কোম্পানীর প্রতিনিধি, আমাদের অফিসে কাজে এসে চট করে ফিরতে চায়না। ফিরে গেলেই কাজ আর কাজ। তার চেয়ে ঠাণ্ডায় কিছুক্ষণ আয়েস করে ফিরে গিয়ে বললেই হবে, - অমুক সাহেব কিছুতেই ফাইল ছাড়ছিলেননা। তাদেরই একজন ব্যাপারটা আঁচ করে আগেভাগে দরজার কাছে উঠে গেছিল। লোকটা কাছাকাছি যেতেই সে জাপটে ধরল। ভাস্কর চেঁচিয়ে বলল, ছাড়বেন না, ধরে রাখুন।
আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি ভাস্কর লোকটার দুগালে গালে চড় কষাচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছেনা। ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত নিপাট ভদ্রলোক কাউকে চড় কষাবে এ তো ভাবাই যায়না। অবশ্য যার চড় মারা অভ্যাস নেই তার চড় খুবই আলতো হয়, এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছিল।
এবার অমিতাভ দত্ত দৌড়ে গেল। লোকটার কলার চেপে ধরে, ওর কাঁধের ব্যাগ থেকে ভাস্করের সেলফোনটা বের করে আনল। এখানে আবার টিপ্পনীর প্রয়োজন, সে সময়ে আমাদের অফিসে কেবল ভাস্করেরই আধলা ইঁটের মত একটা মোটোরোলা ফোন ছিল। ও যখন সেটা ব্যবহার করত, আমরা গোল গোল চোখ মেলে স্লাইট হিংসে মাখা দৃষ্টি নিয়ে দেখতাম।
এবার আস্তে আস্তে অনেকেই নিজের নিজের কিউবিক্ল থেকে বেরিয়ে এসেছে। লোকটার চারদিকে ভীড়। চড় চাপাটি পড়ছে ধুপধাপ।
আমি কিন্তু তখনও বসে। নানা রকম ঘাত প্রতিঘাতে কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেছি। ভীড় ভাট্টার মধ্যে সচরাচর যাইনা আমি। কিন্তু আমার যাবার কথা, একে তো ভাস্কর সরাসরি আমার বস, মানে উপরওয়ালা। তার বিপদে বা এক্ষেত্রে বিপর্যয়ে আমার নাকটাই আগে গলবার কথা, কিন্তু ঐ যে বললাম, এখন আমি নির্লিপ্ত।
কোনও ব্যাপার ছিলনা, চোর ধরা পড়েছে, সেলফোন উদ্ধার হয়েছে, ব্যাপার স্যাপার মিটেও গেছে। কিন্তু ভদ্র, সভ্য, বঙ্গসন্তানদের আদুরে চড়চাপড় আমার মাথায় হঠাৎ দেশলাই ঠুকল। এরা চোর প্যাঁদাচ্ছে না শালীর মাথায় চাঁটি মেরে খুনসুটি করছে? আমার যে বড় রাগ। আমার সংসারে আগুন কে জ্বেলেছে, চাকরিতে জল কে ঢেলেছে, যত গুণাগুণ নিয়ে জন্মেছিলাম, তাতে ধোঁয়া কে দিয়েছে ? তুই শালা।
চেয়ার থেকে উঠে খুব শান্ত ভাবে ভীড়ের মধ্যে মিশে গেলাম। লোকটার পিছনে গিয়ে ওর টেল বোনের ওপর হাঁটুটা গদাম করে আছড়ে দিলাম। ব্যাটা কাতরে উঠে সামনে ঝুঁকতেই ডান হাতের কনুইটা সপাটে বসিয়ে দিলাম ওর শিরদাঁড়ার ওপরে। ‘বাবাগো’ বলে মুখ ফেরাতেই নাক আর মুখের মাঝামাঝি একটা আড়াআড়ি রদ্দা। লাল রঙের পোস্টার কালার গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে কষ বেয়ে, মুখটা দেখলাম এবার। একটি কুড়ি-পঁচিশ বছরের যুবক, কাতর গলায় বলছে, ‘আর মারবেননা স্যার’। ‘স্যার’ বলল কেন? আমাকে চেনে নাকি ? আমাদের এজিএম মেঘসুন্দর জোয়ারদার তখন চ্যাঁচাচ্ছে, ওরে বুড়োটাকে সামলা, ওকে থামা তোরা, ছেলেটা মরে যাবে যে, ব্যাটা নির্ঘাত জেলে যাবে।(টিপ্পনীঃ মেঘসুন্দর ছেলেবেলার বন্ধু, একই বয়স)
চোরকে ছেড়ে সবাই তখন আমায় চেপে ধরেছে। হাত ছাড়াতে গিয়ে নিজের জামাটার দিকে নজর গেল। কেমন যেন পিংকিশ রঙ না? গোলাপি ধরণের। এ বয়সে এই রঙ আর মানায়না। নাঃ আর এ জামা পরবনা। বোতামগুলোও ঠিক মিলছেনা, আদিনাথকে সারতে দিয়েছিলাম, উল্টোপাল্টা কী সব লাগিয়েছে –
মূষিকের পর্বত প্রসব
সরু কিচকিচে গলায় ধমক খেয়ে চটকা ভাঙল,- লেখতেয়াসস নাকি? কারে নাকি ধইরা মারসস তাই নিয়া এককাহন। আরে মাইনষের স্বভাবই তো এই, আর কাউরে না পাইয়া নিজেগো মাইরা উল্লাস করে। হেই রোমের অ্যাম্ফিথিয়েটার থিকা এই কান্ড চলতেয়াসে। আরে তরা তো নিজেগো গালি দিবার সময়েও ছাগল, কুত্তা, শুয়ার এই সব নাম নেস, তারা হুইন্যা কত দুঃখ পায় ক’ দেহি?
প্রতিরোধ আইতেয়াসে, হেইডা জানস? এই কয় দিন হইল, গলফ গ্রীনের দুই বেচারারে র্যাবিড শিয়ালে কামরাইয়া মারসে, পরসস নিকি, কাগজে ? কেউ পাপ করে, আর কেউ ফল ভুগে। তগো জুতিবাবুর ঘুমের ব্যাঘাত করসে বইল্যা সেন্ট্রাল পার্কের পোয়াতী শিয়ালডারে প্যাটমোটা পুলিশগুলা বন্দুকের কুন্দা দিয়া পিটাইয়া মারসিল মনে আসে? দলমার হাতিরা প্রতি বৎসর বাকুরা, মেদিনীপুর, বর্ধমানের কত বেচারারে পায়ে চাইপ্যা মারে? বাসন্তী আর রাঙ্গাবেলিয়ায় কত বেচারারে বাঘে নেয় প্রতি বৎসর? এইতো গতকাইল, এই ঝাড়গ্রামে, বাইসন ঢুসাইয়া মারসে এক বেচারারে। আর বেশী কথা কি কমু, তগো দ্যাশের বাপ, খোদ রাষ্ট্রপতির বাসার বাগানে এক পুলিশরে ঢুসাইয়া মারল হরিণে। ভোগদখল, ভোগদখল – তগো ভুগেরও সীমা নাই, দখলেরও সীমা নাই। তগো জুতিবাবু আলফ্রেড হিচককের ‘বার্ডস’ দেখে নাই ? আইজকাই ত কাগজে লেখসে চিতা বাঘ ধরসিল দুইডা মাইয়ারে, বরাত ভাল, নিতে পারে নাই।
একে থামানো দরকার। আমি বললাম, দাঁড়াওতো, তোমাকে একটু শুদ্ধ করে দিই। যাকে তুমি চিতাবাঘ বলছ, তুমি কেন, নাইনটি পারসেন্ট বাঙালি যাকে চিতা বলে, তাকে ইংরিজীতে বলে লেপার্ড, বাংলায় ‘গুলবাঘা’। চিতা আমাদের দেশে আর নেই। উনিশশো আটচল্লিশ সালে অফিশিয়ালি এক্সটিংক্ট হয়ে গেছে। তাও ছিল দু একটা, উনিশশো বাহান্ন সালে সরগুজার মহারাজা রেওয়ার কাছে দুটো চিতার বাচ্চাকে গুলি করে মারেন, সেই শেষ।
ইঁদুরদেব বললেন, থাম। তর কাছে কেউ জুলজী পড়তে আসেনাই, আর ওই মহারাজ হারামজাদার নামে কি জানি কইলি, আর একবার ক’ দেহি শরম লাগে কিনা? যাউকগিয়া, কথা হইতেয়াসিল তগো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাণীগো প্রতিরোধের। বাঘ ভল্লুকে সরাসরি মাইনষের টক্কর নিতে পারে, আমরা পারিনা দেইখা তুচ্ছ ভাবিসনা। এই ইন্দুর বংশের শইল থিকা প্লেইগ কেমন মহামারী হইসিল তা জানস নিশ্চয়। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়স নাই?
দেখলাম, এ লাইনে খেলা যাবেনা, ক্রস ব্যাটে খেলা ছাড়া উপায় নেই। বললাম, আচ্ছা, তোমরা বাঙালরা কি কোনও কথাই ঠিকমত বলতে পারনা? ‘প্লেইগ’ আবার কী, কথাটা প্লেগ। পি-এল-এ-জি-ইউ-ই। - থাম থাম, মেলা পেচাল পারিস না, তরা নিকি শুইদ্ধ কথা কস,- কস ‘অ্যাক’ কিন্তুন লেখস ‘এক’। সুভাষ বোস রে কস ‘শুভাশ বোশ’। চালনির মাইগ্য ঝরঝর করে, হে আবার সুচের বিচার করে, হাইস্যা বাচিনা। লড়াইতে হারলে চলবেনা, বললাম বাঙালদের নিয়ে বড় বিপদ, কোনও কথাই ঠিক মত উচ্চারণ করতে পারেনা। ওটা ‘বাচিনা’ নয়, বাঁচিনা। গনেশবাহন খুব চটেছে, - হ হ আমরা কই হাইস্যা বাচিনা, তরা কস হাঁসতে হাঁসতে মরে যাব। এই হাঁস কয়ডা কইরা ডিম দেয় কইতে পারস ? কথাডা হাঁসি নয়, হাসি। তরা বিনা কারণে চন্দরবিন্দু যোগ করস, আমরা তারে বিয়োগ করি। চন্দরবিন্দু হইল মৃত্যুর প্রতীক। আমরা হইলাম জীবনমুখী। তাই কই, লিভ অ্যান্ড লেট লিভ। ইউ লিভ, লেট ইন্দুরস অলসো লিভ।