পি-এল-আর
এখন অ্যাক্রোনিমের যুগ। বেশী কথা বলবার উপায় নেই। এই তো এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের খেলা চলছে, কিন্তু তা বললে হবে? আই-পি-এল বলতে হবে। তাতে কলকাতা(কোলকাতা) নাইট রাইডার্স বলে একটা টীম আছে। তা বললে হবে? কে-কে-আর বলতে হবে। অবশ্য সব জায়গায় চলবেনা। যেমন, মানুষের নামে। চলবেনা বললে ভুল হবে, ক্ষেত্র বিশেষে চলে তো বটেই, যেমন শাহরুখ খান হলেন এসআরকে। পি চিদাম্বরমকে পিসি(মা নয়) অনেকে বলেন বটে, তাই বলে সোনিয়া গান্ধী কে এসজি কিছুতেই বলা যাবেনা। ওটা সুনীল গাভাস্কার বা সৌরভ গাঙ্গুলী-ও হতে পারে। মনমোহন সিংকে এমএমএস বলা যাবে? লোকে তো মোবাইল খুলে ক্লিপ খুঁজবে।
সিনেমার নামও এখন অ্যাক্রোনিমে হয়। কাগজে, বিশষতঃ ইংরিজী কাগজে সংক্ষিপ্ত নাম ছাড়া দেখাই যায়না। ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’ বলে একটা ঝিংকুচিকু বাংলা ছবি বেরোল(হায় দাদা গোষ্ঠগোপাল, তোমার মরেও শান্তি নেই)। তার নাম লেখা হ’ত ‘পিজেজেআর’। বেশ কিছুকাল আগে একটা হিন্দী ছবি মুক্তি পেয়েছিল, ‘কভি খুশি কভি গম’ নামে। এখন তাকে ‘কেকেকেজি’ বলতে কেমন যেন শোনায়, তাই ‘কে-থ্রি জি’ বলা হতে লাগল, তবে ইস্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা তার নামটা সামান্য বদলে করল, ‘তিন কেজি গম’।
এ জিনিষ আজকের নয়, উনিশশো উনসত্তর সাল। অফিসের কাজে ভুবনেশ্বর যাচ্ছি। তখন এরোপ্লেনে যাবার এলিজিবিলিটি ছিলনা (এলিজিবিলিটি-র বাংলা হয়, কিন্তু ‘যোগ্যতা’কে সঠিক শব্দ মনে হয়না। সব চেয়ে বড় কথা, অতগুলো হ্রস্ব-ই পরপর লেখার লোভ সম্বরণ করতে পারলামনা) ট্রেনেও তখন এসি ফেসি ছিলনা। আমাদের জন্য ছিল ফার্স্ট ক্লাস। শেষ মুহূর্তে টিকিট কেটেছি। চারজনের কামরা সব ভর্তি তাই একটা হানিমুন কুপে দিয়ে দিল, সেখানে আর একজন যাত্রী থাকবেন। কোনও দম্পতি বুক না করলে এগুলো শেষ সময়ে রঘুপতি যদুপতিদের দিয়ে দেয়া হ’ত।
কামরায় ঢুকে দেখি আর এক জন যাত্রী আমারই বয়সী যুবক এবং বাঙালি। খুব ভালই হ’ল। বেশ গপ্পো করতে করতে যাওয়া যাবে। নাম টাম বলে হাত ঝাঁকানোর পর (‘করমর্দন’ কেন বলে আমি এখনো বুঝিনা) অবধারিত পরের প্রশ্ন, আপনি কী কাজ করেন এবং কোথায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে, বিয়ে হয়েছে কিনা(বেশির ভাগ সময় বোঝাই যায়) এবং শ্বশুরবাড়ি কোথায়। ব্যাপারটা আলাপের ক্ষেত্রে অ্যাট অল রেলেভেন্ট কিনা আমার মাথায় ঢোকেনা। যাই হোক, আমারটা তো বলেছি আগে। এবার তাঁর পালা। আপনি কোথায় আছেন? তিনি বললেন সিবিআই। আমার মুখের হাসি শুকিয়ে গেল, আমি খুব ধীরে ধীরে সীটের একেবারে কোনায় গিয়ে সিঁটিয়ে বসলাম।
কিছুক্ষণ বাদে সেটা খেয়াল করে আমার সহযাত্রী বললেন, ওকি! আপনি ওরকম আড়ষ্ট হয়ে বসে আছেন কেন? অত কোনায় গিয়েই বা বসেছেন কেন, এখানে তো আর কেউ আসবেনা। আমি বললাম, না, মানে, আপনাদের প্রোফেশনের লোক দেখলে একটু ভয় হয় কিনা – উনি কথা থামিয়ে বললেন, সেকি, আপনার আমার তো একই প্রোফেশন। আমিও তো ব্যাঙ্কার, আমার কর্তৃপক্ষ সিবিআই, মানে, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া।
ডাক্তার বিনায়ক সেনের মামলায় সারা পৃথিবী উত্তাল হওয়ায় মিডিয়া কাভারেজ ভালই হচ্ছিল। তার মধ্যে একটা খবর ছিল যে, ছত্তিসগড়ের স্পেশাল প্রসিকিউটর টি সি পান্ড্য মহোদয় আদালতে বলেছেন, বিনায়ক সেনের যোগাযোগ শুধু মাওবাদীদের সঙ্গে নয়, আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থীদের সঙ্গেও ওঁর যোগ রয়েছে। ডাক্তার সেনের স্ত্রী ইলিনা সেন নাকি নিয়মিত ‘আইএসআই’ এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তাঁর তথ্য চালাচালি হয় কোনও এক ‘ফার্নান্ডেজ’-এর সঙ্গে।
ব্যাপারটা গোলমেলে। ফার্নান্ডেজ নামের লোক ইন্টারপোল বা সিআইএ-র গুপ্তচর হতেও পারেন কিন্তু আইএসআই? ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হচ্ছে। মিসেস সেনের কাছে জানা গেল, ‘আইএসআই’ হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান সোসাল ইনস্টিটিউট’ আর মিস্টার ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ হচ্ছেন নিউ দিল্লিতে অবস্থিত সেই সংস্থার পূর্বতন ডিরেক্টর।
আমরা, মানে ব্যাঙ্কবাবুরাও কিছু কিছু অ্যাক্রোনিম ব্যবহার করতে করতে এমন সড়গড় হয়ে যাই যে প্রাত্যহিক জীবনেও তা প্রয়োগ করতে গিয়ে মহা বিপত্তি বাধাই। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার কিছুদিন আগে আমাকে এক মস্ত বড় শাখার কর্ণধার করে দেয়া হ’ল। সেখানে একদিন টহল মারতে মারতে এক অফিসারের সঙ্গে এক ক্লায়েন্টের কথোপকথন কানে এল –
- ডাক্তারবাবু, আপনার হাউসিং লোনের কিস্তিতো খানিক বাকি পড়েছে। আর একটা ফেল করলেই ‘এনপিএ’ হয়ে যাবে। এনপিএ মানে জানেন তো?
- থাক থাক, আমাকে আর নন প্র্যাক্টিসিং অ্যালাউয়েন্স নিয়ে জ্ঞান দিতে হবেনা। ওটা নিয়েও অনেকে প্রাইভেট প্র্যাটিস করছে, এই বলতে চান তো?
- না না, আমি বলছিলাম, এনপিএ, মানে, নন পারফর্মিং অ্যাসেট-এর কথা।
- আপনি কী বলছিলেন আমি ভালই বুঝেছি। আই শ্যাল বি গ্ল্যাড ইফ ইউ কাইন্ডলি মাইন্ড ইয়র ওন বিজনেস।
ঐ যে বললাম, ব্যাঙ্কে বা যে কোনও বড় সংস্থায় বেশিদিন কাজ করলেই এই সব অ্যাক্রোনিম দৈনন্দিন ভাষায় ঢুকে পড়ে। আমাদের কাছে ‘পিএলআর’ ব্যাপারটা জলভাত। এর পুরোটা হচ্ছে ‘প্রাইম লেন্ডিং রেট’ তা কোন ব্যাঙ্কার না জানে। কিন্তু এখন বাজারে ‘পিএলআর’ বলে যা চলছে, সে অতি সাংঘাতিক জিনিষ। একে পুরো বললে দাঁড়ায়,- ‘পাস্ট লাইফ রিগ্রেশন’।
সত্যি নাকি ?
সন্দেহবাদী, যাদের ইংরিজীতে ‘স্কেপটিক’ বলা হয়, তাঁরা বলেন পুনর্জন্ম ফুনর্জন্ম বলে কিছু হয়না। মুকুল সোনার কেল্লায় ঢুকে কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি, তার কারণ সম্ভবতঃ রায় মশাইও ব্যাপারটার যৌক্তিকতা নিয়ে ধন্ধে ছিলেন। যদি বলা হয়, মুকুল না পারুক, এই যে কাগজ টাগজে মাঝে মাঝেই পড়ি, অমুক গ্রামের তমুক বাড়ির ছেলে আগের জন্মে কোথায় ছিল, সে সব পুঙ্খানুপুঙ্খ বলে দিচ্ছে? স্কেপটিকরা বলেন, রাখুন তো, পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য ওসব আগে থেকে শিখিয়ে দেয়া থাকে।
যাঁরা অতটা কট্টর নন, তাঁদের ব্যাখ্যা হচ্ছে এইরকম, ইএসপি বলে একটা বস্তু আছে। যাদের রিসেপশন ভাল, তাঁরা অনেক সময়েই দূরের বস্তুর অস্তিত্ব টের পায়। এই দূরত্ব শুধু জাগতিক নয়, সময়-প্রাচীর, মানে গোদা বাংলায় ‘টাইম-ব্যারিয়ার’ পেরিয়েও এই ইনফো আসতে পারে। তাই দেখেই ওরা বলে, আমি ওখানে ছিলাম, এই হয়েছিল, তাই হয়েছিল, এই সব। কিন্তু যদি দুপক্ষই, মানে সময় প্রাচীরের দুদিকের লোকই একই কথা করোবোরেট করে তখন? করোবোরেট-এর বাংলা কী? সমর্থন? কাছাকাছি, তবে একদম এক নয়। আমার গল্পটা বলি –
এখন তো হয় এক সন্তান, বড়জোর দুই। এই খতিয়ান অবশ্য শুধু বাঙালিদের। আমার নিকটতম বিহারী প্রতিবেশীর এই বাজারেও ন’টি সন্তান। ইউ পি-র জনসংখ্যা একুশ কোটি, গোটা রাশিয়ার জনসংখ্যার চেয়েও বেশী। যাক, এ প্রসঙ্গ পরে, যা বলছিলাম, এখন তো একটি দুটি, তাই বড়দা, মেজদা, সেজদা এই সব শব্দ বাংলা ভোকাবুলারি থেকে লোপ পাচ্ছে। পেয়েই গেছে মোটামুটি। তবে যখন এসব চলত, তখন অনেক বাড়িতে দেখেছি বাড়ির সবচেয়ে বড় ছেলেকে অন্যরা ‘মেজদা’ বলছে।
এর কারণটা কী? কারণ খুব ছোট বেলায় বড় ছেলে মারা গেছিল। হ্যাঁ, তা দুঃখের কথা, কিন্তু তখন তো বেশির ভাগ ছোট ভাই বোনগুলো জন্মায়নি, তো তারা যাকে জন্মে থেকে বড় দেখছে, তাকেই তো বড়দা বলবে। না, তা নয়, সম্ভবতঃ কোনও জ্যোতিষির ভবিষ্যবাণী ছিল যে, এ বাড়ির বড় ছেলের ফাঁড়া আছে, তাই বড়কে মেজ বললে সে বিপদ থাকছেনা।
আমার মায়ের দিকের সম্পর্কের এমনি এক আত্মীয়দের বাড়িতে ছোটবেলায় গিয়ে দেখতাম বড়ভাই কে মেজদা বলা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, আসল বড় ছেলে খুব অল্প বয়সে মারা গেছে। ধরা যাক তার নাম ছিল যদু।
তখন তো বাংলা ভাগ হয়নি, তাই এপার ওপারের ব্যাপার ছিলনা। কোলকাতা থেকে প্রায়ই ‘দেশে’ যাওয়া হ’ত। সে আমরাও যেতাম বছরে দুতিন বার। সেবার সে বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠ কেউ দেশে যাচ্ছেন, যদু বায়না ধরল, আমিও যাব। সে একেবারে নাছোড়বান্দা, তাকে সঙ্গে নিতেই হ’ল। যিনি যদুকে নিয়ে গেলেন, তিনি বহুযুগ পরে যাচ্ছেন, রাস্তাঘাট কিচ্ছু মনে নেই। লোককে জিজ্ঞেস করে করে যেতে হবে।
যদু বলল, কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। গরুর গাড়ির গাড়োয়ানকে সেই বলতে লাগল রাস্তা। সঙ্গে যিনি যাচ্ছিলেন, সেই জ্যেষ্ঠ বা খুল্লতাত মশাই তো অবাক। তিনি অনেকদিন পর এলেন বলে তাঁরই পথ চিনতে অসুবিধে হচ্ছে, আর এই বালক তো জীবনে প্রথম এল। এ পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?
বাড়িতে পৌঁছে আর এক কান্ড। বাড়িটা বিশাল, সাতমহলা টাইপ। অনেক শরীকের অংশ আছে তাতে। রীতিমত গোলকধাঁধা। সেখানেও যদু নাচতে নাচতে, লাফাতে লাফাতে, এ বারান্দা, ও উঠোন, সে দালান টপকে সটান চলেছে নিজেদের অংশের দিকে, যেন কতকালের চেনা পথ। খানিক যাবার পর একটা বাগান পড়ল। সেখানে মালী কাজ করছিল। যদু বলল, কি, বনমালী, ভাল আছতো?
সঙ্গে যিনি ছিলেন, তাঁর হাঁ বন্ধ হচ্ছেনা কিন্তু বনমালী এগকগাল হেসে বলল, বাবু, আপুনি আবার ফিরে আসিলে?
সেই বনমালী দেখেই চিনেছে ‘বাবু’কে। বাবুও চিনেছেন পেয়ারের মালীকে। আমাদের এর মধ্যে না থাকলেও চলবে। হ্যাঁ, যদু আরও অনেক কান্ড ঘটিয়ে ছিল, সব আমার বিশদে মনে নেই। মাত্র বারো বছর বয়সে সে মারা যায়।