পাতালের আহ্বান দুর্নিবার
অন্ধকারের প্রগাঢ় প্রলেপ
এই অবধি লিখে অবিনাশ ভাবতে বসল, কবিতা লেখা কি আমার সত্যি উচিত ? সমস্যাটা হ’ল, যাতে ভাবনায় জড়িয়ে না যাই, তাই মনাদা কবিতা লিখতে বলেছিল। এত কী ভাবিস রে সারাদিন? বেশি ভাবলে তো মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কী ভাবিস, বলতো আমায়। অবিনাশ বলল, না, তেমন কিছু তো নয়, তবে ভাবনা তো চলেই আসে, করব কী? মনাদা বলল, তা অবশ্য ঠিক। ভাবনা ছাড়া মানুষ থাকতে পারেনা। আমরাও ভাবি, ছেলেকে স্কুল বদলে ইংলিশ মিডিয়ামে দেব কিনা, প্রভিডেন্ট ফান্ডে একটু বেশি কাটাব কিনা, কাজের মেয়েটা বড় বেশি কামাই মারছে, ওকে ছাড়াতেই হবে। গিন্নীর অ্যাপেন্ডিক্সটা পরের বছর কাটালে কি দেরী হয়ে যাবে? নানা চিন্তা মাথায় ঘোরে। তোর তো সেসব ঝামেলা নেই, তাই ভুলভাল ভাবনা। তা তুই বরং কবিতা লেখ। যা ভাববি তাই লিখে ফেল। আজকাল দারুণ সুবিধে হয়েছে। কবিতার সব নিয়ম কানুন নাকি উঠেও গেছে, বালাই গেছে। যা লিখবি তাই কবিতা। তুই লেখ। বলা যায়না, একদিন হয়তো দেখলি –
অবিনাশ ভাবল, নাঃ এই কবিতাটা চলবেনা। প্রগাঢ়-র পর আবার প্রলেপ। দুটো প্র পর পর ভাল লাগছেনা। আহ্বান লিখতে হ আগে, না ব আগে? তাছাড়া দুর্নিবারের সঙ্গে আকর্ষণ যায় শুনেছি, আহ্বান যায়? তার ওপর কথা হচ্ছে, এটা তো আমার ভাবনা নয়। আমি এমন কথা ভাবছিনা, তবে মনের ভেতর থেকে কে যেন ঠেলে, গুঁজে দিচ্ছে ভাবনাটা। কে সে? অবিনাশ? না না, আমিই তো অবিনাশ। কিন্তু নাঃ আমার দ্বারা হবেনা। তা ছাড়া আমি কী ভাবছি? আচ্ছা ঠিক কী ভাবছি এখন? এখন আমি ভাবছি, আমি কী। আমি কী বলতে, আমি শিশু, কিশোর বা বালক নই। আমি বৃদ্ধ, অশীতিপর বা নবতিপর কিছুই নই। নিদেনপক্ষে সিনিয়র সিটিজেনও নই। রইল বাকি যুবক আর প্রৌঢ়। আমার বয়স এখন উনচল্লিশ বছর ন’মাস। আমি কি যুবক ? আমি প্রৌঢ় হব বোধহয় পঁয়তাল্লিশ পেরোলে। তবে এখন আমি কী? আমি কি অবিবাহিত? না তো, এই তো বছর পাঁচেক আগে শিবালিক হাউস ভাড়া করে, তবে কেটারারটা ভাল ছিলনা। চিংড়িটা পচা ছিল অনেকেই বলেছে। কিন্তু আমার তো বৌ নেই, তবে কি মৃতদার ? তাও তো না। ডিভোর্সি? নাঃ। তবে?
অবিনাশ ভাবল আমি কি বেকার? জবলেস ? না না, চাকরিটা আছে তো, মাঝে মাঝেই বাড়িতে চিঠি আসে। আমি যাইনা সে কথা আলাদা। সরকারি চাকরি অত চট করে যায়না। উঃ তবে আমি কী? আচ্ছা, আমার নাম সত্যিই অবিনাশ তো? মনাদা যে জিতু বলে ডাকল আমায়? ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটে বা অফিসের রেকর্ডে তো স্মরজিৎ কুন্ডু লেখা আছে। আচ্ছা আমি যদি মারা যাই হঠাৎ ? লোকে কী বলবে, অবিনাশ মারা গেছে, না স্মরজিৎ? অবিনাশ কে, আমি?
লোকটা আজ আবার এসেছে। আচ্ছা, লোকটা সব সময়ে চাদর গায়ে দিয়ে থাকে কেন? এখনও তো তেমন শীত পড়েনি। আগে এসব চলতনা। তখন পাড়ায় ভুলভাল লোক ঢুকলেই রকে বসা ছেলেরাই আটকাতো। কী চাই ভাই? কাকে খুঁজছেন? এখন পাড়া বলে আর কিছু নেই। সেই সব একতলা দোতলা বাড়িগুলো নেই, আম, নীম, কাঁঠাল গাছগুলো নেই, কোথাও কোনও রক-ও নেই। রকে বসা ছেলে টেলে আজকাল আর দেখা যায়না। সব লম্বা লম্বা জি প্লাস ফোর গা ঘেঁষে রাস্তা অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে। তাদের হরেক খোপে হরেক কবুতর। কে কখন ঢুকছে, বেরোচ্ছে, কে খবর রাখে।
লোকটা অবিনাশকে দেখে হাসল। ভাল আছেন, অবিনাশ? অবিনাশ ভাবল, এই যে ভাল আছি কিনা জিজ্ঞেস করল লোকটা, আসলে কিন্তু এটা কোনও প্রশ্ন নয়। আমি তো কোনওদিনই উত্তর দিই না। তাতে তার খুব একটা কিছু আসে যায় বলে মনে হয়না। তবু লোকটা বলে, ভাল আছেন অবিনাশ? আসলে ও আমায় মনে করিয়ে দেয় যে আমি অবিনাশ। কিন্তু আমি অবিনাশ কেন? আমার বৌ নেই কেন? আমি চাকরি করিনা কেন? আমি বাড়িতে একা থাকি কেন? আমি কি পাগল?
ঘটনাটা বেশি পুরোন নয়, এই বছর দুয়েক হবে। সেদিন হঠাৎ পাওয়ার কাট হয়ে গেল। তার পর জেনারেটরও চললনা। সবাই বলাবলি করছিল, সেটা নাকি খারাপ হয়ে গেছে। ইলেকট্রিসিটি নেই তাই এসিও নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। অফিস শুদ্ধু লোক বেরোতে চাইছিল। লিফট-ও বন্ধ। তাই সিঁড়ি বেয়ে নামছে সবাই। অনেকটাই নামতে হয়। সিঁড়িটাও অন্ধকার মতন। প্রায় দোতলার কাছাকাছি চলে এসে দেখা গেল, এই লোকটাও নামছে পাশাপাশি। এ বাড়িতে আরও অনেক অফিস আছে। সবাইকে চেনাও সম্ভব নয়, কিন্তু এইরকম চাদর গায়ে দেয়া লোক কি কোনো অফিসের কর্মী হতে পারে?
লোকটা বলল, ভাল আছেন অবিনাশ ? কাছাকাছি প্রভাস নামছিল। বলল, কে অবিনাশ? ইনি তো কুন্ডুদা, স্মরজিৎ কুন্ডু। কাকে ভুলভাল নামে ডাকছেন মশাই? কথাটা লোকটার কানে ঢুকল বলে মনে হলনা। সে বলল, চলুননা অবিনাশ, আমরা নেমে যাই। নামতে বড় মজা জানেন, উঠতেই কষ্ট। সত্যি তো, নামতে কিন্তু সত্যি মজা। আবার যদি সিঁড়িটা গোল হয়, তাহলে আরও মজা। নামছি তো নামছি – নামছি তো নামছি – আরও নামছি – আরও –
পিওন বলে আজকাল কোনও পোস্ট নেই। বললে ভীষন রেগে যায় এরা। বলে, হমলোগ গুরুপ ডি হ্যাঁয়, পিওন ফিওন মত বোলিয়ে। তা গ্রুপ ডি রামপরবেশ চেঁচিয়ে বলল, আরে আরে কুন্ডুবাবু, কহাঁ যা রহেঁ হ্যাঁয় ? ইয়েহি তো গ্রাউন্ড ফলোর হ্যায়। ইসকে নীচে তো বেসমেন্ট হ্যায়। আইয়ে আইয়ে – হাত ধরেই টেনে নিল সে। ভেবেছে বোধহয় অন্ধকারে তলা ভুল হচ্ছিল। কিন্তু নামতে দারুণ লাগছিল, নেশার মত। আরও নেমে যাওয়াই যেত। চাদর গায়ে লোকটা কিন্তু নেমেই গেল। বেসমেন্টে কী কাজ ওর? আচ্ছা বেসমেন্টেরও তলায় যাওয়া যায়না?
তার পরেও লোকটা এসেছে বার দুয়েক। একদিন তো লিফটের সামনেই ধরল সোজাসুজি। চলুননা অবিনাশ, সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নামি। নামতে ত কষ্ট নেই, বলুননা, আছে কষ্ট? সেদিন আবার সিকিওরিটির লোকটা ধরল তাকে। এইযে, এইযে সার, ওদিকে না, এইটে বাইরে যাবার রাস্তা। অবিনাশ দেখল আর নামা যাবেনা। কিন্তু চাদর গায়ে লোকটা তরতরিয়ে নেমে গেল যে? সিকিওরিটির লোকটা তাকে ধরলনা কেন? চেনাশোনা নাকি? বাড়ি এসে রত্নাকে সে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, আমার নাম কিন্তু অবিনাশ। রত্না ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে? তুমি তো আগে মদ টদ খেতেনা, নতুন ধরলে?
এ পাড়ার বেশির ভাগ বাড়ি প্রোমোটারের গর্ভে গেলেও দু-একটা সাবেক বাড়ি এখনও টিকে আছে। এটা তার মধ্যে একটা। এ বাড়িতে অবিনাশ একা থাকে। অবিনাশ পাগল টাগল নয়, কিন্তু সারাদিন ধরে কি সব ভাবে। খাওয়া দাওয়াও চলে যাচ্ছে ঠিক। ব্যাঙ্কের টাকা ফুরোতে এখনও কিছু বাকি। ভাতের হোটেলে নিরামিষ তিরিশ টাকায়। মনাদার বাড়ি থেকে ডাল রুটি আর পেঁয়াজি দিয়ে যায় প্রায়ই। সে বেলাটা তিরিশ টাকা বেঁচে গেল। রত্না বাপের বাড়িতেই থাকে তবে রবিবার টিফিন কেরিয়ারে চিকেন আর ভাত পাঠায়। অবিনাশের খাওয়ার কষ্ট নেই। অবিনাশ আলো কম জ্বালে, গরমেও পাখা বন্ধ রাখে মাঝে মাঝে। পঞ্চাশ টাকার বেশি ইলেকট্রিকের বিল হয়না। এ সব কারনেই বোঝা যায় অবিনাশ পাগল নয়, শুধু আজকাল ভাবনায় ডুবে থাকে সারাদিন। ভাবনার বেশির ভাগটাই হল একটাই ব্যাপার নিয়ে, - আমি কী? অথবা, আমি কে?
সেদিনও আলো নিভিয়ে রেখেছিল অবিনাশ। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, এই যে ভাবছি, ভেবেই চলেছি, কেন ভাবছি এত? অফিসে জয়েন করব? করলে তো এত ভাবতে পারবনা, কাজ করতে হবে তো। একসঙ্গে দুটো করলেই মুশকিল। কোনওটাই ভালমত হবেনা। তাছাড়া অফিসে গেলেই তো সবাই কুন্ডুবাবু কিংবা স্মরজিৎ বলে ডাকবে। ওটা তো ভুল নাম, আমি তো অবিনাশ।
একেবারে অন্ধকার নয়, কারণ এবাড়ি অন্ধকার হলেও রাস্তায় বা আসেপাশের বাড়ির আলো আসছে। জানলার বাইরে একটা চাদর গায়ে দেয়া চেহারা দেখা গেল। ভাল আছেন অবিনাশ? নীচে যাবেন? চলুননা। বেশ অন্ধকার চারিদিক, এই তো সুযোগ – লোকটার পাশাপাশি অবিনাশ নামতে শুরু করল সিঁড়ি দিয়ে। এবাড়ির সিঁড়িটা গোল, বেশ ভালই লাগছে নামতে, বেশ লাগছে। একবার মনে যে খটকা লাগেনি তা নয়। দোতলা থেকে একতলা নামলেই তো শেষ, তবু এতক্ষণ নামছি কী করে? নামছি তো নামছি, নামছি তো নামছি, নেমেই চলেছি-
রত্নার বাপের বাড়ির কাজের লোক বলল, খাবার দেয়া গেলনা দিদি, জামাইবাবু ঘুমোচ্ছে বোধহয়, দরজা বন্ধ। সেকী? এতক্ষণ ঘুমোচ্ছে? চলতো দেখি। মনাদা এসেছেন, বৌদি এসেছেন, ফ্ল্যাটবাড়ির লোকগুলো খুব একটা পাড়ায় মেশেনা, তবু জ্ঞানপ্রীত সিংজি এসেছেন, আলভারেস রা কর্তা গিন্নী দুজনেই এসেছেন। একটু পরে পুলিশ চলে এল। রত্নাকে বলল, ম্যাডাম দরজাটা ভাঙছি তাহলে। আশ্চর্য, ভেতর থেকে সব বন্ধ, এমনকি ছাদের দরজাও, তো জলজ্যান্ত লোকটা গেল কোথায়? আলভারেস গিন্নি রত্নাকে জড়িয়ে ধরে আছেন, ডোন্ট ক্রাই ডিয়ার, হি মাস্ট বি সামহোয়্যার। কনস্টেবল বলল, স্যার, সিঁড়ির তলাটা দেখেছেন? টালিগুলো এক্কেবারে নতুন মনে হচ্ছে। খুঁড়ে দেখব স্যার? খুঁড়ে অবশ্য কংক্রীট আর মাটি ছাড়া কিছুই পাওয়া গেলনা।