পুলিশ
সাতই এপ্রিল, দু হাজার নয়। এই তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি চিঠি ছাপা হয়েছে ‘সম্পাদক সমীপেষু’ বিভাগে। লিখছেন আনন্দপুর থেকে সায়নি গুপ্ত। চিঠির বক্তব্য, গত এগারই ফেব্রুয়ারী, পত্রলেখিকার বাবা শ্রী কমল গুপ্ত, যিনি আকাশবাণীর কর্মী ও সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন, এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু দুর্ঘটনাটি ঘটার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে তৎপর পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, রক্তের ব্যবস্থাও করে। দুর্ভাগ্য, তাঁকে বাঁচানো যায়নি। সায়নি দেবী জনে জনে প্রত্যেক পুলিশকর্মীর নাম, আই. ডি নম্বর, সব উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। তাঁর ভাষায়, “বেঙ্গল পুলিশের এই অভাবনীয় কর্মতৎপরতা শুধুমাত্র পুলিশকর্মীদেরই পক্ষেই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্যও দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। এ জন্য পুলিশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই”।
পুলিশ সম্পর্কে আম জনতার ধারণা খুব একটা ভাল না। ধারণা এক দিনে তৈরী হয়না, আবার একদিনে সে ধারণা পাল্টায়ও না। সায়নি দেবীর বাবার মৃত্যু সত্বেও সেদিন পুলিশের কর্মতৎপরতায় উনি এতটাই মুগ্ধ, যে ধন্যবাদ জানাতে চিঠি লিখেছেন দৈনিক পত্রিকায়। তবে তিনি একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন, “অভাবনীয়”।
তার মানে যা ভাবা যায়না, ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম বলেই এই চিঠি। পুলিশ রোজ রোজ এরকম তৎপর হলে লোকে থোড়াই বাহবা দিত।
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। বছর পনের আগেকার কথা। একদিন হঠাৎ একটা সমন এল আমাদের অফিসে। অমুক ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাশে হাজির হতে হবে, না হলে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যানার্জী সাহেব বললেন, সরকার সাহেব, আপনি তো আদালত এক্সপার্ট, যান ঘুরে আসুন। আমি বললাম, আমি আর কী করতে যাব, এতে তো কোনও আর্গুমেন্ট নেই, উকিলও লাগবেনা। আমার এক্সপার্টীজ মাঠে মারা যাবে। তা ছাড়া এটা তো এজিএল ডিভিসনের কেস, ওদের ম্যানেজার বা কোনও অফিসার যাক না। ব্যানার্জী সাহেব বললেন, যাব্বাবা, আমি কোথায় হেড অফিসে বলে কয়ে আপনার জন্য ম্যানেজ করলাম। এই সুযোগে দেড় দিন ছুটিও পেয়ে যাবেন। এমনিতে তো কোলকাতা যানই না। এই সুবাদে বৌমার সঙ্গে দেখাটাও হয়ে যাবে। বললাম, সেই ভয়েই তো যাইনা।
সমনটা অদ্ভুত। একটা বাড়ির নাম লেখা আছে, আর সল্টলেকের একটা ব্লকের নাম। ঠিকানা ফিকানা নেই। এবার খুঁজি কী করে? ট্যাক্সিটা বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাবার পর মাঝামাঝি জায়গায় এসে ছেড়েই দিলাম। যদিও অফিস ভাড়াটা রিইমবার্স করবে, তবু ঘু্রতে ঘুরতে মিটারটা একটা অবিশ্বাস্য যায়গায় চলে যাচ্ছিল, লোকের সন্দেহ উদ্রেক হতে পারত এমন বিল দেখলে। ট্যাক্সি ছেড়ে এবার পায়ে হাঁটা। যাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘জানিনা’ কেউ বলেনা, উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম যে কোনও দিকে হাত তুলে বলে এইদিকে।
পষ্টো মনে আছে সেটা জুন মাস। বেলা প্রায় বারোটা। সমনে লেখা ছিল এগারটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। কিন্তু খুঁজে না পেলে কী করব। সূর্য তখন মধ্য গগনে, আমি একটা চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে। ব্লক তো এটাই, কিন্তু ঠিকানা বলতে সম্বল শুধু একটা বাড়ির নাম। দেখলাম ছাতা মাথায় এক ভদ্রমহিলা আসছেন। চেহারাপত্তর দেখে পাড়ার লোকই মনে হল। তড়বড়িয়ে বললাম, ম্যাডাম, এই বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারেন? উনি একদিকে আঙুল দেখালেন। ধন্যবাদ, বলে সেদিকে হাঁটা দিলাম। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর দেখি, রাস্তার মোড়ে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকান, দুজন যুবক বসে আছে। বললাম ভাই, অমুক বাড়িটা এই দিকে তো? তারা আঙুল তুলে দেখাল সেই দিক, যে দিক থেকে আমি কুড়ি মিনিট হেঁটে এলাম।
সে বছর রেকর্ড গরম পড়েছিল। জুন মাস, দুপুর বারোটা, সল্ট লেকের এই অঞ্চলটায় গাছপালা কম, যে কটাও আছে তারা নিজের নিজের শেকড়ের ওপর ছায়া ফেলছে, সূর্য তো ঠিক নব্বই ডিগ্রীতে। রাস্তায় কোনও লোক নেই, রিক্সো নেই, কাক নেই, কুকুর নেই, মনে হল সাহারা মরুভূমিতে পথ হারিয়েছি।
দিকভ্রান্তের মত হাঁটছি। কোনদিকে যাচ্ছি তাও জানিনা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে দেখি একটা পুলিশ থানা। হাতে চাঁদ পেলাম। আর কেউ না পারুক পুলিশ তো ডেফিনিটলি বলতে পারবে এই ঠিকানা। ওরা তো রাস্তায় রাস্তায় টহল মারে রাতদিন, সব বাড়ি মুখস্থ। থানার দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি, সামনে বন্দুকে ভর দিয়ে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে। আর খানিক ভেতরে চেয়ার টেবিলে বসা একজন এএসআই। এটা একটা বড় হলঘর, এর পাশে আলাদা আলাদা ঘরে অন্য সব লোকজন। আমি কনস্টেবল মশাইকে জিজ্ঞেস করব করব ভেবেও একটু এগিয়ে এএসআইয়ের সামনে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, আচ্ছা, অমুক বাড়িটা – ভদ্রলোক খাতায় কী যেন লিখছিলেন, হঠাৎ আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকাতেই চেঁচিয়ে উঠলেন, একীঈঈঈঈ-?
আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। আচমকা আমাকে দেখে বিস্ফারিত নয়নে ‘একী’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছেন মানে নির্ঘাত আমাকে কোনও বড় ক্রিমিনাল ভেবেছেন। সেধে সেধে নিজে এসে সারেন্ডার করছে বলে এতটা বিস্ময়। ভদ্রলোক চোখ বড় বড় রেখেই চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে এসে খপ করে আমার বাঁ হাতের ওপরদিকটা ধরেছেন। তারপর একজন কনস্টেবলকে চেঁচিয়ে বললেন অ্যাই ধরতো। সে লোকটাও খট খট করে জুতোর আওয়াজ তুলে দৌড়ে এসে আমার ডান হাতটা ধরেছে। দুজনে ধরে ধরে আমাকে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি, এবার গারদে ঢুকিয়ে বেদম ধোলাই, কথা টথা পরে হবে।
আমি তো চোখ বন্ধ রেখে ব্যাক স্টেপ করে পেছনে হাঁটছিলাম, দুপাশে দুজন চেপে ধরে আছে। হঠাৎ হাঁটুর পেছন দিকে কী একটা ঠেকল, বুঝলাম বেঞ্চি গোছের কিছু। ওরা দুজন ধরে আমাকে বসিয়ে দিল তার ওপর। অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর মশাই বললেন, শুইয়ে দে, শুইয়ে দে, দেখলাম আমাকে শোয়ানো হ’ল। পটাপট বুকের বোতামগুলো খুলে দিল একজন। আরও বেশ কজন জড় হয়েছে তখন। একজন একটা পেল্লায় হাতপাখা নিয়ে এসে বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে লাগল, যদিও ওপরে আরো জোরে ফ্যান ঘুরছে। একজন বলল, অ্যাই, ঠান্ডা জল নিয়ে আয়। এ,এস আই ধমক দিলেন, না এক্ষুনি জল খাওয়াবি না, বরং মুখে চোখে ছিটে দে।
ভয়ে যে চোখ বন্ধ করেছিলাম, এবার সে দুটো খুলেছি। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে চার পাঁচখানা মুখ। পেছনে আরো ক’জন। একজন প্রশ্ন করলেন, কেমন বোধ করছেন এখন? আমি তড়াক ক’রে উঠে বসলাম, আমি তো ভালই আছি- এএসআই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। উঠবেন না, উঠবেন না, একদম উঠবেন না। দু জন আবার চেপে ধরে শুইয়ে দিল।
মিনিট দশেক পরের কথা, আমি উঠে বসেছি। একজন ঠান্ডা জলের গেলাস হাতে সামনে দাঁড়িয়ে। ছোটবাবু বললেন, আস্তে আস্তে খাবেন। কেমন লাগছে এখন? আমি বললাম, আমি তো এমনিতে ঠিকই আছি, একটা ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে ঢুকেছিলাম। এ এস আই মশাই বললেন, ঠিকই আছি? একটা আয়না দেব? মুখটা একবার দেখবেন? তাওতো জল টল দিয়ে খানিক মেরামত হয়েছে। এই রোদে কেউ রাস্তায় বেরোয়?
আমি কষের ফোকলাটা ছাড়া বাকি দাঁতগুলো বের ক’রে বললাম, আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। পুলিশ শুনলেই আমরা কী না কী ভেবে বসি। এখন দেখছি সত্যি, কত সহৃদয়। যাকগে, এই অমুক ভবনটা কোথায় যদি বলে দেন তো ষোল কলা পূর্ণ হয়। রোদে কি আর সাধ করে বেরিয়েছি, আদালতের সমন বলে কথা।
পুলিশবাবু মাথা টাথা চুলকে বললেন, অমুক ভবন? আপনি একটা কাজ করুন, আমাদের থানা থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে গেলে একটা মোড় পাবেন। সেখান থেকে আবার বাঁ দিকে যাবেন। মিনিট পনের হাঁটলে বিকাশ ভবন। আসলে ভবন মানেই সরকারি অফিস। যত ভবন সব ঐ দিকে। বাকি পুলিশরাও সমস্বরে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ ওই দিকেই হবে। যেই বেরোতে নিয়েছি, ছোটবাবু বললেন, এক্ষুনি না গেলেই নয়? রোদটা পড়লে যেতেন- আমি বললাম, সমন বলে কথা, প্রায় ‘শমন’ এর মতো। না গেলে নাকি কঠিন শাস্তি। আচ্ছা নমস্কার।
থানার বাইরে এসে সবে দু’পা ফেলেছি। এক ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা, একটা কথা বলব? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছেন। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম থানাতেও ঢুকলেন। কী ব্যাপার বলুন তো? বললাম, সাধে কি আর ঘুরছি মশাই, এই দেখুন, অমুক ভবনটা খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হয়ে গেলাম, এদিকে সাড়ে এগারটায় অ্যাপিয়ারেন্স – ভদ্রলোক বললেন, অমুক ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাশে? আসুন আমার সঙ্গে। আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, আপনি – উনি বললেন, আমি ওই অফিসেই কাজ করি। যে বাড়িটায় উনি আমাকে নিয়ে গেলেন, সেটা থানার ঠিক পেছনে। যাকে বলে পিঠোপিঠি।
(চলবে)
ছবিঃ লেখক