টাকমাথা তিনটে বুড়ো
বেশ ক’বছর আগের কথা। তা বছর পনের তো হবেই। পুরী বেড়াতে গেছি। সঙ্গে স্ত্রী আর ছেলে। মেয়ে পরীক্ষা ছিল বলে যায়নি। ওখানে গিয়েই মনে হল, ওড়িষার যে সব ভাল ভাল জায়গাগুলো আমি আগে দেখেছি, সেগুলো এদের ঘুরিয়ে দেখাই। ছেলের মা অবশ্য আগেও অনেকবার পুরীতে এসেছে, তবে পুরীর বাইরে খুবজোর কনারক অবধি গেছে। ছেলেতো এই প্রথম এল। নাকের বদলে নরুণের মত মেয়ের বদলে আর একটা মেয়ে পেয়ে গেলাম। আমাদের পাশের ঘরে তাদের পরিবার উঠেছে, আলাপও হল। বললাম, আমি তো একটা গাড়ি নেবই, তুই যাবি আমাদের সঙ্গে? সেও রাজি। চারজনে বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথম ধাক্কাটা খেলাম ভূবনেশ্বরে এসে। ইন্দ্র দুগারের ল্যান্ডস্কেপের মত যে শহরটা আমি চিনতাম, তার এ কী হাল হয়েছে? এতো কালীঘাটের বস্তি। রাজারাণী মন্দিরটার কাছে গিয়ে বুকের মধ্যে মোচড় দিল। লাল মাটির ধু ধু প্রান্তরের মধ্যে লাল পাথরের মন্দিরটা এ অঞ্চলের অন্য মন্দিরগুলোর চেয়ে অন্যরকম। অত নিখুঁত কারুকাজ অন্য মন্দিরে নেই। চারদিকে রুক্ষ পাথুরে জমি আর কয়েকটা খড়ের চাল দেয়া গ্রাম্য কুটির, এই পুরো, যাকে বলে অ্যামবিয়েন্সটাই ছিল হৃদয়স্পর্শী। ষাট সত্তরের দশকে যতবার ভূবনেশ্বরে এসেছি, ওই মন্দিরের ছায়ায় বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্কেচ করে করে স্কেচবুক ভরিয়ে ফেলতাম। তারপর মিউজিয়ামে এক পরিচিত ভাস্কর্যের ছাত্রের কাছ থেকে সেই স্কেচ থেকে মূর্তি বানিয়ে আনতাম সামান্য পারিশ্রমিকে।
কুৎসিত দর্শন একগাদা বাড়িঘরের মধ্যে সে মন্দির এখন রাস্তা থেকে দেখাই যায়না। কোথায় সেই ধু ধু প্রান্তর, আর কোথায় সেই খড়ের চাল। উদ্বাস্তু কলোনীর মত ঘিঞ্জি বাড়িঘরের মাঝে ছোট্ট একফালি সরকারি বাগান দিয়ে ঘেরা মন্দিরটা বুড়ি বেশ্যার মত দাঁড়িয়ে এখনো। ছবি তুলতে গিয়ে দেখলাম, বহু মূর্তি আংশিক উধাও। ভারতীয় স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য্য শিল্পের নিদর্শন হিসেবে মূর্তির হাত, পা, কাটা মুন্ডুও বিদেশে বিক্রী হয় চড়া দামে।
এবার অন্য দিকে। গঞ্জামের দিকে যাবার পথে অপূর্ব নিসর্গ ছড়ানো ছিল পথের ধারে। সেই রুক্ষ জমি, দিগন্ত বিস্তৃত। অদ্ভুতদর্শন বেঁটে বেঁটে শালগাছ আর দলে দলে লালমুখো বাঁদর বা রেসাস মাঙ্কি। গাড়ি আসতে দেখলে বাচ্চাগুলো দৌড়ে গিয়ে মায়ের কোলে সেঁধিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখে। লাল মাটি, শাল গাছ আর কালো কালো ছোট বড় টিলা। দেখে দেখে তবু চোখ ভরেনা। বেশ খানিকটা গেলে, পথের দুধারে দুই বিশাল কালো পাহাড়, তোরণদ্বারের মত দাঁড়িয়ে, তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দুই হাবসি প্রহরী যেন কড়া চোখে নিরীক্ষণ করে আগত পর্যটকদের।
এবারে সে পথ দিয়ে যেতে যেতে ভাবি, এমা ছি ছি, কেন এলাম? কোথায় লালমাটির প্রান্তর, কোথায় খর্বাকৃতি শালগাছ, কোথায় কালো পাথরের টিলা? পথের দুধারে অশ্লীলদর্শন বিকটাকার ঘরবাড়ি সারিবদ্ধভাবে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে। এদের মধ্যে কোনও কোনওটা আবার কিম্ভুত ক্যাটক্যাটে সবুজ বা গোলাপী রঙের।
ভাবি খানিকদূর গেলে বোধহয় চোখের ওপর অত্যাচার একটু হালকা হবে। আবার বোধহয় প্রকৃতির দেখা মিলবে, কিন্তু তা হয়না। অশ্লীল গোলাপী-সবুজ বাক্সগুলো সারি দিয়ে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি, সে বিশাল পাহাড়দুটো কোথায় হে? পথের দু ধারে প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকত? রসিক ড্রাইভার বলে, দেখুন গিয়ে, হয়তো আপনার বাড়ির ছাদে। রেগে গিয়ে বলি, এ কথার মানে কী? সে বলে ওগুলো কেটে কেটে গুঁড়িয়ে স্টোনচিপস হয়ে গেছে। বলা তো যায়না, আপনার বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ে হয়তো এই পাহাড়ের টুকরোই লেগেছে।
বছর ছয়েক আগের কথা, ট্রেনে চেপে যাচ্ছি কেরালার তিরুর জংশনে। ওখান থেকে অটোরিক্সো নিয়ে যাব কোট্টাকাল বলে একটা জায়গায়। সেখানে এক হাসপাতালে আমার স্ত্রী ভর্তি আছেন।
ম্যাড্রাস বা অধুনা চেন্নাই থেকে ট্রেন বদল করে যেতে হয় ওদিকে। সেদিন চেন্নাইতে নেমে দেখি তুমুল বৃষ্টি, স্টেশনের বাইরে রাস্তায় এক হাঁটু জল। যে গাড়িটায় তিরুর যাব, সেটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকলেও ঘনঘন ঘোষণা হচ্ছে যে, গাড়ি এখন ছাড়বেনা, রেললাইনে জল দাঁড়িয়ে গেছে, নামলে তখন ছাড়বে।
বেশ কয়েক ঘন্টা বিলম্ব হয়ে গেল। তাতে অন্যান্য যাত্রীদের মেজাজ তিরিক্ষে হলেও আমার মন খুশীতে ডগমগ। তার কারণ, পালঘাট দেখতে পাব।
পালঘাট জেলাটি তামিলনাডু ও কেরালার সন্ধিস্থলে। সেখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য অসাধারণ। তবে যতবারই ওপথে গেছি, পালঘাটের ওপর দিয়ে গাড়ি যায় মাঝরাতে। ফলে কিছুই দেখা যায়না। এবার ঈশ্বর আমার প্রাণের আকুতি শুনেছেন। দু চোখ ভরে শুষে নেব পালঘাটের প্যানোরামা।
অধীর প্রতীক্ষার পর এল পালঘাট। স্টেশন ছাড়িয়ে একটু যেতেই স্বর্গের নন্দন কাননের দরজা খুলে গেল। ভারতে আর কোথাও অত নীল পাহাড় নেই, অত সবুজ গাছপালা নেই আর অত টলটলে জলের নদী নেই। মনে মনে ট্রেনের চালককে গালি দিই, ব্যাটাচ্ছেলে একটু আস্তে চালাতে পারনা? আর কি কোনওদিন এভাবে দেখতে পাব?
বেশ চলছিল জানলার দুধারের দৃশ্য, চোখ জুড়ো্নো, মন ভরানো, হঠাৎ থমকে গেল চোখ। একটা ছোট পাহাড়ে এসে আটকে গেল। টিভিতে দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনে যেমন আধখাওয়া আপেলের ছবি দেখায়, ঠিক তেমনিভাবে খুবলে খুবলে কাটা হচ্ছে পাহাড়টাকে। নীলচে সবুজ চূড়োটা এখনো বেঁচে, চারধার দিয়ে নিষ্ঠুর হলদেটে গর্ত। চারদিকের নীলিমা, শ্যামলিমা, যেমন ছিল তেমনি আছে, শুধু মাঝখানের পাহাড়টা ব্রেকফাস্ট টেবিলের উচ্ছিষ্ট পাঁউরুটি। নাঃ আর দেখবনা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরার পর্দা টেনে দিলাম। সবাই ভোরবেলা আরামের ঘুমে মগ্ন, আমিও ঘুমোই কম্বল চাপা দিয়ে।
ঈশ্বর বড় পরিহাসপ্রিয়।
হাল আমলে যেখানেই গেছি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িষা, সব জায়গায় পাহাড় কাটা হচ্ছে নির্দয়ভাবে। কত হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তিলে তিলে মৌল এবং যৌগিক উপাদান জমে জমে এই পাহাড়। লোভী ঠিকাদার পাহাড় কাটে, লোভী সরকার মুখ বন্ধ রাখে। মেধা পাটকরদের আন্দোলন শুধু নর্মদা(জল) আর সিঙ্গুর(মাটি) নিয়ে। পাহাড় যেন বানের জলে ভেসে এসেছে।
এই লিমেরিক গোছের কবিতাটা পবিত্র সরকারের লেখা –
‘ফিরিয়ে দাও’
“ কাল বিকেলে দেখতে পেলুম টাকমাথা ওই তিনটে বুড়োয়
রেল লাইনে খোশ মেজাজে বস্তা ভরে পাথর কুড়োয়
কান্ডটা কী? করতে সে খোঁজ
বলল তারা, “ব্যাপার সহজ-
পাহাড় ভেঙে আনা পাথর আসব রেখে পাহাড় চূড়োয়”।
আমি বেশ কিছুকাল যাবৎ তিনটে বুড়োর খোঁজ করছি। একজনকে পেয়েও গেছি, তাঁর নাম সুভাষ দত্ত। ভদ্রলোকের বেশ চকচকে টাক, বুড়োও একদিন না একদিন হবেনই। তবে ওঁর কাজকর্ম কলকাতা এবং হাওড়া নিয়ে। সেখানে একটাও পাহাড় নেই।
সেই সময়
এ নামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস আছে। তার সঙ্গে অবশ্য এর কোনও সম্পর্ক নেই। সালটা উনিশশো উনসত্তর, হঠাৎ কোথা থেকে কী হয়ে গেল, বিপ্লবের হাওয়া ধেয়ে এল নকশালবাড়ি থেকে। আমি তখন চাকরি করি। বন্ধুদের মধ্যে আমার মত এত অল্পবয়সে চাকরিতে কেউ ঢোকেনি। তাদের অনেকেই তখন বিভিন্ন ইঞ্জীনিয়ারিং কলেজে পড়ছে। তারা ভেসে গেল বিপ্লবের জোয়ারে। ব্যাপারটা ভাল হল না খারাপ হল, সে প্রসঙ্গে ঢুকবই না। তবে অনেক বন্ধু অচিরেই আকাশের তারা হয়ে গেল।
তখন সন্ধের পর কিশোর-যুবকদের একা বা দলবদ্ধভাবে বেরোন বারণ ছিল। বেপাড়ায় বা অচেনা জায়গায় একা যাওয়া ছিল আত্মহত্যার সামিল। হয় পুলিশ ধরবে নকশাল ভেবে, অথবা নকশাল ধরবে পুলিশের চর ভেবে। এই দুই ক্ষেত্রেই ফিরে আসার সম্ভাবনা বিরল।
আমার এক সহপাঠী, ইস্কুল ছাড়ার পরও ইউনিফর্ম ছাড়েনি। তার বাঁধা পরিধান ছিল, সাদা হাফশার্ট আর খাকি ফুলপ্যান্ট(স)।তাই নিয়ে তাকে আমরা বিস্তর ক্ষ্যাপাতাম, আবার জোর করে ইস্কুলে ভর্তি করে দেবার ভয়ও দেখাতাম। সে অবশ্য ইঞ্জীনিয়ারিং ডিপ্লোমা পাশ করেছে এবং চাকরিও পেয়ে গেছে ম্যাড্রাসে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে সেটা দেখাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে কসবা গেছিল দিদির বাড়ি। ওর ড্রেস দেখে পুলিশ ভেবে ওরা তাড়া করেছিল। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখিয়ে কাজ হয়নি, লুম্পেন প্রোলেতারিয়েত-রা ইংরিজী বুঝতনা। দৌড়ে গিয়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়েছিল সে প্রাণ বাঁচাতে। প্রাণ বাঁচেনি।
আমার বাবার অফিসের এক ভদ্রলোক সেদিক দিয়ে কিছুটা ভাগ্যবান। তিনিও সাদা শার্ট আর খাকি প্যান্টের দলে। আসলে এখন ভাবলেও হাসি পায়, সে সময়ে বেশ কিছু কোলকাতাবাসী এই পরিধানকে আপন করেছিলেন। কেন, তা অবশ্য আমার জানা নেই। আমার বড়মামাকেও বেশ কিছুদিন এই ‘ইউনিফর্ম’ চালাতে দেখেছি। আমাদের ব্যাঙ্কের একজন ক্লায়েন্ট, আলিপুরে একাধিক ম্যানসনের মালিক এবং এক বিশাল প্রতিষ্ঠানের এম.ডি। তিনি লিমুজিন গাড়ি ছাড়া কোনও দিন চলেননি অথচ কখনও এই নির্দিষ্ট বসনের বাইরে অন্য কিছু পরতেননা।
বাবাদের অফিসের সেই ভদ্রলোক রিটায়ার করার পর ইনকামট্যাক্স কনসালট্যান্ট হয়েছিলেন। সাদা-খাকি জামাকাপড় ছাড়াও ওঁর দুর্ভাগ্যের কারণ হয়েছিল ছ’ফুটের ওপর উচ্চতা আর কদমছাঁট চুল। একদিন মোতিলাল নেহরু রোডের এক ক্লায়েন্টের বাড়ি গিয়ে তাঁকে না পেয়ে ভাবলেন, আবার অতদূর ফিরে যাব? তার চেয়ে কাছেই কোনও সিনেমা হলে একটা ছবি দেখে সময় কাটাই, ভদ্র্লোক ফিরলে একেবারে কাজ সেরেই নাহয় বাড়ি যাব।
কাছেই ‘প্রিয়া’ সিনেমা। উনি একটা টিকিট কেটে(সে সময় ইভনিং এবং নাইট শো-এর দর্শক খুব কম হত) ভেতরে গিয়ে বসে পড়লেন। ‘ইন্ডিয়ান নিউজ রিভিউ’ শেষ হয়ে দু একটা বিজ্ঞাপনের পর ছবির টাইটল দেখানো সবে শুরু হয়েছে, হঠাৎ ভদ্রলোকের চার দিকের মাটি ফুঁড়ে যেন উঠে দাঁড়াল গোটা ছয়েক ছায়ামূর্তি।
তারা বলল, আপনি বাইরে চলুন। হলের মধ্যে চ্যাঁচামেচি হ’লে যারা ছবি দেখছে, তাদের অসুবিধে হবে। তাছাড়া আশপাশের লোকের গায়ে রক্তের ছিটে লাগুক, আমরা চাইনা। অন্ধকারের মধ্যেও প্রোজেক্টরের ক্ষীণ আলোয় ওদের হাতের ধাতব বস্তুগুলো চকচক করছিল। ভদ্রলোকের জিভ শুকিয়ে তখন গলার মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। আশপাশে সাহায্যের জন্য তাকিয়ে লাভ হলনা, ওঁর কাছাকাছি সিটগুলো ফাঁকা। চ্যাঁচালে বিপদ আরও বেশী। উনি কোনও রকমে বলতে পারলেন, তোমরা ভুল করছ ভাই, আমি ট্যাক্সের উকিল। তারা বলল, মরণকালে কত খোচোড়(স্ল্যাং উচ্চারণে পুলিশ) ডাক্তার-উকিল হয়ে যায়, ও আমরা কত্তো দেখেছি। অ্যাই সালা, চল বাইরে তাড়াতাড়ি।
এদিকে কপালগুনে তাদের নেতাটি ছিল খাঁটি মার্ক্সীয়, বাকিদের মত লুম্পেন নয়। সে বলল, আপনি যে উকিল, তার প্রমাণ দিতে পারবেন? কেউ চেনে আপনাকে? ভদ্রলোক বললেন, আমি নর্থের লোক, সাউথে আমায় কে চিনবে? তখন নেতা বলল, তাহলে কিছু করা গেলনা, আমরা দুঃখিত। কাইন্ডলি বাইরে চলুন।
সিনেমা হলের ঠান্ডাতেও ভদ্রলোকের সাদা শার্ট আর খাকি প্যান্ট তখন ঘামে চুপচুপ করছে। হঠাৎ ওঁর মনে পড়ল, বলনেন, দেখুন ভাই, এত নম্বর মোতিলাল নেহরু রোডে আমার ক্লায়েন্ট থাকেন। তিনি আমায় চেনেন, তবে তিনি তো এখন বাড়ি নেই। নেতার দয়া হল, বলল, বলা তো যায়না, এতক্ষণে হয়তো ফিরে এসেছেন। সে উকিলবাবুর নাম ঠিকানা জেনে নিয়ে বলল, অ্যাই, তোরা দুজন আমার সঙ্গে আয়, আর তোরা তিনজন ভদ্রলোকের দেখাশোনা কর। দাদা, আমরা একটু মোতিলাল নেহরু রোড ঘুরে আসছি, আপনি ততক্ষণ সিনেমা দেখুন। আন্দাজ মিনিট কুড়ি ভদ্রলোক পর্দার দিকে তাকিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই নাকি দেখতে পাননি। কুড়ি মিনিট পর ছেলেগুলো ফিরে এসে বলেছিল, সরি দাদা, আমরা আসছি। আপনি সিনেমা দেখুন। আশ্চর্য, ভদ্রলোক তারপরও কিছুক্ষন হলে বসেছিলেন, কিন্তু তারপরও পর্দায় কিছু দেখতে পাননি।
হল থেকে বেরিয়ে মোতিলাল নেহরু রোডে যেতেই সেই ক্লায়েন্ট বললেন, আরে মশাই আপনি? এখন সুস্থ আছেন তো? উকিলবাবু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন, কেন বলুন তো? – আরে এই কিছুক্ষণ আগে তিনটি ছেলে এসেছিল, খুব ভদ্র আর বিনয়ী। তারা বলল, আপনি এই নামে কাউকে চেনেন? ছ’ফুটের ওপর লম্বা, সাদা শার্ট আর খাকি প্যান্ট পরা – আমি বললাম, বিলক্ষণ চিনি। উনিতো আমার ট্যাক্স কনসালট্যান্ট, আর ওটা তো ওঁর জাতীয় পোষাক, তা হঠাৎ- ওরা বলল, উনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বললেন, এপাড়ায় আপনি ছাড়া কেউ চেনেনা। তবে আপনি ব্যস্ত হবেননা, আমরা সব সামলে দিচ্ছি, যদি প্রয়োজন পড়ে, আপনাকে খবর দেব।
ভদ্রলোক এর পরেও সেই পোষাক আর হেয়ারকাট বজায় রেখেছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই।
এই রকম পরিস্থিতিতেও আমি বাড়ি ফিরতাম অনেক রাতে। উপায় ছিলনা, আমি তখন ব্যাঙ্কের যে শাখায় কাজ করি, সেটি ‘সান্ধ্য’ শাখা। অফিসের স্বাভাবিক সময়ই ছিল দুটো থেকে ন’টা। ব্যাঙ্কে কাজ সব সময়েই বাড়তি থাকে, সে সব সেরে বেরোতে বেরোতে দশটা এগারোটা বেজে যেত। একদিন তো অফিস থেকে বেরিয়েছিলাম রাত একটা বেজে দশ মিনিটে।
আশ্চর্য ব্যাপার হল, সে অশান্ত সময়েও কিন্তু বাড়ি ফিরতে অসুবিধে হতনা। এখন রাত দশটা বাজলেই সরকারি বেসরকারি বাসগুলো শিডিউল ওয়ান ভুক্ত বন্যপ্রাণীর চেয়েও বিরল হয়ে পড়ে, ট্যাক্সি উত্তর দক্ষিণ কোনও দিকেই মিটারে যাবেনা, এমনকি পাড়ার রিক্সোগুলোও দ্বিগুণ ভাড়া চাইবে। তখন কিন্তু পৌনে বারোটা পর্যন্ত স্টেট বাস থাকত প্রায় সব রুটে, যেদিন রাত একটার পর বেরিয়েছিলাম, ট্যাক্সিওয়ালা এক পয়সাও বেশী চায়নি, পাড়ার রিক্সোগুলো যা ভাড়া, তাতেই যেত মাঝ রাত পর্যন্ত।
যাক সে কথা, আমার বয়স তখন ছিল খুবই কম। আমার বয়সী অনেকেই তখনও ছাত্র। তাই অত রাতে বাড়ি ফেরাটা মোটেই নিরাপদ ছিলনা। তা ছাড়া বড়রাস্তার ওপরেই তো আমার বাড়ি নয়, কসবার মত সে সময়ের ‘ডেঞ্জারাস’ এলাকার মধ্যে দিয়েই আমাকে ফিরতে হত।
একদিন বাড়ি ফিরছি প্রায় দশটার কাছাকাছি। তখনও বিজন সেতু হয়নি, বালীগঞ্জের লেভেল ক্রসিং পেরিয়েই আসতে হত। বালীগঞ্জে এসে মনে হল, মা বলেছিল বিস্কুট(বিস্কিট) ফুরিয়েছে, কিনতে হবে। সে সময় কিন্তু অত গন্ডগোলের মধ্যেও বড়রাস্তার দোকানবাজার খোলা থাকত অনেক রাত পর্যন্ত। বালীগঞ্জের লক্ষীনারায়ণ টী এর পাশের দোকানটা থেকে বিস্কুট কিনলাম। এই প্রসঙ্গে এক মজার কথা, বালীগঞ্জ থেকে রাসবিহারীর মোড়, দোকান বাজার তখন যা ছিল, তা আমূল পালটে গেছে গত চল্লিশ বছরে। সে বিস্কুটের দোকান কিন্তু তেমনি আছে তার মালিক সমেত। মালিকটি আমারই বয়সী কিন্তু এখনও দেখলে বছর পঁচিশের ছেলে মনে হয়। এ রহস্যের কথা তাকে জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে।
তা সে দোকান থেকে বিস্কুট কিনলাম দু’রকম। তখন প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ছিলনা, আর বিস্কুটও প্যাকেটে বিক্রী হতনা। বড় টিনে আসত, ওজন করে যার যা চাই, দিত। আমাকে দুটো ব্রাউন পেপারের ঠোঙা পাটের দড়ি দিয়ে জড়িয়ে দিল। ভাগ্যিস সে দিন বিস্কুট কিনেছিলাম। কাকতালীয়?
রেললাইন পেরিয়ে তো রিক্সোর স্ট্যান্ডে এলাম। তখন সেটা ছিল একেবারে লেভেল ক্রসিং এর গা ঘেঁষে। লাইনে দাঁড়িয়ে আমার টার্ন আসতে দেখলাম চালক একটা বাচ্চা ছেলে। ভাল করে তার পা-ই পৌঁছচ্ছেনা পেডালে। বললাম, কিরে তুই চালাতে পারবি? সে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ । ওর রিক্সোয় উঠতে মনটা খুঁতখুঁত করছিল কিন্তু উপায়ও ছিলনা। লাইনে যে আসবে তার গাড়িতেই উঠতে হবে। বাছাবাছির সুযোগ ছিলনা। চলল রিক্সো, আমাদের পাড়ায় ঢোকার মুখে লাহিড়িদের ‘আনন্দ ভবন’এর কাছাকাছি এসে খেয়াল করলাম রাস্তার সব কটা আলোর বাল্ব ভাঙা। পুরো রাস্তাটাই অন্ধকার। বাল্বগুলো ভাঙলো কে? অন্ধকারে ঠাওর করে দেখি, দূরে, আমাদের বাড়ির সামনে জনা কুড়ি পঁচিশ লোক। কিন্তু ব্যাপারটা যেন কেমন কেমন ঠেকছে। লোকগুলো সব শার্টপ্যান্ট পরা।
এই প্রসঙ্গে বলি, দিনাজপুরের দিকে যেমন ভারতীয় ভূখন্ডে বেশ কিছু বাংলাদেশী ‘ছিটমহল’ আছে, এই খাস কোলকাতাতেও তেমনি বেশ কিছু ছিটমহল আছে। আমাদের বেদিয়াডাঙা হচ্ছে বিহারের ছিটমহল। এখানে অপরিচিত লোকের সঙ্গে বাংলায় কথা বললে কটুক্তি-ব্যঙ্গোক্তি শুনতে হয়। এখন এখানে বাঙালি শতকরা পঁচিশ-টচিশ হবে, তখনও তিরিশ-চল্লিশের বেশি ছিলনা।
অতগুলো শার্টপ্যান্ট পরা লোক এপাড়ায় দেখতে পাবার কথা ছিলনা তখন। এখন বিহারীরা ফেডেড ডেনিম আর কুটনস এর টি পরে ইয়ামাহা কিংবা হন্ডা চালায় কিন্তু তখন তো সবই ধুতি আর গামছা। অতগুলো অচেনা পোষাক পরা লোক দেখে আমি ছেলেটাকে বললাম, অ্যাই, থামা থামা, গাড়ি থামা – কিন্তু গাড়ি গড়িয়েই চলছে। ব্যাটা বলল, বেরেক কমজোরি, এট্টু পরে থামবে। আমি ওর হাতে পয়সাটা গুঁজে দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামলাম কিন্তু ততক্ষণে ওদের দৃষ্টির গোচরে চলে এসেছি। অন্ধকারেও দেখলাম, দুজন দৌড়ে আসছে আমার দিকে।
সামনের ছেলেটার হাতে রিভলভার। সে দুহাতে ট্রিগার ধরেছে। বুঝলাম একহাতে ফায়ার করতে গিয়ে কব্জিতে চোট পেয়েছে আগে। একটা চান্স নেয়া যেতেই পারে। ওরা আমার কাছে আসছেনা, হাত দশেক তফাতে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চ্যাঁচাচ্ছে, অ্যাই শুয়োরের বাচ্চা, সে সময় বাইশে শ্রাবনের ভাষা হয়তো ছিল, শুনিনি তা নয়, তবে লুম্পেনরাও শুওরের বাচ্চা অবধিই যেত । তারা বলল, অ্যাই শুওরের বাচ্চা, একদম নড়বিনা, গুলি করে দেব কিন্তু – তার মানে আমাকে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু কেন?
একটু পরেই বুঝলাম কেন। উদ্যত রিভলবার দেখে ইডিয়োমোটর অ্যাকশনে আমার হাতদুটো সামনে এগিয়ে গেছে। হাত দিয়ে বন্দুকের গুলি আটকানো যায়না, কিন্তু ইডিয়োমোটর চালিকাশক্তি যুক্তিবুদ্ধি নিয়ে চলেনা। সেই বাড়ানো হাতে দুটো গোল ব্রাউন পেপারের প্যাকেটকে অন্ধকারে কী মনে হতে পারে তা আন্দাজ করার জন্য কোনও প্রাইজ নেই। ওরা যা ভাবছে সে ভুল কোন পাগলে ভাঙায়, আমি সেই গোল বস্তু ওদের দিকে ছোঁড়ার ভঙ্গি করলাম। ওরা ভয়ে পেছন ফিরতেই আমি বাঁ দিকের পাঁচিল টপকে ওপারের ডোবার এককোমর কাদায়। সেখানে মশা আর জোঁকের সঙ্গে ঘন্টা দেড়েক ঘর করতে করতে লুকিয়ে দেখলাম, আমারই মতন পোষাক আর অনেকটা আমারই মতন চেহারার কেউ একজন কয়লার দোকানের ছাদে ধুপ করে লাফিয়ে পড়ল। আমার প্রতি এদের অনুরাগের কারণটা বোঝা গেল। পুরো দঙ্গলটা তার পেছন পেছন ছুটে চলে যাবার পর আমি সাবধানে বাড়ি ঢুকলাম। কোমর অবধি কাদায় মাখামাখি হলেও বিস্কুটের প্যাকেট দুটো হাত থেকে পড়েনি। পাঁচিল টপকাবার সময়েও না।
শুধু পাঁচটি বছর
আমার এক বন্ধুর নাম দিব্যাশীষ (যথারীতি নকল নাম)।
সে দক্ষিণ শহরতলীর এক অঞ্চলে একটা বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকত। সেই বাড়িরই একতলায় ভাড়া নিয়ে থাকত আমারই এক ডালপালা আত্মীয়। তাদের বাড়িতে আমার ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। সেই সুবাদে দিব্যার সঙ্গেও দেখা হয়ে যেত প্রায়ই। সে কলকাতায় থাকলেও তার পরিবারের আর সবাই থাকত পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানকার বাঙালিরা ভেতর ভেতর ফুঁসছিল, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
পরিবারের আর সবাইকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে দিব্যার বাবা থেকে গেলেন ওখানে। শেকড় তুলে ফেলা যে কত কঠিন, তা বাঙালিরা ছাড়া কেউ জানেনা। তা ছাড়া উনি ওখানে কোম্পানী অডিট করতেন, এখানে সে রোজকার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেত। অতবড় সংসার চলত কি ভাবে। মেসোমশাই কোলকাতায় এলে প্রথম প্রথম বড় ছেলের কাছেই উঠতেন, তার কারণ, পরিবারকে পশ্চিমবাংলায় পাঠালেও কোলকাতায় রাখার মত সামর্থ ছিলনা। কিছুদিন পর থেকে অবস্থার একটু পরিবর্তন হল।
একবার উনি কোলকাতায় এসে আমার সেই আত্মীয়দের বাসায় উঠলেন। বললেন, আমি যদি তোমাদের বাইরের ঘরে দুরাত্তির কাটাই, তোমাদের কি খুব অসুবিধে হবে? ও (দিব্যা) তো একটা মাত্র ঘর নিয়ে থাকে, মানে ওর প্রাইভেসি – তারা হাঁ হাঁ করে উঠল, সেকী, আপনি যখন খুশী আসবেন, যতদিন খুশী থাকবেন আর খাওয়া দাওয়া আমাদের সঙ্গেই করবেন। সেই থেকে উনি এলে সেখানেই উঠতেন, কিন্তু বাইরে কোথাও খেতেন। কোনও আপত্তি শুনতেন না। ঠিক দুদিন পর আবার চলে যেতেন।
সে বাড়ির বাসিন্দারা কোথাও বেড়াতে গেলে আমি বাড়ি পাহারা দিতে থেকে যেতাম। সেই পরিস্থিতিতে অন্ততঃ দুবার মেসোমশাই এসেছিলেন সেখানে। খুব ভোরে, কাক ডাকারও আগে বারান্দার দরজায় সন্তর্পনে আস্তে আস্তে টোকা দিয়ে ভাঙা গলায় রূপঙ্কর, রূপঙ্কর, বলে ডাকতেন। পরেরবার যখন এলেন, দরজাটা খুলে আমি চমকে গেলাম।
মেসোমশায়ের বয়স যথেষ্ঠই হয়েছিল, মাথায় খুব ঘন ঠাসা চুল কিন্তু সবকটা ধবধবে সাদা। তবে শরীর ছিল পেটানো মজবুত, পেশীবহুল। আমার মত যুবকদের কাছেও তা ছিল ঈর্ষার বস্তু। সেই শরীর দেখি দুমড়ে মুচড়ে একসা। চোখের তলায় কালি, মুখে আতঙ্কের ছায়া, দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। আঁতকে উঠে বলি, একী, মেসোমশাই, কী হয়েছে আপনার? উনি বললেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলাম বাবা, একটু জল –
পাকিস্তানের খানসেনারা তখন প্রতিদিনই কিছু লোককে ‘তুলে’ নিয়ে যেত। স্বাধীনতা সংগ্রামী বা বিপ্লবী হলে তো কথাই নেই, এছাড়া ছাত্র-যুব, বুদ্ধিজীবি এবং আর এক ধরণের লোক – ‘বাঙালি হিন্দু’।
এদের মধ্যে প্রায় কেউই আর ফিরে আসতনা। আমি যে বাড়ির কথা বলছি সে বাড়ির গৃহস্বামীর সেজদা একটা ছোটখাট ব্যবসা চালাতেন। বিপ্লবী নন, ছাত্র কিংবা যুব নন, বুদ্ধিজীবিও নন। তাই বাড়ির লোক পই পই করে বারণ করতেও রোজই রাস্তায় বেরোতেন। বলতেন, বসে থাকলে পেট চলবে? তাছাড়া ওরা যাদের ধরছে আমি তো তার ধারে কাছে নেই, আমার কোনও ভয় নেই। ক’দিন রাস্তা থেকে বুলেট তুলে এনেছেন স্যুভেনীর হিসেবে। একদিন আর ফিরলেননা। প্রতিবেশী এক মুসলমান দোকানদার ধরা পড়া লোকেদের দলে ছিলেন। তিনি কপালগুনে ফিরেছেন। বললেন, ওরা আমাদের মধ্যে সাত জনকে বুড়িগঙ্গায় হাঁটু অবধি পানিতে নামতে বলে পিছন থেকে গুলি করল। লাশগুলাও ফিরত দেয় নাই।
মেসোমশাইকে বুড়িগঙ্গায় নামতে হয়নি, কেননা শহরটা ঢাকা নয়। ভাগ্যিস ঢাকা নয়। উনি বললেন, একদিন অফিস থেকে ফেরার সময়ে একটা মিলিটারির গাড়ি পাশে এসে থামল। দুজন অফিসার নেমে বলল, গাড়িতে উঠুন, কিছু সওয়াল করার আছে। উনিও গোলমালের সময় মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিলেন। ছাত্র-যুব মোটেই নন, পলিতকেশ বৃদ্ধ। স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন মনে মনে নিশ্চয়ই দেখেন, কিন্তু ‘বিপ্লবী’ যাদের বলে, একদমই তা নন। আর বুদ্ধিজীবি? একজন চার্টাড অ্যাকাউনট্যান্ট বুদ্ধিজীবি তো বটেই, বুদ্ধিই তাঁর জীবিকা। তবে ‘বুদ্ধিজীবি’ হচ্ছে ইন্টেলেকচুয়াল-এর বাংলা। সে অর্থে উনি কোনওদিনই ইন্টেলেকচুয়াল নন, তাই ওঁরও ভয়ডর ছিলনা।
জল খেয়ে খানিক বসে উনি বললেন, পরের দিন একদম সকাল সকাল আমাদের ব্যারাকের মধ্যে এক জায়গায় নিয়ে গেল, বলল লাইন করে দাঁড়াও। তারপর মার্চ করে একদল সেপাই এসে আমাদের উল্টোদিকে সারি দিয়ে দাঁড়াল। বুঝলাম, ফায়ারিং স্কোয়ড। রূপঙ্কর, আমার মনের অবস্থাটা বুঝছ কিছু? ভাবছি জীবনটা আর কতক্ষণ? দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড, এক মিনিট, দুই, পাঁচ? মাথাটা একেবারে ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেল, বাড়ির লোকের কথা, ছেলেমেয়েদের কথা, কিচ্ছু মনে পড়ছেনা। ভগবানের কথাও না।
আমরা সারিবদ্ধ একত্রিশ জন। আমিই প্রথম। একবার ভাবলাম, অনেক সময়তো শোনা যায় গুলি খাবার ভান করে লোকে পড়ে যায়, অন্য দেহগুলোর সঙ্গে ডেডবডি হিসেবে যদি ফেলে টেলে দেয় কোথাও – তারপর ভাবলাম কোনও চান্স নেই ভান করে পড়ে যাবার। আমিই তো প্রথম। মেজর সাহেব এসে কম্যান্ড দিচ্ছেন, অ্যাটেনশন, বন্দুক তোল, এইম কর, ফা- নাঃ ‘ফায়ার’টা বলার আগেই একটা লোক এসে মেজরকে দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে কি একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করল।
আলোচনা চলছেতো চলছেই। রূপঙ্কর, গল্প তো শুনছ, আমাদের মনের অবস্থাটা বুঝছ কিছু? বুকের সামনে তাক করা বন্দুক, সেপাইগুলো ট্রিগারে আঙুল রেখে অপেক্ষা করছে। একটা করে সেকেন্ডকে এক এক ঘন্টা মনে হচ্ছে। কুড়ি মিনিট হয়ে গেল, আমাদের আয়ু কুড়ি মিনিট বাড়ল, কিন্তু তাতে আমরা কেউ খুব একটা আহ্লাদিত নই। ভাবছি ব্যাটাচ্ছেলে ফিরে আয়, এসে ‘ফায়ার’ বল। এই অনন্ত উৎকণ্ঠা তো আর সহ্য হয়না। একেবারে মেরে দে বাপ, তিলে তিলে মারিস না।
এমন সময় সাইরেন বাজল। পালা বদলের পালা। মেজরের ডিউটি শেষ। সে আর কম্যান্ড দিতে পারবেনা। লোকটা পাঞ্জাবী ছিল। এল একটা বালুচ মেজর। সেপাই গুলোকে বন্দুক নামিয়ে ‘অ্যাট ইজ’ দাঁড়াতে বলে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? তারা বলল, এদের ওপর ফায়ারিং অর্ডার আছে। বালুচরা নিজেরাও তখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল, মেজর সাহেব বললেন, ফায়ারিং? গুলির দাম নেই নাকি? যাও ওদের কয়েদ কর। একত্রিশজন মনে মনে একসাথে বললাম, জয় বালুচিস্তান।
মেসোমশাই পাকাপাকি ভাবে চলে এলেন এপারে। দেশ স্বাধীন হবার পরও যাননি। হুগলী জেলার এক আধা শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। বছর পাঁচেক পর কোনও পাঞ্জাবী বা বালুচের হস্তক্ষেপ ছাড়াই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।
‘ স্যার’
প্লেনে চাপতে আমার ভীষণ ভয়। পারতপক্ষে উঠিনা, কোথাও যাবার হ’লে ট্রেনের ধান্ধা করি। এর কোনও মানে নেই, কোনও যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবেনা। এইতো ক’দিন আগে গাইসালের বীভৎস দুর্ঘটনা, তার পর রাজধানী এক্সপ্রেস। এ,এস-ওয়ান কম্পার্টমেন্টে একজনই বেঁচে ফিরেছে, সে আমাদের পাশের গলির মুখুজ্জেদের বড় ছেলে, পেশায় এঞ্জিনীয়র। (এই অধ্যায় যখন লেখা, সেটা দুহাজার চারের মাঝামাঝি, জ্ঞানেশ্বরী কান্ড তার কয়েক বছর পরে)
যখন সে কথা উঠলই, তখন ব্যাপারটা বিশদে বলা যাক। সে যাচ্ছিল অফিসের কাজে, রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল আর সবার মত। কোনও কারনে ঘুম ভাঙে এক ঝটকা লেগে। তার মুখ থেকে যা শুনেছি, তাই বলি। আচমকা ঘুম ভেঙে খানিক হকচকিয়েই গেছিল সে। ব্যাপারটা এতটাই আচমকা, যে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা যে নেই, তাও টের পায়নি মুখুজ্জে। শুধু এটুকু খেয়াল আছে, যে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার আর বাইরে তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যে আবার জানলার বাইরে বেশ কিছু ছায়ামূর্তি শাবল দিয়ে জানলা ভাঙছে।
নির্ঘাত ডাকাত পড়েছে, এই ভেবে সে মটকা মেরে পড়ে রইল নড়াচড়া না করে। বাইরের লোকগুলো জানলা ভেঙে ভেতরে ঢুকে টর্চ ফেলতে দেখা গেল কামরাটা একেবারে লন্ডভন্ড। যে কজন যাত্রীকে দেখা যাচ্ছে, তারা কেউ বেঁচে নেই। তাকে জীবিত পেয়ে ওরা তার নিজের এবং বাকি মৃত ব্যক্তিদের কম্বলগুলো জড়িয়ে জানলার ভাঙা কাঁচের মধ্যে দিয়ে বার করে এনে মাটিতে শুইয়ে দিল। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মুখুজ্জে বলল ভাই, একটা ব্রীফকেসে আমার অফিসের সত্তর হাজার টাকা ছিল (সে সময় বেশ অনেক টাকাই)। তারা ভাঙা জানলার কাঁচ গলে তাও এনে দিল তাকে। পরে জানা গেছিল, সে কামরায় আর কেউ বেঁচে ফেরেনি।
এই সব কান্ড শুনেও আমি আকাশের চেয়ে রেলপথ বেশি পছন্দ করি, কারণ অজ্ঞাত। আমি কিন্তু একা নই। এই কিছুদিন আগে সার ডন ব্র্যাডম্যানের ফিউনারালে এদেশের প্রতিনিধিত্ব করার বরাত পেলেন নবাব অফ পতাউদি। তিনি প্লেনে চাপার ভয়ে গেলেন-ই না অস্ট্রেলিয়া। মিডিয়া জিজ্ঞেস করল, যখন খেলতে যেতেন, তখনতো প্লেনে চাপতেন? মনসুর আলি বললেন, সে তো বাধ্য হয়ে। উত্তমকুমারের জীবনীতে পড়েছি, তিনিও ভীষণ ভয় পেতেন প্লেনে চাপতে। যখন বাধ্য হয়ে চাপতে হতো, তখন 'বুড়ো’ অর্থাৎ তরুনকুমারকে সঙ্গে নিয়ে শক্ত করে তাঁর হাত চেপে ধরে স্টিফ হয়ে বসে থাকতেন।
আমি বেশ কয়েকবার অফিসকে ধোঁকা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ট্রেনে গেছি। কর্পোরেট ফিনান্স করতে এসে দেখি সে সুযোগ আর নেই। এখানে অফিস আমায় টিকিট কাটতে দেয়না, টিকিট কেটে হাতে ধরিয়ে দেয়। তা ছাড়া অত সময়ও দেয়না। অনেক সময় সকালের ফ্লাইটে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসতে হয়। অগত্যা উত্তমকুমারের মত ‘স্টিফ’ হয়ে ঘণ্টা দেড় দুই কাটিয়ে দিই।
এবার আমি ইন্দোর থেকে ফিরছি। ওখানে ডাইরেক্ট উড়ান নেই, বোম্বে হয়ে যেতে হয়। দুদিনে চার চার বার উড়োজাহাজ চাপা। প্রাণটা যে এখনো বেরোয়নি তা আমার চোদ্দপুরুষের ভাগ্য। যদিও বোম্বে অবধি চোখ বন্ধ করে সিঁটকে বসে গেছি, ইন্দোর যেতে বেশ মজাই লাগছিল। প্লেনটা অ্যালায়েন্সের। চাপতে গিয়ে টারম্যাকে পৌঁছে দেখি, সামনে উইন্ডমিলের মত মস্ত বড় বড় চারটে প্রপেলার। ঘাবড়ে গেলাম, সিনেমায় বিশ্বযুদ্ধের আমলের প্লেনে এইরকম প্রপেলার দেখতাম। তবু সেগুলোও অনেক ছোট। এই প্রকান্ড পাখা ওয়ালা প্রাগৈতিহাসিক উড়োজাহাজ এল কোত্থেকে তাই ভাবতে ভাবতে সীটে বসেছি। সেখানেও এক বিপত্তি। আমি সব সময় ‘আইল’ সীট নিই, ভয়ে কখনো জানলার ধারে বসিনা। এখানে দেখি আইল সীটের পাশে সীট নেই। সেখানে এক পেল্লায় গর্ত আর তার মধ্যে লোকে বেমালুম লাগেজপত্র রেখেছে। ভাবলাম এই এয়ারলাইন্সে কি নিয়ম-কানুন কিচ্ছু নেই? বিমানসেবিকাকে জিজ্ঞেস করব বলে ডাকতে গিয়ে দেখি, ও হরি, বিগতযৌবনা সুন্দরী(?)রা যে যার ইচ্ছে মত শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ‘ইউনিফর্ম’ বলে কিছু নেই।
যাকগে নিয়মকানুন। যেহেতু পাশে সীট নেই তাই জানলার ধারে না বসলেও জানলার দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। সেবিকারা যখন লবেঞ্চুস বিলি করছেন, তখন দেখলাম দিব্যি মানুষজন, ঘর-বাড়ি, গরু-ছাগল দেখা যাচ্ছে। কিরে বাবা! মিনিট পাঁচেক ওড়া হয়ে গেল, এখনও গরুছাগল, মানুষজন? কি জানি, পরে হাইট নেয় বোধ হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন দিদিমনি ঠান্ডা পানীয় সরবরাহ করছেন, নীচে দেখি জ্যান্ত বরাহ ঘুরছে। ব্যাপারটা কী? শুনলাম এ জাহাজ হেলিকপ্টারের মত এই হাইটেই ওড়ে। ব্যাস। আমার ভয় ডর হাওয়া হয়ে গেল। এর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। প্লেন কুড়ি ফুট ওপর থেকে পড়লেও যা, দুহাজার ফুট থেকেও তাই। তবু বেশ ফুরফুরে আমেজ এসে গেল। জীবনে প্রথম উড়ান উপভোগ করতে লাগলাম। আমার ঘুম পেয়ে গেল।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম, আমি আর বেঁচে নেই। ভগবানের কাছে পৌঁছে গেছি। খুব নরম গলায় বলছি, - মে আই কাম ইন সার?
- আ,- মাই ডিয়ার, ওয়েলকাম ব্যাক। হাউ আর ইউ?
- ফাইন সার, থ্যাঙ্ক ইউ।
- অ্যান্ড হাউ ওয়জ ইয়োর স্টে অন দা প্ল্যানেট? ওয়জ ইট গুড?
আমি কিন্তু কিন্তু করে বলি, নট কোয়াইট, নেভারদিলেস, ইট ওয়জ নট ভেরি ব্যাড ঈদার।
- দেন? হাউ ওয়জ ইট? ডোন্ট ইউ হ্যাভ এগজ্যাক্ট ওয়র্ডস টু ডেসক্রাইব?
- ই-ইয়েস সার, ইট ওয়জ সো-সো।
- অ্যান্ড হোয়ট প্রিসাইজলি ইজ আ ‘সো-সো’?
- ইট ইজ আ স্টেট অফ বিয়িং হুইচ ইজ নট ভেরি গুড। দি ইউসেজ অ্যাপিয়ারস ইন দি ইংলিশ লেক্সিকন।
- ও, ইজ ইট? হাউএভার, হোয়াই আর উই স্পিকিং ইন ইংলিশ? হোয়ট হ্যাপেনড টু দেবভাষা, দ ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দ হেভেন?
- সার, ক্লাস এইটে সংস্কৃতে অষ্টআশী পেয়েছিলাম, কিন্তু তার পর কিচ্ছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, খুব ঘন ঘন অনুস্বর আর বিসর্গ ব্যবহার হয়। তবে সার দেবভাষা মনে না থাকলেও দেবনাগরী হরফ আমার বিলক্ষণ মনে আছে, পড়তেও পারি, লিখতেও পারি।
- সো হিয়ার ইজ আ ওয়র্থলেস ক্রীচার ব্যাক ইন হেভেন হ্যাভিং লার্ন্ট রীডিং অ্যান্ড রাইটিং ডেভনাগরী স্ক্রিপ্ট। হোয়ট অ্যাবাউট দ মিশন? হ্যাভ ইউ অ্যাকমপ্লিশড ইট?
- হো-হোয়ট মিশন সার?
ভগবান খুব চটে গেছেন,- ফূল, ডোন্ট ইউ নো দ্যাট এভরিওয়ান অন আর্থ ইজ সেন্ট দেয়ার টু ফুলফিল আ টাস্ক? গো ব্যাক ইমিডিয়েটলি, ফাইন্ড আউট দ মিশন ইউ ওয়্যার সেন্ট টু অ্যাকমপ্লিশ অ্যান্ড কাম ব্যাক হোয়েন ইয়োর টাইম কামস। রিমেমবার নট টু মীট মি উইদাউট প্রায়র অ্যাপয়েন্টমেন্ট। নাউ গো –
এত জোরে ধমক খেলাম যে স্বপ্ন ভেঙে গেল। যাক বাবা, এখনও বেঁচে আছি। শুধু শেষ কথাটা কেমন যেন বেখাপ্পা শোনাল,
- ক্যান ইউ গিভ মি ওয়ান গুড রীজন হোয়াই আই শুড নট গিভ ইউ আ নাইস কিক অন ইয়োর পসটিরিয়র সো দ্যাট ইউ ল্যান্ড এগেন অন আর্থ ‘মুখ থুবড়ে’?
(চলবে)