এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • ধানাই পানাই ৫

    রূপঙ্কর সরকার লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৬ জুন ২০১২ | ৯২৩ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০

    নাম-যশ

    খুব ছোট বেলায় মানুষ নানা রকম দৃশ্য, বক্তব্য, মতামত ইত্যাদিতে এক্সপোসড হয়। কোনও কোনওটা তার মাথায় আটকে যায়। এর জন্য অবশ্য তার জেনেটিক মেক-আপও বহুলাংশে দায়ী, কিন্তু শুধু জিনের ঘাড়ে দোষ বা গুণ চাপিয়ে ঠিক হবেনা, এক্সপোসারটাও বিরাট ফ্যাকটর।
     
    ইস্কুলে পড়ার সময়ে তো কত গদ্য, পদ্য, ব্যাখ্যা, রচনার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই, কিন্তু দেখা যায়, কোনও মানুষ বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তার কিছু কিছু অবিকল আউড়ে যেতে পারে। কারণ একটাই, সেই পংক্তিগুলো মাথায় আটকে গেছে।

    এই ধানাই পানাই লেখার আগে পর্যন্ত আমি ইহ জীবনে যা লিখেছি, কয়েকটি ছোটগল্প বাদে তার সবই ছড়া। আমার বেশ কিছু নাটকও পুরোপুরি ছড়ায় বাঁধা। এই ছড়া বোধহয় জিনের মধ্যে ঢুকে ছিল। অবশ্য তাও অন্নদাশঙ্কর বা অমিতাভ চৌধুরির ছড়া এক্ষুনি বললে আমি মুখস্থ বলতে পারবনা, সুকুমার রায়ের একটা দুটো হয়তো পারব, কিন্তু ইস্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা, আমার দু এক ক্লাস ওপরে পড়া এক ছাত্রের ছড়া আমি এক্ষুনি আউড়ে দেব।

    “আকাশ থেকে খামচে
    বাড়িয়ে ধরে চামচে
    খানিকটা মেঘ বাগিয়ে এনে
    খেলাম চেটে চেটে
    ওমা, দেখি জোলো জোলো
    ব্যাপারটা কি রকম হ’লো?
    মেঘেও ভেজাল, বুদ্ধি এত
    নীল আকাশের পেটে?”                                                              
     

    একটা স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা, সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর অপরিচিত এক ছাত্রের লেখা ছড়া বাহান্ন বছর পরও মুখস্থ আছে কেন? সিম্পল এক্সপ্ল্যানেশনঃ মাথায় আটকে গেছে।

    আর একটা ছড়া। এর লেখিকার নাম পায়েল মাইতি, কোনও এক স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। আনন্দবাজারের ছোটদের পাতায় পড়েছিলাম বছর সাতেক আগে। কিন্তু মাথায় ঢুকে গেছে, আর বেরোয়নি।

    “শালুক পাতা চিতসাঁতারে
    বলছে ডেকে, মেঘের দল-
    আমরা যাচ্ছি রথের মেলায়
    ইচ্ছে হলে সঙ্গে চল”।                                                               
     

    স্কুলে পড়ার সময় কত কবিতাই তো পড়তে হত, ‘পঞ্চনদীর তীরে, বেণী পাকাইয়া শিরে’ – এটা রবিঠাকুরের লেখা জানি, ব্যাস ওইটুকুই। আমার মনে হয়, যাঁরা নিজেদের লেখায় নানা রকম রেফারেন্স টানেন, ইস্কুলে পড়া, ইউনিভার্সিটিতে পড়া বলে, তাঁরাও কি আর মুখস্থ লেখেন? মনে তো হয়না। একবার পড়ে নেন নিশ্চয়ই। ইংরিজী সাহিত্য নিয়ে পড়তে গিয়ে, শেলী, কীটস, বায়রন, ওয়র্ডসওয়র্থ, টেনিসন কতো ঘেঁটেছি। কিস্যু মনে নেই। শুধু ড্রাইডেনের একটা ছোট্ট কবিতা স্ট্যাম্পের মত সেঁটে গেছে মাথায়ঃ

    “He that fights and runs away                                                  
    Lives to fight another day                                                       
    But he that is in the battle slain                                                
    Will rise up never to fight again”                                              
     

    এটা আসলে আমার নিজের জীবন-আদর্শ। তাই অপরের লেখায় তার প্রতিফলন পেয়ে মগজ আঁকড়ে ধরেছে।

    কী মনে থাকবে আর কী মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে, তার বোধহয় কোনও হিসেব নেই।

    শ্রীযুক্ত কমলাকান্ত চক্রবর্তীর প্রবেশ। বললেন, নরানাং মাতুলক্রম বলে একটা প্রবচন শুনেছিলাম, নরানাং পিতৃব্যক্রম কোথাও শুনিনি তো! আমি তো শালা আফিংখোর, এক কথা কইতে কইতে আরেক কথায় চলে যাই, এতো সকলেই জানে। এ রোগটা তোকে ধরল কেন? লেখার নাম ‘নাম-যশ’ কিন্তু লেখা চলছে কবিতা মুখস্থ নিয়ে- আমি বললাম, খুড়ো, তোমার গোড়ায় গলদ। এই রচনাবলী কী নামে শুরু হয়েছে বলতো? ‘ধানাই পানাই’।


    তো সেখানে ধানাইপানাই বকবো নাতো কোথায় বকবো?

    আসলে একটা কবিতার খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ মগজে চিপকে গেছিল সেই ছোটবেলায়। কবিতাটা বৈষ্ণবদের তর্কযুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু নাম কী, কার লেখা, গোড়ার লাইনগুলো কেমন, তা কিচ্ছু মনে নেই। একটু ঘাঁটলেই পাওয়া যেত অবশ্য, তবে খুড়ো, তুমিতো জান, আমি অপ্রয়োজনে ব্যাটারি একদম পোড়াইনা। সেই ছোট্ট অংশটা কেন মনে আছে, আর কিছু মনে নেই, তাই বোঝাতেই ভূমিকায় এত ধানাই পানাই। অথচ, একটু খুঁজে আস্ত কবিতাটা বের করে, তাই নিয়েই এই এপিসোড দিব্বি শুরু করা যেত। তবে তা ‘ধানাই পানাই’-এর চরিত্রভ্রষ্ট হত।

    চক্রবর্তী মশাই বললেন, হয়েছে, সেই অংশটা কী এবার শুনি? আমি বললাম, “যশ প্রতিষ্ঠা/ শূকরীবিষ্ঠা/ মেখে এলি সারা গায়”।


    ন্যায়শাস্ত্রে সুপন্ডিত শিষ্য তর্কযুদ্ধে রথী মহারথীদের হারিয়ে মহা উৎসাহে গুরুর কাছে এসেই এই গালি খেলেন। যশ-প্রতিষ্ঠা ইজ ইকোয়াল টু ডাং অফ আ ফিমেল পিগ (অফ অল থিংস)।

    তখন বাংলা টীচার কে ছিলেন? নারানবাবু না জ্যোতিবাবু? (আমরা, মানে জগবন্ধুর ছাত্ররা ‘জ্যোতিবাবু’ বলতে একজনকেই বুঝি। তাঁর নাম স্বর্গীয় জ্যোতিভূষণ চাকী। তিনিও শিশুসাহিত্যিক হিসেবে কম বিখ্যাত লোক ছিলেন না। আমাদের আর কোনও জ্যোতিবাবু নেই ।) যিনিই থেকে থাকুন, সেদিন খুব ভাল লাগছিল তাঁর পড়ানো শুনতে। মনের ভেতরে অজানা এক দর্শন সেঁধিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। তার প্রয়োজনও ছিল। যে শেয়াল বলে, “আঙ্গুরফল টক”, তাকে এক অচিন পাখি ঠুকরে একটা ফল ফেলে আগেই খাইয়েছে। ফলটা টক-ই ছিল।

    খুড়ো, তুমি থাকাতে বিরাট সুবিধে হয়েছে। যখন তখন প্রসঙ্গ পাল্টানো যাবে, কেউ প্রশ্ন তুললেই সব দোষ যাবে তোমার ঘাড়ে। আমার বড়মামার নাম দিলীপ রায়। নাম যে মানুষের কত ক্ষতি করতে পারে, বড়মামা তার জাজ্বল্যমান নিদর্শন। বড়মামার নাটক দেখতে গেছি। নাটকের নাম ‘প্রস্তাব’।


    কুশীলব-দিলীপ রায়(অভিনেতা), অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মমতা চট্টোপাধ্যায়। বড়মামা বলেছিল, শেষ হলে কেমন লাগল বলে যাস। গ্রীনরুমে ঢুকতে গিয়েই এক ডাকাতে চেহারার মুখোমুখি। কি চাই? বললাম দিলীপ রায়ের সঙ্গে দেখা করব। ডাকাত বলল, এখন হবেনা, মেকাপ তুলছেন। আমি বললাম, আমি যাঁর সঙ্গে দেখা করব, তিনি মেকাপ ফেকাপ করেননি, তোলার প্রশ্ন নেই। রাস্তা ছাড়ুন।

    বড়মামা বড় ভাল গাইতেন, বেশ কয়েকটা রেকর্ডও ছিল। রেডিওতে মাঝে মাঝে পুরোন গানও বাজাত। একদিন আড্ডায় বসেছি, লক্ষণের দোকানে হঠাৎ বেজে উঠল,-‘দিয়ে গেনু বসন্তের এই/ গান খানি’ – আপন মনেই ‘বড়মামা’ বলে ফেলেছি। একজন বলল, কে ভদ্রলোক? বললাম, দিলীপ রায়, -ওরে বাবা, ডি এল রায় তোর দাদু? বলিসনিতো? আমি দাঁত চেপে বললাম, আমার দাদুর নাম, শ্রীযুক্ত দীনেশ চন্দ্র রায়, যাঁর লেখা বই আইন কলেজে পড়ানো হয়।

    বড়মামা খুব ভাল ছবিও আঁকত। সে সময়ের নামী শিল্পীদের (যাঁদের মধ্যে দুজন এখনো জীবিত) কতবার আসতে দেখেছি মামাবাড়িতে। লেডি রাণু মুখার্জী এতই স্নেহ করতেন বড়মামাকে, যে অ্যাকাডেমিতে বড়মামার এক্সিবিশন হলে ভাড়া লাগতনা। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, নায়ক আছে, গায়ক আছে, শিল্পী দিলীপ রায়ও আছে নাকি কেউ? বড়মামা বলত, আছে হয়ত।

    আই পি টি এ যখন প্রথম গঠন হয়, যে ক’জন মিলে শুরু করেছিল, বড়মামা তাদের একজন। দোলের সময় গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে পথে গাইতে গাইতে হেমন্ত মুখুজ্জেরা মামাবাড়িতে আসত কিনা সে প্রসঙ্গ পরে হবে। তবে লিটল থিয়েটার গ্রুপ বা এলটিজি বড়মামা আর কয়েক জন মিলে পত্তন করেছিল, নামটাও বড়মামার দেয়া। যাঁরা কাগজে লেখেন ও কাজটি উৎপল দত্ত মশাই করেছিলেন, তাঁরা হয় জানেন না, নয় মিথ্যে কথা বলেন।

    উনিশশো ছিয়াত্তরের মাঝামাঝি একদিন ভোর বেলা অকৃতদার দিলীপ রায়কে পন্ডিতিয়া রোডের বাড়ির ছাদের রান্নাঘরের কড়িবরগা থেকে ঝুলতে দেখা যায়। পা দুটো পেছনে ভাঁজ করা ছিল, ছ’ফুট দু ইঞ্চি লোকটা দাঁড়ালেই তো ওই নীচু সিলিং-এ মাথা ঠেকে যাবার কথা।

    বড়মামাকে কেউ বলেনি, যশপ্রতিষ্ঠা ইজ ইকোয়াল টু ডাং অফ আ ফিমেল পিগ।

    আমার নাম রূপঙ্কর। সমনামধারী এক যুবক, গান টান গেয়ে নিজে বেশ নাম করেছেন, আমারও প্রভূত উপকার করেছেন। এখন আর কাউকে নাম বললে, কি বললেন, দীপঙ্কর? এ প্রশ্ন করেনা। বড়মামার নামে বহু লোক ছিল বলে বিপদ, আমার নামে কেউ ছিলনা বলে বিপদ।

    আমার খুব ছোটবেলায়, অ্যাকাডেমীতে একটা আর্ট এক্সিবিশন হয়েছিল। ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ ভাল ভাল কথা লিখেওছিল। কিন্তু না, আমার নামে নয়, ’শুভঙ্কর সরকারের ছবি’ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। আমার বড়মাসি খবরের কাগজে বাড়ির কারো নাম বেরোলেই কেটে রাখত। একটু বড় হয়ে একদিন খুব রাগারাগি করেছিলাম, ফেলে দাওনা। শুভঙ্কর বলে কাউকে তুমি চেন?

    আমার একটি নাটক শেষ মঞ্চস্থ হবার পর একটা অভিনন্দন পেলাম দলের এক সদস্য মারফৎ - ‘আমি আপনার খুব বড় ফ্যান, আপনার যেমন গানের গলা, তেমনি নাটক লেখার হাত’-।

    অনেক সময়ে হয়, খুব হাসি পাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই হাসা যাচ্ছেনা।

    শুধু নিজের নাম নয়, গতকাল (২৩/০৩/২০১১) হঠাৎ ডেভিডের ফোন। কিরে, তোর নাটক টিভিতে হল, আর একটা খবর দিলিনা? আমি মাঝখান থেকে দেখলাম- আমি বললাম, আমার নাটক টিভিতে হবার কোনও চান্স নেই। ডেভিড বলল, সেকি, পরিষ্কার শুনলাম, ত্রিপুরা শঙ্কর চক্রবর্তী – আমি বললাম, সে তো হতেই পারে। বাংলা ভাষায় লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক উৎপল দত্তর ‘টিনের তলোয়ার’এর মুখ্য চরিত্র বেণীমাধব চট্টোপাধ্যায়। আবার জয় গোস্বামীর কবিতা পড়িসনি –‘বেণীমাধব, বেণীমাধব তোমার বাড়ি যাব/বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাব?

    ডেভিড বলল, আরে আমি তো তোর নাটকটা দেখেছি, এটা তো খানিকটা সেইরকমই। নন্দিনী বলল, দেখুনগে কেউ আপন করে নিয়েছে হয়তো। আমি বললাম, এ জিনিষ আজকের নয়। আশুতোষ কলেজে পড়ি তখন। স্বর্গীয় সাহিত্যিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আমাদের জিসেক। কলেজ ম্যাগাজিন বেরোবার আগে বললেন অ্যাই রূপঙ্কর, লেখা দাও। ক’দিন তারাদা তাড়া করার পর দিলাম একটা বাংলা ছোটগল্প ‘চাঁদের ওপিঠ’।



    ক'’দিন পরেই তারাদার তলব, আরে তুমি বাংলা গল্প দিয়েছ কেন? ম্যাগাজিনে একটা ইংরিজী সেকশন থাকে জাননা? তোমরা ইংরিজীর ছেলেরা বাংলা লিখলে ইংরিজী লেখা কি বাংলা অনার্সের ছেলেরা  দেবে? তখন একটা ইংরিজী গল্প লিখে দিতে হল, মন্দ হয়নি সেটা। বললাম তারাদা, বাংলা স্ক্রিপ্টটা তাইলে ফেরত দ্যান। তারাদা বলল, এখন খুব ব্যস্ত, যাতো, ঝামেলা করিসনা। বেশ কয়েকদিন ঘুরলাম ওটা ফেরত পাবার জন্য, পাইনি। পরে একদিন তারাদা বলল, তোর লেখাটা খুঁজে পাচ্ছিনারে, বলা তো যায়না, কারো পছন্দ হয়েছে নিশ্চয়ই। বলে তারাদা হেসেছিল। হাসিটা সত্য হয়ে গেল।

    খুড়ো বলল, সত্য হয়ে গেল মানে?- মানে কিছুদিন পর ঐ ‘সত্য’ টাইপেরই নাম দিয়ে এক বিখ্যাত হিন্দী ছবি নামল বাজারে ( নামটা লিখছিনা, কেউ মামলা করে দিতে পারে। গল্পটা আমার, তেমন কোনও প্রমাণ তো নেই)। চারিদিকে বিশাল বিশাল পোস্টার, মন টা হু হু করত। চক্কোত্তি মশাই বললেন, সেই তারাদাকে বললিনা? আমি বললাম, আমরা দুজনেই তখন কলেজের বাইরে।

    বড়মামার প্রতিভার কণামাত্র আমার মধ্যে নেই। ছ’ফুট দু ইঞ্চি উচ্চতা আর বেয়াল্লিশ ইঞ্চি বুকের খাঁচাও নেই। রিহার্সাল দিয়ে ফেরার সময়ে মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতা করছিল বলে দু-দুটো তাগড়া আমেরিকান সোলজারকে লাথি মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল বড়মামা। দাঙ্গার সময়ে পাড়ার একমাত্র মুসলমান পরিবারের দরজায় তেল মাখানো লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বড়মামা, গুন্ডাগুলোকে বলেছিল, আগে আমায় টপকা, তবেতো ঢুকবি।

    নরানাং মাতুলক্রম প্রমাণ করতে একটাই ব্যাপার ছিল, বড়মামার মত আমিও অনেকগুলো বিষয়ে ঢুকেছি কিন্তু ভাগ্যিস জ্যোতিবাবু মাদী শুওরের গু এর উপাখ্যানটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, তাই আমি তোফা আছি।

    যদি কেউ বলে আঙুরফল টক, তাকে বলি, বিশ্বাস কর, একটা পড়েছিল, খেয়ে দেখেছি সত্যি টক। খুড়ো এখনো আছ? শোনো তবে শুওরের গু মাখানো টক আঙুরের গল্প।

    খুড়ো এমন একটা বাঙালি দেখাতে পার, যে চূণী গোস্বামীর নাম শোনেনি? আমি পারি।





    সেকালে চূণী গোস্বামী ছিলেন বাঙালির কাল্ট ফিগার। বাঙালি চিরকালই এক একটা তারা ভাঙিয়ে খেয়ে এসেছে। একটা রবীন্দ্রনাথ, একটা উত্তমকুমার, একটা সৌরভ গাঙ্গুলী- একটা সময় ছিল, যখন বাঙালি চূণী গোস্বামীকে ভাঙিয়ে খেত। খবরের কাগজে বিরাট ছবি বেরোত, আমরা কাঁচি দিয়ে কেটে খাতায় আটকে রাখতাম। কেউ কোনও কথা এড়িয়ে গেলে ‘চূণীর মত ডজ করিসনা’ বলে একটা প্রবাদবাক্য চালু হয়ে গেছিল বঙ্গদেশে।

    আরও গল্প আছে। কাগজে চূণী গোস্বামীকে তখন লেখা হত ‘ফুটবলের গ্ল্যামার বয়’।



    কথাটা মিথ্যে নয়। শিবদাস ভাদুড়িদের ‘যুদ্ধ’মার্কা ফুটবল, ‘চীনের প্রাচীর’ গোষ্ঠ পালদের ফুটবল, শৈলেন মান্না, কেষ্ট পালদের ফুটবল ছাড়িয়ে ময়দানে গ্ল্যামার আমদানি প্রথম করেন চূণীদা। দশ নম্বর জার্সির মারাদোনা তখন বিছানায় হাত পা ছুঁড়ছে, রোনাল্ডো জন্মায়নি, বিশ্ববিখ্যাত দশ নম্বর পেলেকে কোলকাতায় দেখার প্রশ্ন নেই (তার বহুযুগ পরে দেখা গেছে অবশ্য), তাছাড়া সেও খানিক জুনিয়র। কোলকাতা চিনত দুই দশ নম্বরী চূণী-বলরামকে। পেনাল্টি বক্স আর সেন্টার লাইনের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সতীর্থদের কাছে বল চাইত, পেলেই একটা কোমরের মোচড় আর একটা বিদ্যুতের ঝলক। প্রি অলিম্পিকে ইরানের সব ডিফেন্ডারকে দাঁড় করিয়ে প্রায় মাঝমাঠ থেকে যে গোলটা করল খুড়ো, কি বলব, সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, দেখ একবার – এমনি এমনি বিনা কারনে সে বছর ‘এসিয়ার সেরা স্ট্রাইকার’ খেতাব পায়নি।

    চূণী গোস্বামীর গ্ল্যামার ফ্যাক্টরটা এতদূর গড়িয়ে ছিল, যে বাংলা ফিল্মের এক প্রযোজক তো সোজা চূণীদাকে একটা ফিল্মে নামিয়েই দিলেন। ছবিটা খুব একটা ব্যবসা করেনি অবশ্য, নামটা যদূর মনে পড়ে, ‘প্রথম প্রেম’।



    তা যাই হোক গ্ল্যামার ট্যামার নিয়ে চূণীদা তখন সৌরভের মত রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছেন। যে কোনও বাঙালি গিন্নীকে অমিয় ব্যানার্জী বা বিদ্যুত মজুমদারের কথা জিজ্ঞেস করলে ঠোঁট উলটে ‘জানিনা বাবা’ বলতেন, কিন্তু চূণী গোস্বামী? নাম শোনেনি এমন বিধবা পিসি কলতলাতেও পাওয়া যেতনা।

    এর পর চূণীদা ক্রিকেট খেলতে এলেন। বাঙালি দেখল, বল পায়ের কাছে গড়িয়ে গড়িয়ে এলে তুলে ফেরৎ দেয়া কে ‘ফিল্ডিং’ বলেনা, বলের পেছনে ছুটতে হয়, তাও বলের গতিতে। আর অলরাউন্ড পারফরমেন্সের রেকর্ড? বলছি দাঁড়াও, তার আগে অন্য একটা গল্প শোন।

    আমাদের দেশে যাঁরা ক্রিকেট কমেন্টারি করেন, অর্থাৎ যাঁরা হলেন গিয়ে ধারাভাষ্যকার, তাঁদের মধ্যে এমন একটা আটারলি স্টুপিড লোক আছে, যাকে দেখলেই আমার তাকে কানের গোড়ায় কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে।

    কমলাকান্ত বলল, কী করতে ইচ্ছা করে? বি স্পেসিফিক। আমি বললাম, তা কি বলা যায়? পালক দিয়ে চুলকানোর ইচ্ছেও হতে পারে। তবে ক্রিকেট বোদ্ধা বলে যারা বাজারে পরিচিত নাম, ইনক্লুডিং প্রাক্তন প্লেয়ারস, তারা অনেকেই আমার সঙ্গে একমত। সেই লোক, ধারাভাষ্য দেবার বিফল চেষ্টা করছিল এক আইপিএলের খেলায়।

    খেলার শেষে আজকাল এক ঢপের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান থাকে। সেখানে একটা মেকশিফট স্টেজে এক টিভি অ্যাঙ্কর, গোটা দুত্তিন পেটমোটা টাকমাথা স্পনসর কোম্পানীর প্রতিনিধি আর একজন ‘বিশেষ’ ব্যক্তি, তিনি স্থানীয় মন্ত্রী, অভিনেতা, মেয়র, যে কেউ থাকেন। আজ ছিলেন চূণীদা। কাঁচুমাচু মুখ করে একটা পায়খানা রঙের স্যুট পরে কোলের কাছে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে। সেই চূণীদা, যে আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে এইভাবে দাঁড়ালে (স্যুটটা অবশ্য অন্য কালারের পরে) মাঠে গ্যালারি ভেঙে টেঙে একসা হয়ে যেত।

    সেই ধারাভাষ্যকার, পেটমোটা স্পনসরদের বহুবিধ পরিচিতি আওড়ানোর পর মনে করলেন আরে, এই হলদে স্যুট পরা লোকটার সম্বন্ধে তো কিছু বলতে হয়। সে বলল, অ্যান্ড হি ইজ চূণী গোসওয়ামী, হু রিপ্রেসেন্টেড ইন্ডিয়া ইন ফুটবল। পষ্টো শুনলাম পাশ থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে কিছু একটা প্রম্পট করল, তখন লোকটা বলল, হি অলসো প্লেড সাম ক্রিকেট।

    মাথায় আগুন জ্বলল কাকা, থাকতে পারলামনা। চ্যাঁচাতে লাগলাম, ওরে শুয়াচ্চা, প্লেড সাম ক্রিকেট মানে কিরে, এ লোকটা বেঙ্গলের রঞ্জি টিমের ক্যাপ্টেন ছিলরে, দু দুবার বাংলাকে ফাইনালে তুলেছিলরে। একটা সেঞ্চুরি, সাতখানা ফিফটি আর সাতচল্লিশটা উইকেট আছে মাত্র ছেচল্লিশটা ম্যাচ খেলে- শালা তোর বাবা কোনদিন ফার্স্টক্লাস ক্রিকেট- ছেলে বলল, বাবা, ও শুনতে পাচ্ছেনা, চেঁচিওনা।

    আমি বললাম, তুই শুনলি? বলল হি রিপ্রেসেন্টেড ইন্ডিয়া ইন ফুটবল? ভারতের ক্যাপ্টেন ছিল, এসিয়ান গেমসে একমাত্র গোল্ড, বাষট্টিতে এসিয়ার শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার নির্বাচিত, তেষ্টটিতে অর্জুন, তিরাশিতে পদ্মশ্রী, কি বলছিস তুই? ছেলে বলল, বাবা থামবে?

    চক্রবর্তী, আমার তখন থেকে মাদী শুওরের গু এর কথা মনে হচ্ছে। চূণীদা নিশ্চয়ই কিছু অনরারিয়াম পেয়েছিলেন ওখানে হাসি হাসি মুখে দাঁড়ানোর জন্য। কমেন্ট্রি বক্স থেকে কোন গাধা কী বলছে কানেও যায়নি, কিন্তু দাঁড়াও, পরের গল্পটা তো শোন –

     

    হ্যাঁ গল্পের মধ্যে আবার দুটো আরও ছোট গল্প। সেই যে এসিয়ান গেমসে চূণীদার ক্যাপ্টেন্সিতে সোনা জেতার কথা বললাম, সেই দলে ছিলেন মেওয়ালাল। বিশ্ব ফুটবলের ‘যাদুকর’ বলা হত স্ট্যানলি ম্যাথিউজকে, আর ভারতের যাদুকর মেওয়ালাল। মেওয়ালালের গোলেই সম্ভবতঃ সোনাটা এসেছিল। সেই মেওয়ালাল গুরুতর অসুস্থ। তিনি প্রাক্তন রেলকর্মী হিসেবে রেলের হাসপাতালে ভর্তি হতে গেছেন। ডাক্তার বলল যায়গা নেই। মেওয়াদার ছেলে বলল, একটু দেখুন না, এসিয়াডে সোনাজয়ী খেলোয়াড়ের যদি এই অবস্থা, সাধারণ কর্মীদের কী হবে? ডাক্তার বলল, তাই নাকি? সোনাজয়ী নাকি? কাল মেডেলটা সঙ্গে আনবেনতো, দেখব কি করা যায়। মেওয়াদা মারা গেলেন পরের দিন।

    আর এক জন, তিনিও মারা গেলেন ক’দিন আগে। তাঁর নাম মঙ্গল পুরকায়স্থ। খুব বেশীদিন খেলতে পারেননি, বাষট্টি থেকে চৌষট্টি সাল পর্যন্ত খেলেছেন। চোটের জন্য মাঠ ছাড়তে হয়েছিল কিন্তু যে কদিন গড়ের মাঠ কাঁপিয়েছেন, তাঁকে খেলার মাঠের ‘অরণ্যদেব’ বলত লোকে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, মাঠের যে জায়গা দিয়ে হেঁটে গেলেন, ভক্তরা সেই জায়গার ঘাস ছিঁড়ে মাথায় দিচ্ছে।

    সেই মঙ্গল পুরকায়স্থ, মাঠে একদিন মেম্বারশিপ কার্ডটা আনতে ভুলে গেছেন, ভাবলেন আমি মঙ্গল পুরকায়স্থ, কার্ড নেই তো কি, চেনা বামুনের পৈতের খোঁজ কে করবে। গেটের ‘কর্তব্যনিষ্ঠ’ পুলিশ অফিসার আটকালেন। চেনা বামুন বললেন, আরে কাকে আটকাচ্ছেন? আমি মঙ্গল পুরকায়স্থ। পুলিশসাহেব বললেন, কে মঙ্গল পুরকায়স্থ?-আরে আমাকে এখানে এক ডাকে সবাই চেনে, আমায় আটকাচ্ছেন? ভীড় করা সদস্যদের দিকে ফিরে অফিসার বললেন, আপনারা কেউ চেনেন নাকি? যাদের বাবারা পায়ে মাড়ানো ঘাস ছিঁড়ে মাথায় দিত, তারা বলল, নাঃ। মঙ্গল পুরকায়স্থ সেদিন চোখের জল মুছে বাড়ি এসেছিলেন। বহুদিন ও মুখো হননি।

    কাকা, গল্প এখনো অনেক বাকি। আমাদের ব্যাঙ্কের একটা শাখা আমাদের পাড়াতে আমার বাড়ির খুব কাছেই আছে। একদিন টাকা তুলতে গেছি, দেখি এক নতুন অফিসার। যেচে আলাপ করলাম। হেঁ হেঁ আমি আপনাদের ব্যাঙ্কেই ছিলাম আর কি। ক্রেডিট অ্যানালিস্ট ছিলাম, ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারিও করেছি বেশ কিছুদিন, তা আপনি কোত্থেকে এলেন? ভদ্রলোক বললেন, ফোর্ট উইলিয়াম। বললাম ও, ওখানে তো চূণীদা কিছুদিন ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার ছিলেন।

    - কে চূণীদা?
    - আরে চূণী গোস্বামী।

    - কে চূণী গোস্বামী?
    - আপনি চূণী গোস্বামীর নাম শোনেননি? স্ট্রেঞ্জ!

     - দেখুন আমাদের ব্যাঙ্কের এগার হাজার ব্র্যাঞ্চ, অফিসার ক’হাজার নিজেই বলুননা, সবাইকে চেনা সম্ভব?
    - আরে ভাই, ব্যাঙ্কের অফিসার বাদ দিন, খেলাধুলোর জগতে প্রবাদপ্রতিম চূণী গোস্বামী। তাঁর নাম আপনি শোনেননি বলছেন?

    ভদ্রলোক স্পষ্টতই বিরক্ত, বললেন, কেন, না শুনে থাকলে কোনও পানিশমেন্ট আছে নাকি?
    মিস্টার কমলাকান্ত চক্রবর্তী, গল্পটা এখনে শেষ হলে কি দারুন হতনা? বেশ একটা শকিং এন্ড? কিন্তু যা হলে ভাল হত তাই কি সবসময়ে হয়? তুমিই বলনা। গল্পটা আরও কিছুটা বাকি।
    এ লেখাটা যখন লিখেছিলাম, তারপর বেশ ক’বছর গড়িয়ে গেছে। চূণী গোস্বামী আবার খবরে, বাট ফর দা রঙ রীজ্‌ন। দু হাজার বারো সালের জানুয়ারিতে আবার চূণীদা খবরে। তবে খবরটা কোলকাতার কোনও কাগজে ছাপেনি। শুধু উনি যে বাংলার স্পোর্টস কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেছেন, তাই ছেপেছিল। তবে সর্বভারতীয় কাগজগুলোর অন্তত একটায় খুব রসিয়ে লিখেছিল। খুড়ো বলল, শুনি তোর কেমন খবর ? আমি বললাম, না, থাক। চূণীদার বয়স এখন চুয়াত্তর চলছে। এই বয়সে, এই কারনে খবর হওয়াটা খুব একটা গর্ব করে বলার মত নয়। তবে খুড়ো মধ্যবিত্তের চরিত্রে যে গুলো দোষ বলে ধার্য্য হয়, সেলিব্রিটিদের সেটাই গুণ। শুধু চূণীদাকে খবর বানালে হবে, আমি তো গন্ডায় গন্ডায় অমন খবর জানি। তোলাই থাক না ওটা।

    আনন্দবাজার কাগজের ‘কলকাতার কড়চা’ খুললেই প্রতিসপ্তাহে কত ব্যক্তির ছবি দেখি, ‘নিঃশব্দে চলে গেলেন’, ‘আনন্দলোকের যাত্রী হলেন’, ইত্যাদি। তাঁদের জীবন বৃত্তান্ত শুনলে চমকে উঠতে হয়, কি বিশাল কর্মকান্ড, কি প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, কত লেখার সম্ভার, বিভিন্ন বিষয়ের দিকপাল একএকজন, কিন্তু ক’জন নাম শুনেছে তাঁদের?

    আমি কাগজ কলম নিয়ে বসলেই বাড়ির কিছু সদস্য ঝঁপিয়ে পড়ে, কি হবে এই সব ছাতা মাথা নাটক লিখে? এলি তেলি লোক টিভিতে রোজ ইন্টারভিউ দিচ্ছে, আর ইনি? লিখেই যাচ্ছেন, লিখেই যাচ্ছেন – বলেই একটা কাজ ধরিয়ে দেয়। খোলা কলমের কালি শুকোয়। যখন অভিনয় করতাম, তখনও দিনরাত গঞ্জনা। শুনতে পেতাম জানলা দিয়ে প্রতিবেশীর উদ্দেশে, এর কাছে তালিম নিয়ে অমুক এখন কত বড় স্টার, আর একে দেখ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ – যদি বিনীত ভাবে বলতে যাই, যা খাচ্ছি তা নিজেরই রোজগার, এবং তা বেশ ভালই, তবে আর রক্ষা নেই। তাই একদিন চূণীদা মেওয়াদার কথাটা পাড়লাম, এই তো তাদের হাল, নাম করে ক’দিন সে নাম ধ’রে রাখা যায়?

    তাদের কথা আলাদা, খেলোয়াড়রা খেলা ছাড়লে বাতিলের দলে। -তাই? আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? খেলোয়াড় তো নন, তাঁর নাম চিরস্থায়ী নিশ্চয়ই। খুড়ো, ঘটনাটা বাড়ির লোকেদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছি, তোমায় এবার বলি শোন।

    এখন তো সার্ধশত চলছে। খুড়ো অনেস্ট কনফেশন করি তোমার কাছে, ‘দেড়শো’ কে যে ‘সার্ধশত’ বলে, মাইরি বলছি, আগে জানতামনা। তা সেটা ছিল কবিগুরুর একশো পঁচিশতম জন্মজয়ন্তী। সেটা আবার কতশত বলে জান কিছু? যাকগে, সেদিন সন্ধে বেলা বোকাবাকসো চালু করেছি, এস হে বৈশাখ-, আলোকেরই ঝর্ণাধারায়-, এই সব গান টান চলছে, পুরো রাবীনদ্রিক পরিবেশ।

    হ্যাঁ, তখন ছিল সাদাকালো। হঠাৎ দেখি দূরদর্শনের এক প্রতিনিধি (এঁর কণ্ঠস্বর আমার খুব প্রিয় ছিল) বুম হাতে রবীন্দ্র অনুরাগী শিকারে বেরিয়েছেন। এই ধরণের প্রশ্নোত্তর-





    - আচ্ছা, আপনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছেন?
    - হ্যাঁ শুনেছি
     
    - তিনি কে ছিলেন, বা কী ছিলেন যদি একটু বলেন-
    - কবি। কবি ছিলেন

    - তাঁর একটা কবিতা, আবৃত্তি না করতে পারলে অন্ততঃ নামটা-
    - ওইতো,- ওইযে,- আঃ ইয়ে-

    (পরের লোক)

    - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছেন?
    - হ্যাঁ (বেশ জোরের সঙ্গে), শুনেছি।

    - তিনি কে ছিলেন বা কী ছিলেন?
    - সাধু ছিলেন।

    (কালীঘাটের এক ভিখিরি)

    - রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন?
    - (বোধহয় বুড়ি খিস্তি দিল, উত্তরটা সেন্সরড মনে হল)

     
    (ইত্যবসরে দু একজন ডেফিনিটলি সঠিক উত্তর দিয়েছেন কোনও প্রাইজ ছাড়াই। একজন কবিতা আবৃত্তি, আর এক ট্রামের কন্ডাক্টর চলন্ত ট্রামে দরাজ গলায় গানও শুনিয়েছেন)

    এবার বুম টা যেখানে এল, যায়গাটা বিলক্ষণ চেনা। যার সামনে এল, সে আমার একেবারে নেংটুবেলার বন্ধু, তবে নামটা লিখতে পারবনা, কেননা সে আর ইহলোকে নেই।
     

    - আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছেন?
    - বাঃ শুনবোনা?

    - উনি কী ছিলেন?
    - বড় ভাল লোক ছিলেন।

     খুড়ো, সত্যি বলছি, কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছিলাম ক’দিন। কারো প্রসঙ্গ উঠলেই বলতাম, বড় ভাল লোক ছিলেন। একদিন অফিসে লাঞ্চ আওয়ারে আড্ডা মারছি, এক ভদ্রলোক এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। ঘোষালদার টেবিলটা ফাঁকা, সেদিকে ইঙ্গিত করে উনি বললেন, আচ্ছা, মিস্টার ঘোষাল এখানে বসতেন না? আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি, হ্যাঁ, বড় ভাল লোক ছিলেন। ভদ্রলোক বিস্ফারিত চোখে অ্যাঁ – বলে প্রায় বসে পড়ছিলেন। ভাদুড়ি সামলে দিল, না না, লাঞ্চে গেছেন, এক্ষুনি আসবেন।

    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০
  • ধারাবাহিক | ২৬ জুন ২০১২ | ৯২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | ***:*** | ২৯ জুন ২০১২ ০৮:৩৫90072
  • দাদা,
    সঙ্গে আছি। এবারেরটা অন্যরকম লেগেছে।
  • কান্তি | ***:*** | ২৯ জুন ২০১২ ০৯:৩১90070
  • রূপঙ্কর বাবু, এই শুক্কুর বারের বারবেলায় আপনার ধানাইপানাই বিমল আমোদ দিল। জ্জিও গুরু। কান্তি।
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ২৯ জুন ২০১২ ০৯:৪৮90071
  • কান্তি মানে, আপনি কান্তিদা তো ? রূপঙ্করবাবু টাবু আর লিখবেননা। স্রেফ রূপঙ্কর। সঙ্গে থাকুন, পড়ে চলুন।
  • রূপঙ্কর সরকার | ***:*** | ৩০ জুন ২০১২ ০৪:১৯90073
  • রঞ্জনবাবু, ধানাই পানাইয়ের মজাই হ'ল, এটা উল্টো পাল্টা কমেন্টারি। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই, তবে অনেকখানি পড়ার ধৈর্য থাকলে, খানিক দূর গিয়ে একটা আন্ডারলাইং ফিলোজফি হয়তো খুঁকে পাবেন - 'হয়তো'
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন