ডকটর রমেশ
‘তানহান্না-নানা-নানা-নাআআআ –‘ কি খুড়ো, সুরটা চেনা চেনা লাগছে? অসাধারণ মিউজিক না? বলতো, সেই কতকাল আগে সাদাকালো টেলিভিশনে যখন ‘সোয়ামী’(স্বামী) বলে সিরিয়ালটা হত, একটা অসাধারণ ফীলিং হ’ত না? দারুণ ছিল গল্পগুলো। হবেনা? আর,কে,নারায়ণের লেখা, সঙ্গে তাঁর ভাই আর,কে,লক্সমণের কার্টুন। গল্পগুলো ‘মালগুডি ডে-স’ নাম দিয়েও চলত কিছুদিন। ওই মিউজিকটা কানে গেলেই কিরকম রোমাঞ্চ হত। তা আমরা নারায়ণ-লক্সমণের কথা তো ঘটা করে পড়তাম, যদিও পরে জেনেছিলাম, এর মধ্যে বেশ কয়েকটা, যেমন স্টীম রোলার লটারিতে পাওয়ার গল্পটা, বিদেশ থেকে টোকা, তাতে কি, টোকা মোকা যাই হোক কী অসাধারণ প্রেজেন্টেশন, বল খুড়ো – এর পরিচালকের নাম জানতে, তুমি?
পরিচালক ছিলেন শঙ্কর নাগ, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। দুর্ধর্ষ পরিচালক ছিলেন। আচ্ছা তুমি অনন্ত নাগের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই, আরে বাবা, শ্যাম বেনেগালের অধিকাংশ ছবিতে তাকে দেখা যেত মনে নেই? অত সুপুরুষ, মানে হ্যান্ডসাম চেহারা নিয়েও বেশিরভাগ ছবিতেই খল চরিত্রে দেখা যেত। সেই অনন্ত নাগের দাদা ছিলেন শঙ্কর।
আচ্ছা, হাল আমলের কথা বলি। অমিতাভ বচ্চন আটষট্টি বছর বয়সে প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চা ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করে সোরগোল তুললেন মনে আছে? ঐ যে গো, ‘পা’ ছবিতে। সেই ছবিতে ঠাকুমার ভূমিকায় কে ছিলেন জান? অরুন্ধতী নাগ। তিনি কুড়ি বছর আগে প্রয়াত শঙ্কর নাগের স্ত্রী। বাঙালিদের মধ্যে প্রতিভার অভাব নেই, বল -
এবার চল প্রিন্ট মিডিয়ায়। বিখ্যাত কলামনিস্ট রামচন্দ্র গুহ-র নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। ইকনমিক, পোলিটিকাল, সব রকম কলাম লেখেন, একটু প্রচ্ছন্ন বাম-সিমপ্যাথি আছে মনে হয়। হবেনা, ‘গুহ’ তো, একে বাঙালি তায় বাঙাল। গুহ তো পশ্চিম বাংলার পদবী নয়।
খুড়ো তোমার সঙ্গে একটু মজা করলাম। এই নাগ, গুহ, এরা কেউ বাঙালি নন। এরা সব কানারিজ। এঁরা কর্ণাটকের বাসিন্দা এবং কন্নড় এঁদের মাতৃভাষা। দক্ষিণ ভারতে এমন ‘বাঙালি’ কিন্তু মাঝে মাঝেই পাওয়া যায়।
আবার অন্য রকম বাঙালিও আছে। সৈয়দ মুজতবা আলি একবার ম্যাড্রাস (তখন এই নামই ছিল) শহরের পথ দিয়ে হাঁটছেন। এদিকে ক’দিন ধরে পেটটাও ঠিক যাচ্ছেনা। একজন ডাক্তার দেখালে হয়, এমন সময়ে দেখলেন এক ডাক্তারের চেম্বারের ওপরে লেখা- ডাঃ এস, সি, চট্টোপাধ্যায়। তিনি মহা উৎফুল্ল হয়ে ঢুকে পড়লেন। বললেন, যাক, এতদিন পর একজন বাংলায় কথা বলার লোক পাওয়া গেল। ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে বিনীত ভাবে বললেন, আপনি যদি ইংরিজিতে আপনার বক্তব্যটি বলেন তো আমার বুঝতে সুবিধে হয়। আলি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, সেকী! বিদেশে বাস করেন বলে নিজের মাতৃভাষাটাও ভুলে গেছেন? ডাক্তার হেসে বললেন, আপনি কি আমাকে বাঙালি ঠাউরেছেন নাকি? দাঁড়ান, একটু বিশদে বলি। আমার পুরো নাম শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সৈয়দ সাহেব বললেন, তবে? ডাক্তার বললেন দাঁড়ান, আমার ভাইয়ের নামটা তো শুনুন, তার নাম সুভাষ চন্দ্র বসু।
ডাক্তার বাবু ব্যাখ্যা করেছিলেন, আমরা বিখ্যাত লোকের নামে ছেলেমেয়েদের নাম রাখতে ভালবাসি। কিন্তু আপনাদের পদবী, উপাধি, এইসব নামের সঙ্গে আলাদা ক’রে আমরা বুঝতে পারিনা, তাই পুরো নামটাই রেখে দেয়া হয়।
আমি চাকরি থেকে অবসর নেবার বছর দুই আগে, একদিন অফিসে আমার ঘরের বাইরে এসে দেখি দু-জন অফিসার কম্পিউটারের স্ক্রীনে কি একটা দেখে খুব মজা পেয়েছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম, তাঁরা এক আধিকারিকের সই মেলাচ্ছেন। ব্যাঙ্কে অনেক বড় বড় সংখ্যার টাকা সামান্য একখন্ড কাগজের মাধ্যমে দেশে বিদেশে পাঠান হয়। সেই কাগজে থাকে এক বা একাধিক আধিকারিকের সই। সেটাও আবার বিশ্বের সব শাখায় কম্পিউটারে নথিবদ্ধ থাকে। তাই সেই সই মিলিয়েই প্রাপক শাখা টাকাটা ছাড়ে। জিজ্ঞেস করে জানলাম ওঁরা কেরালাতেও এক বাঙালি অফিসার খুঁজে পেয়েছেন।
সত্যিই মজার ব্যাপার। বঙ্গদেশে কেরালার অফিসার থাকাটা বিচিত্র নয়, তবে কেরালায় বাঙালি অফিসার থাকাটা সত্যিই কৌতুহলের। জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী তাঁর? তারা বলল, সুভাষ চন্দ্র বোস। সৈয়দ মুজতবা আলির লেখাটা আমার পড়া ছিল। স্ক্রীনের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম লেখা আছে- কে, কে, সুভাষচন্দ্রবোস। বললাম ভদ্রলোক বাঙালি নন। ওরা অবাক হতে বললাম, নামের প্রথমে দুটো ‘কে’ আছে দেখেছ তো? নামটা হয়তো কোজিকোড করুনাকরণ সুভাষচন্দ্রবোস কিংবা কোচি কুমারন ইত্যাদি।
আবার ফিরে আসি কর্ণাটকে। কর্ণাটক আমার খুব প্রিয় জায়গা। তাই বার বার ওখানে বেড়াতে যাই। আজব ব্যাপার হ’ল, চাকরি জীবনে অফিসের কাজ নিয়ে আমায় সারা ভারত ঘুরতে হ’ত কিন্তু আফশোষ, কর্ণাটকে একটাও জাঙ্কেট পাইনি। সে যাই হোক কর্ণাটকে আমি বহুবার গেছি। আবার ওখানে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল মহীশূর। বছর তিনেক আগে ছেলেকে নিয়ে মহীশূর গিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম। সেই ছবির মত শহরটাকে সিঙ্গাপুর বানাতে গিয়ে কী হাল করেছে। তার ছায়াসুনিবীড় বীথিগুলো এখন দেড়শো ফুট চওড়া মেটাল রোড। পথের ধারে বিশাল বিশাল বাগানওয়ালা টালির ছাদের সাহেব বাংলোগুলো এখন বীভৎস হাইরাইজ অথবা কদাকার রঙের শপিং মল। এই বুড়ো বয়সেও আমার কান্না পেয়ে গেল। এটাকে ‘প্রগতি’ ‘উন্নতি’ এইসব বলা হচ্ছে। এখনও যে কয়েকটা বাংলো টিকে ছিল, দেখলাম তাদের মধ্যে কিছু কিছু ভাঙা হচ্ছে। আরও উন্নতি চাই। যাক, বিতর্কে যেতে রাজি নই, বাঙালি নিয়ে কথা হচ্ছিল।
উনিশশো আশি সাল। ভজন সোম(নাম বদল) বলল, আপনিতো খুব বেড়িয়ে বেড়ান। একবার আমাকে নিয়ে চলুননা, আমি সঙ্গীর অভাবে যেতে পারিনা। বললাম দক্ষিণে চলুন। তবে বায়না করলে হবেনা, আমি যেখানে যেখানে নিয়ে যাব, সেখানেই যেতে হবে। কয়েক জায়গা ঘুরে সেই মাইসোর। আগরওয়াল লজে গিয়ে বললাম, দোতলার সামনের ঘরটার চাবি দিন। রিসেপশনের লোকটা বলল, ঘর খালি নেই। আমি বললাম, সেকি, আমি তো এখানে এলে আর কোথাও উঠিনা। আমাকে ঘর দিতেই হবে। লোকটা বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখিত সার, কিন্তু আমি নিরুপায়। আচ্ছা, কোনও প্রাইভেট বাড়িতে থাকতে আপত্তি আছে? আমি বললাম, আপত্তি কিসের, শুধু বাথরুমটা পরিষ্কার থাকলেই হ’ল।
রিসেপশনিস্ট একটা বাচ্চা ছেলেকে ডেকে কন্নড় ভাষায় কি যেন বলল, ছেলেটা ইঙ্গিতে তার পেছনে যেতে বলল। অলি গলি চলিরাম হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। ঢুকেই আমার মন ভাল হয়ে গেল। এটাও একটা বাংলো এবং রীতিমত বিরাট। বিশাল বাগান শুধু নয়, সবুজ মোলায়েম একটা লন, তাতে তিনটে টেনিস কোর্ট অনায়াসে ধরে যাবে।
আমাদের ঠাঁই অবশ্য সে বাড়িতে হলনা, লনের ওপারে এবাড়ির একদা সাহেব মালিকের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের একতলায়। ঘর ভালই, আসবাবপত্র ছিমছাম, মেঝেতে লিনোলিয়াম পাতা, ভাড়া পনের টাকা প্রতি রাতের জন্য। দোতলাতেও ঘর আছে, তাতে তখন অতিথি এক আমেরিকান ও এক জার্মান দম্পতি।
বাড়ির মালিকের নাম বাবুরাও। নাম শুনে মনে হ’ল, এঁরা অন্ধ্রপ্রদেশের লোক হতেও পারেন। তিনি আমাদেরই বয়সী, চাকরি করেন। অফিস থেকে ফিরে সন্ধেবেলা দেখা করতে এলেন। অত্যন্ত বিনীত এবং স্বল্পভাষী ভদ্রলোক। বললেন, “আপনাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে নাতো?” আমি বললাম, আরে! আপনি বাংলায় কি করে – ও, বুঝেছি। আপনার এই ‘গেস্ট হাউসে’ বাঙালি টুরিস্ট খুব আসে বোধ হয়? মিস্টার রাও বললেন, না, এখানে তো কেবল বিদেশীরাই আসেন। খুব চেনা গেস্ট হলে আগরওয়াল থেকে মাঝে মাঝে পাঠায়। তাদের মধ্যেও বাঙালি খুবই কম। আমি বললাম, তবে? তিনি বললেন, একবার কোলকাতায় গিয়ে মাস তিনেক ছিলাম। - খুব রিসেন্টলি? বাবুরাও ছোট্ট করে হাসলেন, তাও ছ’-সাত বছর হবে। আমি হাঁ হয়ে গেলাম, তিন মাসে শেখা বাংলা, তাও ছ-সাত বছর আগে?
আমি বাড়িটার প্রেমে পড়ে গেলাম, বিশেষতঃ সবুজ লন-টার। জীবনে প্রথম ওখানেই ছবির বইয়ের বাইরে জ্যান্ত একজোড়া মোহনচূড়া দেখলাম। চারপাশের গাছগুলোরই বা কি ঘন আর সবুজ পাতা। বাগানে ফুলেরও কমতি নেই। টালির ছাদ আর কাঠের থাম ওয়ালা বাংলোটাও পরিমন্ডলের সঙ্গে এমন খাপ খেয়ে গেছে, যে ওটা না থাকলেও ছবিটা অসম্পূর্ণ মনে হত। আমি সাত সকালে একটা চেয়ার টেনে লনের ধারে গিয়ে বসে পড়তাম। পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালী রোদ্দুর – গালচে-সবুজ লনে একজোড়া মোহনচূড়া, ফুলে ফুলে বোঁ বোঁ করা ভোমরা, -ঈশ্বর, স্বর্গের নন্দনকানন কি এর চেয়েও সুন্দর?
ভজন সোম ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকত, দূর মশাই, ঘরে বসে থাকার জন্য এলাম নাকি? আমি বলি, হাত পা কি বেঁধে রেখেছি নাকি? যান না একা একা, একটু স্মার্ট হোন। আমিতো কত একা একা ঘুরি। রুট-টুট এঁকে, বাসের নম্বরও বলে দিচ্ছি। যান মন্দির দেখুন গে। আমি এই স্বর্গ ছেড়ে নড়ছিনা।
লনের অপর পারে বাংলো। বাংলো যেমন হয়, সামনে কাঠের থাম দেয়া চওড়া বারান্দা, সেখান থেকে তিন থাক সিঁড়ি নেমে এসেছে মাটিতে। বারান্দায় কয়েকটা বেতের চেয়ার, মনে হয় আগেকার সাহেব মালিক এগুলো সমেত বাড়িটা বেচেছেন। লনটা বেশ বড় বলে অতদূর থেকে বাড়ির আর কোনও বাসিন্দাকে দেখা যেতনা। এঁরা খুব মৃদুভাষী বলে কথাও শোনা যেতনা কারো। শুধু একটি মেয়েকে মাঝে মাঝে দরজা খুলে বাগানের দিকে আসতে দেখতাম। মেয়েটি কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যুবতী। মাথায় দক্ষিণী ধাঁচে ফুল বাঁধা, পরনে ট্র্যাডিশনাল দক্ষিণী ঘাগরা চোলি।
আজ সন্ধেবেলা বেশ মনোরম হাওয়া দিয়েছে। ঘ্যানঘ্যানে ভজনকে বাধ্য হয়ে খানিক ঘুরিয়ে আনতে হল। অবশ্য ওর দিকটাও দেখতে হবে, আমি তো বহুবার মাইসোর এসেছি। যে নতুন এসেছে সে তো ঘুরবে বলেই এসেছে। চান টান করে পাজামা পাঞ্জাবী পরে লনের ধারে চেয়ার পেতে বসলাম। সন্ধে হয়ে আসছে, মোটামুটি এই সময়ে বাবুরাও এসে যান রোজ, আর রোজই অসুবিধে হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করেন।
আমি বাংলোটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম মেয়েটি বারান্দা থেকে লনে নামল। সোজা এইদিকেই আসছে। আজ কিন্তু দক্ষিণী পোষাক ছেড়ে শাড়ি পরেছে। ছিপছিপে চেহারা, গায়ের রঙ শ্যামলা , সামান্য লম্বাটে মুখের গঠন, টানা টানা চোখ দুটোয় ডুব দেবার মত গভীরতা। তার হাঁটায় এক অদ্ভুত ছন্দ, মনে হচ্ছে লনের একটা ঘাসেরও সামান্যতম আঘাত লাগছেনা। আমার বুকের মধ্যে কেমন কেমন করছে কেন? প্রেমে পড়ছি নাকি? মেয়েটির সঙ্গে আমার ভাষা, কৃষ্টি, বয়স, সব কিছুরই অনেক তফাত।
ভজনও হয়তো মেয়েটিকে দেখেছে কিন্তু তার ওপর নারীজাতির প্রভাব বিন্দুমাত্র নেই। ভজন রাম কিপ্টে, এই বয়সেই দোতলা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। পরিচিত লোকেদের কাছে ভজন সোম বিরাট খোরাক। এক অবাঙালি ভদ্রলোক হলদে রঙের ফল দেখিয়ে এটা কী জিজ্ঞেস করায় ভজন বলেছিল ‘ম্যাচিওর গোয়াভা’ সেই থেকে ছেলেরা ওকে দেখলেই বলত, ‘ম্যাচে গোয়েভারা’ (অবশ্য প্রখ্যাত বিপ্লবী মানুষটির নামের উচ্চারণ ‘গেভারা’)।
একদিন মিনিবাসে একজনের পকেট মারা গেছে। তিনি চ্যাঁচামেচি করতেই ভজন পকেট থেকে অনেকগুলো একশ টাকার নোট বের করে গুনতে আরম্ভ করল। তখন আসল পকেটমারই বলল, এইযে, এই তো পকেটমার। ভজন বেধড়ক মারও খেল, টাকা কটাও গেল। সে সময়ে কেব্ল ছিলনা, ভজন টিভি কেনার সঙ্গে সঙ্গে বড়বাজার থেকে বিশাল ত্রিপল কিনে আনল, যাতে বৃষ্টি প’ড়ে অ্যান্টেনার ক্ষতি না হয়। ভজনের গল্প করতে বসলে আর কিছু বলা যাবেনা, দিন কাবার। আমি আর ভজন, দুজনেই সিংগল। আমার বিয়ে হতেও পারে কোনওদিন কিন্তু ভজন বিয়ের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে, হাল আমলে রাজ্য সরকারের টিভির বিজ্ঞাপনে সুনীল মুখার্জীর মতো বলে, অনেক খচ্চাঃ।
মেয়েটি ঘাসের ওপর দিয়ে ভেসে এল। আমার থেকে হাত তিনেক তফাতে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করল, কাঁচের চুড়ি বাজল টিং লিং। বলল, নমষ্কার, গলার সুর বাজল, টিং লিং। তারপর যা বলল, আমি প্রস্তুত ছিলামনা। মেয়েটি বলল, “দাদা অফিসের কাজে একটু বাইরে গেছেন। আমাকে বলে গেছেন আপনাদের খবর নিতে।“ টিংলিংটিংলিংটিংলিং—আমি বললাম, আপনিও? মানে আপনিও কোলকাতায় গিয়ে তিনমাসে বাংলা শিখেছেন? মেয়েটি লজ্জায় মুখ নীচু করেছে, শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, আমি কোলকাতা যাইনি। দাদার কাছে শিখেছি। আমি বললাম, এত ভাষা থাকতে বাংলা শিখলেন কেন? জবাবটা খুব আস্তে এল, আমার ভাল লাগে। আমি দৃষ্টি সরাতে পারছিনা, প্রেমে পড়ছি নাকি বলে সন্দেহ প্রকাশ করছিলাম, সে সন্দেহ এখন আর নেই। ঈশ্বর, রক্ষা কর। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা......মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য...সে বলল, আমি যাই? কোনও প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন। আমি বললাম, কী বলে ডাকব? সে বলল, আমি লতা। শুধু লতা? বনলতা নয়? ......আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন......আমাকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের – ঈশ্বরকে মন দিয়ে ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে ফল হয়। ভজন পেছন থেকে এসে বলল, আমার পাইখানা পেয়েছে।
কমলাকান্ত বলল, আচ্ছা, তোর লেখাপত্তরেও দেখছি, কথাবার্তাতেও শুনি, তুই খুব অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সের ভক্ত, নারে? আমি বললাম খুড়ো, মানুষের জীবনের ছাপটাইতো তার লেখায় পড়ে। যাকগে আসল গল্পটাই তো বলা হয়নি, সেটা শুনবেতো? চক্কোত্তি মশাই বললেন, হ্যাঁ, সেই কর্ণাটকের বাঙালি নিয়ে- তা সেতো বলেই দিলি। বাবুরাও আর লতার গল্প। আমি বললাম, জান খুড়ো, আমাদের তো বয়স গেছে। ইন ফ্যাক্ট আমি এখন তোমার চেয়েও বয়স্ক, খুড়ো বলে ডাকতাম তাই- তিনি বললেন, সে আবার কী! আমি বললাম, ঐ দেখ শিবানী বৌদি। যখন ফ্রক পরতেন, বেড়া বিনুনি বাঁধতেন, তখনও মা দুগগা কে যেমন দেখেছেন, আজ খুনখুনে বৃদ্ধা, কুঁজো হয়ে গেছেন, চলতে পারেননা, কিন্তু মা দুগগা এখনও তেমনি। ঠিক সেরকম, তোমায় যখন খুড়ো বলা শুরু করেছি, তার পর থেকে গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়াল বল?
হ্যাঁ যা বলছিলাম, যখন ভাববে সব শেষ হয়ে গেছে, আবার দেখবে মাটি ফুঁড়ে নতুন গাছ বেরোচ্ছে। কর্ণাটকের বাঙালির গল্প এখনও বাকি। একদিন ভজনের সঙ্গে সাধারণ বাসে চেপে শ্রীরঙ্গপত্তনমের পেছন দিয়ে যাচ্ছি। সে জায়গাটার এখন ‘উন্নতি’র ফলে এত পরিবর্তন হয়েছে, যে চেনাই যাবেনা। সেই রাস্তাটাই বোধহয় আর নেই। রাস্তার ধারে নয়ানজুলি, তার ওপার থেকে দূর্গের পাঁচিল উঠে গেছে। পাঁচিলের গা ঘেঁষে ঘন সবুজ ঝোপ, তাতে নানা বুনো ফুলের সমারোহ আর প্রজাপতিদের ভিড়। খুড়ো তুমি বুঝবেনা কেন ওদিকে এখন গেলে বুকের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে হাহাকার জেগে ওঠে।
টুরিস্টরা সাধারণতঃ লাক্সারি বাসে ওঠে, আমরা উঠেছি সাধারণ বাসে। সে বাসে গ্রাম্য চেহারার গরীবগুর্বো মানুষও অনেক। দেখলাম বেশ কিছু সাদা পাগড়ি পরা লোক। আমি ভজনকে জ্ঞান দেয়া শুরু করলাম। বললাম, বাইরে এসে শুধু মন্দির আর পাহাড় দেখলে হবে? স্থানীয় লোকজন, তাদের সংস্কৃতি বেশভূষা সবই দেখতে হবে, জানতে হবে। এই যে দেখছেন সাদা পাগড়ি, আসলে এক সময়ে সারা ভারতে সব প্রদেশের লোকই শিরাচ্ছাদন ব্যবহার করত। আমাদের বাংলাতেও ঘ্যামা লোকেরা শামলা মাথায় দিতেন। খুড়ো, তোমার ধম্মোবাপ বঙ্কিমও দিতেন। ভজনকে বললাম, আর গরীব চাষাভুষোরা মাথায় দিত ‘টোকা’,যেটা এখন ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডে গেলে দেখা যায়। তেমনি সারা ভারতে সবাই কিছু না কিছু মাথায় দিত। সব রীতি রেওয়াজ উঠে গিয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বেঁচে ছিল শিখ আর মাড়োয়ারিদের পাগড়ি। এখন আছে শুধু শিখদের।
আমি বললাম, তবে এইসব প্রাচীন এলাকায় এলে, সাবেকি গ্রাম্য লোকেদের কিছু অভ্যাস এখনও টিকে থাকতে দেখা যায়। দক্ষিণীরাও পাগড়ি পরত এককালে। ডাঃ সর্বোপল্লী রাধাকৃষ্ণনের কথা মনে নেই? তবে এদের পাগড়ির রঙ সব সময়েই সাদা। আমি কেবল তামিল আর কন্নড় পাগড়ির তফাতটা ধরতে পারিনা, মনে হয় প্যাঁচ মারার টেকনিকটা আলাদা। আমার সামনের সীটের ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, দাদা, যা বলছেন, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়।
আমি বললাম, যাব্বাবা, এখানেও বাঙালি? বিদেশে বাঙালি পেলে যা হয়, তুমুল আড্ডা শুরু হয়ে গেল। ভদ্রলোক বললেন, দাদারা আছেন কতদিন? বললাম তা আরও পাঁচ সাত দিন তো বটেই। উনি বললেন তাহলে একদিন বাড়িতে চলে আসুন। বাসে কি আড্ডা হয়? এই শ্রীরঙ্গপত্তনম ফোর্টের মধ্যেই আমার বাড়ি। এই কার্ডটা রাখুন, যাকে বলবেন, দেখিয়ে দেবে।
কার্ডটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলাম। লেখা আছে ডক্টর রমেশ। বললাম, বাবা, আপনি আবার ডাক্তার? তা আপনার পদবীটা তো লেখেননি, শুধু নাম- ডাক্তার হেসে বললেন, ওটাই নাম, ওটাই পদবী। আমি বললাম, যাঃ, তা আবার হয় নাকি? উনি বললেন, এখানে হয়। আমি বাঙালি না, কন্নড়ভাষী। আমার মুখের হাঁ বন্ধ হচ্ছেনা। বলেন কি মশাই, এত পারফেক্ট উচ্চারণ, অ্যাকসেন্ট ফ্যাকসেন্ট সব ঠিকঠাক, অবাঙালি বাঙলা বলছে বোঝার কোনও উপায় নেই? ও, বুঝেছি। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেছেন। দীর্ঘদিন হস্টেলে থাকতে থাকতে – রমেশ থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি জীবনে একবারই কোলকাতা গেছি, তিনদিনের জন্য দূর্গাপূজো দেখতে। আমি চোখ ছানাবড়া করে বললাম, তবে? খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে ডাক্তার বললেন, আসলে বৌ বাঙালি। সে পরিষ্কার বলে দিয়েছে আমি কন্নড় শিখবনা। তুমি বাংলা শিখলে শেখ, না হলে ইংরিজিতে কথাবার্তা চলবে। বলুন দাদা, বিদেশী ভাষায় দাম্পত্য চলে? আমার স্টপ এসে গেল। একদিন আসবেন কিন্তু-
পরের দিন আবার বসেছি সেই চেয়ারে, সেই জায়গায়। ঈশ্বরকে বলে নিস্তার পেয়েছি, কিন্তু মনের ওপর কোনও কন্ট্রোল নেই। আজওতো আসবে, এক্ষুণি। ভাগ্য ভাল ভজন ব্যাটা ধারে কাছে নেই, কলা কিনতে বেরিয়েছে। ......আবার আসিবে ফিরে, ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে......নদী নেই তো কী, লন তো আছে......পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে মাইসোরের বনলতা...শুধুলতা......আমেজে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম। চোখ খুললেই যাতে- ‘কোনও অসুবিধে হচ্ছে নাতো?’ কানে এল, কিন্তু-টিংলিংটিংলিং বাজল নাতো। চোখ খুললাম। হাত জোড় করে সামনে মিস্টার বাবুরাও। পাটভাঙা কড়া ইস্তিরির জামাকাপড়, মুখে হাল্কা হাসি। নমষ্কার ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, আপনি না বাইরে গেছেন? রাও বললেন, আর বলবেন না, আমি বাইরে গেলে আবার এখানে অচল, তাই তড়িঘড়ি ডেকে পাঠাল।
কমলাকান্ত চক্রবর্তী ‘ফোঁস’ করিয়া এক অতিদীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করিল।
(চলবে)