নগ্-নো
তখন বছর পনের বয়স। আমি এক নগ্ন মহিলাকে ভালবেসে ফেললাম।
ঝপ্ করে কাঁচাপাচা চুলওয়ালা আধময়লা ধুতি পরা একটা লোক লাফ দিয়ে পড়ল। অ্যাঃ, এইবার পাওয়া গেছে, একেবারে অ্যাডাল্ট লিটারেচার। আমি বললাম, খুড়ো, গল্পটা ‘অ্যাডাল্ট’ রেটেড কিনা জানিনা, তবে অ্যাডাল্টারেটেড একদমই নয়। খুড়ো বলল, বুঝিচি, শিব্রাম সিনড্রোম।
শব্দটা প্রথম যখন শিখি, তখনই ভেতর থেকে ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে দিল, এটা নিয়ে বাড়িতে বড়দের সঙ্গে ডিসকাস করা যাবেনা। পাড়ায় এক বেঁড়েপাকা দাদাকে ধরলাম, ‘নগ্ন’ মানে কি ? সে বলল নগ মানে কি ? পাহাড়। তাহলে নগ-নো মানে কি, যা পাহাড় নয়, তাইতো ? তবে যদি নগ্ন কাউকে দেখিস, বিশেষ করে কোনও মহিলা , তাহলে দেখবি পাহাড় পর্বতের দিকেই নজর যাচ্ছে বেশি। কিছুই বুঝলাম না।
তবে এটুকু বুঝলাম, আমাকে নিয়ে একটু মজা করা হল। পাড়ার এক মাস্টারমশাইকে রাস্তায় ধরলাম। তিনি আমাদের ইস্কুলের নন, তাই সেফলি জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। মাস্টারমশাই বাজার যাচ্ছিলেন, পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, স্যার নগ মানে পাহাড়? তিনি বললেন, অমন উচ্চারণ নয়, গ-এর পর হসন্ত নেই। উচ্চারণ, ‘নগঅ’। এর মানে পাহাড় হতে পারে, প্রাচীন বৃক্ষ হতে পারে, বা চলাফেরা করেনা, এমন কিছুও হতে পারে। চারদিকে তাকিয়ে দুম করে বলে বসলাম, স্যার, নগ্ন মানে কি? তিনি বললেন, প্রথম মানে, বিবস্ত্র, যার গায়ে জামাকাপড় নেই। দ্বিতীয় মানে নির্লজ্জ। সন্ধি ভাঙলে পাচ্ছি, ‘নজ’ প্লাস ‘ক্ত’, অর্থাৎ লজ্জা ত্যাগ করেছে যে। ক্লীয়ার ? উনি বাজারে যাওয়ার কদম বাড়ালেন, আমি ফিরে এলাম।
বেশ ক’বছর পরের কথা, তখন উঁচু ক্লাসে পড়ি। সে বছর ইস্কুলের কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে মুর্শিদাবাদ গেছিলাম। দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো দেখা ছাড়াও এদিক ওদিক ঘুরছি। শুনলাম বেশ ক’দিন থাকা হবে। আমাদের ইস্কুলের এক মাস্টারমশাই, কিশোরীবাবু ওখানকার স্থানীয়। তখন যেমন আমাদের ছুটি, এখানেও ছুটি। তাই এখানকার এক ইস্কুলের একটা ঘর খুলে দেয়া হয়েছে আমাদের থাকার জন্য। হোটেল টোটেলে উঠতে হয়নি।
দিনের বেলা যত ঘোরাঘুরি, রাত্রে করার কিছু নেই। ওই ইস্কুল বাড়িটায় বেজায় মশা। ইলেক্ট্রিসিটি হয় ছিলনা কিংবা ছুটির কারণে বন্ধ করে রাখা ছিল, অত মনে নেই, কোলকাতা থেকে আসা কতকগুলো বাউন্ডুলের জন্য তো আর ইস্কুল বিদ্যুতের বিল মেটাবেনা। গোটা দুয়েক লন্ঠন পাওয়া গেছিল, বাথরুম যাবার পথে সাপখোপের ঘাড়ে পা না পড়ে। রাত্তিরে আলো কমিয়ে ঘরের কোনে রাখা থাকত।
কাঁচা বয়সের ছেলেপিলে, অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে কার আর ভাল লাগে। লন্ঠনের আলো বাড়িয়ে তাস টাস খেলা যেতে পারত কিন্তু সেটাও খুব একটা আকর্ষণীয় প্রস্তাব নয়। প্রথম দিনটা অবশ্য সেই করেই কাটল, পরের দিনই আমরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যদিও কিশোরীবাবু বার বার বারণ করেছিলেন সূর্যাস্তের পর ইদিক উদিক যেতে, যায়গা নাকি ভাল নয়। তা সেসব শোনে কে, বড়দের কাছে নিজের ঘরের বাইরে কোনও জায়গাই ভাল নয়। আজকাল খবরের কাগজ পড়ে অবশ্য ভাবি, ভাগ্যিস সাড়ে ছয় দশক আগে জন্মেছিলাম।
গোটা তিনেক দল হয়েছিল। আমি যে দলে ঢুকলাম, তাতে দুই পালোয়ান, একজনের নাম আর অন্যজনের পদবী আমার নামের খুব কাছাকাছি। তারা সকালে উঠেই দুশোটা করে ডন এবং শ’পাঁচেক বৈঠ্কি দেয়। আমিও একটু আধটু সামলানোর খ্যামতা রাখি। তখন অস্ত্রশস্ত্রের খুব একটা চল ছিলনা, তাই এই দলে থাকলে জায়গা যতই খারাপ হোক, ভয়ডরের গল্প নেই। বাকি দুটো দলের খবর জানিনা, তবে আমাদের যাবার একটা জায়গা হল।
একজন এসে খবর দিল, অ্যাই, বাঁদিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে নবাববাড়ি যাওয়ার একটা গোপন পথ আছে, যাবি ? গঙ্গার ঘাটে বসলে হেবি লাগবে। চ, তাহলে যাওয়া যাক, শুভকাজে দেরী কেন? ঝোপের মাঝে একটু গুঁড়ি মেরে গেলেই খোলা জায়গা, গাছপালা কম। সামনেই ঘাট, জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে আসছে। ঘাটের সিঁড়িতে বসে চটি খুলে জোয়ারের সময়ে জলে পাও ডোবানো যাবে, দারুণ ব্যাপার।
পেছনে তখন সবে চাঁদ উঠছে, থালার মত বড় পূর্ণিমার হলদে চাঁদ। কিন্তু সেটা তখনও এত নীচে, যে জলে তার টুকরো টুকরো আলো পড়বার সময় হয়নি। কোনদিকে তাকাই, সামনে জোয়ারের গঙ্গা, সিঁড়িতে ঢেউ ভাঙছে। পেছনে আকাশ আলো করা পূর্ণিমার চাঁদ, সঙ্গে যুঁই গাছের বিশাল ঝাড় থেকে মন মজিয়ে দেয়া সুবাস। আমাদের তখন ঠিক রোমান্টিক হবার, বা কবিতা লেখার বয়স হয়নি, তবে ভীষণ ভাল যে লাগছে, তা সবাই বুঝছি।
হঠাৎ একটা জিনিষে চোখ গেল। আমাদের ঠিক পেছনে একটা থাম, অনেকটা উঁচু আর তার মাথায় একটা ডানা মেলা ঈগল পাখির মূর্তি। চাঁদ তখন ঠিক সেই ঈগলের পেছনে। জলে তার ছায়া এসে পড়েছে। এমন মাপেই ওটা বানানো, যে থামটার ছায়া সিঁড়িতেই থেমে যাবে, জলে শুধু ঈগল, ডানা মেলা। অনেকটা দূরে ছায়া পড়ছে বলে সে তখন অতিকায় এক পাখি, ঢেউয়ের দোলায় তার পাখা ঝাপটাচ্ছে, রোমহর্ষক ব্যাপার।
এক পালোয়ান বলল, রূপঙ্কর, তুই তো অনেক গল্প জানিস, আজ যা পরিবেশ, একটা ভাল দেখে ভূতের গল্প নামা তো। সঙ্গে সঙ্গে একজন আমার কাঁধ খামচে ধরল। তার হাতে বড় বড় নখ। আর এক হাতে মুখও চেপে ধরল, না, না, বলবিনা, একদম বলবিনা। আমার কাঁধে তার নখ বিঁধে যাচ্ছিল, মুখেও। সে আমারই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আমার পরের ক্লাসে পড়ত। তার এত ভয়, যে রাত্রে বাথরুম যেতে দুপাশে দুজন লাগবে, একজনেও হবেনা। না গেলে কেঁদে কেটে এমন করবে, পুরো ট্যুর মাটি। একজন আমার কানে কানে বলল, শালাকে সঙ্গে আনাই ভুল হয়েছে, ওদিকে একা রেখে আসাও তো যেতনা।
কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর একজন বলল, গল্প যখন হবেনা, তখন গান টান হোকনা, কেউ গান টান জানিস? আমি ছেলেবেলা থেকেই অবাক হওয়া ব্যাপারটা শিকেয় তুলে রেখেছি। পৃথিবীতে কোনও ব্যাপারেই অবাক হতে নেই, তা পদে পদে দেখেছি, শিখেছি। একজন, যে অতি গুন্ডা প্রকৃতির, মুখে অনায়াসে উচ্চারণযোগ্য নয়, এমন ভাষা, হাবে ভাবে, চেহারায়, প্রকৃতিতে, মার্জিত রুচির কোনও ছাপ নেই, রবীন্দ্রনাথের নামোচ্চারণও যার কাছে প্রত্যাশিত নয়, হঠাৎ তার উদাত্ত কন্ঠে শুনলাম, - নদী আপন বেগে পাগল পারা, আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু, গন্ধভরে – না, ‘অতিথি’ সিনেমাটা তার বহুকাল পরে রিলীজ করেছে, পার্থ মোটামুটি তখনও জন্মায়নি বলে অনুমান, সিনেমার গান শুনে শিখেছে, তা কোনও মতেই বলা যাবেনা।
‘আমার চলা, যায়না বলা, আলোর পানে প্রাণের চলা’ – নদীর ধারে নদীর গান। ছলাৎ ছলাৎ করে তালযন্ত্রের বোল দিচ্ছে নদী। একটা মানুষকে নতুন করে চিনলাম। সে গুন্ডা তা ঠিক, পরে বড় হয়ে শুনেছি বেশ কয়েকটা বিয়েও করে ফেলেছে, তা করুকগে। আমরা নিজেদের বাড়িতে উঠে আসার পর একদিন বলে গেল, শোন, নতুন জায়গায় এসেছিস, কোনও (অমুদ্রণযোগ্য) যদি কিছু বলে, আমায় খবর দিবি। আমি বললাম, তোকে পাব কোথায়, ঠিকানা ফিকানা – সে বলল, লাগবেনা। বালীগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে চেঁচিয়ে বলবি, আমি অমুককে খুঁজছি। অরণ্যদেবের গল্পে যেমনি থাকে আরকি। আমি খবর পেয়ে যাব। আমার অবশ্য তেমন প্রয়োজন হয়নি, কিন্তু কৃষ্টিবান, মার্জিত কেউ কিন্তু বাড়ি বয়ে এসে এমন অফার দেয়নি আমায়। এই মাত্র কিছুদিন আগে একটা লরির মাথায় অনেক ভারী ভারী মালা পরে অনেক মোসাহেব পরিবৃত হয়ে বড় রাস্তা দিয়ে হাসিমুখে হাত জোড় করে গেল। ভোটে দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে চাইল একবার, চিনতে পারেনি বোধহয়।
যাক, সেই গান চলাকালীন আমি একবার উঠলাম। তখন অন্য কেউ গান ধরেছে। আমি নবাববাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি নবাববাড়িটাকে তখন ভুতুড়ে লাগছে। সেই সময়ে তাঁকে দেখলাম, সেই নগ্ন মহিলাকে। তাঁকে আমি দিনের বেলাতেও দেখেছি, আমরা সবাই দেখেছি, কিন্তু চাঁদের আলো গায়ে পড়লে কোথায় যে কি হয়ে যায় –
নবাববাড়ির সামনে গঙ্গার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, বাঁ দিকে একটা বাগান মত। সেসময়ে খুব একটা যত্ন আত্তি পেতনা, গাছপালাগুলো আপন খেয়ালে বাড়ছিল। বাগানটা লম্বাটে, অনেকটা জায়গা নিয়ে। মাঝখানে একটা গম্বুজওয়ালা গোল ঘর আছে, বিশ্রামকক্ষ ধরণের। আর আছে শ্বেতপাথরের এই মূর্তি। এ মূর্তি আগেও দেখেছি, যেদিন সবাই মিলে নবাববাড়ি দেখতে এসেছিলাম। তখন দিনের বেলা, চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি, মূর্তিও দেখলাম। বিশেষ কিছুই নয়, এমন মূর্তি ঢের দেখেছি। তখন তেমন কিছু মনেও হয়নি।
তখন কোলকাতাতেই বহু বাড়িতে শ্বেত পাথরের মূর্তি ছিল আর প্রায় সব মূর্তিই ইউরোপীয়ান শিল্পীদের বানানো। সেই সব মূর্তির সিংহভাগই হল স্খলিতবসনা সুন্দরীদের অথবা নগ্ন নারীর। উত্তর কোলকাতায় মার্বল প্যালেসে কোনওদিন ঢুকিনি, তবে আমাদের দক্ষিণেই সিংহী ম্যানসন এবং সিংহী প্যালেস, দুটোতেই সামনের বাগানে প্রচূর এই ধরণের মূর্তি ছিল। আর সেই সব মূর্তির মধ্যে এই বিশেষ ভঙ্গিটি প্রায় সব জায়গাতেই থাকত, এক নারীর অঙ্গের বসন খসে পড়েছে, আর তিনি নীচু হয়ে তা তোলবার চেষ্টা করছেন। এই বিশেষ রূপটি বোধহয় সব শিল্পীই একবার না একবার বানিয়েছেন।
এমন মূর্তি ঢের দেখেছি, যদিও সবে কাঁচা থেকে বেড়ে ওঠবার বয়স, এই সব মূর্তি মনের ওপর বিশেষ কোনও ছাপ ফেলতনা, একবার দেখবার পর দুবার ঘুরে তাকাতেও ইচ্ছে করতনা। কিন্তু ইনি কী যাদু করলেন ? আমি হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সামনে চলে এসেছিলাম,বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। শ্বেত পাথরের ওপর চাঁদের আলো। সে আলো পিছলে পড়ছে। ছায়া আর আলোর মধ্যে এমন বন্ধুত্ব আমি আগে দেখিনি, আলো সরতে সরতে কখন ছায়ায় চলে আসছে, তা বোঝবার যো নেই, শিল্পীর ছেনি এতই মোলায়েম।
নেশায় পেয়ে গেল। পরের দিন সকালে একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করেও কখন সূর্য ডুববে, সেই অপেক্ষা। ছেলেগুলোকে বলি আবার যাবি নাকি, যায় তো ভাল, না হলে একাই যাব। চাঁদ আজও ঝলমলে। ওরাও রাজি, অবশ্য মূর্তির টানে নয়, এর কথা কেউ জানেনা। যে মুখ খামচে ধরেছিল, তাকে অন্যদলে ভিড়িয়ে দেয়া হল। আজ নিশ্চিন্ত। একটু রাত করেই যাওয়া হল।
আমাদের গোপন পথ দিয়ে জঙ্গল ভেদ করে খানিক যেতেই একজন হাত চেপে ধরল, অ্যাই দাঁড়া, কি ব্যাপার ? চাঁদের আলোতে কালো কালো অনেক ছায়ামূর্তি, জনা কুড়ি পঁচিশ তো হবেই। এত রাতে এরকম যায়গায় এত লোক? আমরা পালাব কিনা ভাবছি, এমন সময় শুনলাম, চাপা গলায় কেউ বলল, এসে গেছে, এসে গেছে – বস বস সবাই।
যেখানে ভীড়টা জড়ো হয়েছিল, সেখানে একটা অতিকায় ঢাকনাওয়ালা কূয়োর মত একটা নীচু বাঁধানো জায়গা। অনেকে তার ওপরে বসে পড়ল। যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা একটু তফাতে সরে গেল। একজন রোগামতন লোককে আসতে দেখা গেল, সঙ্গে তবলা ও হারমোনিয়াম নিয়ে আরো ক’জন। কিরে বাবা, গান বাজনা হবে নাকি ? এই আঘাটায় রাত দুপুরে গান ?
যে রোগা মতন ভদ্রলোক মধ্যমণি, তাঁর নাম হ্রস্ব-ই দিয়ে শুরু। ইয়াসিন হতে পারে, ইলিয়াস হতে পারে, ইসমাইল হতে পারে, আমি ইসমাইল-টাই নিচ্ছি, এতদিন পরে সঠিক নামটা মনে নেই। তিনি গান টান ধরেননি, হারমোনিয়ামে ধুন বাজাচ্ছিলেন। সে যে কি অপূর্ব সুরের খেলা, আমি জীবনে ভুলতে পারবনা। হারমোনিয়ামে রাগ রাগিনী বাজাতে আমি একমাত্র ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়কে শুনেছি। তবে এখানে থাকলে তিনিও হাততালি দিতেন।
ইসমাইলদা গৌড় সারঙ দিয়ে শুরু করে এবার ভূপালি ধরেছেন। তবলায় যে সঙ্গত করছে, সেও দারুণ। আমি একটু বেশি বয়স পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের তফাৎ বুঝতামনা, বাড়িতে জাতধম্মো নিয়ে আলোচনা বারণ ছিল। ইসমাইল নামটা অমল, বিমল, কমল এবং ইন্দ্রজিৎ নয়, একটু আনকমন, এই মাত্র। বড় হয়ে জেনেছি, মুসলমানদের অগ্রজকে ‘ভাই’ বলতে হয় আর অনুজকে ‘ভাইয়া’।
এখানে কিন্তু সবাই ইসমাইলদা-ই বলছিল।
কেউ একজন বলল, ইসমাইলদা, একটু দরবারী কানাড়া হয়ে যাক। তিনি বললেন, ওটা বাজাবার মত রাত তো এখনো হয়নি, যাক বলছ যখন – আমি আস্তে আস্তে ওখান থেকে উঠে পড়লাম। খসে যাওয়া বস্ত্র টেনে তুলতে গিয়ে থমকে আছে কেউ চাঁদনি মায়ায়। দরবারী কানাড়া দুঃখের রাগ, মন খারাপ করা সুর হাওয়ায় ভাসছে, চাঁদের আলো নয়, তার ছায়ার সঙ্গে মিশে এক ব্যঞ্জনা তৈরী করেছে। শঙ্খমর্মরের বিবসনার সামনে দাঁড়িয়ে একা, চারপাশে কেউ নেই, কিছু নেই, জগৎ নেই, আছে চাঁদের আলোয় লুকিয়ে থাকা ছায়া আর দরবারী কানাড়ার বিলাপ। ও মেয়ে, কাঁদ কেন তুমি ? কি দুঃখ আমায় বল ? কে যে টেনে আনল আমায় সেদিন, তা আর মনে নেই। আস্তানায় ফিরেও ঘোর কাটেনি। এক পালোয়ান জিজ্ঞেস করল, ওখানে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে কি বকছিলি রে?
পরদিন আবার। আজ ওরা অন্যদিকে গেছে। আমি একা, একা ঠিক নই, ইসমাইলদা আছেন, আছে তাঁর ভক্ত ও গুণমুগ্ধরা। আজ উনি ধরেছেন মালকোষ, দক্ষিণ ভারতে বলে, ‘হিন্দোলম’। আজ দুঃখ নেই, আনন্দধারা বহিছে ভূবনে...দিন রজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে...আজ আমার বন্ধুর চোখে কান্না নেই, মুখে এক অদ্ভুত হাসি। রাত বাড়ে, চাঁদের অবস্থান বদলায়, আলো, ছায়া, সব বদলায়, বদলায় ছায়াঘন জ্যোৎস্নায় শ্বেতপরীর মুখমন্ডল।
উনিশশো বিরাশি সালের শেষভাগ। নোটন বলল, মুর্শিদাবাদ যাবেন ? আমার পিসশাশুড়ির বাড়ি। চলুননা খুব মজা হবে। গিয়ে অবধি তর সয়না, কখন যাব সেখানে। এখন অবশ্য দিনের আলো, গনগনে সূর্য। সে পরী আবার আলোয় কথা বলেনা। তায় আবার সঙ্গে বৌ রয়েছে, অভিমান না করে। খানিক যেতেই ধাক্কা খেলাম। সেই সুন্দর গোল গম্বুজওয়ালা বসার ঘরটার মেঝে থেকে মার্বলগুলো উপড়ে নিয়ে গেছে কেউ। কাস্ট আয়রনের বাহারি রেলিংগুলোও নেই। সেই জুঁইয়ের ঝাড় এখন ইতিহাস। একজন স্থানীয় লোককে পেলাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ চাতালটায় রাত্রে এখনও গানবাজনা হয় ? সে আকাশ থেকে পড়ল, গান বাজনা ? সন্ধে হলেই সেখানে সেয়ানাদের ভীড়, ওদিকে মানুষ যায় লাকি ? ‘সেয়ানা’ শব্দটার স্থানীয় অর্থ গুন্ডা এবং ছিনতাইবাজ।
সেও তাহলে নেই ? দূর থেকে সাদামতো কি একটা দেখা যাচ্ছেনা ? ওঃ আছে তাহলে, ওই তো, যাক কতদিন পর দেখা। এক দৌড়ে কাছে গিয়ে চোখ তেতো, মুখ তেতো, সারা শরীর তেতো হয়ে গেল। তার সেই পেলব উরু, যা এক সেন্টিমিটার বেশি হলে স্থূল আর এক সেন্টিমিটার কম হলে কৃশকায়া মনে হত, তার ওপরে পেরেকের গভীর আঁচড়ে রাহুল প্লাস বর্ণালী, শাজাহান প্লাস হোসেনারা। পেটে, কোমরে, পিঠের তলদেশে, মিঠু, সাজ্জাদ, প্রবীর, লায়লা, লোকমান, নাঃ পালাও পালাও – নোটন বলল, ও রূপঙ্করদা অত হন হন করে যাচ্ছেন কোথায়? আমি বললাম ফিরে যাব, ভাল লাগছেনা।
ভিক্টোরিয়ার উল্টোদিকে সেই লম্বা ঘাসের মধ্যে জয়দেবদা, আমি আর পাঁচশো বাদামভাজা। সে সময়ে জয়দেবদাকে খুব ঈস্থেটিজমে পেয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের বাগেশ্বরী শিল্পপ্রবন্ধমালা আনা হয়েছে, কমলা লেকচার্সের এক কপিও যোগাড় হয়েছে অতি কষ্টে। ঈস্থেটিজমের মার্ক্সিয় কনসেপ্ট আর এঁদের লেখায় কি বিরোধ পাচ্ছিস কিছু ? আমি বললাম, দাদা, অত থিয়োরি পড়েন কেন বলুনতো ? জয়দেবদা বললেন, তুই বল তাহলে হোয়ট ইজ ঈস্থেটিক ?
আমি বললাম, একটা বুড়ো আঙুলের নিয়ম শুনবেন ? থাম রুল? যাহা দেখিলে চিত্তে অসীম আনন্দ ব্যতিরেকে অন্য কোনও ভাবের উদয় হয়না, তাহাই ঈস্থেটিক। গোলি মারিয়ে অবন ঠাকুর অওর কার্ল মার্ক্সকো। জানেন, এক্কেরবারে কাঁচা বয়সে, পনের কি ষোল হবে, মুর্শিদাবাদে গিয়ে এক নগ্ন নারীর সামনে – জয়দেবদা বললেন, হুম্, তা থিয়োরির কোনও প্রয়োজন না থাকলে এঁরা এত কাগজ কলম খরচা করে বেকার এসব লিখেছেন বলছিস ?
কী আছে নগ্ন নারীদেহে ? সেই আদ্দিকালে লুকাস ক্র্যানাস দ এল্ডার থেকে শুরু করে, টিশিয়ান, এল গ্রেকো, বত্তিচেল্লি, রাফায়েল, দা ভিঞ্চি, মিচেলেঞ্জেলো, সবাই। ভ্যানগগ, মনে, পিকাসো, আমাদের হুসেন, বিকাশ ভট্টাচার্য, সনাতন দিন্ডা, কে আঁকেননি ন্যুড ? কিন্তু কেন ? সবই কি ঈস্থেটিক ? রবীন্দ্রনাথও বাদ যাননি। যদিও তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মধ্যে ছবি আঁকাটাকে গায়ের জোরে ঢোকানো হয়েছে। এবার কিছু ব্যোমকেশ ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারা বলল, ছবিটার পোজিশন দেখে প্রত্যয় হচ্ছে, এটা জানলার বাইরে থেকে আঁকা এবং ছবির মডেল ঘরের মধ্যে মাটিতে শুয়ে ছিলেন। এ কাদম্বরী দেবী ছাড়া কেউনা। মডেল ছাড়া ন্যুড হয়না ? ভারতে একজন বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন, কে এইচ আরা। তিনি ন্যুড আঁকতেন, একেবারে রগরগে ন্যুড। বহু পুরস্কার পেয়েছেন, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রদর্শনী হয়েছে, অথচ তিনি প্রথাগত আঁকার শিক্ষা পাননি, ছিলেন একজন মোটর মেকানিক। একটা ইন্টারভিউ পড়েছিলাম, তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আচ্ছা এত যে ন্যুড আঁকেন, আপনার মডেল হয় কে ? তিনি বললেন, ওমা, এতে আবার মডেল লাগে নাকি, আমি তো চোখ বুজলেই পষ্টো এদের দেখতে পাই।
আমার বাড়ি যখন প্রায় ভেঙে পড়ছিল, একটা ফ্ল্যাট কেনা হয়েছিল তা আগে বলেছি। এবার বাড়ি মেরামত হয়ে যাবার পর ওটা খালিই পড়েছিল বেশ কিছুদিন। একদিন এক শিল্পী এসে বললেন, দাদা আমাকে মাস দুয়েকের জন্য ভাড়া দেবেন ? আমার একটা বড় প্রোজেক্টের জন্য অনেকটা বাড়তি জায়গার প্রয়োজন। ওঁর ছবি আমি দেখেছি আগে। প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, আঁকেনও খুবই ভাল। তা তিনি ছাত্র ছাত্রী সমেত চলে এলেন আমার ফ্ল্যাটে।
একদিন একটা ম্যাগাজিন হাতে করে হন্তদন্ত হয়ে সেই ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। তাতে একটা সচিত্র গল্প ছেপেছে। এক শিল্পোৎসাহী মাড়ওয়ারনন্দনের বাড়ির ছবি। তার পরতে পরতে বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি টাঙানো। এনার প্রচূর টাকা এবং নিলামে ছবি উঠলেই উনি পটাস করে কিনে নেন, শিল্পোৎসাহী বলে কথা। তাঁর ঘর, সিঁড়ি, বারান্দা, কোথাও এক ইঞ্চি খালি নেই। বিখ্যাত শিল্পীরা লাইন দিয়ে ঝুলছেন। বাথরুমটার ছবি দেয়নি, সেখানেও আছে নির্ঘাৎ। তবে সেটা ব্যাপার নয়। ওঁর বসার ঘরে নানা রকমের সোফা, বীনস ব্যাগ ইত্যাদি। ছবিও অসংখ্য, তা বলা বাহুল্য, তবে তিনি নিজে যে আসনে বসেন, স্ট্র্যাটেজিকালি তার ঠিক মাথার ওপর এক নগ্নিকার ছবি। বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা, শিল্পীর নাম ফ্রান্সিস নিউটন সুজা। সেই সুজা, সোথবির নিলামে হুসেনের ছবির পরেই দ্বিতীয় মহার্ঘ ছবি যাঁর, কয়েক লক্ষ ডলারের। ছবিটা এতই কুরুচিপূর্ণ, যে দুবার তাকানো যায়না।
আমি হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে বললাম, এটা সম্বন্ধে আপনার কি মত ? উনি বললেন, হ্যাঁ এই ভদ্রলোক তো একজন বিখ্যাত শিল্প সংগ্রাহক, খুব নামী লোক ইনি। আমি বললাম, আর এই ছবিটা ? এই জঘন্য ছবিটা ? দেখুন, এটা ডেলিবারেটলি এমন ভাবে টাঙানো হয়েছে, যে ঘরে কোনও গেস্ট এলে অন্য কোনও ছবি তিনি দেখুন না দেখুন, এটার দিকে তাকাতে হবেই। আর যতক্ষণ, তিনি পুরুষ বা মহিলা যে-ই হোন, গৃহস্বামীর সঙ্গে কথা বলবেন, এই বিকৃত পারভার্টেড অশ্লীল ছবিটা তাঁকে বাধ্য হয়ে দেখতে হবে ?
আমার ভাড়াটে আর্টিস্টবাবু হাসলেন, করুণার হাসি। দেখুন দাদা, শ্লীলতা অশ্লীলতার কনসেপ্ট এখন অনেক পাল্টে গেছে। আপনি মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা নিয়ে এযুগে চলতে পারবেননা। আর প্রথম কথা এই ভদ্রলোক শিল্প সংগ্রাহক হিসেবে খুব বিখ্যাত লোক, সারা ভারতে এঁর নাম। আজ আপনি যদি হঠাৎ বলেন, ইনি পারভার্ট – যাক, আমায় বলেছেন বলেছেন, আর কাউকে বলবেননা যেন। আর এফ এন সুজা ? তিনি কত বড় শিল্পী তা তো সারা ভারত নয়, সারা বিশ্ব জানে। আপনি যদি তাঁর ছবির এমন সমালোচনা করেন – আচ্ছা দাদা, আমি এখন একটু ব্যস্ত। পরে না হয় একদিন আপনার সঙ্গে এই নিয়ে –
এফ এন সুজার ছবির মহিলার উরুতে সাজ্জাদ, প্রবীর, লায়লা বা লোকমানের নাম ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া কালি দিয়ে লেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। কত ইচ্ছেই তো জীবনে পূর্ণ হয়নি, এটাও হবেনা।
আপনি আচরি...
সেই মুর্শিদাবাদ, কিশোর বয়সে সম্ভবতঃ প্রথম পরিবারের সদস্যদের বাইরে অন্যদের সঙ্গে দুনিয়া চেনা। কেন যে চিনতে গেলাম, সে দুনিয়াটা আর তেমন রইল কই (দীর্ঘঃশ্বাস)। খুব ঘুরছি তখন দিনের বেলা আর আর রাত হলে ইসমাইলদার হারমোনিয়াম শুনতে যাওয়া। দ্বিতীয় দিনেই নবাব বাড়ি আর হাজার দুয়ারী দেখা হয়ে গেল।
সেই কিশোর বয়সে প্রথম এবং যৌবনেও আবার যখন মুর্শিদাবাদ গেছি, তখন স্থানীয় লোকের মুখে বরাবর শুনেছি, রঙচঙ করা বিরাট বিরাট থাম আর নানা ঐতিহ্যের স্মারক বোঝাই বাড়িটা নবাব বাড়ি, আর তার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁদিকের প্রায় ভেঙে পড়া খন্ডহর টাইপের বাড়িটা হাজার দুয়ারী। সে সৌধটার নাম নিজামত ইমামবাড়া। তখন শুনতাম, নবাব বাড়িতে ন’শোটা দরজা আছে, ইমামবাড়ায় অ্যাকচুয়ালি হাজারটা। কে জানে আসল কি, এখন তো নিজামত ইমামবাড়াও ঝাঁচকচকে নতুন আর নবাব বাড়ির নাম হয়েছে হাজারদুয়ারী প্যালেস।
এখনকার মুর্শিদাবাদ দেখলে বোঝাও যাবেনা জায়গাটা কেমন ছিল। রোদে ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত, তার ওপর পথ হারিয়েছি। পথচলতি দু একজনকে জিজ্ঞেসও করলাম, আসলে আমরাই ঠিকমত ঠিকানা বলতে পারিনি, তাদের দোষ নেই। সামনে দেখি খড়ের চাল দেয়া একটা বেশ বড়গোছের বাড়ি, তার লম্বা টানা একটা দাওয়া, তার ওপরে বাঁশের খুঁটি দেয়া খড়ের চাল। আমরা গিয়ে দাওয়াটায় বসে পড়লাম। পাশেই বিশাল অশ্বত্থ গাছ, ছায়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। খুব তেষ্টা পেয়েছে, একজন ঘোমটা পরা মহিলাকে আসতে দেখে তড়বড়িয়ে বললাম, মাসীমা, একটু জল দেবেন?
এই কথাটার মধ্যে এমন কী ছিল জানিনা, উনি শক্ খাওয়ার মত থমকে দাঁড়িয়ে এক হাতের মত ঘোমটাটা ঝুলিয়ে দিলেন। তারপর কোনও কথা না বলে ধাঁ করে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, কি রে বাবা, কি এমন বললাম। এবার বাড়ির ভেতর থেকে একজন পুরুষ বেরিয়ে এলেন। মুখে একগাল লম্বা দাড়ি, পরণে ফতুয়া আর লুঙ্গি। তিনি বললেন, বাবাদের কোত্থেকে আসা হচ্ছে ? আমি তড়বড়িয়ে বললাম, আমরা কোলকাতা থেকে এসেছি, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল দেবেন ?
তিনি বাড়ির দরজার দিকে ফিরে কিছু ইশারা করতে সেই বিশাল ঘোমটা দেয়া মহিলা, একটা পেল্লায় কাঁসার বাটিতে অনেকটা মুড়ি আর প্রচূর বাতাসা নিয়ে এসে ঠক্ করে নামিয়ে আবার শক্ লাগার মত পিছিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক বললেন, এগুলো খেয়ে নিন বাবারা, ইয়ে, মানে ঐ জ-জলটা ঠিক দেয়া যাবেনা।
গ্রুপের লীডার আমি, কথাবার্তা আমিই চালাচ্ছিলাম, বললাম, সেকি, আমাদের তো ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে, মুড়ি দিয়ে কি করব? তাছাড়া জল দেয়া যাবে নাই বা কেন ? ভদ্রলোক ভীষণ বিব্রত, অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, এ বাড়ির জল খেলে আপনাদের জাত যাবে বাবারা, বাড়িতে বাবা মা শুনলে খুব বকাবকি করবেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, জাত যাবে মানে ? জাতের কি পা আছে নাকি ? আর যাবেই বা কেন ? তিনি বললেন, আমরা যে মুসলমান।
এইখানে একটু ভূমিকার ব্যাপার আছে। অন্যদের কথা জানিনা, ‘মুসলমান’ শব্দটা শুনে আমি অন্তত কিছুই বুঝিনি। আমি মামাবাড়িতে মানুষ(?)। সেখানে এবং পিতৃকুলেও জাতধর্ম নিয়ে আলোচনা কেউ কোনওদিন করত না, ফলে কিছুই জানতাম না। আমার বন্ধু প্রণব, খেলার মাঠে জামা খুলে জার্সি পরার সময়ে দেখি তার গলায় একজোট করা অনেকগুলো সূতো ঝুলছে। বললাম, এই সুতোগুলো কীসের রে? সে বলল, এটা পৈতে, তাও জানিসনা? মহামূর্খ তো। প্রণবের পদবী সরকার, আমারও তাই। বাড়ি এসে বললাম, প্রণবের গলায় সূতো ঝোলে কেন ? কই আমার তো নেই? বাবা কি মামা মনে নেই, বলল, আঃ ও তো ভীষণ দুষ্টু ছেলে, ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল, ছিঁড়ে চলে এসেছে, তবু খানিক রয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন পরেও সেই ‘দড়ি’ দেখে বুঝলাম, আমাকে বোকা বানানো হয়েছে। যাক এই নিয়ে আর প্রশ্ন করিনি।
শুনলে হাসি পাবে, আমি চাকরিতে ঢোকার আগে পর্যন্ত ব্যানার্জী মানে বামুন, আর সেনগুপ্ত মানে বদ্যি, তা জানতাম না। দাড়িওয়ালা লোক মানে মুসলমান, তাও জানতাম না। আমাদের পাশের গ্যারাজেই প্রশান্ত সেন নামে এক জ্যোতিষীর চেম্বার ছিল। তাঁরও একেবারে ঠিক ওমনি দাড়ি। মুসলমান শব্দটা শুনেছি কখনও সখনও, পড়েওছি। কিন্তু সেটা যে একটা আলাদা ধর্ম, আর তাই নিয়ে এত ধুন্ধুমার, তাও কোনওদিন শুনিনি বাড়িতে। বাবা কট্টর নাস্তিক হলেও আমি খুব ধার্মিক ছিলাম। মসজিদ দেখলেই মন্দিরের মত ভক্তিভরে প্রণাম করতাম।
আমি বললাম, দেখুন মেসোমশায়, জল না দিলে আমরা কিন্তু এখান থেকে উঠছিনা। ভদ্রলোক বললেন, কী বিপদ, আপনারা মুড়িটুক খেয়ে নিন না বাবারা, একটু এগোলেই বড় পুকুরটার ওধারে হিন্দুদের পাড়া। আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। এখানে পানি খেয়েছেন জানলে বাড়িতে খুব বকবে। আমি বললাম, আমার বাড়িতে কেউ বকবেনা, কী রে তোদের বকবে নাকি ? পালোয়ানরা সমস্বরে ‘না’ বলল । আমি বললাম, ব্যাস, এবারে জল না দিলে এখানে গলা শুকিয়ে মরে পড়ে থাকব, তবু এখান থেকে উঠব না।
ভদ্রলোক ভীষণ বিব্রত, বললেন, শুনছো, এরা তো কোনও কথাই শুনবেনা। দাও তা হলে, তবে দেখো ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়। চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যের মহলা চলছে মনে হল। ‘জলো দাও – জলো দাও’ – ‘ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা ছিঃ – ওযে চন্ডালিনীর ঝি’ – এক হাত ঘোমটা দেয়া মহিলা একটা পেতলের জাগ নিয়ে এসেছেন। এরকম জাগ আমাদের কারো বাড়িতে থাকতনা, সে সময়ে বিয়েবাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়া হত, সেখানে দেখেছি এমন জাগের ব্যবহার। আমরা হাঁটু গেড়ে আঁজলা পেতে, উনি ওপর থেকে জাগ কাত করে জল ঢেলে দিচ্ছেন। যেহেতু নীচে, তাই ওপরে তাকালে ঘোমটার ফাঁকে একটা মুখ দেখতে পাচ্ছি, সিস্টিন চ্যাপেলের ম্যাডোনার মুখ।
অনেক বছর পরের কথা, আমি হাফ বুড়ো তখন। স্ত্রী একটা খুব খারাপ অসুখে ভুগছে বহুকাল ধরে। চিকিৎসার নামে নানাবিধ তামাশা ও ভারতের বিভিন্ন শহরের ‘বিশেষ-অজ্ঞ’ দের পেছনে কয়েক লক্ষ টাকা গলে যাওয়ার পর সবাই যা করে, তাই করা হচ্ছে, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ইউনানি, মাদুলি, তাবিজ, কবচ, কিচ্ছু বাকি নেই। এর কারণও আছে। অল্টার্নেটিভ চিকিৎসাই বলা হোক, আর দৈবই বলা হোক, বারাসতের কাজীপাড়ার এক হেকিম সাহেবের ঝাড়ফুঁক ও শেকড়বাকড়ের কল্যানে প্রায় সেরে উঠছে সে। জিনিষটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার। হিন্দী একটা প্রবচনের বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আম খাবে, না আঁটি গুনবে?’ আশার প্রদীপ যখন প্রায় সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প, এমন সময় হেকিম সাহেব হঠাৎ চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন। হাজার অনুরোধেও টলবেননা। কয়েক মাসের মধ্যে রোগিনী ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।
তখন আমি মরিয়া হয়ে আর একজন হেকিম খুঁজছি। কেননা প্রথাগত চিকিৎসা যেমন চলার চলছে। তাতে কিছু হবেনা আমিও জানি, যাঁরা চিকিৎসা করছেন, তাঁরাও জানেন। কিন্তু আর যে সব পন্থা ঘেঁটে দেখা হল, তার মধ্যে হেকিমিতে যে অব্যর্থ কাজ দিল তা তো দেখাই গেল। আমাদের বাড়ির কাজের মহিলা এক হেকিমের সন্ধান দিলেন। গেলাম তাঁর কাছে, ভুল বললাম, তিনিই এলেন। গায়ে একটা ধুতির সঙ্গে পরার মত হাত গুটোনো শার্ট, পরনে মুসলমানি পাজামা। মুসলমানি পাজামা মানে, তার ঝুল হবে গোড়ালির ওপরের হাড়টার কিছু কম, মাটি থেকে বিঘৎখানিক তফাতে।
তিনি এসে আগের হেকিমের মতই একটা সবুজ রঙের ডিমের মত পাথর বের করে তাই দিয়ে ঝাড়তে শুরু করলেন। ঝাড়ফুঁক হয়ে গেলে পাথরটার মধ্যে আমাকে মা ফতেমার মুখ দেখানোর বহু চেষ্টা করলেন। নেহাৎ মহা পাপী বলে আমি অবশ্য কিছুই দেখতে পেলামনা।
তাঁর একটা ফোন নাম্বার ছিল, না সেলফোন নয়, তখন সে সব বেরোয়নি। তাঁকে ডাকলেই চলে আসতেন। ওষুধ, ঝাড়া, সবই চলছিল, তবে সেই বারাসতের হেকিমের মত কাজ হয়না। তখন তিনি বললেন চলুন আমার গুরুর কাছে। গেলাম, মধ্য কোলকাতার এক ঘিঞ্জি অঞ্চলে। এত সরু রাস্তা, যে গাড়ি ঢোকানোও মুশকিল। হেকিম সাহেব বেশ পরিচিত ব্যক্তি দেখলাম। সকলেই স্লামালেকুম জানাচ্ছে। উনিও পুরোটা, মানে, ‘ওয়া আলাইকুমুসসালামু’ কিংবা নিদেনপক্ষে কাজ চালানো ‘আলেকুম আস্সালাম’ না বলে শর্টে শুধু ‘আলেকুম’ বলে প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন। একটা বস্তির মধ্যে গুরুর বাড়ি, তিনি তখন রান্না করছিলেন। গুরু একজন মহিলা। তিনিও ঝাড়লেন, স্থানীয় এক দরগায় নিয়ে গেলেন, সেখানেও দোয়াদরুদ করা হল। আমরা ভীষণ সরু রাস্তা দিয়ে অনেক কষ্টে গাড়ি বের করে ফিরে এলাম।
হেকিম সাহেবও আমাদের সঙ্গে এলেন। একটা লম্বা মত কাগজে কি একটা উর্দুতে লিখে ঘরের একটা ‘ভাল’ জায়গায় রাখতে বললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী লেখা আছে ওতে ? উনি বললেন, লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ। এটা আমাদের প্রথম কলমা। এরকম আরো পাঁচটা আছে।
কিছুদিন পর, ওষুধটা নিয়ে উনি আসতে পারছেননা, খুব ব্যস্ত। ফোনে বললেন, আপনি একটু কষ্ট করে নিয়ে যেতে পারবেন ? আমি বললাম, না না, কষ্ট আর কি, নিশ্চয় যাব। মধ্য কলকাতায় ঠিকানা খুঁজে দোতলায় উঠে ঘরে ঢুকেই দেখি এক গোলগাল গিন্নী, কপালে দগদগে সিঁদুর, হাতে শাঁখা, পলা। একটু ঘাবড়েই গেলাম। মুসলমান মহিলা সিঁদুর পরেন, তা কোথাও কোথাও দেখেছি, কিন্তু শাঁখা পলা ? উনি আমার জন্য চা আনতে গেলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বেশ কিছু দেবদেবতার ছবি দেয়ালে ঝুলছে। কিরে বাবা, গোলমাল ঠেকছে। ইতোমধ্যে হেকিম সাহেব এসে গেছেন। আমি গলা খাঁকরে বললাম, সাহেব আপনার নামটাই জানা হয়নি। উনি বললেন, আমার নাম ? দুলাল নন্দী। চুঁচড়োয় জি টি রোডের দিকটায় গেছেন কখনো ? নন্দীবাড়ি বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।
সে চিকিৎসাটা অবশ্য আর কনটিনিউ করা হয়নি। দুলালবাবুর ওষুধটা দেখে ডাঃ বিশেষজ্ঞ খুব বকাবকি করায় ওটা ওখানেই ইতি করা হল।
আবার ক’বছর পিছিয়ে যাই, ক’বছর মানে, বেশ ক’বছর। বুলবুলদার একটা চশমার দোকান ছিল। তার ওপরে দোতলায় ছিল একটা মহিলাদের টেলরিং শপ। সেখানে মাপজোক একটা মেয়েই নিত, মাস্টার টেলরের নাম ছিল নজরুল। সে নীচের দোকানেই বসে থাকত বেশির ভাগ সময়ে। ঈদের সময়ে একটা বিশাল বড় পেতলের টিফিন কেরিয়ারে দুরকমের মাংস, লাচ্ছা পরোটা আর সেমুইয়ের পায়েস নিয়ে আসতো। বুলবুলদা এত বেশি পরিমানে আনার জন্য বকাবকি করলে খুব সেন্টিমেন্টাল ডায়ালগ দিত বলে বকা একদম বন্ধ। অতবড় যে টিফিন কেরিয়ার হতে পারে, তাই আমি জানতামনা, পৃথিবীতে কত কিছুই তো জানিনা।
একদিন আমরা কয় বন্ধু আর নজরুল লাইন দিয়ে নীচে বসে আছি। নজরুল আমাদেরই বয়সী, এক গ্রুপেরই মনে হচ্ছে। পাশের রাস্তা থেকে একটা ছেলে হাতে এক মস্ত ঝুড়ি নিয়ে, তার থেকে সবাইকে নানা রকম ফল আর সন্দেশের টুকরো বিলি করছে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে জানা গেল কালীপূজোর প্রসাদ। এটা সেই দীপাবলির কালীপূজো নয়, বিভিন্ন সময়ে নানা রকম শক্তি উপাসনা হয়, এটা তারই একটা। আমরা সবাই মাথায় ঠেকিয়ে গালে পুরছি, নজরুল হাত গুটিয়ে নিল।
ছেলেটা তো আর চেনেনা, বলল, ও দাদা, আপনি নেবেননা ? আমি তড়বড় করে বললাম, ওকে দিওনা ভাই, ও মুসলমান। বুলবুলদা অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার নজরুল, তুমি তো শিবরাত্তিরের প্রসাদ দিব্যি খেলে সেদিন ? নজরুল বলল, হ্যাঁ শিবের প্রসাদ খাই, কালীর খাইনা। আমি তাজ্জব হয়ে বললাম, কেন কালীর প্রসাদ খাওনা কেন ? নজরুলের মুখে রাজ্যের বিরক্তি, ধূর, অসভ্য মেয়েছেলে, জামাকাপড় পরে না, যেখানে সেখানে শ্মশানে মশানে ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ওর প্রসাদ কে খাবে।
দূরে কোথায় যেন মাইকে মান্না দের গান বাজছিল, ‘এতো রাগ নয় গো- এযে অভিমান –‘
স্যারের কাছে
- স্যার, স্যার, আপনি কোথায় ?
- এই যেএএ, টুউউউ–কি। ওহ্ মাই গড, অলমোস্ট ফেল ইন ইয়র ট্র্যাপ।
- স্যার আপনিই তো ভগবান, তো গড বললেন কাকে ?
- আই ওয়জ স্পীকিং টু মাইসেলফ্
- স্যার দিব্যি তো বাংলা বলে ফেললেন, তার মানে বাংলা জানেন –
- ইউ হাফউইট, আই নো অল দা ল্যাংগুয়েজেস স্পোকেন, রিট্ন অ্যান্ড ইভেন থট ইন দিস ওয়ার্ল্ড।
- তো খামোখা ইংরিজি বলেন কেন ?
- বিকজ দা ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ স্পোকেন বাই দা পীপ্ল হু রুল দা ওয়ার্ল্ড। আই অলসো রুল দা ওয়ার্ল্ড ইন আ ডিফারেন্ট ওয়ে।
- স্যার চিনেম্যান চ্যাংচুং মালাইকা ভট্-রা নাকি দুনিয়া শাসন করবে আর ক’দিন পর ? আপনি তখন চ্যাং চুং বলবেন ?
- ওই আনন্দেই থাকো।
- স্যার আবার তো বাংলা বলে ফেললেন ।
- ইউ আর আ ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স ( দড়াম) ( দরজা বন্ধ হইল)।
যে কারণে এসেছিলাম, সেটাই হলনা। স্যারকে জিজ্ঞেস করতাম, ধর্মের উৎপত্তি কোথা থেকে এবং কি কারণে। আছে, অনেক মোটা মোটা বইপত্তর আছে। আমার কাছেও আছে বেশ কটা। ভাল করে পড়া হয়ে ওঠেনি, সময় কোথায়।
(চলবে)