এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কলপের গল্প

    Subhamoy Misra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৩৪২ বার পঠিত
  • - স্যার, চুলটা রং করে দিই? 
    - না, দরকার নেই। 
    - ভালো রং ছিল।
    - না, থাক।
    - করেই দেখুন না একবার, মাত্র দেড়শো টাকায় তিন মাসের গ্যারেন্টি।
    - পকেটে পয়সা নিয়ে বেরোইনি, পরে হবে।
    - পয়সা পরে দেবেন, আপনি কি আর পালিয়ে যাচ্ছেন!
    - আরে আমার পাকাচুলও কি আর পালিয়ে যাচ্ছে! পরের বার হবে।
     
    সেলুনে গিয়ে চুল কাটার শেষ পর্যায়ে প্রতিবারই এমন প্রস্তাব আসে ভোলাবাবুর কাছে, ভোলাবাবু এটা ওটা বলে এড়িয়ে যান।
     
    - দাদা, চুল যে সব সাদা হয়ে গেল!
    - বয়স বাড়ছে তো।
    - বয়স ভাবলেই বয়স, ও একটা সংখ্যা বৈ তো কিছু নয়।
    - সংখ্যারও তো বেশি কম আছে।
    - ছাড়ুন তো; ভালো কোথাও গিয়ে কলপ করিয়ে নিন। দেখতে ভালো লাগবে।
    - এলার্জি আছে ভাই। কপালে ঘায়ের মতো চুলকানি বেরোবে, চোখ লাল টকটক করবে, সঙ্গে হাঁচি-কাশি-সর্দি। সেটাও বা কি এমন দর্শনধারী হবে!
    - ও কিছু নয়, বড়োজোর একদিনের মামলা। দুবেলা দুটো সেট্রিজিন মেরে দেবেন।
    - সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে আবার ওষুধ খেয়ে লাভ আছে!
     
    চেনাজানা লোকেদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে এভাবেই প্রসঙ্গটার রাশ টানার চেষ্টা করেন ভোলাবাবু।

    - কি রে, বুড়োদের মতো একমাথা পাকাচুল নিয়ে ঘুরে বেড়াস কেন?
    - ওতেই চলে যাচ্ছে। আপনি কেমন আছেন?
    - চুলের রং দেখলেই বুঝবি তোর চেয়ে ভালো আছি। এখনো নুনমরিচ।
    - সে আপনারা খাঁটি দুধ-ঘি খেয়ে বড় হয়েছেন, আমাদের তো সব হাইব্রিড।
    - ফক্কুড়ি ছাড়, এসব লিভার থেকে হয়। ঢুকুঢুকু কি বেশি হয়ে যাচ্ছে?
    - না না, কি যে বলেন! 
    - সকালে খালি পেটে কচি ঘাসের রস খা; একটু কপালভাতি কর। নিদেন পক্ষে একটু লেবু, আমলা আর শিকাকাই মিশিয়ে লাগা।
    - লেবুর যা দাম! দেখছি।
    - ওই দেখছি দেখব করেই কাটিয়ে দিলি। বয়স হয়েছে, এবার একটু গা ঝাড়া দে।
    - তাই তো বলছি, বয়স হয়েছে। চুলপাকা তো বয়সের দোষ।
     
    তরতাজা গুরুজনদের সঙ্গে দেখা হলে কথাবার্তার এটাই দস্তুর।

    - কি রে তোর মাথার চুলের এ কি অবস্থা! বিশ্বাসই হয় না আমরা একসঙ্গে পড়েছি।
    - তোরও তো পেকেছে।
    - চোখটারও মাথা খেয়েছিস দেখছি, আমার এই কয়েকটার সঙ্গে তোর মাথা ভর্তি পাকাচুলের তুলনা!
    - কি আর করব, তোদের মত সুখী মানুষ তো নয়। ছোটবেলায় মাস্টাররা চুলের মুঠি ধরে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়েছে, এখন অফিসসুদ্ধ সবাই মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে। এত অত্যাচার কি সামান্য চুল সইতে পারে! পেকে গেল।
    - বাজে বকিস না। অফিসে মেয়েরা ধারেকাছে ঘেঁষে? পাত্তা টাত্তা দেয়?
    - তা দেবে না কেন! দরকার পড়লেই আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসে।
    - তোকে বুড়োর দলে ফেলেছে বলেই ফাঁপরে পড়লে আসে। তারপর কাজ মিটলে থ্যাংক ইউ বলে চলে যায়, তাই তো!
    - তো আবার কি করবে?
    - কফি টফি খেতে ডাকে না সঙ্গে?
    - ধুর, সে সব দিন চলে গেছে।
    - ওই দেখ, পাকাচুলের সঙ্গে মনটাকেও বুড়ো বানিয়ে রেখেছিস। চুলটা ডাই কর, আজকাল তো লাল সবুজ নীল এসব রংও করছে লোকজন। হাবিবে গিয়ে করে ফেল, মনটা দেখবি প্রজাপতির মতো ফুরফুর করে উড়ছে।
    - পয়সা নেই রে ভাই, মাইনের টাকা কোনদিক দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় জানতেই পারি না।  
    - তুই চিরকালই কঞ্জুস রয়ে গেলি। মনটা বুড়িয়ে গেলে পয়সা ডাক্তারে খাবে।
    - আর চুল রং করতে গেলে পয়সা হাবিবে খাবে।
     
    বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হলে আলোচনাটা একটু তরল হলেও প্রসঙ্গটা বেশিদূর গড়ায় না।

    ভোলাবাবুর চুল পাকার শুরু তো সেই কলেজে পড়ার সময়; প্রেম, বিয়ে, মহিলা মহলে জনপ্রিয়তা কোনোটাতেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি তা। পাকাচুল তাঁর পাকা ধানে মই দিচ্ছে না বলে তিনিও চুলে কলপ দেওয়ার কথা ভাবেন নি কোনোদিন। তারপর মধ্যচল্লিশেই সব চুল সাদা হয়ে গেল। তবুও কলপ করার প্রসঙ্গ উঠলেই ধানাই পানাই করে এড়িয়ে গেছেন। ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্বই দেননি কখনো। নীলের গামলায় ডুবে রং পাল্টালেই কি শেয়াল বনের রাজা হয়ে যায় না ময়ূরপূচ্ছ লাগালেই কাক ময়ূর হয়!

    তবে বছর দুয়েক আগে, একটা ঘটনার পর চুলে কলপ না করার সচেতন সিদ্ধান্ত নিলেন ভোলাবাবু। ঘটনাটা আর কিছু নয়, মধ্য-জুনের মাঝ-সপ্তাহের মধ্যাহ্নবেলায় কানে মধু ঢেলে দিয়েছিল দুটি শব্দ, “আঙ্কেল বসুন।” ভিড়ে ভিড়াক্কার মিনিবাসের মধ্যে একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে, বাসে সিট ছেড়ে দিয়েছিল তাঁকে।
     
    এমন সুযোগ হাতছাড়া করার মতো আহম্মক ভোলাবাবু নন। প্রথামাফিক একটু আপত্তির পরে মৃদুস্বরে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে সিটের দখল নিয়েছিলেন ভোলাবাবু। কে বলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা সৌজন্য ভুলে গেছে!

    কিন্তু এত লোক থাকতে তিনি কেন? সিটে গুছিয়ে বসার পর প্রশ্নটা মাথায় চেপে বসেছিল ভোলাবাবুর। জ্যামের মধ্যে ঢিকিঢিকি করে এগোনো বাসে সময়ের অভাব ছিল না। ভাবতে ভাবতে আক্ষরিক অর্থে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়েও তাঁর প্রতি এই দাক্ষিণ্যের কারণটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বাস হাওড়া ব্রিজে উঠতেই একঝলক হাওয়া পেয়ে কারণটা মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে গেল।
     
    পাকাচুল।
     
    পাকাচুল ছাড়া কিচ্ছু নয়; বয়স্ক মানুষ ভেবে মেয়েটা সিট ছেড়ে দিয়েছে। একদম নিশ্চিত ভোলাবাবু। মনে মনে খুব হাসলেন।

    এরকম ঘটনা তারপরেও ট্রামে বাসে ট্রেনে মাঝেমাঝেই ঘটতে লাগল। কখনো অল্পবয়সী ছোকরা ট্রেনে সিট ছেড়ে দিল, কখনো সদ্য যুবতী অটোতে তাঁকে পেছনের সিটে বসতে দিয়ে সামনে গিয়ে বসল, কখনো ময়দানের ট্রামে পাশাপাশি বসা কপোতকপোতী ছাড়াছাড়ির ভয়ে সিট না ছাড়লেও হাতের ব্যাগটা চেয়ে নিল। ফুটপাথে চা খাওয়ার সময় দোকানদার ভাঙা টুল এগিয়ে দিল বসার জন্য। লঞ্চে ওঠার সময় লাইন ভেঙে এগিয়ে গেলেন, কেউ কিছু বলল না। ব্যাংকে টাকা তোলার লাইনেও তাই। এমনকি ইলেকট্রিক অফিসে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ লেখা ফাঁকা কাউন্টারে গিয়ে টাকা জমা দিলেন, বিনা বাধায় কাজ মিটে গেল। মোদ্দা কথা, যেখানে আধার-প্যান ইত্যাদি দেখাতে হয় না, সেখানে পাকাচুলের কল্যাণে সুবিধা পেতে লাগলেন তিনি।
     
    এসব আগেও হয়তো ঘটেছে, ভোলাবাবু খেয়াল করেন নি। এখন যাই ঘটুক না কেন, তা যে পাকাচুলের জন্যই ঘটছে এ ধারণা মনে বদ্ধমূল হল ধীরে ধীরে। ব্যাপারটা কিছুটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। এ আর এমন কি খারাপ ব্যাপার, চুরি ছিনতাই খুন রাহাজানি তো করছেন না! চুলে কলপ করে অফিসের আধবুড়িদের সঙ্গে ক্যান্টিনে কফি খেতে খেতে খেজুরে আলাপ করা বা নেমন্তন্ন বাড়িতে মহিলাদের সঙ্গে মজলিস জমানোর সুযোগের চেয়ে, বাসে-ট্রেনের সিট অনেক মহার্ঘ্য। সুতরাং শতেক প্ররোচনার পরেও পাকাচুল যেমন কে তেমন রইল।
     
    তাতেই ক্ষান্তি দিলে তাও ঠিক ছিল, পাকাচুলের সমর্থনে রীতিমত যুক্তিতর্ক শুরু করলেন ধীরে ধীরে। পাকাচুল প্রকৃতির দান, সে দান মাথা পেতে নেওয়াই কাম্য, এই মর্মে পরিচিত মহলে গলা ফাটানো শুরু হল অচিরেই। খোদার উপর খোদকারি করতে গিয়ে বন্যা, ভূমিকম্প, পাহাড়ে ধস, সমুদ্রে সুনামি, অতিবৃষ্টি, জলাভাব, সুগার-প্রেসার-হার্ট এটাক-ক্যান্সার ইত্যাদির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে চুলোচুলির ভয়ে পরিচিতরা এড়িয়ে যেতে লাগল; ঠিক যেমন করে ভোলাবাবু কলপ করার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন কিছুদিন আগেও।

    তবে পরিবর্তনের হাওয়ায়  কত জ্ঞানীগুণী লোকের মতামত পাল্টে যায়, কত রাজা মহারাজাদের কঠিন সংকল্প রসাতলে যায়, আর এ তো ভোলাবাবুর সামান্য পাকাচুল। মাত্র কিছুদিন আগের একটা ঘটনা, সেই মিনিবাসেরই ভেতর, ভোলাবাবুর সংকল্প ভুলিয়ে দিল। হতভম্ব অবস্থায় বাস থেকে নামার পরেই তিনি সিদ্ধান্ত বদল করলেন।

    সন্ধের মুখে কাজকর্ম সেরে ফিরছিলেন ভোলাবাবু। স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে দেখলেন আর সব সিট ভর্তি, কেবল ‘সিনিয়র সিটিজেন’ লেখা সিটটা ফাঁকা। বিনা দ্বিধায় ওখানেই গুছিয়ে বসলেন। পাকাচুলের কল্যাণে নেহাৎ থুত্থুড়ে বুড়ো না উঠলে জানালার ধারে বসে ঘুমটা জমবে ভালোই।
     
    একসময় বাস ছাড়ল। স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তায় পড়তেই বেশ কিছু লোক হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ল বাসে। মারমুখী সেই দঙ্গলের ভেতর থেকে এক জোয়ান ছোকরা লাফ মেরে এসে ভোলাবাবুর পাশের ফাঁকা সিটটা দখল করল। তাড়াতাড়ি পাকাচুলের মালিক হতে না পারলে, নিয়মমাফিক এই সিটের দখল পেতে আরও অন্তত তিরিশ বছর হুড়ুদ্দুম মারপিট করেই কাটাতে হবে ছোকরাকে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে হাসলেন ভোলাবাবু। কন্ডাক্টরের হাঁকডাক আর প্যাসেঞ্জারের গালাগালির মধ্যে বাস ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলতে থাকল। আরামসে সিটে বসে ভোলাবাবুর হালকা ঝিমুনিও চলতে থাকল।

    বাস যেমনই চলুক, একসময় গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন ভোলাবাবু। আর মাত্র দুটো স্টপ বাকি। ঢুলুনিটা ছাড়ানোর জন্য ঘাড় ঝাঁকালেন, চোখ পিটপিট করলেন, তারপর আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করার ছলে পাকাচুলগুলোকে একটু আদর করে দিলেন কৃতজ্ঞতাস্বরূপ।
     
    এমন সময় বাসে উঠলেন এক সত্যিকারের সিনিয়র সিটিজেন। বগলে পুরোনো ধাঁচের পেট মোটা একটা ব্যাগ। কুঁচকে যাওয়া রোদে পোড়া চামড়া দেখলেই বোঝা যায় পোড় খাওয়া মানুষ, মাথার চুল এমনি এমনি পাকেনি। ভিড় ঠেলে ভোলাবাবুর সিটের দিকেই এলেন তিনি।
     
    ভোলাবাবুর পাশে যুদ্ধজয়ী ভাগ্যবান ছোকরা তখনও কানে ‘ঠুলি’ গুঁজে বসে গানের গুঁতো খাচ্ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছোকরার কাঁধে হাত রেখে চোখ নাচিয়ে ইশারা করলেন সিট ছাড়ার জন্য। ভুরু নাচিয়ে জানালার মাথার ‘সিনিয়র সিটিজেন’ লেখাটার দিকেও ইঙ্গিত করলেন। ছোকরা একবার লেখাটা দেখল, তারপর ভিড়ের দিকে দেখল। উঠতে তো তাকে হবেই; নইলে ভিড়ের মধ্যে গরমে হাঁসফাঁস করা সিট-বঞ্চিতদের বাক্যবাণ থেকে রেহাই নেই। মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে কোলের ব্যাগটা গুছিয়ে নিল সে।
     
    এদিকে ভোলাবাবুর আর একটা স্টপ বাকি। ভিড় ঠেলে বাসের দরজায় পৌঁছতে হবে, সিট ছেড়ে ওঠার উদ্যোগ নিলেন তিনি। তাঁকে উঠতে দেখে ছোকরা ব্যাগের হাতল ধরা মুঠোটা আলগা করল, একটু ঢিলে দিল উঠে দাঁড়ানোর উদ্যোগে। চোখের ইশারায় সেই বয়ষ্ক ভদ্রলোককে বোঝাতে চাইল, পাশের সিটে বসে যান।

    কিন্তু সেই বয়ষ্ক ভদ্রলোক সেসবে পাত্তা না দিয়ে ভোলাবাবুর কাঁধে চাপ দিয়ে বসিয়ে দিলেন। তারপর আবার ইশারা করে ছোকরাকে উঠতে বললেন, এবার হাত নেড়ে। কাঁধে চাপ পড়ায় ভোলাবাবু বসে পড়লেন, অবাক হয়ে, কিছু না বুঝেই। আর ছোকরা উঠে পড়ল, কিছুটা নিরুপায় হয়ে, একটু বিরক্তির সঙ্গে।

    ছোকরার ছেড়ে দেওয়া সিটে ভদ্রলোক বসলেন। বসেই ভোলাবাবুর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, “আপনি উঠছিলেন কেন?”

    ভোলাবাবু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করলেন, “আপনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাই।”

    “তাতে কি! এই সিটের হকদার আপনিও। ছেলেছোকরা সিটে বসে গান শুনবে আর একজন বয়স্ক মানুষ আরেকজনকে সিট ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে, সে কি হয়!”

    ভোলাবাবু ইতস্ততঃ করে বললেন, “না, তা ঠিক নয় ব্যাপারটা।”

    মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভদ্রলোক বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, “আরে দাদা, ব্যাপার সব বুঝি। এত বছর ইন্স্যুরেন্স লাইনে আছি, লোক দেখেই বুঝতে পারি কার প্রিমিয়াম কত পড়বে, কার ক্লেইম-এর সময় হয়ে এসেছে। এই শরীর নিয়ে এরকম ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আপনার কম্মো নয়।

    ভোলাবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “আসলে, সামনেই নামব।”

    “সে যখন সময় হবে তখন নামবেন। বুড়ো বয়সে গেটে ঝুলবেন নাকি! সমবয়সী মানুষের সুবিধে অসুবিধে বুঝব না, এমন বান্দা আমি নয়। আপনিই বলুন না, আমাদের ছেলেবেলায় তেমন শিক্ষা কি আমরা পেয়েছি!”

    গন্তব্য এসে গিয়েছিল, বাসের প্যাসেঞ্জার ওগরানোও প্রায় শেষের পথে। ব্যাগ নিয়ে গেটের দিকে এগোলেন ভোলাবাবু। দেরি দেখে কন্ডাক্টর ধমকে উঠল, “ঘুমোচ্ছিলেন দাদু! আপনার জন্য বাস দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি!”
     
    ভোলাবাবুর মাথাটা কেমন ভোম মেরে গেছে, উত্তর দিতে পারলেন না।

    পেছন থেকে হুঙ্কার শুনতে পেলেন, “এই কন্ডাক্টার, দাদাকে সাবধানে ধরে নামিয়ে দে। সারাক্ষণ হামাগুড়ি দিয়ে এখন তোর যত তাড়া, না! "
    '
    ধমক খেয়ে কন্ডাক্টর ধাঁই করে বাসের গায়ে থাবড়া মেরে হাঁক পাড়লো, “একদম আস্তে।”
     
    তারপর ভোলাবাবুর বাহুতে ধরে মোয়ায়েম গলায় বলল “সাবধানে দাদু, সামনে গাড্ডা।”

    কোথায় সুন্দরীদের মিষ্টি হাসির সঙ্গে “বসুন আংকেল,” “ব্যাগটা দিন আংকেল” আর কোথায় কন্ডাক্টরের দাদু বলে হাঁকড়। যিনি আসল দাদু, তিনি ভোলাবাবুকে দাদা বলছেন। যাঁর নিজেরই নতুন বীমার বয়স পেরিয়ে গেছে, তিনি কিনা বলেন ভোলাবাবুর ক্লেইম-এর সময় এসে গেছে। তাঁর ইশারায় মারকুটে জোয়ান সিট ছেড়ে উঠে পড়ল, হাঁকডাকে চোয়াড় মার্কা কন্ডাক্টর মিইয়ে গেল।আর সবে পঞ্চাশ ছোঁয়া ভোলাবাবুকে অন্যের হাত ধরে বাস থেকে নামতে হচ্ছে, সিনিয়র সিটিজেনের অধিকার নিয়ে ভাষণ শুনতে হচ্ছে!
     
    পাকাচুল।

    সবের মূলে ওই সযত্ন রক্ষিত পাকাচুল।

    বাস থেকে নামার পর বোমকে যাওয়া ভাবটা কাটতেই এই চিন্তাগুলো মাথায় এল ভোলাবাবুর।
     
    অনেক হয়েছে, আর না।

    পাকাচুল দেখিয়ে সিট দখল করে ঘুম বা লাইন ভেঙে কার্যোদ্ধার আর না।
     
    এককাপ চা খেয়ে, শর্টকার্ট রাস্তা ছেড়ে বাজার ঘুরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন ভোলাবাবু। নতুন একটা স্পা না পার্লার খুলেছে ওখানে। পারলে আজই, বড়জোর কাল সকালে, পাকাচুলের একটা এস্পার ওস্পার করে ছাড়বেন। প্রকৃতির দান বিনা বাক্যব্যায়ে মাথায় নেওয়ার চেয়ে কিছু পয়সা ব্যয় করে মাথাটা বিউটিশিয়ানের সামনে বাড়িয়ে দেওয়াই ভালো।

    প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই তো মানুষ সভ্য হয়েছে।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন