তত্বমসি
আমি ছেলেবেলায় ক্লাস ফোর অবধি লেক ভিউ স্কুলে পড়েছি। স্কুলটা মোটেই পাতে দেওয়ার মত ছিলনা। আমার মামাবাড়ি তখন ছিল হিন্দুস্থান পার্কে, আমি তো সে বাড়িতেই মানুষ(?)।আমাদের পাশের বাড়ি ছিল বাঙ্গালবাড়ি, সে বাড়ির ছেলে মেয়েরা ছিল, মীরা, ইরা, গোপাল, বুড়ি। এরা পিওর বাঙাল ভাষায় কথা বলত। একদিন মীরাকে ডেকে বাবা জিজ্ঞেস করল, অ্যাই তুই কোন ইস্কুলে পড়িস রে? মীরা বলল, লেক ভিউ। নামটা বেশ হাই ফাই, বাবা বলল, ইস্কুলটা ভাল? মীরা বলল, হ্যাঁ, খু-উব ভাল। ওপিনিয়ন নেবার ব্যাপারে বাবা খুব লিবারাল ছিল। গয়লাকে জিজ্ঞেস করত, তুমারা দুধমে জল টল নেই হ্যায় তো? গয়লা দু কানে হাত দিয়ে বলত, রাম রাম, কি যে বোলেন –।
যেই মীরার ওপিনিয়ন পাওয়া গেছে, ব্যাস, কোনও খোঁজ খবর নেই, বাবা আমাকে নিয়ে সটান ইস্কুলে হাজির। হেডমাস্টার মশাইয়ের নাম ছিল মতিলাল দাশ। বাবা বলল, এটা আমার ছেলে, আপনার স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে এলাম। হেডস্যার বললেন, তা কি করে হবে, ফর্ম ফিলাপ করতে হবে, অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে – বাবা বলল, তা নাহয় দেবে। ও সব পারবে। - আরে পারবে বললেই তো আর হয়না, টেস্ট তো নেওয়া হয়ে গেছে। বাবা বলল, একটু দেখুননা, আমি তো ঠিক জানতামনা, জানলে আগেই নিয়ে আসতাম। - বয়েস কত? – এই পাঁচ পেরিয়ে ছয় চলছে। বেশ গাবলু গুবলু দেখতে ছিলাম, দেখে বোধহয় মতিলালবাবুর মায়া হল, বললেন, বাংলা থেকে ইংরিজী করতে পার? বলতো মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছে –এর ইংরিজী কী? মনে মনে বললাম, এটা একটা প্রশ্ন হল? মুখে বললাম, এ জেন্টল ব্রীজ ইজ ব্লোইং। - ওরেব্বাবা, পেরে গেলে? আচ্ছা বলতো ফাইভ ইন্টু ফাইভ কত হয়?- টোয়েন্টি ফাইভ। -ভেরী গুড, ঠিক আছে, তোমাকে আর টেস্ট ফেস্ট দিতে হবেনা। মোহিতবাবু, আপনার ছেলেকে ক্লাস টু-তেই নিয়ে নিলাম। ওয়ানে পড়বার আর দরকার নেই। যাও বাবা, ওই সামনের ঘরটায় গিয়ে বসে পড়, এক্ষুনি ক্লাস শুরু হবে।
‘ওই সামনের ঘরটা’ কে ঘর বলা যেতেই পারে, তবে ওটা স্কুলের দালান বাড়িটার বাইরের দিকে এক্সটেনশন। স্কুলবাড়িটার পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে, পাঁচিল ঘেরা খেলার মাঠটার দিকে যেতে ডান দিকের কোনে। পাঁচিল আর দালানের দুটো ইঁটের দেয়াল আর বাকি দুটো দরমার বেড়া দিয়ে ঘেরা। শালকাঠের বীমের ওপর টিনের ছাদ আর ঘরের মাঝে কয়েকটা শালবল্লার থাম।
ঘরটার এক তৃতীয়াংশ আবার একটা দরমার বেড়া দিয়ে আড়াল করা। সেখানে আমাদের স্কুলের দারোয়ানের সংসার। একখানা খাটিয়া, কিছু হাঁড়িকুড়ি, একটা তোলা উনুন আর বেড়ার গায়ে পেরেকে খাটানো নারকেল দড়িতে ঝুলন্ত তার খাকি ইউনিফর্ম, ধুতি ও গামছা।
পেরেকে অবশ্য আর একটা জিনিস ঝুলত, সেটা একটা ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডার তো থাকতেই পারে আর তখনকার ক্যালেন্ডার মাত্রই দেবদেবীর কিংবা প্রথিতযশা মানুষের ছবি। তবে এই ক্যালেন্ডার যারা ছেপেছে, তাদের বিক্রি ভালই। ক্যালেন্ডারে কেষ্ট ঠাকুর আছেন, কেউ কিচ্ছু বলতে পারবেনা। আর আছে এক পৌরাণিক কাহিনী, তাতেও কেউ কিচ্ছু বলতে পারবেনা, - গোপিনীদের বস্ত্রহরণ। গাছের ডালে শ্রীকৃষ্ণ, ফাজিল ফাজিল মুখ করে বাঁশী বাজাচ্ছেন, আর জলে নামমাত্র ডুবে বেশ কিছু নাদুস নুদুস তেল চুকচুকে রুবেনেস্ক মহিলা। ছবিটা আঁকবার সময়ে জলে তারা কতখানি ডুবে থাকবে সে ব্যাপারে পুরাণে বোধহয় স্পেসিফিক কিছু বলা ছিলনা, আর তাদের জামাকাপড় তো চুরিই গেছে, তাই তাদের খুব একটা দোষও দেওয়া যায়না তবে মাইনাস কেষ্ট ব্যাপারটা বেশ রগরগে।
দারোয়ানের নাম বোধহয় ছিল রাম। আমার পরের স্কুল অর্থাৎ জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনের দারোয়ানেরও নাম ছিল রাম। আসলে এই সব বিহারী রামভক্তদের অধিকাংশেরই নাম রাম দিয়ে শুরু হত, যেমন, রামসেবক, রামপূজন, রামপিয়ারী ইত্যাদি। পরের অংশটা কেটে ছোট করে, এরা সবাই রাম। যাই হোক, সেই লেকভিউএর রাম ছিল বেশ রাগী রাগী দেখতে। ইউনিফির্মের ওপরের অংশটা গায়ে চাপালেও কোমরে থাকত একটা গামছা। তখনকার খাকি ইউনিফর্ম বেশ মোটা সুতী কাপড়ের হত, তাই গ্রীষ্মকালে তার গায়ে খাকি জামাটা থাকলেও তার সব কটা বোতামই থাকত খোলা। দারোয়ানজীর বুক পেট জুড়ে ছিল বাংলা ৩ এর মত গোল গোল লোম। ভুঁড়িটা এত বড় ছিল, যে জামার বোতাম লাগালেও তা বেশীদিন থাকার কথা নয়।
ক্লাসে ঢোকার সময়ে প্রায়ই তাকে দেখতাম একটা পেতলের কাঁসিতে আটা বা ছাতুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। দারোয়ানজীর ঘরটা আলাদা হলেও তার আলাদা দরজা ছিলনা। আমাদের ক্লাসে ঢোকার দরজা দিয়ে ভেতরে গিয়ে বাঁদিকে দরমার বেড়ায় একটা দরজার মাপে কাটা, তাতে একটা দরমার দরজা লাগানোও ছিল, তবে সেটা সবসময় ভাঁজ করা থাকত। ক্লাসে ঢুকতে গেলেই আমার চোখ পড়ে যেত ওই ক্যালেন্ডারের দিকে। তখন ক্লাস টু তে পড়ি, কিছুই বোঝার বয়স হয়নি, তবু এটা বুঝতাম, বেশীক্ষণ ওদিকে তাকানো দৃষ্টিকটু, তাই কেউ কাছাকাছি এলেই তাড়াতাড়ি কৃষ্ণের উদ্দেশে কপালে ঘন ঘন হাত ঠুকতাম।
লেকভিউ স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ত। তখন এই ব্যাপারটা অনেক স্কুলেই চলত, মেয়েদের স্কুলেও নীচের দিকে কয়েকটা ক্লাস ছেলেরা পড়তে পেত। আমার পাশে বসত একটা মেয়ে, তার নাম অন্নপূর্ণা, তবে সে বলত ‘অন্যপুন্না’। মেয়েটি আমার চাইতে মিনিমাম চার ইঞ্চি লম্বা, নিকষ কালো, গোল গোল চোখের মণি দুটো ঠিক মাঝখানে, চোখের দিকে তাকালেই ভয় করত। তার ওপর তার সামনের দাঁতগুলো ছিল কোদালের মত। সে খুব মোলায়েম করে কথা বললেও মনে হত ঝগড়া করছে। মাথার ঘন তেলতেলে চুলে সে ইয়াব্বড় লাল ফিতে বেঁধে আসত।
তাকে সবাই ভয় পেত, কিন্তু সে আমার খুব বন্ধু হয়ে গেছিল। অন্যরা যখন আমাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে ভেবে কেমন কেমন করে তাকাত, তখন কিন্তু ‘অন্যপুন্না’ আমাকে মোলায়েম করে তার সুখ দুঃখের কথা শোনাচ্ছে। আর একটা অ্যাডভান্টেজও ছিল। সব স্কুলের মত ওই স্কুলেও বেশ কিছু বদমাশ ছেলে ছিল, তারা আমার মত ভালমানুষ পেলেই র্যাগিং করত, কিন্তু যেহেতু অন্যপুন্না আমার বডিগার্ড, আমার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতে সাহস করতনা।
আমাদের ইস্কুলের উল্টোদিকে ছিল এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের মস্ত বড় চেম্বার আর তার পাশেই ছিল একটা ছোট্ট দোকান, যাতে খুব লোভনীয় কটকটি, হজমি, চানাচুর ইত্যাদি পাওয়া যেত। আমাদের বাড়িতে ছোটদের হাতে পয়সা দেওয়ার রেওয়াজ ছিলনা। আমি কলেজে পড়া ইস্তক ট্রামভাড়া ছাড়া কিছু পাইনি। তার ওপর রাস্তার জিনিষ খাবার ওপর ছিল কড়া পাবন্দি। এদিকে অন্যপুন্না পীরিতের টানে প্রায়ই ঐ দোকান থেকে চানাচুর এনে খাওয়াতো। ব্যাপারটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছিল। বাড়িতে কখনও সখনও যে সব সফিস্টিকেটেড চানাচুর খেয়েছি, তার তুলনায় এই সস্তা চানাচুরের ঝালঝাল টকটক স্বাদ ছিল অনেক লোভনীয়।
একদিন টিফিন টাইমে অন্নপূর্ণার দেখা পাচ্ছিনা, কোথায় গেছে কে জানে, এদিকে সময় প্রায় শেষ হয়ে এল বলে। অনেকক্ষণ ধরে দেখতে পাচ্ছি অন্নপূর্ণার পেন্সিলবক্সটা হাট করে খোলা, আর তার মধ্যে একটা রাজার মাথাওয়ালা চৌকো দুআনি। কি মনে হল কে জানে, ভাবলাম অন্নপূর্ণাতো চানাচুর আনবে বলেই পয়সাটা রেখেছে, এদিকে ঘন্টা পড়ল বলে। যাই, আমিই নিয়ে আসি। পয়সাটা তুলে নিয়ে দৌড় দিলাম, হাঁফাতে হাঁফাতে দোকানে গিয়ে বললাম, দু জায়গায় এক আনার চানাচুর দিনতো। দোকানদার দুটো ঠোঙা হাতে ধরিয়ে দিল। বললাম, ফেরৎ এক আনা?
দোকানদার বলল, তুমি তো এক আনা করে দু জায়গায় বললে। আমি বললাম, মোটেই না, আমি এক আনার চানাচুর দু জায়গায় চেয়েছি। নাদুস নুদুস ফর্সা গোলগাল ছেলেটাকে দোকানদার আগে দেখেনি। নতুন মুরগী পেলে তখনকার দোকানদারও ছাড়তনা, সে বলল, এক আনার চানাচুর দু জায়গায় দেওয়া যাবেনা। আমি বললাম, তবে একটা ফেরৎ নিয়ে এক আনা দিন। সে বলল খাবার জিনিষ ফেরৎ হয়না। এদিকে ঘন্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, এরপর আর তর্ক করার সময় নেই, বেশ বুঝলাম, ঠকেছি। অন্নপূর্ণা এই সাইজেরই দুটো ঠোঙা এক আনায় আনে।
একছুটে রাস্তা পেরিয়ে ক্লাসে ঢুকে অন্নপূর্ণার খাতার পাশে একটা ঠোঙা রেখে আমারটা মুঠোয় নিয়ে সবে মুখে একটু দিয়েছি, অন্নপূর্ণা হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে ফিরে এল। কিরে, খুব চানাচুর খাচ্ছিস, আমায় দিবিনা ? হ্যাঁ হ্যাঁ ঐ তো তোর ঠোঙা। অন্নপূর্ণাকে বেশ চমকে দেব ভাবলাম। ঠোঙাটার পাশেই পেন্সিলবক্স, সেদিকে তাকিয়েই ছানাবড়া চোখদুটো আরও বড় হয়ে গেল। আমার দু আনা? কোদাল দাঁতগুলো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। নাকের পাটা ফুলে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস পড়ছে, - আমার দু আনা কোথায়? চিল চীৎকার। ক্লাস শুদ্ধু দেখছে, -তুই চুরি করেছিস? আমি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলাম, তোর জন্যে তো এনেছি, -খাবনা আমি। এক ঝটকায় ক্লাসের মেঝে চানাচুরময় হয়ে গেল। বাকি এক আনা কোথায়? চোর –
ক্লাসের তিরিশ জোড়া চোখ আমায় দেখছে। আমাদের বাড়ির শিক্ষা, পথে টাকা পড়ে থাকলে, সেটা তোলা দূরে থাক, সেদিকে তাকানো বারণ। আমার ফর্সা টুকটুকে রঙ, আমার বড় বাড়ির আভিজাত্য, আমার পারিবারিক ঐতিহ্য গলে গলে খসে পড়ছে। বোঁ বোঁ করে মাথা ঘুরছে, একটা প্রতিধ্বনি মাথার ভেতর পাক খাচ্ছে –চোর- চোর-চোর।
রাত্তিরে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি, - একটা তেপান্তরের মাঠের মধ্যে দিয়ে আমি প্রাণপন ছুটছি, দিগন্ত জুড়ে ‘অন্যপুন্না’র খ্যানখ্যানে গলার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে, চোর – চোর -, আমার পেছনে তেড়ে আসছে রাম। একহাতে কোমরের গামছা চেপে ধরে সে ধাওয়া করেছে আমাকে। কবজি অবধি আটা মাখা অন্য হাতে ধরা আছে স্কুলের সবচেয়ে বড় বেতটা। রাম যত ছুটছে বেতটা তত লম্বা হচ্ছে, বুকখোলা খাকি জামাটা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে, ছোটার তালে তালে তার রোমশ ভুঁড়িটা খপর খপর করে দুলছে। তার পেছনে ছুটছে জল থেকে সদ্য উঠে আসা তেল চুকচুকে গোপিনীদের দল। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দেখি সামনে মতিলাল দাশ। তাঁর গায়ে একটা গোলাপি রঙের জামা, যার তিনটে বোতাম তিন রঙের। দু হাতে মুখ ঢেকে ককিয়ে উঠি, আর মারবেননা স্যার।
খিলখিল করে হাসি শুনে ওপরে তাকিয়ে দেখি আমার চেয়ে একটু বড় একটা ছেলে গাছের ডালে বসে পা দোলাচ্ছে। তার গায়ের রঙ শ্যামলা, পরণে একটা বাসন্তী রঙের ধুতি। তার হাতে একটা বাঁশী আর মাথায় বড় বড় চুল ঝুঁটি করে বাঁধা, তাতে গোঁজা ময়ূরের পালক। সে বলল, কিরে, হলতো? আমার সেই ফেমাস কথাটা মনে নেই?
আমি বললাম খুব মনে আছে।- ‘কর্মণ্বি বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’। আরে ফলের দিকে না তাকিয়ে কাজ করতেই তো এই বিপদ। প্রথম কথা, আমি নিজেই চোর, আবার চোরকে মারতে গেছি। ও ব্যাটা যদি সবার সামনে হঠাৎ ‘তত্বমসি’ বলে দিত? যদি বলত, নিজেকে চিনতে পারছেননা স্যার? আমার নাম পি সি সরকার। এই দেখুন হাতের মুঠোয় ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেলফোন। দেখুন আবার মুঠো খুলছি, - হোকাস পোকাস গিলি গিলি – এই দেখুন অন্যপুন্নার দু আনা।
কেষ্টদা বলল, আমি মোটেই ও কথা বলিনি। আমাদের পুরাণ টুরাণ খুব গোলমেলে। অর্জুনবাবুর ড্রাইভার কেষ্ট আর আমি কেষ্ট এক লোক নাও হতে পারি। বলতে পারিস কাত্তিক কার ছেলে, দুগগার না গঙ্গার? বলতে পারিস সরস্বতী বেম্মার মেয়ে না বৌ? শিব ঠাকুরের বৌ কটা? দুগগা, উমা পার্বতী এক না আলাদা? তবে হ্যাঁ, গ্রেট মেন থিঙ্ক অ্যালাইক, তাই ঐ কেষ্ট যা বলেছে আমার তাতে দ্বিমত নেই। তবে আমার এক্সপ্ল্যানেশন অন্য। - সেটা কিরকম ? কেষ্টদা বলল, ভেবে দেখ, কার money-ই বা অধিকার করিস?(কারমাণি বাঅধিকার হস্তে) এই issue কখনও muffle করবিনা (মাফল ইসু কদাচন)। বললাম,- যা ব্বাবা, কোথা থেকে কী টেনে আনলে।
কেষ্টদা বলল, কী নিয়ে পড়েছিস? বললাম, ইংরিজী।
– ব্যাঙ্কে কী কাজ করিস?
– ক্রেডিট অ্যানালিসিস।
– তা সেখানে ইংরিজী সাহিত্য কী কাজে লাগে?
- না-তেমন কিছু না।
- তা হলে করিস কিকরে?
- নানা রকম ট্রেনিং নিয়েছি, কাজ করতে করতে শিখেছি।
- ওই সেলফোন চোরটাকে ট্রেনিং দিলে পারতনা?
- পারত হয়ত, কিন্তু তার কী সম্পর্ক এর সঙ্গে?
- বুঝলিনা, কার মানি অধিকার করেছিস? অন্যপুন্নার দু আনা তো তুচ্ছ।
বললাম, দেখ, বাজে কথা একদম বলবেনা। তুমিও তো চোর। এই তো কত শাড়ি চুরি করে টাঙিয়ে রেখেছ, টাঙ্গাইল, ধনেখালি, বেগমপুরী – কেষ্টদা আবার খিলখিল করে হাসল, ওরে মাথামোটা, রীড বিটুইন দ লাইনস। আই হ্যাভ নট স্টোলেন দেয়ার গারমেন্টস, আই হ্যাভ টেকন অ্যাওয়ে দেয়ার ইনহিবিশন। বললাম, ছাড়, ছাড়, তখন বাচ্চা ছিলাম, ভাল করে বুঝতামনা। তুমি একজন পাক্কা ভয়ারিস্ট। কেষ্টদা মিষ্টি করে হাসল, তাই ? রাম দারোয়ানের ঘরের বাইরে হাঁ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত কে? তুই না আমি? তত্বমসি ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিস তো ? তৎ ত্বম অসি। আমি, তুই, সেলফোন চোর, সব একই লোক, হি হি।
মিথ্যেন্দ্র
ধানাই পানাইতে কোনও সময়ের ধারাবাহিকতা নেই। উনিশশো চুয়ান্ন সালের পরে উনিশশো আটানব্বই আসতে পারে, আবার উনিশশো চৌষট্টিতে ফিরেও যেতেপারে। এই ঘটনা দুই হাজার এগার সালের, একেবারে টাটকা। গত ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারী থেকে একজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। পৃথিবীতে রোজ বহু মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়, আমাদের ভারতবর্ষে তো যায়ই। তাদের অধিকাংশেরই কোনওদিন হদিশ মেলেনা। এক্ষত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তিনি নিজেই নিজেকে নিখোঁজ করেছেন, মানে, সোজা কথা, লুকিয়ে আছেন। এমন ভাবে লুকিয়েছেন, যে পরিবারের সকলেও জানেনা তিনি কোথায়।
ভদ্রলোকের নাম সুরেন্দ্র কুমার সিং। তিনি বিহার গভর্নমেন্টের একজন এক্সিকিউটিভ এঞ্জিনীয়র, কর্মস্থল – মুজফ্ফরপুর। তা তিনি হঠাৎ এভাবে লুকিয়ে আছেন কেন? প্রাণের ভয়ে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার টাকা পয়সা এঁর হাত দিয়েই মঞ্জুর হয়। এঁকে কন্ট্র্যাক্টররা বলেছে, এই যোজনার বরাদ্দ বাহান্ন কোটি টাকা ‘ছেড়ে’ দিতে। কাজটা আদৌ হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন নাকি অবান্তর।
এক্সিকিউটিভ এঞ্জিনীয়রের ঐ পদটি গত ছ-মাস ধরে খালি ছিল (দেখা যাচ্ছে, ন্যায্য কারণে)। মাত্র পনের দিন হল ভদ্রলোক কাজে যোগ দিয়েছেন। ভদ্রলোকের শঙ্কা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ, বিহার এঞ্জিনীয়ারিং সারভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান, রাম স্বরূপ শাহ বলেছেন, মিস্টার সিং কে বাহান্ন কোটি টাকার বরাদ্দ আটাশে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে খরচ হিসাবে দেখাতে তাঁর উচ্চ পদাধিকারীরা আদেশ দিয়েছিলেন, যেখানে কোনও কাজই হয়নি। ( টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ০৩/০৩/২০১১)
কে বলল কাজ হয়নি? গুণমানের প্রশ্ন উঠলে আলাদা কথা, সে ভারতবর্ষে কোথায়ই বা সরকারি কাজে ‘গুণমান’ বজায় থাকে, তবে ন-কোটি টাকার কাজ ‘নাকি’ হয়েছে শোনা যাচ্ছে। তাহলে অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। একেবারে কোনও কাজ না করে টাকা ছাড়তে বলা হয়নি, ন-কোটির কাজের বিনিময়ে বাহান্ন কোটি চাওয়া হয়েছে, না দিলে প্রাণে মারার হুমকি, এই মাত্র।
এরকম ঘটনা তো বিহারে নতুন নয়, যোগেন্দ্র পান্ডে নামে আর একজন এক্সিকিউটিভ এঞ্জিনীয়রকে বিহারের সীতামারি ( সিতামারহি) জেলায় তো প্রাণই দিতে হল ঠিক এই ভাবে কন্ট্র্যাক্টরদের জুলুম না মানার জন্য। এসব বিহারে কোনও ব্যাপারই না।
এগুলো নিয়ে খুব একটা হৈ চৈ হয়না। হয়না তার কারণও আছে।
- এই যে দাদা, শুনছেন – ও ভাই, ভাই-ই বলি, অনেক ছোট আপনি। আচ্ছা, রিজওয়ানুর রহমানের নাম শুনেছেন?
- শুনবনা? কি যে, বলেন, টিভি থেকে নাকি? বুম কই?
- নন্দীগ্রামের ঘটনা মনে আছে ?
- থাকবেনা? পুলিশ-হার্মাদ জয়েন্ট অ্যাকশনে চোদ্দ জন নিরীহ গ্রামবাসী –
- মোমবাতি জ্বেলেছিলেন?
- জ্বালবনা? যে কেউ জ্বালবে।
- সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের জন্যও জ্বেলেছিলেন নিশ্চয়?
- কে সাধুচরণ?
- ওইযে, নন্দীগ্রামে যাকে টুকরো টুকরো করে কাটা হল, ঐ গুলি চালানোর ক’দিন আগে?
- হার্মাদ নাকি?
- না, সাদা পোষাকের নিরস্ত্র পুলিশ।
- ও একই হল।
- যোগেন্দ্র পান্ডের জন্য মোমবাতি?
- ধুর মশাই, কাজ নেই নাকি? যত সব ভুলভাল নাম –
- এক সেকেন্ড, বেশী সময় নেবনা। চাকরী করেন?
- ডেফিনিটলি।
- ইনকাম ট্যাক্স দেন?
- দেবনা? কান মুলে টিডিএস কাটে বছরে পাক্কা আড়াই মাসের মাইনে।
- যোগেন্দ্র পান্ডে আপনার ট্যাক্স দেওয়া টাকাটা বাঁচাতে গেছিলেন। মোমবাতি জ্বালবেন?
- দাদা, প্লীজ যান তো, বোঝাই যাচ্ছে কোনও কাজ নেই, যত্তো সব –
ট্যাক্সের টাকার কথা বলাটা উচিত হয়নি। পূজোয় এক হাজার এক টাকা চাঁদা দেবার পর কি কেউ হিসেব নিতে যায়, প্যান্ডালে বা প্রতিমায় ক’টাকা লাগল? সরকারি তোলাবাজি দেখেই ছোট তোলাবাজরা শেখে। যা গেছে তা গয়ং গচ্ছ ধরে নিয়ে দেখতে হবে বাঁ হাত দিয়ে এর মধ্যে কতটা রিকভার করা যায়।
যোগেন্দ্র পান্ডের নাম না শুনলেও সত্যেন্দ্র দুবের নামটা বোধ হয় শুনেছেন ভদ্রলোক। কাগজওয়ালারা কদিন ধরে লাগাতার ছেপেছিল তো ব্যাপারটা – ওটা জিজ্ঞেস করলে হ’ত।
সত্যেন্দ্র দুবে ছিলেন ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার প্রোজেক্ট ডিরেক্টর। তখন প্রাইম মিনিস্টারস গোল্ডেন কোয়াড্রিলেটারাল বা প্রধানমন্ত্রীর সোনালী চতুর্ভুজ যোজনায় বাহান্ন ফাহান্ন নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা লুঠ হচ্ছিল। সত্যেন্দ্র দুবে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে ‘স্ট্রিক্টলি প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেনশিয়াল’ চিঠি পাঠিয়েছিলেন, কী হচ্ছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে। প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেনশিয়াল চিঠি মানেই চূড়ান্ত গোপনীয়। তিনি তাও বারংবার অনুরোধ করেছিলেন তাঁর নামটা গোপন রাখার জন্য। নাম গোপন দূরে থাক তাঁর সেই চিঠিটাই সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল লুন্ঠনকারীদের দপ্তরে। দুহাজার তিন সালের নভেম্বর মাসে গয়ায় সার্কিট হাউসের সামনেই সত্যেন্দ্র দুবেকে গুলি করে মারা হয়।
এই হাজার হাজার কোটি টাকার সূতোর ওমাথাটা কতদূর যায় তা বুঝতে ব্যোমকেশ, ফেলুদা, বিদ্যা বাগচী, কাউকে ডাকার দরকার নেই। আমাদের দেশে শুধু ধনঞ্জয় চ্যাটার্জীর ফাঁসির জন্য কেঁদেকেটে পথনাটক করে কেউ কেউ। যাদের ফাঁসি হলে সমাজের প্রভূত উপকার হত, তাদের বেশ কয়েকটা প্রোমোশন হয়ে গেছে ইত্যবসরে।
উনিশশো সাতাত্তর সাল। আমার এক বন্ধু ছিল, স্বপন ( নাম পাল্টানোর ব্যাপারটা চলছেই)। পিডব্লুডি দপ্তরের ছোট এঞ্জিনীয়র। এককালে নকশাল টকশাল হয়েছিল, তখন সিপিয়েম। সেটা প্রমোদ দাশগুপ্তের আমল, খুব আদর্শবাদী ছেলে, চিন্তাধারায় ঘোর কমুনিস্ট। গড়িয়ার দিকে তখন একেবারে ফাঁকা, শেয়াল টেয়াল ডাকে। একটা কালভার্ট হয়েছে, সে ইন্সপেকশানে যাবে। অফিসের কর্মীরা হাসাহাসি করেছিল, এই সব ছুটকো ছাটকা কাজ কেউ ইন্সপেক্ট করেনা স্যার, এখানে বসেই সই করে দিন। স্বপন এ কথার উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করেনি, বেরিয়ে গেছিল। আমার আর এক বন্ধু, বেকার। কোনও কাজ নেই, তাই ওর সঙ্গে গেছিল। তার মুখ থেকে শোনা –
সাইটে গিয়ে দেখা গেল, কাজ ভাল মত শুরুই হয়নি, শেষ তো দূরের কথা। স্বপন ফিরেই আসছিল, দূর থেকে জনা তিনেক লোককে আসতে দেখা গেল। মাঝখানের মোটামত লোকটা হাঁকছিল ও স্যার, ও স্যার -। স্বপনরা দাঁড়াতে কাছে এসে একসারি দাঁত বের করে একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরল,- অটোগ্রাফটা স্যার – স্বপন বলল, কী এটা? দাঁত বলল, আমার বিলটা স্যার। স্বপন বলল, এখানে কেন? বিল অফিসে জমা দেবেন, তা ছাড়া পুরো মালই তো পড়েনি, এখনই বিল কিসের? দাঁত বলল, ওই যা পড়েছে ওতেই ছেড়ে দ্যান স্যার, এই রকমই হয়ে আসছে। বলে, পেট চুলকোতে আরম্ভ করল। যত চুলকায়, টি শার্টটা তত ওপরে ওঠে। উঠতে উঠতে এক সময়ে রিভলভারের বাট টা দেখা গেল।
স্বপন বলল, ও, এই ব্যাপার? বলে পা চুলকোতে শুরু করল। তখন সবাই বেল বটম যাতীয় ঢোলা প্যান্ট পরত, সহজেই ওপরে ওঠে। বেশ খানিকটা তোলার পর গুলির দাগ গুলো প্রকট হল, বন্ধুকে বলল, তিনটে বেরিয়েছে, দুটো এখনও আছে, খুব চুলকায়, জানিস-। দাঁত ক্যালানো লোকটার হাঁ করা মুখের সামনে দিয়েই জিপটা ভুস করে ধোঁয়া ছেড়ে চলে এল।
সপ্তমীর চায়ের দোকান। আমি আর স্বপন। স্বপন ছোট ছোট টানে ফুক ফুক করে সিগারেট খেত, আর অল্প অল্প ধোঁয়া ছাড়ত। ধোঁয়া ছাড়ার ফাঁকে ফাঁকে বলল, দেখ, তুই সৎ থাকতে চাইলে কোনও বাঞ্চোতের ক্ষমতা নেই তোকে অসৎ বানায়। আশার কথা কি জানিস? যুগ পাল্টাচ্ছে। আমার মত অনেক আদর্শবাদী ছেলে আসছে সরকারি চাকরীতে। পশ্চিম বাংলাটা পুরো বদলে যাবে, দেখিস –
উনিশশো একাশি সাল। তখন চুটিয়ে ফোটগ্রাফি করছি, নিজের বাড়িতে ল্যাবও হয়েছে। এক গুণগ্রাহী ছিল, শিবু ( এ নামটা জেনুইন)। একদিন বলল, কী সব কোলকাতায় ছবি তোলেন, কোলকাতায় আছেটা কী, আমাদের গ্রামে চলুন, আপনার সাবজেক্টের ছড়াছড়ি। আমাদের বিশাল বাড়ি ফাঁকাই পড়ে থাকে। বাবা একলা থাকেন, কথা বলার লোক পেলে খুব খুশী হবেন। চললাম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে।
তিন দিন ধরে প্রচুর ছবি তোলা হল। শিবুর বাবার আতিথেয়তায় প্রাণ যায় যায়। কিন্তু বাড়ি তো ফিরতেই হবে, ট্রেনের সময় দেখে বেরোলাম। শিবু বলল রিক্সো ধরবেননা, আমার বাইকের পেছনে চলুন। বাইক স্টার্ট করে খানিকদূর গিয়ে ও বলল, আরে, এতদূর এলেন, আর আপনার বন্ধুর বাড়ি ঘুরে যাবেননা? – কে বন্ধু? – আরে স্বপনবাবু, উনি যেখানে আছেন, দারুণ জায়গা, একেবারে পিকচারেস্ক। এখান থেকে মাত্র পাঁচ-ছ কিলোমিটার, যাবেন? বলছিস যখন, ঘুরেই যাই, একরাত্তির তো থাকা যাবে, ছুটি কাল শেষ।
আমাকে দেখে স্বপন তো আহ্লাদে আটচল্লিশ। আ-রে রূপু, খি ভ্যাপার! খি-ভ্যা-পা-র! কি ব্যাপার রে? কোত্থেকে উদয় হলি? আচ্চয্য! ভেরি আচ্চয্য – আয় আয়,বোস বোস-। আদিখ্যেতা শেষ হতেই বলল, চ, খেয়ে নি। আমরা আবার সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যেই ডিনারটা সেরে ফেলি। শরীরটাতো রাখতে হবে-
এটা সরকারি কোয়ার্টার। বসবার ঘরের পেছনেই ডাইনিং রুম। ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজন, আমাকে নিয়ে তিন। টেবিলে বসেই দেখলাম, ভাত, ডাল, স্যালাড যা থাকবার আছে। তার সঙ্গে বিরাট দুটো রেকাবিতে রুই মাছের কালিয়া আর ইলিশ মাছের পাতুড়ি । কোনও মাছের পিস দেড়শো গ্রামের কম নয়, সংখ্যায় তারা কুড়ি পঁচিশ তো হবেই। ভাত নাড়তে নাড়তে ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করলাম, তুই জানতিস, আমি আসছি? স্বপন বলল, পাগল নাকি? আমি তো একেবারে অবাক!
খাবার পর বসার ঘরে এসে দেখি, স্বপন এখন সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দেয়। সিগারেট গুলোও লম্বা লম্বা। সোজাসুজি বললাম, ঘুষ খাচ্ছিস? স্বপন বলল, হ্যাঁ। মিনিট দুয়েক দুজনেই চুপচাপ। বললাম, আদর্শ ? কমিউনিজম ? ও একটা লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, এ দেশে হবেনা রে, কুমীরের সঙ্গে ভাব না করে জলে থাকা যাবেনা।
স্বপন বলল, আমি জয়েন করার ক’দিন পরই আমার বস, মানে এক্সিকিউটিভ এঞ্জিনীয়র কাজে যোগ দিলেন। আমরা দুজনেই নতুন। একদিন একটা কালো মোষের মত ধুতিপরা লোক বাইক চালিয়ে এল। বসের টেবিলের সামনে ধপাস করে বসে বলল, নমস্কার স্যার, আমি সামন্ত। আমার বস খুব ধার্মিক এবং ভিতু টাইপের লোক। বললেন, হ্যাঁ বলুন কী চাই? লোকটা বলল, না স্যার সব সময় কি চাওয়া যায়? এই এটা দিতে এলাম, বলে একটা সাদা খাম রাখল টেবিলে। খামটা মুখ বন্ধ নয়, তাই চকচকে নোটগুলো পেটমোটা খামের ভেতর থেকে দিব্যি দেখা যাচ্ছিল। বস ভুরু কুঁচকে বললেন একী? এক্ষুনি এসব নিয়ে এখান থেকে বিদেয় হোন।
লোকটা এবার একটা চকচকে রিভলবার বের করে খামটার পাশে রেখে একগাদা পান খাওয়া থুতু ছিটিয়ে বলল, এটার আবার লাইসেন নেই স্যার। তা বড়বাবু সবই জানেন, আমার লাইসেন টাইসেন লাগেনা।
আমার বস খুব ভিতু লোক আগেই বলেছি। উনি বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনার বিল টিল পাস করে দেবখন, আপনি এটা সরান, আর ওটাও নিয়ে যান।
সামন্ত বলল, তা কিকরে হবে স্যার, এর মধ্যে তো সবার অংশ আছে। আপনার ডিপার্টমেন্টের সব কর্মচারীর মাইনের মত হিসেব স্যার। মাসের পোথোমেই হিসেব হয়। দেখবেন কারো ভাগে হয়ত তিনশো সাতাশি টাকা পঁচিস পয়সা পড়েছে। যদিও বেশীর ভাগটাই আপনার। তারপর আরো অনেকখানি পান খাওয়া থুতু ছিটিয়ে বলল, আমাদের কাছে খপর আছে স্যার, আপনি খুব ধাম্মিক। তা ভারত সেবাস্যম, রামকেষ্ট মিশন, এসব আছে কি করতে? পাপের টাকা দান করে দিবেন। পাপ করতে না চাইলে কেউ কি স্যার জোর করে করাতে পারে? হেঁ হেঁ-
যাবার সময় বলল, যাই স্যার, দেখবেন কুন্ডুবাবুর মত আবার বাঁশবাগানে আপনার বডি না পাওয়া যায়। বড়বাবু সব জানেন স্যার, চলি?
স্বপন বলল, কিছু করার নেই রে রূপু, লম্বা সিগারেট খাবি? বিদেশী। এখন তো আর কিনতে হয়না।
স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বহু বছর। খবর পেয়েছিলাম, এক্সিকিউটিভ এঞ্জিনীয়র হয়েছে, তারপর বোধহয় সুপারিন্টেন্ডিং এঞ্জিনীয়রও হয়েছিল। আর কোনও খবর নেই।