জন-পল
না, কোনও পোপ টোপের নাম নয়, জন একটা কুকুরের নাম, পল পরে আসছে। এই কুকুরের নাম ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত। আমি খুব ছোটবেলা থেকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি, পারছিনা। আচ্ছা এই যে লোকে বলে, ছি, ছি, ছি আমি অমন কাজ করতে পারি ? যদি এটা আমার কাজ হয়, তাহলে আমার নামে কুকুরের নাম রাখিস। কেন ভাই, কুকুরের নাম রাখব কেন? প্রথম কথা পশুপাখিদের মধ্যে মানুষের সবচেয়ে কাছের প্রাণী। সবচেয়ে উপকারী, প্রভুভক্ত, রক্ষাকারী, নির্বিরোধী, তবু এই বদনাম ? কাউকে কুত্তা বললে আর রক্ষা নেই। এই যে ষাট সত্তরের দশকে, বোম্বের সিনেমায় ধর্মেন্দ্র রাগী মুখ অথচ কাঁদো কাঁদো গলা করে বলত, কুত্তে, কামীনে, ম্যায় তেরা খুন পী যাউঙ্গা- এর কারণটা কি ? কুত্তাই শুধু কামীনা ? তা ছাড়া লোকটাকে সবসময়ে কুত্তে, কামীনে, মানে বহুবচনে সম্বোধন করা হত কেন তাও বুঝতামনা। গৌরবে বহুবচন হয় জানি, ধিক্কারেও হয় ? নাকি ভিলেনগুলো সবকটা একত্রে কুত্তে ।
কাউকে কুত্তা বললে, সে রেগে যাবে, মারতে পারে, গালাগাল তো দেবেই। অথচ কাউকে বেড়াল বললে আহ্লাদি আহ্লাদি মুখ করবে। এদিকে বেড়ালের মত হাড় হারামজাদা দুনিয়ায় নেই। ব্যাটাচ্ছেলে আদর খাবে, বিছানায় ঘুমোবে, শ্রেষ্ঠ খাবারটি খাবে, সামান্য বাসি হলে নাক সিঁটকে মুখ ঘোরাবে, কিন্তু কোনও উপকারে আসবেনা, কিচ্ছুটিনা। ওদিকে আন্দামানে সুনামিতে ভেসে যাওয়া সাত বছরের ছেলেকে কুকুর জলে ধাওয়া করে সারা দিন টেনে ভাসিয়ে রেখে পরের দিন স্রোত কমলে পাড়ে নিয়ে এল জ্যান্ত। তাও আবার নেড়ি কুকুর। তবু, তবু কত বদনাম।
শুধু ভিলেন বা খারাপ লোকের নাম নয়, কুকুরের নাম প্রচন্ড কম্যুনালও বটে। যারা ওপার বাংলা থেকে ডিস্পপ্লেসড বা দাঙ্গায় অ্যাফেকটেড তাদের অনেকেরই ক্ষোভ ছিল। সঙ্গত কারণেই ছিল। ইন্দ্রজিতদের বাড়ির সাদা ভুটিয়াটার নাম ছিল ভুট্টো। প্রথমে ভাবতাম ভুটিয়া বলে মিলিয়ে নাম, পরে শুনলাম তা নয়। তখন অবশ্য আমরা কেন, আমাদের বাবারাও ভুট্টোর নাম শোনেনি। তিনি তো প্রথমে প্রেসিডেন্ট, পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সত্তরের দশকের গোড়ায়। আমাদের ছেলেবেলায় ভুট্টো কোথায়? ইন্দ্রজিতের দাদু অবশ্য বলতেন পাকিস্তানে ও-ই সব। লাইন অফ কন্ট্রোলের ওপারেও হয়তো কোনও জহরলাল চেনে বাঁধা থাকত, তবে আমার তা জানা নেই। সুনির্মল সাহার নেড়ি কুকুরটার নাম ছিল কাশেম। যেখান থেকে তাড়া খেয়ে ওরা পালিয়ে এসেছিল, সেই গ্রামে কোনও এক কাশেমের বাড়িতে সুনির্মল নামে পোষা কুকুর থাকলেও থাকতে পারে। সেটাও আমার জানা নেই।
আমাদের পাড়ায় কম্যুনালিজমের চুড়ান্ত, তবে এখানে নামে নয়, কথায়। আগেই বলেছি, এটা বিহারী পাড়া। আমরা কয়েকঘর বাঙালি স্বদেশে প্রবাসী। বংগালি বংগালি বলে কটু কথা, টিটকিরি, মোটামুটি গা সওয়া। আগে ওরা শুধু বস্তিতে থাকত, এখন নতুন গজিয়ে ওঠা অ্যাপার্টমেন্ট গুলোয় বেশির ভাগই ওদের দেসোয়ালিরা এসেছে। ওদের মধ্যে যারা পরিষ্কার বাংলা বলত আগে, সংখ্যায় অ্যাবসলিউট মেজরিটি হয়ে যাবার পর বাংলা বাধ্য হয়ে বলতে হলে, এখন বিচিত্র উচ্চারণে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলে। কিন্তু কুকুরের বেলা পুরো রামমোহন বা ঈশ্বরচন্দ্র।
দীনেশদের ছাদে একদিন পরিষ্কার শুনলাম, ওর ভাইজি ওদের অ্যালসেশিয়ানটাকে বলছে, অত হ্যাংলা কেনরে, খেতে পাসনা বাড়িতে ? অথচ ওদের বাড়িতে কেউ কারো সঙ্গে বাংলায় কথা বলছে ভাবাই যায়না। এস টি ডি বুথের ভিনেয় (বিনয়) একদিন শুনি একটা নেড়ি কুকুরকে বলছে, এখন যাও, যাও বলছি, বিরক্ত কোরনা, বিস্কুট ফিস্কুট নেই এখন। এই সব কথা বলার সময় ওরা দুজনেই আড় চোখে আমার উপস্থিতি মেপে নিয়েছিল। তাই শুনে আমিও গেটের সামনের রাস্তার কুকুরগুলোকে গায়ে পড়ে বলে আসি, অব কেয়া চাহিয়ে, ইয়ে কোই খানেকা ওয়ক্ত হ্যায় কেয়া ? সামকো আনা, রোটি উটি মিল যায়েগা। চেঁচিয়েই বলি, গায়ের জ্বালা যতটা মেটানো যায় আর কি। ঐ ভিনয়ের একটা পোষা আদুরি বেড়াল ছিল। তার সঙ্গে কথাবার্তা অবশ্য বরাবরই হিন্দিতে।
সাহেবরাও কম যায় নাকি, 'লীডিং আ ডগ'স লাইফ', 'দা ডার্টি ডগ', 'গিভ দা ডগ আ ব্যাড নেম', 'ডগ ইন দা ম্যানজার', কত আর ফিরিস্তি দেব। হোটেলের লেফটওভার বাড়ি নিয়ে আসার প্যাকেটের নাম ডগি ব্যাগ, সেটা নিজের জন্যেই আনুন আর বাড়ির পোষা বেড়ালটার জন্যেই, নাম কিন্তু ডগি ব্যাগ। অথচ মানুষ ছাড়া একমাত্র প্রাণী, যে স্বর্গে যবার ছাড়পত্র পেয়েছিল মহাপ্রস্থানে। বিচিত্র সব ব্যাপার।
তখন কতই বা বয়স হবে, ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ি বোধহয়। বেশ কিছুদিন ধরে কুকুর পোষার ইচ্ছে। মা একদম এসব পছন্দ করেনা কিন্তু বাবার প্রচ্ছন্ন সম্মতি আছে বুঝতেই পারি। হপ্তায় দুদিন গঙ্গাচ্চানে যেতাম। আউট্রাম ঘাটের কাছে বেদেদের তাঁবুতে নানা রকম রোমশ কুকুর। কোনওটা অ্যালসেশিয়ান, কোনওটা ককার স্প্যানিয়েল, বাবার কাছে প্রতিদিনই একবার করে ঘ্যান ঘ্যান করতাম, কিনে দাওনা বাবা – বাবা বলত ওগুলো মিক্সড ব্রীড, আসল নয়, কিনলে ঠকে যাবে। আমি ব্রীড ফ্রীড অত বুঝতামনা, কুকুর ইজ কুকুর, তাতে ঠকবার কি আছে, তাও মাথায় ঢুকত না।
তা ভাল জাতের কুকুর পোষার আশা ত্যাগ করলাম। ভাবলাম নেড়িকেও ভাল করে চান করিয়ে খাইয়ে দাইয়ে যত্ন করলে সেও বেশ ভালই হয়। বাবার খোশমেজাজের টাইমে, যেটা খুব কম সময়ের জন্য মাসে দু একবার হত, সেই প্রোপোজালটা দিলাম। বাবা বলল, ওই কোনের বাড়ির কুকুরটার বাচ্চা হলে চাইতে পার। কোনের বাড়িটা চক্রবর্তীদের। তাঁরা বিরাট বড়লোক। সে বাড়ির এক ছেলে আমাদের সঙ্গে মাঝে সাঝে খেলাধুলো করত বটে, তবে উচ্চতা বজায় রেখে। তাকে বলতে গেলাম। সে বলল, বাচ্চা হলে খবর দেব।
অন্য বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে জানলাম। ওর কুকুরটা ঠিক নেড়ি নয়, বর্ণশঙ্কর। বাচ্চা হলে ভালই হবে। খবর পেয়ে আরও দু একজন বাচ্চা বুক করে ফেলল। যাই হোক হপ্তা খানেক পর চক্রবর্তী জুনিয়ারকে রাস্তায় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়ে, মানে বাচ্চা হল? সে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, আমার বাড়িতে যেটা আছে, সেটা কুকুর, গিনিপিগ নয়।
এর পর থেকে আর প্রশ্ন করার সাহস হতনা, তাকে রাস্তায় দেখলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকাতাম, প্রতিক্রিয়ার অভাবে বুঝতে পারতাম, বাচ্চা হয়নি এখনও। একদিন বাবা বলল, কী বলল, ওরা? আমি বললাম, বাচ্চা টাচ্চা হয়নি। বাবা বলল, কে বলেছে হয়নি? আমি অবাক, ওদের বাড়িতে কুকুরটা তিন তলায় থাকে। সকালে একবার হিসি টিসি করতে নামে। তার বাচ্চা হয়েছে বাবা জানল কেমন করে? যাই হোক দৌড়ে গিয়ে বললাম, বাচ্চা নাকি হয়েছে? ছোট চক্কোত্তি বলল, হয়েছে, তবে মায়ের দুধ না ছাড়লে দেয়া যাবেনা।
বেশ কিছু অধৈর্য রাত কাটার পর একদিন ডাক পেলাম ওপরে যাওয়ার। গেলাম ছাদে। একটা ঘেরা জায়গার মধ্যে গোটা পাঁচেক বাচ্চা, বেশ ডাগর হয়েছে, মাস দেড়েক বয়স। নতুন লোক দেখে তাদের মধ্যে চারটে, ঘেউ ঘেউ করার বয়স হয়নি বলে খেউ খেউ করে দাঁত বের করে চ্যাঁচাতে লাগল, শুধু এদের মধ্যে একটা, যেটা আকারে অনেক ছোট, অনেক বেশি লোমশ, আর ভারি মিষ্টি দেখতে, আহ্লাদে ডগোমগো হয়ে লেজ নাড়তে লাগল। পরিষ্কার শুনলাম, অ্যাই দাদা, আমায় কোলে নে না। আমি দুহাত বাড়িয়ে সামান্য ইশারা করতেই এক লাফে কোলে উঠে এল। ওইটুকু বাচ্চা কুকুর এতটা লাফাতে পারে? আশ্চর্য !
অচিরেই বাড়ির চার নম্বর মেম্বার হয়ে গেল সে। বাবা সাহেবি নাম রাখবে জানতাম, অনেক কষ্টেও 'ছোটকু' নামটা চালাতে পারলাম না, ওর নামহয়ে গেল 'জন'।
মা একদম পশুপাখি পছন্দ করতনা, সেই মা-ও দেখতাম তার খাবার দাবারের ত্রুটি হতে দিচ্ছেনা। রাস্তায় সকাল বিকেল বের করতেই হত। বন্ধুরা বলত, এটা কেন নিলি, এটাতো ছোট্ট মতো, অন্যগুলোর কি বিরাট চেহারা, দূর বোকা। খালি একজন বলল, ওর চোখদুটো দেখ, এ তো মানুষের চোখ, আশ্চর্য তো! আশ্চর্যের তখনই হয়েছে কী?
একদিন মামাবাড়িতে নেমন্তন্ন। আমরা তো সেখানে খাব, জন খাবে কী? তাছাড়া জনের জন্য টেংরির জুস রান্না করলেও তাকে খাবার সময়ে দেবে কে সেটা? মা বলল, ওকে নিয়ে চল না, মামাবাড়িতে অনেক জায়গা। ওর বরং ভালই লাগবে। মামাবাড়ি গিয়ে যা শুনলাম, তা বিশ্বাসযোগ্য কিনা জানিনা, তবে যা শুনেছিলাম, তা তো বলতেই হবে।
জনকে চাক্ষুষ দেখেই মামা মাসিরা একযোগে বলে উঠল, আরে, এতো পল! কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আমি তো কিছুই বুঝছিনা। পরে জানা গেল, মা কুকুর দুচোখে দেখতে পারেনা, তবু জনের প্রতি দুর্বলতা কেন। গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ওই বয়সেই আমারও সন্দেহ ছিল, কিন্তু এতগুলো লোক একসঙ্গে একই কথা বললে কী করা যাবে।
গল্পটা এই রকম। অনেক আগে, আমার জন্মের আগে তো বটেই, তখন বাড়িতে কারো বিয়েই হয়নি, বড়মাসিরও না। আমার সেজমাসি, যাকে আমি মাসিমণি বলি, তাঁর টাইফয়েড হয়েছিল। সে সময়ে টাইফয়েড হলে ভগবান ডাকা ছাড়া পথ ছিলনা, ডাক্তারদের বিশেষ কিছু করার থাকতনা। বেঁচে ফিরত অল্প কিছু লোক।
এদিকে মেজমামার একটা কুকুর ছিল, নাম তার পল। সে বাঁধা থাকত দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ। তার ছিল ছোটখাট চেহারা, গায়ে ছিল বড় বড় লোম আর চোখ দুটো ছিল ঠিক মানুষের মত। তাকে পেরিয়ে দোতলায় ওঠার সাধ্য ছিলনা কারো কিন্তু মাসিমণিকে দেখতে যেদিন ডাক্তারবাবু এলেন, পল টুঁ শব্দটিও করেনি।
এটা অবশ্য কোনও গল্পের উপাদান না। বহু বাড়িতেই এমন ঘটনা দেখা যায়, কিন্তু ডাক্তারবাবু মাসিমণিকে দেখে মাথা নেড়ে স্টেথো বাক্সে ভরলেন। বললেন, ভগবান ডাকা ছাড়া এখন উপায় নেই। আমি তবু একদিন ছাড়া ছাড়া দেখে যাব। তিনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, পল একবার মুখের দিকে চাইল, তারপর থাবায় মুখ গুঁজল। পল খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল সেদিন থেকে। অনেক সাধ্য সাধনায় ফল হলনা। শুধু জল খেত দু একবার।
দিন যায়, ডাক্তারবাবু আসেন, যান, পল মুখ তুলে দেখে আর নামিয়ে নেয়। খাওয়া বন্ধ, প্রচন্ড রোগা আর দুর্বল, আর ক'দিনই বা বাঁচবে। একদিন ডাক্তার বাবু হঠাৎ বললেন, বাই গডস গ্রেস, এবার ভালর দিকে যাচ্ছে। আর চিন্তা নেই। তিনি যখন নামছেন, পল মুখ তুলে চাইল, তারপর লেজ নেড়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করল। গাঁউ গাঁউ করে এক গামলা মাংস ভাত খেল।
জন নাকি হুবহু পলের মত দেখতে, বাড়ি শুদ্ধু সবাই বলল। আরেকটা ব্যাপার, জনের গায়ের রঙটা ছিল অদ্ভুত। সাদার ওপর ছোপ, তবে ব্রাউনও না, চকোলেটও না, কেমন একটা বিচিত্র রঙ। অমন রঙের কুকুর আমি জীবনে দেখিনি। ওকে পাঁচটার মধ্যে আলাদা করে পছন্দ করার সেটাও একটা কারণ। পলের রঙও নাকি ঠিক তেমনি ছিল। মামা মাসিরা কোরাসে বলল, গায়ের ছোপগুলো পর্যন্ত ঠিক সেই সেই জায়গায়।
এগুলো অবশ্য কোনও ব্যাপার নয়, পল সেই কবে মরে গেছে, কতকাল আগে। খানিকটা সাদৃশ্য থাকতেই পারে, তাই দেখেই সবাই হৈ হৈ করেছে হয়তো, কিন্তু সবাই একযোগে একই কথা বললে একটু কেমন কেমন লাগেনা? তবে আসল ঘটনাটা তো অন্য জায়গায়। মামাবাড়িতে গিয়েই জন চলে গেল সটান মেজমামার ঘরের সামনে, আর কোত্থাও না। মনে হল, যেন কত কালের চেনা। আর মেজমামা বেরোতেই এত জোরে লেজ নাড়তে লাগল, যে মনে হল, লেজ খুলে পড়ে যাবে। তারপর সেই বিশাল লাফ, একদম মেজমামার কোলে। আর কাউকে দেখে তো এমন করল না? কাকতালীয়?
গল্প এখনো অনেক বাকি। সেদিন খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা বাড়ি ফিরেছি। জনও এসেছে আমাদের সাথে, ফিরবে তো বটেই। দিন তিনেক পর সকালে উঠে দেখলাম জন নেই। রাত্রে সে বাঁধা থাকত চেন দিয়ে। দেখলাম, চেনের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে ঝুলছে। কী ব্যাপার, এত মোটা লোহার চেন, তাগড়া অ্যালসেশিয়ান ছিঁড়তে পারেনা, এই ছোটখাট ছেলেমানুষ ছিঁড়ে ফেলল? তা যদি ছিঁড়েই থাকে, গেল কোথায়? চারিদিকে হন্যে হয়ে ঘুরলাম, আমার বন্ধুরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, পাড়ায় সবাই চিনত ওকে, কেউ কি দেখেছ? নাঃ।
বাড়িতে কারো খাওয়াই হলনা, এত মন খারাপ, যে আমি তো ইস্কুল গেলামই না, তার জন্য কেউ বকল না পর্যন্ত। বিকেল বেলা মেজমামা বাড়িতে হাজির, কোলে জন। কী ব্যাপার? মেজমামা বলল, আর বলিস না, সাত সকালে উঠে দেখি, আমার ঘরের সামনে বসে আছে। এতদূর রাস্তা চিনে গেল কী করে, আর গেলই বা কেন, তাও তো বুঝলাম না।
আমি বুঝলাম একটু একটু। কদিন পর ভাল করে বুঝলাম, যখন জন তিন বার চেন ছিঁড়ে পালাল আসুরিক শক্তি দিয়ে। প্রতিবারই আরও মোটা চেন কিনে এনেছি। প্রতিবারই মেজমামার ঘরের সামনে তাকে পাওয়া গেছে। পোষা জীবকে কেউ তুলে বা চুরি করে নিয়ে গেলে, সে বহু দূরের রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে এমন গল্প অনেক শুনেছি কিন্তু বারবার নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য কোনও বাড়িতে চলে গিয়ে বিশেষ কারো ঘরের সামনে বসে থাকার গল্প শুনলেও বিশ্বাস করা কঠিন। এ কি জন, না পল?
কদিন পর দেখলাম হঠাৎ জন আমাদের বাড়িওয়ালির বাগানে। অ্যাই, এখানে কী করছিস? বলতে গিয়ে দেখি, একটা ফেলে দেয়া ঝাঁটা চিবিয়ে খাচ্ছে। কিছুটা জানতাম সিম্পটম, গায়ে হাত দেওয়ায় বিপদ ছিল, তবু নীচু হয়ে ওর কাছে মুখ নিয়ে গেলাম। ফিসফিস করে বলল, দাদা, বড় কষ্ট রে।
আমার বাবার মত অত গুরুগম্ভীর রাশভারি লোককে অমন হাউহাউ করে ডুকরে কাঁদতে দেখলে পাড়াশুদ্ধু লোক অবাক হয়ে যাবার কথা। আমি মারা গেলেও বোধহয় বাবা অত কাঁদতনা। যেখানে এখন নজরুল মঞ্চ হয়েছে, সেখানে আগে অনেক নীচে একটা কবরখানা ছিল টিপু সুলতানদের পরিবারের। একটা বাটির মত জায়গা। তবে বহুকাল কবর টবরও কেউ দেয়নি ওখানে। একটা গোল অন্ধকার প্রকান্ড গর্তের মধ্যে একজোড়া তালগাছ ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকত। বাপবেটায় ধরাধরি করে একটা বস্তায় ভরে ওখানে মাটিচাপা দিয়ে এলাম। ওইটুকু পল তখন কী ভারী। ওঃ কি বললাম, পল? না না, জন। ওর নাম জনই ছিল তো।
রোজনামচা, ষষ্ঠেন্দ্রিয়, ইঁদুর, ইত্যাদি
এটা আমার সেই ডায়রি হিসেবে লেখা ধানাই পানাইয়ের খানিক অংশঃ-
আজ শনিবার, ১৩ই মার্চ, দু হাজার চার। একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছি। এখন ঠিক সাড়ে ছ'টা। ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল কিন্তু ঘুমোন যাবেনা, এমন একটা ব্যাপার ঘটেছে, যে না লিখলে হবেনা। আজ ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ওয়ান ডে খেলা হচ্ছে পাকিস্তানে। দু দেশের সম্পর্ক সহজ করতে ক্রিকেট-ই প্রথম এবং প্রধান রাস্তা। তাই পনের বছর পর ভারত গেছে পাকিস্তানে খেলতে। সকাল থেকেই খেলা শুরু, তবে আনি খুব একটা উৎসাহী ছিলাম না।
আমার এনক্লোজারের সরাসরি বাঁদিকেই টেলিভিশন, তাই মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছিল। তাছাড়া ওখানে বেশ ভীড়। তাই কাজে মনঃসংযোগের অভাবও হচ্ছিল। অফিস টাইমে টিভি খোলা নিষেধ, কিন্তু অন্য প্রোগ্রাম না হলেও ক্রিকেট কিছুতেই আটকানো যায়না। তার ওপর আধিকারিকদের অনেকেই মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরে আসেন। আটকাবেই বা কে। হঠাৎ দেখি আমাদের ড্রাইভার কিশোর হাঁফাতে হাঁফাতে আসছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীরে, অত হাঁফাচ্ছিস কেন ? সে বলল, স্যার, অনেক দূর থেকে দৌড়ে দৌড়ে আসছি রাহুল দ্রাবিড়ের সেঞ্চুরিটা দেখব বলে।
রাহুল তখন একানব্বই ব্যাটিং। আমার ভেতরের সেই লোকটা দুম করে বলে দিল, সেঞ্চুরি হলে তো দেখবি। আমি কাজে মন দিলাম। অত উত্তেজনায় কাজ কি করে করব, লোকজন চ্যাঁচাচ্ছে, টিভির পর্দা আমার চেয়ার থেকেই দেখা যায়। দেখলাম রাহুল ব্যাটিং নাইন্টি নাইন। এই বলটাতেই সম্ভবতঃ সেঞ্চুরিটা আসবে কিন্তু ভিতরওয়ালার কথা তো মিথ্যে হয়না কখনো। বললাম, কী গো, হয়ে গেল তো। সে বলল, এই বলেই আউট এবং সরাসরি বোল্ড। আমি পর্দার দিকে তাকিয়েই রইলাম। দেখলাম বেল ছিটকে যাচ্ছে এবং রাহুল অজানা অদৃষ্টকে শূণ্যে ব্যাটপেটা করে ফিরে আসছে প্যাভিলিয়নে। আমি আবার কাজে মন দিলাম। কম বয়সে উত্তেজনার আতিশয্যে লোককে বলে ফেলতাম। এখন বয়স বাড়তেই উচ্ছ্বাস কমেছে। কাউকে এসব বলি না। কিন্তু ডায়রিতে লিখব না, তা তো হয় না।
ফেরার সময়ে বাস থেকে নেমে রিক্সো স্ট্যান্ডে এসেছি। রিক্সো স্ট্যান্ডের কাছেই ফুটপাথের ওপর একটা অস্থায়ী ক্লাবে টিভি চলছে। আমি রিক্সো ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, খেলার খবর কী? দেশের অগ্রগতি বিভিন্ন ভাবে বোঝা যায়। আজ থেকে বছর পনের আগে, কোনও রিক্সোওয়ালাকে ক্রিকেট সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করার কথা কেউ ভাবতে পারত? এখন খেলার কথা অনেক নীচে পর্যন্ত চুঁইয়ে এসেছে। এলবিডব্লিউ কে 'এল্বি' বা ওয়াইড বলকে 'হোয়াইট বল' বলতে শিখেছে জনসাধারণ। ডীপ মিড উইকেট কোন জায়গায়, বা চায়নাম্যান কেমন বল, তা হয়তো জানেনা এরা। কিন্তু ক্রিকেটের বাজারীকরণ অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে যাঁরা করেছেন, তাঁরা জানেন, আম জনতার কতটুকু জানলে কাজ চলে যায়।
রিক্সোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, খেলার খবর কী? ও বলল, খবর ভাল না, ওরা জিতে যাবে, ষাট বলে নব্বই করতে হবে। আমি বললাম, ষাট বলে নব্বই মানে জান তো, ওভার প্রতি ন'রান। রিক্সা চালক বলল, বেশি উইকেট পড়েনি তো, খুব পেটাচ্ছে। প্রতি ওভারেই ছয়, চার। আমি ভিতরওয়ালাকে বললাম, কী হবে গো ? সে বলল, কি আবার হবে, ইন্ডিয়া জিতবে।
বাড়ি ফিরে তড়বড়িয়ে ওপরে গেলাম। ওপরের ঘরে একটা টিভির কানেকশন তখনও আছে। গিয়ে দেখি সাঁইত্রিশ বলে চুয়ান্ন করতে হবে। মোটে চার উইকেট পড়েছে। ভেতরের লোকটাকে বললাম। কী গো, করে দেবে তো? সে বলল, চুপচাপ বসে দেখইনা। ধুমধাড়াক্কা ছয়, চার মারছে পাকিস্তানীরা। তখন একুশ বলে আটাশ রান করতে হবে। আমার অবশ্য টেনশন হচ্ছেনা মোটেই। ভিতরওয়ালা সব সময় কথা বলেনা, কোনও সময়ে হাজার খোঁচালেও কোনও উত্তর নেই, একদম চুপ। কিন্তু যখন বলে, তখন কথার নড়চড় হয়না।
একুশ বলে আটাশ অবশ্য পৃথিবীর যে কোনও টিম করে দেবে, কিন্তু যে ভরসা দিচ্ছে, তার ওপর পুরো কনফিডেন্স। যখন শেষ ওভারে মাত্র ন'রান বাকি, তাও আবার পাকিস্তান ব্যাট করছে, একবার শুধু বলেছি, কী গো? ভিতরের লোক হেভি খচে গেল। তুমি ছোটবেলা থেকে দেখছ না, কোনওবার কথার খেলাপ হয়েছে? ত্যা অবশ্য ঠিক। ক'দিন আগেই সৌরভের সেঞ্চুরির কথা বলেছিল। বাচ্চা ছেলেও ধরে নেবে, এমন তিনটে ক্যাচ ফসকে সেঞ্চুরি হয়ে গেল। এ খেলার রেজাল্টটা আর লিখে সময় নষ্ট করছি না।
কয়েকদিন পরের কথা। ঠিক তারিখটা ডায়রিতে নেই।
কাল যখন লিখেছি, আমার ভাঙা বাড়ির কথা, এই বাক্যটা শেষ না হতেই লোড শেডিং শুরু হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম, বেশ বড় গোলমাল, সারা রাত আলো নাও আসতে পারে। এমন কিছু গরম পড়েনি, যে ফ্যান ছাড়া ঘুম হবেনা, কিন্তু ঘরের মধ্যে এত আওয়াজ, যে ঘুমোয় কার সাধ্য। খুট্খাট্, টিংটং, খচ্মচ্ হয়েই চলেছে। বুঝলাম সেই কুমোরটুলির 'ইন্দুর' এর নাতিপুতিরা ধেই ধেই নৃত্য শুরু করেছে। কিন্তু প্রথম কথা, আমাকে ঘুমোতে হবে। দ্বিতীয়তঃ, প্রচূর দরকারি নথিপত্র ডাঁই করা আছে, যে রকম আওয়াজ শুনছি, আজই কেটেকুটে নাশ করবে বোধহয়। অন্ধকারে রান্না ঘরে গিয়ে খুঁজেটুজে কোনও খাবার পেলাম না, একটা মিনি সাইজের রুটি বানাতে হল অন্ধকারেই। আজ এদের থামাতেই হবে। কলের মধ্যে রুটিটা ঝুলিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকতেই সেই ক্রিকেটের স্কোর বলা লোকটা বলল, আজ কলে এক জোড়া পড়বে। আমি বললাম, যাঃ তাই কখনো হয় নাকি? চিরকাল তো দেখছি কল পাতলে একটা করে ইঁদুরই পড়ে। বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই ঘুম। সকালে উঠে দেখি লাইট জ্বলছে, পাখা চলছে, কখন শেষ রাত্তিরে কারেন্ট এসেছে। কলের কাছে গিয়ে দেখি, ভেতরে এক জোড়া ইঁদুর।
ঘড়িতে দেখলাম, সবে পাঁচটা। এত তাড়াতাড়ি ওঠার কোনও মানেই হয়না, সাতটায় উঠলেও সব কাজ সেরে অনায়াসে অফিস বেরনো যাবে। তাহলে আর এক ঘুম হয়ে যাক। দ্বিতীয় দফার ঘুমে স্বপ্ন দেখলাম, আমাদের জমিতে প্রথম কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হচ্ছে। ঠেলা গাড়ি করে ছোটমাসির বাড়ি থেকে পোলগুলো আনা হচ্ছে। অত পুরোন ঘটনা স্বপ্নে দেখার মানে কি ?
অফিসের সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই সামনে বাঘ, থুড়ি, ইঁদুর। বলল, হঃ একখান বেরা বাইন্ধাই আনন্দে নিত্য করস,- এই জমিনডা আমাগো, এই জমিনডা আমাগো, গাধা কারে কয়। অরে মূর্খ, এ জগতে আমাগো বইল্যা কিছু নাই। তর এই জমিনডার উপর খারাইয়া একদিন শ্যামাচরণ পার্শির বিধবা মাইয়া পাতাসিবালা ভাবতেয়াছিল, এই জমিনডা আমার। তপন সিনহার ক্ষুধিত পাষান দ্যাখছসনি ? আমি মিনমিন করে বললাম, ওটা তো রবিঠাকুরের – ইঁদুর রেগে গেল, আঃ ছিনামাডা বানাইসে কেডা, তার নামেই চলে বেশি।
ইঁদুর বলল, তর মত আমিও একদিন ভাবতাম, এই ঢাকা, এই বরিশাল, এই ফরিদপুর, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, সব আমাগো। একদিন তো লুকাইয়া, বিএসএফের গারিতে চাইপ্যা, বেনাপোল অবধি চইল্যা গেছি। কাঁটাতারের বেরার পানে চাইয়া দুই ফোটা চউক্ষের জল ফালাইছি কি ফালাইনাই, হঠাৎ জানি কই থিকা পাগলা মেহের আলি ফাল দিয়া পরল। কয় কিনা, 'সব ঝুঠ হ্যায়, তফাৎ যাও'।
হ্যারে, অ্যাই ছ্যামরা, টমাস কারলাইলের 'কুই বোনো' পরছস ?
'হোয়াট ইজ ম্যান, আ ফুলিশ বেবি
ভেইনলি স্ট্রাইভস, ফাইটস অ্যান্ড ফ্রেটস
ডিম্যান্ডিং অল, ডিসারভিং নাথিং
ওয়ান স্মল গ্রেভ ইজ হোয়াট হি গেটস।'
যাউক গিয়া এই সব পেচাল, কাইল তর কলে নাকি আমার দুই চাইরডা নাতিন ধরা পরসে? আবার তাগো কাউয়া দিয়া খাওয়াইসস নিকি? আমি বললাম, দু চারটে নয়, দুটো। একবার ভেবেছিলাম কাকের মুখেই ছেড়ে দিই। যা জ্বালাতন করছিল। তবে তা করিনি। মাঝ রাতে উঠে দর্জি ঘরের পেছনের জঙ্গলে ছেড়ে এসেছি।
বালোই করসস। মেনি থ্যাঙ্কস। পেটার নাম হুনছস? পেটা? পীপ্ল ফর এথিকাল ট্রীটমেন্ট অফ অ্যানিম্যালস? আমি ফেলোশিপের লিগ্যা তর নাম রেকমেন্ড করুম। শুধু মনে রাখিস, এই জমিনে পাতাসিবালা, রূপঙ্কর আর আমার নাতি নাতিন, হগ্গলেরই সমান অধিকার।
কাকতালীয় ঘটনা নিয়ে এই ডায়রিতে একগাদা লেখাপত্তর আছে। সব এখানে তুলে দেয়া সম্ভব নয়। আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস, যখন এক রকমের ঘটনা ঘটে, তখন পরপর ঘটে। একটা বিশেষ প্রাণী দেখা গেলে, বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা বা দুর্ঘটনা, পর পর ঘটে যায় বিভিন্ন জায়গায়। তারই একটা -
এরপর বাইশে মার্চ দু হাজার চার।
কয়েকদিন আগে, বেশ কিছুদিন পরপর কাগজে একটা খবর বেরোচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গেরই কোনও এক মফস্বল শহরে, খুব সম্ভবত কৃষ্ণনগর, আচমকা কেউ, লোকের বাড়িতে কাপড়ে বা ন্যাকড়ায় আগুন লাগিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তাতে অনেকের ঘর বাড়িই পুড়ে গেছে। অনেক পাহারা সত্বেও অপরাধীকে বা অপরাধীদের ধরা যায়নি। পুলিশ সন্দেহবশত হাসপাতালের এক কর্মীকে আটক করেছে, কারণ আগুন লাগিয়ে যে কাপড় ছোঁড়া হচ্ছিল, তা ব্যান্ডেজ জাতীয়।
আমি বিশেষ খবর হলে তার কাটিং রাখি বটে, তবে এমন কান্ডও যে কাকতালীয়ভাবে আবার হবে, কে জানত। আজ সোমবার, বাইশে মার্চ দুহাজার চারের ইকনমিক টাইমসে আছে, মধ্য প্রদেশের নীমাচ জেলার রাত্রিয়া গ্রামে কে বা কাহারা গ্রামবাসীদের বাড়িতে আগুন ছুঁড়ছে গত এক সপ্তাহ যাবৎ। পুলিশ কিছুই করতে পারছেনা। এমন হাল দাঁড়িয়েছে, যে আগুন নেভাতে গ্রামের কুয়োগুলির জলই প্রায় শেষ হবার যোগাড়।
এইসব খবর বেশি বেরোয় স্থানীয় কাগজে। আমাকে অফিসের কাজে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়। আমি হোটেলে যে কাগজ গুলো ঘরে দেয়, তা লুকিয়ে নিয়ে আসতাম পরে ভাল করে স্ক্যান করে এইরকম খবরের যোগসূত্র বের করার জন্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারতের সব প্রদেশের স্থানীয় কাগজের কয়েকদিনের সংখ্যা যদি যোগাড় করা যেত, শুধু আগুন ছোঁড়ার ঘটনাই পাওয়া যেত গোটা ছয় সাত। গত পনের দিনের কোলকাতার কাগজই ময়না তদন্তের টেবিলে ফেললাম। আশ্চর্য, গোটা দশ বারো আগুন লাগার ঘটনা পেলাম, বেশির ভাগেরই কারণ অজানা।
ডায়ারি এখনকার মত এই পর্যন্তই। কিন্তু আরও খানিক না বললে বক্তব্য পরিষ্কার হবে না। অনেকদিন আগে, সম্ভবতঃ উনিশশো আশি সালে, এই কাকতালীয় ঘটনার ভূতটা আমার মাথায় চাপে। তখন যা কিছু 'গুরুত্বপূর্ণ' আলোচনা, সব হত জয়দেবদার সঙ্গে। জয়দেবদা ঘোর কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী, প্রচন্ড যুক্তিবাদী, কিন্তু কখনো এঁড়ে তর্ক করতেননা। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, আপনি কী ভাবেন, ভগবান আছেন, না নেই? উনি বলতেন, এইটুকু তো জীবন, সারা জীবনে মানুষের কাজ করেই কুলিয়ে উঠতে পারবনা, তিনি আছেন না নেই, ভাববার সময় কোথায় ?
জয়দেবদাকে গিয়ে বললাম, দাদা, যখন কোনও ঘটনা ঘটে, কাকতালীয় ভাবে অনেক জায়গায় পরপর ঘটে। জয়দেবদা বললেন, যেমন? আমি বললাম, এই দেখুন, বিভিন্ন খবরের কাগজ ঘেঁটে পাচ্ছি, গতকাল বিভিন্ন জেলায় আলাদা আলাদা জায়গায়, বাজ পড়ে ছ'জন লোক মারা গেছে। জয়দেবদা বললেন, বর্ষাকালে বাজ পড়েই থাকে। মেঘের মধ্যে তৈরী হওয়া ইলেকট্রিসিটি আর বিভিন্ন অঞ্চলের কন্ডাক্টিভিটির ওপর তার চলে আসা নির্ভর করে। এরকম তো হতেই পারে, আশ্চর্য তো কিছু নয়।
ঠিক তিনদিন পর অনেকগুলো কাগজ বগলদাবা করে গেলাম তাঁর কাছে। দাদা, গতকাল মেদিনীপুরে, মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে, এবং ভারতের আরও তিন জায়গায় কূয়োয় পড়ে পাঁচজন মারা গেছে। এটাও কি ইলেক্ট্রিক কনডাক্টরের মত ন্যাচারাল ফেনোমেনন? জয়দেবদা টাকটা একটু চুলকে বললেন, না, আই মাস্ট অ্যাডমিট ইউ হ্যাভ আ পয়েন্ট দেয়ার। এটা নিয়ে ভালভাবে নিরীক্ষা চালাতে হবে। আমার তো সময় নেই, তুই চালা, কী পেলি, মাঝে মাঝে বলে যাস। অনেক কিছুই পেলাম, পাচ্ছি এখনও, জয়দেবদাকে সে সব জানাতে হলে পরলোকে যেতে হবে। আপাতত এখন সেটা হচ্ছে না।
(চলবে)