ডাক্তার বাবুর চেম্বারের বাইরে সিমেন্টের পিলারে পিঠ ঠ্যাকনা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাসুম। এতক্ষণ বসেই ছিল। কিন্তু ডাক্তারের অপেক্ষায় যদি হাতে প্লাস্টার নিয়ে কোনো মহিলা দাঁড়িয়ে থাকে সামনে, পায়ের উপর পা তুলে মেটাল চেয়ারে বসে থাকাটা মাসুমের পক্ষে অস্বস্তিকর লাগে। তাই পেসেন্ট পার্টিকে ইশারায় বসতে বলে একটু পায়চারি করে নেয় মাসুম। বাইরে গিয়ে একটু সিগারেট ফুঁকে এলে ভালো লাগত। কিন্তু কখন ডাক পড়ে চেম্বারে।
ফ্যানের হাওয়ায় ফরফর করে উড়তে থাকা ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ যায় মাসুমের। আজ এক্স রে রিপোর্ট দেখে ডেট দেবে ডাক্তারবাবু। আসমা বায়না ধরেছিল নিজে আসার। ডাক্তার কী বলে, নিজের মুখে শুনতে চেয়েছিল সবটা। মাসুমের ওপর তার মোটেও ভরসা নেই। যদি ভালো করে সবটা না শুনে আসে। কিন্তু ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পা নিয়ে এই ভরা বর্ষার খানাখন্দময় রাস্তায় বাইকের ব্যাক সিটে বসিয়ে আনতে সাহস হয় নি মাসুমের। যেখানে গতকালই দেখিয়ে গেছে। ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া পায়ের পাতা দেখে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, “খারাপ ধরনের চোট। মনে হচ্ছে শুধু প্লাস্টারে হবে না। সার্জারি করে প্লেট বসাতে হবে। তবে এক্স রে রিপোর্ট না দেখে কিছু বলা যাবে না। কালই রিপোর্ট নিয়ে আসুন। টেম্পোরারি একটা ব্যবস্থা করছি। তবে রিপোর্ট দেখানোর সময় পেসেন্ট না আসলেও হবে।“
এর মধ্যে দু বার ফোন করা হয়ে গেছে আসমার। ওষুধ খেয়েও ব্যথা টা কমছে না মোটেই। সেটা যেন বলে মাসুম, বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে আসমা। আর ফেরার সময় তরকা রুটি আনতে বলেছে। কোনো রকমে দুপুরের রান্নাটুকু করতে পেরেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রাতে আর পারবে না কিছু করতে। মাসুমের মনে হল, আজ যেন বেশী সময় নিচ্ছেন ডাক্তারবাবু। সেই কখন ঢুকেছে আগের পেসেন্ট। এখনো বেরোনোর নাম নেই। তবে বসতেই দেরি হয়েছে ডাক্তারবাবুর। নাম লেখা ছেলেটা বলল, এমার্জেন্সি ওটি পড়ে গেছিল হঠাৎ। ক্যাচ করে শব্দ হল দরজায়। এতক্ষণে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বেরোলো বুড়োবুড়ি। পাঁচজন পেসেন্ট দেখার পর নাকি ডাকবে রিপোর্ট দেখার জন্য। এখন বোধহয় তিন নম্বর চলছে।
আজ জিজ্ঞেস করতে হবে অপারেশন করাতে হলে খরচাপাতির ব্যাপারটা। ডাক্তারবাবুর সময় কম কথা শোনার। এক ফাঁকে জেনে নিতে হবে। ভাবে মাসুম। কয়েক বছর আগে হলে এসব নিয়ে ভাবতে হত না। তখন এ তল্লাটে খেলার সরঞ্জামের দোকান বলতে লোকে 'দিলরুবা স্পোর্টস জোন'কেই চিনত। সারাদিন কাস্টমারের ভীড় লেগেই থাকত। তাছাড়া স্কুল, ক্লাব, বড় টুর্নামেন্ট এর আয়োজকদের থেকে বড় বরাত আসত। বছরে দুবার দিল্লী থেকে নিজে হাতে পছন্দ করে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে বুক করে আসতো খেলার সামগ্রী, ট্রফি, মোমেন্টো।
এখন মাসুম প্রায় সারাদিন বসে বসে ঝিমায় ছোট্ট দোকানেঘরে। রাস্তা ভুল করে চলে আসা দু একজন খেলাপাগল ছেলে চমকে দিয়ে বলে ওঠে, "কাকু, ক্যারাম বোর্ড রাখো নাকি? বাবা বলল, অনলাইনেই বুক করে দেবে। আমার না দেখে নিলে মনটা খুঁতখুঁত করে।" গা ঝাড়া দিয়ে উঠে মাসুম মুখের মাস্ক টা ঠিকঠাক করে। তারপর ডাস্টার দিয়ে ক্যারাম বোর্ডের ধুলো ঝাড়ে আর মনে মনে হিসেব করে, অনলাইনের দামে বেঁচলে আদৌ লাভ থাকবে কি না।
বছর দেড়েক আগেও মাসুম আর দু’জন কর্মচারী মিলে হিমসিম খেত দোকান সামলাতে। গরমে বর্ষায় ফুটবল, শীতে ক্রিকেট ব্যাট, বল, উইকেট, টুকটাক ডিউস বলে খেলার সামগ্রী, ভলি বল, নেট এসব বিকোতো হু হু করে। মাসুমদের আধা মফস্বল গঞ্জেও শীতে ব্যাটমিন্টন খেলার হাওয়া এলো। ব্যাটমিন্টন খেলা মানেই শাটল-কক আর নেট বিক্রি করে তাল পাওয়া যেত না। সেসব দিনের কথা মনে পড়লেই পাঁজর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছিটকে বেরোয় আনমনে।
মাসুমের কর্মচারী দু’জন এখন সব্জি ফেরি করে শহরে । ব্যবসা পত্রের যা হাল, তাতে ওদের মাইনে দেওয়ার সাধ্য নেই মাসুমের। মাসুম পারতপক্ষে মুখোমুখি হতে চায় না ওদের।
মাস তিনেক ধরে বিকল্প আয়ের একটা রাস্তা না খুলে গেলে এখন হয়ত মাসুম বৌকে নিয়ে সদর হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে মেডিকেল কলেজের রাস্তায় থাকত। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াটুকুও ধার করতে হত কারো থেকে।
রাতে মাসুমদের ক্লাবের আড্ডাটা এখনো চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। খেলার সরঞ্জাম আর মিটিং রেজিস্টারের ওপর ধুলোর পরত জমলেও এখনো আড্ডায় যেতে দেরি হলে মাসুমের মোবাইলে ফোন চলে আসে ক্লাব সেক্রেটারি বুল্টন দা'র। সেদিন আর কেউ আসেনি। নাইট কার্ফু সফল করতে পুলিশ ভ্যান ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক সেদিক।
"তুই সেদিন বলেছিলি না, একটা পার্ট টাইম কাজের জন্য, একটা কাজের খোঁজ আছে, বুঝলি মাসুম", ক্লাবের বারান্দার ঘুপচি করিডোরে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বলেছিল বুল্টন, “মনে হয় তুই পারবি। এক সময় খেলাধুলো করতিস। তোর চেহারা ছবি ভালো। কথা বার্তায় চৌখোশ। বাইক, চারচাকা ছোটাতে পারিস জোরসে। প্লাস, দরকারে ক্লাবের কিছু ছেলেকে কাজে লাগাতে পারবি। ওরা তো মাসুমদা করে অস্থির। এই সুযোগে ওদেরও চা বিড়ির পয়সা টা উঠবে।”
বুল্টনের কথা শুনে একটু ভুরু কুঁচকেছিল মাসুম। এটা ঠিকই, একটা সময় চমকানো, ধমকানো, হাতের সুখ নেওয়ার মত কার্যকলাপে উৎসাহ ছিল মাসুমের। তবে সেসব দিন এখন বিগত জন্মের গল্প বলে মনে হয়। নতুন করে আবার কি সেসব কাজের ইঙ্গিত দিচ্ছে বুল্টন দা? দ্বিধায় পড়ে মাসুম।
“আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? মেয়ে, বউ নিয়ে দিব্বি সংসার করছিস। আমি অ্যাসিওর করছি, কোনো ঝামেলায় জড়াবি না”, মাসুমের মনের কথা পড়ে ফেলে বলে বুল্টন, “আমারই এক বন্ধু ফোন করেছিল এর মধ্যে। আসলে আমাকে যেমন ছেলের কথা বলেছিল, প্রথমেই তোর কথাই মনে হল। আমি একজনের ফোন নাম্বার দেব। কথা বল। একদিন ফর্মাল একটা ইন্টারভিউ নেবে। আমায় যেটা বলেছে, যেদিন কাজ করবি ওদিনের পয়সা পাবি। স্পট পেমেন্ট। ভালোই দেবে। মানে, তোর ইনিটিয়াল ক্রাইসিসটা মিটে যাবে।"
একটা ছোট বাচ্চা ওর বাবা মায়ের সাথে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ঢুকল। তীব্র চিৎকার করছে। মনে হয় হাত ভেঙেছে। এর মানেটা দাঁড়ায়, রিপোর্ট দেখাতে আরো দেরি হবে মাসুমের।
এতক্ষণ খেয়াল করেনি মাসুম। পকেটের ফোন টা গোঁ গোঁ করছে অনেক্ষণ । আসমা নাকি? নিশ্চই ডাক্তার কী বলল সেটা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ফোন করছে। ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখে অফিসের ফোন। নতুন কোনো কেস নাকি? চারদিকটা একবার দেখে বাইরে এলো মাসুম।
“কী ব্যাপার কোথায় থাকিস? অনেক্ষন ধরে ট্রাই করছি। যাই হোক। একটা নতুন কেস আছে। গাড়ি সবে রওনা হয়েছে। দুটো ছেলে বাইকে আছে পেছনে। হোয়াটস অ্যাপ টা খোল, তোকে লাইভ লোকেশন পাঠিয়েছে”, ফোনের ওপাশে একটা ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর বলে গেল একটানা।
“কিন্তু এত শর্ট নোটিশে ম্যানেজ করাটা যে একটু চাপ হবে”, আশপাশটা দেখে গলাটা একটু নামিয়ে বলল মাসুম, “মানে জনা কয়েক ছেলেপুলেকে তো জোটাতে হবে স্যার। আর বলছিলাম, মিসেসের পা ভেঙেছে কলতলায় পড়ে। ডাক্তারের চেম্বারে এসেছি। বোধ হয় অপারেশান করে প্লেট বসাতে হবে। একটু চাপে আছি স্যার।”
“ধানাই পানাই না করে বল মালটা তুলতে পারবি কি না। না পারলে বল। শোন, এই কাজ করার জন্য অনেকে লাইন দিয়ে আছে।”
টকাস্ করে মটকাটা গরম হয়ে গেল মাসুমের। একটু পরেই ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে হবে ভেবে যাচ্ছেতাই একটা গালাগালকে কৎ করে গিলে ফেলতে হল অবশেষে।
“আচ্ছা, তোর কোনো পেমেন্ট আটকেছি এখনো, বল? আগে পুরোটা শোন আমার কথা, তারপর কমেন্ট কর”, ঝাড়টা দিয়েই স্বর একটু নরম করে ফের বলতে শুরু করে ফোনের ওপ্রান্ত থেকে, “সবে পুন্ডিবাড়ি ছাড়লো পার্টি। হাতে এখনো ঘণ্টা দেড়েক। এর মধ্যে যা করার করবি। তবে এখন পুরোটাই মাখন রাস্তা। দেড় ঘণ্টা মানে কিন্তু দেড় ঘণ্টাই। দেখিস, পার্টি যেন ফস্কে না যায়। আর পার্টির গায়ে যেন হাত না পড়ে, এটা মাথায় রাখবি। কোম্পানির যেন বদনাম না হয়। আর শোন, বাইকে যে দু’জন আসছে, ওদের সাথে পার্টির ট্র্যাঞ্জাকশন হিস্ট্রি প্রিন্ট করা আছে। বেশি তর্ক করলে ওটা বের করে দেখাবি। ছাড়ছি, কেমন? আমি কিন্তু পজিটিভ খবর চাই, বুঝলি?”
দিন ছোট হয়ে গেছে অনেকটা। হাইওয়ের ধারে একটা ধু ধু ফুটপাথের ওপর বাইক স্ট্যান্ড করে হুস হুস করে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ি দেখছে মাসুম। ওর সঙ্গীদের অনেকেই চলে এসেছে। পাঁচটা বাইকে দশ জন আসার কথা। এখন অবধি তিনটে বাইক এসেছে। বাকিদেরও চলে আসার কথা। এই মুহূর্তে বাড়িতে থাকতে পারলে ভালো হত। অপারেশনের কথা শুনে আসমা খুব টেনশন করছে। মাসুম ভেবেছিল, বাড়ি গিয়েই একেবারে বলবে কথাটা। কিন্তু কাজটা না সেরে তো বাড়ি ফেরা সম্ভব নয় কোনোমতেই। তাই বলতেই হল। নাহলে ফোন করে অস্থির করে দেবে আসমা। কিন্তু অপারেশনের পর যে মাস তিনেক রেস্টে থাকতে হবে, এ বোমাটা এখোনো ফেলা হয় নি। এটা শোনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, এটাই মাসুমের মাথা থেকে যাচ্ছে না।
“বস, তিস্তা ব্রিজ পারাইলাম। তৈরী থাইকো” তীব্র হাওয়ার আওয়াজের মাঝে কোনোমতে শুনতে পেল মাসুম ফোনের ওপার থেকে, “বাইক নিয়া এ গাড়িকে টক্কর দিতে জান খারাপ হয়ে গেল। সেই পুন্ডিবাড়ি থেকে টানা ছুটায় নিয়ে আসতেছে। আর কিন্তু ফোন করব না। ফোনটা তুমি কাটবা, ঠিক আছে? আমি বুলু টুথে কথা বলতেছি।”
“আমি লাইভ লোকেশন দেখতেছি মোবাইলে। কোনো চিন্তা নাই। বরাবর যেইখানে থাকি আমরা, ওইখানেই আছি। ছাড়লাম”।
ফোনটা কেটে বাকি ছেলেগুলোর দিকে একবার তাকালো মাসুম। এখন আর কথা বলতে হয় না। ইশারাতেই কাজ হয়ে যায়।
মাসুম দূর থেকে দেখল, তীব্র গতিতে ছুটে আসছে দুধসাদা গাড়িটা। নব্বই স্পীড তো হবেই। আর দেরি করা ঠিক হবে না। বাইকে স্টার্ট দিল মাসুম আর তার ছেলেরা। তিনটে বাইক আগেই রওনা দিয়ে দিল হাল্কা গতিতে। হাইওয়ের পুরো লেন আটকে হেলেদুলে চালাতে শুরু করল সওয়ারীরা।
সমানে হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে দুধসাদা গাড়ি। কিছুতেই সাইড দিচ্ছে না বরং গতি আরো কমিয়ে একেবারে থেমে গেল একসময়। দুধসাদা গাড়িকে এবারে যেতে হলে বাইকগুলোকে পিষে চলে যেতে হবে।
কাঁচ নামিয়ে মুখ বের করে একটা চার অক্ষর দিল সওয়ারী। মাসুম মনে মনে ভাবল, শিকারীকে জালে ফেলতে বেগ পেতে হল না খুব একটা।
গাড়ির জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে স্টার্ট বন্ধ করে চাবি ছিনিয়ে নিল মাসুম। সেটা ছুড়ে দিল ওরই এক শাকরেদের হাতে।
প্রবল রাগে গাড়ি থেকে নেমে মাসুমের দিকে ছুটে এলো সওয়ারী। কিন্তু ততক্ষণে বাকি ছেলেরা এসে ঘিরে ধরেছে ওকে।
“দ্যাখ ভাই, আমরা ডাকাত ফাকাত না, ভয় পাস না। এই যে গাড়িটা চালাচ্ছিস না, এটার লোনের পাঁচ মাসের কিস্তি বাকি পড়েছে। সবার ক্ষেত্রে যা নিয়ম, তোর ক্ষেত্রেও তাই। আগে তিন মাসের পর এসব হত। এখন আরো কিছুদিন গ্রেস দেয়। ব্যবসা পাতির অবস্থা তো ভালো না, তাই না?”, দুধসাদা গাড়ির সওয়ারীর দিকে চোখে চোখ রেখে বলল মাসুম, “তো, এখন আমরা গাড়িটা সিজ করে কোম্পানীকে দিয়ে দেব। এই ব্যাপারে আমাদের সাথে কথা বলে লাভ হবে না, যা বলার অফিসে গিয়ে কথা বলবি, কেমন?”
মাসুমের শাকরেদরা বাইকগুলো মহাসড়কের পাশে রেখেছে। বেশীক্ষণ রাস্তা আটকে রাখলে মুশকিল হবে। তবুও পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গাড়িগুলো জটলা দেখে গাড়ির গতি কমিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বের করে একটু দেখে নিচ্ছে পরিস্থিতি। তবে কেউই দাঁড়াচ্ছে না।
দুধসাদা গাড়ির সওয়ারী গাড়িতেই ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ নিচু করে। আধো অন্ধকারে মাঝে মাঝে গাড়ির হেডলাইট তার অবয়ব দৃশ্যমান করে আবার মিলিয়ে দিচ্ছে অন্ধকারে।
"দ্যাখ ভাই, ফালতু নাটক করার সময় আমাদের নেই। গাড়িতে যারা বসে আছে, নামতে বল। বুঝতেই পারছিস, গাড়িটা রাখতে হলে কী করতে হবে, আমাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে লাভ নেই। কালকে যা ওদের অফিসে", গলার স্বর পাল্টে ফের বলতে শুরু করে মাসুম, "কি হল? কথা কানে যাচ্ছে না?”
“কায় নামির কয় রে গাড়ি থাকি? হাতখান জোড় করিয়া ক’না, চাইর বছরের ছাওয়া ধরি মেডিকেল যাবার ধচ্ছি। হাসপাতাল থাকি এফার লিখি দিয়া স্যালা কইল না ডাক্তারটা, গছোত থাকি পড়িয়া ছাওয়াটার মাথাত অক্ত জমাট আছে নাকি দেখা খাবে। কথাগুলা উমাক ক’না বাপ”।
হাইওয়ের হেডলাইটের আলোয় দুধ সাদা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করা মহিলা’র মুখটাই সব এলোমেলো করে দিল মাসুমের। গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল মাসুম। খোলা কাঁচের জানালা দিয়ে দেখল, পেছনের সিটে এলিয়ে পড়ে আছে একটা বাচ্চা। মাথায় ব্যান্ডেজ। হাতে চ্যানেল। দেহে সার নেই কোনো। পাশে বসা মহিলাটি চেষ্টা করছে হাতে ধরা স্যালাইনের বোতলটাকে উঁচুতে রাখতে।
“ভাড়াই পাই না, লোনের কিস্তি কী দিব? পুরা বিয়েবাড়ির সিজিন লসে গেল”, মাসুমের পাশে এসে খাটো গলায় বলল সওয়ারী, “আমার গ্রামেরই এই বাচ্চাটার দুপুরে এই অঘটন। পাড়ার লোক বলল, যা সবাই মিলে তেল খরচ টা দিব। গরীব পরিবার। না করা যায় এইসব কেসে? দ্যাখেন, আজ হোক বা কাল গাড়ি সিজ হবে, এইটা জানতাম। কিন্তু এইভাবে হবে, এইটা স্বপ্নেও ভাবি নাই।”
মাসুম টের পেল, আধো অন্ধকারে দলের ছেলেরা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে সিদ্ধান্তের জন্য। গাড়িটার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে আর একবার বাচ্চার বুকের ওঠানামা দেখার চেষ্টা করল মাসুম।
কেউ কোনো কথা বলছে না। এবারে কিছু একটা করতেই হবে মাসুমকে। কিন্তু মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আসছে ক্রমশ। প্রায় অন্ধকার মহাসড়কের ধারে সমবেত নৈশব্দের পরত গাঢ়তর হয়। দম আটকে আসে মাসুমের।
------------
'পুলি' (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ২০২১) পত্রিকায় প্রকাশিত। সম্পাদক - ড: বিশ্বজিৎ রায়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।