সুশান্তর লাইন ছিল এগারো জনের পরে। বারো নম্বর। ও সবজি শেষ হয়ে যাচ্ছে কিনা মাঝে মধ্যে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিলো আর সবজিওয়ালার সাথে রিপিট করছিলো “আপনার পঁচাশি আর এককেজি কাঁচা আম... একশো পাঁচ”। আর শেষে একটা করে “..হুঁ” মনে হচ্ছিলো পবিত্র মন্ত্রপাঠ চলছে। ‘হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাসুখম্ | হর রোগং হর ক্ষোভং হর মারীং হরপ্রিয়ে।‘ ওদিকে ইলেকট্রনিক ওয়েট মেশিনের সামনে ‘পুরোহিত’, এদিকে সুশান্ত। হাতে শুধু ছেঁড়া ফুলের বদলে ছেঁড়া ব্যাগ। ছুঁড়ে না দ্যায়।
দাম মিটিয়ে লাইন থেকে সরে দাঁড়ালেন একশো পাঁচের ভদ্রলোক। সাদা পাজামা সাদা পাঞ্জাবী, সত্তরউর্দ্ধ এগিয়ে গেলেন তিরিশউর্দ্ধ সাইকেলের দিকে। যেন চাপলেই সেঞ্চুরি, কেনা লাউ বার করে আমাদের দিকে দেখিয়ে অভিবাদন নেবেন। নাঃ, সেসব হবার আগেই সুশান্ত ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো “কিইই, ছেলে চাকরি পেলো?” লাউডাঁটাগুলো ব্যাগে ঠেসে বিরক্তিঘৃণাহতভম্ব তাকালেন সত্তরজেঠু, “আমার ছেলে তো চাকরি করে সেই নিরানব্বই সাল থেকেই, স্কুলমাস্টার, ভুলে গেছ নাকি! আর তুমি, তোমার চাকরি হলো?” সুশান্ত না-বাচক। “তোমার বৌ চাকরিবাকরি করছেনা?” সুশান্তর জবাব সাদা চুল ছুঁয়ে ধপ করে গড়িয়ে গেলো, “ফাইভ পাস”। জেঠু ধরতে পারেননি। “এঁএ্যা কি বললে?” “ফাইভ পাস, ফাইভ পাস, শিক্ষিতরাই চাকরি পাচ্ছে না আর আমার বৌ”। “অ, তাহলে মায়ের ভরসাতেই খাচ্চো? বাপ্ মরে গেলো, মা পেনশন পায়, আর ক’দিন? তারপর তো তোমরা ভেসে যাবে”। সুশান্ত দেখলো এনার গলার আওয়াজে চাপা পড়ে যাচ্ছে সবজিওয়ালার হিসেব। এসএসসি পাওয়া হয়নি, ছেলেমেয়েদের অংক শেখানো হলোনা। টিউশনি গিয়ে সময়মতো মাইনে নেবার অংকটাও ভুল হয়ে গেছে অনেকবার। শুধু মায়ের কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে এসে এই লাইনে দাঁড়িয়ে অংকটা ঝালিয়ে নেওয়া চলছে সপ্তাহে তিনদিন, নাকি একদিন, বৌকে জিজ্ঞেস করতে হবে ফিরে।
“আর দাদা কোথায়?” “ব্যাঙ্গালোরে গেছে আর ফিরে আসেনি, অনেকদিন হলো”। “ওঃ তাহলে তো সে পথও বন্ধ, এখানে থাকলে তোমাদের খাটিয়ে মারতো কিন্তু কিছু সুরাহাও তো হতো, নাকি!” সুশান্ত আবছা শুনতে পেলো “দুশো তেইশ হয়েছে, দুশোকুড়িই দিন”। অদ্ভুত, তিনটাকাটা কোথায় গেলো? যায় কোথায় খুচরো পয়সা, খুচরো দিন, খুচরো মানুষগুলো। এখানে অংক মেলে কই! কি জমকালো গরমিল, আছে কিন্তু নেই। লাইনটা এখন ছায়ার দিকে বেঁকে বিস্মৃতির আনত আকার নিয়েছে। একজন টেম্পোরাল লোবের মত একফালি কুমড়ো নিয়ে চলে গেলেন।
সাইকেলের স্ট্যান্ড পায়ের পাতা দিয়ে ঠেলে “কিছু করো, কিছু করো” বলতে বলতে সত্তরজেঠু বেরিয়ে গেলেন। সুশান্তর কিছুতেই মনে এলোনা এঁর এসএসসি পাস ছেলের অংকে হেল্প করার জন্য ঠিক কত টাকা বাকি আছে। লাইনটা এগিয়ে গেছে। ঠেলা খেয়ে সুশান্তও এগিয়ে গেলো নির্দ্বিধায় অংক করে চলা সবজিওয়ালার দিকে।