একদিন সকালে তিতলি ঘুম থেকে উঠল এক অজানা দুনিয়াতে। ঘুম থেকে ওঠার পর বাড়ির সেরকম কিছু পরিবর্তন দেখেনি অবশ্য। সত্যি বলতে কী বাড়িতে কিছুই বদলায়নি। যেরকম ছিল তেমনি আছে।
ড্রয়িং রুমের এক কোণে অগোছালো একখানা বিছানা। কারোর বসার উপায় নেই সেখানে। তিতলিরই নানান জিনিস, খেলনা, আর বই দিয়ে ভরা সেই বিছানা। মা তো বলে হাতি পর্যন্ত হারিয়ে যেতে পারে সেখানে। তার দুদিকে দুটো বড় বড় ঘর। ড্রয়িং রুমের পাশেই একটা ছোট রান্নাঘর। তার পাশে একটা ছোট তাক যেখানে জলের বোতল, রান্নার ছোট বড় বাসনপত্র রয়েছে, তাছাড়া অনেক ওষুধও রয়েছে। মেন গেটের পাশেই একটা বাথরুম।
ঘুমের ঘোর কাটার কিছুক্ষণ পর তিতলির হুঁশ হল যে সে বাড়িতে একা, মানে বাড়িতে তার মা বাবা কেউ নেই। অবশ্য তাতে তিতলির কিছু খটকা লাগেনি কারণ তার মা বাবা প্রায়ই সকাল সকাল কাজে যেত। বাড়ির মধ্যেই এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আর ফ্রেস হতে হতে যে কখন এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে তার আর সেই খেয়াল নেই।
মা বাবা বাড়িতে নেই দেখে ওর আর পড়তে বসতে ইচ্ছা করল না। ভাবল পড়ার বইয়ের বদলে বরং একটা গল্পের বই পড়বে, যেটা সে কালকেই স্কুল থেকে এনেছে। আর তখনই তার প্রথম চমকটা লাগল।
ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে অবাক কাণ্ড। বইয়ের তাক উধাও। বইপত্তর কিচ্ছু নেই। এমনকি স্কুলব্যাগটা পর্যন্ত উধাও। অবস্থা দেখে তিতলি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। খানিকক্ষণ পর মনে হলো এইভাবে বসে থাকলে তো আর বইগুলো একা একা হেঁটে হেঁটে চলে আসবে না, বইগুলো খুঁজতে হবে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে বইগুলো খোঁজার চেষ্টা করল কিন্তু শেষমেশ না পেয়ে হাঁপিয়ে গিয়ে হাল ছেড়ে দিল।
সাধের গল্পের বইটা না পেয়ে ওর আর এই বাড়িতে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছা করল না। তিতলি তো এখন চাবি দিয়ে তালা খুলতে আর বন্ধ করতে জানে। তাই আর দেরি না করে চলে গেল জুতো পরতে। ইচ্ছে, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসবে। জুতো পরতে গিয়ে আবার চমকে গেল তিতলি। জুতোর র্যাকে দেখে কিনা এক বিশাল বড় জুতো জোড়া। সেই জুতো তিতলির পায়ের মাপের নাকি পুরো তিতলিই তাতে ঢুকে যাবে, তা বোঝা মুস্কিল। কিছুই বুঝতে না পেরে সে তাই খালি পায়েই বাইরে চলে গেল। তালা লাগাতে লাগাতে বোঝার চেষ্টা করল এত বড় জুতো তার বাড়িতে কী করে এলো? তাছাড়া তার বইগুলোই বা কোথায় গেল?
আর তারপর বিল্ডিংটার মেন গেটে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে তিতলির চক্ষু ছানাবড়া! ওর হৃদপিণ্ড বুকের বাইরে প্রায় বেরিয়ে আসছিল! পাঠকের মনে হতেই পারে যে কী এমন হল যাতে তিতলি এইরকম প্রতিক্রিয়া দেখাল?
আসলে সামনে পাঁচটা লাল, নীল, সবুজ ড্রাগন দেখলে মানুষ এইরকমই ব্যবহার করে। অবশ্য সেই ড্রাগনগুলো তিতলিকে কিছুই আঘাত করেনি। তাই তিতলিও আঘাত করেনি। তিতলির মনে এখন ভয় আর আনন্দ দুটোই কাজ করছে।
নিজের বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে রওনা দিল তার সামনে থাকা বিভিন্ন এঁকে বেঁকে যাওয়া রাস্তা ধরে। যাওয়ার পথে কতো পরীদের সঙ্গে আলাপ হলো তার। একেকজন পরী ওকে একেক রাস্তা বলে দিল। ও অবশ্য ওর নিজের মতন করেই নিজের রাস্তায় গেল। খানিক পরে সে দৌড়ে পৌঁছে গেল একটা মাঠে! দৌড়ে হাঁফ লেগে গেল, তাই সামনে একটা বড় পাথরের উপর গিয়ে সে বসে পড়ল। চারিদিকে তখন হাল্কা বাতাস বইছিল।
এমন সময় হঠাৎ কার একটা মিষ্টি কণ্ঠর তিতলির কানে এলো। মনকে যেন কেউ ছুঁয়ে, কানে আবলতাবল বকে চোখের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। পিছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখে কিরকম একটি প্রাণী! ঘোড়ার মতন দেখতে আবার একটা শিং আছে! আজব তো!? তিতলি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর চেঁচিয়ে উঠল, “আরে, এতো পক্ষীরাজ!” ওর চিৎকার শুনে পক্ষীরাজটা তার রঙ্গিন পাখনা মেলে উড়ে গেল। তিতলি তার দিকেই চেয়ে ছিল যতক্ষণ না পক্ষীরাজটা ওর চোখের দৃষ্টির আড়ালে সরে গিয়েছে।
পাথরটার উপরে বসে বসে সেই পক্ষীরাজটার কথাই ভাবছিল। এমন সময় মাঠটা চলন্ত নদীতে পরিণত হয়ে গেল। ভাগ্য ভালো যে তিতলি একটা বড় পাথরের উপর বসে ছিল তাই সে পড়ে যায়নি। তিতলির খুব ভয় করছিল যখন মাঠটা নদী হয়ে গেল। ও মনে করেছিল যে সে নদীতে পড়ে যাবে আর মরে যাবে। অবশ্য সেটা হল না কারণ ও একটা বড় পাথরের উপর বসে ছিল।
পাথরের উপর বসে থেকে নদীর দিকে তাকিয়ে তিতলি একটা বড় হাঁফ ছাড়ল! তারপর অবাক হয়ে দেখল, একটা রূপবতী জলপরী জলের নিচ থেকে মাথার জল ঝড়াতে ঝড়াতে উঠে এলো। তাই না দেখে তিতলি আনন্দতে হাততালি দিয়ে উঠল, “এইতো জলপরী! কে বলেছে যে ওরা সত্যি হয়না? আর গল্পে যেরকম সুন্দর হয় রিয়েল লাইফেও তো দেখি তেমনি সুন্দর!”
তাই শুনে জলপরীটা বলে উঠল, “তুমি আমার সাথে জলের নিচে ঘুরতে যাবে? আমি তোমাকে যেমন নিয়ে যাব সেইরকমই আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসব!” তিতলি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই যাব! কিন্তু আমি যে মানুষ, আমি তো জলের নিচে শ্বাস নিতে পারব না!” জলপরী হেসে বলল, “তুমি এখানে যা মনের থেকে বিশ্বাস করবে তাই সত্যি হবে। চেষ্টা কর ভাবার যে তোমার কানকো আছে এবং তুমিও জলপরী!”
মনে মনে তিতলি তাই ভাবল এবং সে জলের নিচে জলপরীটার সাথে জলপরী হয়ে চলে গেল। প্রথম প্রথম তার কোনও অসুবিধে হয়নি কিন্তু পরে সে আর এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে সে সত্যি জলের নিচে আছে তাই তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। একথাটা জলপরীকে বলাতে সে বলল, “নিজেকে একটা জলপরী মনে কর এবং সেটা বিশ্বাস কর যতক্ষন না আমরা ডাঙাতে ফিরে যাচ্ছি।"
জলের নিচে তিতলি তাই করল এবং শেষ পর্যন্ত নিঃশ্বাস নিতে পারল! তিতলি অবাক হয়ে যাচ্ছিল জলের নিচের এই দুনিয়াটাকে দেখে। কত গাছ, কত মাছ। সবাই নানান রঙের ও আলাদা আলাদা শেপের! তিতলি নিজেকেই বলার মতন করে গাছগুলোকে বলল, “এই! তোরা কী কোরাল?” গাছগুলো একসঙ্গে দুলে উঠে বলল, “হ্যাঁ তো, আমরাই তো কোরাল!” তিতলির চমক দেখে জলপরীর সে কী হাসি! তারপর জলপরী তিতলিকে তার বাড়ি দেখাল আর তিতলির সেই বাড়িটা খুব পছন্দ হল। পছন্দ না হয়ে পারা যায়! শামুকের মতন দেখতে, বাড়ির মাথার উপরে একটা ছোট ঘাস তাছাড়া পুরো বাড়িটা গোলাপি আর নীল! তারপর তিতলি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর আর জলের নিচে থাকতে চাইল না। ও তখন জলপরীর সঙ্গে ডাঙায় উঠে এলো। জলপরী তো জলে থাকে তাই সে তিতলিকে বিদায় জানিয়ে জলের নিচে চলে গেল।
তারপর তিতলি সেই কোরালগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মনের আনন্দে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। এমন সময় হঠাৎ আকাশটা বেগুনি রঙের হয়ে গেল। আর তখনই মা বাবার জন্য মন কেমন করে উঠল। মনে পড়ল ও তো না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে! ও এটাও জানে না ও এখন কোথায়! তিতলির তখন কেমন একটা ভয় করতে শুরু করল। ও যদি হারিয়ে যায়! এছাড়া ওর মা বাবা এতক্ষণে নিশ্চয় ওকে খোঁজাখুঁজি করছে আর বাড়িতে ফিরে ওকে বকা খেতে হবে!
বাড়ি ফিরবে কী করে সেটা বোঝার জন্য এদিক ওদিক তাকাতেই কানে এলো, “কী রে তুই ? আজ ঘুম থেকে উঠবি না! আর দেরি করলে স্কুল যাওয়া হবে না কিন্তু...”। মায়ের গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙল তিতলির। এদিক ওদিক পিটপিট করে তাকিয়ে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, এতক্ষণ যা দেখেছে সেটা স্বপ্ন নাকি সত্যি! তারপর পাশের ঘরে বাবার গলা শুনে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকল, "এসো না মামমাম!”