ভোর রাতে মোড়ের মাথায় দুটো বোমা ফেটেছে; বিস্ফোরণের শব্দ এ'পাড়ার প্যাঁচালো গলি ঘুঁজি বেয়ে, এই দেওয়ালে ওর পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে তাগদ হারিয়েছিল অনেকখানি। তবু অবশিষ্টটুকুর এমনই জোর যে বড়রাস্তার মুখের ফ্ল্যাটবাড়ির কাচের জানলা থরথর করে কেঁপেছিল; ফলতঃ লোকজন ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে বাইরে তাকিয়ে বিহ্বল হয়। তারপর পাঁচতলা অবধি এক এক করে আলো জ্বলে ওঠে -যেন ঐ বোমার আওয়াজ রিমোট কন্ট্রোলে দীপাবলীর মোমবাতি জ্বালাচ্ছে।
ফ্ল্যাটবাড়ির নাম শশীবাবুর সংসার। তার ডাইনে বাঁয়ে একতলা দোতলা পুরোনো বাড়ি, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল। তিন নম্বর বাড়ি মিঠুদের। ও বাথরুমে যাচ্ছিল- আজকাল রাত শেষ না হতেই পেট কামড়ায়, সম্ভবত রাতের খাবার হজম হয় না- ভোরের আগে বমি বমি লাগে; বিছানা ছেড়ে বাথরুমের আলো জ্বালাচ্ছে মিঠু, পাতলা সুজনির তলায় গুলগুলে আর কুন্তী ছিল এতক্ষণ- চাদর সরে যেতেই আড়মোড়া ভাঙছে, এমন সময় গুমগুম আওয়াজ যেন গলির মুখ থেকে এসে ওদের বাড়িতে ধাক্কা খেলো- জলের ফিল্টারের তলার তিন পা টেবিল অনেকদিন নড়বড়ে; ঝাঁকুনিতে ফিলটারের ওপরে উপুড় করে রাখা কাচের গেলাস খানখান হতেই মিঠু চেঁচালো - "মা, ভূমিকম্প"; এমন জোরে চিৎকার করল যে বুকে ধরে রাখা বাতাসটুকু যেন খরচ হয়ে গেল তার। আবার শ্বাস নিল সে, তারপর একদমে- "কতদিন বলেছি এই ভাবে গ্লাস রাখবে না"- বলে, পেট চেপে বাথরুমে ঢোকার আগে চোখের কোণ দিয়ে ডাইনের ঘর থেকে ছন্দাকে আলুথালু হয়ে বেরোতে দেখল। ছিটকিনি দিতে দিতে এক মুহূর্তের কৌতূহল হয়েছিল , বিপ্লবও একই ঘর থেকে বেরোলো কী না জানতে।
ছন্দা প্রথমে বারান্দার , তারপর বাইরের ঘরের আলো জ্বালিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো- সামনের গলিতে আধো অন্ধকার, নর্দমার গন্ধ আর মশার ঝাঁক জমাট হয়ে আছে, হাওয়া বাতাস নেই- কালু, পটল, লালু, বিউটি পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে; পাশের বাড়ির মীনা আর সুধীনকে গেট খুলে রাস্তায় বেরোতে দেখে ছন্দা চেঁচিয়ে বলল- "কী হয়েছে বৌদি?"
মিঠু বাথরুম থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের আওয়াজ পাচ্ছিল। তারপর দমকলের ঘন্টা। কুকুরের ডাক এক জায়্গা থেকে অন্য জায়্গায় সরে সরে যাচ্ছিল। ছন্দার গলা পাচ্ছিল- মা সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তার দিকে যাচ্ছে টের পাচ্ছিল সে। বিপ্লবের কাশির আওয়াজ পেল তারপর। বাথরুমের দরজায় টোকা দিল বিপ্লব, " দেরি আছে রে? একটু যেতাম-"
- আসছি, দাঁড়াও। গ্লাস ভেঙেছে একটা। পা কেটো না।
গলির প্রায় শেষ বাড়ি মিঠুদের। পরের দুটো বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না- প্রোমোটারকে দেওয়া আছে, ফ্ল্যাটবাড়ি উঠবে। ছন্দা, মীনা আর সুধীন এক কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল; বড় রাস্তার দিক থেকে চেঁচামেঁচি, অ্যাম্বুলেন্স আর দমকলের আনাগোণা টের পাওয়া যাচ্ছে। বাতাসে হিম রয়েছে।
-কী হয়েছে মা? ভূমিকম্প হয় নি? বাইরে কী করছ? ভেতরে ঢোকো । ঠান্ডা লাগবে। কুন্তী কই?
- ঘরে আটকে রেখেছি। কোথায় ভূমিকম্প!! মীনা বলছে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেছে। দাঁড়া দেখে আসি। কাচগুলো তুলে ফেলিস। তোর মামু পা কাটলে কেলেংকারি।
মিঠু জানে , মা এখন মীনা আর সুধীনকে বিপ্লবের সুগার ইত্যাদি চোদ্দো রকম অসুখের ফিরিস্তি দিতে দিতে বড় রাস্তা অবধি যাবে; মীনাকাকিমারা মুখ টিপে শুনবে এখন , অথচ বাড়ি ফিরে-
ভাবতেই মিঠুর কান , মাথা গরম হল। মনে মনে নিজেই হাসল তারপর- আজ এত বয়সেও অভ্যাস হল না। ভারি শরীর নিয়ে নিচু হল মিঠু; কাচের টুকরো কতদূর ছড়িয়ে গেছে- অগম সব কোণ থেকে কাচের টুকরো টুকিয়ে আনতে মজা পাচ্ছিল সে। শেষ টুকরোটা কুড়োতে গিয়ে খেয়াল করল দেড় সেন্টিমিটার সূর্যের আলো চৌকাঠ পেরিয়েছে অলরেডি। খিদে পেতে লাগল। চায়ের সঙ্গে কড়া টোস্ট-ফ্রিজ থেকে মাখন বের করে লাগাতেই গলে গলে যাবে - মুখ ভরে জল এল মিঠুর।
ছন্দা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই চেঁচাচ্ছিল, " কত দেরি হয়ে গেল রে! চা বসিয়েছিস? সাঙ্ঘাতিক কান্ড । বোমা পড়েছে মোড়ের মাথায়- যেতে দিচ্ছে না ওদিকে।"
-তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
উত্তর না দিয়ে ছন্দা বাথরুমে ঢুকে গেল।
এই এখন মিঠু, ছন্দা আর বিপ্লব চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অন্যদিন এই সময় সামনের ফুটে বাপি আর মাণিক তরকারি নিয়ে বসে, সামনের মুদীখানার ঝাঁপ খুলে বেচাকেনা শুরু হয়- টুকটাক পাঁউরুটি, মাদার ডেয়ারির পাউচ, মারি বিস্কুট; স্কুলবাস বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়, গলির বাচ্চারা দলবেঁধে বাস ধরতে হাঁটে। মিঠুর রিক্সা আসে- বলাই এলে ছন্দা আর বিপ্লব ব্যালকনিতে দাঁড়ায়; মিঠু হাত নেড়ে কালো চশমা পরে নেয় তখন, তারপর রিক্সার হুড তুলে , হুডের দু'দিকের কলকব্জা টিপে সমান করে, বাদলা দিনেপ্লাস্টিকের পর্দা টেনে দেয়। তারপর,বলাই মিঠুকে বড়রাস্তায় নামিয়ে দিলে সে বাস ধরে কলেজ পৌঁছয়।
আয়নায় তাকালে মিঠুর আজকাল নিজেকে গ্যাসবেলুনের মত লাগে- যেন সুতো ছেড়ে দিলেই আকাশে উড়ে যাবে। এই গলির ওপর দিয়ে, শশীবাবুর সংসারের ছাদের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে সে- তার হাওয়া ভরা হাত, পা, শরীর- বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে মা আর মামু- ভাবতে হাসি পায় তারপর চোখে জল আসে যেন গ্যাসবেলুনের সুতো আটকে আছে ছাদের জং ধরা অ্যান্টেনায়, সে চাইছে আরো উঠতে, তারপর স্রেফ ভেসে যেতে, অথচ টান পড়ছে সুতোয়।
ডক্টর দাস বলছিলেন," মিঠু, ওজন কমা। এখনই হাঁটুতে ব্যথা, কোমরে ব্যথা তোর। এরপর অসুখের ডিপো হয়ে বসে থাকবি"। ডায়েট, নিয়মিত এক্সারসাইজ- না পারলে সকাল বিকাল হাঁটাহাঁটির প্রেসক্রিপশন তার ব্যাগেই আছে, অথচ এই গলি পেরিয়ে বড় রাস্তা অবধি সে হাঁটতে চায় না- বলাইএর রিক্সা লাগে; মিঠুর ভয় করে- এই বুঝি সনতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল- ছন্দা অনেকবার দেখেছে সনৎ কে এ'অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করতে। একদিন নাকী বিপ্লবকে বাজারে ধরে প্রণাম করেছিল-" মামু কেমন আছেন?" ছন্দা সে কথা শুনে চেঁচামেচি করেছে- "তুমি ওকে প্রণাম করতে দিলে?" বিপ্লবকে কাঁচুমাঁচু দেখিয়েছে আর মিঠুর ভয় বেড়ে গেছে তিনগুণ। রিক্সার ঘেরাটোপ, কালো চশমা ছাড়াও আজকাল একটা চাদর নিতে শুরু করেছে মিঠু। তবে ঐ বড় রাস্তার মুখ অবধি। একবার বাসে, লোকের ভীড়ের মধ্যে নিজেকে গুঁজে দিতে পারলে আর ভয় নেই।
আজ রবিবার। মিঠুর কলেজ নেই। বলাইকে আসতে বলেছিল তবু- টুকটাক কেনাকাটা- ক্রীম ট্রীম; নেলপলিশ ফুরিয়ে গেছে, একটা পারফিউম- সকাল সকাল সেরে আসবে ভেবেছিল। তারপর দুপুরে খেয়ে দেয়ে লম্বা ঘুমোবে।
ছন্দাই বলল, "বলাই কি আসতে পারবে আজ? বড় রাস্তার দিক দিয়ে তো কিছুই আসতে দিচ্ছে না।"
বলাই মিঠুকে মোবাইলের নম্বর দিয়ে রেখেছে বহুদিন। রিক্সা চালালে ফোন ধরতে পারে না । আজ একবার বাজতেই ধরে নিল।
- দিদি, আমি তো বড় রাস্তার মোড়ে সেই কখন থেকে। ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ।
-জানি তো। মেলার মাঠের পিছন দিয়ে একটা ঘোরা পথ আছে না সাহেবগলি হয়ে? । আসবে?
-না দিদি। এখানে খুব ঝামেলা হচ্ছে। মাণিক মারা গেছে জানেন তো?
-মানে?
- মাণিককে চেনেন না? আপনাদের বাড়ির সামনেই তো বসে সব্জি নিয়ে। বোমায় উড়ে গেছে।
মিঠুর হাত পা থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে।
-তুমি জানলে কী করে?
- দুজন মারা গেছে দিদি। কী রক্ত, কী রক্ত!! টিভিতে দেখাচ্ছে সব চ্যানেলে- দেখেন নি? বডি দুটো এখন নিয়ে যাবে। রাস্তা খুলবে। তারপর আসব দিদি?
- না , আজ থাক। মা, ও মা, টি ভি খোলো শিগ্গির।
টিভির সামনে থম মেরে বসে আছে বিপ্লব- এ-চ্যানেল ও- চ্যানেল ঘুরিয়ে একই খবর শুনে যাচ্ছে বারবার- যেন মাণিকের মৃত্যুর খবর ভুল বলে প্রমাণ করে দেবে কোনো এক চ্যানেল। ছন্দা খানিক কাঁদল, এখন বাজার কী করে হবে, শান্তি কী করে ঘর মুছতে আসবে-এই সব বলছে। গুলগুলে ল্যাজ তুলে একবার বিপ্লবের পাজামা আর একবার ছন্দার শাড়িতে মাথা ঘষছিল। কুন্তী চাদরের তলায় অ্যাজ ইউজুয়াল। মিঠু হাত বোলাচ্ছিল কুন্তীর মাথায়। তারপর আলনা থেকে ওড়না টানল- " আমি বাজার নিয়ে আসছি"।
বিপ্লব বলল, "তুই বোস, আমি যাই।"
" মিঠু যাক। তোমার আজ বেরিয়ে কাজ নেই ", ছন্দা চোখ মুছল।
"আমি ঠিক আছি" বিড়বিড় করতে করতে বিপ্লব আবার বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল। পা টেনে টেনে হাঁটছিল বিপ্লব, কাঁধ ঝুঁকে গেছে, পায়জামার দড়ি ঝুলছিল; বারান্দার বেসিনে নাক ঝেড়ে বাথরুমে ঢোকার আগে বলল- 'বেশি দূরে যাস না মিঠু' মোড়ের মাথায় সব পেয়ে যাবি।'
এই সব গন্ডগোলে সনৎ এদিকে আসতে পারবে না - মিঠুর মনে হয়েছিল। কালো চশমা, ছাতা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্যাঁচানো গলির শেষ গিঁটটা পার হতে বাঁয়ে ঘাসজমি আর সামান্য এগোলে বড় রাস্তা। আকাশ ঝকঝকে - সাদা মেঘ ছোটো নৌকার মত ভাসছে- যদিও অক্টোবরের শেষাশেষি, তবু আজ যেন বাংলা রচনা বই এর বর্ণনা থেকে সটান উঠে এসেছে পারফেক্ট শরতের আকাশ। ঘাসজমিতে এখনও প্যান্ডেলের খাঁচা - কালিপুজো সবে শেষ হয়েছে। মিঠু একবার ছাতা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল তারপর সামনে। পুলিশে, গাড়িতে, ভীড়ে বড় রাস্তার মোড় থই থই করছে। ওর অসহায় লাগল কেমন- ঝোঁকের মাথায় না বেরোলেই হত। এই ভীড় পেরিয়ে বাজার অবধি কেমন করে যাবে ?
বলাইকে ফোন করতে এবারও বলাই একবারে ধরে নিল।
-দিদি, বেরিয়েছেন?
- তুমি কোথায়?
- আমি তো এই মোড়ের মাথায়, মিষ্টির দোকানের সামনে; -একটু এগিয়ে আসুন। বডি নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষুণি সব ক্লীয়ার হয়ে যাবে।
মিঠু ফোনে কথা বলতে বলতেই এগিয়ে যায়। টেন কম্যান্ডমেন্টস সিনেমায় মোজেসের দু পাশ থেকে যেমন সমুদ্রর জল সরে গিয়েছিল, ভীড়টা সেই রকমভাবে পথ করে দিচ্ছিল দুটি সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহকে। এর মধ্যে একজন মাণিক। গতকাল সন্ধ্যায়ও ওর থেকে টমেটো আর বেগুন কিনেছিল মিঠু। কুপির আলোয় মুড়ি খাচ্ছিল - " নিয়ে যান দিদি, পোকা নেই" বলেছিল।
মিঠুর মাথার ওপরে নীল আকাশ- তার নিচে দুটি প্রাণহীন দেহ। মেঘে মেঘে ঘর বাড়ি তৈরি হচ্ছিল এতক্ষণ, তারপর ভেঙে গিয়ে মানুষের মুখ; একটা ডানাওলা পাখি দুটো সাদা ঘোড়া হয়ে এবারে ঘন মেঘের সুড়ঙ্গ হয়ে গেল চোখের সামনে- ভেতরে কালচে গহ্বর। অমনি ইলেকট্রিক চুল্লির কথা মনে হল মিঠুর। আজকের রোদ আর আকাশের সঙ্গে মৃত্যুকে মেলাতে পারছিল না সে। ওর মনে হচ্ছিল, মৃত্যুতে জীর্ণ দেহ, ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর মেলে শুতে হয় - এই রোদে সে যেন এক মহা পতন। আচমকাই নিজের মৃত্যুর কথা ভাবল মিঠু - এই রকম সাদা চাদরের তলায় যেন তার ভারি শরীর- চুল্লিতে ঢুকে যাবে এইবারে। তারপর এই পতনকে সে অস্বীকার করতে চাইল বারে বারে; আকাশের দিকে তাকিয়ে, কার কাছে চাইল সে নিজেও জানে না- মনে মনে বলল, সে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরতে পারে-