কথামুখ
~~~~~
সেইই কত কা-আ-ল আগে গন্ডোয়ানাল্যান্ড যখন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভলকে ভলকে উগরে দিচ্ছিল গরম ব্যাসল্ট শিলার স্তর। উত্তপ্ত গলিত সেই ব্ল্যাসল্ট ভাঁজে ভাঁজে জমে উঠছিল সমুদ্দুরটার কিনার ঘেঁষে, কত সহস্র বছর পরে সে সমুদ্দুরের নাম হবে আরব সাগর। কিন্তু তখন, পনেরো কোটি বছর আগে ধরিত্রী যখন নেহাৎই কিশোরী, তার শরীরে চলছে নানা ভাঙচুর, সেইসময়ই গড়ে উঠছিল পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। ডায়নোসররা তখনও বেঁচে, তবে কে জানে হয়তো বা ওই গলিত ব্যাসল্টের স্তরের পর স্তর ধেয়ে এসেই মুছে দিয়েছিল ডাইনোদের। তখনকার গল্পগুলো সব তো আর কোত্থাও লেখা নেই। কিছু থেকে গেছে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ ও অজস্র জীববৈচিত্র্য ভরা অপরূপ পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ঘন জঙ্গলে এদিক ওদিক, কিছু থেকে গেছে কঠিন পাহাড়ের গর্ভে। ছোটো ছোটো বসতি, গ্রাম, হতদরিদ্র লোকজন কখনও পেয়ে যায় সেইসব গল্পের খোঁজ। নতুন গল্পও তৈরি হয় বইকি। লোভী মানুষ ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে, বসতি উচ্ছেদ করে গড়ে তোলে দামি আবাসন, চারিদিকে বাজে উন্নয়নের জয়ডঙ্কা। ওদিকে কিছু একগুঁয়ে বেয়াক্কেলে মানুষ পাহাড় জঙ্গল বাঁচাতে জানমান এক করে আন্দোলনে নামে, সরকার বাধ্য হয় বলতে ‘সমস্ত পাহাড় বনদপ্তরের অধীন, ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে আবাসন বা রেস্টুরেন্ট বানানো যাবে না’। লোভী মানুষ কি এতই সহজে ছেড়ে দেবে? তাই কি হয়!
১)
মঙ্গলা ঘুমচোখে বারান্দায় এসে দেখল নীচের রাস্তা দিয়ে লেংচে লেংচে নাকুশা যাচ্ছে, পিঠে যথারীতি নোংরা ঝোলাটা আর কাঁধে ফেলা ছোটো একটা কোদাল। একবার ভাবল ডাকবে ওকে, কিন্তু অনেকটা এগিয়ে গেছে মেয়েটা, এখন ডাকলে আবার ফিরতে হবে। আর রাস্তা এখানে ঢালু, পিছিয়ে আসতে গেলে ঢাল বেয়ে উঠতে হবে। থাক এখন, একটা পা ছোটো হওয়ায় এমনিতেই মেয়েটার হাঁটতে কষ্ট হয়। চোখ কচলে তাকাতে গিয়ে দেখল রোদ্দুরের তেজ বেড়ে গেছে, চোখে বিঁধছে। মার্চের মাঝামাঝি এখন, সকাল তাড়াতাড়ি হয়, সাড়ে সাতটা মানে বেশ বেলা। পাহাড়ের একদম কোলঘেঁষা এই বাড়িটার ৭ তলায় ওদের এই ফ্ল্যাটের ব্যালকনি দক্ষিণ পশ্চিমে খোলা। দক্ষিণে অনেকদূর অবধি দেখা যায়, রাস্তা পাশের অল্প ঢাল বেয়ে উঠে মাঠ পেরিয়ে ছোটো একটা বাজার—ক্রিস্ট্যাল মার্কেট, তারপরে ঘাসজমি, ছোটো ঢিপির সারি, পেছনে আবার কিছু হাইরাইজ। পশ্চিমে পুরোটাই পাহাড়। হাজার কি খুব জোর দেড়হাজার ফুটের বেশি উঁচু হবে না, কিন্তু পুরো এলাকাটা বনদপ্তরের অধীন হওয়ায় একদম উপর পর্যন্ত বেশ ঘন জঙ্গলে ঢাকা। বর্ষা এলে দিন পনেরোর মধ্যে হালকা থেকে ঘন সবুজের শেডে ঢেকে যায় পুরোটা। মার্চের এই সময় অবশ্য বেশিটাই হলদে বাদামি বিবর্ণ ডালপাতায় ভরা। পাতার বুনোট হালকা হওয়ায় খুব খেয়াল করে দেখলে দূরে দূরে ছোটো কিছু বাড়ি দেখা যায়, রাতে মিটমিটে আলো। নামেই গ্রাম এসব, আসলে দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্র কিছু মানুষ কোনোমতে মাথা গুঁজে থাকে। কেউ হয়তো মুরগি, শুয়োর বা ছাগল পালে, কেউ পাহাড়ের ওপাশের ঢাল বেয়ে নেমে সমতলে কিছু সয়াবিন কি অড়রডাল লাগায়। ইলেকট্রিকের খুঁটি আছে বটে কারেন্ট নেই অধিকাংশ গ্রামেই। গত ভোটের আগে মুলশি থেকে জল সরবরাহ শুরু হয়েছে একটু নীচের দিকের তিনটে গ্রামে। অনেকটা উপরের দুটো গ্রামে এখনো জল যায়নি, তবে জলের পাইপ টানা আছে বটে। ওই নীচের একটা গ্রামেই থাকে নাকুশা ওরফে নাক্কিয়া, একটু হাবলামতো, দিনপ্রতি তিরিশটাকা মজুরিতে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে কেটে পাহাড় পাতলা করে।
মারাঠিতে নাকুশা মানে নাকি অবাঞ্ছিত বা অপয়া, বিনীতা বলেছিল। নাকুশার মা তখন ওদের ঘর ঝাড়ুপোছা আর বাসন সাফ করত। তারপর তো মা-টা মরেই গেল আর নাক্কিকে এলাকার এক কর্পোরেটার লাগিয়ে দিল পাহাড় পাতলা করার কাজে। চুপচাপ গিয়ে রাস্তা থেকে একটু উপরে উঠে মাটি কেটে কেটে জমা করবে আর হপ্তায় একদিন কর্পোরেটারের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে জমা করা মাটি। এমনি করে করে পাহাড়টা যখন রোগা হয়ে যাবে, বেঁটে হয়ে যাবে, পাহাড় বলে আর চেনা যাবে না, তখন কর্পোরেটার এসে সেখানে মস্ত আলিশান সব বাড়ি বানিয়ে ফেলবে। নাক্কিয়া তদ্দিনে বড়ো-সড়ো হয়ে সেইসব বাড়িতে কামওয়ালি বাই হয়ে কাজে লেগে যেতে পারবে, চাই কি বিয়ে-শাদিও হয়ে যেতে পারে। ফ্ল্যাটে এখন মঙ্গলা একাই। বিনীতা আর অকষতা বাড়ি গেছে হোলির ছুটিতে। রামিয়া গেছে বাইরের দেশে, ওর তো প্রায় লটারি লেগে গেল গত ডিসেম্বরে, ছয় মাসের জন্য বাইরে যেতে হবে একজনের বদলি। জুনের শেষে কিংবা জুলাইয়ের শুরুতে ওর ফেরার কথা, কিন্তু ইতিমধ্যেই কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে যার বদলি গেছল রামিয়া সে আর ওই দেশে ফেরত যেতে রাজি নয়। তাহলে রামিয়াকেই থেকে যেতে হবে আরও কতদিন কে জানে। এতদিন এই বাড়িটা রামিয়া ছাড়েনি, ভাড়া শেয়ার করছে এখনও। কিন্তু জুনের পরেও থাকতে হলে এটা ছেড়েই দেবে নিশ্চয়ই, খামোখা কত আর ভাড়া গুনবে। বিনীতা এসে যাবে এই সপ্তাহেই, অকষতা অবশ্য বড়ো ছুটিতে গেছে, মাসের শেষের দিকে ফেরার কথা। বাড়ি যাবার কথা মনে হলেই মঙ্গলার কেমন বমি বমি পায়, শরীর অস্থির করে। ওই বছরে একবার কালীপুজোর সময়টায় যায় দুদিনের জন্য, কোনোমতে চোখকান বুজে থেকে আসে ক-টা দিন। ওদের ওখানে কালীপুজোর খুব ঘটা, পিসিরা, জ্যাঠা-জেঠিরা সব আসে। মঙ্গলার মা একা আর পেরে ওঠে না এখন, সমানে গজগজ করে ‘আমি আছি এক ঝিমাগি সবার প্যালা দিতে’ আরও নানা কথা। মঙ্গলা তাই ওই তিন-চারটে দিন মা-র সাথে যতটা পারে হাতে হাতে করে নেয়। ভাইফোঁটা পার করেই ট্রেনে চাপে ও আর এখানে আসতেও তো প্রায় দুটো দিন লেগে যায়।
ব্যাংকে মানে ওর অফিসে পৌঁছে মঙ্গলা দেখল আজও লোক বেশ কম, হোলির পরে প্রায় সাত-আট দিন হয়ে গেল তাও অনেকেই ফেরেনি হয়তো বাড়ি থেকে। এরা আবার বাড়ি যাওয়াকে বলে ‘গাঁও যানা’। প্রথমদিকে ও বেশ করে বোঝাত যে ওর বাড়ি ঠিক গ্রামে নয়, শহর থেকে দূরে বটে, তবে গ্রামও নয়। সবাই মন দিয়ে শুনত তারপর হাসি হাসিমুখে বলত—হ্যাঁ হ্যাঁ ওই তোমার গাঁও। আজ লোক তো বেশ কম তাও কেমন গরমভাব ভেতরে। বছরে এই তিন সাড়ে তিনমাস বাদ দিয়ে গরম তেমন পড়ে না এখানে, সারাবছরই একটা না ঠান্ডা না গরম ভাব। বর্ষাকাল জেঁকে এলে বরং বেশ শীত শীতই লাগে। কুলকার্নি স্যার বলেন আগে এখানকার কোনো বাড়িতে পাখার পয়েন্টই বানানো হত না, এসি তো কল্পনারও বাইরে। ২০০৭-০৮ থেকে শহরটা যত গায়ে-গতরে বাড়তে শুরু করল, ততই সব গাছ কেটে ফেলা হতে লাগল আর গরমও বাড়তে লাগল। ওদের ব্যাংকেও সেন্ট্রাল এসি। তবে সত্যি বলতে মঙ্গলার এসি-তে একটু সমস্যাই হয়, তাই অফিসে ও বেশিরভাগ সময় একটা শাল জড়িয়ে রাখে মাথায় গায়ে। ওদের বাড়িটায় খুব হাওয়া। এপ্রিল মে-র গরমেও সন্ধের পর পশ্চিম পাহাড়ের দিক থেকে চমৎকার হাওয়া দেয়, রাতেও বেশিরভাগ দিন পাখা লাগেই না। ব্যাংকে ওর কাজ খানিকটা পিওন আর খানিকটা ম্যানেজার কুলকার্নিস্যারের অ্যাসিসটেন্ট। স্যারের ঘরে আলো দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখে স্যার এসি চালাননি, ঘরটা বেশ গরম হয়ে আছে। রিমোট হাতে নিতেই স্যার হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “আরে, এসি চালিও না খবরদার। কী একটা বাজে অসুখ এসেছে একটু ঠান্ডা লাগলেই মানুষ মরে যাচ্ছে।” মঙ্গলা অবাক হয়ে ভাবল তাই জন্যই বাইরে থেকে এসে হলে ঢুকেও গরমভাব লেগেছিল, ভেবেছিল হয়তো দেরিতে চালানো হয়েছে তাই ঠান্ডা হয়নি এখনও। ইতিমধ্যে সাংখে স্যার আরও দুই-তিনজনকে নিয়ে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে আসেন আর স্যার আবারও হাঁ হাঁ করে ওঠেন, “এতজন একসাথে এত ছোটো ঘরে নয়, এক এক করে এসো।”
২)
মাঝারি সাইজের একটা ডাফলব্যাগে অল্প কয়েকটা জামাকাপড়, পেস্ট ব্রাশ, সাবান এটা সেটা টুকিটাকি ভরছিল বিনীতা। মঙ্গলা ঘরে ঢুকে ওকে গোছাতে দেখে অবাক হয়ে গেল। এই তো সবে পরশু অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেলা ঝকমারি সয়ে ফিরল বিনীতা। সেই যে দোলের ছুটিতে বাড়ি গেছিল আর তো ফিরতে পারেনি। যেদিন ফেরার কথা সেদিন সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা হওয়ায় দু-দিন বাদে আসার প্ল্যান করে। তা সেও আগের রাতে হঠাৎ তিনঘণ্টার নোটিশে মাঝরাত থেকে সারাদেশ বন্ধ হয়ে যায়। সমস্তকিছু থেমে থাকার মেয়াদ বাড়তেই থাকে। কী এক অদ্ভুত অজানা অসুখের আতঙ্কে সারাদেশ কাঁপছে, অকষতা এখনও ফিরতে পারেনি। বিনীতা একটা বড়ো-সড়ো প্রাইভেট হাসপাতালের স্থানীয় শাখায় অফিস অ্যাসিস্টেন্ট, আর পাঁচদিনের মধ্যে জয়েন না করলে ওর চাকরিটাই যেত, সেরকমই তো বলল এসে। এখন আবার কোথায় যাচ্ছে তাহলে? বিনীতা বলে ওকে আজ থেকে হাসপাতালেই থাকতে হবে, ছোঁয়াচে অসুখ, কার কীভাবে ছোঁয়াচ লাগছে ডাক্তাররাও বুঝে পাচ্ছেন না, তাই এই ব্যবস্থা করেছে। তারপর ঠোঁট মচকে বলে এই যে এতদিন প্রায় আড়াইমাস ছুটিতে রইলাম সেই কাজ উশুল করতে হবে না? মালিক অমনি অমনি পগার গুনছে মাসে মাসে? কতদিন থাকতে হবে সেসব কিছু জানায়নি, ও তাই সাতদিনের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে। বেশি হলে দরকারমতো বাড়ি এসে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারবে। ওর থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে বিনীতা বলে “তু মান লে ইয়ে ফেলাট তেরি হি হো গই ম্যান”, মঙ্গলাকে মজা করে ‘ম্যান’ বলে ডাকে বিনীতা। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় হয়তো ওর লম্বা-চওড়া চেহারাটার জন্যই ব্যঙ্গ করে ওভাবে, কিন্তু বিনীতার ব্যবহারে কখনও কোনো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ছোঁয়া পায়নি মঙ্গলা। অকষতাও রামিয়ার মতো আইটিতে আছে, ওকে নাকি ওর আকোলার বাড়িতে ডেস্কটপ পৌঁছে দিয়েছে ওদের কোম্পানি থেকে, বলেছে আগামী কয়েকমাস বাড়ি থেকেই কাজ করুক। এখন বিনীতাকে আবার হাসপাতালে গিয়ে থাকতে হবে। মঙ্গলার মনে হয় ও একটা আজব স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গেছে, কিছুতেই বেরোতে পারছে না।
এমনিতে শনিবার ছুটি হলেও এই অসুখটা আসার আগে অকষতাকে মাসে অন্তত দুটো শনিবারে অফিস যেতেই হত। আর-একটা প্রোমোশান হলে বাড়ি থেকে কাজ করবার সুবিধে পাবে ও, তাই প্রাণপণে খাটত। এই ক-দিনে কোত্থেকে যে কী হয়ে গেল একেবারে অফিস থেকে লোক পাঠিয়ে আস্ত কম্পিউটার বাড়িতে, শুধু বাড়ি না গাঁওতে পাঠিয়ে দিল! অকষতা প্রথমদিকে খুব চিন্তায় ছিল, ফিরতে পারছে না, চাকরিটাই না চলে যায়। এপ্রিলের শুরুতে কোম্পানির কম্পিউটার ওর বাড়ি পৌঁছাবার পরেও আরও কত সমস্যা। আকোলা ছোটো জায়গা, নেট কানেকশান ঠিকমতো থাকে না, বাড়িতে কাজ করার সময় আশেপাশের বাড়ি থেকে চিৎকার, রাস্তা থেকে কুকুরের ডাক গোরুর ডাক ভেসে আসে, ওকে নিয়ে অফিসের মিটিঙে সবাই হাসাহাসি করে। অকষতা তখন ফোন করে মঙ্গলাকে রোজ জিগ্যেস করত বাস চলছে কি না, ওলা উবের চলছে কি না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেল, অকষতা এখন ভাবছে একবার আসতে পারলে এসে বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাবে। “ফালতুমে রেন্ট কায় কো ভরনেকা?” এই বাড়িটায় একটা শোবার ঘর, একটা বসার ঘর একটা বাথরুম, রান্নাঘর খাবার জায়গা আর ছোটো একটা বারান্দা, ব্যালকনি বলে এখানে। শোবার ঘরে আর বসার ঘরে দুটো করে খাট পেতে ওরা চারজনে থাকে, মাথাপিছু আড়াই হাজার দিতে হয় ভাড়া। খাইখরচা, কেবল লাইন, ঘরমোছা বাসনমাজার বাই সব মিলিয়ে আরও আড়াই থেকে তিন হাজার পড়ে। এরা সবাই চলে গেলে মঙ্গলা একা তো টানতে পারবে না এত খরচ, ওকে আবার বাড়ি খুঁজতে হবে তাহলে। রামিয়া বলেছিল ও না ফিরলে ওর কোম্পানি থেকে আর-একজনকে খুঁজে দেবে। কিন্তু সবাই যদি যে যার গাঁওতে চলে যায় বা অফিসে গিয়ে থাকতে শুরু করে, ভাড়া নেবে কে? মঙ্গলার কাজ তো বাড়ি থেকে করবার মতো নয়। আর তিন-চারদিনের বেশি থাকার মতো কোনো ‘বাড়ি’ও তো ওর নেই।
হাসপাতালের স্টিকার লাগানো গাড়ি এসে বিনীতাকে নিয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে। আজ মঙ্গলাকে অফিস যেতে হবে না, সবকিছু বন্ধ হবার পর প্রথম প্রথম ওকে সপ্তাহে দু-দিন করে যেতে হত। এখন সপ্তাহে তিনদিন করে যাচ্ছে, আগে থেকে ফোন করে কয়েকজন কাস্টমার আসে। জনধন অ্যাকাউন্ট যাদের, তারা অবশ্য সোজা চলে এসে টাকা চায়, ফোন-টোনের বালাই নেই। কে নাকি বলেছে প্রধানমন্ত্রীজি সব্বাইকে পাঁচশো টাকা করে পাঠিয়েছেন, তাই এসেছে টাকা তুলে নিতে। বিশ্বাস করতে চায় না যে কোনো টাকাই আসেনি অ্যাকাউন্টে, রাগ করে। চিৎকার চেঁচামেচি, কখনও টেবিলে দরজায় দুমদাম ঘুঁষি। নাক্কিয়ার তাউজি এরকম একদিন উত্তেজনার সময় মঙ্গলাকে দেখে হঠাৎ কেঁদে ফেলেছিল—“কাম ধান্ধা কুছ নহি আজ ঢাই মাহিনা, ঘরমে একপাও জোয়ারি ভি নাহি, কেয়া করেঁ ম্যাডামজি, বাতাও না স্যারকো।” কদিন আগে ক্রিস্ট্যাল মার্কেটের এগরোলওয়ালা, লন্ড্রির ডেলিভারি দেবার ছেলেটা, বিসমিল্লা চিকেনের হেল্পার আরও কয়েকজন মিলে এসেছিল দোকানগুলো খোলার কথা বলতে, ঘরে দানাপানি নেই। সোসাইটির মেম্বাররা সব বাসিন্দার থেকে চাঁদা তুলে ওদের প্রত্যেককে পনেরো দিনের রেশন কিনে দিয়েছে। দোকান খোলা তো সরকারের হাতে, আর কেউ এখন রাজিও নয় সব খোলাখুলিতে। কামওয়ালি বাই, ড্রাইভার, খবরের কাগজওলা এরাও সব বেকার। লিটল অ্যাঞ্জেল স্কুলের গাড়ি চালাত ইয়োগেশ, সকালে চারঘণ্টা করে সবজি নিয়ে বসছে গেটের বাইরেটায়। ওই চারঘণ্টায়ই দুধ, সবজি, মুদি দোকানের জরুরি জিনিসপত্র যা লাগে সব নিয়ে আসতে হয়। মাছ মাংস পাওয়াই যাচ্ছে না, ওষুধের দোকান অবশ্য বিকেল ছটা অবধি খোলা। বিনীতা কাল রাত্তিরে ফিরে বলছিল ওদের হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ড বলতে কিছু আর নেইই এখন, পুরোটাই এই নতুন অসুখটার জন্য আলাদা করে দিয়েছে। অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকায় মঙ্গলা, বর্ষা আসবে আর দিন পনেরোর মধ্যেই, পাহাড়ের মাথা মেঘে ছাওয়া।
৩)
অফিসে বেরোবার ঠিক আগে নাকমুখ ঢাকার নাকোশ, কপাল থেকে থুতনি অবধি ঢাকার পাতলা পলিথিনের চাদর, মোটা দস্তানা, অফিসের ব্যাগে একটা টিফিনবাক্সে ক-টা রুটি আর ঢ্যাঁড়শভাজা সব গুছিয়ে নিতে নিতেই অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেন শুনে বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল মঙ্গলার। এমনিতে ক-দিন ধরে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন দিন নেই রাত নেই বেজেই চলেছে। মুলশি, পিরঙ্গুট, মানগাঁও থেকে রুগিদের যাবার মতো সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল হল বিনীতাদেরটা। সরকারি হাসপাতাল অন্তত দেড়ঘণ্টার রাস্তা, তাই জরুরি পরিস্থিতিতে লোকে ধারদেনা করে জমি বেচেও ওখানেই নেয় সাধারণত। নতুন অসুখটার জন্যও এরা নাকি ভালোই ব্যবস্থা করেছে, তবে আট কি দশদিন থাকলে কুড়ি থেকে পঁচিশ লাখ মতো লাগে। মঙ্গলা জানে এই অসুখটা হলে ওকে চুপচাপ মরে যেতে হবে, অত টাকা একসাথে ওর বাপ-দাদাও চোখে দেখেনি কখনও। কিন্তু আজকে সাইরেনের আওয়াজটা যেন বড্ড কাছে। সাইরেনটা থেমেও গেল হঠাৎ। আকাশটাও কেমন থম ধরে আছে, তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে নীচে এসে বেরোতে গিয়ে বাধা পেল, ওদের বিল্ডিঙের নীচে মূল প্রবেশপথের বাইরে লাল পলিথিনের চকচকে পট্টি বাঁধা, দুটো লালরঙের রাস্তা আটকানোর ত্রিভুজও বসানো। আশেপাশের বিল্ডিঙের কয়েকজন অধিবাসী নাকোশ, দস্তানা মাথায় টুপি পরে একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দড়ির তলা দিয়ে গলে বেরোতেই একজন হাঁ হাঁ করে ওঠে—“মৎ যাইয়ে উধার”, উলটোদিকের বিল্ডিঙের চারতলায় একজন আশঙ্কাজনক অবস্থার রোগীকে নিতে এসেছে অ্যাম্বুলেন্স। সত্তরের উপরে বয়স ওই আঙ্কলের, চেনে মঙ্গলা, অমায়িক বৃদ্ধ সবার সাথে হেসে কথা বলেন, কুশল জিজ্ঞেস করেন। সম্ভবত দৈনন্দিন বাজারহাটের সময় কারও সাথে কথা বলতে গিয়ে ছোঁয়াচ লাগিয়েছেন। লাল-নীল আলো জ্বালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে যাবার পরে ব্লিচিং জল দিয়ে পুরো চত্বর ধোয়া হল। তারপরে অফিস রওনা হতে পারল মঙ্গলা।
অফিস পৌঁছাতে বেলা সাড়ে এগারোটা, মাত্র দু-জন কাস্টমার ক্যাশ কাউন্টারে, কুলকার্নি স্যারের ঘর অন্ধকার। আজ যেসব কর্মীর আসার কথা তার মধ্যে মাত্র তিনজন এসেছে, মঙ্গলাকে নিয়ে চারজন। ওকে দেখে ডাকল বিটঠল, বাড়ি বা গাড়ির ঋণ সংক্রান্ত বিভাগে বসে, চোখেমুখে কথা বলে। আজ ব্যাংক দুটোর সময় বন্ধ হয়ে যাবে, কুলকার্নিস্যার বলে পাঠিয়েছেন। কী এক ঝড় তেড়ে আসছে মুম্বাইয়ের দিকে, বিকেল চারটের মধ্যে সবাই যেন দুই তিনদিনের মতো খাবারদাবার নিয়ে বাড়ি ঢুকে যায়। মঙ্গলা শোনেনি কিছু। এই তো সেদিন ওদের ওদিকে মারাত্মক ঝড় হয়ে গেছে, মঙ্গলাদের বাড়ির নিম আর জামগাছ দুটো ভেঙে পড়ে গেছে। বাসস্ট্যান্ডের মোড়ের মস্ত বটগাছ উপড়ে জিটি রোড বন্ধ করে দিয়েছে, মা বলছিল সেদিন। রাগ করছিল ও কোনো খবর নেয়নি কেন? মঙ্গলা গতমাস থেকে আর কেবল রিচার্জ করেনি, টিভি চলে না অনেকদিন। অফিসে কাগজ আসে একটা ইংরিজি, একটা মারাঠি। এক তো কাগজ পড়তে ওর ভালোলাগে না আর ইংরিজি কাগজ পড়ে বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়, অতক্ষণ সামনে ধরে রাখতে লজ্জা করে। ওদিকের ঝড়ের কথা জানতই না। এদিকে আবার কীসের ঝড় আজ? এদিকে ঝড়ঝাপ্টা তেমন দেখেনি মঙ্গলা। হ্যাঁ বৃষ্টি হয় খুব। এই তো গতবার টানা পাঁচদিন ধরে এমন বৃষ্টি হল যে সাংলির ওদিকটায় নীচু ঘরবাড়িগুলো সব ভেসে গেল, মুথার জল বেড়ে রাস্তায় উঠে অটোশুদ্ধু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দুজনকে, সিসিটিভির সেই ফুটেজ পুলিশ ছড়িয়েছে সবার মোবাইলে যদি কেউ কোনো হদিশ দিতে পারে। চমকে ওঠে বিটঠলের উঁচু গলায় “আররে মউসি কেয়া শোচতি রহতি হো? সুনো তো সাহিই”... একটু ধাক্কা লাগে বুকে ‘মউসি!!’ ওকে মউসি বলে ডাকছে? এত বুড়ি হয়ে গেল কবে ও? জীবনটা এখনও একটুও গোছানো হল না যে... বিটঠল বলে যাচ্ছে, ম্যাঞ্জারসাবের কাল থেকে জ্বর, কাশি, গলায় চেরা চেরা ভাব, মুখে স্বাদ নেই, এখন দু-হপ্তা ঘরেই থাকবেন যদি না হাসপাতালের দরকার হয়। মঙ্গলা পরশু পর্যন্ত ওঁর ঘরে একেবারে কাছে থেকে কাজ করেছে, ওঁর জুঠা চায়ের কাপ খাবার প্লেট সাফ করেছে, ফাইল পৌঁছে দিয়েছে অন্যদের কাছে, মঙ্গলাও আগামী দিন পনেরো কুড়ি বাড়িতেই থাকুক, ও এখন হাই রিস্ক।
‘হাই রিস্ক’ ‘হাই রিস্ক’ শব্দদুটো মাথার মধ্যে ঠঙাস ঠঙাস করে ঘুরতে থাকে। ওরও কি গলা খুসখুস করছে? জিভের তলা শুকনো কাঠ। সকালে ভাজার সময় ঢ্যাঁড়শের গন্ধ পেয়েছিল ও? মনে পড়ছে না, ভ্যাবলামুখে আশেপাশে তাকায়। উপস্থিত তিনজন কর্মী আর এক গ্রাহক ওরই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কুলকার্নিস্যারের ঘরের গিয়ে ঢোকে, আলো জ্বালিয়ে কোণে রাখা ফিল্টার থেকে জল নিয়ে খায়, টেবিল চেয়ার মুছতে গিয়েও ভাবে থাক গে। আলো নিভিয়ে বেরিয়ে আসে, একটা নাগাদ অফিস থেকে বেরোয়। স্কুটি নিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখে এর মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে ঝিপ ঝিপ করে। স্কুটিটা আসলে রামিয়ার, ওদের কাছে চাবি দিয়ে বলে গেছিল চালু রাখতে। বিনীতার নিজের নতুন অ্যাকটিভা, সেটা নিয়েই ঘোরে। অকষতা আর মঙ্গলাই চালাত পালা করে, তারপর এই মার্চ থেকে মঙ্গলা একাই চালাচ্ছে। কী ভাগ্যিস লাইসেন্স একটা করিয়ে রেখেছিল গতবছর। নিজের জন্য কিনে উঠতে পারেনি যদিও। পেট্রোলের খরচাটা লাগছে, তেমনি অটোভাড়া বাঁচছে। তবে রাস্তায় বাস অটো এখন কোথায়ই বা! ‘হাই রিস্ক’ আবার মাথায় ঘাই মারে। ওর যদি অসুখটা হয় তাহলে কী করবে ও? রামিয়া একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল হোয়াটস্যাআপে, এক মস্ত লম্বা চওড়া মেমসায়েব কাশতে কাশতে দুমড়ে যাচ্ছিল, দম নিতে না পেরে সবুজ চোখজোড়া ঠিকরে আসছিল... প্ল্যাস্টিকে মুড়িয়ে মাটির গভীরে পুঁতে দিচ্ছে... মাথা ঝিমঝিম করে, বৃষ্টির জোর বাড়ল একটু, স্কুটির গতি বাড়ায় মঙ্গলা। কে-মার্টে ঢুকে দুধ পাঁউরুটি ম্যাগি নিয়ে দেখল টাটকা পালংশাক আছে আর দুই তিনটে মুরগি। মনটা একটু খুশি হল, একমাসের বেশি হয়ে গেল মাছ বা মাংস কিছুই পায়নি। অন্যরা সব মোবাইলে অর্ডার করে, অনলাইন না কী যেন। ও ঠিক সাহস পায় না, কোনোদিন করেনি, তাই দোকানে যা মেলে সেই ঢ্যাঁড়শ, করোলা, বেগুন আর বরবটি দিয়েই চালিয়ে গেছে। আলুও বেড়ে পঁয়তাল্লিশ টাকা কেজি হয়েছে, টিপেটিপেই আলু দেয় রান্নায়। এককিলো চিকেন কাটিয়ে নিয়ে নেয়, সবাই তো বলে নাকি প্রচুর প্রোটিন খাওয়া দরকার।
৪)
বাড়ি এসে ভালো করে স্নান করে জামাকাপড় কেচে আদা দিয়ে চা করে সাথে মুড়ি মেখে নিয়ে বারান্দায় আসে। হাওয়া শুরু হয়েছে এলোমেলো, ছাট আসছে, পাহাড়টা মনে হচ্ছে বাড়ির উপরে ঝুঁকে আসছে ক্রমশ, জায়গায় জায়গায় সবুজ ছোপওয়ালা বাদামি গায়ের মস্ত একটা দৈত্যের মতো লাগছে পাহাড়টাকে। ব্যালকনির কাচের পাল্লা টেনে দিয়ে ভেতরে এসে মোবাইলে এফ এম চালায় মঙ্গলা ‘রেডিও মির্চি ৯৮.৩ অলওয়েজ খুশ’। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে খুব ফুর্তি করে বলছে ঝড়টা মুম্বাইয়ের উপকূলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এখন মুম্বাইকে পাশ কাটিয়ে নীচের দিকে সরে গেছে, আলিবাগে আছড়ে পড়ে ভেতর দিকে ঢুকে কর্ণাটকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, মুম্বাই এখন নিরাপদ। তবে বৃষ্টি চলবে। যাহ লোকে শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিল। কে-মার্টের ক্যাশ কাউন্টারের ভাইয়া পর্যন্ত ওকে বলল “জলদি জলদি ঘর যাও ম্যাডামজি চক্রিবাদল আনে কা খবর হুই।” গেটের সিকিউরিটি কাকা ওকে স্কুটি বেসমেন্টের শাটারওলা পার্কিঙে লাগাতে বলল, আর কিছুক্ষণ পরে মেন গেট বন্ধ করে ওরা সোসাইটি অফিসে চলে যাবে। সকলেই এত ভয় পাচ্ছে আর ঝড় কেমন পাশ কাটিয়ে পালাল দেখো! এফ এম বন্ধ করে ইউটিউবে যায়, ছোটোবেলার গান খুঁজে বের করে স্পিকারে দেয়, ঘরজুড়ে গেয়ে ওঠেন আশা ভোঁসলে ‘ময়না বল তুমি কৃষ্ণ রাধে তাকে মন দিতে যে চাই কেমন বাধে।’ এই গানটা ওদের পাড়ায় কারণে অকারণে বাজত, কেউ মাইক বাজালেই হল। ছোটোবেলায় ভারী দস্যি ছিল মঙ্গলা, পাড়ায় নাম ছিল ধিঙ্গি মেয়ে। তখন কেমন কোনোকিছুই গায়ে লাগত না, আর সেই ওকে আজ মউসি বলে ডাকে। এতদিন চেনা অচেনা সবাই ম্যাডামজি বলত, তবে কি হাই রিস্ক হওয়াতেই মউসি হয়ে গেল? হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল মুড়িতে মাখা চাট মশলার টকঝাল গন্ধটা পাচ্ছে, তার মানে অসুখটা এখনও ধরেনি। কাল ভালো করে ঝাল দিয়ে চিকেনের ঝোল করবে বাড়ির মতো, দুটো-তিনটে আলু কেটে দেবে না হয়, মা যেমন করে, বাবা খুব ভালোবাসে বড়ো বড়ো আলু দিয়ে ঝোল। কে জানে ওদের সাথে আর কখনও দেখা হবে কি না।
আরও ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে, বাইরে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, এফ এম ঘুরিয়ে দ্যাখে ক্যারক্যার আওয়াজ হচ্ছে, সিগনাল নেই। ঘড়িতে সময় বিকেল চারটে তিরিশ, ঘরের আলোটা দুবার কেঁপে উঠে নিভে গেল। টিউবটা গেল? নাহ, পুরো বাড়িরই কারেন্ট গেছে। সমস্ত জানালা বন্ধ করে ভেতরের ঘরে আলমারির গায়ে লাগানো আয়নাটায় নিজেকে দেখে, এক প্রেতিনীর মতো লাগে যেন। ছটফটিয়ে বাইরে ব্যালকনিতে আসে আর অমনি ঝড়বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে এসে জাপটে ধরে। আকাশ থেকে একটা ঘোলাটে ছাইরঙের পর্দা নেমে এসেছে পাহাড় ছাপিয়ে কোথাও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, নীচের রাস্তাটাও না। পাহাড়টা কেমন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে না? যেন নীচু হয়ে এসে ওকে ব্যালকনি থেকে তুলে নেবে। একবার দেখবে নাকি বেরিয়ে? সেই ছোটোবেলায় যেমন কালবৈশাখীর ঠিক আগে বেরিয়ে পড়ত ওরা। মাথায় ঝড় চোখে ঝড় নিয়ে মঙ্গলা ব্যালকনির দরজা, ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে নীচে আসে, চিঠির বাক্সের ফাঁক দিয়ে চাবিটা ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ে পায়ে বড়ো গেটের সামনে আসে। লোহার গেট টেনে আটকানো মোটা শেকল দিয়ে। একপাশে সরু ফালিমতো একটা দরজা খোলা, বড়োজোর একটা লোক সাইকেল নিয়ে যেতে পারে। বেরোতে বেরোতে আবছা কানে আসে দূর থেকে কেউ ডাকছে ‘ম্যাডামজি ম্যাডামজি’। কান না দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। আকাশ যেন ওকে দেখে খুশিতে লকলকিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে এদিক থেকে ওদিক অবধি। সোজা হয়ে হাঁটা যাচ্ছে না হাওয়ায় হেলিয়ে দিচ্ছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে পাশের ঘাসজমি, ওটা টপকালেই দক্ষিণের পাহাড়টার গা বেয়ে সরু পাকদণ্ডি, টলে টলে উঠতে থাকে মঙ্গলা। নীচের দিকে ঘাসজমি, ছোটো ছোটো ঝোপ, অনেকটা উপরে প্রায় চুড়ার কাছে বড়ো বড়ো গাছ, নীচে মার্কেটের দিকটায় তীব্র আলোর ঝলকানির সাথে বোমা ফাটার মতো আওয়াজ... চারিদিক আরও বেশি অন্ধকার হয়ে গেল... ট্রান্সফর্মার গেল নাকি? যাগ্গে যাক। যা খুশি হোকগে।
হাওয়ার তেজ আরও বেড়েছে, কেমন রাতপাহারা পার্টির হুইসেলের মতো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে চারপাশ থেকে। পা পিছলে যায়, নাক্কিয়া, এক পা ছোটো নাক্কিয়া এইখান দিয়ে উঠে যায় রোজ, ধিঙ্গি মউসি মঙ্গলা পারবে না? কোথায় যেন অনেক কাচ নাকি টিন একসাথে আছড়ে পড়ল... সোজা হয়ে ওঠা যাচ্ছে না চার হাতেপায়ে মাটি খামচে ওঠার চেষ্টা করে। নিম আর করঞ্জা গাছদুটো ওকে সামনে পেয়ে ডালপালা বেঁকিয়ে আদর করতে চায়। বৃষ্টি আরও জোরে নামে, সামনে এক পা-র বেশি দু-পা দেখা যাচ্ছে না। কোথা থেকে এত মাটি উঠছে... কালচে লাল মাটি গোল হয়ে ঘুরছে ওর চারপাশে। উচ্চমাধ্যমিকের মার্কশিট নিয়ে ক্লাসের আর সবাই দূরের জেলাশহরের কলেজে পড়তে যাচ্ছে, মঙ্গলা মায়ের সাথে নিটোল গোল পাতলা ফোলা ফোলা রুটি করছে। আরও মাটি উড়ছে, একটু যেন গাঢ় কমলা মাটি ওর চারিদিকে চোঙের মতো ঘিরে উড়ছে। মুলানদী ফুঁসে উঠে দু-কূল ভাসিয়ে ঢুকে এসেছে, নদীতীরের পেশোয়াদের বানানো রাস্তা ভেঙেচুরে বয়েজ হাইস্কুলের দোতলার লিন্টেল অবধি ডুবিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছাইরঙা জল—১২ জুলাই ১৯৬১ তুমূল বৃষ্টিতে পানশেত বাঁধ ভেঙে ভেসে যায় পুনা। মাটিতে জলেতে পিছলে পড়ে যায়, ওঠে, এত মাটি... লাল কমলা মাটি.... উড়ছে উড়ছে... তিলক স্মারক মন্দির আলোয় সাজানো, শ্রীপদ ডাঙ্গে, শ্রীধর যোশী, কেশব রাও আরও কত লোক হাসছে, আনন্দ করছে, মোদক বিলোচ্ছে—১ মে ১৯৬০, আজ থেকে মহারাষ্ট্র আলাদা রাজ্য হয়ে গেল। কমলারঙা মাটি উড়ছে, বৃষ্টির জলে মিশে ঝাপসা কমলা স্ক্রিন টাঙানো, ইস্কুলে নাটকের মতো; প্যাঞ্জিয়া থেকে ছিটকে যাচ্ছে গন্ডোয়ানা, ফাটলের ফাঁকে হট স্পট থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে লাভা, ফিসার তৈরি হচ্ছে, কত শত বছর ধরে এলাকাজোড়া অগ্ন্যুৎপাতে স্তরে স্তরে গড়ে উঠছে দাক্ষিণাত্য মালভূমি—লীনা দিদিমণির ভূগোল ক্লাস, মঙ্গলারা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ মঙ্গলা মউসি, ব্যাংকের পিওন হাই রিস্ক মঙ্গলা বৃষ্টির জল আর চোখের জলে একাকার মুখে ঝলকানো বিদ্যুতের আলোয় ভারী নিশ্চিন্ত হয়ে থেবড়ে লেবড়ে বসে পড়ে আদিম গন্ডোয়ানা ভূমিতে।
‘আমি আলোর ভিতরে শুধু ধ্বংস, হাড় হৃৎপিণ্ড, রোদনের স্রোত দেখে
এসেছি তোমার কাছে ফিরে ফিরে হে পাবক, অগ্নিশিখা হে তীব্র তামস!’
~~~~~
এই লেখার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। শুধু প্রচন্ড নাড়া দিয়ে গেল সেই কথাই মনে থাকে। এতো অবলীলায় হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়, দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে পড়ে এ তো কেবল বাইরের নয়, এ ভেতরেরও দুর্যোগ !
খুব ভালো লাগল, দমুদি।
ইতিহাস ধরা থাকল ।কি নির্মোহ ভাবে বলা !
শব্দ যেন খেলে গেল।মঙ্গলা কখন যে মনে বসে গেল কে জানে।আবার পড়ব আবার ভাবব।
খুব ভালো লাগলো গল্পটা। খুব সহজ শব্দে, বাক্যে, অনেক গভীর আর জোরালো কথা বলে দেওয়া। মনে একটা নাড়া লাগে। একটু বসে ভাবতে হয়।
সঙ্গের ছবিটা অসম্ভব সুন্দর। আমি ছবির গ্রামার বুঝিনা। তাই শুধু এইটুকু বলেই ক্ষান্তি দিতে হচ্ছে!
বেশ.... খুব ভালো লাগল।
গল্পটার দুটো জিনিস স্পর্শ করে, একটা হলো পশ্চিমঘাটের নিখুঁত বর্ণনা এবং তার আবহ। এছাড়াও বাঙালি লেখক সচরাচর তার কমফর্ট জোন ছাড়তে চায় নাা। এই লেখা সেখানে ব্যতিক্রম।
তবে, কথামুখের একাংশ পড়ে মনে হয়েছে, লেখক, পাঠকদের কিছুটা আন্ডার এস্টিমেট করছেন। এটা বাড়তি মনে হয়েছে।
কি লেখা মা রে মা!!আবার পড়তে হবে।
একজন দক্ষ গল্পকারের গল্প নিয়ে নিজের কোনা ভালো না লাগার কথা বলতে দ্বিধা হয়। এটা খুব-ই সম্ভব যে গল্পটি বুঝতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। সে ক্ষেত্রে এখন যা লিখতে যাচ্ছি সেটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার অনুরোধ রইল। গল্পটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, গল্পের (মুখবন্ধ বাদ দিয়ে) দুটি ভাগ - শুরু থেকে ৪)-এর প্রথম অনুচ্ছেদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আর তার পর থেকে বাকিটা। প্রথম ভাগটি অসাধারণ লেগেছে, অত্যন্ত স্বাভাবিক লেগেছে, দ্বিতীয় অংশটি গল্পটিকে সমাপ্তিতে আনার জন্য বানিয়ে তোলা লেগেছে। এবং এই অংশটির জন্যই গল্পের মুখবন্ধটির দরকার পড়েছে বলে মনে হয়েছে।
ঝড়ের রাতে মঙ্গলা যেন তার কৈশোরে ফিরে যাচ্ছে, পৃথিবীও যেন তাই-
এই কনসেপ্টটা সমাপ্তিতে ঘনিয়ে আনতে যে ভাষা, যে এক্সপ্রেশন এসেছে তা প্রশংসনীয়।
তবে, আমার মত সাধারণ পাঠকের বিচারে, অনেক কিছু নির্মমভাবে ছেঁটে ফেলার ছিল- ছোটোগল্প বলেইঃ যেমন কথামুখ, কবিতার লাইন ইত্যাদি -
লেখক এই গদ্যকে উপন্যাসে নিয়ে যাওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন..
প্রতিভা, অভ্যু, স্বাতী
ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।
যাহ আগের পোস্টটা অর্ধেক গেছে।
সুদেষ্ণা, সুরমিতা, শত, ধ্ন্যবাদ জানবেন।
কেকে, ধন্যবাদ। হ্যাঁ গো ছবিটা আমারো খুবই ভাল লেগেছে। পাইয়ের ছবিগুলো এক একটা এত অদ্ভুত বিস্ময়কর!
কুশান, ধন্যবাদ ভাই। ঠিক আন্ডার এস্টিমেট না, লিখছি পরে।
একলহমা, দ্বিধার কিছু নেই তো। বড়জোর বলা যায় আপনার আর আমার ফ্রিকোয়েন্সি মেলে নি। আমি সাধারণত গোলগাল গল্পে ঠিক স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। পড়ার জন্য ধন্যবাদ জানবেন।
ছোটাই, মঙ্গলা ঘুরেফিরে আসছে, হয়ত কখনো উপন্যাস হয়েও যেতে পারে বলা যায় না। নানাবিধ কারণে আমার এখন ঠিক বাঁধাছকে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। মানে গল্প বলেই এরকম বা উপন্যাস বলেই ওরকম কিম্বা একেবারে ফৌজী ইইউনিফর্মের মত আঁটোসাটো মাপের জিনিষ ইত্যাদি। আর এমনিতে আমার পাঠক খুবই অল্প, হাতেগোণাই বলা যায় প্রায়, গুরু আবার এসব ছেপেও দেয়, তাই যেমন ইচ্ছে লিখি আর কি। ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।
এইবারে এক আধটা কথা খুব সংকোচের সাথে লিখেই রাখি। পশ্চিমঘাটের পাহাড়গুলো পনেরো কোটি বছর ধরে ঘটে চলা যাবতীয় ঘটনারই সাক্ষী। এই যে পাহাড়গুলো কেটে ফেলে ছেঁটে ফেলে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে আমার কেমন মনে হয় ওদের যদি স্মৃতি বলে কিছু থাকত তা তো এমনিভাবে একেবারে লুপ্ত হয়ে যেত। আর জিওলোজিস্টরা বলেন পাহাড় পর্বতের মাটির স্তর থেকে অনেক কিছু জানতে পারেন। তা সেই মাটি যখন কেটে কেটে পাহাড়টা নেই করে দেওয়া হয় তখন ঐ মাটি যে সমস্ত সময়ের ঘটনার সময় ছিল, সেইগুলো র স্মৃতি নিয়েই মিলিয়ে যায় হয়ত। এইসব ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে কথামুখ। অনেকের কাছে বক্তব্য পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছি দেখাই যাচ্ছে। ভাববো কী করে এই কথাগুলো পৌঁছনো যায় সবার কাছে।
আবারো ধন্যবাদ যাঁরা পড়লেন তাঁদের।
কথামুখ্টা আর কবিতার চার লাইন আসলে গল্পেরই অংশ কিন্তু আলাদাভাবে লিখে প্রক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে, যেন গল্পটা লিখেও এই কথাগুলো আলাদা করে বলতে হচ্ছে, কারণ গল্পটা ভেতর থেকে এগুলো বলতে পারেনি। এরকমই মনে হলো। গল্পের সাথে কোনভাবে মিশিয়ে দিতে পারলেই হতো !