অনেকক্ষণ বই পড়লে, ল্যাপটপে ভিডিও দেখলে আমার চক্ষুদুটি কিঞ্চি প্যাঁ-প্যাঁ করে ওঠে। চোখ 'প্যাঁ-প্যাঁ' করা আমাদের পুত্রদেবের শিশুবেলায় ভোকাবুলারি। এমন কিছু ইউনিক শব্দসৃষ্টি অনেক শিশুই করে থাকে। আজন্ম কলকাতার বাইরে বড় হয়ে, দেরিতে কথা ফুটে, যুক্তাক্ষরে হোঁচট খেয়ে মনোভাব প্রকাশের তাগিদে সে ছোটবেলায় এমন সব বিচিত্র শব্দ সৃষ্টি করেছিলো। চোখ 'প্যাঁ-প্যাঁ' করিতেছের নির্গলিতার্থ - ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
আরেকটা মজার উদাহরণ নেওয়া যাক। সন্ধেবেলায় জামনগরে লাখোটা লেকের ধারে বাজারে গেছি তিনজনে। বৌ হঠাৎ কনুই দিয়ে ঠোনা মারে। শুধোই, কী হোলো? কানে কানে বলে বৌ, ওর হিসি পেয়েছে বলছে। বাড়িতে তো - বমি থেকে বাহ্যে - শিশুদের সব দায়িত্ব মায়েদের। তবে ছেলেটা তো আর বাণের জলে ভেসে আসেনি। তার ধরায় আগমন আমাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার। তাই বাইরে বেরোলে তাকে হিসু করানোর দায়িত্ব আমি স্বেচ্ছায় পালন করতাম। তাই তার ড্যানা ধরে নিয়ে গেলুম একটা নর্দমার ধারে। ছেলের পেছনে দাঁড়িয়ে, কোমর ঝুঁকিয়ে, হাফ প্যান্টের জিপ খুলে, দু আঙ্গুলে ঐটি ধরে, মুখে - সিইইই, সিইইই আওয়াজ করি।
ইলিউসিভ 'অচ্ছে দিনের' মতো আমার মুখে সিসিই সার - হিসি আর আসেনা। কোমর ব্যাথা করছে। ছেলে আমার দু আঙ্গুলে তার মহার্ঘ সম্পদ নির্দ্বিধায় সমর্পন করে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে। কী হলো রে? হিসি পেয়েছে বললি যে? জানতে চাই আমি। ছেলে করুণ গলায় বলে, পেয়েছিলো তো, এখন আসছে না। আর একটু দাঁড়াও, 'চেষ' করে দেখি। অর্থাৎ যেটা তখন ওর আসছে মনে হয়েছিল, করতে গিয়ে দেখা গেল ছলনা, তাই আর একটু চেষ্টা বা ওর ভাষায় - 'চেষ' করতে চায়। তবে শুধু শিশু নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা চাষীর দ্বিগুণ আয়ের জন্য নিবেদিতপ্রাণ দেশসেবকরাও অহোরাত্র 'চেষ' করে চলছেন। কাঙ্ক্ষিত ফল এলো বলে।
শিরোনামের প্রসঙ্গটি ২০১৮ সালের। তখন আমাদের একমাত্র পুত্র মনিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অসময়ে কর্মজীবনে অবসর নিয়ে আমরা তিনজন ওখানে একটি চারশো ফ্ল্যাটের হাউসিং সোসাইটিতে একটা বড় দ্বিশ্যয্যার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ছিলাম। ছেলে হোস্টেল ছেড়ে আমাদের সাথেই থাকে। সেই ফ্ল্যাটের কিচেন বারো বাই বারো। আঠারো বাই চোদ্দ ড্রয়িং রুমে টেবল টেনিস খেলা যায়। দুটো বেডরুমে বাড়িওলার দুটো ডাবল বেড পাতা আছে। ভাইনিং স্পেসে দেওয়াল সাঁটিয়ে ডাইনিং টেবল রেখেও যে জায়গা ছিল সেখানে পেতেছি আমাদের ডাবল বেড খাট।
ওটা বারোয়ারী খাট। এই খাটের মাথার দিকে আছে কিছু না পড়া বই। অন্য দিকে পড়া কাগজের ডাঁই। আছে ইস্ত্রি করতে যাওয়ার জন্য ব্যাগে জমা করা কাচা কাপড়ের ডাঁই, রোল করা যোগা ম্যাট একটা, জলের বোতল কয়েকটি, দুটো ছাতা। এককোনে শুয়ে আছে দুটো রোগা ডাম্বেল। তলানি বাহুবল টিকিয়ে রাখতে কখনো একটু ভাঁজি। পাশে একটা টামি ট্রিমার। ইচ্ছে হলে পা ছড়িয়ে বসে একটু রোয়িং করি। বৌ ঐ খাটে ফ্যানের তলায় বসে খবরের কাগজ পেতে সবজি কাটে। এহেন নানাবিধ কাজকর্ম হয় ঐ খাটে।
দেওয়ালে প্লাস্টিক ইমালশন, তাতে ঝুলছে দূর্বোধ্য ছবি, নিয়মিত ডাস্টিং করা ঝাঁ চকচকে আসবাব, ওয়াল ক্যাবিনেটের মাঝে ৫৬ ইঞ্চি এলইডি টিভি, দুপাশে দাঁড়িয়ে লম্বকর্ণ জিরাফকন্ঠী বাঁকুড়ার বিখ্যাত ঘোড়া .... এমন মিউজিয়াম সদৃশ বাড়িতে থাকতে আমার দমবন্ধ লাগে। এমন বাড়ির ফুলকাটা ফলস্ সিলিংয়ে মাকড়সাও পেটে ডিম নিয়ে চারদিকে আটপায়ে দৌড়ে মরে ভাগ্যকে গাল পেড়ে - কেন যে মরতে ঢুকেছিলাম এ বাড়িতে! এখন নেক্সট জালটা কোথায় পাতি রে বাবা! প্রতি হপ্তায় তো ভ্যাকুয়াম ক্লীনার দিয়ে আপদ চাকরটা শোঁক শোঁক করে টেনে নেয় সব জাল। এদিকে লালা তো শুকিয়ে কাঠ!
প্রাচীন বনেদী বাড়ির রঙচটা বিশ ইঞ্চি দেয়ালে কুলুঙ্গির কোনে ফুরিয়ে আসা ড্রিমফ্লাওয়ার ট্যাল্কের গোলাপী লম্বাটে কৌটো, খিলান ওয়ালা বড় দালান, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে চড়াইয়ের অবাধ আনাগোনা, উঁচু কড়ি বরগার ছাদ, তার ফাঁক ফোঁকরে রোমান্টিক পারাবত প্রিয়ার জুটি ... এসবের একটা মিস্টিক নস্টালজিক এসেন্স আছে।
কখনো মধ্যবিত্ত বাড়িতেও পাওয়া যায় অন্য আর এক ধরণের মিস্টিক চার্ম। ঠাকুরদার আমলের পালিশওঠা ভারী মেহগনি খাট যা সরাতে চারজন লাগে। ছতরির কোনে তাল পাকানো তালি মারা মশারি। দেওয়ালে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে ঝুলছে বন্ধ হয়ে যাওয়া কুক এ্যান্ড কেলভি গ্ৰ্যান্ডফাদার ক্লক। পাশে ঠাকুমার কারুকার্যময় বার্মাটিকের আলমারি। তার পাশে আলনা। সিলিং থেকে ঝুলন্ত ও আজও ঘূর্ণায়মান নব্বই বছরের হেরিটেজ ফ্যান - 'জিইসি তুফান' - কাঠের চার ব্লেডের সেই ডিসি ফ্যান এখন কন্ভার্টার দিয়ে এসিতে চলে। কি হাওয়া! এসব উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। এর সাথে জড়িয়ে থাকে বহু মধূর স্মৃতি। একটু দুরে মূর্তিমান কন্ট্রাস্ট। হাল আমলের ফঙ্গবেনে ডাইনিং টেবিল ও চেয়ারের সেট। ঐতিহ্যময় অতীত ও পানসে বর্তমানের কোলাজ। আমার মন্দ লাগে না এমন বাড়িতেও। মাটির কিছুটা কাছাকাছি মনে হয় নিজের অস্তিত্ব। শেষবেশ ওতেই তো মিলতে হবে। তাই যদ্দিন বাঁচি ফুটপাতের ধুলো বাঁচিয়ে কিঞ্চিৎ ওপরে থেকে যতটা পারি মাটির গন্ধে আঁচাই। ওপারে যাওয়ার আগে খুব বেশি ওপরে ওঠার সাধ নেই। সাধ্যও নেই।
তবে চতুর্দিকে প্রাণে ধরে ফেলতে না পারা নানা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর ডাঁই, দেওয়ালে পুরোনো ক্যালেন্ডার, দেওয়ালের কোনে ঝুল, খাটের তলায় আবর্জনা, চিমসে গন্ধ - এমন বাড়িও ভালো লাগে না।
কড়ে আঙুলের টোকায় স্ফটিকের ফুলদানি উল্টে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকার মতো টিপটপ ড্রয়িং রুমের চেয়ে আমার পরিচ্ছন্ন কিন্তু একটু আগোছালো ঘরে থাকতে বেশ লাগে। দীপাবলীর আগে দোকান ঝাড়পোঁছ করার মতো হয় কেউ আসার হলে তার আগে ঘরদোর ভালো করে গোছগাছ হয়। অতিথি চলে গেলে ঘরদোর আবার যে কে সেই - ভোটের পরে রাস্তার মতো।
আমার চোখ 'প্যাঁ-প্যাঁ' সিনড্রোম যে কোনো সময় হতে পারে। তখন চোখে দু ফোঁটা আইটোন দিয়ে ধপাস করে ডাইনিং স্পেসের ঐ বারোয়ারী খাটে টুকুন বডি ফেলার স্বর্গসুখ আমার মতো অলস সম্প্রদায়ের অকোজো ঢেঁকি ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে না।
ছেলের কলেজ কাছেই। দুপুর খেতে আসে। খেয়ে আবার কলেজে যায়। ফেরার নির্দিষ্ট সময় নেই। কখনো পাঁচটায় চলে আসে। লাইব্রেরীতে গেলে দেরি হয়। তাই আমি সদর দরজায় ছিটকিনি দিই না। ওকে বলেছি বেল বাজিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবি না। ইয়েল লকের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেখবি আগে। দরজা বন্ধ থাকলে তবেই বেল দিবি। ছেলে বলে, তুমি যেভাবে সী বীচে ভেসে এসে আটকে যাওয়া জেলিফিশের মতো খাটে পড়ে অঘোরে ঘুমোও, একদিন দেখবে কেউ ঢুকে ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যাবে। আমি বলি, বাজে বকিস না। গেটে সিকিউরিটি, চারদিকে সিসি ক্যামেরা, ক্যূরিয়ার, আমাজন, জোমাটো, সুইগির ছেলেগুলোকেও খাতায় সই করে ঢুকতে হয়। এটা কলকাতা নয়, এখানে ওসব হবে না। তাই ঐ অবস্থাই জারি আছে। ও বেল না বাজিয়ে ঘরে ঢোকে। তাই এখন বেল বাজে কেবল ক্যূরিয়ার বা গ্যাস এলে।
সেদিন বেলা চারটে অবধি মোবাইলে শব্দের গামছা বুনে চোখটা 'প্যাঁ-প্যাঁ' করে উঠলো। পত্রপাঠ সেই খাটে ধপাস। খানিক বাদেই বেশ মিঠে একটা তন্দ্রা মতন এসেছিল তখনই - ডিং ডং। কী ব্যাপার? দরজাতো খোলা। গ্যাসও আসার নেই। তবে কি ক্যূরিয়ার? বাড়িতে বারমুডা পরে খালি গায়ে থাকি। বড় আরাম। ছেলের বন্ধুরা আসার থাকলে ছেলেই আগাম ফোন করে জানায়, বাবাই আমার সাথে শ্রীজা আর দিন্দু আসছে, গায়ে জামা দাও। তখন দিতে হয়। এখন আবার কে এলো?
কাঁচা ঘুম ভাঙ্গা আঠালো চোখে গায়ে একটা গামছা ফেলে বাইরের দরজা খুলি। চাচী ৪২০ গোছের এক স্থানীয় মহিলা বাইরে দাঁড়িয়ে। চাপা রঙ, মধ্য বয়স, জাঁদরেল চেহারা। ঘুম চোখেও বুঝতে পারি তিনি ভুল দরজায় বেল বাজিয়ে ফেলেছেন। এমন অনেকবার হয়েছে। শনিবার রাত দুটোয় কারুর ঘরে পার্টি থেকে কোনো কারণে বেরিয়ে পুনরায় ফেরায় সময় কেউ বন্ধুর ফ্লোর গুলিয়ে ফেলে আমাদের ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়েছে। আমায় দরজা খুলতে দেখে সোমরসে চুরচুর বালক ''সরি আঙ্কল, সরি আঙ্কল' বলতে বলতে পালিয়ে গেছে। বা ফ্ল্যাট নম্বর ভুল দেখে ফুড ডেলিভারি দিতে এসে আমাদের ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় দরজার ওপরে লেখা ফ্ল্যাট নম্বর মিলিয়ে দেখা।
মুখে নীরব প্রশ্ন মাখিয়ে মহিলার দিকে তাকাই। তিনি কিন্তু দরজার ওপরে ফ্ল্যাটের নম্বর না দেখে আমাকেই খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। হয়তো ভাবেন ফ্ল্যাট তো এটাই মনে হচ্ছে, তাহলে হয়তো কাজের লোক বদল হয়ে গেছে। গায়ে গামছা, না কামানো দাড়ি, হাফ প্যান্ট পরিহিত আমায় দেখে তেমন ভাবলে তাকে দোষ দেওয়াও যায় না। কিন্তু মুখে কিছু জিজ্ঞাসাও তো করে মানুষ। তাও না। আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি মুখ গলিয়ে বাঁদিকে তাকান। একটা বড় কার্টনে ভরা আছে সবার কচিৎ ব্যবহারের জুতো। তার পাশে আগের ভাড়াটের ফেলে যাওয়া বেতের জুতোর র্যাক। এতক্ষনে চাচীর মুখে একটু অপ্রস্তুত হাসি ফোটে। অর্থাৎ, দোষ নিওনি কত্তা, টুকুন ভুল হয়ে গেছে। তিনি কিছু না বলে চলে যান।
আমি চিন্তিত মুখে দরজা বন্ধ করতে করতে ভাবি, ঘরের নম্বর নয়, বাড়ির কর্তাকে কাজের লোক ভেবেও নয় - জুতোর র্যাক দেখে বুঝতে হলো ফ্ল্যাটটা ভুল? আশ্চর্য!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।