এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ভোটুৎসবে ভাট - স্বপনে তাহারে (পুনশ্চ)

    সমরেশ মুখার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৮ মে ২০২৪ | ২৩৫ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩
    শিবাংশু‌র অতীতের লেখাটি পড়ে বর্তমান শিবের গাজন আমার দুই প্রাক্তন  বন্ধুর সাথে এক রসিক শিক্ষকের মিথস্ক্রিয়া আধারিত। পাঁচ থেকে বারো ক্লাস অবধি আমি পড়েছিলাম হাওড়ার এক মামূলী স্কুলে। কিন্তু আমার কিছু বন্ধু - উৎপল, অর্জুন, চন্দন, অমিতাভ, সুকুমার পড়তো এক ঐতিহ্য‌ময় স্কুলে - হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন। সে স্কুলে‌র অনেক প্রাক্তন ছাত্র পরে নানা উচ্চপর্যায়ের পদ অলঙ্কৃত করেছে। 
     
    তো সেই স্কুলে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন শ্রী বামন‌দেব চক্রবর্তী। সেকালে ইংরেজী গ্ৰামারে  নেসফিল্ড সাহেবের মতো সমাদর পেয়েছেন প্রফুল্ল কুমার দে সরকার। তেমনি বামনদেব চক্রবর্তীর বাংলা ব‍্যাকরণ‌ও ছিল এক প্রামাণ্য গ্ৰন্থ। ১৯৬৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে হালেও একবিংশতম পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পুনর্মুদ্রণ হয়েছে বহু‌বার। অর্থাৎ মূল প্রণেতার প্রয়াণের পরে‌ও কিছু কালজয়ী পুস্তক বাজারে চলতে পারে বহুদিন। 

    সেকালে অনেক বাড়িতে‌ই পড়ার ঘরে থাকতো বামনদেব চক্রবর্তীর বাংলা ব‍্যাকরণ ও   পি.কে. দে-সরকারের ইংরেজী গ্ৰামার। আমি যদিও ও দুটোতে‌ই লবডংকা তবু দিদি ও দাদার দৌলতে আমাদের বাড়িতে‌ও ছিল ঐ দুটি ব‌ই। দাদা, দিদি জীবনের পথে ছড়িয়ে গেছে দূরে।  আমার কাছে রয়ে গেছে ব‌ই‌ দুটো - যত্ন সহকারে। ওটা‌ই আমি ভালো‌‌ পারি - সযত্নে সাজিয়ে রাখতে নানা অকিঞ্চিৎকর দ্রব‍্য। এবং স্মৃতি - তবে যাদের নিয়ে ঘেরা তা,  তাদের হয়তো মনে‌ও থাকে না তা।

    বন্ধুদের সাথে আড্ডায় শুনেছি ব‍্যাকরণের মতো নীরস বিষয় পড়ালেও এবং রাশভারী ব‍্যক্তি‌ত্বের অধিকারী হলেও অন্তঃসলিলা নদীর মতো বামনদেববাবুর অন্তঃকরণে‌ ব‌ই‌তো প্রচ্ছন্ন রসময়তা। তাই ব‍্যাকরণের পাঠ‍্যপুস্তক লিখলেও  তিনি লিখেছেন দুটি উপন‍্যাস‌ও। তাদের নামকরণে‌‌‌ও পাওয়া যায় তাঁর রসবোধের পরশ - "বিধিচক্রের অজ্ঞাত‌বাস" এবং "কহনে না যায়"।

    বামনদেব বাবুর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন ক্লাসে ছাত্রদের নামের বদলে পদবী ধরে ডাকা। তবে এক‌ই পদবী‌র অন‍্য ছাত্র থাকলেও যাকে উদ্দেশ করে ডাকা হচ্ছে সে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারতো। কারণ তিনি সম্বোধন করতেন তার দিকে দৃষ্টি‌ নিক্ষেপ করে। সাথে থাকতো তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে পদবী‌র আগে, পরে কিছু শব্দ সংযোজন। যেমন "ওহেএএ চাটুজ্জ‍্যে" বা "এই যেএএ ঘোষ মহাশয়"। তা শুনে এড়িয়ে যেতে চাইলেও যে মনকানা তার স‍্যারের দিকে না তাকিয়ে উপায় থাকতো না। ছাত্রদের মারধোর তিনি পছন্দ করতেন না। তাই বিচ‍্যূতি হলে তাকে বাংলামাধ‍্যমে সবার মাঝে সেঁকতেন। সেটা তিনি খুব উপভোগ‌ও করতেন। দুটি উদাহরণে তা পরিস্কার হবে। তার দ্বিতীয়‌টিতে থাকবে বর্তমান "স্বপন‌কুমার" প্রসঙ্গ।

    অমিতাভ ব‍্যানার্জী গৌরবর্ণ, দীর্ঘ‌কায়, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। সময়ের একটু আগে‌ই হরমোনের তৎপরতা‌য় তার মুখে দেখা গেছি‌ল দাড়ি গোঁফ। দশম ক্লাস পেরোতে ওর সমবয়সীদের ওপরোষ্ঠ, চিবুক বা গণ্ডদেশে যখন সবেমাত্র নবদূর্বার আভাসমাত্র দেখা দিচ্ছে অমিতাভ তখন থেকেই নিয়মিত সেলুনে যায়। ওর ঐ দাড়ি গোঁফের প্রাদুর্ভাব ও পরিপুষ্ট চেহারার জন‍্য ওকে ক্লাসের মধ‍্যে একটু  বড়ই লাগতো। কিন্তু মনটা তো সেই হারে পরিপক্ক হয়নি। তাই তখন‌ও ওর স্বভাবে রয়ে গেছিল কিছু কৈশোরোচিত কৌতূহলের রেশ।

    তো একদিন হয়েছে কী, বামনদেব বাবুর ক্লাসে অমিতাভ পিছনের দিকে তৃতীয় বেঞ্চে বসে বাঁদিকে‌র জানলা দিয়ে ক্ষণিক বা‌ইরে তাকিয়ে অন‍্যমনস্ক হয়ে গেছিল। বামনদেব বাবুর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তা এড়ালো না কিন্তু তিনি এক‌ই ভঙ্গিতে পড়িয়ে চললে‌ন। যেন কিছুই খেয়াল করেননি। কিন্তু আধ মিনিট বাদে‌ও অমিতাভ‌কে গভীর একাগ্ৰতায় বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি চুপ করে গেলেন। তাও অমিতাভর নজর ফিরলো না স‍্যারের দিকে। স‍্যারের দৃষ্টি অনুসরণ  করে প্রথম দিকের বেঞ্চের কিছু ভালো ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে চাইলো। কিন্তু অমিতাভ যেন সেই মুহূর্তে হয়ে গেছে অহল‍্যার কিশোর ভার্সন। জমে গিয়ে নিথর ভাবে তাকিয়ে আছে বাইরে।

    বামনদেব বাবু তাঁর ট্রেডমার্ক স্টাইলে বললেন, "ওহেএএ বাঁড়ুজ্জ‍্যে, বিচ্ছেদটা কিন্তু এদিকে হচ্ছে।" 
     
    অমিতাভ চমকে এদিকে তাকিয়ে বলে, "এ্যাঁ, কী বললেন স‍্যার? ঠিক বুঝতে পারলাম না।" 
     
    উনি ওনার পেটেন্টেড রসময় ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, "এ্যাঁ নয়, হ‍্যাঁ। বিচ্ছেদ। মানে সন্ধি বিচ্ছেদের সূত্রগুলো এদিকে, মানে ক্লাসের ভিতরে বোঝা‌নো হচ্ছে। বাতায়নের বাহির হতে আকাশবাণী হচ্ছে না। তুমি বাইরে কী দেখছো বলো তো তখন থেকে?"

    "স‍্যার, একটা প‍্যাঁ‌চা" কিঞ্চিৎ ভ‍্যাবাচ‍্যাকা খেয়ে বলে অমিতাভ।  

    "প‍্যাঁচা-আ-আ-আ!!!" মা লক্ষীর বাহনকে বিলম্বিত লয়ে টেনে, বিষ্ময়সূচক ধ্বনি সহকারে সম্বোধন করে অতঃপর তিনি অমিতাভ‌র উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত বাক‍্য সম্পূর্ণ করেন "দিনদুপুরে তুমি জানলার বাইরে তাকিয়ে পেচক দেখতে পাচ্ছো?"

    "হ‍্যাঁ, স‍্যার, দেখুন আপনি, ঐ তো আমগাছের ডালে বসে আছে, সাদা একটা লক্ষীপ‍্যাঁচা। তাই তো আমি‌ও খুব অবাক হয়ে গেছি‌লাম স‍্যার।"    
     
    বামনদেববাবু জানলা দিয়ে আমগাছের দিকে তাকান। বেচারা অমিতাভ। তার আগে‌ই সে‌ই প‍্যাঁ‌চা বা প‍্যাঁ‌চানী ফুরুৎ করে উড়ে গেছে। তার নাম ধরে বামনদেববাবুর বেশ জোরে ডাকার জন‍্য‌ও হতে পারে, ওদের তো শ্রবণক্ষমতা খুব তীব্র।

    ঐদিকে পাশেই  ছিল একটি তিনতলা নিবাস। লক্ষীপ‍্যাঁচা উড়ে গেলেও, পুনরায় অমিতাভর দূর্ভাগ্যের ফলে‌ই হয়তো ঠিক তখন‌ই ছাদের পাঁচিলে কাপড় মেলছিল একটি ফুটফুটে সদ‍্যপরিণীতা লক্ষীমন্ত বৌ। বামনদেব বাবু আমগাছে যা খুঁজছিলেন না পেয়ে খানিক তাকিয়ে র‌ইলেন ছাদের দিকে। হয়তো মনে পড়লো তাঁর যৌবনের কথা। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে তিনি ফিরে এলেন ব্ল‍্যাকবোর্ডের সামনে। 
     
    অমিতাভ দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। তিনি উদাস ভঙ্গিতে বললেন, "আসলে তোমার কোনো‌ দোষ নেই বুঝলে বাঁড়ুজ্জ‍্যে। বয়সটা কুড়ি‌ পার হ‌ওয়ায় আগে‌ই তোমার মনটা করতে শুরু করেছে উড়ি উড়ি। তাই ভরদুপুরে প‍্যাঁ‌চা দেখতে পাচ্ছো। যাকগে এবার এদিকে একটু মন দা‌ও।" 

    স‍্যারের বলার ভঙ্গিতে ক্লাশসুদ্ধ ছেলে মুখ টিপে হাসছে। অমিতাভ গালে দুদিনের না কামানো দাড়ি‌তে হাত বুলোতে বুলোতে তখন এক পাজি প‍্যাঁ‌চার প‍্যাঁ‌চে পড়ে অপ্রস্তুতের একশেষ। অকালে শ্মশ্রু গুম্ফের আধিক‍্যর জন‍্য ওর বন্ধু‌রা ওকে আদর করে ডাকতো 'দাদু' বলে। ঐ ঘটনার পর ছাদে ঐ বৌটি এলে ছেলেরা অমিতাভ‌কে ক্ষ‍্যাপাতো, "ঐ দ‍্যাখ দাদু, বৌমা এসেছে রে।" অমিতাভ হাসিখুশি ছেলে। এসবে রাগতো না বরং উপভোগ‌ই ক‍রতো।

    উৎপল ছিল ব‌ইয়ের পোকা। সবরকম ব‌ই পড়তো। তবে স্কুলে নিয়ে যেতো কেবল স্বপনকুমার। চটি ব‌ই। সুবিধা হোতো। নীরস ক্লাসের মাঝে ফাঁক পেলে ব‌ই পড়তো। সেদিন নিয়ে গেছিল কালনাগিনী সিরিজের ১৭ নম্বর চটি - মহাশুন‍্যে কালনাগিনী। এমনি‌তে টিফিন টাইমে পড়লে‌ও সেদিন এমন একটা জায়গায় সুন্দরী লাস্যময়ী দস‍্যুনেত্রী কালনাগিনী‌ আশমানে ঝুলন্ত যে তার‌পর কী হোলো জানার জন‍্য মনটা আঁকুপাঁকু ক‍রছে ওর। তখন কি আর নীরস ব‍্যাকরণের কচকচি শুনতে ভালো লাগে। 
     
    তাই বামনদেব বাবু কিছু বলছেন, মাঝে মাঝে বোর্ডে লিখছেন উৎপল পিছনের দিকে একটা বেঞ্চে বসে মনযোগী পড়ুয়া‌র মতো বামনদেব‌বাবু‌র‌ই মোটা ব‍্যাকরণ ব‌ইটা হাই বেঞ্চে রেখে, মাঝখানে চটি কালনাগিনী রেখে পড়ে যাচ্ছে। ভাবখানা যেন স‍্যার যা পড়াচ্ছেন সেটা‌ই ও ব‌ইয়ের পাতায় দেখছে। সেদিন তিনি যেভাবে অমিতাভ‌র অন‍্যমনস্কতা ধরতে পেরেছি‌লেন তা ছিল সহজ। কারণ ও তাকিয়ে ছিল বাইরে। আজ উৎপল ব‌ইয়ের ওপর মুখ ঝুঁকি‌য়ে থাকলেও অভিজ্ঞ শিক্ষকের মনে হোলো শরীর ক্লাসে থাকলেও উৎপলের মন পড়ে আছে অন‍্য কোথাও। 
    গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "এ‌ই যে দত্তর পো, আজ কী পড়ানো হচ্ছে?" 
     
    উৎপলের বাংলাতে আগ্ৰ‌হ‌ এবং দখল‌ও আছে। তাই জানতো কী পড়ানো হচ্ছে, তা‌ই পত্রপাঠ বলে, "অলঙ্কার প্রসঙ্গে সমাসোক্তি নিয়ে স‍্যার।"
     
    বামনদেব বাবু বলেন, "আচ্ছা বলোতো আজ ক্লাসের শুরুতে ইংরেজী‌ গ্ৰামারে এর সাথে কার মিল আছে বলেছিলাম?" 
     
    উৎপল বলে, "Personification বা Metaphor এর সাথে স‍্যার।" 
     
    বামন‌দেব বাবু প্রফুল্ল হয়ে বলেন, "একদম ঠিক, আচ্ছা তুমি তো ব‌ই‌টা খুলেই রেখেছো, সমাসোক্তি‌র একটা উদাহরণ দিতে পারো?" উৎপল চালু ছেলে, এসব আগেই দেখে রেখেছে, ওর মনেও থাকে ভালো, তাই স‍্যারের ব‌ইয়ের‍‌ই একটা উদাহরণ ব‌ই না দেখেই পত্রপাঠ দিয়ে দিলো - "যতীন্দ্র‌নাথ সেনগুপ্ত‌র লোহার ব‍্যাথা, থেকে বলছি স‍্যার।"

    “রাত্রি গভীর হলাে, 
    ঝিল্লীমুখর স্তব্ধ পল্লী, তােলাে গাে যন্ত্র তােলো। 
    ঠকা ঠাঁই ঠাঁই কাঁদিছে নেহাই, আগুন ঢুলিছে ঘুমে, 
    শ্রান্ত সাঁড়াশি ক্লান্ত ওষ্ঠে আলগােছে ছেনি চুমে, 
    দেখ গাে হােথায় হাপর হাঁপায়, হাতুড়ি মাগিছে ছুটি ….।” 
     
    বামনদেব বাবু বলেন "থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে, খুব সুন্দর। আচ্ছা বলতো এটা সমাসোক্তি‌র উদাহরণ কেন?" 
     
    উৎপল বলে, "কারণ স‍্যার এখানে উপমানের কোনো সরাসরি উল্লেখ ছাড়াই কেবলমাত্র উপমেয়র দ্বারাই উপমান সম্পর্কে বলা হচ্ছে।" 

    ব‍্যাকরণ রসে রসসিক্ত শিক্ষক ছাত্রের এহেন উত্তরে খুশি হয়ে বলেন, "উপমান ও উপমেয়‌ বলতে কী বুঝি আমরা?" 
     
    কবিতা লেখা‌য় হাত পাকাতে গিয়ে উৎপল এসব ইতোমধ্যে গুলে খেয়েছে, তাই বলে, "যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তা উপমান আর যার মাধ‍্যমে বলা হচ্ছে তা উপমেয়।" 

    বামনদেব‌বাবু মজা পেয়ে গেছেন, এই না হলে ছাত্র, "তাহলে একটা সরল উপমা দিতে পারো যাতে উপমান ও উপমেয় দুটোর‌ই উল্লেখ আছে?" 
     
    উৎপল বলে, "যেমন স‍্যার, চাঁদের মতো সুন্দর মুখ। এখানে মুখ উপমান মানে যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, আর চাঁদ উপমেয় মানে যার সাথে তুলনা টেনে উপমাটি দেওয়া হচ্ছে।"
     
    বামনদেব‌বাবু চমৎকৃত হয়ে বলেন, "তুমি এসব ব‌ই দেখে বলছো নাকি?" 
     
    উৎপল বলে, "না স‍্যার, ব‍‌ই‌টা আপনি যা পড়াচ্ছেন সেখানে‌ই খুলে রেখেছি বটে তবে এগুলো আগেই পড়া ছিল।"

    কিন্তু বেচারা জানতো না বামনদেববাবুর ঈগলের মতো তীক্ষ্ম দৃষ্টি‌কে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ নয়। তাঁর লেখা ব‌ইয়ের কোথায় কী আছে তা তাঁর নখদর্পণে। উৎপলের এই কথাতেই ওনার চোখে পড়ে ও যেভাবে মাঝ বরাবর ব‌ই‌টা খুলে আছে সেখানে অলংকার অধ‍্যায়টা থাকার কথা‌ই নয়। ওটা‌তো আছে ব‌ইয়ের শেষের দিকে। তাহলে কোথায় খুলে আছে ও ব‌ই‌টা?  আর কেন‌ই বা? ব‌ই‌তো বাড়িতে গিয়ে দেখা‌র জন‍্য। ক্লাসে যখন তিনি পড়াচ্ছেন তখন তো মন দিয়ে শোনা বা বোর্ডের দিকে নজর দেওয়ার কথা। উনি বলেন, "ব‌ইয়ের ঠিক ঐখানে আঙুল দিয়ে ব‌ই‌টা নিয়ে এদিকে এসো তো।" 
     
    এবার উৎপলকেও পাষাণী অহল‍্যার  ভূমিকা‌য় দেখা যায়। কিছু করার নেই। যেতেই হবে। উৎপল ভাবে স‍্যারের কাছে যাওয়ার আগে সর্প‌মুক্ত হয়ে যাওয়া‌ই ভালো। ওঠা‌র সময় ব‌ইয়ের মাঝখান থেকে আঙুলটা একটু কায়দা করে সরায়। বেঞ্চের ধারে‌ই বসে ছিল ও। কিন্তু দুর্ভাগ্য উৎপলের। ব‌ই‌টা দুটো বেঞ্চের মাঝে‌ পড়লো না, যেমনটা ও চেয়েছিল। বরং ঠকাস করে ব‌ই থেকে প‍্যাসেজে‌র মেঝেতে এসে পড়লো কালনাগিনী। 



    তাই দেখে স‍্যার এগিয়ে এলেন। ব‌ই‌টা তুললেন। ঝকাস প্রচ্ছদ এবার সটান বামনদেব‌বাবুর মুখাভিমুখে। একটা বিমান গুলি খেয়ে সাদা ধোঁয়া ছেড়ে লাট খেয়ে নীলাকাশ থেকে ভূতলমুখী। আর হলুদ স্লিভলেসের ওপর জরিপাড় টকটকে লাল  বেনারসী পরা কালনাগিনী নগ্নপদে নৃত‍্যমূদ্রায় নামছেন প‍্যারাস‍্যূটে ঝুলে। মুখায়ববে এবং মুখভাবে দস‍্যুনেত্রী‌র কোনো ছাপ‌ই নেই বরং যেন অরুন্ধতী‌দেবীর আভিজাত্যের ছোঁয়া। তার নৃত‍্যময় শারীরভাষ‍্য দেখে হেমা মালিনী‌ও হীনমন্যতায় ভুগবে। প্রবল হাওয়ায় কালনাগিনী‌র উন্মুক্ত কেশদাম উড়ছে নাগিনী‌মূদ্রায় কিন্তু শাড়ি যে কে সেই।

    যেহেতু ক্লাসে বসে ব‌ইয়ের ফাঁকে কালনাগিনী গুঁজেও উৎপল ওনার সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে‌ছে তাই উনি সেদিন ওকে কিছু‌ই বললেন না। তবে পরবর্তী দেড় বছরে, যতদিন না ওরা উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে স্কুল ছেড়ে চলে গেছিল,  ক্লাসে তিনি উৎপলকে সম্বোধন করতেন, "এই যে কালনাগিনী, এটা বলতে পারো?" বলে। হয়তো সুরসিক শিক্ষকের ছাদের সেই লক্ষীমন্ত বৌটির মতো সুন্দরী কালনাগিনী‌কেও ভালো‌ লেখেছিল। আর মনযোগী ছাত্র উৎপলকেও।

    পুনশ্চঃ- বাস্তবে অমিতাভ ও উৎপল পর্ব ঠিক এভাবে ঘটে নি। বহুদিন আগে শোনা ঘটনার কেবল মূল দুটি উপাদান সত‍্য - প‍্যাঁ‌চা ও কালনাগিনী। তবে রচনাটি‌কে রসমালাই বানাতে পাশের ছাদে লক্ষীমন্ত টুকটুকে বৌ আমদানি - আমার মস্তিষ্ক‌প্রসূত।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩
  • ব্লগ | ২৮ মে ২০২৪ | ২৩৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন