অধূনা আমাদিগের জীবনধারণের নিমিত্তে সংসারের ব‍্যয়নির্বাহ মোর মণ্ডুকের আধুলি সদৃশ অবসরকালীন সঞ্চয়ের কুসীদনির্ভর। জীবিকার পশ্চাতাকর্ষণ এখন আর নাই। তাই সেদিন বিলম্বিত প্রাতে নভদিশায় পশ্চাদ্দেশ করিয়া শয‍্যায় অস্টাবক্র মুনীর ন‍্যায় পড়িয়া থাকিয়া আমি অষ্টম ঘটিকা কাল অবধি ছলনাময়ী নিদ্রাদেবীর আরাধনার অক্ষম প্রচেষ্টায় রত ছিলাম। 

     সেই কালে পাচনকক্ষ হ‌ই‌তে শয‍্যাকক্ষের দ্বার অবধি মোর দারকণ্ঠ হ‌ইতে তীক্ষ্মস্বরে কিছু ভাষ‍্য ভাসিয়া আসিল। আমা উদ্দেশে উচ্চারিত কিঞ্চিৎ অহৃষ্ট আঙ্গিকে এবং তন্দ্রা দূরীভূত করিবার পক্ষে উপযুক্ত গ্ৰামে নির্দেশ‌সূচক সম্মোধন বাক‍্যটি ছিল এই প্রকার: 
 
-  "ওহে মোর প্রাকবৃদ্ধস‍্য ভর্তা, আপনাকে অনুগ্ৰহ করিয়া শীঘ্র শয‍্যা হ‌ইতে গাত্রোত্থান‌ করিয়া প্রাতরাশে মমরন্ধিত শ্বেত ঘুঁটে ভক্ষণ করিতে অনুরোধ করিতেছি। উক্ত খাদ‍্যবস্ত উষ্ণ অবস্থায় গলাদ্ধঃকরণ‌ই বিধেয়। অন‍্যথায় শীতলাবস্থা প্রাপ্ত হ‌ইলে তাহা ভক্ষণ কিঞ্চিৎ অস্বাদু বোধ হ‌ইতে পারে। তজ্জনিত কারণে আমায় কোনরূপ কটাক্ষবাণ নিক্ষেপ করিলে আমি‌ও যে নির্দ্বিধায় উপযুক্ত মাত্রায় প্রত‍্যুত্তর করিব, তাহা এইক্ষণে‌ই জ্ঞাত করিয়া রাখিলাম"।

    যখন সময় ছিল তখন করিনি। বলা ভালো পারি‌নি। এখন জীবন সায়াহ্নে এসে আমায় মাতৃভাষা (অপ)চর্চার শখে ধরেছে। ঋদ্ধ জনগণের মতে আঙ্গিক একটু শক্ত লাগলেও বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু লেখা অন্ততঃ না পড়লে বাংলা নিয়ে লেখ‍্যচর্চার আদিখ্যেতা অবাঞ্ছনীয়। আমার এখনো বঙ্কিমচন্দ্র পড়া হয়নি। বাকি জীবনে‌ও হবে কিনা সন্দেহ। বস্তুত সাধুভাষায় লেখা আমায় টানে না। একটি মাত্র পংক্তি (উপরোক্ত) সাধুভাষায় লেখার চেষ্টা করে বুঝলাম সঠিক ভাষাজ্ঞান ও অভ‍্যাস না থাকলে এ প্রয়াস অতি কষ্টকর প্রক্রিয়া। এটাই চলিত ভাষায় লেখা অনেক সহজ ছিল, যেমন:

    সময়ের আড়াই বছর আগে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে আর আমার হপ্তায় পাঁচদিন সকালে উঠে কাজকর্ম সেরে জামাকাপড় পরে নাকে মুখে গুঁজে চারচাকা চালিয়ে পাঁইপাঁই করে অফিসে ছোটার প্রয়োজন নেই। এখন আমাদের সংসারখরচ চলে আমার সঞ্চিত ব‍্যাঙের আধুলী‌র সুদে। চাকরির পিছুটান নেই। তাই সেদিন সকাল আটটা অবধি বিছানায় পেছন উল্টে কুঁকড়ে মুচড়ে মটকা মেরে শুয়ে ভাঙা ঘুম জোড়া লাগানো‌র বৃথা চেষ্টা করছি‌লাম। এমন সময় রান্নাঘর থেকে বৌমণি‌র তীক্ষ্ণস্বরে ঘুমতাড়ানো হাঁক শোনা গেল, "এ্যাই বুড়ো, ওঠনা। সাদা ঘুঁটে বানিয়েছি। আয় তাড়াতাড়ি, খেয়ে নে। এ ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভাল্লাগবেনা। তখন যদি প‍্যান‌প‍্যান করেছিস তো দেখাবো তোর মজা, এ্যাই বলে দিলাম"।

    ছেলের আহ্লাদিত গলা শোনা গেল, "মামি, সাদা ঘুঁটে করেছো? কি মজা! তুমি এটা যা বানাও না!" ইডলি খেতে খুব ভালোবাসে ছেলে। বৌমণি একবার টিভিতে কাউকে ইডলিকে বলতে শুনেছিল "সাদাঘুঁটে"। সেটা বৌমণির মুখে শুনে আমার ও পুত্রের বেশ মজা লেগেছিল। তখন থেকে আমরা সপরিবারে ইডলিকে সাদাঘুঁটে বলি।
 
    সেদিন সেটা খেতে খাসা হয়েছিল। তো আজ তাই নিয়ে‌ই ভোটুৎসবের মরশুমে ভাটিয়ে ফেললাম কিছু হাবিজাবি। এই বাঁজা লেখা পড়ে বেফালতু লাগতেই পারে। কেননা নেতানেত্রীদের নির্বাচনী ভাষণের মতোই এতো কোনো কনটেন্ট, কন্টেক্‌স্ট কিচ্ছু নেই। তবে লেখার ওপরে দেওয়া সেদিন বৌমণি‌র পরিপাটি করে প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন করা সাদাঘুঁটের ছবিটা দেখে হয়তো লেখাটি পড়ার বিরক্তি কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। যেমন বোতাম টিপে আশায় বাঁচে চাষা।